শ্লোকঃ ৪৪
ভোগৈশ্চর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে ।। ৪৪ ।।
ভোগ- জড় সুখভোগে; ঐশ্চর্য- ঐশ্চর্যে; প্রসক্তানাম- যারা গভীরভাবে আসক্ত; তয়া- তাদের দ্বারা; অপহৃতচেতসাম- বিমূঢ়চিত্ত; ব্যবসায়াত্মিকা- দৃঢ়চিত্ত, নিশ্চয়াত্মিকা; বুদ্ধিঃ- ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবা; সমাধৌ- সংযতচিত্ত; ন- না; বিধীয়তে- হয় না।
গীতার গান
ভোগৈশ্চর্যে আসক্ত যে পাগলের মত।
নিজেকে হারিয়া বসে আশা শত শত।।
তারা নাহি বুঝে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি।
আসক্তি তাদের শুধু ভুক্তি মুক্তি সিদ্ধি।।
অনুবাদঃ যারা ভোগ ও ঐশ্চর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মূঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না।
তাৎপর্যঃ চিত্ত যখন একাগ্র হয়, তখন তাকে বলা হয় সমাধি। বৈদিক অভিধান নিরুক্তিতে বলা হয়েছে, সম্যগাধীয়তেহস্মিন্নাত্মতত্ত্বথাত্ম্যম- “মন যখন আত্মাকে উপলব্ধি করার জন্য একাগ্র হয়, তাকে তখন বলা হয় সমাধি।“ যে মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ উপলব্ধি করতে উৎসুক এবং যারা অনিত্য জড় জগতের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন, তাদের পক্ষে একাগ্রচিত্তে আত্ম-উপলব্ধি বা সমাধি লাভ করা অসম্ভব। মায়া তাদের এত গভীরভাবে বেঁধে রেখেছে যে, তাদের পক্ষে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া দুষ্কর।
শ্লোকঃ ৪৫
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন।
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান ।। ৪৫ ।।
ত্রৈগুণ্য- প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্পর্কিত; বিষয়াঃ- বিষয়ে; বেদাঃ- বৈদিক শাস্ত্রসমূহ; নিস্ত্রৈগুণ্যঃ- জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণের অতীত; ভব- হও; অর্জুন- হে অর্জুন; নির্দ্বন্দ্বঃ- দ্বন্দ্বরহিত; নিত্যসত্ত্বস্থঃ- শুদ্ধ সত্ত্ব চিন্ময় অস্তিত্বে; নির্যোগক্ষেমঃ- অলব্ধ বস্তুর লাভ এবং তার রক্ষার চিন্তা থেকে মুক্ত; আত্মবান- অধ্যাত্ম চেতনায় অবস্থিত।
গীতার গান
ত্রিগুণের মধ্যে বেদ সত্ত্ব রজস্তম।
তাহার উপরে উঠে তবে সে উত্তম।।
তখনই দ্বন্দ্বভাব ঘুচিবে তোমার।
নিত্য শুদ্ধ সত্ত্বভাব হবে আবিষ্কার।।
আত্মবান হয় সদা নির্যোগ নিক্ষেম।
যে ধনে সে ধনী তাহা বগবদ প্রেম।।
অনুবাদঃ বেদে প্রধানত জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। হে অর্জুন। তুমি সেই গুণগুলিকে অতিক্রম করে নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হও। সমস্ত দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও এবং লাভ-ক্ষতি ো আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্ম চেতনায় অধিষ্ঠিত হও।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের প্রভাবে জড় জগতের প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রতিক্রিয়া বা কর্মফল জীবকে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। বেদ সাধারণত সকাম কর্ম করার শিক্ষা দান করে, যার ফলে সাধারণ মানুষ জড় সুজখ উপভোগ ও জড় ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধনের স্তর থেকে ক্রমশ অধোক্ষজ স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। ভগবান তাঁর প্রিয় সখা ও প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, বেদান্ত দর্শনের মর্ম উপলব্ধি করে পরা প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হতে। এই বেদান্ত দর্শনের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- ব্রক্ষ্ম জিজ্ঞাসা, অর্থাৎ পরব্রক্ষ্মের অনুসন্ধান করা। জড় জগতের প্রতিটি জীবই বেঁচে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম করছে। এই সমস্ত মায়াবদ্ধ জীবকে উদ্ধার করার জন্য ভগবান সৃষ্টির আদিতে বৈদিক জ্ঞান দান করেন, যাতে তারা বুঝতে পারে, কি রকম জীবনযাপন করলে তারা এই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তাদের প্রকৃত আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারবে। বেদের কর্মকান্ড নামক অধ্যায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিভাবে যাগজজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে জাগতিক কামনা-বাসনার তৃপ্তিসাধন করা যায়। এভাবে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি জনিত নানা রকম সুখভোগ করার পর জীব যখন বুঝতে পারে, জড় জগতের সমস্ত সুখই অনিত্য ও নিরর্থক, তখন তার মন পারমার্থিক তত্ত্ব অনুসন্ধানে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তাই বেদে কর্মকান্ডের পর উপনিষদে ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উপনিষদগুলি হচ্ছে বিভিন্ন বেদের মর্মার্থ, যেমন গীতোপনিষদ বা ভগবদগীতা হচ্ছে প্নচম বেদ মহাভারতের সারাংশ। এই উপনিষদগুলির মাধ্যমে মানুষের পারমার্থিক জীবন শুরু হয়।
যতক্ষন আমাদের জড় দেহ আছে, ততক্ষণ প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের প্রভাবে আমাদের কর্ম করতে হয় এবং তার ফল ভোগ করতে হয়। এটিই হচ্ছে কর্মবন্ধন। কিন্তু অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হতে হলে এই যে সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণের দ্বন্দ্বভাব, তাতে অবিচলিত থেকে তার প্রভাবমুক্ত হতে হয় এবং তখন আর লাভ-ক্ষতির বিচারবোধ থাকে না। মন তখন আর অনুশোচনা ও অহংকার দ্বারা বিমোহিত হয় না। এভাবেই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে জীব যখন ভগবানের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে, তখনই সে পরা প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে তার সৎ, চিৎ ও আনন্দময় স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারে।
শ্লোকঃ ৪৬
যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান সর্বেষু বেদেষু ব্রাক্ষণস্য বিজানতঃ ।। ৪৬ ।।
যাবান- যে সমস্ত; অর্থঃ- প্রয়োজন; উদপানে- ক্ষুদ্র জলাশয়ে; সর্বতঃ- সর্বতপভাবে; সংপ্লুতোদকে- অতি বৃহৎ জলাশয়ে; তাবান- তেমনই; সর্বেষু- সমস্ত; বেদেষু- বৈদিক শাস্ত্রে; ব্রাক্ষণ্যস্য- পরব্রক্ষ্ম সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তির; বিজানতঃ- পূর্ণ জ্ঞানবান।
গীতার গান
সেই প্রেমে ভাসমান সর্বলাভ পায়।
কূপ জল নদী জল যথা যথা হয়।।
এক কূপে হয় এক কার্যের সাধন।
নদীর জলেতে হয় একত্রে ভাজন।।
বেদের তাৎপর্য সেই এক লক্ষ্য হয়।
ব্রাক্ষ্মণ যে হয় সেই সমস্ত বুঝয়।।
অনুবাদঃ ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি বৃহৎ জলাশয় থেকে আপনা হতেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনই, ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি পরব্রক্ষ্মের জ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন, তাঁর কাছে সমস্ত বেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ বেদের কর্মকান্ডে যে-সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ও যাগ-যজ্ঞের বিধান দেওয়া আছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবকে ক্রমশ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে উৎসাহিত করা। ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের পঞ্চদশ শ্লোকে (১৫/১৫) স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, বেদ অধ্যয়ন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্ব কারণের কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। এভাবে আমরা দেখতে দেখতে পাই, আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার অর্থ হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্ক উপলব্ধি করা। ভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে (১৫/৭) ভগবানের সঙ্গে জীবের সম্পর্কের ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, জীব হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ; তাই, জীবের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে, ভগবানের সেবা করা- তার অন্তরের শাশ্বত কৃষ্ণভাবনা জাগিয়ে তোলা। এটিই হচ্ছে বৈদিক জ্ঞানের চরম সত্য। শ্রীমদ্ভাগতে (৩/৩৩/৭) তার সমর্থনে বলা হয়েছে-
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান
যজ্জিহাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্ষা
ব্রক্ষ্মানুচূর্ণাম গৃণন্তি যে তে।।
“হে ভগবান, নিরন্তর যিনি আপনার নাম কীর্তন করেন, তিনি যদি চন্ডালের মতো নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তবুও তিনি অধ্যাত্ম-মার্গের অতি উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত। এই প্রকার মানুষ বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে বহু তপশ্চর্যা করেছেন এবং সমস্ত পুণ্যতীর্থে বহু স্নান করে তিনি বহুবার বেদ অধ্যয়ন করেছেন। এমন মানুষকে আর্যকুলে শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচনা করা হয়।“
সুতরাং বেদ থেকে আমরা বুঝতে পারি, যাগ-যজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠান করে স্বর্গলোকে উন্নততর ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার শিক্ষা বৈদিক শাস্ত্র আমাদের দিচ্ছে না। বৈদিক শাস্ত্রের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা। বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশিত বিভিন্ন যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা, সমস্ত বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুশীলন করা এই যিগের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সমস্ত করার জন্য যে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্চর্য ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, তা এই যুগের মানুষের নেই। তাই, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই কলিযুগের অধঃপতিত মানুষদের উদ্ধার করার জন্য ভগবানের দিব্য নামের সঙ্কীর্তন করার পথ প্রদর্শন করে গেছেন। মহাপণ্ডিত প্রকাশানন্দ সরস্বতী যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জিজ্ঞেস করেন, যদিও তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ন বলে মনে হয়, তবু বেদান্ত দর্শন পাঠ না করে তিনি কেন তাবুকের মতো ভগবানের নাম কীর্তন করছেন। এর উত্তরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, তাঁর গুরুদেব বুঝতে পারেন যে, তিনি অত্যন্ত মূর্খ, তাই তিনি তাঁকে শাসন করে উপদেশ দিলেন যে, বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়নে তাঁর অধিকার নেই। এই বলে তিনি তাঁকে কৃষ্ণমন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিলেন। এই নাম জপ করতে করতে তিনি ভগবদ্ভক্তির ভাবে উনামদ হয়ে উঠলেন। এই কলিযুগে অধিকাংশ মানুষই মূর্খ। বেদান্ত দর্শন বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের নেই, তাই ভগবান বেদান্ত দর্শনের সারমর্ম ভগবদ্ভক্তির বার্তা বহন করে এনে, এই ভক্তি লাভ করার পথ প্রদর্শন করে গেলেন। নিষ্কলুষ চিত্তে নিরপরাধে ভগবানের নাম জপ করার মাধ্যমে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার আশীর্বাদ দিয়ে গেলেন। বৈদিক জ্ঞানের শেষ কথা হচ্ছে বেদান্ত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বেদান্ত দর্শনের প্রবক্তা। যে মহাত্মা নিরন্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন করে অসীম আনন্দ উপভোগ করেন, তিনিই হচ্ছেন বেদান্ত-তত্ত্ববেত্তা। কারণ, সেটিই হচ্ছে বৈদিক অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের চরম উদ্দেশ্য।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ