সম্মোহন করে কোন কোন রোগীকে কীভাবে সাজেশন দিতে হয়, এই অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোচনায় যাব। তার আগে জেনে নেওয়া ভালো, যাদের সম্মোহিত করা যায় নাঃ
১) যার মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চার করতে চাই, তার ভাষাটা জানা একান্তই জরুরি। ধরুন আমি আরবি জানি না। সেক্ষেত্রে শুধু আরবি জানে এমন কাউকে সম্মোহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
২) জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সম্মোহন করা সম্ভব নয়।
৩) বধিরকে সম্মোহিত করা সম্ভব নয় ।
৪) মানুষ ছাড়া প্রাণিজগতের কারুকে সম্মোহন করা সম্ভব নয় ।
৫) বস্তুকে সম্মোহন করা সম্ভব নয়।
যারা সম্মোহিত হতে নারাজ তাদের সম্মোহিত করতে হলে…
১) এমন কিছু রোগী আছেন, যারা মনোবিদ বা হিপনোথেরাপিস্টের সাজেশন মন দিয়ে শোনেন না। কান দিয়ে সাজেশন ঢুকছে, আর তখন মন দিয়ে ভাবছেন—আমি কি সত্যিই সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছি?
এক মনে সাজেশন না শুনলে সম্মোহিত হবেন না।
২) কেউ কেউ ‘সম্মোহন’ বিষয়টির কার্যকারিতা নিয়ে অতিমাত্রায় অবিশ্বাসী। সেই কারণে ‘সাজেশন’ মন দিয়ে শোনায় তাদের কোনো আগ্রহ-ই থাকে না।
৩) তিনি হয়তো কোনো কারণে চিকিৎসকটির সম্মোহন করার ক্ষমতা থাকার বিষয়ে সন্দিগ্ধ।
৪) রোগীর মানসিক অবস্থা হয়তো এতই বিক্ষিপ্ত যে মনঃসংযোগ করতে চাইলেও করতে পারছেন না ৷
৫) যিনি সম্মোহন করবেন, তাঁর ক্ষমতার উপর রোগীর একটা চ্যালেঞ্জের মানসিকতা রয়েছে।
এই সব অবস্থায় সাধারণ উপায়ে সম্মোহন করা অনেক সময় সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণ ‘সম্মোহন’ বিষয়ে রোগীর মনে বিশ্বাস বা প্রত্যাশা তৈরি করতে না পারলে, তাঁর সহযোগিতা পাওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে না পারলে সম্মোহিত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে। তাই সম্মোহন করার আগে ‘সম্মোহনপূর্ব ধারণা সঞ্চার’ বা ‘প্রি-হিপনটিক সাজেশন’-এর প্রতি সম্মোহনকারীদের গুরুত্ব আরোপ করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি বলে আর বিস্তৃত আলোচনায় ঢুকলাম না।
১ নম্বর থেকে ৪ নম্বর রোগীদের ক্ষেত্রে সম্মোহন করার আগে উত্তেজনা নাশক বা ঘুম আনা ওষুধ খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের আগেই সতর্ক করে দিচ্ছি যে, আপনি কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসক না হলে এইসব ওষুধ রোগীদের উপর প্রয়োগ করতে যাবেন না।
৫ নম্বর রোগীদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যারা কিনা সম্মোহনকারীর সম্মোহন ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে আছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য চমক সৃষ্টি সবচেয়ে ভালো উপায়।
আমাকে অনেক সময় এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এমনি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আমি আমার সমস্যা সমাধান করেছি প্রতিটি ক্ষেত্রেই চমক সৃষ্টি করে। চ্যালেঞ্জকারীর সঙ্গে কোনো তর্কে যাইনি। কারণ তর্ক স্পষ্টতই চ্যালেঞ্জকারীর মানসিকতাকে আরো বেশি করে আমার প্রতি বিরূপ করে তুলবে। তাঁর সঙ্গে সহজভাবে আলোচনা চালিয়েছি মানুষের মন ও বিচিত্র ক্ষমতা সম্পর্কে আমার জানা সামান্য জ্ঞান নিয়ে জানিয়েছি, “আমার জানাকে অভ্রান্ত সত্য বলে মনে করি না। আমি কোনো কিছুকে প্রমাণ করতে চাই না। চাই সত্যে পৌঁছতে। এ বিষয়ে আপনি-ই হয়তো আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পরবেন।”
“এই ধরুন আপনি যা দেখছেন, তার অনেক কিছুর ব্যাখ্যা আপনার জানা নেই, অনেক কিছুর ব্যাখ্যা আমার-ও জানা নেই। এই যে আপনার কোটের বাঁ পকেটে একটা দু-টাকার নোট আর খুচরো দুটি ৫০ পয়সা পড়ে আছে, তা আমি যে মানসিক শক্তিতে জানতে পারছি, সেই শক্তির হদিশ ও তার প্রয়োগ আপনার জানা নেই। আমার জানা নেই আপনার অনেক ক্ষমতার গোপন রহস্য।”
চ্যালেঞ্জ জানানো মানুষটি এবার তাঁর কোটের বাঁ পকেটে হাত দেবেন-ই এবং পাবেন দু-টাকা ও দুটি ৫০ পয়সা, যা চমক সৃষ্টির জন্যে আমিই ঢুকিয়ে দিয়েছি অথবা কাউকে দিয়ে ঢোকানোর কাজটা সেরেছি। বিভিন্ন সময় অপ্রচলিত ম্যাজিক প্রয়োগ করে আমি চমক সৃষ্টি করেছি। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জারকে শেষ পর্যন্ত ভাবতে বাধ্য করেছি—এটা দেখালাম সম্মোহন করে।
ফলে সত্যি সম্মোহনের সময় চ্যালেঞ্জার তার মানসিকতা পাল্টে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন।
সম্মোহন যখন সেমিনারে
যখন কোনো সভায় বা সেমিনারে সম্মোহন করি, তখন সম্মোহন নিয়ে একটা মোটামুটি আলোচনা সেরে নিই। এই আলোচনা সাধারণত চলে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত। বিপুল শ্রোতা ও দর্শকদের সামনে কয়েকজনকে সম্মোহন করে দেখাবার আগে এই সময়টা ব্যয় করা প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়। কারণ আলোচনা শেষে দর্শকদের কাছে আমি আবেদন রাখি, যারা বাস্তবিকই সততার সঙ্গে আমার কথা বা ‘সাজেশন’ গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনবেন, তারা মঞ্চে উঠে আসুন।
উঠে আসাদের মধ্যে থেকেই প্রথম আসা দু-তিনজনকে প্রথম দফায় বেছে নিই। সভার সময় দর্শকদের মুড ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে কত রকমের সম্মোহন দর্শকদের সামনে হাজির করব, তা ঠিক করি। তারপর প্রয়োজনমতো দফায় দফায় কয়েকজন করে দর্শককে মঞ্চে ডেকে নিই ।
ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্যে যখন কাউকে সম্মোহন করার প্রয়োজন হয় তখন তাঁর সঙ্গে সম্মোহন বিষয়ে কিছু আলোচনা সেরে নিই। উদ্দেশ্য :
ক) সম্মোহন সম্পর্কে অলীক ভয় দূর করা।
খ) সম্মোহনের কার্যকারিতা ও উপকারিতা।
গ) সম্মোহনের ক্ষেত্রে রোগীর চূড়ান্ত মনোযোগ ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা । প্রয়োজনে দু-একটি সম্মোহনের ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আর এই প্রয়োজনটা সাধারণভাবে হয় সেমিনার বা সভায় ।
এটা গেল যাকে সম্মোহিত করব, তাকে মানসিকভাবে তৈরি করার প্রথম ধাপ। এবার আসছি দ্বিতীয় ধাপে।
সম্মোহিতের হাত অসাড় করতে…
পাশাপাশি গোটা তিনেক চেয়ার স্টেজে পাতা থাকে আগে থেকেই, তাতেই বসিয়ে দিই উঠে আসা দর্শকদের। বলি, “চোখ বুজে একমনে শুধু আমার কথা শুনতে থাকুন। আপনি ভাবতে থাকুন ঘুম আসছে, চোখের পাতাগুলো একটু একটু করে ভারী হয়ে আসছে।”
বার পাঁচেক এই কথাগুলো টেনে টেনে বলতে থাকি। তারপর বলতে থাকি, “আমি আপনার ডান কাঁধ থেকে বাহু হয়ে হাতের আঙুল পর্যন্ত ধীরে ধীরে আমার হাত বুলাতে থাকবো। এবং যা বলবো, তা একমনে শুনতে থাকবেন।”
কাঁধ থেকে আঙুল পর্যন্ত হাত বুলাতে বুলাতে ধীরে ধীরে বলতে থাকি, “আপনার ডান হাতটা অবশ হয়ে যাচ্ছে, ভারী হয়ে যাচ্ছে।”
এই কথাটা ধীরে ধীরে কম ভলিউমে একটু সুরেলা করে বলতে থাকি। বার পাঁচেক কথাটা বলার পাশাপাশি কাঁধ থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত আমার হাতের আঙুল বুলোতে থাকি। তারপর হাতে চিমটি কাটি। জিজ্ঞেস করি, “এই যে চিমটি কাটছি, কোনো ব্যথা অনুভব করছেন?”
সম্মোহিত যখন বলেন, ব্যথা অনুভব করছেন না, তখন একটা ইঞ্জেকশনের ডিসপোজাল সিরিঞ্জের নিড়লের পুরোটাই হাতে ঢুকিয়ে দিই। ঢোকাবার সময় শুধু এটুকু খেয়াল রাখি, সিরিঞ্জের নিড্ল যাতে ধমনিতে না ঢোকে। নিড্ল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করি, “এবার যে চিমটি কাটলাম, ব্যথা পেয়েছেন?”
সব সময় একই উত্তর পেয়ে আসছি, “না ”
এবার বলি, “চোখ খুলুন। দেখুন, আপনার হাতে একটা সিরিঞ্জের নিড়লের পুরোটাই ঢুকিয়ে দিয়েছি কিন্তু আপনি কোনো ব্যথা অনুভব করছেন না।”
এবার চোখ খোলেন। হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখতে থাকেন।
অবাক হওয়ার ঘোর কাটার আগেই বলতে শুরু করি, “আপনি নিড্লটা নিজেই তুলে ফেলুন। তারপর আবার নিজের হাতেই পুরোটা ফুটিয়ে দিন। একটুও ব্যথা লাগবে না।” সম্মোহন ঘুম থেকে ওঠা মানুষটি ছুঁচ তোলেন, আবার পুরোটা ঢুকিয়ে দেন। ব্যথা অনুভব করেন না ।
এইভাবে সাজেশন দিয়ে শরীরের যে কোনো অঙ্গকে যেমন অসাড় করা যায়, তেমনই উল্টোটাও অনেক সময় করি। যাকে সম্মোহিত করব, তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে বলতে থাকি, “রিল্যাক্স মুডে আপনি বসে থাকুন। চোখ বুজুন। একমনে ভাবতে থাকুন আপনার চোখ ভারী হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনার হাতে একটা পিন ফোটাবো। ব্যথা লাগল কি লাগল না, জানাবেন।”
বার পাঁচেক এই কথাগুলোই বলে যাই। তারপর একটা রেলের টিকিট বা বাসের টিকিট নিয়ে হাতে ছোঁয়াই।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই সম্মোহিত চেঁচিয়ে ওঠেন পিন ফোটানোর ব্যথায় ।
একইভাবে সাজেশন দিয়ে মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়কেই চালনা করা যায়। একই সিগারেট টেনে কেউ আমার সাজেশনমতো মিষ্টি অনুভব করেন, তো কেউ ঝাল, আবার কেউ বা টক।
এভাবে আমাদের প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়কেই সাজেশন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ