আগের অধ্যায়গুলিতে আমরা দেখেছি কালের কর্ম সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে। এই শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত লোকের বিশ্বাস ছিল পরম কালে। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনাকেই “কাল” নামক একটি বিশেষ সংখ্যা দ্বারা অনন্য উপায়ে চিহ্নিত করা যায় এবং বিশ্বাস ছিল দুটি ঘটনার অন্তর্বর্তী কাল বিষয়ে প্রতিটি ভাল ঘড়িরই মতৈক্য থাকবে। কিন্তু পর্যবেক্ষক যে ভাবেই চলমান হোন না কেন আলোকের গতি সব সময় প্রতিটি পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ একই মনে হবে- এই আবিষ্কার অপেক্ষবাদের পথ দেখাল এবং তার ফলে অনন্য পরম কাল সম্পর্কিত চিন্তাধারা পরিত্যাগ করতে হল। তার বদলে ধারণা হল প্রতিটি পর্যবেক্ষকেরই কালের মাপন হবে তার নিজস্ব এবং সেটা চিহ্নিত হবে তিনি যে ঘড়ি বহন করছেন তার সাহায্যে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের বহন করা নিজস্ব ঘড়িতে সব সময় মতৈক্য থাকবে তার কোনো অর্থ নেই। সুতরাং কাল হয়ে দাঁড়াল। একটি আরও ব্যক্তিগত ধারণা এবং সে ধারণা যে পর্যবেক্ষক মাপছেন সেই পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ।
মহাকর্ষের সঙ্গে কণাবাদী বলবিদ্যা মেলানোর চেষ্টার ফলে ‘কাল্পনিক’ কাল সম্পর্কিত চিন্তন উপস্থিত করতে হয়েছে। কাল্পনিক কালের সঙ্গে স্থানে অভিমুখের পার্থক্য করা সম্ভব নয়। কেউ উত্তরে গোলে- অভিমুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তিনি দক্ষিণেও যেতে পারেন। কেউ যদি কাল্পনিক কালে সম্মুখে যেতে পারেন তাহলে অভিমুখ ঘুরিয়ে তাঁর পশ্চাতে যাওয়াও সম্ভব হওয়া উচিৎ। এর অর্থঃ কাল্পনিক কালে অগ্র পশ্চাৎ অভিমুখের ভিতরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য থাকা সম্ভব নয়। অন্য দিকে ‘বাস্তব’ কালের অভিমুখে দৃষ্টি দিলে অগ্র পশ্চাৎ অভিমুখের ভিতরে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। আমরা সবাই একথা জানি। অতীত এবং ভবিষ্যতের এই পার্থক্যের উৎস কি? কেন আমরা অতীতকে মনে রাখি কিন্তু ভবিষ্যৎকে মনে রাখি না?
বিজ্ঞানের বিধিগুলি অতীত এবং ভবিষ্যতের ভিতরে কোনো পার্থক্য স্বীকার করে না। আগের ব্যাখ্যা মতো আরও সঠিকভাবে বলা যায় C, P এবং T –এর সমন্বয় ক্রিয়াতে (কিম্বা প্রতিসাম্য- symmetries) বিজ্ঞানের বিধিগুলি অপরিবর্তিত থাকে। (C- এর অর্থ কণিকার বিপরীত কণিকায় পরিবর্তন, এবং T –এর অর্থ সমস্ত কণিকার গতির অভিমুখ বিপরীত করাঃ কার্যত কণিকার গতিকে পশ্চাৎমুখী করা)। C এবং P –নামক দুটি ক্রিয়া স্বকৃতভাবে সমন্বিত হলেও সমস্ত স্বাভাবিক অবস্থায় বিজ্ঞানের যে বিধিগুলি পদার্থের নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলি অপরিবর্তিত থাকে। অন্যভাবে বলা যায় অন্য একটি গ্রহের অধিবাসীরা যদি আমাদের দর্পণ প্রতিমিম্ব হয় এবং যদি পদার্থ নিয়ে গঠিত না হয়ে বিপরীত পদার্থ দিয়ে গঠিত হয় তাহলেও তাদের জীবন একই রকম হবে।
C এবং P ক্রিয়া আর CP এবং T ক্রিয়ার সমন্বয়ে যদি বিজ্ঞানের বিধিগুলি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে শুধুমাত্র T ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও সেগুলি অপরিবর্তিত থাকবে। তবুও সাধারণ জীবনে বাস্তব কালের ক্ষেত্রে অগ্র পশ্চাৎ অভিমুখে একটি বিরাট পার্থক্য থাকে। কল্পনা করুন টেবিল থেকে একটি জলের পেয়ালা মেঝেতে পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এর একটি আলোকচিত্র নিলে আপনি সহজেই বলতে পারবেন চিত্রটি অগ্রগামী না পশ্চাৎগামী। আপনি অতীতের দিকে চালনা করলে দেখবেন টুকরোগুলি মেঝে থেকে হঠাৎ একত্রিত হয়ে লাফিয়ে টেবিলের উপর উঠে একটি সম্পূর্ণ পেয়ালা হয়ে গিয়েছে। আপনি বলতে পারবেন আলোকচিত্রটি পশ্চাৎগামী, কারণ এরকম আচরণ সাধারণ কখনোই দেখা যায় না। এরকম হলে যারা চীনামাটির বসানপত্র তৈরি করে তাদের ব্যবসা উঠে যেত।
পেয়ালার ভাঙ্গা টুকরোগুলি মেঝেতে একত্র হয়ে কেন আবার টেবিলে ওঠে না, তার কারণ সাধারণত দেখানো হয়ঃ তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় বিধি অনুসারে এটা নিষিদ্ধ। এই বিধি অনুসারে যে কোনো বদ্ধ তন্ত্রে (closed system) কালের সঙ্গে সঙ্গে বিশৃঙ্খল (entropy) সব সময়ই বৃদ্ধি পায়। অন্য কথায় বলা যায়, এটা এক ধরনের মারফির বিধি (murphy’s law)। জিনিষপত্র সব সময়েই গোলমাল হয়ে যেতে চায়। টেবিলের উপরের না ভাঙ্গা পেয়ালাটি একটি উঁচুদরের সংগঠিত অবস্থা; মেঝের উপরের ভাঙ্গা পেয়ালাটি একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা। টেবিলের উপরের অতীতের পেয়ালা থেকে মেঝের উপরের ভবিষ্যতের ভাঙ্গা পেয়ালায় স্বচ্ছন্দেই যাওয়া যায় কিন্তু উল্টো দিকে যাওয়া যায় না।
তথাকথিত কালের তীরের একটি উদাহরণ হল কালের সঙ্গে বিশৃঙ্খলা (এনট্রপি –entropy) বৃদ্ধি। এই কালের তীর অতীত আর ভবিষ্যতের পার্থক্য আনে, কালকে একটি অভিমুখ দান করে। অন্ততপক্ষে তিনটি বিভিন্ন কালের তির রয়েছে। প্রথমটি তাপগতীয় (thermo-dynamic) কালের তীর-অর্থাৎ কালের যে অভিমুখে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কালের তীর (psychological arrow of time)। এটা হল সেই অভিমুখ –যে অভিমুখে আমরা কালের স্রোত বোধ করি- যে অভিমুখে অতীত স্মরণ করি কিন্তু ভবিষ্যৎ স্মরণ করি না। আর অন্তিমে রয়েছে মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক (cosmological) কালের তীর। মহাবিশ্ব সংকুচিত না হয়ে যে অভিমুখে সম্প্রসারিত হচ্ছে এটা হল সেই অভিমুখ।
মহাবিশ্বের সীমানাহীনতার অবস্থার সঙ্গে দুর্বল নরত্বীয় নিতি যুক্ত করলে তিনটি তীরের কেন একই অভিমুখ – সেটা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তাছাড়া ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কেনই বা একটি ভাল সংজ্ঞাবিশিষ্ট কালের তীর থাকবে। এই অধ্যায়ে আমি সেই তথ্যের সমর্থনে যুক্তি দেখাব। আমার যুক্তি হবে তাপগতীয় তীর নির্ধারণ করে মনস্তাত্ত্বিক তীর এবং এই দুটি তীরের অভিমুখ অবশ্যম্ভাবী রূপে সব সময় অভিন্ন। যদি মহাবিশ্বের সীমানাহীন অবস্থা মেনে নেওয়া হয় তাহলে আমরা দেখব সুসংজ্ঞায়িত তাপগতীয় এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক কালের তীর অবশ্যই থাকবে কিন্তু মহাবিশ্বের ইতিহাসের সমগ্রকালে তাদের অভিমুখ এক থাকবে না। কিন্তু আমার যুক্তি হবে- যখন তাদের অভিমুখ অভিন্ন হয় একমাত্র তখনই এই প্রশ্ন করার উপযুক্ত বুদ্ধিমান জীব বিকাশের উপযুক্ত অবস্থা হয়ঃ কালের যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল, সে অভিমুখেই কেন বিশৃঙ্খলা বাড়ে?
প্রথমে আমি আলোচনা করব তাপবিদ্যুৎ গতীয় কালের তীর। সব সময়ই সুশৃঙ্খল অবস্থার চাইতে বিশৃঙ্খল অবস্থার সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। এই তথ্যেরই ফলশ্রুতি তাপগতি বিদ্যার দ্বিতীয় বিধি। বিচার করুন একটি বাক্সের ভিতরের কয়েক টুকরা জিগস (jigsaw –করাত দিয়ে কাটা কয়েকটা টুকরো। ঠিকমত মেলাতে পারলে একটি ছবি হয়)। এগুলির একটি এবং একটিমাত্র বিন্যাসেই সম্পূর্ণ একটি ছবি হয়। কিন্তু টুকরোগুলির এমন বহু সংখ্যক বিন্যাস আছে যেগুলিতে টুকরোগুলি বিশৃঙ্খল থাকে এবং কোনো ছবিই হয় না।
অনুমান করা যাক একটি তন্ত্র খুব অল্প সংখ্যক সুশৃঙ্খল অবস্থার কোন একটিতে শুরু হয়েছে। কালে কালে বৈজ্ঞানিক বিধি অনুসারে তন্ত্রগুলির বিবর্তন হবে এবং তন্ত্রটির অবস্থারও পরিবর্তন হবে। পরবর্তীকালে তন্ত্রটির সুশৃঙ্খল অবস্থার সংখ্যা বেশি। সুতরাং তন্ত্রটি যদি প্রাথমিক স্তরে উচ্চস্তরের শৃঙ্খলা মেনে চলে তাহলে কালে কালে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির প্রবণতা থাকবে।
অনুমান করা যাক জিগস –এর খন্ডগুলি একটি বাক্সে শুরু করল একটি সুশৃঙ্খল অবস্থায়। এ অবস্থায় তারা একটি চিত্র গঠন করল। বাক্সটিকে একটি ঝাঁকুনি দিলে তারা অন্য বিন্যাস গ্রহণ করবে, সম্ভবত সেটি হবে একটি বিশৃঙ্খল বিন্যাস। সে অবস্থায় খন্ডগুলি আর সঠিক চিত্রগঠন করতে পারবে না। তার সহজ কারণ হল বিশৃঙ্খল অবস্থার সংখ্যা অনেক বেশি। কিছু কিছু খন্ড একত্র হয়ে তখনো হয়তো চিত্রটির কিছু অংশ গঠন করতে পারবে। কিন্তু বাক্সটিকে যত ঝাঁকুনি দেবেন- সম্ভাবনা হল ঐ অংশগুলি ততই ভেঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যাবে। এ অবস্থায় তারা আর কোনো রকম চিত্রই গঠন করতে পারবে না। সুতরাং খন্ডগুলি যদি প্রথমে উচ্চস্তরের সুশৃঙ্খল অবস্থা নিয়ে শুরু করে তাহলেও সম্ভাবনা হল কালে খন্ডগুলির বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু অনুমান করা যাক, ঈশ্বর স্থির করেছিলেন মহাবিশ্বের শুরু যেভাবেই হোক না কেন এর পরিণতি হবে উচ্চস্তরের সুশৃঙ্খল অবস্থা। আদিমকালে মহাবিশ্ব হয়তো বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকবে। তার অর্থ কালের সঙ্গে বিশৃঙ্খলা হ্রাস পাবে। আপনি ভাঙ্গা পেয়ালার টুকরোগুলির একত্র হয়ে টেবিলের উপর লাফিয়ে ওঠা দেখতে পাবেন। কিন্তু টুকরোগুলিকে পর্যবেক্ষণ করছেন এরকম যে কোন মানুষ এমন মহাবিশ্বে বসবাস করবেন যেখানে কালের গতির সঙ্গে বিশৃঙ্খলা হ্রাস পায়। আমার যুক্তি হবে সেই সমস্ত মানুষের কালের মনস্তাত্ত্বিক তীর হবে পশ্চাৎমুখী। অর্থাৎ তারা ভবিষ্যতের ঘটনাগুলি মনে রাখবে ওটা টেবিলের উপর ছিল। আবার ওটা যখন টেবিলের উপর থাকবে তখন ওরা মনে রাখবে না যে, ওটা মেঝের উপর ছিল।
মানবিক স্মৃতিশক্তি বিষয়ে আলোচনা করা শক্ত, কারণ মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে সেটা আমরা বিস্তৃতভাবে জানি না। কিন্তু কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি কিভাবে কাজ করে তার সবটাই আমরা জানি। সেজন্য আমি কম্পিউটারের সাপেক্ষ কালের মনস্তাত্ত্বিক তীর নিয়ে আলোচনা করব। আমার মনে হয় কম্পিউটারের তীর এবং মানবিক তীর অভিন্নঃ এ অনুমান যুক্তিসঙ্গত। তা যদি না হোত তাহলে আগামীকালের মূল্য মনে রাখে এরকম কোনো কম্পিউটারের মালিক হলে শেয়ার বাজারে বিরাট লাভ করা যেত।
একটি কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি মূলত একটি কৌশল যার এমন কতগুলি উপাদান আছে যেগুলি দুটি অবস্থার যে কোন একটি অবস্থায় থাকতে পারে। সবচাইতে সরল উদাহরণ হল একটি অ্যাবাকাস (Abacus)। এর যে সরলতম রূপ তাতে থাকে কয়েকটি তার। প্রতিটি তারে একটি করে গুটি থাকে। গুটিটিকে যে কোনো দুটি অবস্থানের একটি অবস্থানে রাখা যায়। কম্পিউটারের স্মৃতিতে একটি জিনিস নথিভুক্ত করার আগে তার স্মৃতি থাকে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। দুটি সম্ভাব্য অবস্থার যে কোনো একটি অবস্থার সম্ভাবনা থাকে সমান। (অ্যাবাকাসের গুটিগুলি তারের উপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো থাকে।) স্মৃতিশক্তি এবং স্মরণীয়ের পারস্পারিক ক্রিয়ার পর গুটিগুলি নিশ্চিত ভাবে দুটি অবস্থার একটি অবস্থায় থাকবে আর সেটা নির্ভর করবে তন্ত্রটির অবস্থার উপর। (অ্যাবাকাসের প্রতিটি গুটি থাকে তারের বাঁ দিকে কিম্বা ডান দিকে থাকে)। সুতরাং স্মৃতিটি বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছেছে, কিন্তু স্মৃতিটি সঠিক অবস্থায় রয়েছে সেটা নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষ পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন। (উদাহরণঃ গুটিটিকে চালানো কিম্বা কম্পিউটারে শক্তি সরবরাহ করা)। এই শক্তি ক্ষয় হয়ে তাপের রূপ নেই এবং মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি সবসময়ই স্মৃতির শৃঙ্খলা বৃদ্ধির চাইতে বেশিঃ এটা সর্বদাই দেখানো যেতে পারে। সুতরাং কম্পিউটারে শীতল রাখার পাখা যে তাপ বহিষ্কার করে তার অর্থ হল কম্পিউটার যখন একটি জিনিস স্মৃতির অন্তর্ভুক্ত করে তখনও মহাবিশ্বের মোট বিশৃঙ্খলার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সময়ের যে অভিমুখে কম্পিউটার অতীতকে স্মরণ করে সেই অভিমুখ এবং বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির অভিমুখ অভিন্ন।
সুতরাং কালের অভিমুখ সম্পর্কে আমাদের ব্যক্তিনিষ্ঠ (subjective) বোধ অর্থাৎ কালের মনস্তাত্ত্বিক তীর আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর স্থির হয় কালের তাপগতীয় তীর দিয়ে। ঠিক একটি কম্পিউটারের মতো- যে ক্রমে বিশৃঙ্খলা (entropy) বাড়ে, সেই ক্রমেই আমাদের বিভিন্ন বিষয় স্মরণে রাখতে হবে। এর ফলে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় বিধি প্রায় তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়। কালের গতির সঙ্গে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় তার কারণ যে অভিমুখে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় সেই অভিমুখেই আমরা কাল মাপি। এর চাইতে ভাল বাজি ধরার বিষয় আপনি খুঁজে পাবেন না।
কিন্তু কালের তাপগতীয় তীরের অস্তিত্ব কেন থাকবে? কিম্বা অন্য কথায় বলা যায়- কালের একটি প্রান্তে (প্রথাত যে প্রান্তকে আমরা অতীত বলি) মহাবিশ্ব কেন উচ্চস্তরের সুশৃঙ্খল থাকবে? কেন সব সময় সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকবে না? আসলে এ সম্ভাবনাই সবচাইতে বেশি বলে মনে হতে পারে এবং কেন সময়ের যে অভিমুখে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় এবং যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল সেই দুটি অভিমুখ অভিন্ন?
মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হোত সে বিষয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা চিরায়ত ব্যাপক অপেক্ষবাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতায় বিজ্ঞানের সমস্ত জানিত বিধি ভেঙ্গে পড়ে। মহাবিশ্ব অত্যন্ত মসৃণ এবং সুশৃঙ্খল অবস্থায় শুরু হতে পারত। সে অবস্থা হতে পারত আমাদের পর্যবেক্ষণ করা কালের সুসংজ্ঞায়িত তাপগতীয় এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক কালের তীরের পথিকৃৎ। কিন্তু এটা একই রকম ভালভাবে শুরু হতে পারত পিন্ডপিন্ড (lumpy) এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায়। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্ব থাকত সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায়, সুতরাং কালের গতির সঙ্গে বিশৃঙ্খলা আর বাড়তে পারত নাঃ হয় স্থির থাকত, নয়তো বিশৃঙ্খলা হ্রাস পেত। স্থির থাকলে কালের কোনো সুসংজ্ঞায়িত তাপগতীয় তীর থাকত না। হ্রাস পেলে কালের তাপগতীয় তীরের অভিমুখ এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক তীরের অভিমুখ হোত বিপরীত। আমাদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে এ দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই মেলে না। আমরা কিন্তু দেখেছি চিরায়ত ব্যাপক অপেক্ষবাদ ভবিষ্যদ্বাণী করে নিজের পতনের। স্থান-কালের বক্রতা বৃহৎ হলে কণাবাদী মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়া (quantum gravitational effect) গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং মহাবিশ্বের উত্তম বিবরণরূপে চিরায়ত তত্ত্বের অস্তিত্ব আর থাকবে না। মহাবিশ্বের আরম্ভ বুঝতে হলে কণাবাদী মহাকর্ষীয় তত্ত্ব ব্যবহার করতে হবে।
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কণাবাদী মহাকর্ষীয় তত্ত্বে মহাবিশ্বের অবস্থার বিবরণ দিতে হলেও বলতে হবে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য ইতিহাসগুলির অতীতের স্থান-কালের সীমান্তে কিরকম আচরণ হোত। ইতিহাসগুলি যদি সীমানাহীনতার শর্ত পূরণ করে অর্থাৎ তারা যদি আয়তনে সসীম হয় কিন্তু তাদের কোনো সীমানা, কিনারা কিম্বা অনন্যতা যদি না থাকে তাহলে আমরা যা জানি না এবং যা জানা সম্ভব নয় তার বিবরণ দেওয়ার অসুবিধা এড়াতে পারি। সেক্ষেত্রে কালের আরম্ভ হবে স্থান-কালের একটি নিয়মানুগ (regular) মসৃণ বিন্দু এবং মহাবিশ্ব তার সম্প্রসারণ শুরু করবে অত্যন্ত মসৃণ এবং নিয়মানুগ অবস্থায়। সে ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ সমরূপ হোত না কারণ তাহলে কণাবাদী তত্ত্বের অনিশ্চয়তাবাদ লঙ্ঘিত হোত। কণাগুলির গতিবেগ এবং ঘনত্ব সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি হতে হোত। কিন্তু সীমানাহীন অবস্থার নিহিতার্থ হলঃ এই হ্রাসবৃদ্ধি হোত যতটা সম্ভব অল্প তবে অনিশ্চয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে।
মহাবিশ্বের শুরুতে কিছুকাল অতি দ্রুত সম্প্রসারণ হোত (exponential or inflationary) –আয়তনে মহাবিশ্ব বৃদ্ধি পেত বহুগুণ। এই সম্প্রসারণের সময় ঘনত্বের হ্রাসবৃদ্ধি প্রথমে কম থাকত কিন্তু পরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করত। যে অঞ্চলের ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চাইতে সামান্য বেশি সেই সমস্ত অঞ্চলে অধিক ভরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের জন্য সম্প্রসারণের হার হ্রাস পেত। পরিণামে ঐ সমস্ত অঞ্চলের সম্প্রসারণ বন্ধ হোত এবং চুপসে গিয়ে তৈরি হোত নীহারিকা, তারকা এবং আমাদের মতো জীব। মহাবিশ্ব শুরু হোত মসৃণ এবং নিয়মানুগ অবস্থায় এবং কালের গতির সঙ্গে পিন্ড পিন্ড এবং বিশৃঙ্খল হোত। এটাই হোত কালের তাপগতীয় তীরের ব্যাখ্যা।
কিন্তু যদি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে সঙ্কোচন শুরু হোত, তখন কি হোত? তাহলে কি কালের তাপগতীয় তীর বিপরীতমুখী হোত? এবং কালের গতির সঙ্গে কি বিশৃঙ্খলা হ্রাস পেত? যারা সম্প্রসারণশীল অবস্থা থেকে সঙ্কোচনশীল অবস্থা পর্যন্ত বেঁচে থাকত তাদের সম্পর্কে নানা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো সম্ভাবনার পথিকৃৎ হোত এরকম ঘটনা। তারা কি পেয়ালার ভাঙ্গা টুকরোগুলির মেঝেতে একত্র হয়ে লাফিয়ে টেবিলে ফিরে যাওয়া দেখত? তারা কি শেয়ার বাজারে পরের দিনের দাম মেনে রেখে অনেক টাকা রোজগার করে নিত? মহাবিশ্ব যখন আবার চুপসে যাবে তখন কি হবে তা নিয়ে মাথা ঘামানো একটু বেশি পণ্ডিতীর (academic) ব্যাপার হয়ে যাবে কারণ অন্তত এক হাজার কোটি বছরের আগে মহাবিশ্বের সঙ্কোচন শুরু হবে না। কিন্তু কি হবে সেটা জানবার একটি দ্রুততর পদ্ধতি আছেঃ কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপ দেওয়া। একটি তারকা চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হওয়া অনেকটা সমগ্র মহাবিশ্বের চুপসে যাওয়ার শেষের অবস্থার মতো। সুতরাং যদি মহাবিশ্বের সঙ্কোচনশীল অবস্থায় বিশৃঙ্খল হ্রাস পায় তাহলে আশা করা যেতে পারে কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরেও বিশৃঙ্খলা হ্রাস পাবে। সুতরাং একজন মহাকাশচারী কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর পড়ে গেলে হয়তো তিনি রুলেট (roulette- এক ধরনের জুয়া- ছোট ছোট বল দিয়ে খেলা হয়) খেলায় বলটা কোথায় গিয়েছে বাজি ধরার আগেই সেটি মনে রেখে অনেক টাকা করতে পারবেন। (কিন্তু তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে বেশিক্ষন খেলতে পারবেন না- তার আগেই তিনি স্প্যাঘেটি (এক ধরনের সেমাই) হয়ে যাবেন। তিনি কালের তাপগতীয় তীরের বিপরীতমুখী হওয়ার সংবাদও আমাদের দিতে পারবেন না কিম্বা বাজিতে জেতা টাকা ব্যাঙ্কে দিতেও পারবেন না। তার কারণ তিনি কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের আড়ালে আটকে যাবেন)।
প্রথমে আমার বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্ব পুনর্বার চুপসে গেলে বিশৃঙ্খলা হ্রাস পাবে। কারণ আমার ধারণা ছিল মহাবিশ্ব যখন আবার ক্ষুদ্র হবে তখন তাকে মসৃণ আর নিয়মানুগ অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। এর অর্থ হোত সঙ্কোচনের দশা সম্প্রসারণের দশার কালিক বৈপরীত্যের মতো হবে। সঙ্কোচনের অবস্থায় মানুষ তার জীবন যাপন করবে পশ্চাৎমুখী হয়েঃ জন্মের আগেই মৃত্যু হবে এবং মহাবিশ্ব যেমন সঙ্কুচিত হবে তাঁরাও তেমন তরুণতর হবে।
এ চিন্তনের আকর্ষণ আছে কারণ এর অর্থ হবে সঙ্কোচন দশা এবং সম্প্রসারণ দশার ভিতরে একটি চমৎকার প্রতিসাম্য (symmetry)। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্পর্কিত অন্যান্য চিন্তন থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই চিন্তনকে শুধুমাত্র তার নিজস্বতা দিয়ে গ্রহণ করা যায় না। প্রশ্নটা হলঃ এ ধারণা কি সীমানাহীন অবস্থার ভিতরে নিহিত আছে? না কি অবস্থার সঙ্গে এ ধারণা সঙ্গতিহীন? আমি আগে বলেছি- আমি ভেবেছিলাম সীমানাহীন অবস্থার ভিতরে এই চিন্তন নিহিত আছে যে সঙ্কোচনের দশায় বিশৃঙ্খলা হ্রাস পাবে। আমার ভুল হয়েছিল অংশত ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে উপমার (analogy- উপমা) ফলে। যদি মহাবিশ্বের আরম্ভকে উত্তর মরুর অনুরূপ বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে অন্তিম অবস্থায় মহাবিশ্বের হওয়া উচিৎ আরম্ভের অনুরূপ, ঠিক যেমন দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুর অনুরূপ। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর সঙ্গে মহাবিশ্বের শুরু এবং শেষের সাদৃশ্য কিন্তু কাল্পনিক কালে। বাস্তব কালে শুরু এবং শেষের ভিতরে খুবই পার্থক্য থাকতে পারে। মহাবিশ্বের একটি সরল প্রতিরূপ নিয়ে গবেষণায় চুপসে যাওয়া অবস্থাকে মনে হয়েছিল সম্প্রসারণশীল দশার কালিক বৈপরীত্যের মতো। আমার ভুল হওয়ায় একটি কারণ এই গবেষণা। কিন্তু সীমানাহীন অবস্থা হলেই যে সঙ্কোচনশীল দশা সম্প্রসারণশীল দশার কালিক বৈপরীত্য হবে এরকম কোনো আবশ্যিকতা নেই। এ বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন আমার সহকর্মী পেনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডন পেজ (Don page)। রেমন্ড লাফ্লাম (Raymond Laflamme) নামে আমার একজন ছাত্র তাঁর গবেষণায় দেখলেন অন্য একটি সামান্য জটিল প্রতিরূপে মহাবিশ্বের চুপসে যাওয়া এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণে অনেকটা পার্থক্য। আমি বুঝতে পারলাম নিজের ভুলঃ সীমানাহীন অবস্থার ভিতরে নিহিত অর্থ রয়েছে। সে অর্থঃ সঙ্কোচনশীল দশায় বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে। মহাবিশ্বের পুনর্বার সঙ্কোচনের সময় কিম্বা কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে, কালের তাপগতীয় কিম্বা মনস্তাত্ত্বভিত্তিক তীরের বৈপরীত্য (reverse) হবে না।
নিজের এরকম একটি ভুল আবিষ্কার করলে আপনি কি করবেন? কিছু লোক কখনোই ভুল স্বীকার করেন না এবং তাঁরা নিজেদের মত সমর্থন করার জন্য নতুন নতুন যুক্তি খুঁজে বার করেন আর অনেক সময়ই যুক্তিগুলি হয় পরস্পর সামঞ্জস্যহীন। কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্বের বিরোধীতা করার জন্য এডিংটন এরকমই করেছিলেন। আবার অনেকে দাবী করেন প্রথমত তাঁরা কখনোই আসলে এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেননি কিম্বা করলেও ক্রেছেন ঐ দৃষ্টিভঙ্গি কতটা সামঞ্জস্যহীন সেটা দেখানোর জন্য। আমার মনে হয় যদি আপনি ছাপার অক্ষরে মেনে নেন যে আপনি ভুল করেছিলেন তাহলে ব্যাপারটা অনেক ভাল দেখায় আর বিভ্রান্তিও কমে। এর একজন ভাল উদাহরণ ছিলেন আইনস্টাইন। তিনি যখন মহাবিশ্বের একটি স্থির প্রতিরূপ গঠন করার চেষ্টা করছিলেন তখন তিনি মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক ধ্রুবক উপস্থিত করেছিলেন। শেষে তিনি বলেছিলেন এটা ছিল তাঁর জীবনের সব চাইতে বড় ভুল।
কালের তীরের প্রসঙ্গে ফিরে এলে একটি প্রশ্ন থেকে যায়ঃ আমাদের পর্যবেক্ষণে কেন কালের তাপগতীয় তীর এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক তীরের অভিমুখ অভিন্ন হয়? কিম্বা অন্য কথায় বলা যায়ঃ যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়, কেন সেই অভিমুখেই বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়? যদি একথা বিশ্বাস করা যায় যে সীমানাহীনতার প্রস্তাবে যে অর্থ নিহিত আছে বলে মনে হয় সেই অনুসারে মহাবিশ্ব প্রথমে সম্প্রসারিত হবে এবং পরে সংকুচিত হবে, তাহলে একটি প্রশ্ন আসবেঃ কেন আমাদের অবস্থান-সঙ্কোচনশীল দশায় না থেকে সম্প্রসারণশীল দশায় থাকবে?
দুর্বল নরত্বীয় নীতির ভিত্তিতে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে। সঙ্কোচনশীল দশার অবস্থা এমন বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্বের উপযুক্ত হবে না যারা প্রশ্ন করতে পারেঃ যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল কেন সেই অভিমুখেই বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে? সীমানাহীনতার প্রস্তাব যে ভবিষ্যদ্বাণী করে তার অর্থঃ আদিম মহাবিশ্বের স্ফীতির হার ছিল ক্রান্তিক হারের (critical rate) খুব কাছাকাছি। সেই হারে পুনর্বার চুপসে যাওয়া এড়ানো সম্ভব হবে এবং বহুকাল পর্যন্ত মহাবিশ্ব পুনর্বার চুপসে যাবে না। ততদিনে তারকাগুলি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে এবং সেগুলির ভিতরকার প্রোটন এবং নিউট্রিনো এবং বিকিরণ (radiation) রূপান্তরিত হবে। তখন মহাবিশ্ব থাকবে প্রায় সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায়। কালের শক্তিশালী তাপগতীয় তীর থাকবে না। বিশৃঙ্খলা আর বাড়তে পারবে না। তার কারণ, মহাবিশ্ব তখন প্রায় সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায়। কিন্তু বুদ্ধিমান জীবের ক্রিয়াকর্মের জন্য কালের শক্তিশালী তাপগতীয় তীর প্রয়োজন। বেঁচে থাকবার জন্য মানুষের খাদ্যগ্রহণ প্রয়োজন। খাদ্য শক্তির একটি সুশৃঙ্খল রূপ। সেটি রূপান্তরিত হয় তাপে। তাপ শক্তির একটি বিশৃঙ্খল রূপ। সুতরাং মহাবিশ্বের সঙ্কোচনশীল দশায় বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কালের তাপগতীয় তীর এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক তীরের একই অভিমুখ আমরা কেন দেখতে পাই তার ব্যাখ্যা এটাই। ব্যাপারটা কিন্তু এরকম নয় যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ফলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, বরং সীমানাহীন অবস্থাই বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে এবং সম্প্রসারণশীল দশাই শুধুমাত্র বুদ্ধিমান জীবের উপযুক্ত অবস্থা।
সংক্ষেপে বলা যায় বিজ্ঞানের বিধি, কালের অগ্রগতি এবং পশ্চাৎগতির ভিতর কোনো পার্থক্য করে না। কিন্তু কালের অন্তত এমন তিনটি তীর রয়েছে যেগুলি অতীত এবং ভবিষ্যতের ভিতর পার্থক্য করে। সেগুলি হল তাপগতীয় তীর অর্থাৎ যে অভিমুখে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, মনস্তাত্ত্বিক তীর অর্থাৎ কালের যে অভিমুখে আমরা অতীত স্মরণ করি কিন্তু ভবিষ্যৎ স্মরণ করি না এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক তীর অর্থাৎ যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সংকুচিত না হয়ে সম্প্রসারিত হয়। আমি দেখিয়েছি মনস্তাত্ত্বিক তীর এবং তাপগতীয় তীর মূলত অভিন্ন, সুতরাং এই দুটি তীরের অভিমুখ সব সময়ই অভিন্ন হবে। মহাবিশ্বের সীমানাহীনতার প্রস্তাব কালের একটি সুসংজ্ঞায়িত তাপগতীয় তীরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে, কারণ মহাবিশ্বের তাপগতীয় তীর এবং মহাবিশ্বের ভিত্তিক তীরের ঐক্যের কারণঃ বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব শুধুমাত্র শুধুমাত্র সম্প্রসারণশীল দশায়ি থাকতে পারে। সঙ্কোচনশীল দশা অনুপযুক্ত হবে, তার কারণ সে দশায় কালের কোনো শক্তিশালী তাপগতীয় তীর থাকে না।
মহাবিশ্ব বোঝার প্রচেষ্টায় মানবজাতির প্রগতি- যে মহাবিশ্ব বিশৃঙ্খলা বর্ধমান সেই মহাবিশ্বে একটি সুশৃঙ্খল কোণ (comer – ? নীড়) সৃষ্টি করেছে। এ বইয়ের প্রতিটি শব্দ যদি আপনি মনে রাখেন তাহলে আপনার স্মৃতি প্রায় দু’মিলিয়ন (১০,০০,০০০ = এক মিলিয়ন) খন্ড সংবাদ নথিভুক্ত করেছে, আপনার মস্তিষ্কের শৃঙ্খলা বেড়েছে দু’মিলিয়ন একক। তবে এই বই পড়বার সময় অন্তত এক হাজার ক্যালরি খাদ্যরূপ সুশৃঙ্খল শক্তিকে আপনি তাপরূপ বিশৃঙ্খল শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। এই পরিমাণ শক্তি ঘর্ম এবং পরিচলনের (পরিচলন- convection) ফলে দেহ থেকে আপনার চারপাশের বায়ুতে হারিয়েছেন। এর ফলে মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা বাড়বে প্রায় কুড়ি মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন একক অর্থাৎ আপনার মস্তিষ্কে যে শৃঙ্খলা বেড়েছে, তার দশ মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন গুণ, অবশ্য আপনি যদি এ বইয়ের সবটাই মনে রাখেন। এতোক্ষন আমি যে সমস্ত আংশিক তত্ত্বের বিবরণ দিয়েছি কি করে লোকে সেগুলি সংযুক্ত করে মহাবিশ্বের সব কিছু ব্যাখ্যা করে এরকম সম্পূর্ণ একটি ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব গঠন করার চেষ্টা করছেন পরের অধ্যায়ে সেটা ব্যাখ্যা করে আমাদের পরিবেশের শৃঙ্খলা আর একটু বাড়াতে চেষ্টা করব।
“কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ