* সাইকোসিস রোগী মনে করতে পারে, সে না দেখা মানুষদের কথা শুনতে পাচ্ছে। * তার চিন্তা অন্য কেউ ধরে ফেলছে, জেনে ফেলছে।

* সে স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।

* যা ঘটতে চলেছে, তা দেখতে পায় ।

এই ধরনের অবাস্তব চিন্তার মানুষদের বলে সাইকিক পেসেন্ট বা পাগল অথবা উন্মাদ। সাইকোথেরাপির সাহায্যে সুফল পাওয়া যায় না। এদের মনোরোগ চিকিৎসকদের হাতেই ছেড়ে দিতে হয়। ওষুধ ছাড়া রোগমুক্তির সম্ভাবনা প্রায় নেই। হাসপাতালে বা মনোরোগ চিকিৎসা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়ার আশা করা যায়।

 

সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)

বাংলা সাহিত্যের এক বিখ্যাত কবি। বয়স বছর চল্লিশ। অবিবাহিত। হঠাৎ ওঁর মনে হতে লাগল—পাশের পাড়ার এক বিবাহিত সুন্দরী কবিকে অনবরত অনেক প্রেমের কথা শোনাচ্ছে। শ’দুয়েক গজ দূরের বাড়িতে বসে মেয়েটি যা বলেন, সবই শুনতে পান কবি ।

ওঁর পত্রিকা অফিসের চারদিকের লোকেরা ওঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। প্রত্যেকটি ষড়যন্ত্রের কথাই কবি নাকি শুনতে পান। পুলিশ কমিশনারের কাছে এক সহকর্মী কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কী বলেছেন, তাও ওঁর অজানা থাকেনি।

কবিকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারিনি, এসবই তাঁর মানসিক রোগের ফল। চিকিৎসা করান। শেষ পর্যন্ত মানসিক ওয়ার্ডে ভর্তি করা হল। সাইকোলজিস্ট ও সাইক্রিয়াট্রিস্ট মত দিলেন কবি সিজোফ্রেনিয়ার শিকার।

আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে, চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক। সিজোফ্রেনিয়া রোগে এই ইন্দ্রিয়গুলোর এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় ভুল-ভালো কাজ করে। ফলে রোগী ভুল শোনে, ভুল দেখে, ভুল গন্ধ পায়, ভুল স্বাদ পায়, ভুল স্পর্শ অনুভব করে।

সিজোফ্রেনিয়া শুরুতে চিকিৎসা করালে সুস্থ করে তোলা যায়। এই চিকিৎসায় ওষুধ ও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন।

ভ্রান্তধারণা, মিথ্যাসন্দেহ (Delusion)

সন্দেহবাতিক। সব কিছুতেই সন্দেহ। স্ত্রীর চরিত্রে সন্দেহ, স্বামীর চরিত্রে সন্দেহ, সহকর্মীরা ষড়যন্ত্র করছে বলে সন্দেহ, আত্মীয়-বন্ধুদের সন্দেহ—তারা নাকি ক্ষতি করতে চাইছে।

সময়মতো চিকিৎসা না করলে যত দিন যাবে, ততই সন্দেহ আরো দৃঢ় হবে।

আবার অন্যরকম ভ্রান্ত ধারণাও সৃষ্টি হতে পারে। Delusion রোগী ভাবতে লাগল তার সঙ্গে প্রিয়াংকা চোপড়ার প্রেম আছে। আবার কোনো মহিলা ভাবতে শুরু করলেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বামী। আবার কেউ ভাবতে লাগলেন তাঁর মৃত গুরুদেব তাঁর সঙ্গে মাঝে-মধ্যেই শারীরিক সম্পর্ক গড়েন।

আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর অন্ধ-বিশ্বাস তার শ্বশুরমশাই পূর্বজন্মে তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিলেন। বন্ধুর সংসার বলতে নিজে, স্ত্রী, একটি ছোট্ট মেয়ে ও বাবা। বন্ধু অফিসে বেরোলেই ওর স্ত্রী ভয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিত। বাড়িতে সব সময়ই কাজের জন্য একটি মেয়ে ছিল, মেয়েটি কখনো দু-চার দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলে বন্ধু-পত্নী মেয়েকে নিয়ে চলে যেত বাপের বাড়ি। বন্ধু-পত্নীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওর বদ্ধমূল ধারণা পূর্বজন্মে ওর শ্বশুর ছিলেন আকবর, আর ও ছিল আনারকলি।

রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, বামাক্ষ্যাপা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন মা কালী বা মা তারা তাঁদের সঙ্গে সব সময় কথা বলছেন, ঘুরছেন, ফিরছেন, দৈনন্দিন কাজকর্মে সাহায্য করছেন। দীর্ঘকাল ধরে লালিত বিশ্বাসই একসময় বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস বা delusion-এ পরিণত হয়েছে।

আমার এক মধ্যবয়স্ক সহকর্মী ছিলেন, যিনি delusion-এর রোগী। নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় ধরে নিচ্ছি তাঁর নাম যদুবাবু। যদুবাবুর দৃঢ় ধারণা সহকর্মীরা তাঁর প্রতি সহানুভূতিহীন, হীনচরিত্র ও দুষ্ট প্রকৃতির। সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে যদুবাবু ধরে নেন ওরা তাঁর সম্বন্ধেই কথা বলছে। কোনো দুই সহকর্মী নিজেদের দিকে তাকালে যদুবাবু ধরে নেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করেই ওরা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। ও কেন আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সিগারেটের প্যাকেট বের করল? আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কেন আমজাদ খাঁর গল্প করল এরা? আমি কি ভিলেন? অফিসের বিবেক ঘোষ কেন আমাকে হেমামালিনীর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দিল? আমি কি লম্পট? আমি সেকশনে ঢুকতেই ওরা সকলে হেসে উঠল। আমি কি ওদের হাসির রসদ? এই রকম নানা ধরনের আত্মপ্রাসঙ্গিক ভ্রান্তি নিজের সঙ্গে জুড়ে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে রোগী। নির্যাতনমূলক এই delusion রোগী কিন্তু নিজের প্রতিটি ধারণা ও ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত বলে মনে করে।

পাভলভের মতে Delusion-এর উৎপত্তির মূলে রয়েছে প্রথমত মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিকারগত অনড়ত্ব আর দ্বিতীয় কারণ হল, অতি স্ববিরোধী মানসিক অবস্থা। এই দুটি ব্যাপারই একসঙ্গে বা পরপর ঘটতে পারে। সেই অনুসারে delusion রোগীর উপসর্গের ও কিছু হেরফের হয়।

 

বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি (Paranoia)

‘Paranoia’ কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি’। বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করার চেষ্টা না করে একে আমরা বরং বাংলায় ‘প্যারানইয়া’ই বলি।

‘প্যারানইয়া’ রোগী delusion রোগীর মতোই অন্ধ ভ্রান্ত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয় বটে কিন্তু প্যারানইয়া রোগী তার এই বিশ্বাসের পেছনে এমন সুন্দর যুক্তি হাজির করতে থাকেন যে, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও অনেক সময় বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে—উনি মানসিক রোগী অথবা বক্তব্যের যুক্তিগুলো সত্যি?

ধরুন, মধুবাবু একদিন আপনাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। শুধু এই কথাটাই বললেন না, তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে যেসব ঘটনা ও যুক্তি হাজির করলেন, তাতে আপনি প্রাথমিকভাবে হয়তো বিশ্বাসই করতে বাধ্য হবেন, মধুবাবুর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত। মধুবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে আপনি আপনার পরিচিত প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগালেন, নিজেও লেগে পড়লেন বন্ধুকে নষ্টা স্ত্রীর হাত থেকে বাঁচাতে। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন বন্ধুর প্রতিটি সন্দেহ ভিত্তিহীন।

নিজের ভুল বিশ্বাসকে যুক্তিসহ হাজির করার প্রচেষ্টাই প্যারানইয়া রোগীর বৈশিষ্ট্য। নিজের ওই বিশেষ ভ্রান্ত বদ্ধমূল বিশ্বাসের বাইরে প্যারানইয়া রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হয়।

এবার এক সুন্দরী রমণীর কথা বলছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় এখানে তাঁর নাম দিলাম রাধা। রাধা শুধু সুন্দরীই নন, যথেষ্ট গুণীও। স্বামী, ধরা যাক নাম তাঁর সত্য, সমাজে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। রাধার বদ্ধমূল ধারণা সত্যর চরিত্র ভালো নয়। সুযোগ পেলেই আত্মীয়া- অনাত্মীয়া, কুমারী, সধবা, বিধবা, যে কোনো বয়েসের মেয়ের সঙ্গেই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যান। এই বিষয়ে রাধা যেসব যুক্তি হাজির করেন, যেসব ঘটনার অবতারণা করেন, সেসব শোনার পর রাধার বান্ধবীদের অনেকেরই ধারণা সত্য একটি ‘প্লে-বয়’।

বেচারা সত্যকে রাধার তৈরি যুক্তি-তর্কের কালি মেখেই থাকতে হচ্ছে।

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ম্যাকডুগালের মতে–প্যারানইয়া রোগীর গোপন মনে হীনমন্যতাবোধ বা পাপবোধ লুকিয়ে থাকার দরুন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এক ধরনের শান্তি পায়। নিজের অন্যায় কাজকে ‘জাস্টিফাই’ করতে স্বামী বা স্ত্রীকে লম্পট প্রতিপন্ন করে প্রশান্তি পায়।

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!