কুরআন মজীদ যে সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে, উহার তাৎপর্য সম্বন্ধে বিজ্ঞ ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে । ইমাম আবূ আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইব্ন আবূ বকর ইব্ন ফারাহ আনসারী কুরতুবী মালেকী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থের ভূমিকায় বলিয়াছেনঃ ‘সাতটি হরফ -এর তাৎপর্য কি? এ সম্বন্ধে আলিমদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। আলিমগণ উহার পঁয়ত্রিশটি তাৎপর্য বয়ান করিয়াছেন। এইস্থলে আমি উহার মধ্য হইতে মাত্র পাঁচটি তাৎপর্য বর্ণনা করিতেছি । আবূ হাতিম মুহাম্মদ ইব্ন হাব্বান উহার সবগুলি বর্ণনা করিয়াছেন।’ অতঃপর ইমাম কুরতুবী উহার পাঁচটি তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন। নিম্নে আমি (ইব্ন কাছীর) সংক্ষেপে উহা বর্ণনা করিতেছিঃ
প্রথম তাৎপর্যঃ অধিকাংশ বিজ্ঞ ব্যক্তি এই প্রথম তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন। সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনাহ, আবদুল্লাহ্ ইব্ন ওহাব, আবূ জাফর মুহাম্মদ ইব্ন জারীর এবং ইমাম তাহাবী তাঁহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। উহা এই যে, কুরআন মজীদের একই স্থানে বিভিন্নরূপে পৃথক পৃথক শব্দে পরস্পর ঘনিষ্ট সাতটি অর্থ নিহিত থাকে। পরস্পর ঘনিষ্ট একাধিক অর্থের একাধিক পৃথক পৃথক শব্দের দৃষ্টান্ত হইতেছেঃ هلم – تعال - اقبل ইহাদের প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ প্রায় এক । অর্থাৎ ‘আসো’ (আদেশসূচক)। ইমাম তাহাবী বলেন- হযরত আবূ বুকরাহ (রাঃ) নামক জনৈক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসে উপরোক্ত তাৎপর্য স্পষ্টতরভাবে বিবৃত হইয়াছেঃ
সাহাবী আবূ বুকরাহ (রাঃ) বলেন- একদা হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আসিয়া বলিলেন, আপনি একটি মাত্র হরফে পড়ুন। ইহাতে হযরত মীকাঈল (আঃ) বলিলেন, আপনি অধিকতর সংখ্যক হরফের জন্য অনুমতি চান। তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন, আপনি দুইটি হরফে পড়ুন। ইহাতে হযরত মীকাঈল (আঃ) বলিলেন-আপনি অধিকতর সংখ্যক হরফের জন্যে অনুমতি প্রার্থনা করুন। এইরূপ হযরত জিবরাঈল (আঃ) সাতটি হরফ পর্যন্ত পৌঁছিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন- পড়ুন। উহাদের প্রত্যেকটিই যথেষ্ট ও আরোগ্যদাতা । তবে রহমতের আয়াতকে আযাবের আয়াতের সঙ্গে এবং আযাবের আয়াতকে রহমতের আয়াতের সঙ্গে মিলাইয়া তালগোল পাকাইবেন না। যেমনঃ هلم – تعال - اقبل অর্থ আসো । আবার ذهب – اسرع - عجل অর্থ সত্বর যাও ।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মুজাহিদ, আবূ নাজীহ ও ওয়ারকা (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘হযরত উবাই ইবন কা’ব (রা) يَوْمْ يَقُوْلَ الْمُنَافِقُوْنَ و الْمُنَافقَاتللَّذيْنَ امَنُوًا أَنْظْروَنًا نَفُتَبِس من نوركم এই আয়াতের انظرونا শব্দের স্থলে اخرونا – امهلونا এবং اد قيونا পড়িতেন। (প্রত্যেকটির অর্থ ‘আমাদের জন্য অপেক্ষা করুন’।) তিনি অনুরূপভাবে كلما أضاء لَهُمْ مَشَؤًا فيه এই আয়াতের مشوا শব্দের স্থলে مروا এবং سعوا পড়িতেন।(১)
ইমাম তাহাবী প্রমুখ বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ বলেন- ‘অনেক লোক কুরায়শের ভাষায় তথা নবী করীম (সাঃ)-এর ভাষায় কুরআন মজীদ শুধু পড়িতে সমর্থ ছিল। কারণ তাহারা ছিল নিরক্ষর। তাহারা উহা লিখিয়া রাখিতে পারিত না। ফলে তাহাদের পক্ষে উহা ধরিয়া রাখা কষ্টকর ছিল। তাই সাতটি ভাষা-রীতিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে অনুমতি প্রদান করা হইয়াছিল। ইমাম তাহাবী, কাযী বাকিল্লানী এবং শায়েখ আবূ উমর ইব্ন আব্দুল বার বলেন- প্রথম দিকে সাতটি ভাষা-রীতিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে অনুমতি প্রদান করা হইয়াছিল। কিন্তু, পরবর্তীকালে অসুবিধা দূর হইয়া যাইবার পর উক্ত অনুমতি রহিত হইয়া গিয়াছে। লিখন-পঠনের মাধ্যমে কুরআন মজীদের সংরক্ষণ কার্য সহজ হইয়া যাইবার ফলেই উপরোল্লেখিত অসুবিধা অপসারিত হইয়া গিয়াছে।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি- কেহ কেহ বলেন, হযরত উসমান (রাঃ)-ই সাতটি ভাষা রীতির ছয়টিকে পরিত্যাগ করত মাত্র একটি ভাষা রীতিতে কুরআন মজীদ সংকলন করেন । তিনি যখন দেখিলেন, কুরআন মজীদের শব্দের উচ্চারণ রীতিতে লোকদের মধ্যে দারুণ মতভেদ দেখা দিয়াছে, তখন তাঁহার মনে এই আশংকা জন্মিল যে, ভবিষ্যতে এই মতভেদ চরম মতভেদে এবং পরিশেষে পরস্পরকে কাফির আখ্যাদানে পরিণত হইতে পারে । তাই তিনি অন্য সকল উচ্চারণ রীতি পরিত্যাগ করতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) কর্তৃক নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট সর্বশেষ রমযানে পেশকৃত উচ্চারণ রীতিতে কুরআন মজীদ সংকলন করিলেন । সংঘর্ষ এড়াইবার উদ্দেশ্যে তিনি লোকদিগকে আদেশ দিলেন- তাহারা যেন অন্যান্য অনুমোদিত উচ্চারণ রীতিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত না করে। অবশ্য দুর্বৃত্তগণ তথাপি উহা ছাড়ে নাই । তাহারা উহাকে কেন্দ্র করিয়া মুসলিম উম্মাহকে বহুধা বিভক্ত করিয়া ছাড়িয়াছে। অনুরূপভাবে হযরত উমর (রাঃ) এক সঙ্গে উচ্চারিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করিতে লোকদিগকে আদেশ দিয়াছিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল, এক সঙ্গে উচ্চারিত তিন তালাকে তিন তালাক সংঘটিত হওয়ার ফলে দাম্পত্য তথা পারিবারিক জীবনে যে শোচনীয় অশান্তি ও অব্যবস্থা নামিয়া আসে, তাঁহার আদেশে উহা তিরোহিত হইয়া যাইবে । কিন্তু, ফল হইয়াছিল বিপরীত তাঁহার আদেশের পর সমাজে তালাকের সংখ্যা বাড়িয়া গেল। হযরত উমর (রাঃ) বলিলেন- পূর্ব প্রচলিত ব্যবস্থাই যদি লোকদের মধ্যে প্রচলিত রাখিতাম! অতঃপর তিনি তাহাই করিলেন । অনুরূপভাবে তিনি হজ্জের মাসগুলিতে তামাত্তু (تمتع)(১) করিতে লোকদিগকে নিষেধ করিতেন । তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল, এইরূপ নির্দেশের ফলে হজ্জের মাসগুলির বাহিরেও আল্লাহ্র ঘরের যিয়ারত চালু থাকিবে। হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) অবশ্য হজ্জের মাসগুলিতেও তামাত্তু জায়েয মনে করিতেন। তবে আমীরুল মুমিনীনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত তিনি স্বীয় ফতোয়া প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছিলেন।
দ্বিতীয় তাৎপর্যঃ একদল আহলে ইলম বলেন- কুরআন মজীদ সাত হরফে নাযিল হইবার তাৎপর্য ইহা নহে যে, কুরআন মজীদের প্রতিটি শব্দ সাত রকম উচ্চারিত হইতে পারে; বরং উহার তাৎপর্য এই যে, কুরআন মজীদের একটি শব্দ এক উচ্চারণ রীতিতে এবং অন্যটি অন্য উচ্চারণ রীতিতে উচ্চারিত হইবে। এইরূপে উহাতে আরবী ভাষাভাষীদের বিভিন্নরূপ উচ্চারণ রীতির মধ্য হইতে সর্বমোট সাতটি উচ্চারণ রীতি বিদ্যমান রহিয়াছে। ইমাম খাত্তাবী বলেন- “কুরআন মজীদের কোন কোন শব্দ অবশ্য সাত প্রকারের উচ্চারণ রীতিতেই উচ্চারিত
হইয়া থাকে। যেমনঃ وعبد الطاغوت -এর অন্তর্গত عبد শব্দটি। এইরুপে يرتع ويلعب -এর অন্তর্গত يرتع শব্দটি। ইমাম কুরতুবী বলেন- আবূ উবায়দ সংশ্লিষ্ট হাদীসের উপরোক্ত তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন। ইবন আতিয়া উহাকে সঠিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। ইমাম আবূ উবায়দ মন্তব্য করিয়াছেন- আরবের বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন উচ্চারণের মধ্য হইতে যে সকল উচ্চারণ রীতি কুরআন মজীদে গৃহীত হইয়াছে, উহাদের একটি আবার অন্যটি অপেক্ষা অধিক পরিমাণে গৃহীত হইয়াছে। এই কারণে বলা যায়, কুরআন মজীদে গৃহীত সকল উচ্চারণ রীতিই সমান সৌভাগ্যের অধিকারী নহে। একটি অপরটি হইতে অধিকতর সৌভাগ্যের অধিকারী I কাযী বাকিলানী বলেন- ‘কুরআন মজীদ কুরায়শের ভাষায় নাযিল হইয়াছে’ হযরত উসমান (রাঃ)-এর এই কথার তাৎপর্য এই যে, উহার অধিকাংশই কুরায়শের ভাষায় নাযিল হইয়াছে । অর্থাৎ কুরআন মজীদে কুরায়শের ভাষা ও উচ্চারণ রীতির প্রাধান্য রহিয়াছে। সমগ্র কুরআন মজীদ কুরায়শের ভাষা ও উচ্চারণ রীতিতে নাযিল হইয়াছে, এইরূপ কথার কোন প্রমাণ নাই । আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- قرانا عربيا অর্থাৎ আমি উহাকে আরবী গ্রন্থরূপে নাযিল করিয়াছি । এক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন নাই قرانا قريشيا আমি উহাকে কুরায়েশী গ্রন্থরূপে নাযিল করিয়াছি। বলাবাহুল্য عرب বলিতে আরবী ভাষাভাষী সকল গোত্রকে অথবা আরবী ভাষাভাষী গোত্রসমূহের সমগ্র এলাকাকেই বুঝায়। শায়েখ আবূ উমর ইব্ন আবদুল বারও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন- উহার কারণ, কুরায়েশ গোত্রের ভাষা ভিন্ন অন্য গোত্রের ভাষাও কুরআন মজীদের বিশুদ্ধ কিরাআতে বর্ণনা রহিয়াছে । যেমনঃ হামযা همزه বর্ণসহ শব্দ উচ্চারণ করা। উল্লেখ্য যে, কুরায়শ গোত্র হামযা বর্ণসহ শব্দ উচ্চারণ করে না ৷ ইমাম ইবন আতিয়্যা বলিয়াছেন- ‘হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ‘আমি السموات والارضفاطر এই আয়াতাংশের অর্থ জানিতাম না ৷ একদা জনৈক বেদুঈনকে বলিতে শুনিলাম انا فطرتها (আমিই উহাকে সর্বপ্রথম খনন করিয়াছি)। সে উহা একটি কূপ সম্পর্কে বলিতেছিল।’হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বেদুঈন লোকটির নিকট হইতে শিখিলেন, يقفطر – قطرا فاطر অর্থ কোন বস্তুকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত করা । ইমাম ইবন আতিয়্যা ইহা দ্বারা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন যে, কুরআন মজীদে ব্যবহৃত فاطر (নব উদ্ভাবক) শব্দটি কুরায়শের ভাষা ভিন্ন অন্য গোত্রের ভাষা। কারণ কুরায়শ গোত্রে জন্মগ্রহণকারী হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট উহার অর্থ অবিদিত ছিল।
তৃতীয় তাৎপর্যঃ কেহ কেহ বলেন- সংশ্লিষ্ট হাদীসের তাৎপর্য এই যে, আরবী ভাষাভাষী বিপুল সংখ্যক গোত্রের ভাষারীতির মধ্য হইতে মাত্র সাতটি গোত্রের ভাষারীতি কুরআন মজীদে গৃহীত হইয়াছে; আর মুযার مضر গোত্রের ভাষারীতির মধ্যে এই সাতটি ভাষারীতির সমাবেশ ঘটিয়াছে। অতএব, কুরআন মজীদের সাতটি ভাষারীতি মুযার গোত্রের ভাষারীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ । মুযার গোত্রের বিভিন্ন শাখার ভাষারীতির বাহিরের কোন ভাষারীতি ইহাতে গৃহীত হয় নাই ৷
আলোচ্য হাদীসের উপরোক্ত তাৎপর্যের ভিত্তিতে ‘কুরআন মজীদ কুরায়শের ভাষায় নাযিল হইয়াছে’- হযরত উসমান (রাঃ)-এর এই কথার তাৎপর্য এই হইবে যে, কুরআন মজীদে সন্নিবেশিত সাতটি গোত্রীয় ভাষারীতি কুরায়শের ভাষারীতির বিরোধী নহে। উহা একদিকে বিক্ষিপ্তভাবে সাতটি গোত্রীয় ভাষারীতির সমষ্টি এবং অপরদিকে কুরায়শ গোত্রের নিজস্ব সামগ্রিক ভাষারীতিও বটে । কুরায়েশ গোত্রটি কাহার বংশধর? কুরায়শ গোত্র হইতেছে নাযর ইব্ন হারিছের বংশধরগণ । বংশ পরিচয় বিশারদগণের মধ্যে কুরায়শের পরিচয় সম্বন্ধে মতভেদ রহিয়াছে । তবে উহার উপরোক্ত পরিচয়ই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য। সুনানে ইব্ন মাজাহ প্রভৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসে ঐরূপই বর্ণিত রহিয়াছে।
চতুর্থ তাৎপর্যঃ ইমাম বাকিল্লানী বলেন- কেহ কেহ বলিয়াছেন, আলোচ্য হাদীসের তাৎপর্য এই যে, কুরআন মজীদের বিভিন্নরূপে উচ্চারণের শব্দ সম্ভারের সাতটি অবস্থা রহিয়াছে । ইহাদের সবগুলিই শরীআত কর্তৃক অনুমোদিত অবস্থা । প্রথম অবস্থা এই যে, উহার উচ্চারণের রূপ একাধিক হইলেও উহাতে শব্দের মূল হরকতে, শব্দের সামগ্রিক বাহ্য আকৃতিতে অথবা উহার অর্থে কোনরূপ পরিবর্তন বা বিভিন্নতা আসে না । যেমনঃ صدرى يضيق -এর অন্তর্গত يضيق শব্দটির অবস্থা।(১)
দ্বিতীয় অবস্থা এই যে, উহার উচ্চারণের রূপ একাধিক হইলেও উহাতে শব্দের বাহ্য আকৃতিতে কোনরূপ পরিবর্তন বা বিভিন্নতা আসে না। তবে উচ্চারণের বিভিন্নতার দরুণ উহাতে অর্থের বিভিন্নতা দেখা দেয়। যেমনঃ فقألوا رَبنًا باعد بين أَسْفَارنًا বাক্যাংশের অন্তর্গত ياعد শব্দটির অবস্থা।(২)
তৃতীয় অবস্থা এই যে, শব্দের উচ্চারণে বিভিন্নতা আসিবার দরুণ উহার বাহ্য আকৃতি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই বিভিন্নতা দেখা দেয়। তবে এইরূপ বিভিন্নতা শব্দের অন্তর্গত কোন বর্ণের বিভিন্নতার কারণে দেখা দেয়। যেমনঃ كيف ننشزها বাক্যাংশের অন্তর্গত ننشز শব্দটির অবস্থা।(৩)
চতুর্থ অবস্থা এই যে, একই স্থানে একাধিক শব্দ পঠিত হয়। কেহবা একটি বিশেষ শব্দ, আবার কেহবা অন্য একটি শব্দ পাঠ করেন। উহাতে শব্দ বিভিন্ন হইলেও অর্থে বিভিন্নতা দেখা দেয় না। যেমনঃ كالعهن المنفوش বাক্যাংশের অন্তর্গত العهن শব্দের অবস্থা।(৪)
পঞ্চম অবস্থা এই যে, একই স্থানে কেহ বা একটি বিশেষ শব্দ, আবার কেহবা অন্য একটি শব্দ পাঠ করেন। আর শব্দের এইরূপ বিভিন্নতার কারণে অর্থেও বিভিন্নতা দেখা দেয়। যেমনঃ وطلّح متضود এর অন্তর্গত طلح শব্দটির অবস্থা।(৫)
যষ্ঠ অবস্থা এই যে, বাক্যের অন্তর্গত শব্দের স্থান পরিবর্তনের কারণে উহার বাহ্য আকৃতি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেয় ৷ যেমনঃ
وجاءت سكُرة الموت بألحَق আয়াতাংশের অবস্থা।(১)
সপ্তম অবস্থা এই যে, বাক্যে কোন শব্দ বৃদ্ধি করিবার ফলে উহার বাহ্য আকৃতি ও অর্থ উভয়ে অথবা শুধু বাহ্য আকৃতিতে পার্থক্য দেখা দেয়। যেমনঃ له تسع وتسعون نَعْجَة এর স্থলে له تسع وتسعون نعجة انثى পাঠ করিবার অবস্থা(২) অথবা وأما الْغلام فَكَانَأبواه مؤمنين এর স্থলে واما الغلام فكان كافرا وكان ابواه مؤمنين পাঠ করিবার অবস্থা। কিংবা ومن يكرههن فان الله من بعد اكراههن لَفَفُورَ رَحِيْم এর স্থলে ومن يكرههن فان اللّه من بعدا كراههن لهن غفور رحيم পাঠ করিবার অবস্থা।
পঞ্চম তাৎপর্যঃ কেহ কেহ বলেন- কুরআন মজীদ সাত হরফে নাযিল হইয়াছে, ইহার তাৎপর্য এই যে, কুরআন মজীদে বর্ণিত বিষয়াবলী সাত শ্রেণীতে বিভক্ত । উক্ত সাত শ্রেণীর বিষয়াবলী হইতেছেঃ (১) আদেশ (২) নিষেধ (৩) পুরস্কারের ওয়াদা (৪) শাস্তির ব্যাপারে সতর্কীকরণ (৫) কাহিনীসমূহ (৬) যুক্তি প্রদর্শন ও (৭) দৃষ্টান্তসমূহ ।
ইমাম ইব্ন আতিয়্যা মন্তব্য করিয়াছেন- আলোচ্য হাদীসের উক্ত তাৎপর্য বর্ণনা যুক্তিসঙ্গত নহে ৷ কারণ, এই সকল বিষয়ের কোনটি ‘হরফ’ নামে অভিহিত হয় না। এতদ্ব্যতীত, আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, কুরআন মজীদকে ‘সাতটি হরফে’ পড়িতে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। এমতাবস্থায় ‘হরফ’ শব্দটির তাৎপর্য উপরোক্তরূপ হইলে মানিয়া লইতে হয় যে, কুরআন মজীদে বর্ণিত হালালকে হারাম, হারামকে হালাল অথবা অর্থগত অন্যরূপ কোন পরিবর্তন করিবার অনুমতি শরীআতে রহিয়াছে। অথচ ইহা উম্মতে মুহাম্মদিয়ার সর্ববাদীসম্মত রায়ের পরিপন্থী।’ ইমাম বাকিল্লানী এতদসম্পর্কিত একটি হাদীস বর্ণনা করতে মন্তব্য করিয়াছেন- উপরোক্ত বিষয়সমূহ এইরূপ নহে যাহার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন সাধন করিয়া কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা শরীআতে বৈধ ৷ প্রকৃতপক্ষে ইহা আদৌ সম্ভবপর নহে ।
ইমাম কুরতুবী বলেনঃ মুদাবূনী, ইব্ন আবূ সাফারাহ প্রমুখ বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ বলিয়াছেন- প্রচলিত সাতটি কিরাআত মূলত হাদীসে অনুমোদিত সাতটি কিরাআত নহে। প্রচলিত সাতটি কিরাআত প্রকৃতপক্ষে হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কুরআন মজীদে গৃহীত কিরাআতের বিভিন্নরূপ। উহা একটি কিরআতেরই একাধিক সংস্করণ ভিন্ন কিছু নহে । উহাদের মধ্যে যে পার্থক্য রহিয়াছে, তাহা একবোরেই সামান্য । ইব্ নুহাস প্রমুখ ব্যক্তিও অনুরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন। প্রচলিত সাতটি কিরাআতের অনুসারী সাতজন কারীর প্রত্যেকেই অপর কারীদের কিরাআতকে অনুমোদন করিয়াছেন। তবে তাঁহাদের একেকজন যেহেতু নির্দিষ্ট একেকটি কিরাআতকে অধিকতর শুদ্ধ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন, তাই উহাদের একেকটি কিরাআত তাহাদের একেকজনের নামের সহিত সম্পর্কিত হইয়া রহিয়াছে । মুসলিম উম্মাহ সর্বসম্মতভাবে প্রচলিত সাতটি কিরাআতকেই সঠিক ও শুদ্ধ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন । উহাদের সঠিকতা ও শুদ্ধতার সমর্থনে বহু পুস্তক রচিত হইয়াছে। এইরূপে আল্লাহ্ তা’আলার ওয়াদা অনুযায়ী তাঁহার কালাম সংরক্ষিত হইয়া আসিতেছে।