সাঁওতাল সমাজে   ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে বিশ্বাস সমুদ্র-গভীর। এই সমাজের যারা শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত তাঁদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যেও ডাইনিদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বিষয়ে বিশ্বাস গভীর। একই সঙ্গে তাঁরা জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতায় ও তাঁদের ডাইনি খুঁজে বের করার ক্ষমতায় আস্থাশীল।

যারা ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্থঃ বাস্তবিকই ডাইনি ও জানগুরুদের কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে? কি নেই?

সিংরাই মর্মু বাঁকুড়া জেলায় ডাইনি প্রথা অসাধু ব্যক্তি আছে, আদিবাসী ভাষায় এদের সানি ও সখা বলে। ভালো কথায় জানগুরু। ইতি ভূত প্রেত ধরতে জানেন এবং কেউ ডাইনি হলে ঠিক রকম বলতে পারলে কিন্তু ডাইনি ছাড়াতেও পারে অবশ্য সেই জন্য মোটা টাকা দক্ষিণা হিসেবে দাবি করে। এবং ডাইনি কাউকে করিলে জরিমানা করা হয় বা দিতে হয়। কিন্তু যার দু মুঠো অন্ন সময়ে জোটে না, জীবন শেষ হয়ে যার তার পক্ষে মোটা টাকা দেওয়া কি রকম কষ্টকর তা সহজেই অনুমেয়। এই ব্যাপারে আমরা বহু সমাজ সমিতি করেছি এবং বহু জায়গায় আমরা আদিবাসীর সমাজে সে আলোচনা করেছি কিন্তু তাতেও কোনও পড়েনি- বেশির দিকে চলে যাচ্ছে এবং এই ডাইনি বাংলায় বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের বহুবার তুলে দিয়েছিলাম। কি ভারতবর্ষ সমাজ দিককে নিপুঞ্জকর এবং পুলিশদের হাতেও এই ব্যাপারে তুলে দিয়েছিল, কিন্তু কোনও ফায়দা হয়নি। সে জন্য আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে দুঃখিত। আমার জীবনের যাত্রাতে এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা হল বাংলা ১৩৭৫ সাল ১৫ই আশ্বিন। আমাদের গ্রামে বৃদ্ধা মহিলা মুড়ি ভাজতে গিয়ে তাঁহার বাঁ পায়ের বাইরের চামড়া আগুনের তাপে ঝলসে যায়। জ্বলে যাবার পর স্থানীয় ডাক্তারের অভাবে তাঁহার পরিবারের লোকেরা জঙ্গলের মধ্যের শিকড়-বাকড়ের ওষুধ বেঁধে সেই ঘায়ের উপর লাগাল। কিছুদিনের পর দেখা গেল ঘা-টি আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে এবং নতুন চামড়া গজাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার সেই বৃদ্ধ মহিলা আর স্থির হতে পারছেন না, চলা ফেরার জন্য অস্থির। কোনও রকমে আর রাখা গেলো না। যেমনি চলাফেরা করলেন তেমনি তাঁর পায়ের চামড়া ফেটে ঝরঝর করে রক্ত বেরোতে লাগল। পায়ের অবস্থা আরও মন্দ হয়ে দাঁড়ালো। সেই মহিলার একটি ছেলে, যে হচ্ছে একজন প্রথম শ্রেণীর শিক্ষক। মায়ের কেটে যাওয়া ঘা দেখে তার মধ্যে একটা সন্দেহ ফুটে উঠল। আমার মা আর ভালো হবে না এবং আমার মাকে ডাইনি আক্রমণ করেছে। এতো ওষুধ লাগাচ্ছি ভালো হচ্ছে না কেন? তাহলে ডাইনি ছাড়া কোনও কিছু আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু এইটুকু শিক্ষক মশাই বুঝতে পারলেন না, মায়ের ঘা এখনও শুকোয়নি চলাফেরা বন্ধ হোক। কিন্তু তা সে করল না। তিনি সোজা গ্রামের মোড়লকে আবেদন দিলেন, মায়ের ঘাটি ভালো হতে হতে কেন রক্তঝরণা হয়? এতে নিশ্চয়ই কিছু আছে।

মোড়ল শিক্ষক মহাশয়ের আবেদন শুনে ঠিক করল, তাড়াতাড়ি পাড়ার লোককে ডেকে এবং মাস্টার মহাশয়ের ব্যাপারটার একটা সিদ্ধান্ত নেন। আমরা সবাই মোড়লের নির্দেশ অনুযায়ী সব ব্যাপারটা হ্যাঁ করলাম কারণ তাঁর কথা অমান্য করা মানে সংসারে আগুন ফেঁকা। কাজেই মোড়লের আদেশ অনু্যায়ী আমরা সবাই পাড়ার লোক তেল ও খড়ি দেখব। কি কারণে মায়ের ঘা ভালো হচ্ছে না। সবাই এক হয়ে একটি ওঝার কাছে যাওয়া গেল। তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন আমাদের শিক্ষক মহাশয় এক মুঠো শালপাতা এবং ২৫০ গ্রাম তেল। সেই তেল দিয়া ওঝাবাবু আমাদের দেবতাকে ধরবে। ওঝাবাবু শালপাতায় তিন ফোঁটা সরিষার তেল দিয়া পানের মতন মুড়ে নিজের গায়ে ঝুলিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চেপে রাখলেন। মিনিট পাঁচ পরেই সেই শালপাতায় নানারকম ছবি দেখা গেল। এতে আমাদের কাছে পরিষ্কার ভাবে দেখিয়ে দিলেন, তোমাদের সমস্যাটি পুরোপুরি জানলাম। এটা কোনও পাড়ার যোগতী তেল নয়, এটা একটা মালিকের তেল এবং মালিক পাড়ার সহযোগিতা নিয়েছে। সবাই আমরা হ্যাঁ করি এবং পরিষ্কার ভাবে ওঝাবাবু দেখিয়ে দেন, ঘরের পশ্চিম পাশে একটি আধাবয়স্ক মহিলা আছে। সে বিধবা, সেই মায়ের ওপর অত্যাচার আক্রমণ চালাচ্ছে। পরিষ্কার আমাদের মোড়ল থেকে পাড়ার সবাইকে ওঝাবাবু খুশি করিয়ে দেয় কিন্তু আমার কোনও উপায় ছিল না কারণ একে সবার চেয়ে বয়েসে ছোট তাই বলার কোনও সুযোগ নাই। পরে সবাই আমরা ওঝাবাবুর মতামত শুনে তাঁকে দশটাকা দক্ষিণা দিয়া  সবাই আমরা ওখান থেকে সরে যাই। কিছু কিছুদূর আসার পর আমাদের মোড়লবাবু একটা আদেশ করেন। কি ব্যাপার, কতটা সত্য আরও অন্য দুই জায়গাতে দেখা যাক। পরে আমরা একটা আলো নিয়ে আসব।

সেদিন সকাল থেকে খাওয়া-দাওয়া নাই সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমরা অন্য আরও দুই জায়গাতে দেখলাম। ব্যাপারটি সন্দেহজনক, কিন্তু আমি সন্দেহ করি না। কারণ যদি মহিলাটি ডাইনি হতেন- তাঁর সন্তানের আমার মত বয়স, এবং সে ছেলে আমার সঙ্গে ঘোরাফেরা করেছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে। সবাই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু উপায় ছিল না। সেদিন আমরা পাড়ার লোক গ্রামে ফিরে আসার পর মোড়লবাবু আর একটি আদেশ করলেন। আমরা যে তিন জায়গাতে তেল খড়ি করলাম আরও আশপাশে তিনটি গ্রামে দিতে হবে। সবাই আমরা আরও তিনটি গ্রামে তেল খড়ি পৌঁছিয়ে দিলাম এবং সবাইকে এক দুই দিনের মধ্যে Result চাইলাম যথাক্রমে আমরা একই দিনে সব লোকের তেল খড়ি মিলিয়ে দেখলাম ওই পশ্চিম পাশের মহিলাটি ডাইনি বলে, আমাদের তেল খড়িতে বেরিয়েছে আর কোনও কথা নাই- সবাই গেলাম ওঝাবাবুর কাছে। দিন ঠিক করা হল এবং মোড়লবাবুর আদেশ অনু্যায়ী আমরা সবাই সখা বাবুর কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু যাবার আগে মোড়লবাবু একটি কথা ঘোষণা করেন যেন আমরা সবাই সখাবাবুর কাছে যাব। যাবার আগে আমি একটা কথা ঘোষণা করছি- “আমাদের মধ্যে কেউ যদি ডাইনি হয়, তাকে জরিমানা হিসেবে ৩০০ টাকা দিতে হবে নইলে পাঁচ বিঘা জমি আমরা দখল করে নেব”। আমার কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে অমত। আমার সন্দেহ একান্ত বৃথা। মোড়লের আদেশ অনুযায়ী সকাল ১০টার সময় সখাবাবু মন্দির মুখে জপ করছিল। আমাদের দলবল দেখে সখাবাবু হাসিমুখ করে কিন্তু আমার মুখ শুকনো। আমরা সবাই সখাবাবুর চরণ ধুলো মাথায় নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষক মহাশয় ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল সখাবাবুর হাতে তুলে দিলেন। সখাবাবু নিজের দেবতাকে তাঁর ভাষায় কিছু বলিলেন। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ফলাফল জানালেন। “তোমাদের তেলের ভিতর দোষ আছে। যদি তোমরা তেল পরিষ্কার করতে চাও তাহলে আমার দক্ষিণা হিসেবে ৩,০০০ টাকা আমার মন্দিরে রাখ এবং আমি তোমাদের সব কিছু পরিষ্কার করে দেব। কোনও চিন্তা নাই।“ কিছুক্ষণ পর সখাবাবু বললেন, “ঘরে একটি বিপদ কিছুদিন আগে হয়েছে কিন্তু তোমরা অনেক কিছু করেছ এতে ঠিক হয়নি। যাক ঠিক হয়ে যাবে।“ আমরা চাঁদা করে ৩,০০০ টাকা দক্ষিণ হিসেবে মন্দিরে রাখলাম এবং সখাবাবুর কথা অনুযায়ী মাকে কিছুদিন চলাফেরা বন্ধ করা হল। একটা ওষুধ দিলেন, দিনে দুবার লাগানোর জন্য- মা কালীকে স্মরণ করে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই। ভালোভাবে ভুঁড়িটি করে দিলেন। আমার করার কিছুই ছিল না। পরে বুঝলাম সব। কিছুদিন পরে বৃদ্ধা ভালো হয়ে যান।

ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের শরিক এবং ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের অধ্যক্ষ গুরুচরণ মুর্মুর কথায় “সান্তাড়দের (সাঁওতালদের) পুরাতন বৃদ্ধ কথায়”, (সাঁওতালি ভাষায়- “হড় করেন মারে হাপড়ামক রেয়াও কথা”) আছে কিভাবে একজন জ্ঞানী ‘জানগুরু’ তাঁর অদ্ভুত সব ক্ষমতার পরিচয় দিতেন। জানগুরু তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে বলে দিতে পারতেন রোগীর নাম, রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের নাম। রোগিণী বিবাহিতা হলে তাঁর স্বামীর শ্বশুর-শাশুড়ীর নাম পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন। অথচ রোগী বাঁ রোগিণী হয় তো দূর গ্রামের বাসিন্দা, বলতে পারতেন, রোগের কারণ অপদেবতা বা ডাইনি। অপদেবতা বা ডাইনির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়ও বলে দিতে পারতেন।

গুরুচরণের কথা মত, “তখনকার জানদের (জানগুরুদের) বিশ্বাস করানোর মত কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তবে কি ডাইনিও ছিল? উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে কোন লোকের যদি অলৌকিক ক্ষমতায় ভাল করার শক্তি থাকে তাহলে অলৌকিক ক্ষমতায় মন্দ করার শক্তিকে অস্বীকার করা অযৌক্তিক। একজনের অলৌকিক শুভ শক্তিকে স্বীকার করলে অন্য আর একজনের অলৌকিক অশুভ শক্তিকেও স্বীকার করতে হয়। তন্ত্র সাধনার গভীরতায় না গিয়েও বলা যায় ষটকর্মের স্তন্তন, বিদ্বেষ, উচাটন-মারনের কথাও অনৈতিকহাসিক নয়।”

সুখেন সাঁতারা ডাইনি প্রথার বিরোধী। তাঁর ধারণায়, এইসব ডাইনির মত মধ্যযুগীয় প্রথাগুলো তাঁদের সমাজে আরও বহুদিন প্রচলিত থাকবে। থাকবে না কেন, যে সমাজের তিন ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার মধ্যে বাস করে সেই সমাজ থেকে এই অন্ধ সংস্কারের জগদ্দল পাথরকে ঠেলে সরাবার মত মহাজন কোথায়?

এইসবই সুখেনের কথা। আবার এই সুখেনই বলেন, “রোগীরই অর্ধেক রোগ সেরে যায়। এই রকম ভাবে কারও পেটে সারা হলে ভূটভাট করলে পাড়ায় পাড়ায় বুড়ো-বুড়িদের নুন পড়া দিতে দেখেছি। অর্থাৎ নুন নিয়ে মন্ত্র পড়ে দেয়, সেটা জল দিয়ে তিনদিন খেতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি পেটে বায়ু জমা রোগীর পক্ষে নুন জল খুব উপকারী। সেইরকম ভাবে শরীরে কোথাও  মোচড় লেগে গেলে তেলপড়ার বিধান। অর্থাৎ, মন্ত্রপূত সরষের তেল দিয়ে মালিশ। এক্ষেত্রে ওই রোগীর সরষের মালিশটাই কাজ করে। আবার শোয়ার দোষে ঘাড়ে ব্যথা লাগলে বোতলে করে গরম জল ভরে ঘাড়ে তাপ দিতে দিতে মন্ত্র পড়তে দেখেছি। ওই তাপটাই ঘাড়ের ব্যথা উপশমের কাজ করে এখানে।

এমনি আরও বহু রকম রোগের বহুরকম ঝারফুঁক তুকতাকের ব্যাপার আছে যেগুলোর সঙ্গে আবার কোনরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মলে না। যেমন কাউকে সাপে কাটলে আমি গাঁ-গঞ্জের বহু ওঝাকে দেখেছি কেবল মন্ত্র ঝাড়ফুঁক করেই তার বিষ নামিয়ে দেয়। সে বিষধর সাপ হলেও। এইতো কিছুদিন আগে আমার মাকে রাত্রিবেলা চন্দুরে বোরা কামড়ে দিল। বিষের জ্বালায় মায়ের শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল, চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলেন। এইরকম একটি রোগীকে আমাদেরই পাড়ার একটি বউ কি একটা গাছের শিকড় দিয়ে (ওরা নাম বলতে চায় না) হাত চেলে আর ঝাড়ফুঁক দিয়ে মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে সারিয়ে তুলল। আমাকে অসংখ্যবার নানা ধরনের সাপে কেটেছে। কিন্তু আমি কখনো হাসপাতালে যাইনি ওই ঝাড়ফুঁকেতেই ভাল হয়েছে।

আবার সাপে কাটা রোগীকে থালা পড়া,  সরা পড়া দিয়েও ভাল করতে দেখেছি। তেমন রোজাও আমাদের গাঁয়ে এখনও আছে। পিতলের থালায় মন্ত্র পড়ে রোগীর পিঠের ওপর ছুঁড়ে দেয়। সেই থালা চুম্বকের মত রোগীর পিঠের ওপর টেনে ধরে। যতক্ষন না বিষ নামে থালা ছাড়তে চায় না। সরা পড়াটা আবার আরও আশ্চর্যের ব্যাপার। রোজা একটা মাটির সরায় মন্ত্র পড়ে দিয়ে রোগীকে ঝাড়ফুঁক করতে থাকে। এবার যতক্ষন না রোগীর দেহ থেকে বিষ নামবে ততক্ষণ ওই সরা আছার মেরেও কেউ ভাঙতে পারবে না। তবে কোন সাপে কাটা রোগীকে যদি কোন ডাইনি ভেড়ে দেয় তাহলে কোন রোজার বাপের সাধ্যি নেই বিষ নামায়। এইজন্য কাউকে সাপে কাটলে সে কথা রোজার কাছে ছাড়া কারও কাছে প্রকাশ করতে নেই। বলা যায় না কার পেটে কি আছে, যদি ভেড়ে দেয় তখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি। ডাইনিকে তো আর আলাদা করে চেনা যায় না। আমাদের মতই মানুষ সে। সুতরাং চেনা দায়। আমাদের পাড়াতেও তো এমনি এক ডাইনি বুড়ি আছে। গরুর বাচ্চা হলে এরা বাঁটের দুধ শুকিয়ে দেয় মন্ত্র দিয়ে। সদ্য-প্রসূতি মায়েদের এমন মাখ দেড়ে দেবে ছেলে আর মাই খাবে না। মাইয়েতে যন্ত্রণা হবে। তখন আবার রোজার কাছে যাও, সে জল পড়া দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে তবে ভাল করবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা মাদুলিও দিয়ে দেয় পাঁচসিকে আড়াই টাকা দাম মূল্য নিয়ে, যাতে ওই ডাইনিতে পুনর্বার আর মাই না ভাড়তে পারে। গরুর গলাতে জিওলের বোল বেঁধে দিলেও ডাইনিরা আর ভাড়তে পারে না। আবার কারও গায়ে ঘা-ছি হলেও রক্ষে নেই। অমনি ডাইনিরা পাকা আমের মত গন্ধ পায়। সঙ্গে সঙ্গে ভেড়ে দেয় তারা। তখন সেই ঘা আর মোটে সারতে চায় না।

তবে ডাইনিদেরও জব্দ করার রাস্তা আছে। নিজের পায়খানা নিয়ে ওকে খাইয়ে দাও, ব্যাস, ডাইনি তার মন্ত্র ভুলে যাবে। এমনি একবার এক ঘটনা ঘটেছিল- এক বৌয়ের শাশুড়ি ডাইনি ছিল। তা বউয়ের পায়ে হোঁচট লেগে খানিকটা কেটে গেছিল। অমনি ডাইনি তা থেকে পাকা আমের গন্ধ পেল। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। নিজের বউকেই ভেড়ে দিল।  তা বউতো ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে সারা। কত পয়সা খরচ হতে লাগল, কত ওষুধ খেল সেই ঘা আর ভাল হতে চায় না। হবে কি করে, ঘরেতেই যার ডাইনি। বরং দিনে দিনে তার ঘা আরো বাড়তে লাগল। বউতো মহাচিন্তায় পড়ল। সোয়ামীকে বললে বলে- তোমার জন্যে কি আমি মাকে দূর করে দোব।

চিন্তায় চিন্তায় বউ তো শুকায়। তখন গায়ের এক তিন মাথা বুড়ি তাকে পরামর্শ দিল। বলে, -ওলো বউ, তুই বরং এক কাজ কর, তোর শাউড়ীকে ডালের সঙ্গে গু খাইয়ে দে, দেখবি ও ওর ডাইনি মন্ত্র ভুলে যাবে। নিরুপায় বউ তাই করল। ডাইনিও তার মন্ত্র ভুলে গিয়ে দিনে দিনে রুগ্ন হয়ে একদিন মরে গেল। সেজন্য অবশ্য বউ ডাক ছেড়ে খুব কেঁদেছিল। কারণ শাউড়ী ডাইনি হলেও তার মরণতো সে চায়নি।”

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের এই উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর “আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার” লেখাটিতে এক জায়গায় বলেছেন। “এটাকে (ডাইনি প্রথাকে) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ।

অর্থাৎ শ্রীবাস্কের ধারণায়- ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। ক্ষতিকারক মানে? ডাইনি বিদ্যার সাহায্যে, ডাইনি ক্ষমতার সাহায্যে মানুষের ক্ষতি করা সম্ভব? অর্থাৎ ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে?

শ্রীবাস্কে আরও বলেছেন, “অনেক আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস, তুক-তাক ও ইন্দ্রজাল (black magic) বিদ্যায় মেয়েরাই পারদর্শী হয়। স্বাভাবিক কারণেই তারা দুর্বল। সমাজে নানা কাজে পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাদের অনেক কিছু স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। বিশেষ করে ঋতুবতী নারীর সম্পর্কে কিছু কিছু সংস্কার পৃথিবীর সব সমাজেই প্রচলিত আছে। এই অবহেলার জন্য অনেকে ক্রুদ্ধ হয় আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এ বিদ্যা আয়ত্ত করে থাকে।”

বাস্তবিকই কি ‘ডাইন-বিদ্যা’র অস্তিত্ব আছে? ডাইনি বিদ্যায় অন্যের মধ্যে রোগ সংক্রমিত করা যায়? উচাটন-মারন মন্ত্রে যে কোনও প্রাণীর মৃত্যু ঘটান সম্ভব?

শ্রী বাস্কের প্রগতিশীল সংগ্রামী মন অবশ্য সেই সঙ্গে একথাও বলে, “এ সব মেয়েরা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করে এবং তারা মনে করে যে অন্যের ক্ষতি করার স্বাভাবিক ক্ষমতা তাদের আছে। এ ক্ষতি হয়তো কোন অলৌকিক উপায়ে ঘটে না, কৌশলে কার্যকারণের যোগসাজোসেই এ সব হয়তো ঘটিয়ে থাকে।”

শ্রীবাস্কের মনেই সংশয় থেকে গেছে- হয়তো ডাইনিরা অলৌকিক উপায়ে ক্ষতিসাধান করে না। অর্থাৎ ডাইনিরা হয়তো অলৌকিক উপায়েই ক্ষতি সাধন করে। শ্রীবাস্কের মনেই যদি ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে কি নেই- এই বিষয়ে সংশয় থাকে তাহলে সাধারণ সাঁওতাল সমাজের মানুষের ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক।

শ্রীবাস্কে ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে কতকগুলো উপায় উল্লেখ করেছিলেন। তার মধ্যে ডাইনি বিদ্যার অপকারিতা সম্পর্কে নাটক মঞ্চস্থ ও তথ্যচিত্র তোলার কথা ছিল। কিন্তু ডাইনি বিদ্যা বলে বিদ্যাই যেখানে কল্পনা মাত্র, সেখানে ডাইনি বিদ্যার পক্ষে বা বিপক্ষে বলার প্রশ্নই উঠতে পারে না। বাস্তব সত্যকে সাধারণের সামনে তুলে ধরা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং আদিবাসী সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য সহজ-সরল

নদীয়া জেলার জনৈক জানগুরু

যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে- ডাইনি বিদ্যা বলে কোনও বিদ্যার অস্তিত্ব নেই। জানগুরু, সখা ও ওঝাদেরও নেই কোনও অলৌকিক ক্ষমতা।

ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যাদের কথা এতোক্ষণ আলোচনা করলাম, তাঁদের প্রত্যেকের প্রচেষ্টায় ও আন্তরিকতায় আমি শ্রদ্ধাদনত। শুধু এটুকু মনে হয়েছে- তাঁদের আন্তরিকতার সঙ্গে অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে দৃষ্টির স্বচ্ছতা যুক্ত হলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

ডাইনি প্রথা বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবী জানিয়ে ইতিমধ্যে পত্রিকা ও প্রচারপত্র মারফৎ দাবী জানিয়েছেন সারদাপ্রসাদ কিসকু, সভাপতি, সাঁওতাল সাহিত্য পরিষদ; মহাদেব হাঁসদা, সম্পাদক, “ভেতরে’ মাসিক পত্রিকা; কলেন্দ্রনাথ মান্ডি, সম্পাদক, ‘সিলি’ দ্বিমাসিক পত্রিকা; গুরুদাস মুর্মু, সম্পাদক, ‘খেরওয়াল জারপা’; বালিশ্বর সরেন, সম্পাদক, ‘জিরিহিরি’।

দাবী পত্রে তাঁরা জানিয়েছিলেন, “…ভন্ড জানগুরুদের কথায় বিশ্বাস করে কত যে অপরাধ, অন্যায়, অবিচার সংঘটিত হচ্ছে, তা বলে শেষ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ডাইনি প্রথা একটা অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তো নাই-ই, পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে কোনও উপকার পাবার প্রশ্নও নেই। এর মূল সমাজের এত ভিতরে প্রবেশ করেছে যে এক্ষুণি এর অবসান ঘটানো সাধারণের ক্ষমতার অতীত। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দীর্ঘদিন পরেও ভারতের মত একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের এ ধরনের কু-প্রথার অস্তিত্ব বিস্ময়জনক।

এই প্রথার উচ্ছেদকল্পে
সরকার যদি আইন প্রণয়ন করেন, অন্তত
ভন্ড জানগুরুদের বে-আইনী বলে ঘোষণা করেন,
তাহলেই এই ক্ষতিকারক প্রথার উচ্ছেদ সাধিত হতে পারে।
আমরা এ বিষয়ে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের
সহানুভূতি কামনা করছি এবং আশু ডাইনি
প্রথা বিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য
অনুরোধ জানাচ্ছি।

যুগ যুগ ধরে যে বিশ্বাস আদিবাসীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে রয়েছে তা কয়েকজনের ব্যক্তি প্রচেষ্টায় বা কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চেষ্টায় (সে চেষ্টা যতই আন্তরিক ও ব্যাপক হোক না কেন) নিমেষে যাবার নয়। এ জন্য আরও বেশি করে সমাজসচেতন মানুষ ও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সরকারী প্রশাসনকে। দীর্ঘদিন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বহুজনের চেষ্টাতেই সম্ভব এই অবস্থা থেকে উত্তরণ। কিন্তু বহুজন করে এগিয়ে আসবে এ আশায় বসে না থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। আমার কথায় কাজ হচ্ছে, কাজ চলছে। বহু আদিবাসীরাও এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। এগিয়ে এসেছেন কিছু প্রতিষ্ঠান। আমাদের সমিতিও সীমিত ক্ষমতায়  আদিবাসীদের অন্ধ সংস্কার থেকে মুক্ত করতে কাজ করছে বিভিন্ন ভাবে। সারাও পাচ্ছি বিপুলভাবে।

আমরা হাজির হচ্ছি একটু নতুন ভাবে। আমাদের সমিতি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামে অনুষ্ঠান করতে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে প্রতিনিয়ত যাচ্ছে, তার মধ্যে আদিবাসীপল্লীও পড়ে। যখন যাই তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই স্থানীয় বিশাল অঞ্চল জুড়ে যত জানগুরু, সখা, সৎসখা, দিখলী, ওঝা (সচরাচর সাঁওতাল সমাজ যাদের ‘জানগুরু’ বলে বিভিন্ন আদিবাসী-অধ্যুষিত জেলায় তারাই এ সব নামে পরিচিত) ও অবতারদের বিষয়ে খবর নিই- তারা কি কি ধরনের অলৌকিক ক্ষমতার (?) অধিকারী। অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালান হয়। ফলে আশ-পাশের গাঁয়ের মানুষ নানা অলৌকিক ঘটনা দেখার উৎসাহে হাজির হন। স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতাবানদের এতদিন ধরে ঘটানো ঘটনাগুলোই আমাদের সমিতির সভ্যরা অনুষ্ঠানে ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন। ঘটাগুলো দেখাবার পর বোঝাচ্ছেন -এগুলো কোন অলৌকিক ঘটনা নয়, কৌশলে ঘটাচ্ছি। আপনারাও যে কেউ চেষ্টা করলেই এমনটা ঘটাতে পারবেন, তারপর দর্শকদের দিয়েও ঘটনাগুলো ঘটানো হতে থাকে। উৎসাহী গ্রামবাসীরা হুড়মুড় করে এগিয়ে আসতে থাকেন। এবং অদ্ভুত সব ঘটনা হাতে-কলমে করার কৌতূহলে, আনন্দে, এতদিনের দেখা জানগুরুদের ঘটানো ঘটনাগুলো যে ওঁরাও ঘটাতে পারেন, এই প্রত্যয় বহুর মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা ঘোষনা করি – আপনারা তো কৌশলগুলো জেনে গেলন, এবার জানগুরুদের এসব কৌশল গ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দিন, দেখতে পাবেন ওদের সব জারিজুরু বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো ঘটানোর কৌশলগুলো আপনারা জানতেন না, ওরা জানতো। সেই কৌশল নিয়ে এতদিন আপনাদের ঠকিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করেছে, টোটক্যা ওষুধে অসুখ সারাতে না পারলে নিজের দোষ ঢাকতে আপনাদেরই কারও পরিবারের নিরীহ মেয়েদের ডাইনি বলে ঘোষণা করেছে। ওরা যা করে সব কৌশলেই করে, অলৌকিক ক্ষমতায় নয়।

আরও একটা কাজও আমরা করি। অনেষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা প্রকাশ্যে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়েই স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন। চ্যালেঞ্জের জবাবে কেউ হাজির হলে তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবশ্যই পরাজিত হন। হাজির না হলে গ্রামবাসীদের উপর তাঁদের প্রভাব প্রচণ্ড কমে যায়। ওঝা, জানগুরু, সখাজাতীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের বুজরুকি বন্ধ হলে ডাইনি চিহ্নিত করার কাজও বন্ধ হয়, কারণ এঁরাই ডাইনি চিহ্নিত করেন। অবশ্য এরই পাশাপাশি আরও বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার আশু প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতায় কিছু কিছু পর্যায়ে কাজঅ করছি।

বিভিন্ন জানগুরুদের ক্ষমতার কৌশল নিয়ে পরে আলোচনা করব। এবং এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য আপাতত কি কি করা যেতে পারে সে প্রসঙ্গেও আসব। কিন্তু তার আগে ‘ডাইনি’ নিয়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনায় যাওয়ার অনুভব করছি। সমস্যাটির বিষয়ে মোটামুটি ধারণা না দিয়েই সমাধানের বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়াটা বোধহয় সমীচীন হবে না।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x