শ্লোকঃ ২৮

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।

অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিবেদনা ।। ২৮ ।।

অব্যক্তাদীনি- পূর্বে অপ্রকাশিত; ভূতানি- প্রাণীসমূহ; ব্যক্ত- প্রকাশিত; মধ্যানি- মাঝখানে; ভারত- হে ভরতবংশজ; অব্যক্ত- অপ্রকাশিত; নিধনানি- বিনাশের পর; এব- এমনই; তত্র- সুতরাং; কা- কি; পরিবেদনা- শোক।

গীতার গান

জড়ের রূপাদি নাহি পরেও থাকে না।

মধ্যে মাত্র রূপ গুণ সকলি ভাবনা।।

অতএব নিরাকার যদি নিরাকার।

তাহাতে তোমার দুঃখ কিসের আবার।।

অনুবাদঃ হে ভারত। সমস্ত সৃষ্ট জীব উৎপন্ন হওয়ার আগে অপ্রকাশিত ছিল, তাদের স্থিতিকালে প্রকাশিত থাকে এবং বিনাশের পর আবার অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং, সেই জন্য শোক করার কি কারন?

তাৎপর্যঃ আত্মার অস্তিত্বে বিশবাসী এবং অবিশ্বাসী উভয় মতবাদকে মেনে নিলেও শোকের কোন কারণ নেই। যারা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না, বৈদিক মতাবলম্বী তাদের নাস্তিক বলে অভিহিত করে। তবুও এমন কি যদি তর্কের খাতিরে এই নাস্তিক মতবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করা হয়, তা হলেও অনুশোচনা করার কোনই কারণ নেই। কারণ, জড়ের মধ্য থেকে প্রাণের উদ্ভব হয়ে যদি তা আবার জড়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই অনিত্য বস্তুর জন্য শোক করা নিতান্তই নিরর্থক। আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা ছেড়ে দিলেও সৃষ্টির পূর্বে জড় উপাদানগুলি থাকে অব্যক্ত। এই সূক্ষ্ম অব্যক্ত থেকে আকারের প্রকাশ হয়, যেমন আকাশ থেকে বায়ুর উদ্ভব হয়, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল এবং জল থেকে মাটির উদ্ভব হয়। এই মাটি থেকে নানা রূপের উদ্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ইট, সিমেন্ট, চুন, বালি, লোহা আদি সবই মাটি। সেই মাটি থেকে যখন একটি প্রাসাদ তৈরি হয়, তখন তা রূপ ও আকার প্রাপ্ত হয়। তারপর এক সময় সেই প্রাসাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যায়। যে বস্তু দিয়ে প্রাসাদটি গড়া হয়েছিল, তার অণু-পরমাণুগুলির কোন পরিবর্তন হয় না। শক্তি সংরক্ষণের নীতি বর্তমানই থাকে, কেবল সময়ের প্রভাবে তার রূপের প্রকাশ হয় এবং অন্তর্ধান হয়- সেটিই হচ্ছে পার্থক্য। সুতরাং, এই আবির্ভাব ও অন্তর্ধানের জন্য শোক করার কি কারণ থাকতে পারে? যে-কোনভাবেই হোক না কেন, এমন কি অব্যক্ত অবস্থাতেও বস্তুর বিনাশ হয় না। আদিতে ও অন্তে জড়ের রূপ থাকে না, কেবল মধ্যে তার রূপ ও গুণের প্রকাশ হয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়। সুতরাং, এর ফলে কোন জড়-জাগতিক পার্থক্য সূচিত হয় না।

আর আমরা যদি ভগবদগীতায় উক্ত বৈদিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিই, অর্থাৎ অন্তবন্ত ইমে দেহাঃ- এই জড় দেহটি কালের প্রভাবে বিনষ্ট হবে, নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ- কিন্তু আত্মা চিরশাশ্বত, তা হলে আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দেহটি একটি পোশাকের মতো। তাই এই পোশাকটির পরিবর্তনের জন্য কেন আমরা শোক করব? আত্মার নিত্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে দেখলে সহজেই বুঝতে পারা যায়, জড় দেহের যথার্থই কোন অস্তিত্ব নেই- এটি অনেকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন কখনো আমরা দেখি, আকাশে উড়ছি অথবা রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে আছি, কিন্তু যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন বুঝতে পারি, আমরা আকাশেও উড়িনি অথবা রাজা হয়ে সিংহাসনেও বসিনি। আমাদের জড় অস্তিত্বটিও তেমনই আমাদের মন, বুদ্ধি ও অহংকারের বিকার। বৈদিক জ্ঞান আমাদের দেহের অনিত্যতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং, কেউ আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করুক অথবা আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করুক না কেন, যে-কোন অবস্থাতেই জড় দেহ বিনাশের জন্য শোক করার কারণ নেই।

শ্লোকঃ ২৯

আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম

আশ্চর্যবদ বদতি তথৈব চান্যঃ।

আশ্চর্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি

শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ ।। ২৯ ।।

আশ্চর্যবৎ- বিস্ময়জনক ভাবে; পশ্যতি- দেখেন; কশ্চিৎ- কেউ; এনম- এই আত্মাকে; আশ্চর্যবৎ- আশ্চর্যজনকভাবে; বদতি- বলেন; তথা- সেভাবে; এব- নিশ্চিত; চ- ও; অন্যঃ- অপরে; আশ্চর্যবৎ- তেমনই আশ্চর্যরূপে; চ- ও; এনম- এই আত্মাকে; অন্যঃ- অন্য কেউ; শৃণোতি- শ্রবণ করেন; শ্রুতা- শুনেও; অপি- এমন কি; এনম- এই আত্মাকে; বেদ- জানতে পারেন; ন- না; চ- এবং; এব- নিশ্চিতভাবে; কশ্চিৎ- কেউ।

গীতার গান

আশ্চর্য আত্মার কথা,    না বুঝিয়ে যথা তথা

আশ্চর্য তাহার দেখাশুনা।

আশ্চর্য কেহবা বলে,     আশ্চর্য কেহবা ছলে

আশ্চর্য তাহার অধ্যাপনা।।

আশ্চর্য হইয়া শুনে,       তথাপি বা নাহি মানে

আশ্চর্য যে আশ্চর্যের কথা।

আশ্চর্য হইয়া রহে,        আশ্চর্য বুঝিতে নহে

আশ্চর্য অতি দুর্বলতা।।

অনুবাদঃ কেউ এই আত্মাকে আশ্চর্যবৎ দর্শন করেন, কেউ আশ্চর্যভাবে বর্ণনা করেন এবং কেউ আশ্চর্য জ্ঞানে শ্রবণ করেন, আর কেউ শুনেও তাকে বুঝতে পারেন না।

তাৎপর্যঃ উপনিষদের তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তির উপর গীতোপনিষদ অধিষ্ঠিত, তাই এই শ্লোকের ভাব কঠ উপনিষদের (১/২/৭) শ্লোকটিতেও দেখা যায়-

শ্রবণয়াপি বহুভির্যো ন লভ্যঃ শৃণন্তোহপি বহবো যং ন বিদ্যুঃ।

আশ্চর্যো বক্তা কুশলোহস্য লব্ধাশ্চর্যো জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ।।

সত্য ঘটনা হচ্ছে যে, পারমাণবিক আত্মা বিশালকায় পশুর দেহে, বিশাল বটবৃক্ষে, আবার অতি সূক্ষ্ম জীবাণু যারা লক্ষ কোটি সংখ্যায় মাত্র এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাতেও থাকতে পারে, তাদের দেহেও অবস্থান করে, এটি অতি আশ্চর্যের কথা। যে সমস্ত মানুষ সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন এবং যাদের চিন্তাধারা সংযম ও তপশ্চর্যার প্রভাবে পবিত্র হয়নি, তারা কখনোই পারমাণবিক জীবাত্মার বিস্ময়কর স্ফুলিঙ্গ রহস্য উপলব্ধি করতে পারে না। এমন কি বৈদিক জ্ঞানের মহান প্রবক্ততা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি ব্রক্ষ্মান্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রক্ষ্মাকে পর্যন্ত ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন, তিনি নিজে এসে সেই জ্ঞান দান করার পরেও তার মর্ম তারা উপলব্ধি করতে পারে না। স্থুল জড় পদার্থের দ্বারা অতি মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে পড়ার ফলে বর্তমান যুগের অধিকাংশ মানুষ কল্পনা করতে পারে না, পরমাণুর চাইতেও অনেক ছোট যে আত্মা, তা কি করে তিমি মাছের মতো বৃহৎ জন্তুর দেহে, আবার জীবাণুর মতো অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহে উপস্থিত থেকে তাতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে। তাই, মানুষ আত্মার কথা শুনে অথবা আত্মার কথা অনুমান করে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়। মায়াশক্তির প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে, মানুষ তাদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন করতে এতই ব্যস্ত যে, আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে কোন রকম চিন্তা করার সময় পর্যন্ত তাদের নেই। এমন কি যদিও এই কথাটি সত্য যে, এই আত্ম-উপলব্ধি ছাড়া জীবন-সংগ্রামে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই শোচনীয় পরাজয়ের পর্যবসিত হবে। অনেকেই হয়ত আত্মজ্ঞান লাভ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে না, ফলে জড়-জাগতিক ক্লেশের পীড়নে তারা অহরহ নির্যাতিত হয় এবং তার থেকে মুক্ত হবার কোন উপায় খুঁজে পায় না।

অনেক সময় কিছু মানুষ আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান লাভ  করার প্রয়াসী হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাধুসঙ্গ বলে মনে করে একদল মূর্খের সঙ্গ লাভ করে ভাবতে শেখে যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই- মায়ামুক্ত হলেই জীবাত্মা পরমাত্মাতে পরিণত হয়। এমন মানুষ খুবই বিরল যিনি জীবাত্মা, তাঁদের নিজ নিজ কার্যকলাপ ও পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক এবং অন্যান্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্ব বুঝতে পারেন। আরও বিরল হচ্ছে সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া, যিনি এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং যিনি বিভিন্ন রূপের মধ্যে আত্মার অবস্থানের বর্ণনা দিতে সক্ষম। যদি কেউ আত্মার এই জ্ঞানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তা হলেই তার জন্ম সার্থক হয়।

মানবজন্ম লাভ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, ,এই তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করে মায়ামুক্ত হয়ে চিৎ-জগতে ফিরে যাওয়া। এই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে অন্যান্য মতবাদের দ্বারা বিপথগামী না হয়ে মহত্তম প্রবক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদগীতার বাণীর যথাযথ মর্ম উপলব্ধি করা এবং তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করা। বহু জন্মের পুণ্যের ফলে এবং বহু তপস্যার বলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মানুষ সর্ব কারণের কারণ পরমেশ্বর রূপে উপলব্ধি করতে পারে এবং তাঁর চরণে আত্মনিবেদন করতে সমর্থ হয়। অনেক সৌভাগ্যের ফলে মানুষ সদগুরুর সন্ধান পায়, যার অহৈতুকী কৃপার ফলে সে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারে।

শ্লোকঃ ৩০

দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।

তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমরহসি ।। ৩০ ।।

দেহী- জড় দেহের মালিক; নিত্যম- নিত্য; অবধ্যঃ- অবধ্য; অয়ম- এই আত্মা; দেহে- দেহে; সর্বস্য- সকলের; ভারত- হে ভরতবংশীয়; তস্মাৎ- অতএব; সর্বাণি- সমস্ত; ভূতানি- জীবসমূহ (যাদের জন্ম হয়েছে); ন- না; ত্বম- তুমি; শোচিতুম- শোক করা; অরহসি- উচিত।

গীতার গান

সিদ্ধান্ত আত্মার কথা শুন হে ভারত।

বেদান্ত আমার কথা শুন সেই মত।।

দেহী নিত্য মরে নাহি সকল দেহের।

দেহের বিনাশ তাই নহে ত শোকের।।

অনুবাদঃ হে ভারত। প্রাণীদের দেহে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। অতএব কোন জীবের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।

তাৎপর্যঃ আত্মার অবিনশ্বরতার কথা প্রতিপন্ন করে ভগবান আবার উপসংহারে অর্জুনকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। দেহ অনিত্য, কিন্তু আত্মা নিত্য, তাই দেহের বিনাশ হলে তা নিয়ে শোক করবার কোন কারণ থাকতে পারে না। অতএব পিতামহ ভীষ্ম ও আচার্য দ্রোণ নিহত হবেন বলে ভয়ে ও শোকে যুদ্ধ করতে বিমুখ হয়ে স্বধর্ম পরিত্যাগ করা ক্ষত্রিয় বীর অর্জুনের উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক উপদেশামৃতের উপর আস্থা রেখে, প্রত্যেকের বিশ্বাস করতে হবে যে, জড় দেহ থেকে ভিন্ন আত্মার অস্তিত্ব রয়েছে, এই নয় যে, আত্ম বলে কোন বস্তু নেই, অথবা রাসায়নিক পদার্থের পারস্পারিক ক্রিয়ার ফলে জাগতিক পরিপক্কতার কোন এক বিশেষ অবস্থায় চেতনার লক্ষণগুলির বিকাশ ঘটে। অবিনশ্বর আত্মার মৃত্যু হয় না বলে নিজের ইচ্ছামতো হিংসার আচরণ করাকে কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধের সময় হিংসার আশ্রয় নেওয়াতে কোন অন্যায় নেই, সেখানে তার যথার্থ প্রয়োজনীয়তা আছে। এই প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আমাদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী বিবেচিত হয় না- তা হয় ভগবানের বিধান অনুসারে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x