শ্লোকঃ ৫৯
বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্টা নিবতর্তে ।। ৫৯ ।।
বিষয়াঃ- ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বিষয়সমূহ; বিনিবর্তন্তে- নিবৃত্ত হয়; নিরাহারস্য- কৃত্রিমভাবে বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিবৃত্ত করে; দেহিনঃ- দেহীর; রসবর্জম- বিষয়রস বর্জন করে; রসঃ- ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ; অপি- যদিও; অস্য- তাঁর; পরম- উৎকৃষ্ট বস্তু; দৃষ্টা- দর্শন করে; নিবর্ততে- নিবৃত্ত হন।
গীতার গান
বৈরাগ্য করিয়া হয় বিষয়-নিবৃত্তি।
তাহা নহে স্থিতপ্রজ্ঞা স্বাভাবিক বৃত্তি।।
পরমানন্দ জানি যেবা জড়ানন্দ ছাড়ে।
স্থিতপ্রজ্ঞ সেই বীর বিষয়ে বিহারে।।
অনুবাদঃ দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু উচ্চতর স্বাদ আস্বাদন করার ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন।
তাৎপর্যঃ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত না হলে মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিত্যাগ করতে পারে না। বিধি-নিষেধের দ্বারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার পন্থা অনেকটা রোগীর বিশেষ ধরনের খাদ্যের প্রতি নিষেধাজ্ঞার মতো। রোগী সাধারণত এই সমস্ত বিধি-নিষেধ মানতে চায় না এবং তার রোগের জন্য এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য খেতে সাময়িকভাবে বিরত থাকলেও তার খাওয়ার লালসা কোনো অংশে কমে না। তেমনই, যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান আদি সমন্বিত অষ্টাঙ্গ-যোগের মতো কিছু পারমার্থিক পদ্ধতির দ্বারা যে ইন্দ্রিয় সংযম, তা উন্নত জ্ঞানহীন, অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় প্রগতি সাধনের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কন্দর্প-কোটি রমণীয় রূপকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাঁর আর নিষ্প্রাণ জড় বস্তুর প্রতি কোন রকম রুচি থাকে না। তাই, অধ্যাত্ম-মার্গের প্রাথমিক স্তরেই কেবল বিধি-নিষেধের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে হয়, কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় যতক্ষন রুচি না হয়, ততক্ষণ এই বিধি-নিষেধ মঙ্গলজনক হয়। যখন কেউ প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি আপনা থেকেই ইতর বস্তুর প্রতি তাঁর রুচি হারিয়ে ফেলেন।
শ্লোকঃ ৬০
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপচিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমথীনি হরস্তি প্রসভং মনঃ ।। ৬০ ।।
যততঃ- যত্নশীল; হি- যেহেতু; অপি- সত্ত্বেও; কৌন্তেয়- হে কুন্তীপুত্র; পুরুষস্য- মানুষের; বিপশ্চিতঃ- বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন; ইন্দ্রিয়াণি- ইন্দ্রিয়সমূহ; প্রমাথীনি- চিত্ত বিক্ষেপকারী; হরস্তি- হরণ করে; প্রসভম- বলপূর্বক; মনঃ- মনকে।
গীতার গান
আত্মার সম্পর্ক নাই বৈরাগ্যের যতন।
পণ্ডিত হলেও তার প্রসভিত মন।।
প্রমাথী ইন্দ্রিয় তাকে বিষয়েতে ফেলে।
শুষ্ক বৈরাগীর লাগে আগুন কপালে।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়সমূহ এতোই বলবান এবং ক্ষোভকারী যে, তারা অতি যত্নশীল বিবেকসম্পন্ন পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে।
তাৎপর্যঃ অনেক ঋষি, মুনি ও অধ্যাত্মবাদী আছেন, যারা ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক সময় তাঁদের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং তাঁরা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে পড়েন। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মতো যোগী, যিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করবার জন্য গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন, তিনিও স্বর্গের অপ্সরা মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে কামান্ধ হয়ে অধঃপতিত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই রকম অনেক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণভক্তি ছাড়া মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করা অত্যন্ত কঠিন। মনকে শ্রীকৃষ্ণে নিয়োজিত না করে, কেউই এই প্রকার জাগতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত হতে পারে না। একটি কার্যকর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে মহাসাধক ও ভগবদ্ভক্ত শ্রীযানুচার্য বলেছেন-
যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে
নবনবরসধামন্যুদ্যতং রমত্তুমাসীৎ।
তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্ষমাণে
ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠাবনং চ।।
“আমার মন এখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণাবিন্দের সেবায় নিয়োজিত হয়েছে এবং আমি প্রতি নিয়তই নব নব অপ্রাকৃত রসের আস্বাদন করছি। এখন কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কথা মনে হলেই আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে এবং আমি সেই চিন্তার উদ্দেশ্যে থুথু ফেলি।”
কৃষ্ণভক্তি এমনই এক অপ্রাকৃত আনন্দে পরিপূর্ণ যে, এর স্বাদ একবার পেলে জড় সুখভোগের প্রতি আর কোন আকর্ষণ থাকে না। নানা রকম সুস্বাদু খাবার খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি হলে যেমন আর আজেবাজে জিনিস খাবার ইচ্ছা থাকে না, তেমনই কৃষ্ণভক্তির স্বাদে পরিতৃপ্ত মন আর কিছুই চায় না। ক্রিষ্ণভক্তি আস্বাদন করার পর মন আপনা থেকেই শান্ত হয়ে যায় এবং কোন অবস্থাতেই তা আর বিচলিত হয় না। তাই আমরা দেখতে পাই, মহারাজ অম্বরীষকে বিনাশ করতে উদ্যত হলে, মহা-তেজস্বী মুনি দুর্বাসার প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং অবশেষে তিনি মহারাজ অম্বরীষের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রাণ রক্ষা করেন। কারণ, মহারাজ অম্বরীষের মন কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন ছিল (স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োর্বচাংসি বৈকুন্ঠগুণানুবর্ণনে)।
শ্লোকঃ ৬১
তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।। ৬১ ।।
তানি- সেই ইন্দ্রিয়সমূহ; সর্বাণি- সমস্ত; সংযম্য- সংযত করে; যুক্তঃ- যুক্ত হয়ে; আসীত- অবস্থিত হয়ে; মৎপরঃ- আমার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত; বশে- সম্পূর্ণরূপে বশীভূত; হি- অবশ্যই; যস্য- যার; ইন্দ্রিয়াণি- ইন্দ্রিয়সমূহ; তস্য- তাঁর; প্রজ্ঞা- জ্ঞান; প্রতিষ্ঠিতা- প্রতিষ্ঠিত।
গীতার গান
কৃষ্ণসেবা যুক্ত হয় ইন্দ্রিয় সংযত।
ইন্দ্রিয় সে বশ হয় প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত।।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে সংযত করে আমার প্রতি উত্তমা ভক্তিপরায়ণ হবে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করেছেন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
তাৎপর্যঃ ভক্তিযোগই যে শ্রেষ্ঠ যোগ তা এখানে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণভক্তি ছাড়া ইন্দ্রিয়কে সংযত করা যায় না। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মহা তেজস্বী দুর্বাসা মুনি অকারণে মহারাজ অম্বরীষের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয় সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন। পক্ষান্তরে, মহারাজ অম্বরীষ দুর্বাসার মতো শক্তিশালী তপস্বী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। অন্তরে ভগবানের ধ্যানে মগ্ন থেকে তিনি দুর্বাসার সমস্ত অত্যাচার ও অপমান নীরবে সহ্য করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর জয় হয়েছিল। শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/৪/১৮-২০) বর্ণিত নিম্নোক্ত গুণাবলীর অধিকারী হবার ফলেই মহারাজ অম্বরীষ তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন-
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
র্বচাংসি বৈকুন্ঠগুণানুবর্ণনে।
করৌ হরেমন্দিরমামার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসংকথোদয়ে।।
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌ
তদভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমত্তুলস্যা রসনাং তদর্পিতে।।
পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে
শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে।
কামং চ দাস্যে ন তু কামকাম্যয়া
যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ।।
“মহারাজ অম্বরীষ তাঁর মনকে শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের ধ্যানে, তাঁর বাণী দিয়ে বৈকুন্ঠের গুণ বর্ণনায়, তাঁর হাত দিয়ে তিনি ভগবানের মন্দির মার্জনে, তাঁর কান দিয়ে ভগবানের লীলা শ্রবণে, তাঁর চোখ দিয়ে ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপ দর্শনে, তাঁর দেহ দিয়ে ভক্তদেহ স্পর্শনে, তাঁর নাক দিয়ে ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণে, তাঁর জিহ্বা দিয়ে ভগবানকে অর্পিত তুলসীর স্বাদ আস্বাদনে, তাঁর পদদ্বয় দ্বারা যেখানে ভগবানের মন্দির বিরাজমান সেই সব তীর্থস্থানে ভ্রমণে, তাঁর মস্তক দিয়ে ভগবানকে প্রণতি নিবেদনে এবং তাঁর কামনা দিয়ে ভগবানের মৎপর ভক্ত করে তোলে।”
এখানে মৎপর শব্দটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কিভাবে মৎপর হওয়া যায়, তা মহারাজ অম্বরীষের আচরণের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। মৎপর পরম্পরায় আচার্য মহাপণ্ডিত শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ মন্তব্য করেছেন। মদ্ভক্তিপ্রভাবেন সর্বেন্দ্রিয়বিজয়পূর্বিকা স্বাত্মদৃষ্টিঃ সুলভেতি ভাবঃ। “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার মাধ্যমেই কেবল ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণভাবে সংযত করা যায়।” তা ছাড়া, কখনো কখনো আগুনের দৃষ্টান্তের দেওয়া হয়- “একটি আগুনের শিখা যেমন একটি ঘরের মধ্যে সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে, তেমনই যোগীর হৃদয়ে অবস্থিত ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর অন্তর থেকে সব রকমের কলুষতা দহন করেন।” যোগসূত্রেও ধ্যানের প্রণালী বর্ণনা করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে ধ্যান করতে। শূন্যকে ধ্যান করার কোন কথাই বলা হয়নি। য্র সমস্ত তথাকথিত যোগী শ্রীবিষ্ণু ছাড়া অন্য কিছুর ধ্যান করে, তারা কোন অলীক ছায়ামূর্তির দর্শন করার আশায় অনর্থক সময় নষ্ট করে থাকে। কিন্তু যারা পরমার্থ সাধনের প্রয়াসী, তাঁরা কেবল ভগবদ্ভক্তিই আকাঙ্ক্ষা করেন- সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। এটিই হচ্ছে যোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ