শ্লোকঃ ৬২-৬৩
ধ্যায়তো বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে ।। ৬২ ।।
ক্রোধাদ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ।।৬৩ ।।
ধ্যায়তঃ- ধ্যান করতে করতে; বিষয়ান- ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ; পুংসঃ- মানুষের; সঙ্গঃ- আসক্তি; তেষু- ইন্দ্রিয় বিষয়ে; উপজায়তে- উৎপন্ন হয়; সঙ্গাৎ- আসক্তি থেকে; সঞ্জায়তে- সঞ্জাত হয়; কামঃ- কাম; কামাৎ- কাম থেকে; ক্রোধঃ- ক্রোধ; অভিজায়তে- জন্মায়; ক্রোধাৎ- ক্রোধ থেকে; ভবতি- হয়; সম্মোহঃ- পূর্ণ মোহ; সম্মোহাৎ- সম্মোহ থেকে; স্মৃতি- স্মৃতির; বিভ্রমঃ- বিভ্রান্তি; স্মৃতিভ্রংশাৎ- স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার ফলে; বুদ্ধিনাশঃ- সৎ-অসৎ বিচারবুদ্ধির বিনাশ; বুদ্ধিনাশাৎ- বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে; প্রণশ্যতি- অধঃপতিত হয়।
গীতার গান
শূষ্ক বৈরাগ্য যে আর বিষয়েতে ধ্যান।
ক্রমে ক্রমে সঙ্গ সেই হয় আগুয়ান।।
সঙ্গ ক্রমে কাম হয় কামে ক্রোধ হয়।
ক্রোধে সম্মোহন পরে বিভ্রম বাড়ায়।।
স্মৃতি ভ্রষ্ট হলে পরে বুদ্ধিনাশ হয়।
বৈরাগীর সর্বনাশ সেই সে পর্যায়।।
অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়; আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।
তাৎপর্যঃ যার অন্তরে ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়নি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করা মাত্রই তার মনে আসক্তি জন্মায়। ইন্দ্রিয়গুলিকে সঠিকভাবে নিযুক্ত করা দরকার, তাই সেগুলিকে যখন ভগবানের প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত করা না হয়, তখন সেই ইন্দ্রিয়গুলি জড়-জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। জড়-জগতের সকলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়, এমনকি ব্রক্ষ্মা এবং শিবও এর দ্বারা প্রভাবিত- স্বর্গলোকের অন্যান্য দেব-দেবীদের তো কোন কথাই নেই। জড় জগতের এই গোলক ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় ভাবিত হওয়া। এক সময় মহাদেব গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, পার্বতী যখন কামার্ত হয়ে তাঁর সঙ্গ কামনা করেন, তখন তাঁর ধ্যান ভঙ্গ হয় এবং তিনি পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হন, ফলে কার্তিকের জন্ম হয়। ভগবানের একনিষ্ঠ ভক্ত ঠাকুর হরিদাসও এভাবে স্বয়ং মায়াদেবীর দ্বারা প্রলুব্ধ হন, কিন্তু ভগবানের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তির প্রভাবে তিনি অনায়াসে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শ্রীযামুনাচার্যের লেখা পূর্বোক্ত শ্লোকের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, নিষ্ঠাবান ভক্ত ভগবানের দিব্য সাহচর্য লাভ করে এক অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ লাভ করেন, যার ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ পরিহার করতে পারেন। ভগবদ্ভক্তির প্রভাবে মন আপনা থেকেই আসক্তি রহিত হয়ে পড়ে এবং হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয়। সেটিই হচ্ছে সাফল্যের রহস্য। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্তি ছাড়া জোর করে ইন্দ্রিয়-দমন করার চেষ্টা করলে তা কখনোই ফলপ্রসূ হয় না, কারন ইন্দ্রিয় সম্ভোগের সামান্য চিন্তার ফলে সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনায় মন উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
শ্রীল রূপ গোস্বামী আমাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছেন-
প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তুনঃ।
মুমুক্ষুভি পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথাতে।।
(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ১/২/২৫৬)
ভগবদ্ভক্তির বিকাশ হলে ভক্ত বুঝতে পারেন, সব কিছু দিয়েই ভগবানের সেবা করা যায়। যারা ভগবৎ-তত্ত্ব জানে না, তারা কৃত্রিম উপায়ে জড় বিষয়বস্তু পরিহার করার চেষ্টা করে এবং ফলস্বরূপ, যদিও তারা জড় বন্ধন থেকে মুক্তির কামনা করে, কিন্তু এই রকম শত চেষ্টা করেও তাদের হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয় না। তাদের তথাকথিত বৈরাগ্যকে বলা হয় ফল্গু অর্থাৎ অসার। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্ত জানেন কিতাবে সব কিছু ভগবানের সেবায় ব্যবহার করতে হয়; তাই তিনি আর জড় চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, নির্বিশেষবাদীদের মতে, ভগবান অথবা পরমতত্ত্ব হচ্ছেন নিরাকার, তাই তিনি খেতে পারেন না, ভোগও করতে পারেন না। সেই জন্যে নির্বিশেষবাদীরা জোড় করে ইন্দ্রিয়-দমন করবার অভিপ্রায়ে ভাল খাবার আদি সব রকমের ভোগ পরিত্যাগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম ভোক্তা এবং ভক্তিভরে যা কিছু নৈবেদ্য তাঁকে নিবেদন করা হয়, তা তিনি ভোজন করেন। তাই, ভক্ত উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য ভগবানের ভোগের জন্য নিবেদন করে, সেই নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করেন। ভক্তকে তাই জোর করে ইন্দ্রিয়-দমন করতে হয় না। এভাবেই ভগবানকে নিবেদন করার ফলে সব কিছু পবিত্র হয়ে ওঠে এবং সেই ভগবৎ-প্রসাদ গ্রহণ করার ফলে অধঃপতনের আর কোন সম্ভাবনা থাকে না। পক্ষান্তরে, নির্বিশেষবাদীরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার প্রয়াসে সব কিছুই পার্থিব বলে পরিত্যাগ করতে সচেষ্ট হয়, কিন্তু এই ধরনের কৃত্রিম বৈরাগ্যের ফলে তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। সামান্য উত্তেজনাতেই তাই তাদের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং তারা জড় জগতের আবর্তে পতিত হয়। সেই জন্যই এই সমস্ত মুক্তিকামীরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরেও, ভগবদ্ভক্তির অবলম্বন না থাকার ফলে, জড়া প্রকৃতিতে পতিত হয়।
শ্লোকঃ ৬৪
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন।
আত্মশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি ।।৬৪ ।।
রাগ- আসক্তি; দ্বেষ- বিদ্বেষ; বিমুক্তৈঃ- যিনি মুক্ত হয়েছেন; তু- কিন্তু; বিষয়ান- ইন্দ্রিয়ের বিষয়; ইন্দ্রিয়ৈঃ- ইন্দ্রিয়ের দ্বারা; চরন- আচরণ করে; আত্মবশ্যৈঃ- স্বীয় বশীভূত; বিধেয়াত্মা- সংযতচিত্ত মানুষ; প্রসাদম- ভগবানের কৃপা; অধিগচ্ছতি- লাভ করেন।
গীতার গান
অতএব রাগ দ্বেষ নাহি যার অতি।
মুক্ত যেবা হইয়াছে বিষয়ের গতি।।
চিত্ত প্রসাদে সে হয় কৃষ্ণার্পিত মন।
বিষয়ে থাকিয়া তিনি জীবন্মুক্ত হন।।
অনুবাদঃ সংযত চিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি এবং অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে ভগবানের কৃপা লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, অষ্টাংগ-যোগ, হঠযোগ আদি কৃত্রিম উপায়ে সাময়িকভাবে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা সম্ভব হলেও, ভগবানের সেবায় তাদের নিযুক্ত না করলে, প্রতি মুহূর্তে মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় ভগবানের ভক্তকে আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়াসক্ত বলে মনে হলেও, ভগবানের প্রতি নির্মল ভক্তি লাভ করার ফলে ইন্দ্রিয়-পরায়ণ কার্যকলাপের প্রতি তাঁর কোন আসক্তি থাকে না। ভগবানের প্রতি ভালোবাসা এতোই গভীর যে, আর কোন কিছুর প্রতি তাঁর আর কোন রকম মোহ থাকে না। ভগবানের প্রেমামৃত আস্বাদন অর্জন করার ফলে বিষয়-বিষের প্রতি তাঁর আর আসক্তি থাকে না। ভগবানের ভক্তের একমাত্র চিন্তা হচ্ছে, কিভাবে তিনি ভগবানের সেবা করবেন, কিভাবে ভগবানকে তুষ্ট করবেন, এছাড়া আর কোন বিষয়েই তিনি চিন্তা করেন না। তাই তিনি সমস্ত রকমের আসক্তি ও নিরাসক্তির অতীত। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছানুসারে কেবল তিনি তাঁর সমস্ত কর্তব্যকর্ম করেন। শ্রীকৃষ্ণ যদি চান, তবে তিনি এমন কাজও করেন, যার জন্য সারা জগৎ তাঁকে নিন্দা করতে পারে। আবার, শ্রীকৃষ্ণ না চাইলে তিনি তাঁর অবশ্য করণীয় কর্মও পরিত্যাগ করেন। কর্তব্যকর্ম সাধন সাধারণত নির্ভর করে আমাদের ইচ্ছার উপরে, কিন্তু কৃষ্ণভক্ত কেবল ভগবানের নির্দেশ অনুসারে তাঁর কর্তব্যকর্ম করে চলেন। ভগাবনের অহৈতুকী কৃপার ফলে ভক্ত এই ধরনের শুদ্ধ চেতনা লাভ করেন, যার ফলে কোন রকম জড় কলুষময় পরিবেশে তিনি সংশ্লিষ্ট থাকলেও কোন কলুষতা আর তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ