শ্লোকঃ ২২

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়

নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-

ন্যানি সংষাতি নবানি দেহী ।। ২ ।।

বাসাংসি- বস্ত্র; জীর্ণানি- জীর্ণ; যথা- যেমন; বিহায়- পরিত্যাগ করে; নবানি- নতুন বস্ত্র; গৃহ্নাতি- গ্রহণ করে; নরঃ- মানুষ; অপরাণি- অন্য; তথা- তেমনই; শরীরাণি- শরীর; বিহায়- ত্যাগ করে; জীর্ণানি- জীর্ণ; অন্যানি- অন্য; সংষাতি- ধারণ করে; নবানি- নতুন দেহ; দেহী- শরীরী।

গীতার গান

পুরাতন বস্ত্র যথা,     ভঙ্গুর শরীর তথা,

এক ছাড়ি অন্য বস্ত্র পরে।

পুরাতন বস্ত্র ছাড়ে,     নবীন বসন পরে,

নবীন শরীর সেই ধরে।।

জীর্ণ শরীর ছাড়ি,   নবীন শরীর ধরি,

দেহীনব্য হয় পুনর্বার।

দেহ দেহী এই ভেদ,    তাহাতে বা কিবা খেদ,

ছাড় দুঃখ যুদ্ধ করিবার।।

অনুবাদঃ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন।

তাৎপর্যঃ পারমানবিক জীবাত্মা যে এক দেহ ছেড়ে আর এক দেহ ধারণ করে, তা সর্বজনস্বীকৃত তথ্য। তবু আধুনিক যুগের কিছু বৈজ্ঞানিক আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, অথচ হৃদয় থেকে কেমন করে শক্তি সঞ্চালিত হয় তা বোঝাতে পারে না। কিন্তু তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, প্রতি মুহূর্তে দেহের পরিবর্তন হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের ফলেই দেহে শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য দেখা দেয়। বার্ধক্যের পর আত্মা অন্য দেহ ধারণ করে। এই সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই (২/১৩) বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পরমাত্মার কৃপার ফলেই অণু আত্মা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। বন্ধু যেমন বন্ধুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে, পরমাত্মাও তেমন অণু আত্মার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মুন্ডক উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আত্মা ও পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল খাচ্ছে, অন্য পাখিটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। এই দুটি পাখি গুণগতভাবে যদিও এক, তবুও তাদের একজন সেই জড়-জাগতিক গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ, আর অন্য জন একান্ত সুহৃদের মতো তার কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সাক্ষীরূপ পাখি, আর অর্জুন হচ্ছেন ফল আহারে রত পাখি। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্য জন হচ্ছেন ভৃত্যু। জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে তার এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই এক গাছ থেকে আর এক গাছে অর্থাৎ এক দেহ থেকে আর এক দেহে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জড় দেহরূপ বৃক্ষে জীবাত্মা কঠোর সংগ্রাম করছে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে অন্য পাখিটিকে পরম গুরুরূপে গ্রহণ করতে সম্মত হয়, যেভাবে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ লাভের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলেন, তৎক্ষণাৎ অধীন পাখিটি সমস্ত শোক থকে মুক্ত হয়। মুন্ডক উপনিষদে (৩/১/২) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/৭) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে-

সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহণীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।

জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।

“দুটি পাখি একই গাছে বসে আছে, কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত সে গাছের ফলের ভোক্তারূপে সর্বদাই শোক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখিটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্চর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।“ অর্জুন তাঁর নিত্যকালের বন্ধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে ভগবদগীতার তত্ত্ব জানতে পেরেছেন। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করার ফলে তিনি ভগবানের পরম মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমস্ত শোক থেকে মুক্ত হন।

ভগবান এখানে অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, তাঁর বৃদ্ধ পিতামহ, শিক্ষক আদি আত্মীয়-পরিজনদের জন্য শোক না করতে। পক্ষান্তরে, সেই ধর্মযুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করার ফলে তাঁদের দেহগত কর্মফল জনিত সমস্ত পাপ থেকে তাঁরা মুক্ত হবেন বলে, আনন্দিত হওয়া উচিত। যজ্ঞবেদিতে অথবা ধর্মযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় এবং তার ফলে উচ্চতর জীবন লাভ হয়। সুতরাং, অর্জুনের শোক করবার কোনই কারণ ছিল না।

শ্লোকঃ ২৩

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ।

ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ।। ২৩ ।।

ন- না; এনম- এই আত্মাকে; ছিন্দন্তি- ছেদন করতে পারে; শস্ত্রাণি- অস্ত্রসমূহ; ন- না; এনম- এই আত্মাকে; দহতি- দহন করতে পারে; পাবকঃ- অগ্নি, ন- না; চ- ও; এনম- এই আত্মাকে; ক্লেদয়ন্তি- আর্দ্র করতে পারে; আপঃ- জল; ন- না; শোষয়তি- শুষ্ক করতে পারে; মারুতঃ- বায়ু।

গীতার গান

অস্ত্রাঘাতে নাহি কাটে চিন্ময় শরীর।

অগ্নি না জ্বালায় তাহা শুন বিজ্ঞ বীর।।

জল দ্বারা নাহি ভিজে বায়ু না শুকায়।

ঘাত প্রতিঘাত সব জড়েতে জুয়ায়।।

অনুবাদঃ আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।

তাৎপর্যঃ তরবারি, আগ্নেয় অস্ত্র, পর্জন্যাস্ত্র, বায়বীয় অস্ত্র আদি কোন রকমের অস্ত্রশস্ত্রই আত্মাকে হত্যা করতে পারে না। এই শ্লোকে বোঝা যায়, মহাভারতের যুগে আধুনিক যুগের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তো ছিলই, আর তা ছাড়া জল, বায়ু, আকাশ আদির তৈরি অস্ত্রের ব্যবহারও ছিল। আধুনিক যুগের পারমানবিক অস্ত্রশস্ত্রগুলি এক রকমের আগ্নেয়াস্ত্র, কিন্তু তথাকথিতভাবে বিজ্ঞানের উন্নতি হলেও জল, বায়ু, আকাশ আদির দ্বারা নির্মিত অস্ত্রের ব্যবহার আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মহাভারতের যুগে জলীয় অস্ত্রের দ্বারা পারমানবিক অস্ত্রের মতো আগ্নেয়াস্ত্রকে খন্ডন করা হত- যা আজকের বৈজ্ঞানিকদের কল্পনারও অতীত। সেই যুগের বীরেরা যে-সমস্ত অদ্ভুত ঝটিকা অস্ত্রের ব্যবহার জানতেন, তা আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা কল্পনাও করতে পারে না। অগ্নি, জল, বায়ু, আকাশ আদির মত সমস্ত অস্ত্র থাকলেও, কোন বৈজ্ঞানিক অস্ত্রের দ্বারাই আত্মাকে হত্য করা যায় না।

মায়াবাদীরা বঝাতে পারেন না কেমন করে জীবাত্মা নিতান্তই অজ্ঞতার ফলে জড় অস্তিত্ব লাভ করে এবং তার ফলে মায়াশক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আত্মাকে যেমন অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, তেমনই আত্মাকে তার উৎস পরমাত্মার থেকেও কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না; বরং, স্বতন্ত্র জীবাত্মাগুলি পরমাত্মার শাশ্বত ভিন্নাংশ। যেহেতু সনাতন জীবাত্মা পরমাণুসদৃশ, তাই ভগবানের বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা তাদের আচ্ছাদিত হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং এভাবে তারা ভগবানের সান্নিধ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, ঠিক যেমন আগুনের স্ফুলিঙ্গ, যদিও আগুনের সঙ্গে তা গুণগতভাবে এক ও অভিন্ন, কিন্তু আগুনের থেকে বেরিয়ে এলেই তা নিভে যায় এবং তখন আর তার মধ্যে আগুনের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় না। তেমনই পরমাণুসদৃশ জীবাত্মা-বিমুখ হয়ে পড়লে ময়াশক্তির দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে এবং তার প্রকৃত স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে পড়ার ফলে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করতে থাকে। বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে, জীবাত্মা পরমাত্মার বিভিন্নাংশ। ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই সম্পর্ক নিত্য শাশ্বত। সুতরাং, মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরও জীবাত্মা স্বতন্ত্র স্বরূপেই বিদ্যমান থাকে, যা অর্জুনের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশেই সুস্পষ্ট উপলব্ধি হয়। ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার পর অর্জুন মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তা বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এক হয়ে যাননি।

শ্লোকঃ ২৪

অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহ শোষ্য এব চ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ।। ২৪ ।।

অচ্ছেদ্যঃ- অচ্ছেদ্য; অয়ম- এই আত্মা; অদাহ্যঃ- পোড়ানো যায় না; অয়ম- এই আত্মাকে; অক্লেদ্যঃ- ভিজানো যায় না; আশোষ্যঃ- শুকানো যায় না; এব- অবশ্যই; চ- এবং; নিত্যঃ- চিরস্থায়ী; সর্বগতঃ- সর্বব্যাপ্ত; স্থাণুঃ- অপরিবর্তনীয়; অচলঃ- নিশ্চল; অয়ম- এই আত্মা; সনাতনঃ- নিত্য বর্তমান।

গীতার গান

অচ্ছেদ্য যে আত্মা হয় অক্লেদ্য অশোষ্য।

চিদানন্দ আত্মা নহে জড়ের সে পোষ্য।।

সর্বত্র আত্মার গতি স্থির সনাতন।

অচল অটল আত্মা নিত্য সে নূতন।।

অনুবাদঃ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষ্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।

তাৎপর্যঃ পারমাণবিক আত্মার এই সমস্ত গুণাবলী নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, সে অবশ্যই পরমাত্মার পরমাণুসদৃশ অংশ এবং সে নিত্যকাল অপরিবর্তিত ভাবে একই পরমাণুরূপে চিরকাল বর্তমান থাকে। অদ্বৈতবাদীরা যে বলে থাকেন, মায়ামুক্ত হলে জীবাত্মা পরমাত্মায় পরিণত হয়, সেই তত্ত্ব এই শ্লোকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। মায়ামুক্ত হবার পর জীবাত্মা ইচ্ছা করলে ভগবানের দেহনির্গত ব্রক্ষ্মজ্যোতিতে চিৎকণারূপে বিরাজ করতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমান জীবাত্মারা ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করে ভগবানের সাহচর্য লাভ করে।

এখানে সর্বগত (সর্বব্যাপ্ত) শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা কোন সন্দেহ নেই যে, ঈশ্বরের সৃষ্টির সর্বত্রই আত্মা বিরাজ করছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, এমন কি আগুনেও জীবাত্মা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আগুনে আত্মা নেই, কিন্তু এই শ্লোকে আমরা বুঝতে পারি, সেই ধারণাটি ভ্রান্ত, কারণ, এখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, আগুন আত্মাকে দহন করতে পারে না। এর থেকে বোঝা যায়, সূর্যলোকেও সেখানকার উপযোগী দেহ ধারণ করে জীবাত্মা রয়েছে। সূর্যলোকে যদি জীব না থাকত, তা হলে সর্বগত, অর্থাৎ ‘সর্বত্র আত্মার গতি’ কথাটি ব্যবহার করা হত না।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x