শ্লোকঃ ৫৬

দুঃখেষনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।

বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে ।। ৫৬ ।।

দুঃখেষু- ত্রিতাপ দুঃখে; অনুদ্বিগ্নমনাঃ- উদ্বেগশূন্য চিত্ত; সুখেষু- সুখে; বিগতস্পৃহঃ- স্পৃহাশূন্য; বীত- মুক্ত; রাগ- আসক্তি; ভয়- ভয়; ক্রোধঃ- ক্রোধ; স্থিতধীঃ- স্থিতপ্রজ্ঞ; মুনিঃ- মননশীল ব্যক্তি; উচ্যতে- বলা হয়।

গীতার গান

দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা সুখে নাহি স্পৃহা।

নিজ সেবাকার্যে যার একমাত্র ঈহা।।

বীতরাগ শোক ভয় ক্রোধ নাহি যার।

সে জন স্থিতধী মুনি বিদিত সবার।।

অনুবাদঃ ত্রিতাপ দুঃখ উপস্থিত হলেও যার মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যার স্পৃহা হয় না এবং যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনিই স্থতিধী অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ।

তাৎপর্যঃ মুনি তাঁকে বলা হয়, যিনি কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে নানা রকম অনুমান করবার জন্য মনকে নানাভাবে আলোড়িত করতে পারেন। তাই বলা হয় যে, ‘নানা মুনির নানা মত।‘ কোন মুনির মত যদি অন্য মুনি থেকে স্বতন্ত্র না হয়, তবে তাঁকে যথার্থ মুনি বলা যায় না। নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম (মহাভারত, বনপর্ব ৩১৩/১১৭)। কিন্তু ভগবান এখানে বলেছেন, স্থিতধীমুনি সাধারণ মুনিদের থেকে ভিন্ন। স্থিতধীমুনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন, কেন না তিনি জল্পনা-কল্পনামূলক সমস্ত কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি করেছেন। তাঁকে বলা হয় প্রশান্ত-নিঃশেষ-মনোরথান্তর (ত্রোস্তরত্ন, ৪৩), অথবা যিনি জল্পনা-কল্পনার স্তর অতিক্রম করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, বসুদেব-তনয় ভগবান বাসুদের বা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছু (বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সদুর্লভঃ)। তাঁকে বলা হয় মুনি, যার মন একনিষ্ঠ। এই ধরনের কৃষ্ণভাবনায় ভগবদ্ভক্তকে জড় জগতের ত্রিতাপ ক্লেশের কোন আক্রমণই আর বিচলিত করতে পারে না। কারণ, তিনি সব রকমের দুঃখ-দুর্দশাকে ভগবানের আশীর্বাদ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, তাঁর পূর্বকৃত অসৎ কর্মের ফলস্বরূপ আরও দুঃখ-দুর্দশা তাঁর একমাত্র প্রাপ্য, কিন্তু ভগবানের অহৈতুকী করুণার ফলে তাঁর সেই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার ভার অনেক লাঘব হয়ে গেছে। তেমনই, যখন তাঁর সুখানুভূতি হয়, তখন তিনি নিজেকে সেই সুখের অযোগ্য বলেই মনে করেন; তিনি ভাবেন, ভগবানের কৃপাতেই তিনি ঐ রকম সুখপ্রদ অবস্থায় রয়েছেন এবং ভগাবনের সেবায় তাই আরও বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে পারছেন। ভগবানের সেবা করবার জন্য তিনি সব সময়ই সংসাহসী ও তৎপর এবং কোন রকম আসক্তি বা বিরক্তি তাঁকে সেই সেবা থেকে বিরত করতে পারে না। নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার আকাঙ্ক্ষাকে বলা হয় আসক্তি এবং এই ধরনের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে বলা হয় বিরক্তি। কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনায় অবিচলিত, তাঁর কোন কিছুর প্রতি আসক্তিও নেই, বিরক্তিও নেই, কেননা ভগবানের সেবায় তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন। তাই তাঁর কোন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ক্রোধান্বিত হন না। সফল হন বা ব্যর্থই হন, তিনি তাঁর সংকল্পে সর্বদাই একনিষ্ঠ।

শ্লোকঃ ৫৭

যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম।

নাভিনন্দিত ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।। ৫৭ ।।

যঃ- যিনি; সর্বত্র- সর্বত্র; অনভিস্নেহঃ- আসক্তি বর্জিত; তৎ তৎ- সেই সেই; প্রাপ্য- লাভ করে; শুভ- ভাল; অশুভম- খারাপ; ন- না; অভিনন্দিত- প্রশংসা করেন; ন- না; দ্বেষ্টি- দ্বেষ করেন; তস্য- তাঁর; প্রজ্ঞা- পূর্ণ জ্ঞান; প্রতিষ্ঠাতা- প্রতিষ্ঠিত।

গীতার গান

দেহস্মৃতি নাহি যার শুভাশুভ কিবা তাঁর।

সর্বত্র অনভিস্নেহ লোক ব্যবহার।।

অভিনন্দ দ্বেষ নাই সর্ব হইতে রত।

তাঁহার জানিও প্রজ্ঞা স্থির প্রতিষ্ঠিত।।

অনুবাদঃ জড় জগতে যিনি সমস্ত জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, যিনি প্রিয় বস্তু লাভে আনন্দিত হন না এবং অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে দ্বেষ করেন না, তিনি পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

তাৎপর্যঃ জড় জগতে সব সময়ই নানা রকম উত্থান-পতন ঘটে চলেছে, সেগুলি কখনো শুভ বা অশুভ হতে পারে। যিনি এই ধরনের উত্থান-পতনে বিচলিত হন না, যিনি ভাল-মন্দে প্রভাবিত হন না, তাঁকেই কৃষ্ণভাবনায় অবিচলিত বলে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ জড় জগতে থাকলে সব সময়েই শুভ-অশুভ সম্ভাবনা থাকে, কারণ জড় জগৎটাই এই জগৎটাই এই দ্বন্দ্বভাবের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় একনিষ্ঠ ভক্তে কখনই এই শুভ-অশুভ দ্বন্দ্বের দ্বারা প্রভাবিত হন না, কারণ তিনি সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় মগ্ন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এই অনুরাগের ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ অপ্রাকৃত অবস্থায় অধিষ্ঠিত হন, যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘সমাধি’।

শ্লোকঃ ৫৮

যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।

ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠাতা।।

যথা- যখন; সংহরতে- প্রত্যাহার করেন; চ- এবং; অয়ম- তিনি; কূর্মঃ- কচ্ছপ; অঙ্গানি- অঙ্গসমূহ; ইব- যেমন; সর্বশঃ- সর্বতোভাবে; ইন্দ্রিয়ানি- ইন্দ্রিয়ানিসমূহ; ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় থেকে; তস্য- তাঁর; প্রজ্ঞা- চেতনা; প্রতিষ্ঠাতা- প্রতিষ্ঠিত।

গীতার গান

গোদাস ইন্দ্রিয়সুখে বিচলিত সদা।

গোস্বামী হয়েছে ধীরত আত্মাতে সর্বদা।।

তাই সে ইন্দ্রিয় সব কূর্ম অঙ্গ মত।

ইন্দ্রিয় ভোগার্থ সদা বিষয়ে বিরত।।

অতএব জানি তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত। সে জন উপাধিমুক্ত গোস্বামী বিদিত।।

অনুবাদঃ কূর্ম যেমন তার অঙ্গসমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সংকুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।

তাৎপর্যঃ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞানী, যোগী অথবা ভগবদ্ভক্তের লক্ষণ হচ্ছে, তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে পারেন। অধিকাংশ মানুষই তাদের ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে অর্থাৎ তাদের ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। প্রকৃত যোগীকে এভাবে চিনতে পারা যায়। ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষধর সর্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সাধারাণ অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলি স্বেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, কিন্তু সাপুড়ে যেমন সাপকে পোষ মানায়, যোগী বা ভগবদ্ভক্ত ঠিক তেমনভাবে তাঁদের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত করেন। তিনি তাদের কখনোই স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে দেন না। শাস্ত্রে কর্তব্য-অকর্তব্য, বিধি-নিষেধের নির্দেশগুলি আচরণ করার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত না করতে পারলে, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে ভগবদ্ভক্তি সাধন করা যায় না। এই সম্বন্ধে এখানে খুব সুন্দরভাবে কূর্মের উদাহরণ দেওয়া আছে। কূর্ম যে-কোন সময় তার হাত-পা, মাথা আদি অঙ্গগুলি তার খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিতে পারে, আবার প্রয়োজন হলে তাদের বার করে আনতে পারে। ঠিক তেমনই, কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত ভগবানের বিশেষ প্রয়োজনেই তার ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রয়োগ করেন, আর অন্য সময় তাদের গুটিয়ে রাখেন। এভাবেই ইন্দ্রিয়-দমন করার মধ্যমে একাগ্রচিত্তে ভগবানের সেবা করা যায়। অর্জুনকে এখানে সেভাবেই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তিনি নিজের তৃপ্তি-সাধনের জন্য তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে কাজে না লাগিয়ে ভগবানের সেবায় তা নিয়োগ করেন। ভগবানের সেবায় কিভাবে সর্বদা ইন্দ্রিয়াদি নিয়োজিত রাখতে হয়, কূর্মের দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বোঝানো হয়েছে। কূর্মের মতো ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x