এমন প্রশ্নের সুনামি দেখলাম ২০০৯-এর ডিসেম্বরে। সেজন্যে : ‘এন ডি টিভি ইমাজিন’ চ্যানেলের একটা অনুষ্ঠান ‘রাজ পিছলে জনম কা’ ।
শুরু হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে। তার মাসখানেক আগে থেকে বিভিন্ন চ্যানেলে ‘রাজ পিছলে জনম কা’-র ব্যাপক বিজ্ঞাপন ।
অনুষ্ঠানটিতে কী দেখান হবে? বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের সম্মোহন করে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে গত জন্মে। এক গতজন্মেই শেষ নয়। একাধিক জন্মেও নিয়ে যাওয়া হবে কাউকে কাউকে। বিশাল প্রচারের দৌলতে সেই সময়কার ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল ‘রাজ…’। আর আমাদের সমিতির কাছে এস এম এস ও ফোন বন্যার মতো আছড়ে পড়তে লাগল। প্রায় প্রত্যেকেরই মোটামুটি বক্তব্য–হয় এই অনুষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন, নতুবা স্বীকার করে নিন যে, জন্মান্তর আছে, আত্মা অবিনশ্বর ।
রাত ন’টা থেকে অনুষ্ঠানটির কয়েকটা এপিসোড আমাদের সমিতির পদাধিকারীরা প্রায় সকলেই দেখে ফেললাম। অবাক হলাম! এমন একটা মোটা দাগের বোকা-বোকা অনুষ্ঠান দেখতে হামলে পড়েছে গোটা দেশ! প্রচারে হুজুগ তুলতে সমর্থ হয়েছে, এটা স্বীকার করতেই হয়। তবে এটাও বুঝলাম—অনুষ্ঠানটি বলিউডি সেলিব্রেটিদের মতো অর্ধশিক্ষিতরা বোকা বনলেও একজন বিদ্বান, যুক্তিমনস্ক মানুষকে প্রভাবিত করার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই।
খুব সাজগোজ করা এক মধ্যবয়স্কা মহিলা ‘সম্মোহন’ করছিলেন। যাঁরা সম্মোহিত হচ্ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই অভিনয় খুব কাঁচা। সম্মোহনের ঘুমে যে রিল্যাক্স মুডে থাকাটাই স্বাভাবিক, সেই মুডে কাউকে দেখা গেল না। প্রশান্তির সম্মোহিত ঘুমের বদলে প্রত্যেকেই চোখ পিট্পিট্ করছিলেন। অর্থাৎ ঘুমের নাটক করেছিলেন। আর তারপর যা হচ্ছে, পুরো নাটক। কাল্পনিক ঘটনা রিক্রিয়েট করে দেখান হচ্ছে।
যিনি ‘সম্মোহন’ করছেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গত জন্মের ঘটনা কী দেখতে পাচ্ছেন? ‘সম্মোহিত’ বললেন, দেখতে পাচ্ছি একটা প্লেন ক্র্যাশ হয়েছে। দেখতে পাচ্ছি, আমার বডিটা পড়ে আছে ।
ওমনি দর্শকরা দেখতে পেলেন একটা প্লেন উড়তে উড়তে ক্র্যাশ করল। প্লেনের ভগ্নাবশেষ ও কিছু মৃতদেহের ছবি দেখান হল ।
না, এগুলো ‘সম্মোহিত’ মানুষটির চিন্তার ধরা পড়া ছবি নয়। এসবই ইমাজিন টিভির কেনা স্টক—সর্ট।
এটা দেখে যাঁরা সম্মোহনের সাহায্যে আগের জন্মে নিয়ে যাওয়ার ছবিকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রইল।
যুক্তিবাদী সমিতির সভাপতি সুমিত্রা পদ্মনাভন বললেন, আমাদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে যে মেয়েটি, কাকলি, সে খুব উৎসাহ নিয়ে দেখে বেশ ধন্দে ছিল। আমার সঙ্গে আলোচনা করে বলল— ‘সত্যি তো—মরে গেলে তো চিন্তাই থাকবে না। কী দিয়ে ভাববে?’ তাকে বোঝালাম—স্মৃতি তো থাকে মস্তিষ্ক কোষে, আর এটা মরার পর আর থাকে না। কী করে থাকবে? পুড়ে, পচে শেষ হয়ে যায়। আমরা যা ভাবি, সব এই জীবনেরই চিন্তা, ভাবনা, কল্পনা, সুপ্ত ইচ্ছা, শখ এই সব। জেগে, ঘুমিয়ে, স্বপ্নে, সম্মোহনের আধা ঘুমে— যা যা ভাবি, দেখি সব এই জীবনেরই।
‘আত্মা’ বলে একটা কিছু শূন্যে ভেসে বেড়ায়—আমাদের স্মৃতিটাকে সঙ্গে নিয়ে—এটা কল্পনাই। এর কোনো সত্যতা প্রমাণিত হয়নি, বরং অসত্যতাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা জন্মাবার আগেও কোথাও ছিলাম না, আর পরেও কোথাও থাকব না। তাই তো জীবনটা এত সুন্দর, এত মূল্যবান। থাকবে শুধু আমাদের কাজকর্মের প্রভাব, আমাদের অবদান। প্রিয়জনের মনে আমাদের স্মৃতি ।
কাকলি রান্না করতে করতে বলে উঠল—“এটা কী অন্যায় কথা বল—আগের জন্মে একজন অপরাধ করেছিল, আর তাই এ জন্মে তার ভোগান্তি হচ্ছে, এটা কাউকে বলাও তো উচিত না। সে কী বা করতে পারে? এরকম বিশ্বাস লোকের মনে ঢোকানোও তো ঠিক না, কি বল?”
আমি নিশ্চিত হলাম। যাক, ক্লাস এইট পড়া কাকলি যখন বুঝেছে, তখন আর চিন্তা নেই ৷
১ জানুয়ারি ২০১০-এ আমাদের সমিতির ওয়েবসাইট www.srai.org-তে এই অনুষ্ঠানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চ্যানেলের উদ্দেশ্যে লেখা হয়, আপনাদের প্রমাণ করতে হবে আপনাদের অনুষ্ঠানের সত্যতা, নতুবা এই ক্ষতিকারক মিথ্যে প্রভাব সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে।
এরপর প্রচণ্ড ঝড় তোলা বিতর্ক শুরু হল। পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স থেকে প্যারানর্মালের ভান্ডাফোড় করা পৃথিবী কাঁপানো চরিত্র জেমস্ র্যান্ডি এই লড়াইতে আমাদের পক্ষে সামিল হলেন। তাঁরাও জানালেন—জন্মান্তর ব্যাপারটাই পুরোপুরি বিশ্বাস নির্ভর এক মিথ্যে। এটাকে সত্যি বলে চালাতে চাইলে র্যাশানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের জি এস প্রবীর ঘোষের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে।
৯ জানুয়ারি দুপুর। তখন আমাদের ক্লাস চলছে ৩৩এ, ক্রিক রো-তে। ফোন এল আমার মোবাইলে, স্ক্রিনে লেখা NDTV-র প্রোডিউসর নগেন্দ্রজীর নাম। নগেন্দ্রজী যা বললেন তার সংক্ষিপ্তসার হল— ঘোষদা, প্রোগ্রামটা বন্ধ করতে হলে বিশাল ক্ষতি হবে। কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর তিনি প্রস্তাব দিলেন, ঘোষদা, ‘রাজ পিছলে জনম কা’ অনুষ্ঠানে আপনিও অংশ নেন। যা বলার বলুন ।
বললাম, হ্যাঁ রাজি, তবে লাইভ অনুষ্ঠান হতে হবে। রেকর্ডেড অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্যতে যাতে কাঁচি চালাতে না পারেন, তাই এই প্রস্তাব। আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?
এমন লাইভ অনুষ্ঠানে ওঁদের আপত্তি আছে। অতএব ওয়েবসাইট লড়াই জারি রইল। শেষ পর্যন্ত আমরা জিতলাম।
১৫ জানুয়ারি ২০১০ তাড়াহুড়ো করে শেষ অনুষ্ঠানটি দেখালেন প্রোডিউসর। ওঁরা জানালেন, এই অনুষ্ঠানটি বহু মানুষের ভালো লাগলেও কিছু মানুষের প্রতিবাদে তাঁরা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
ভারতের জন-সমষ্টির একটা বড় অংশই হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে একটা বড় অংশই পূর্বজন্ম-পরজন্মে বিশ্বাস করেন। তাঁদের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু যুক্তিবাদী সমিতির উদ্যোগে বিশ্বজুড়ে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষ একজোট হওয়ায় উদ্যোক্তারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ