শ্লোকঃ ৫০

বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।

তস্মাদ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম ।। ৫০ ।।

বুদ্ধিযুক্তঃ- যিনি ভগবানের সেবায় যুক্ত; জহাতি- মুক্ত হতে পারে; ইহ- এই জীবনে; উভে- উভয়; সুকৃত-দুষ্কৃতে- পুণ্য ও পাপ; তস্মাৎ- সে জন্য; যোগায়- নিষ্কাম কর্মযোগের জন্য; যুজ্যস্ব- যুক্ত হও; যোগঃ- কৃষ্ণভক্তি; কর্মসু- সমস্ত কর্মের; কৌশলম- কৌশল।

গীতার গান

বুদ্ধিযোগ দ্বারা কর্ম সু]কৃতি যে ফল।

দুষ্কৃতি বা ফলে যাহা করয়ে নির্মল।।

অতএব তুমি সেই যোগে যুদ্ধ কর।

কর্মের কৌশল এই বুদ্ধিযোগ ধর।।

অনুবাদঃ যিনি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তিনি এই জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় থেকেই মুক্ত হন। অতএব, তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর। সেটিই হচ্ছে সর্বাঙ্গীণ কর্মকৌশল।

তাৎপর্যঃ স্মরণাতীত কাল ধরে প্রতিটি জীব তার শুভ  অশুভ কর্মের ফল সঞ্চয় করছে। এই কর্মফলের জন্যই সে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে এবং জড়-জাগতিক ক্লেশের দ্বারা জর্জরিত হচ্ছে। অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলেই জীব তার স্বরূপ ভুলে গেছে। এই দুঃখদায়ক অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় হচ্ছে, গীতায় নির্দেশিত ভগবানের উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করে তাঁর সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করা। তা হলে আমাদের অজ্ঞতার আবরণ উন্মোচিত হবে এবং জন্ম-জন্মান্তরে কর্ম ও কর্মফলের শৃঙ্খলায়িত শাস্তিযোগের কবল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। সেই জন্য, সকল কর্মফলের প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ করে তোলার পন্থাস্বরূপ কৃষ্ণভাবনাময় কর্মে নিযুক্ত থাকতে অর্জুনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শ্লোকঃ ৫১

কর্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্তা মনীষিণঃ।

জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম ।। ৫১ ।।

কর্মজম- কর্মজাত; বুদ্ধিযুক্তাঃ- ভগবদ্ভক্তিতে যুক্ত হয়ে; হি- নিশ্চয়ই; ফলম- ফল; ত্যক্তা- ত্যাগ করে; মনীষিণঃ- মহর্ষিগণ অথবা ভগবদ্ভক্তগণ; জন্মবন্ধ- জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে; বিনির্মুক্তাঃ- মুক্ত হয়ে; পদম- পদ; গচ্ছন্তি- লাভ করেন; অনাময়ম- দুঃখ-দুর্দশা রহিত।

গীতার গান

মনীষী যেই সে কর্ম বুদ্ধিযোগ দ্বারা।

ত্যাগেতে সমর্থ হয় কর্মফল সারা।।

জন্মবন্ধ বিনির্মক্ত সেই কর্মযোগী।

অনাময় পদ প্রাপ্ত হয় সেই ত্যাগী।।

অনুবাদঃ মনীষিগণ ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জম্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এভাবে তাঁরা সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার অতীত অবস্থা লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ জড়-জগতের দুঃখ-দুর্দশা যেখানে নেই, মুক্ত পুরুষেরা সেখানেই অবস্থান করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/৫৮) বলা হয়েছে-

সমাশ্রিতা যে পদপল্লবপ্লবং

মহৎপদং পুণ্যযশো মুরারেঃ।

ভবাম্বুধির্বৎসপদং পরং পদং

পদং পদং যদ বিপদাং ন তেষাম।।

“পরমেশ্বর ভগবান, যিনি সব কিছুর আশ্রয় এবং যিনি মুক্তিদাতা মুকুন্দ নামে খ্যাত, তাঁর পদপল্লবরূপ তরণীর আশ্রয় যিনি গ্রহণ করেছেন, তিনি অনায়াসে এই ভবসমুদ্র উত্তীর্ণ হন। তাঁর কাছে এই ভবসমুদ্র গোষ্পদতুল্য। পরং পদ বা যেখানে জড় জাগতিক ক্লেশ নেই, অর্থাৎ বৈকুন্ঠ হচ্ছে তাঁর গন্তব্যস্থল। যে জগতে প্রতি পদক্ষেপে বিপদ, সেখানে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না।“

আমাদের অজ্ঞতার জন্য আমরা বুঝতে পারি না যে, এই জড় জগত প্রতি পদক্ষেপে দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। এখানে প্রতি পদক্ষেপেই বিপদ। কিন্তু অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা মনে করে নানা রকম জাগতিক প্রচেষ্টার দ্বারা প্রকৃতির প্রতিকূলতার নিরসন করে তারা সুখী হবে। তারা জানে না, এই জড় জগতে কোন জীবই জন্ম-মৃত্যু-জড়া-ব্যাধি আদি ক্লেশের থেকে রেহাই পেতে পারে না। কিন্তু যে মানুষ তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি ভগবানের নিত্যদাস, তিনি তখন ভক্তিযোগের পথ অবলম্বন করে ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার ফলে তিনি বৈকুন্ঠলোকে উত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা অর্জন করেন, যেখানে জড়-জাগতিক ক্লেশ এবং মৃত্যু ও কালের প্রভাব নেই। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভগবানের মহিমান্বিত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। ভ্রান্তিবশত যে মানুষ মনে করে, ভগবান ও সে একই স্তরে অবস্থিত, অর্থাৎ যে মানুষ মনে করে, সে-ই ভগবান, তার পক্ষে ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করা কখনোই সম্ভব নয়। অহংকারের দ্বারা বিমূঢ় হয়ে সে নিজেকে সর্ব কারণের কারণ বলে মনে করে জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে আরও গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়। ভক্তিযুক্ত ভগবৎ-সেবা ছাড়া আর কোন উপায়েই জড় বন্ধন মুক্ত হয়ে বৈকুন্ঠে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এই ভগবৎ-সেবাকে বলা হয় কর্মযোগ বা বুদ্ধিযোগ, অথবা সরল ভাষায় এঁকে বলা হয় ভক্তিযোগ।

শ্লোকঃ ৫২

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিয্যতি।

তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ ।। ৫২ ।।

যদা- যখন; তে- তোমার; মোহ- মোহ; কলিলম- গভীর অরণ্য; বুদ্ধিঃ- বুদ্ধি; ব্যতিতরিয্যতি- অতিক্রম করে; তদা- সেই সময়; গন্তাসি- প্রাপ্ত হবে; নির্বেদম- বিতৃষ্ণা; শ্রোতব্যস্য- শ্রোতব্য; শ্রুতস্য- ইতিপূর্বে যা শোনা হয়ে গেছে; চ- এবং।

গীতার গান

যখন তোমার মন বুদ্ধিযোগ দ্বারা।

মোহরূপ কর্দমাক্ত হয়ে যাবে পারা।।

তখন নির্বেদ সব হয়ে যাবে কাম।

শ্রুতির শ্রোতব্য তব নাহি রবে ধাম।।

অনুবাদঃ এভাবে পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হতে পারবে।

তাৎপর্যঃ ভগবানের মহান ভক্তদের অনেক সুন্দর দৃষ্টান্ত আছে, যারা কেবলমাত্র ভগবদ্ভক্তি গ্রহণ করার ফলে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠেন। যখন কোন ব্যক্তি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে চিরশাশ্বত সম্পর্ক সম্বন্ধে অবগত হয়, সে স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক কর্মকান্ডের অনুষ্ঠানের প্রতি সম্পূর্ণরূপে উদাসীন হয়, এমন কি সে যদি অভিজ্ঞ ব্রাক্ষ্মণও হয়। মহাভাগবত ও গুরুপরম্পরা ধারায় আচার্য শ্রীমাধবেন্দ্রপুরী বলেছেন –

সন্ধ্যাবন্দন ভদ্রমস্তু ভবতো ভোঃ স্নান তুভ্যং নমো

ভো দেবাঃ পিতরশ্চ তর্পণবিধৌ নাহং ক্ষমঃ ক্ষম্যতাম।

যত্র কাপি নিষদ্য যাদবকুলোত্তমস্য কংসদ্বিষঃ

স্মারং স্মারং অঘং হরামি তদলং মন্যে কিমন্যেন  মে।।

“হে ভগবান! ত্রিসন্ধ্যায় আমি তোমাকে বন্দনা করি, তোমার জয় হোক। হে দেবতাগণ। হে পিতৃগণ। স্নানান্তে আমি আর তোমাদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে পারি না। আমার এই অক্ষমতা তোমরা ক্ষমা কর। এখন আমি যেখানেই অবস্থান করি না কেন, আমি যদুকুলশ্রেষ্ঠ কংসারি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি এবং তার ফলে আমি সমস্ত পাপবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি। আমার মনে হয়, এটিই আমার পক্ষে যথেষ্ট।“

পারমার্থিক মার্গে যারা কনিষ্ঠ অধিকারী, তাঁদের পক্ষে বেদের নির্দেশ অনুযায়ী বিবিধ আচার-অনুষ্ঠান পালন করা একান্ত প্রয়োজন; যেমন –খুব সকালে স্নান করা, পিতৃ-পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা, ত্রিসন্ধ্যায় মন্ত্র উচ্চারণ করা আদি। কিন্তু কৃষ্ণগত প্রাণ হয়ে যিনি ভক্তিসহকারে ভগবানের সেবা করেন, তাঁকে আর কোন আচার-অনুষ্ঠানের বিধি পালন করতে হয় না, কারণ তিনি ইতিমধ্যেই সমস্ত সাধনার পরম সিদ্ধি লাভ করেছেন। শাস্ত্রে যে সমস্ত তপশ্চর্যা, যাগযজ্ঞ, বিধিনিষেধের আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের কৃপা লাভ করে তার পদারবিন্দে সম্পূর্ণভাবে আত্মোৎসর্গ করা। তাই, ভগবানের সেবায় যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁকে আর সেই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের শরণ নিতে হয় না। সেই রকম, বেদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা, সেই কথা না জেনে যারা অন্ধের মতো আচার-অনুষ্ঠান আদিতে নিয়োযিত হয়, তারা অনর্থক সময় নষ্ট করে চলেছে। যে মানুষ ভগবদ্ভক্তি লাভ করেছেন, তিনি শব্দব্রক্ষ্মের স্তর উত্তীর্ণ হয়েছেন, অর্থাৎ তাঁর কাছে বেদ, উপনিষদের আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x