‘সাংখ্য’ মতবাদের প্রবর্তক কপিল মুনি, একথা আমরা আগেই জেনেছি। এও জেনেছি সাংখ্য ভারতবর্ষের প্রাচীনতম দর্শন হিসেবে বহু পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত। সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী—এও আমরা জানি। সাংখ্য বেদ বিরোধী, মনু বিরোধী, কার্য- কারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী অসাধারণ এগিয়ে থাকা একটি মতবাদ। কিন্তু যে কথা আগে আলোচনা করা হয়নি, তা হল সাংখ্য দুটি পরম সত্তাকে স্বীকার করে। এক : পুরুষ, দুই : প্রকৃতি বা নারী। বিষয়টি নিয়ে একটু ছোট করে আলোচনা করে নিই আসুন ।

সাংখ্য বৈদিক সাহিত্য হলেও বেদ বিরোধী এবং বস্তুতান্ত্রিক মতবাদ এতো আগেই বলেছি। সাংখ্য মতে দুই-পরম সত্তা পুরুষ ও প্রকৃতি কেউ কারও উপর নির্ভরশীল নয়। দুই সত্তাই স্বনির্ভর। পুরুষ হল চৈতন্যস্বরূপ। জাগতিক সব কিছুর ঊর্ধ্বে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু মানে ভোগ্য বস্তু ভোগ করে চৈতন্যময় আত্মা বা পুরুষ। পুরুষ এই প্রকৃতিজাত বস্তুর ভোক্তা। চৈতন্যময় আত্মা পরমাত্মার কোনও অংশ নয় । পরমাত্মার সঙ্গে যুক্তও নয়। যত দেহ তত আত্মা। তাই এক আত্মা যখন সুখ ভোগ করে, তখন আর এক আত্মা দুঃখ ভোগ করছে। পরমাত্মার অংশ হিসেবে আত্মা যদি সব দেহে বিরাজ করতো, তাহলে সব আত্মাই একই সঙ্গে সুখ বা দুঃখ ভোগ করতো। একই সঙ্গে ঘুমতো বা জেগে থাকতো। যেহেতু প্রত্যেকের আত্মাই ভিন্ন, কোনও পরমাত্মার অংশ নয়,তাই ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্যময় পুরুষের ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন রকমের।

প্রকৃতি হল শাশ্বত, চিরন্তন। জগতের সব কিছুর সৃষ্টির মূল কারণ। পুরুষের ভোগের উদ্দেশ্যেই প্রকৃতির সৃষ্টি।

সাংখ্যে প্রকৃতিকে জড় ভাবার পরও তাকেই সৃষ্টির মূল কারণ বলা হয়েছে। আবার প্রকৃতিকে নারী রূপে কল্পনা করা হয়েছে (সাংখ্যসূত্র ৩, ৬৮)।

সাংখ্য বলছে— যেমন স্ত্রী-পুরুষের মিলনে সন্তান জন্মায়, তেমনই প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনেই সবের সৃষ্টি (সাংখ্যকারিকা ২১)।

সাংখ্য অনুসারে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুরুষের একটা ভূমিকা আছে বটে, কিন্তু পুরুষের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় ।।

পুরুষের বীজ থেকেই যখন সৃষ্টি, তখন প্রকৃতি বা নারীকে সক্রিয় এবং পুরুষকে নিষ্ক্রিয় বলার কারণ কী? পুরুষকে সাংখ্য এভাবে চিত্রিত করায় শঙ্করাচার্য প্রশ্ন তুলেছিলেন।

সাংখ্যের এমন ভাবনার পিছনের সম্ভাব্য কারণ এমনটাও হতে পারে—

১৮৭১-এর ভারতবর্ষের জনগণনার হিসেবটার দিকে প্রথমে একটু চোখ রাখি আসুন। সেখানে দেখানো হয়েছিল ১৮৬০ লক্ষ ভারতীয়দের মধ্যে আর্য বংশীয় উচ্চবর্ণের মানুষ ১৬০ লক্ষ। অর্থাৎ মোট ভারতবাসীর প্রায় ৯ শতাংশ মাত্র। বাকিরা অ-আর্য। শুধু ট্রাইবালদের অর্থাৎ উপজাতির সংখ্যাই ছিল আর্য-বংশীয়দের চেয়ে বেশি। সংখ্যাটা ১৮০ লক্ষ।

এই হিসেব থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, এদেশে যখন আর্যভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তখন অ-আর্যভাষীদের সংখ্যা ছিল আরও বেশি। অ-আৰ্য রমণীদের অপহরণ করেই আর্যভাষীরা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়ে ছিল। সুতরাং আর্য সাহিত্যের যুগে ভারতীয়দের মধ্যে আর্যভাষীদের সংখ্যা যে ১৮৭১ সালের তুলনায় আরও কম ছিল এটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না।

অ-আর্যভাষীদের সমাজে নারী প্রাধান্য বেশি ছিল, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। সাংখ্য রচয়িতারা আর্যভাষী হলেও তাঁদের চোখের সামনে নারীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উপস্থিত ছিল। মাতৃপ্রধান সমাজে পরিবারের প্রধান মা। বাবার অবস্থান বহিরাগতের মতো। সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হত। নারীদের যৌন স্বাধীনতা ছিল। সাধারণভাবে সন্তানের জন্মদাতাকে চিহ্নিত করা মা ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে মাতৃবংশধারার পাশাপাশি মাতৃকেন্দ্রিক উত্তরাধিকার রীতি প্রচলিত ছিল। পিতার সন্তান উৎপাদনে ভূমিকা থাকলেও স্ত্রী ও পরিবারে তার ভূমিকা নেহাতই নিষ্ক্রিয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রীর ভূমিকা যেমন সন্তান উৎপাদন ছাড়া নিষ্ক্রিয়।

সে সময় অ-আর্যভাষীদের মধ্যে দেবতাদের চেয়ে দেবী পূজার প্রচলন ছিল বেশি। দেবতা বলতে প্রধান ছিলেন শিব। শিবের লিঙ্গকে সৃষ্টি বীজের উৎস হিসেবে পুজো করা হত। একই সঙ্গে যোনিরও পুজো হত। বরাহপুরাণে দুর্গাকে কিরাত রমণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শবররা শিকারজীবী উপজাতি। শিবও উপজাতিদের দেবতা। চামার সম্প্রদায়ের প্রধান দেবী ‘ধরতি মাতা’। ভীলদের প্রধানা দেবী ‘মাতা’৷ রাজস্থানের উপজাতিদের দেবীরা হলেন—অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী, মাতাজননী। এইসব হিন্দুদেবীদের নাম হিন্দু উপাসনা ধর্মের প্রভাবের ফল। প্রাচীন দেবীরাই নতুন নামে পরিচিতা হয়েছেন। রাজস্থানের দেবী গৌরী, ইনি শস্যদেবী। পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটে পুজো পান দেবী ভবানী ও দেবী শীতলা। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের পুজো পান প্রধানত দেবীরা। এঁরা হলেন ‘সর্না বুড়ি’, চণ্ডা’, ‘ঠাকুরানী মা’, ‘কালী’, ‘জ্বালামুখী’, ‘ডাকিনী’, ‘অঙ্গারমতী’, ‘বুড়িয়া মাঈ’, ‘বনসুরী দেবী’, ‘নাগিনী মাতা’, ‘মনসা মাতা’, ‘দিদিঠাকরুণ’ ইত্যাদি। দক্ষিণভারতে দেবীর সংখ্যা আরও বেশি। হ্যাঁ দেবীর সংখ্যা। দেবতারা তুলনায় খুবই সংখ্যালঘু। এইসব দেবীদের নামের পিছনে ‘আম্মা’ অর্থাৎ ‘মা’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণেই সমাজে দেবের চেয়ে দেবীর প্রভাব বৈদিক যুগে ছিল আরও বেশি ।

সাংখ্য রচয়িতারা সমাজের চারপাশের মাতৃপ্রাধান্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অ-আর্যভাষীদের উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নারী-পুরুষ মিলনের জাদুবিশ্বাসও প্রভাব ফেলেছিল।

লিঙ্গ ও যোনি পুজোর মধ্যে দার্শনিক যৌন-দ্বৈতের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে

চেয়েছিলেন সাংখ্য রচয়িতারা। তাঁরা নারী-পুরুষের মিলনের মধ্যে

পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনকে খুঁজে পেয়েছিলেন।

সাংখ্যের এই তত্ত্বের উপরই দাঁড়িয়ে

আছে যোগ ও তন্ত্র।

error: Content is protected !!