শ্লোকঃ ৬৫
প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে।
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে ।। ৬৫ ।।
প্রসাদে- ভগবানের অহৈতুকী কৃপা লাভ করার ফলে; সর্ব- সমস্ত; দুঃখানাম- জড় দুঃখের; হানিঃ- বিনাশ; অস্য- তাঁর; উপজায়তে- হয়; প্রসন্নচেতসঃ- প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির; হি- অবশ্যই; আশু- অতি শীঘ্র; বুদ্ধিঃ- বুদ্ধি; পরি-সর্বতোভাবে; অবতিষ্ঠতে- স্থির হয়।
গীতার গান
পরমানন্দ সুখ যেই প্রসাদ তার নাম।
যাহার প্রাপ্তিতে দুঃখ হয় অন্তর্ধান।।
সে প্রসাদে প্রতিষ্ঠিত যে হয় নিশ্চিত।
আত্মনিষ্ঠা বুদ্ধি তার জগতে বিদিত।।
অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন আর জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখ থাকে না; এভাবে প্রসন্নতা লাভ করার ফলে বুদ্ধি শীঘ্রই স্থির হয়।
শ্লোকঃ ৬৬
নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
না চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম ।। ৬৬ ।।
ন অস্তি- থাকতে পারে না; বুদ্ধিঃ- চিন্ময় বুদ্ধি; অযুক্তস্য- যে কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়; ন- না; চ- এবং; অযুক্তস্য- কৃষ্ণভক্তিবিহীন ব্যক্তির; ভাবনা- সুখের চিন্তায় মগ্নচিত্ত; ন- না; চ- এবং; অভাবয়তঃ- পরমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির; শান্তিঃ- শান্তি; অশান্তস্য- শান্তিরহিত ব্যক্তির; কুতঃ- কোথায়; সুখম- সুখ।
গীতার গান
জীবের স্বরূপ হয় আনন্দেতে মতি।
বুদ্ধিযোগ বিনা তার কোথায় বা গতি।।
অতএব সে ভাবনা নাহি যার স্থিতি।
কোথা শান্তি তার বল সুখের প্রগতি।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার চিত্ত সংযত নয় এবং তার পারমার্থিক বুদ্ধি থাকতে পারে না। আর পরমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। এই রকম শান্তিহীন ব্যক্তির প্রকৃত সুখ কোথায়?
তাৎপর্যঃ ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত না করলে কোন মতেই শান্তি পাওয়া যেতে পারে না। ভগবান নিজেই পঞ্চম অধ্যায়ে (৫/২৯) প্রতিপন্ন করেছেন যে, যখন কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, কৃষ্ণই হচ্ছে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার একমাত্র ভোক্তা, তিনিই সমস্ত বিশ্বচরাচরের অধীশ্বর এবং তিনিই সমস্ত জীবের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু, তবেই সে প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারে। তাই, যে কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার জীবনের কোন চরম উদ্দেশ্যই থাকে না। জীবনের চরম উদ্দেশ্য কি, তা না জানাই তার সমস্ত অশান্তির কারণ। কিন্তু কেউ যখন বুঝতে পারে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ভোক্তা, অধীশ্বর ও সর্বভূতের পরম সুহৃদ, তখন তার মন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় একাগ্র হয়ে ওঠে এবং তার ফলে সে প্রকৃত শান্তি লাভ করে। তাই, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ রহিত হয়ে যে তার সময় অতিবাহিত করে, সে যতই লোক দেখানো তথাকথিত শান্তি ও পারমার্থিক প্রগতির বুলি আওড়াক না কেন, সে সর্বদাই দুঃখ-দুর্দশায় পীড়িত ও অশান্ত। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে একটি স্বয়ং-প্রকাশিত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, যা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একমাত্র সম্বন্ধ গড়ে তোলার মাধ্যমেই লাভ করা যায়।
শ্লোকঃ ৬৭
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং ষন্মনোহনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিভাম্ভসি ।। ৬৭ ।।
ইন্দ্রিয়াণাম- ইন্দ্রিয়সমূহের; হি- নিশ্চিতভাবে; চরতাম- বিচরণকালে; যৎ- যার দ্বারা; মনঃ- মন; অনুবিধীয়তে- সদা অনুসরণ করে; তৎ- তা; অস্য- তার; হরতি- হরণ করে; প্রজ্ঞাম- বুদ্ধিকে; বায়ুঃ- বায়; নাবম- নৌকা; ইব- মতো; অম্ভসি- জলে।
গীতার গান
ইন্দ্রিয় চালিত করি মনোধর্মে স্থিতি।
বায়ুর মধ্যেতে যথা নৌকার প্রগতি।।
সে নৌকা যেমন সদা টলমল করে।
অযুক্ত ব্যক্তির প্রজ্ঞা সেইরূপ হরে।।
অনুবাদঃ প্রতিকুল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনই সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্ভক্ত যদি তাঁর সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নিয়োযিত না করেন, যদি তাঁর কোন একটি ইন্দ্রিয়ও জড় সুখ উপভোগ করার প্রয়াসী হয়, তাহলেও তাঁর মন ভগবানের শ্রীচরণকমল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, ফলে তাঁর পারমার্থিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। মহারাজ অম্বরীষের ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে আমরা শিক্ষা পাই, তাঁর মতো আমাদেরও সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। তা হলেই মন একাগ্র হয়ে ভগবানের শ্রীচরণে সমাধিস্থ হবে, কেন না সেটিই হচ্ছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করার যথার্থ কৌশল।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ