শ্লোকঃ ৩১
স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমহরসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ।। ৩১ ।।
স্বধর্মম- স্বধর্মের প্রতি; অপি চ- আরও; অবেক্ষ্য- বিবেচনা করে; ন- না; বিকম্পিতুম- দ্বিধা করতে; অরহসি- উচিত; ধর্ম্যাৎ- ধর্মের জন্য; হি- যেহেতু; যুদ্ধাৎ- যুদ্ধ অপেক্ষা; শ্রেয়ঃ- শ্রেয়স্কর কর্ম; অন্যৎ- অন্য কিছু; ক্ষত্রিয়স্য- ক্ষত্রিয়ের; ন বিদ্যতে- নেই।
গীতার গান
নিজ ধর্ম দেখি পুনঃ না হও বিকল।
ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ করা ধর্ম যে সকল।।
অনুবাদঃ ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়।
তাৎপর্যঃ চতুর্বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণকে বলা হয় ক্ষত্রিয়। এদের কাজ রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করা। ক্ষৎ কথাটির অর্থ হচ্ছে আঘাত। আঘাত বা বিপদ থেকে (ত্রায়তে- ত্রাণ করে) যে ত্রাণ করে, সে হচ্ছে ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়েরা অস্ত্রচালনা শিক্ষালাভ করে তাতে পারদর্শিতা লাভ করত। তাদের এই শিক্ষার একটি অঙ্গ হচ্ছে, বনে গিয়ে হিংস্র পশু শিকার করত। তাদের এই শিক্ষার একটু অঙ্গ হচ্ছে, বনে গিয়ে হিংস্র পশু শিকার করা। এভাবে অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে ক্ষত্রিয় সন্তান বনে গিয়ে হিংস্র বাঘকে যুদ্ধে আহ্বান করত এবং শুধু তলোয়ার হাতে সেই বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে নিধন করত। তারপর সেই বাঘকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে সৎকার করা হত। এই প্রথা আজও জয়পুরের ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে প্রচলিত আছে। ক্ষত্রিয়েরা শত্রুকে যুদ্ধে আহ্বান করে তার প্রাণ সংহার করতে দ্বিধা করে না। রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনের জন্য এই প্রথার প্রয়োজন অপরিহার্য। তাই, ক্ষত্রিয়েরা সরাসরিভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে অহিংসার পথ অবলম্বন করা কূটনীতি হতে পারে, কিন্তু তা কখনোই নীতিগত পন্থা নয়। নীতিশাস্ত্রে আছে-
আহবেষু মিথোহন্যোন্যং জিঘাংসন্তো মহীক্ষিতঃ
যুদ্ধমানাঃ পরং শক্ত্যা স্বর্গং যান্ত্যপরাঙ্মুখাঃ।
যজ্ঞেষু পশবো ব্রক্ষ্মন হন্যন্তে সততং দ্বিজৈঃ
সংস্কৃতাঃ কিল মন্ত্রৈশ্চ তেহপি স্বর্গমবাপ্নুবন।।
“কোন রাজা অথবা ক্ষত্রিয় যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ঈর্ষান্বিত শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামে রত হন, মৃত্যুর পর তিনি স্বর্গলোকে গমন করেন, তেমনই ব্রাক্ষ্মণ যজ্ঞে পশুবলি দিলে স্বর্গ লাভ করেন।“ তাই, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে হত্যা করা এবং যজ্ঞে পশু বলি দেওয়াকে হিংসাত্মক কার্য বলে গণ্য করা হয় না, কারণ এই ধর্ম অনুষ্ঠানের ফলে সকলেই লাভবান হয়। যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত পশু জৈব বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নত থেকে উন্নততর জীব দেহ ধারণ না করে, সরাসরি মনুষ্যশরীর প্রাপ্ত হয় এবং সেই যজ্ঞের ফলে দেবতারা তুষ্ট হয়ে মর্ত্যবাসীদের ধনৈশ্চর্য দান করেন। সুতরাং, ধর্মাচরণ করলে এভাবে সকলেই লাভবান হয়।
স্বধর্ম দুই রকমের। জড় বন্ধনমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জীবকে শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী তার ধের ধর্ম পালন করতে হয় এবং তার ফলে সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। মুক্ত অবস্থায় জীব তার অপ্রাকৃত স্বরূপে অধিষ্ঠিত থাকে। তখন আর তার দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না, তাই তখন তাকে জড়-জাগতিক অথবা দেহগত আচার অনুষ্ঠান করতে হয় না। শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী, বন্ধ অবস্থায়, বন্ধ অবস্থায় দেহাত্মবুদ্ধির স্তরে জীবের ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চারটি স্তর থাকে এবং তাদের স্ব-স্ব ধর্ম থাকে এবং এই ধর্ম আচরণ করা অবশ্য কর্তব্য। ভগবান নিজেই গুণ ও কর্ম অনুসারে এই স্বধর্ম নির্ধারিত করেছেন এবং এই সম্বন্ধে চতুর্থ অধ্যায়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। দেহগত স্বধর্মকে বলা হয় বর্ণাশ্রম-ধর্ম অথবা মানুষের পারমার্থিক উন্নতি লাভের উপায়। বর্ণাশ্রম-ধর্ম-ধর্ম অথবা জড়া প্রকৃতির নির্দিষ্ট গুণ অনুসারে প্রাপ্ত দেহটির দ্বারা অনুষ্ঠিত বিশেষ কর্তব্যকর্মের স্তর থেকে মানব-সভ্যতা শুরু হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চ-কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসারে এই বর্ণাশ্রম-ধর্ম আচরণ করার ফলে মানুষ ক্রমে ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর জীবন প্রাপ্ত হয়ে অবশেষে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়।
শ্লোকঃ ৩২
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম ।। ৩২ ।।
যদৃচ্ছয়া- আপনা থেকেই; চ- এবং; উপপন্নম- উপস্থিত হয়েছে; স্বর্গদ্বারম- স্বর্গদ্বার; অপাবৃতম- উন্মুক্ত; সুখিনাঃ- সুখী; ক্ষত্রিয়াঃ- ক্ষত্রিয়েরা; পার্থ- হে পৃথাপুত্র; লভন্তে- লাভ করেন; যুদ্ধম- যুদ্ধ; ঈদৃশম- এই রকম।
গীতার গান
অনায়াসে পাইয়াছ স্বর্গদ্বার খোলা।
সে যুদ্ধ কার্যেতে নাহি কর অবহেলা।।
ভাগ্যবান বীর সেই হেন যুদ্ধ পায়।
যুদ্ধ করি যজ্ঞফল ক্ষত্রিয় লভয়।।
অনুবাদঃ হে পার্থ। স্বর্গদ্বার উন্মোচনকারী এই প্রকার ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না চাইতেই যে সব ক্ষত্রিয়ের কাছে আসে, তাঁরা সুখী হন।
তাৎপর্যঃ অর্জুন যখন বললেন, “এই যুদ্ধে কোন লাভ নেই। এই পাপের ফলে আমাকে অনন্তকাল ধরে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।“ তখন সমস্ত জগতের পরম শিক্ষাগুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন যে, তাঁর এই উক্তি তাঁর মূর্খতার পরিচায়ক। তাঁর স্বধর্ম- ক্ষাত্রধর্ম ত্যাগ করে অহিংস নীতি অবলম্বন করা তাঁর পক্ষে অনুচিত। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় যদি অহিংস নীতি অবলম্বন করে, তবে তাকে একটি মস্ত বড় মূর্খ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পরাশর-স্মৃতিতে ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি বর্ণনা করেছেন-
ক্ষত্রিয়ো হি প্রজা রক্ষন শস্ত্রপাণিঃ প্রদন্ডয়ন।
নির্জিত্য পরসৈন্যাদি ক্ষিতিং ধর্মেণ পালয়েৎ।।
“সব রকম দুঃখ-দুর্দশা থেকে রক্ষা করে প্রজা-পালন করাই হচ্ছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং সেই কারণে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য তাঁকে অস্ত্রধারণপূর্বক দন্ডদান করতে হয়। তাই তাঁকে বিরোধী ভাবাপন্ন রাজার সৈন্যদের বলপূর্বক পরাজিত করতে হয় এবং এভাবেই ধর্মের দ্বারা তাঁর পৃথিবী পালন করা উচিত।“
সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখলে দেখা যায়, অর্জুনের যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার কোনই কারণ ছিল না। যুদ্ধে যদি তিনি জয়লাভ করতেন, তবে তিনি রাজ্যসুখ ভোগ করতেন, আর যদি যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হত, তবে তিনি স্বর্গলোকে উন্নীত হতেন- যেখানে তাঁর জন্য দ্বার ছিল অবারিত। যুদ্ধ করলে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি লাভবান হতেন।
শ্লোকঃ ৩৩
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি ।। ৩৩ ।।
অথ- সুতরাং; চেৎ- যদি; ত্বম- তুমি; ইমম- এই; ধর্ম্যম- ধর্ম; সংগ্রামম- যুদ্ধ; ন- না; করিষ্যসি- কর; ততঃ- তা হলে; স্বধর্মম- তোমার স্বীয় ধর্ম; কীর্তিম- কীর্তি; চ- এবং; হিত্বা- হারিয়ে; পাপম- পাপ; অবাপ্স্যসি- লাভ করবে।
গীতার গান
অতএব তুমি পার্থ যদি যুদ্ধ ছাড়।
স্বধর্ম স্বকীর্তি সব একত্রে উগার।।
অনুবাদঃ কিন্তু তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুনের বীরত্বের খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। তিনি মহাদেবের মতো দেবতাদেরও যুদ্ধে পরাস্ত করেছেন। কিরাতরূপী মহাদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করলে, সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে পাশুপত নামক এক ভয়ংকর অস্ত্র দান করেন। তাঁর অস্ত্রশিক্ষা-গুরু দ্রোণাচার্যও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং এমন একটি অস্ত্র দান করেন, যার দ্বারা তিনি দ্রোণাচার্যকেও পর্যন্ত হত্যা করতে পারতেন। তাঁর ধর্মপিতা দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁকে তাঁর বীরত্বের জন্য পুরস্কৃত করেন। এভাবে অর্জুনের বীরত্বের খ্যাতি সমস্ত বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে সুবিদিত ছিল। তাই তিনি যদি যুদ্ধবিমুখ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতেন, তবে তিনি কেবল তাঁর ক্ষাত্রধর্মেরই যে অবহেলা করতেন তা নয়, সেই সঙ্গে তাঁর বীরত্বের গৌরবও নষ্ট হত এবং তাঁকে নরকগামী হতে হত। পক্ষান্তরে, যুদ্ধ করার জন্য অর্জুনকে নরকে যেতে হত না, বরং যুদ্ধ না করার জন্যই তাঁকে নরকে যেতে হত।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ