শ্লোকঃ ৭১

বিহায় কামান যঃ সর্বান পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ।

নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি ।। ৭১ ।।

বিহায়- ত্যাগ করে; কামান- ইন্দ্রিয়সুখ ভোদের বাসনাসমূহ; যঃ- যে ব্যক্তি; সর্বান- সমস্ত; পুমান- পুরুষ; চরতি- বিচরণ করেন; নিঃস্পৃহঃ- স্পৃহাশূন্য; নির্মমঃ- মমত্ববোধ রহিত; নিরহঙ্কারঃ- অহংকারশূন্য; সঃ- তিনি; শান্তিম- প্রকৃত শান্তি; অধিগচ্ছতি- প্রাপ্ত হন।

গীতার গান

কাম ছাড়ি সব যেবা নিস্পৃহ ধীমান।

সর্বত্র ভ্রমণ করে নারদীয় গান।।

মমতাবিহীন আর অহংকার নাই।

তার শান্তি বিনিশ্চিত সেইত গোঁসাই।।

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ নিষ্কাম হওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য কোন কিছু কামনা না করা। পক্ষান্তরে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করার কামনাই হচ্ছে নিষ্কামনা। এই জড় দেহটিকে বৃথাই আমাদের প্রকৃত সত্ত্বা বলে না ভেবে এবং জগতের কোন কিছুর উপরে বৃথা মালিকানা দাবী না করে, শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস রূপে নিজের যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করাটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পরিশুদ্ধ পর্যায়। এই পরিশুদ্ধ পর্যায়ে যে উন্নীত হতে পারে, সে বুঝতে পারে, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করবার জন্য সব কিছুই তাঁর সেবায় উৎসর্গ করা উচিৎ। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন নিজের ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে নারাজ হয়েছিলেন, কিন্তু ভগবানের কৃপার ফলে তিনি যখন পরিপূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হলেন, তখন ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। নিজের জন্য যুদ্ধ করার ইচ্ছা অর্জুনের ছিল না, কিন্তু ভগবানের ইচ্ছার কথা জেনে সেই একই অর্জুন যথাসাধ্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে করেছিলেন, ভগবানকে সন্তুষ্ট করার বাসনাই হচ্ছে বাসনা রহিত হওয়ার একমাত্র উপায়। কোন রকম কৃত্রিম উপায়ে কামনা-বাসনাগুলিকে জয় করা যায় না। জীব কখনোই ইন্দ্রিয়ানুভূতিশূন্য অথবা বাসনা রহিত হতে পারে না। তবে ইন্দ্রিয়ানুভুতি ও কামনা-বাসনার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য সে তাদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে। জড়-জাগতিক বাসনাশূন্য মানুষ অবশ্যই বোঝেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের (ঈশাবাস্যমিদং সর্বম) এবং সেই জন্য তিনি কোন কিছুর উপরেই মালিকানা দাবী করেন না। এই পারমার্থিক জ্ঞান আত্ম-উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, তখন যথাযথ ভাবে বোঝা যায় যে, চিন্ময় স্বরূপে প্রত্যেকটি জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাই জীবের নিত্য স্থিতি কখনোই শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ বা তাঁর চেয়ে বড় নয়। কৃষ্ণভাবনামৃতের এই সত্য উপলব্ধি করাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তি লাভের মূল নীতি।

শ্লোকঃ ৭২

এষা ব্রাক্ষ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।

স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রক্ষ্মনির্বাণমৃচ্ছতি ।। ৭২ ।।

এষা- এই; ব্রাক্ষ্মী- চিন্ময়; স্থিতিঃ- স্থিতি; পার্থ- হে পৃথাপুত্র; ন- না; এনাম- এই; প্রাপ্য- লাভ করে; বিমুহ্যতি- বিমোহিত হন; স্থিত্বা- স্থিত হয়ে; অস্যাম- এতে; অন্তকালে- জীবনের অন্তিম সময়ে; অপি- ও; ব্রক্ষ্মনির্বাণম- জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময় স্তর; ঋচ্ছতি- লাভ করেন।

গীতার গান

সেই সে স্মৃতির নাম ব্রাক্ষ্মীস্থিতি হয়।

যার প্রাপ্তি হয় তাঁর মোহন কোথায়।।

সেই স্থিতি যদি হয় মরণের কালে।

ব্রক্ষ্মস্থিতি ভাব নহে কালের কালে।।

অনুবাদঃ এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাক্ষ্মীস্থিতি বলে। হে পার্থ! যিনি এই স্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না। জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনামৃত অর্থাৎ ভগবৎ-পরায়ণ দিব্য জীবন এক মুহূর্তের মধ্যে লাভ করা সম্ভব, আবার লক্ষ-কোটি জীবনেও তার নাগাল পাওয়া সম্ভব না হতেও পারে। এই জীবন লাভ করতে হলে কেবল পরম সত্যকে উপলব্ধি করে তাকে গ্রহণ করতে হবে। খট্বাঙ্গ মহারাজ তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মুহূর্ত পূর্বে ভগবানের চরণারবিন্দে আত্মোৎসর্গ করার ফলে জীবনের সেই পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলেন। নির্বাণ কথাটির অর্থ হচ্ছে জড় জীবনের সমাপ্তি। বৌদ্ধদের মতে জড় জীবনের সমাপ্তি হলে আত্মা অসীম শূন্যতায় বিলীন হয়ে যায়। ভগবদগীতা কিন্তু আমাদের সেই শিক্ষা দেয় না। এই জড় জীবনের সমাপ্তি হবার পরে আমাদের প্রকৃত জীবন শুরু হয়। এই জড়-জাগতিক জীবনধারা পরিসমাপ্ত করতে হবে, সেই কথাটি জানাই স্থূল জড়বাদীদের পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু যিনি পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি জানেন যে, এই জড় জীবনের পরেও আর একটি জীবন আছে। এই জীবনের পরিসমাপ্তির পূর্বে, সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তবে সে তৎক্ষণাৎ ব্রক্ষ্মনির্বাণ স্তর লাভ করে। ভগবৎ-ধাম ও ভগবৎ-সেবার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। যেহেতু উভয়ই চিন্ময়, তাই ভক্তিযোগে ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত হওয়াই হচ্ছে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি। জড় জগতের সমস্ত কর্মই ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য সাধিত হয়, কিন্তু চিন্ময় জগতের সমস্ত কর্মই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার জন্য সাধিত হয়। এমন কি এই জীবনে কৃষ্ণভাবনাময় উদ্বুদ্ধ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রক্ষ্মপ্রাপ্তি হয় এবং যিনি কৃষ্ণভাবনাময় মগ্ন, তিনি নিঃসন্দেহে ইতিমধ্যেই ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেছেন।

ব্রক্ষ্ম হচ্ছে জড় বস্তুর ঠিক বিপরীত। তাই ব্রাক্ষ্মী স্থিতি বলতে বোঝায় ‘জড়-জাগতিক স্তরের অতীত’। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা নিবেদনকে ভগবদগীতায় মুক্ত স্তররূপে স্বীকার করা হয়েছে (স গুণান সমতীত্যৈতান ব্রক্ষ্মভূয়ায় কল্পতে)। তাই, জড় বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে ব্রাক্ষ্মী স্থিতি।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ভগবদগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়কে সমগ্র ভগবদগীতার সারাংশ বলে বর্ণনা করেছেন। ভগবদগীতার বিষয়বস্তু হচ্ছে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে এবং সমগ্র গীতার সারমর্ম-স্বরূপ ভক্তিযোগের আভাস দেওয়া হয়েছে।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান।

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগতপ্রাণ।।

ইতি- গীতার বিষয়বস্তুর সারমর্ম পরিবেশিত বিশয়ক ‘সাংখ্য-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

 

– সমাপ্ত –

error: Content is protected !!