শ্লোকঃ ১৩

দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।

তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিরধীরস্তত্র না মুহ্যতি ।। ১৩ ।।

দেহিনঃ- দেহীর; অস্মিন- এই; যথা- যেমন; দেহে- দেহে; কৌমারম- কৌমার; যৌবনম- যৌবন; জরা- বার্ধক্য; তথা- তেমনই; দেহান্তর- দেহান্তর; প্রাপ্তিঃ- লাভ হয়; ধীরঃ- স্থিরবুদ্ধি; তত্র- তাতে; ন- না; মুহ্যতি- মোহগ্রস্থ হন।

গীতার গান

দেহ দেহী ভেদ দুই নিত্যানিত্য সেই।

কৌমার যৌবন জরা পরিবর্তন যেই।।

দেহের স্বকার্য হয় দেহী নিত্য রহে।

তথা দেহান্তরপ্রাপ্তি পণ্ডিতেরা কহে।।

অনুবাদঃ দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোনও দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনো এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।

তাৎপর্যঃ– যেহেতু প্রত্যেকটি জীব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র আত্মা, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই প্রত্যেকেই তার দেহ পরিবর্তন করে চলেছে, তার ফলে কখনো সে শিশু, কখনো কিশোর, কখনো যুবক এবং কখনো বৃদ্ধ। এভাবে সে নানা রূপ ধারণ করছে। কিন্তু জীবের প্রকৃত সত্তা আত্মার কোনও পরিবর্তন হয় না। এক সময় দেহটি যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন আত্মা সেই দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ ধারণ করে। মৃত্যুর পর জড় অথবা চিন্ময় আর একটি দেহ প্রাপ্ত হওয়া যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন ভীষ্ম দ্রোণাচার্য আদি আত্মীয়-পরিজনের জন্য শোক করা অর্জুনের পক্ষে নিতান্তই নিরর্থক। বরং, তাঁদের মৃত্যুর কথা ভেবে শোক করার পরিবর্তে তাঁর আনন্দিত হওয়া উচিত ছিল, কারণ মৃত্যু হলে তাঁরা তাঁদের জরাগ্রস্থ বৃদ্ধদেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ প্রাপ্ত হবেন এবং নবশক্তি লাভ করবেন। পূর্বকৃত কর্মের ফল অনুসারে জীব নতুন দেহ প্রাপ্ত হয় এবং নানা রকম সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে। তাই, ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো মহাত্মারা যে দেহত্যাগের পর জড় জগতের বন্ধনমুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধাম বৈকুন্ঠে ফিরে যাবেন, অথবা স্বর্গলোকে দিব্য দেহ প্রাপ্ত হয়ে নানা রকম সুখভোগ করবেন, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং তাঁদের মৃত্যুতে শোক করার কোনই কারণ ছিল না।

যে মানুষ জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ এবং পরা ও অপরা উভয় প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত, তাঁকে বলা হয় ধীর। এই প্রকার মানুষ জড় দেহের পরিবর্তনের জন্য কখনো শোক করেন না।

আত্মাকে খন্ড খন্ড অংশে বিভক্ত করা যায় না এই যুক্তিতে, আত্মা ও পরমাত্মার একত্ব সম্বন্ধে মায়াবাদীদের যে মতবাদ, তা গ্রহণযোগ্য নয়। পরমাত্মাকে খন্ড খন্ড করে বিভক্ত করার ফলে যদি জীবাত্মার উদ্ভব হত, তবে পরমাত্মা হতেন পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত পরমাত্মা যে অপরিবর্তনীয় তার পরিপন্থী। গীতাতে ভগবান বলেছেন, পরমেশ্বরের অংশ জীবাত্মা সনাতন এবং তাঁকে বলা হয় ক্ষুর; অর্থাৎ তার জড়া প্রকৃতিতে পতিত হবার প্রবণতা থাকে। জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ এবং বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরেও সে পরমাত্মার অংশরূপেই বর্তমান থাকে। তবে মুক্ত হবার পর সে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় দেহপ্রাপ্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে ভগবানের সাহচর্য লাভ করে। জলে যখন আকাশের প্রতিফলন দেখা যায়, তখন তাতে সূর্য, চন্দ্র, এমন কি তারাদেরও পর্যন্ত দেখা যায়। তারাগুলিকে জীবাত্মার সঙ্গে তুলনা করা চলে এবং সূর্য অথবা চন্দ্রকে পরমেশ্বরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। অর্জুন হচ্ছেন স্বতন্ত্র অণুচৈতন্য-বিশিষ্ট জীবাত্মা এবং বিভুচৈতন্য পরমাত্মা হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জীবাত্মা ও পরমাত্মা সমপর্যায়ভুক্ত নয়, চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথমেই তা আমরা দেখতে পাব, অর্জুন যদি শ্রীকৃষ্ণের সমপর্যায়ভুক্ত হতেন এবং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের ঊর্ধ্বতন না হতেন তা হলে তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠা কখনোই সম্ভব হত না। তাঁরা দুজনেই যদি মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হতেন, তা হলে একজন উপদেষ্টা এবং অন্য জন উপদেশ গ্রহণকারী হওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। এই প্রকার উপদেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ মায়ায় কবলিত কেউ প্রামাণিক উপদেষ্টা হতে পারে না। এই অবস্থান আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, যিনি জীব থেকে অতি ঊর্ধ্বে অবস্থিত আর অর্জুন হচ্ছে বিস্মরণশীল আত্মা, যে মায়ার দ্বারা মোহিত।

শ্লোকঃ ১৪

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।

আগমাপায়িনোহ নিত্যাস্তাংস্থিতিক্ষস্ব ভারত ।। ১৪ ।।

মাত্রাস্পর্শাঃ- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি; তু- কেবল; কৌন্তেয়- হে কুন্তীপুত্র; শীত- শীত, ঊষ্ণ- গ্রীষ্ম; সুখ- সুখ; দুঃখদাঃ- দুঃখদায়ক, আগম- আসে, অপায়িনঃ- চলে যায়; অনিত্যাঃ- অস্থায়ী; তান- সেগুলিকে; তিতিক্ষস্ব- সহ্য করার চেষ্টা কর; ভারত- হে ভারত।

গীতার গান

শীত উষ্ণ সুখ দুঃখ ইন্দ্রিয় বিকার।

ইন্দ্রিয়ের দাস যারা তাহে অধিকার।।

যে সব অনিত্য বস্তু আসি চলি যায়।

সহিষ্ণুতা মাত্র গুণ তাহার উপায়।।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেন শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ! সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।

তাৎপর্যঃ মানব জীবনের প্রকৃত কর্তব্য সম্পাদন করতে হলে মানুষকে সহনশীলতার মাধ্যমে বুঝতে হবে, সুখ ও দুঃখ কেবল ইন্দ্রিয়ের বিকার মাত্র। শীতের পর যেমন গ্রীষ্ম আসে, তেমনই পর্যায়ক্রমে সুখ ও দুঃখ আসে। সত্যকে উপলব্ধি করে দুঃখে ও সুখে অবিচলিত থাকাই মানুষের কর্তব্য। বেদে নির্দেশ দেওয়া আছে, খুব সকালে স্নান করা উচিত। যে শাস্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে, সে মাঘ মসের প্রচন্ড শীতেও খুব ভোরে স্নান করতে ইতস্তত করে না। তেমনই, গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমেও গৃহিণীরা রান্না করা থেকে বিরত থাকেন না। আবহাওয়া জনিত অসুবিধা সত্ত্বেও মানুষকে তার কর্তব্যকর্ম করে যেতেই হয়। তেমনই, যুদ্ধ করাটাই হচ্ছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং কর্তব্যের খাতিরে তাকে যদি তার আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়, তবুও সে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত হতে পারে না। শাস্ত্র-নির্ধারিত অনুশাসন মেনে চলাটাই হচ্ছে সভ্য মানুষের লক্ষণ। এই অনুশাসন মেনে চলার ফলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ হয় এবং সে তখন ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়। এই জ্ঞানের প্রভাবে তার হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার হয় এবং ভগবানের প্রতি তার এই আন্তরিক ভক্তি তাকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে।

এই শ্লোকে অর্জুনকে কৌন্তেয় ও ভারত নামে সম্বোধন করাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁকে কৌন্তেয় নামে সম্বোধন করার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মাতৃকুলের মহান রক্তের সম্পর্ক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং ভারত নামে সম্বোধন করে তাঁর পিতৃকুলের মহত্ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উভয় দিক থেকে তিনি সুমহান বংশজাত ছিলেন। মহৎ বংশে জাত পুরুষ কখনোই তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত হন না। তাই, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর বংশ-গৌরবের কথা স্মরণ করে তাঁকে যুদ্ধ করতেই হবে।

শ্লোকঃ ১৫

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।

সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে ।। ১৫ ।।

যম- যে; হি- অবশ্যই; ন- না; ব্যথয়ন্তি- বিচলিত হন; এতে- এই সমস্ত; পুরুষম- ব্যক্তিকে; পুরুষর্ষভ- হে পুরুষশ্রেষ্ঠ; সম- অপরিবর্তিত; দুঃখ- দুঃখ; সুখম- সুখ; ধীরম- সহিষ্ণু; সঃ- তিনি; অমৃতত্বায়- মুক্তি লাভের; কল্পতে- যোগ্য হয়।

গীতার গান

ব্যথা নাহি দেয় যারে অনিত্য এইসব।

সেজন বুঝিল জান পুরুষার্থ বৈভব।।

সমদুঃখ সুখধীর অনিত্য ব্যাপারে।

অমরত্ব সেই প্রায় জিতিয়া সংসারে।।

অনুবাদঃ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন)। যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী।

তাৎপর্যঃ যে মানুষ সুখে-দুঃখে সম্পূর্ণ অবিচলিত থেকে তাঁর পারমার্থিক উন্নতি সাধন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তিনি অনায়াসে এই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের যোগ্য হন। বর্ণাশ্রম-ধর্মের চতুর্থ আশ্রম সন্ন্যাস অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ পথ। কিন্তু যে মানুষ তাঁর জীবনকে সার্থক করে তুলতে চান, তিনি সমস্ত রকম অসুবিধা সত্ত্বেও এই সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না। সন্ন্যাস-আশ্রম গ্রহণ করলে মানুষকে তার সব রকম পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করতে হয়। স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের এই বন্ধনমুক্ত হওয়া খুবই কষ্টকর। কিন্তু যিনি এই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন, নিঃসন্দেহে তার পারমার্থিক জীবন সার্থক হয়ে ওঠে এবং অচিরেই তিনি ভগবৎ-দর্শন লাভ করেন। ঠিক তেমনই, অর্জুনকে তাঁর ক্ষাত্রধর্ম পালন করার উপদেশ দিয়ে ভগবান তাঁকে বললেন, এই ধর্মযুদ্ধে তাঁর আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যদিও অত্যন্ত দুঃখদায়ক এবং কষ্টসাপেক্ষ, কিন্তু তবুও তাঁর কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করবার জন্য তাঁর দেহজাত আত্মীয়তার বন্ধন থেকে তাঁকে মুক্ত হতে হবে এবং যুদ্ধ করতে হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, ঘরে তখন তাঁর যুবতী স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মাতা ছিলেন। তাঁদের দেখাশোনা করার জন্য কেউই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মহত্তর উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করেন। মায়ার বন্ধন থেকে  মুক্ত হবার এই হচ্ছে উপায়।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x