শ্লোকঃ ২৫

অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমরহসি ।। ২৫ ।।

অব্যক্তঃ- ইন্দ্রিয়াদির অগোচর; অয়ম- এই আত্মা; অচিন্ত্যঃ- চিন্তার অতীত; অব্যক্তঃ- ইন্দ্রিয়াদির অগোচর; অয়ম- এই আত্মা; উচ্যতে- বলা হয়; তস্মাৎ- অতএব; এবম- এভাবে; বিদিত্বা-ভালভাবে জেনে; এনম- এই আত্মাকে; ন- নয়; অনুশোচিতুম- শোক করা; অরহসি- উচিত।

গীতার গান

কাটা জ্বালা ভিজা শুকা জড়ের লক্ষণ।

জড়ের দ্বারা ব্যক্ত নহে অব্যক্ত কখন।।

মন দ্বারা চিন্ত্য হয় জড়ের লক্ষণ।

আত্মা জড় বস্তু নহে অচিন্ত্য কথন।।

জড়ের বিকার হয় আত্মা অবিকার।

জড় আত্মা বিভিন্নতা শুন বার বার।।

যথাযথ আত্মতত্ত্ব করহ বিচার।

বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার।।

অনুবাদঃ এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

তাৎপর্যঃ পূর্বে বলা হয়েছে, জড়-জাগতিক বিচারে আত্মার আয়তন এত সূক্ষ্ম যে, সবচেয়ে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাকে দেখা যায় না, তাই সে অদৃশ্য। আত্মার অস্তিত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করা যায় না, এর একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে শ্রুতি-প্রমাণ বা বৈদিক জ্ঞান। আত্মার অস্তিত্ব আমরা সব সময়েই অনুভব করতে পারি। আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারও মনেই কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তাই এই সত্যকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে, কারণ এ ছাড়া আর কোন উপায়েই আত্মার অস্তিত্বের এই নিগূঢ় তত্ত্বকে জানতে পারা যায় না। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করে আমাদের অনেক কিছুকেই স্বীকার করতে হয়। আমাদের পিতৃপরিচয় যেমন মায়ের কাছ থেকে জানা ছাড়া আর কোন উপায়েই জানতে পারা যায় না এবং মায়ের প্রদত্ত পিতৃপরিচয়কে যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারি না, আত্মা সম্বন্ধেও তেমন বৈদিক জ্ঞান বা শ্রুতি-প্রমাণ ছাড়া আর কোন উপায়েই জানা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, মানুষের সীমিত ইন্দ্রিয়লব্ধ জড় জ্ঞানের দ্বারা কখনোই আত্মার তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় না। বেদে বলা হয়েছে আত্মা হচ্ছে চেতন। আত্মার থেকেই সমস্ত চেতনের প্রকাশ হয়। এই সত্যকে আমরা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারি। তাই যারা বুদ্ধিমান, তাঁরা এই বৈদিক সত্যকে স্বীকার করেন। দেহের পরিবর্তন হলেও আত্মার কখনো কোন পরিবর্তন হয় না। চির-অপরিবর্তনীয় আত্মা চিরকালেই বিভুচৈতন্য পরমাত্মার পরমাণুসদৃশ অংশরূপেই বিদ্যমান থাকে। পরমাত্মা অসীম-অনন্ত এবং আত্মা পরমাণুসদৃশ। আত্মার কখনো কোন রকম পরিবর্তন হয় না, তাই সে চিরকালই পরমাণুসদৃশই থাকে। তার পক্ষে বিভুচৈতন্য-বিশিষ্ট পরমাত্মা বা ভগবান হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বেদে নানা রকমভাবে বারবার এই কথার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে আমরা আত্মার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারি। কোনও তত্ত্বকে নির্ভুলভাবে ও সম্যকরূপে বুঝতে হলে, সেই জন্য তার পুনরাবৃত্তি দরকার।

শ্লোকঃ ২৬

অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম।

তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমরহসি ।। ২৬ ।।

অথ- আর যদি; চ- ও; এনম- এই আত্মাকে; নিত্যজাতম- সর্বদা জন্মশীল; নিত্যম- নিত্য; বা- অথবা; মন্যসে- মনে কর; মৃতম- মৃত; তথাপি- তবুও; ত্বম- তুমি; মহাবাহো- হে মহাবীর; ন- না; এনম- এই আত্মার জন্য; শোচিতুম- শোক করা; অরহসি- উচিত নয়।

গীতার গান

বিচার করিবে যবে শোক নাহি রবে।

আত্মার নিত্যত্ব জানি নিত্যানন্দ পাবে।।

যদি তাই মান তুমি দেহই সর্বস্ব।

পরিচয় নাহি কিছু আত্মার নিজস্ব।।

নিত্যজন্ম নিত্যমৃত্যু দেহ  মাত্র হয়।

তবুও তোমার দুঃখ নাহি তবু তায়।।

অনুবাদঃ হে মহাবাহো। আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মার বারবার জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়, তা হলেও তোমার শোক করার কোন কারণ নেই।

তাৎপর্যঃ প্রায় বৌদ্ধদের মতো কিছু দার্শনিক আছে, যারা আত্মার দেহাতীত স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা মানতে চায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ভগবদগীতা বলেন, সেই যুগেও এই ধরণের নাস্তিক ছিল, তাদের বলা হত লোকায়তিক ও বৈভাষিকা। এই সমস্ত দার্শনিকদের মতবাদ হচ্ছে, জড় পদার্থের সমন্বয়ের কোন এক বিশেষ পরিণত অবস্থায় প্রাণের উদ্ভব হয়। আধুনিক জড় বিজ্ঞানী ও জড়বাদী দার্শনিকেরাও এই মতবাদ পোষণ করে। তাদের মতে, দেহটি হচ্ছে কতকগুলি জড় উপাদানের সমন্বয় মাত্র এবং কোনও এক পর্যায়ে জড় উপাদান ও রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে প্রাণের লক্ষণ বিকশিত হয়। এনথ্রোপোলজি বা নৃবিজ্ঞান এই মতবাদের ভিত্তিতে প্রচলিত হয়েছে। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে আমেরিকাতে এই মতবাদ ও বৌদ্ধধর্মের নিরীশ্বরবাদের ভিত্তির উপর অনেক নকল ধর্ম গজিয়ে উঠেছে।

বৈভাষিক দার্শনিকদের মতো অর্জুন যদি আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করতেন, তা হলেও তাঁর শোক করার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থের বিনাশের জন্য কেউ শোক করে না এবং তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হয় না। পক্ষান্তরে, আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যুদ্ধবিগ্রহে শত্রু জয় করার উদ্দেশ্যে কত টন টন রাসায়নিক উপাদান তো নষ্টই হচ্ছে। বৈভাষিক দর্শন অনুসারে, দেহের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত আত্মার বিনাশ হয়। সুতরাং, অর্জুন যদি বৈওদিক  মতবাদকে অস্বীকার করে আত্মাকে নশ্বর বলে মনে করতেন অর্থাৎ দেহের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনাশপ্রাপ্ত হয় বলে মনে করতেন, তা হলেও তাঁর অনুশোচনা করার কোনই কারন ছিল না। এই মতবাদ অনুযায়ী, যেহেতু ঘটনাচক্রে জড় পদার্থ থেকে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য জীবের উদ্ভব হচ্ছে এবং প্রতি মুহূর্তেই এই রকম অসংখ্য জীব বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে, তাই এর জন্য দুঃখ করার কোনই কারণ নেই। এই মতবাদের ফলে যেহেতু পুনর্জন্মের কোন প্রশ্নই ওঠে না, তাই অর্জুনের পিতামহ, আচার্য আদি আত্মীয়-পরিজনদের হত্যাজনিত পাপের ফল ভোগ করারও কোন ভয় নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিদ্রুপ সহকারে অর্জুনকে মহাবাহ, অর্থাৎ যার বাহুদ্বয় মহাশক্তি-সম্পন্ন বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ, অন্ততপক্ষে তিনি বৈদিক জ্ঞানের বিরোধী বৈভাষিকদের মতবাদ স্বীকার করেননি এবং তার ফলে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি ক্ষত্রিয়, এই বর্ণ-বিভাগ বৈদিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং যে এই বৈদিক বর্ণাশ্রম-ধর্ম মেনে চলে, সে বৈদিক নির্দেশ অনুযায়ী আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।

শ্লোকঃ ২৭

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুরধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।

তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমরহসি ।। ২৭ ।।

জাতস্য- যার জন্ম হয়েছে; হি- যেহেতু; ধ্রুবঃ- নিশ্চিত; মৃত্যুঃ- মৃত্যু; ধ্রুবম- নিশ্চিত; জন্ম- জন্ম; মৃতস্য- মৃতের; চ- এবং, তস্মাৎ- অতএব; অপরিহার্যে- অবশ্যম্ভাবী; অর্থে- বিষয়ে; ন- নয়; ত্বম- তুমি; শোচিতুম- শোক করা; অরহসি- উচিত।

গীতার গান

জড় দেহ উপজয় অনিবার্য ক্ষয়।

ক্ষয় হয়ে জড়দ্রব্য পুনঃ উপজয়।।

জড় দ্রব্য রূপ ছাড়ি অন্য রূপ হয়।

নতুন রূপের জন্য অন্য রূপ কয়।।

এই জড় বিজ্ঞা যদি করয়ে বিচার।

তথাপি শোকের কথা নহে তিলধার।।

অনুবাদঃ যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। অতএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়।

তাৎপর্যঃ পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে কোন বিশেষ দেহপ্রাপ্ত হয়ে আত্মা জন্মগ্রহণ করে। আর সেই দেহের মাধ্যমে কিছুকাল জড় জগতে অবস্থান করার পর, সেই দেহের বিনাশ হয় এবং তার কর্মের ফল অনুযায়ী সে আবার আর একটি নতুন দেহ ধারণ করে জন্মগ্রহণ করে। এভাবেই আত্মা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত না হওয়া প্রযন্ত জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকে। সে যাই হোক, এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র অনর্থক যুদ্ধ, হত্যা ও হিংসাকে কোন প্রকারেই অনুমোদন করে না। কিন্তু তবুও মানব সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হিংসা, হত্যা ও যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং তা যখন সমাজের মঙ্গলের জন্য সাধিত হয়, তখন তা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।

ভগবানের ইচ্ছার ফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আয়োজিত হয়েছিল বলে তা সম্পূর্ণ অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং ন্যায়সঙ্গত কারণে যুদ্ধ করাটা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। যেহেতু তিনি সঠিক ভাবে কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন, তাই তাঁর আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগে কেন তিনি ভীত ভীত অথবা শোকাহত হবেন? কর্তব্যকর্ম থেকে ভ্রষ্ট হলে পাপ হয় এবং অর্জুন যে স্বজন-হত্যার পাপের ভয়ে ভীত হচ্ছিলেন, প্রকৃত পক্ষে সেই পাপ তাঁর হত যদি তিনি যুদ্ধে বিমুখ হয়ে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করতেন। এই ধর্মযুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেও মৃত্যুর হাত থেকে তিনি তাঁর তথাকথিত আত্মীয় স্বজনদের রক্ষা করতে পারতেন না। প্রকৃতির বিধান অনুসারে একদিন না একদিন তাদের মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু অর্জুন যদি তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়তেন, তা হলে তাঁর মান, মর্যাদা ধূলিসাৎ হত।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x