একটি সংস্কৃতিগোষ্ঠীর জীবনকে অসুস্থ পরিণতির দিকে নিয়ে

যাওয়া এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, যে বিপ্লব,

তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব। একটি সংস্কৃতিগোষ্ঠীর

জীবনকে সুস্থ ভাবে বিকশিত

করে তোলার সংগ্রামই

সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

আমাদের সমাজ জীবনে, আমাদের সংস্কৃতিতে শোষণ চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই দুর্নীতির উপস্থিতি অপরিহার্য। শোষণ ও দুর্নীতির স্থিতাবস্থা বজায় রাখার স্বার্থেই শোষিত মানুষদের চেতনায় অন্ধ-বিশ্বাস, কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ ইত্যাদির উপস্থিতি অপরিহার্য। আর তাই শোষক শ্রেণির একান্তভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে-বঞ্চিত মানুষদের চেতনা এগুতে না দেওয়া। চেতনা এগুলে শোষণের কারণগুলো আর লুকোনো থাকবে না। ফলে গরিব মানুষগুলোকে আর বশে রাখা যাবে না— লাঠি, বন্দুকের ভয় দেখিয়েও। ক্ষমতা হারাতে হবেই। তাই জন-চেতনা মুক্তির প্রতিটি প্রয়াসকে প্রতিহত করতেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীদের কাজ-কর্মকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বাঁধতে চেয়েছে। কৌশল হিসেবে ‘সংস্কৃতি’র ভুল সংজ্ঞাকেই প্রচারের জোয়ারে প্রত্যেকের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে। ফলে আমরা ভাবতে শুরু করেছি ‘সংস্কৃতি’ মানে সংগীত-নৃত্য-সাহিত্য-গৌতম ঘোষ-শ্যাম বেনেগাল- শম্ভু মিত্র-সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার-রবিশংকর-আমজাদ আলি- ভীমসেন যোশী-হুসেন-বিকাশ ভট্টাচার্য ইত্যাদিরা। যে বাড়ির ড্রইংরুমে শোভা পায় বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি, নিদেন টেরাকোটা, যে বাড়ির মানুষ মার্জিত হাসে, মার্জিত কথা কয়, আমরা তাদেরই বলি ‘সংস্কৃতিবান।’

এমন ভাবনার গণ্ডিতে যাঁরা আবদ্ধ, তাঁরা যে ‘সংস্কৃতিবান’ বলতে রিকশাচালক আবু ভাইকে ভাবতেই পারবে না, বরং ওকে সংস্কৃতিহীনের দলেই ফেলবে-এটাই স্বাভাবিক। ওরা ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বলতে চারুকলার জয়যাত্রাকেই শুধু চিহ্নিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে গোলপাকানো চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেলে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বলে মনে হবে কী করে? চেতনা মুক্তির আন্দোলনকে ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বলে মনে হবে কী করে? মনে হয়ও না। এই ভ্রান্ত, খণ্ডিত চিন্তার প্রভাবে অনেক তা-বড় রাজনৈতিক নেতাও ভেবে বসেন প্রতিটি বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রতিটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অর্থ ‘রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম’, ‘রাজনৈতিক সংগ্রাম’। প্রতিটি বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনচেতনাকে বিদ্রোহী করে তোলায় যে প্রক্রিয়া; এটাই যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, জন-চেতনাকে রাজনীতি বিষয়ে সচেতন করে তোলা, সমাজ সচেতন করে তোলাই যে সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদেরই কাজ এই সত্যটুকু অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাণ্ডজ্ঞানের বাইরে বলেই অনেক তর্ক-বিতর্ক, অনেক বাক-বিতণ্ডা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে শোষণমুক্তির সংগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা মুখ্য, না রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা প্রধান ? ‘সংস্কৃতি’র সংজ্ঞা ও ‘রাজনীতি’র সংজ্ঞা বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকলে এই পুরো বিতর্কই অসার হয়ে যায়। কারণ,

স্পষ্টতই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন ও প্রগতির সঙ্গে

সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও প্রগতি মিলেমিশে

একাকার হয়ে রয়েছে, যাকে গুছিয়ে বলতে

গেলে বলতে হয় এরা পরস্পর

পরস্পরের পরিপূরক,

সহযোগী।

কিন্তু ‘সংস্কৃতি’ বিষয়ে ভ্রান্ত ও খণ্ডিত চিন্তা দিনের পর দিন যে-ভাবে আমাদের মস্তিষ্ক, স্নায়ুকোষকে প্রভাবিত করেছে, তাতে,শোষণ মুক্তির কাজে নিবেদিতপ্রাণ মানুষও ভুল চিন্তার ফাঁদে পা ফেলে শোষকদেরই সুবিধে করে দেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনে আন্দোলনকারীরা যাতে সচেতন না হন, তার জন্য মগজ ধোলাই চালিয়ে চলেছে রাষ্ট্রশক্তি ও হুজুরের দল। এটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি, অনেক সৎ রাজনীতিকরাও এই মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের পরিপূরক ও সহযোগী আন্দোলন—সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দেওয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনও চরম সার্থকতার দিকে এগুতে বার বার ব্যর্থ হয়ে গেছে, চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পরও ক্ষমতাচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে—এমন উদাহরণ তো আজ পৃথিবী জুড়ে। সমাজকে চিনতে হলে দৃষ্টিকে শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় আবদ্ধ না রেখে মেলে দিতে হয় সমাজেরই দিকে, সমাজকে আন্দোলিত করা প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহের দিকে, খুঁজে বের করতে হয় সমাজের সঙ্গে এই ঘটনাগুলোর সম্পর্ককে। শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ আমার রান্নার জ্ঞান নিয়ে রাঁধতে গিয়ে আমি যে বস্তুটি তৈরি করেছিলাম, সেটিকে ‘অখাদ্য’ বলে নিজেই মুখে তুলতে পারিনি। ‘রান্না করতে করতেই রান্না শিখতে হয়, যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ’–এর কোনও বিকল্প নেই। আর তাই তো যে বয়সের শিশু লজেন্স চুষতে চুষতে পথ চলে বাবা-মা’র সতর্ক প্রহরায়—পথ যাতে না হারায়, সেই বয়েসের শিশুই আবার ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের কাছে লজেন্স বিক্রি করে, মা-বাবার সংসারকে পথ চলতে সাহায্য করে। জীবন যুদ্ধই তাকে এমনটা তৈরি করে।

কিন্তু আমরা বহু শ্রদ্ধেয়র কাছ থেকেই ‘সংস্কৃতি’ বিষয়ে এমন সংজ্ঞা শুনতে পাই, যা আমাদের বোধকে বিভ্রান্ত করে। আমাদের বোধই যেখানে ভ্রান্ত, সেখানে বোধ থেকে উদ্ভূত আন্দোলনও যে ভুলের গোলকধাঁধায় ঘুরে মরবে— এ তো অনিবার্য।

এক বিশিষ্ট বাম বুদ্ধিজীবী ও বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর লেখা একটি বই হাতে এল। যেখানে ‘সংস্কৃতি’ বিষয়ে লেখকের মতামত বারবার ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে।

তাঁর কথায়, “সংস্কৃতি কি সর্বজনীন হতে পারে? সংস্কৃতিকে বহুজনীন করার প্রচেষ্টায় সংস্কৃতির অবনতি ঘটে না কি? ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন’–সংস্কৃতিকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কল্পনা কি নেহাত হৃদয়াবেগের শিথিল উচ্ছ্বাস নয়? হাটুরে হট্টগোল কি সংস্কৃতি সহায়ক?”

এক বিশিষ্ট বিদ্বজ্জনের চোখে অপসংস্কৃতি কী? তাঁর কথায়, “এই সর্বজনীন কালচারের নাম দেওয়া হয়েছে অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটা ক্ষুদ্র ক্ষেত্রেই এই অপসংস্কৃতি বিচরণভূমি—চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্র।”

তাহলে ‘সংস্কৃতি’ ব্যাপারটা কী? তাঁরই কথায়, “সংস্কৃতি জীবনযাপনের শিক্ষা, বহু বিচিত্র দক্ষতা ও কর্মনিপুণতার চর্চা, উৎপাদন নির্মাণ, উদ্ভাবন সৃজনের বাস্তব ইহলৌকিক প্রতিভা।”

মাননীয় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জ্বলন্ত দিনগুলোর কথা তো আপনার অজানা নয়, তবে এমন জঙ্গি আপনি হঠাৎ সুর পাল্টালেন কেন? সুর পাল্টেছেন বলেই কি ভারতের বৃহত্তম পত্রিকাগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় আপনার বইটি পরম যত্নে বহু বিজ্ঞাপিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে? না কি প্রকাশকের চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন? দুঃখ হয় সেইসব তরতাজা সম্ভাবনাময় তরুণদের কথা ভেবে, একদিন যাঁরা আপনার হুকুমে জীবনের সুন্দরতম সময়গুলো বিসর্জন দিয়েছেন। আপনার এমন সুবিধাবাদী চিন্তা ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ ও ‘শোষণ মুক্তির আন্দোলন’কে পথে বসাবার পক্ষে কি যথেষ্ট নয় ? আজ আপনার পুরোনো সঙ্গীরা আপনাকে ছেড়েছেন, কিন্তু মগজ ধোলাইয়ের কারিগর হিসেবে আপনাকে ধরেও নিয়েছেন বিশাল পত্রিকাগোষ্ঠী ৷

সর্বত্র যে জেনেশুনে গুলিয়ে দেওয়ার এমন প্রয়াস চলে— তা কিন্তু নয়। অনেক সময়ই লাগাতার প্রচারের শিকার হয়ে নিজের ভ্রান্ত চিন্তাই অন্যের মধ্যে প্রচারে উদ্যোগী হন বহু উদ্যোগী মানুষই। এমনই একটি দৃষ্টান্ত চোখে পড়েছিল অতি-সম্প্রতি। উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরে ‘সংস্কৃতি’ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের ভূমিকা’ শিরোনামের এক আলোচনা সভায় একটি বাম রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক শাখার বিশিষ্ট নেতা যে বক্তব্য রাখলেন, তাতে স্পষ্টতই বোঝা গেল ওই মার্কসবাদী দলটি অনেক দিনই ‘স্টাডি ক্লাস’-এর পাঠ চুকিয়েছেন। চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সামান্য রূপরেখাটাও তাঁর অজানা থেকে গেছে, অজানা থেকে গেছে সমাজ বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, এবং রাজনীতির প্রথম পাঠটুকুও।

১৯৬৬ সালের ৮ আগস্ট চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ বিষয়ে ১৬ দফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। তাতে মানুষের চেতনার উত্তরণের জন্য দেশ জুড়ে যুক্তিবাদীদের ব্যাপক প্রসার চাওয়া হয়েছিল, চাওয়া হয়েছিল দেশ জুড়ে যুক্তিবাদী চিন্তার প্রয়োগ।

ঘোষণায় দ্বিধাহীন ভাষায় বলা হয়েছিল : সর্বহারাদের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একমাত্র পথ হচ্ছে-জনগণ নিজেরাই নিজেদের মুক্ত করবেন। এ মুক্তি চেতনার মুক্তি। এ মুক্তি আসবে যুক্তির পথ ধরে, ব্যাপক বিচার-বিতর্কের পথ ধরে।

এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সিদ্ধান্তগুলোতে অতি মাত্রায় জোর দেওয়া হয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক যুক্তিবাদী মানসিকতা প্রচারের উপরে। বলা হয়েছিল দেশ জুড়ে যুক্তিবাদী মানুষ গড়তে বিচার-বিতর্ক চালাও। মনে রেখো, এই বিচার-বিতর্ক কখনোই কলহ নয়। স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল, জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মত থাকাই স্বাভাবিক এবং বিভিন্ন মতামতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রয়োজনীয়, উপকারী ও অনিবার্য। পরিপূর্ণ বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টিতে জনগণের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। ফলে যুক্তির নিরিখে জনগণই যেটা সঠিক তাকে প্রতিষ্ঠা করবে, যেটা বেঠিক তাকে শোধরাবে এবং এ-ভাবেই ক্রমে তারা একমতে পৌঁছবে। আর সেই মতটা অবশ্যই হয়ে দাঁড়াবে যুক্তিনিষ্ঠ। যুক্তিবাদীর পথ ধরে যখন জনচেতনা এগুবে তখন সেই জনচেতনা অবশ্যই সঠিক পথ দেখাবে।

যুক্তিবাদী মানসিকতাই জনগণকে পরিচালিত করবে গণতন্ত্র

প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, আমলাতন্ত্র ঘোচানোর সংগ্রামে, বঞ্চনা ও

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে,

নীতিবোধ ও ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।

এ-গুলো কোনওটাই পৃথক পৃথক

ব্যাপার নয়, পরস্পর

সম্পর্কিত।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের সম্ভাবনা কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায় না। এই সম্ভাবনা দেখা দেয় মানুষের ব্যক্তিগত লোভের পথ ধরে। কিছু মানুষ জনসাধারণকে বঞ্চিত করার কুমতলবে নানা ভাবে মগজ ধোলাই করতে শুরু করে। এই লোভী মানুষগুলোকে বিশেষ সুবিধাভোগী মানুষে, শোষকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিতে পারে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কী হবে? সে বিষয়ে বলা হয়েছে—জনগণের কাছে তথ্য হাজির কর, যুক্তি হাজির কর। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যেহেতু যুক্তির দিকে আকর্ষিত হওয়া, তাই সঠিক যুক্তি, সুযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলে জনগণ সেই সুযুক্তিকে গ্রহণ করবেই। এতদিনকার যুক্তিহীনতার কারণ অবশ্যই এই—সুযুক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেনি।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যে পদ্ধতি নিষিদ্ধ ছিল তা হল— বল প্রয়োগ করে কাউকে নতিস্বীকারে বাধ্য কোরো না। বলপ্রয়োগে চেতনার মুক্তি ঘটে না। বলপ্রয়োগ যুক্তিবাদের বিকল্প নয়, ভুল যুক্তির মানুষদেরও তাদের মতামতের সপক্ষে যুক্তি হাজির করার অধিকার দেওয়া উচিত। চিন্তা করার সাহস, প্রশ্ন করার সাহস এবং কাজ করার সাহস নিয়ে যে তেজ, সেই তেজের বিকাশ ঘটানোই বিপ্লবীর কর্তব্য, যুক্তিবাদভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্তব্য। কোনও কিছুকে মেনে নেওয়ার আগে প্রয়োজনে প্রশ্ন করে নিজের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার করে নাও। অন্ধ আনুগত্যের মধ্য দিয়ে প্রশ্নহীন আনুগত্যের মধ্য দিয়ে নেতাদের বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিও না। প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো, প্রতিটি বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো, প্রতিটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো, ধনতান্ত্রিক চিন্তার অনুসরণকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো। এগিয়ে যাবে, সুস্থ সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে যাবে ।

এই যে আন্দোলন, সমাজ ও সংস্কৃতির আন্দোলন,

জনগণ কর্তৃক জনগণকে মুক্ত করার আন্দোলন,

এরই নাম ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল – বিতর্কের ঝড় তুলতে প্রচারকে তুঙ্গে তোলো, বড় হরফের প্রাচীরপত্রে হাজির করতে থাকো বিতর্ক, যুক্তিবাদের পক্ষে প্রচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান । এইসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানুষের মধ্যে যুক্তির প্রতি আগ্রহের সঞ্চার হবে, ফলে বহু কুসংস্কার, ভূতপ্রেত ইত্যাদি চিন্তার আবরণ খুলে পড়বে, খসে পড়বে কুংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে জিইয়ে রেখে বঞ্চনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়াসগুলো।

অতি স্পষ্টতই চিনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য

ছিল জনগণকে প্রাচীন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অলৌকিকত্বে

বিশ্বাস এবং অবতার পূজার মতো বঞ্চনার হাতিয়ার,

প্রগতির পরিপন্থী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে

চেতনার উন্মেষ ঘটানো।

চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে কিছু ভুল-ভ্রান্তি বা অতি আবেগজনিত উল্টোপাল্টা কিছু কাজকর্ম হয়তো হয়েছিল। Joan Robinson তাঁর গ্রন্থ The Cultural Revolution in China-তে লিখেছেন : প্রতিটি অন্যায়ের, দুর্নীতির ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের আহ্বান ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এ রাখা হয়েছিল তার মধ্যে এক সময় নৈরাজ্যবাদী ঝোঁকও দেখা গিয়েছিল। ফলে বহুর মধ্যেই এমন হঠকারী চিন্তা মাথা চাড়া দিয়েছিল বিদ্রোহ করো।”

“সব কিছুর বিরুদ্ধেই চিনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও সে তুঙ-কে নিয়ে ব্যক্তিপূজা অতি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল, এমন কথা শোনা যায়। মাও-কে নিয়ে এমন কিংবদন্তি তৈরি হয়েছিল যাতে মাওকে অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে দেখানো হয়েছিল। চিনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই ব্যক্তি পূজা প্রসঙ্গ নিয়ে মাও বলেছিলেন, ব্যক্তিপূজার বাড়াবাড়ি অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। এটা বর্জনীয়। তবে ব্যক্তিপূজার কিছুটা প্রয়োজন আছে।

এডগার স্নো (Edger Snow) -র গ্রন্থ ‘The Long Revolution’ (Publisher Hutchinson, London) -এ দেখতে পাই মাও স্নো’কে এ -কথাই বলেছিলেন ।

‘বৌদ্ধ-দর্শন’, ‘মাকর্স-বাদ’ ‘লেনিন-বাদ’, ‘গান্ধী-বাদ’, এই সমস্ত

মতবাদের কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তো কিছু ব্যক্তি-পূজা

এসেই পড়ে। এ-ক্ষেত্রে দর্শনের স্রষ্টার প্রতি এই ব্যক্তি-

শ্রদ্ধা তো একটা আদর্শের প্রতীকের প্রতিই

শ্রদ্ধা হয়ে ওঠে, একটা শিক্ষার

প্রতিই শ্রদ্ধা হয়ে ওঠে।

ব্যক্তি-শ্রদ্ধা, ব্যক্তি-পূজা যেখানে ভক্তকে যুক্তিহীন করে তোলে, অন্ধ-স্তাবক করে তোলে, সেখানে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই নিন্দনীয়। কিন্তু শ্রদ্ধেয়র প্রতি শ্রদ্ধার, অতি-শ্রদ্ধেয়র প্রতি অতি-শ্রদ্ধা তো আদপেই নিন্দনীয় নয়।

শ্রদ্ধা ও অন্ধ-শ্রদ্ধার উদাহরণ টানতে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির তৃতীয় খণ্ডে প্রসঙ্গক্রমে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রতিরোধ’ গ্রন্থটি নিয়ে লিখেছিলাম—

কার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ? অন্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বইটির টাইটেল পেজ’-এ ছাপা আছে— “অন্ধতা ও যুক্তির বিরুদ্ধে রামমোহন থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু”। সম্পাদকীয়তে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, “অন্ধকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বঙ্গমনীষীর ইতিহাসে একের পর এক মানুষের আবির্ভাব; তাঁদের যে-অভিযান তা যেমনই দুঃসাহসিক তেমনই প্রখর প্রতিভার পরিচয়। রামমোহন রায় থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর রচনাবলির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখুন। বুকের বল ফেরত পাবেন। এই সব দীপ্ত মেধাবীরা কিন্তু প্লেটোর ওই অসুর দলে পড়েন। ধর্মান্ধতার ঊর্ণজাল ছিন্নভিন্ন করে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর মশাল জ্বেলে, যুক্তিনিষ্ঠ নির্মল চিন্তার হাতিয়ার হাতে বিজ্ঞানের সমর্থনে এঁরা এগিয়ে এসেছিলেন।”

ধর্মান্ধতার ঊর্ণজাল কে ছিন্ন করেছিলেন? রামমোহন রায়? সত্যেন্দ্রনাথ বসু? রামমোহন রায় তো স্বয়ং এক ধর্মমতের স্রষ্টা। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করে নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মন্দির ও দেবমূর্তি ভাঙে কালের করাল গ্রাসে। অথবা নিশ্চিহ্ন হয় কেউ নিশ্চিহ্ন করে দিলে। নিরাকার ঈশ্বরকে ওভাবে মুছে ফেলা যায় না। এমনই এক ঈশ্বর-চিন্তা জনমানসে প্রোথিত করতে চেয়েছিলেন রামমোহন, যেখানে ঈশ্বর থাকবেন অনেক নিরাপদে।

রামমোহন রায়ের রচনাটির আগে যে সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচয় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দিয়েছেন তাতে রামমোহন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “বিশ্বের সর্বত্র স্বাধীনতাকামী ও সাধারণতন্ত্রী আন্দোলনের প্রতি তাঁর ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন।”

বাস্তব সত্য যে অন্য কথা বলে। বামবুদ্ধিজীবী হিসেবে, আই. এস. আই. ছাপ মারা সুপণ্ডিত দেবীপ্রসাদবাবু কী অস্বীকার করতে পারবেন যে নিচের তথ্যগুলো ভুল বা মিথ্যে?

রামমোহন ইংরেজ শাসকদের প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে দেশীয় উচ্চবর্ণদের উদ্দেশে যে উপদেশ বার বার বারিধারার মতোই বর্ষণ করেছেন এবং তাঁর কাজকর্মে যে চিন্তাধারা অতি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা হল এই—

(১) ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অভিভাবকত্ব মেনে নাও।

(২) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবাসীদের কাছে ঈশ্বরের করুণার মতোই এসে পড়েছে।

(৩) ইংরেজদের সাম্রাজ্যরক্ষায় সব রকমে সাহায্য করো ।

(৪) ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তাদের ঘৃণা করো। ওই বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে ইংরেজদের সর্বাত্মক সাহায্যে এগিয়ে এসো।

(৫) সভা-সমিতি গড়ে সেগুলোর মাধ্যমে ইংরেজদের জয়গান করো ৷ ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করো।

(৬) সংবাদপত্রের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের সুফল বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করো।

(৭) ইংরেজদের কাঁচামাল রপ্তানি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে তৈরি জিনিস আমদানির ব্রিটিশ নীতিকে সমর্থন করো ।

রামমোহনীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেবীপ্রসাদ ‘ইংরেজ’ শব্দের পরিবর্তে ‘শাসক’ শব্দটি রামমোহনের নীতিবাক্যগুলোতে বসিয়ে নিয়ে গ্রহণ করেছেন বলেই কী অন্ধতা ও অযুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষের মস্তক চর্বণের জন্যেই তাঁর এই মিথ্যাচারিতা?

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে পরম ঈশ্বরভক্ত এবং অলৌকিক ক্ষমতায় অগাধ বিশ্বাসী ছিলেন, তা আচার্যদেবের সামান্য হালফিল জানা মানুষদের যেখানে অজানা নয়, সেখানে দেবীপ্রসাদবাবুর মতো এমন সুপণ্ডিতের তো অজানা থাকার কথা নয়। সম্পাদক হিসেবে দেবীবাবু কি তবে না জেনেশুনেই শুধুমাত্র সুন্দর কিন্তু শব্দবিন্যাসের তাগিদেই সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে অন্ধকার ও অযুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী বঙ্গমনীষা বলে অবহিত করলেন? সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে যদি অন্ধকার ও অযুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী চরিত্র বলে দেবীপ্রসাদবাবুর মনে হয়ে থাকে, তবে দেবীবাবু নিশ্চয়ই অন্ধকার ও অযুক্তির ধারক-বাহক হিসেবে অবহিত করবেন সেইসব মানুষদের, যাঁরা অন্ধভাবে ঈশ্বর ও অলৌকিকতাকে মেনে নিতে নারাজ; যাঁরা অন্ধবিশ্বাস ও অযুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

দেবীপ্রসাদের মতো ট্রয়ের ঘোড়া’ শুধুমাত্র অন্তর্ঘাত চালিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে না, এরা অশ্বমেধের দিগ্‌বিজয়ী ঘোড়ার ভূমিকাও পালন করে একের পর এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দুর্গে ধস নামিয়ে। এইসব অশ্বমেধের ঘোড়াদের অগ্রগতি রোধ করতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মীদেরই, যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদেরই।

‘৯২-এর গোড়ার ঘটনা। কলকাতার বিড়লার শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালায় একটি বিজ্ঞান বিষয়ক মাসিক পত্রিকার বার্ষিক আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন আমাদের সমিতির কিছু সভ্য ও সভ্যা। সেখানে বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক নেত্রী আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে আমাদের সদস্যদের কাছে অভিযোগ তুললেন আমার বিরদ্ধে – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুপণ্ডিতের ওপর প্রবীরবাবু যে জঘন্য নোংরা ভাষায় আক্রমণ চালিয়েছেন তাঁর ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থে তা একান্তভাবেই নিন্দনীয় ।

প্রবীরবাবুর প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধা ছিল। তা একেবারে ভেঙে গেল । প্রবীরবাবু এটা কী করলেন?

আমাদের সমিতির এক সদস্য বলেছিলেন, প্রবীরবাবুর সমালোচনার কোন্ অংশটা আপনার কাছে যুক্তিহীন মনে হয়েছে যদি একটু বলেন তো, বুঝতে সুবিধে হয়। দেখুন আমরা যুক্তিবাদী। আমরা কখনোই মনে করি না, আমরা যা ভাবছি, সেটাই অভ্রান্ত। বরং আমরা মনে করি— আমরা যা ভাবছি, সেটা প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। কোনও বিপরীত যুক্তি যদি আমার ভাবনার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়, নিশ্চয়ই গ্রহণ করব। দেবীপ্রসাদবাবুর বিরুদ্ধে প্রবীরবাবুর দেওয়া যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে আমার। আপনি যুক্তি দিয়ে যদি বুঝিয়ে দেন প্রবীরবাবুর চিন্তার ত্রুটি কোথায়। নিশ্চয় সেই যুক্তি গ্রহণ করব ।

উত্তরে মহিলা বলেছিলেন, মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা কি যুক্তির নিরিখে মাপা যায়? না কি মা-বাবার প্রতি কারও অশ্রদ্ধা আপনি মুখ বুজে মেনে নেন?

সদস্যাটি বলেছিলেন, আপনার এই যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। এই ধরনের অন্ধ ব্যক্তিপূজা সব সময়ই বর্জনীয় বলে মনে করি। নতুবা এই অন্ধ-ব্যক্তিপূজাই অনেক সংগ্রামী মানুষকে আপসকামীতে পরিণত করবে। আমরা মনে করি, যাঁরা মন্দ, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, যারা চোর, লম্পট, সমাজবিরোধী, তারাও কারো না কারো মা, বাবা, ভাই, বোন। কিন্তু সমাজবিরোধীর সর্ব-শক্তি দিয়েই তার বিরোধিতা করব, তাকে কখনোই অন্ধ-শ্রদ্ধা বিলোব না।

ব্যক্তিপূজার গ্রহণযোগ্যতা ও বর্জনীয়তা বোঝাবার পক্ষে এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট বিবেচনায় এখানেই দাঁড়ি টানলাম।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব কী? এই বিষয়টা বোঝানোর জন্য চিনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনে আনা একান্তই জরুরি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব পৃথিবীকে সবচেয়ে আলোড়িত করেছিল । চিনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে কেন নৈরাজ্যবাদী ঝোঁক দেখা দিয়েছিল, কেন সংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছিল, এটা আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। তবে এও জানি, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল-যুদ্ধে নেমে, যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধবিদ্যা শেখার মতো একটা ব্যাপার। এটা হয় বহু জনযুদ্ধের ক্ষেত্রেই। যেখানে জনগণকে আগে যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত করে তুলে তারপর জন-শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানো সম্ভব হয় না। তাতে প্রথম দিকে জনযোদ্ধাদের পক্ষে অবশ্যই যথেষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি ঘটে, অনেক ভুল ভ্রান্তি হয়, কিন্তু বহু মানুষ এ-ভাবেই যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ করা শিখে ফেলে। আবিষ্কার করে ফেলে প্রথাগত যুদ্ধবিদ্যার বারে নানা কৌশল। এমন যুদ্ধ কৌশলের সামনে প্রথাগত যুদ্ধবিদ্যাকেও যে পিছু হটতে হয়, এর উদাহরণ পৃথিবীর বহু দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে। চিনের মুক্তি সংগ্রামও এ-ভাবেই শুরু হয়েছিল, এবং সম্পূর্ণ জয়ের মধ্য দিয়েই তার সমাপ্তি ঘটেছিল।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন করতে অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টায় যথেষ্ট প্ৰাথমিক ক্ষয়-ক্ষতি চিনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। অনিবার্য বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, ক্ষয়-ক্ষতির কণ্টকময় পথ অতিক্রম করে বিজয়ের দিকে এগোতে পারেনি, অতএব সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জয় ও সুফল অধরাই থেকে গেছে।

প্রাক্তন রাশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন প্রাক্তন কমিউনিস্ট দেশগুলোর দিকে একবারের জন্য ঘুরে তাকান, তাকান চিনের দিকে, সর্বত্রই দেখতে পাবেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অভাবে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অভাবে সেইসব দেশে বিশেষ সুবিধাভোগী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে নেতাদের একনায়কতন্ত্র-স্বেচ্ছাচারিতা- স্বজন পোষণ, পোষণ, বিচ্যুতি-আখের গোছানোর প্রচেষ্টা-দুর্নীতি-প্রশ্নহীন আনুগত্য লাভের প্রয়াস। ফলে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, ও-সব দেশে বিপ্লবের পরিবর্তে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছিল শুধু। লাগাতার ভাবে সুসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য জনগণের চিন্তা, চেতনাকে যে খাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়া অতি প্রয়োজনীয় ছিল, তা হয়নি। যে মানসিক শিক্ষার ও প্রস্তুতির সাহায্যে কুসংস্কার, আমলাতন্ত্র, নেতৃত্বের চ্যুতি, দুর্নীতি ও বঞ্চনাকে সরানো যেত, সেই মানসিক শিক্ষা প্রচারের লাগাতার প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে অপসংস্কৃতির এক পরিমণ্ডল। এরই সুযোগ নিয়ে ও-সব দেশের সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা ভোগসর্বস্ব ক্ষিদে। মগজ ধোলাই করে ও-সব চিন্তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে শত্রু শিবিরের দেশগুলো। ফলে যা অবধারিত ছিল, তাই ঘটেছে। সর্বহারাদের স্বর্গরাজ্যের স্বপ্নগুলো একের পর এক হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে।

আমি অতি সচেতনভাবেই মনে করি, এ-দেশের বর্তমান সমাজের হুজুর-মজুর সম্পর্কযুক্ত ব্যবস্থাই আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই শোষক-শোষিতের সামাজিক কাঠমো টিকে রয়েছে মানুষের অন্ধ-বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে, তাকে পরিপুষ্ট করে। সমাজ-বিজ্ঞান ও বাস্তব- ঐতিহাসিক পরিস্থিতি নিয়ে সুগভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এই সত্যটি অবশ্যই বেরিয়ে আসে—অন্ধ বিশ্বাসজাত কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির পরিমণ্ডল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে আমাদের আর্থিক কাঠামো এবং শোষিত- শোষিতের শ্রেণিবিশ্বাসের সঙ্গে এবং এরা পরস্পরের পরিপূরকও বটে। অর্থাৎ এ-দেশের আর্থিক কাঠামোকে নিম্নস্থ কাঠামো বা ভিত্তি-কাঠামো (infra – structure) আর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে উপরি কাঠামো (superstructure) বলে ভাবলে ভুলই ভাবা হবে। অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে উঠে আসা ভ্রান্ত-চেতনাপ্রসূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো এ-দেশে অবশ্যই ভিত্তি-কাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে, অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

অনেক রাজনীতিকদেরই বক্তব্য : হুজুর-মজুর সম্পর্কের টিকে থাকার ওপর যে-হেতু অন্ধ-বিশ্বাস, কুসংস্কার, মগজ ধোলাই করে ঢোকানো গোলপাকানো চিন্তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল, অতএব শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলে এইসব অন্ধ সংস্কারের কুয়াশা কেটে যেতে বাধ্য।

তাঁদের এই ধরনের চিন্তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে সাম্প্রতিককালের বহু সমাজতান্ত্রিক বলে ঘোষিত দেশের সরকারের মুখ থুবড়ে পড়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। কেন এমন হল?

রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ওপরই যদি জনগণের চেতনার

উন্মেষ নির্ভরশীল হত, তবে সমাজতান্ত্রিক দেশের

ক্ষেত্রে কেন তেমনটা ঘটল না? সে-ক্ষেত্রে

মানুষের চিন্তা কেন একমুখী হল না?

হল না, কারণ-পূর্ব ইউরোপের মার্কসবাদী দেশগুলোতে দীর্ঘ দিন ধরে মগজ ধোলাইয়ের প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে মার্ক্সবাদ বিরোধী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সে-সব দেশে ধৈর্যের সঙ্গে লাগাতার মার্কিন সংস্কৃতির গন্ধ পাঠানো হয়েছে। ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির গন্ধ পাঠানো হয়েছে, মানুষের চেতনায় নিরন্তর উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপনের খোরাক পাঠানো হয়েছে। সে উত্তেজনা একান্ত সুখের উত্তেজনা, বহুর থেকে বাড়তি সুখ ভোগের উত্তেজনা, নাচ, গান, যৌনতা, যুদ্ধ, ধর্মীয় নেশা ইত্যাদি নানাভাবে পাওয়া উত্তেজনা। এই সব উত্তেজনার, এইসব ভোগসর্বস্ব চিন্তার এমনই মাদকতা মানুষ তখন আত্ম-সুখের বাইরে কিছু ভাবতেই চাইবে না। ‘যেন তেন প্রকারেণ’ নিজের আখের গোছানোর এই চিন্তার মধ্য দিয়েই তারা পরিচালিত হবে। বৃহত্তর সমস্যার প্রতি, অন্যের সমস্যার প্রতি তাকিয়েও দেখবে না, দেখতে চাইবে না এইসব দেশে ।

মার্ক্সবাদীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে মার্কিন গোয়েন্দা

সি. আই. এ. বা বোমা, গোলা, বারুদ কিছুই প্রয়োগ

করল না। প্রয়োগ করল মগজ ধোলাইয়ের

ব্রহ্মাস্ত্র। আর তাইতেই হুড়মুড় করে

একের পর এক মার্ক্সবাদী

সাম্রাজ্য ধসে পড়ল।

অস্বীকার করার উপায় নেই সর্বত্র নাক গলানোর ব্যাপারে সি. আই. এ-র যেমন জুড়ি নেই, তেমনই চিন্তাকে একমুখী করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার ব্যাপারেও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সবার কাছ থেকেই আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। চিন্তার অন্ধত্বে আবদ্ধ না থেকে শেখার মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হলে অবশ্যই অনেক কিছুই শেখা যায়। সি. আই. এ-র ঘটানো ঘটনাগুলো থেকে আমরা অবশ্যই একটা শিক্ষা নিতে পারি, একটা সত্যে পৌঁছতে পারি—জনচিন্তাকে একমুখী করেও রাষ্ট্রক্ষমতায় ধস নামানো যায়। বিশ্ব-ত্রাস রাষ্ট্রশক্তির মধ্যেও ত্রাসের সঞ্চার করা যায়।

এই শিক্ষাকে আমরাই বা কেন কাজে লাগাতে পারব না। আমরাও যদি জন-চেতনাকে বঞ্চিত মানুষদের পক্ষে একমুখী করি তবে, আমাদের দেশের সরকারই বা গণেশ উল্টোবে না কেন? ভারতবর্ষের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী সামরিক শক্তির সাহায্য নিয়েও যখন গণ-বিদ্রোহের মুখে পূর্ব ইউরোপের মার্ক্সবাদী দেশগুলোকে পিছু হটতে হয়েছে, তখন ভারতের ক্ষেত্রেও একমুখী গণ-বিক্ষোভের মুখে সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করা যাবে না কেন ?

সাংস্কৃতিক চেতনাকে এক-মুখী করে অপসংস্কৃতির দ্বারা, অর্থাৎ

ভোগবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত করে জনগণকে যদি

রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে নামানোর

কাজটি সি. আই. এ-নিখুঁত ও সার্থক ভাবে

পালন করতে সমর্থ হয়, তবে আমরাই

বা কেন বঞ্চিত মানুষদের চেতনাকে

সুস্থ-সংস্কৃতির খাতে বইয়ে বঞ্চনার

প্রকৃত কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি

ফিরিয়ে জনগণকে রাজনৈতিক

সংগ্রামে নামাতে পারব না?

যাঁরা তোতা পাখির মতো আউড়ে যান—“সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামই আনতে পারে শ্রেণিমুক্তি”, তাঁরা অবশ্যই বিশ্বের তাবৎ ঘটনার থেকে নিজেদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখেন শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় ৷ জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে এঁরা শিক্ষা নিতে চান শুধুই ছাপার অক্ষর থেকে। পৃথিবীতে কোনও কিছুই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে থাকে না। ভাববাদও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে নেই, শোষণের প্রক্রিয়াগুলো। জিততে গেলে বঞ্চিত মানুষদের স্বার্থেই শোষণের আধুনিকতম কৌশলগুলোকে বুঝতে হবে, শোষকদের বিরুদ্ধে আধুনিকতম কৌশলগুলোরই প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্য যতই স্থির থাকুক, আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে মান্ধাতার আমলের অস্ত্র নিয়ে লড়াই চালানো যায় না। এখানে অস্ত্র বলতে বোঝাচ্ছি—‘মগজ-ধোলাই’ নামক শক্তিশালী অস্ত্রের কথা, যে অস্ত্রের কার্যকারিতা ও সাফল্য প্রশ্নাতীত বলেই আজ তাতে যে কোনও শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তিই প্রশ্নাতীত গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

যাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে একটা বিভেদের পাঁচিল তুলে দেন, তাঁরা চোখটি খুলে দেখতে চাননি সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে কাল্পনিক বিভেদের পাঁচিল বার বারই ভেঙে পড়েছে, দুই আন্দোলনকর্মীরাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে, যখনই বঞ্চিত মানুষদের চেতনা মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীরা ময়দানে নেমেছেন।

একটা বিপ্লবের আগে জনগণকে মানসিকভাবে ক্ষুধার্ত করে তুলে, মোটিভেট করে তুলে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে চালিত করা যায় এবং রাষ্ট্রশক্তির কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা যায়, এটা যেমন আজ বহুবার পরীক্ষার দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তেমনই এও সত্য—বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ে নেতৃত্বকে

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া

অধ্যায়ঃ দুই

♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা

অধ্যায়ঃ চার

♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই

অধ্যায়ঃ সাত

♦ ‘যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন, একটা বস্তুবাদী বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতিঃ কুয়াশা কাটে, কাটে নেশা, আকাশের ঘষা-সূর্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়

অধ্যায়ঃ আট

♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?

“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!