শ্লোকঃ ৪
অর্জুন উবাচ
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজারহাবরিসূদন ।। ৪ ।।
অর্জুনঃ উবাচ- অর্জুন বললেন; কথম- কিভাবে; ভীষ্মম- ভীষ্ম; অহম- আমি; সংখ্যে- যুদ্ধে; দ্রোণম- দ্রোণাচার্য; চ- ও; মধুসূদন- হে মধুসূদন- হে মধুহন্তা; ইষুভিঃ- বাণের দ্বারা; প্রতিযোৎস্যামি- প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব; পূজাহৌ- পূজনীয়; অরিসূদন- হে শত্রুহন্তা।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
মধুসূদন। কি আজ্ঞা কর তুমি মোরে।
ভীষ্ম দ্রোণ গুরুজন তারে মারিবারে।।
পূজার যোগ্য যে তাঁরা হন নিত্যকাল।
তাঁদের শরীরে বাণ সুতীক্ষ্ণ ধারাল।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে অরিসূদন। হে মধুসূদন! এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো পরম পূজনীয় ব্যক্তিদের কেমন করে আমি বাণের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব?
তাৎপর্যঃ পিতামহ ভীষ্ম ও শিক্ষক দ্রোণাচার্যের মতো গুরুজনেরা সর্বদাই পূজনীয়। এমন কি যদি তাঁরা আক্রমণও করেন, তবুও তাঁদের প্রতি-আক্রমণ করা উচিত নয়। সাধারণ শিষ্টাচার হচ্ছে যে, গুরুজনদের প্রতি এমন কি মৌখিক তর্কযুদ্ধ করাও উচিত নয়। এমন কি তাঁদের আচরণ যদি কখনও কখনও রূঢ়ও হয়, তবুও তাঁদের প্রতি রূঢ়ভাবে আচরণ করা উচিত নয়। তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ করা অর্জুনের পক্ষে কি করে সম্ভব? শ্রীকৃষ্ণ কি কখনও তাঁর পিতামহ উগ্রসেন অথবা তাঁর গুরুদেব সান্দীপনি মুনিকে আক্রমণ করতে সমর্থ হবেন? অর্জুন যুদ্ধ থেকে বিরত হবার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে এই রকম যুক্তি প্রদর্শন করলেন।
শ্লোকঃ ৫
গুরূনহত্বা হই মহানুভাবান
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব
ভুঞ্জীয় ভোগান রুধিরপ্রদিগ্ধান ।। ৫ ।।
গুরূন- গুরুজনেরা; অহত্বা- হত্যা না করে; হই- অবশ্যই; মহানুভাবান- মহান আত্মাগণ; শ্রেয়ঃ- শ্রেয়; ভোক্তুম- ভোগ করা; ভৈক্ষ্যম- ভিক্ষার দ্বারা; অপি- ও; ইহ- এই জীবনে; লোকে- এই জগতে; হত্বা- হত্যা করে; অর্থ- লাভ; কামান- কামনা করে; তু- কিন্তু; গুরূন- গুরুজনদের; ইহ- এই জগতে; এব- অবশ্যই; ভুঞ্জীয়- ভোগ করতে হবে; ভোগান- ভোগ্যবস্তু; রুধির- রক্ত; প্রদিগ্ধান- মাখা।
গীতার গান
শুধু গুরু নহে তাঁরা, মহানুভব হয় যারা,
হত্যা করি তাঁদের সবারে।
তদপেক্ষা ভিক্ষা ভাল, কাটিয়ে যাইবে কাল,
মিথ্যা যুদ্ধ করাও আমারে।।
হত্যা এই মহাকাম, বিধি যে হইল বাম,
এই যুদ্ধে গুরু হত্যা হবে।
সে ভোগ রুধিরমাখা, কেমনে করিব সখা,
সে যুদ্ধ কে করিয়াছে কবে।।
অনুবাদঃ আমার মহানুভব শিক্ষাগুরুদের জীবন হানি করে এই জগৎ ভোগ করার থেকে বরং ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ভাল। তাঁরা পার্থিব বস্তুর অভিলাষী হলেও আমার গুরুজন। তাঁদের হত্যা করা হলে, যুদ্ধলব্ধ সমস্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের রক্তমাখা হবে।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রনীতি অনুসারে, যে গুরু জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়েছে এবং ভাল-মন্দ বিচারবোধ হারিয়ে ফেলেছে, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। দুর্যোধনের কাছ থেকে অর্থ-সাহায্য পেতেন বলে ভীষ্ম ও দ্রোণ তার পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও কেবলমাত্র আর্থিক সাহায্য পাবার ফলে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেওয়া তাঁদের উচিত হয়নি। এই অনুচিত কার্য করার ফলে, তাঁরা পান্ডবদের পরমারাধ্য শিক্ষাগুরুর পদের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতি অর্জুনের শ্রদ্ধা কোন অংশে হ্রাস পায়নি এবং অর্জুন এই কথা ভেবে মনে মনে শিহরিত হয়েছেন যে, জাগতিক সুখ উপভোগ করার জন্য তাঁদের হত্যা করা হলে, সেই ভোগ হবে তাঁদের রুধিরমাখা।
শ্লোকঃ ৬
ন চৈতদ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস
তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ ।। ৬ ।।
ন- না; চ- ও; এতৎ- এই; বিদ্মঃ- আমরা জানি; কতরৎ- যা; নঃ- আমাদের; গরীয়ঃ- শ্রেয়ঃ; যৎ- যা; বা- অথবা; জয়েম- জয় করি; যদি- যদি; বা- অথবা; নঃ- আমাদের; জয়েয়ু- জয় করা হয়; যান- যারা; এব- অবশ্যই; হত্বা- হত্যা করে; ন- না; জিজীবিষামঃ- জীবন ধারণের ইচ্ছা করি; তে- তারা সকলে; অবস্থিতাঃ- অবস্থিত; প্রমুখে- সম্মুখে; ধার্তরাষ্ট্রাঃ- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ।
গীতার গান
বুঝিতে পারি না ভাল, কোথায় গরিমা হল,
কোন কার্য জুয়ায় আমায়।
কিবা আমি জয় করি, কিংবা আমি নিজে মরি,
দুই নৌকা আমারে নাচায়।।
যাদের মারিয়া রণে, বাঁচিব সে অকারণে,
তারা সব আমার সম্মুখে।
ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ, আর যত বন্ধুজন,
মরিলে সে হবে মোর দুঃখ।।
অনুবাদঃ তাদের জয় করা শ্রেয়, না তাদের দ্বারা পরাজিত হওয়া শ্রেয়, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করি, তা হলে আমাদের আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। তবুও এই রণাঙ্গনে তারা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ যুদ্ধ করাটা যদিও ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, তবুও অর্জুন স্থির করতে পারছিলেন না যে, সেই অনর্থক হিংসাত্মক যুদ্ধে রত হবেন, না কি ভিক্ষা বৃত্তি গ্রহণ করে জীবন ধারণ করবেন। তিনি যদি তাঁর শত্রুদের পরাজিত না করেন, তা হলে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না। আর তা ছাড়া, যুদ্ধে যে কোন পক্ষের জয় হবে, তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। যুদ্ধে পান্ডবদের জয় হলেও (কারণ, তাঁদের দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত) ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অবর্তমানে জীবন ধারণ করা তাঁদের পক্ষে নিতান্ত দুর্বিষহ হবে বলে অর্জুন মনে করেছিলেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে সেটিও তাদের পক্ষে এক রকম পরাজয়। অর্জুনের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিবেচনা অবধারিতভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল মহৎ ভগবদ্ভক্তই ছিলেন না, তিনি গভীর তত্ত্বজ্ঞান-সম্পন্ন পুরুষ ছিলেন এবং তিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সর্বতোভাবে সংযত করেছিলেন। যদিও তিনি রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেো তিনি ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে জীবন ধারণ করতে মনস্ত করেছিলেন। এর মাধ্যমেও আমরা দেখতে পাই যে, অন্তরে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনাসক্ত। এই সমস্ত সদগুণাবলী এবং তাঁর গুরুদেব শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্মবাক্যের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠা, এই দুইয়ের সমন্বয়ের ফলে তিনি ছিলেন প্রকৃত ধার্মিক। আমরা এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মুক্তি লাভের জন্য অর্জুন সম্পূর্ণরূপে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। ইন্দ্রিয় যদি সংযত না হয়, তবে দিব্যজ্ঞান উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। এই দিব্যজ্ঞান ও ভক্তি ছাড়া জড় জগতের বন্ধন থেকে কোন রকমেই মুক্ত হওয়া যায় না। অর্জুন এই সমস্ত গুণাবলীর দ্বারা ভূষিত ছিলেন এবং সেই সঙ্গে ছিল জাগতিক সম্পর্কিত অস্বাভাবিক গুণাবলী।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ