‘নার্কো টেস্ট” কথাটা যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করে স্ট্যাম্প পেপার দুর্নীতির সঙ্গে

জড়িত তেলগির ‘নার্কো টেস্ট’ হওয়া নিয়ে মিডিয়ার হৈ হৈ থেকে৷

‘নার্কো টেস্ট’-কি সম্মোহন করে কথা বলানোর মতো?

হ্যাঁ তা-ই। ‘নার্কো টেস্ট’ হল ‘সম্মোহন ঘুম’ এনে সত্যি বলানো। নার্কো টেস্টে ‘সম্মোহন ঘুম’ আনতে ‘সাজেশন’ না দিয়ে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।

বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে সুমিত্রা পদ্মনাভনের এই প্রসঙ্গে একটা লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি। শিরোনাম ছিল ‘নার্কো টেস্ট’ কী? লেখাটি ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার নভেম্বর ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ।

নার্কো টেস্ট বা নার্কো অ্যানালিসিস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি প্রথম টিভি দেখে সারা দিন ধরে দেখানো হয়েছিল স্ট্যাম্প পেপারে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আবদুল করিম তেলগির নার্কো-অ্যানালিসিস। যারা দেখেছিলাম, তারা জানলাম নার্কো টেস্টে, অভিযুক্তকে হাসপাতালের মতো একটা পরিবেশে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তারপর তাকে গালে আস্তে চাপড় মেরে মেরে ঘুম একটু ভাঙিয়ে প্রশ্ন করা হয়। না, ঘুম পুরো ভাঙে না—সম্মোহন ঘুমের মতো একটা আধো ঘুম, আধো জাগা অবস্থায় সরলভাবে সেই মানুষটি জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে থাকে মনের কথা। দিতে থাকে প্রশ্নের উত্তর।

বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা! ওষুধের সাহায্যে সম্মোহন ঘুমের অবস্থাটি তৈরি করা হয়। ওষুধের পরিমাণই ঠিক করে কখন ঘুম ভাঙবে। তাই হঠাৎ জেগে যাওয়ার ভয় নেই। আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন কথা যেমন মানসিক রোগীরা সম্মোহিত অবস্থায় বলে ফেলে, ঠিক তেমনই, এক্ষেত্রে সম্ভাব্য অপরাধী বা তার সাকরেদরা সত্য গোপন না করে সব কথা শিশুর সারল্যে বলে যায়। ব্যস্ কেল্লা ফতে।

এতদিনে আরো যাদের যাদের ওপর এই ‘সত্যকথন দাওয়াই’ প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছে চন্দনদস্যু বীরাপ্পনের সাঙ্গোপাঙ্গরা, নিঠারী কাণ্ডের ও আরুশি হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তরা, আবু সালেম ইত্যাদি। সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে অভিযুক্তরা তো আছেই। পুলিশকে শুধু একবার বলতে হয়—যে আসামি সহযোগিতা করছে না, তাই কোনো কথা বের করা যাচ্ছে না। তখনই কোর্ট নার্কো অ্যানালিসিস করার অনুমতি দেয়। সঙ্গে থাকেন বিজ্ঞানীরা । এই সমস্ত পরীক্ষাই হয় ব্যাঙ্গালোরের ‘ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ বা FSL-এর তত্ত্বাবধানে।

ভারতে গত আট বছর ধরে এই নার্কো-অ্যানালিসিস পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে অপরাধের তদন্তের কাজে। তদন্তের সময় অভিযুক্তকে, প্রত্যক্ষদর্শী বলে যারা চিহ্নিত হয়েছে তাদেরকে বা অভিযুক্তের কাছের ও পরিচিত মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হয়। তাদের বয়ান থেকেই অপরাধের নানান সূত্র বেরিয়ে আসে। কিন্তু মানুষের জটিল মস্তিষ্ক মানুষকে শিখিয়েছে মিথ্যা বলতে, অভিনয় করতে, মিথ্যাকে সত্য বলে হলফ করতে। আদালতে গীতা, বাইবেল ইত্যাদি ছুঁয়ে ‘সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ প্রতিশ্রুতির পরও চোখের পাতা না ফেলে, সোনামুখ করে নিপাট মিথ্যে কথা বলে যেতে পারে মানুষই। সত্যি বলানোর জন্যে তাই এত ব্যবস্থা।

কীভাবে হয় নার্কো টেস্ট?

* প্রথমে অভিযুক্তকে বসানো হয় ‘লাই-ডিটেক্টর’ পরীক্ষায়। এর জন্য FSL-এ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাথমিক এই পরীক্ষায় রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন ইত্যাদি আরো কয়েকটি শারীরিক উপসর্গ পরিমাপ করে আন্দাজ করা হয় যে অভিযুক্ত সত্যি কথা বলছে না।

* এরপর হয় ‘ব্রেন ম্যাপিং’। তাতে মস্তিষ্কের কিছু পরীক্ষা করে আবারো নিশ্চিত হওয়া হয় যে অভিযুক্ত কিছু তথ্য গোপন করছে।

* তৃতীয় ধাপে অভিযুক্তকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে দেন যে মানুষটি নার্কো টেস্ট দিতে শারীরিকভাবে প্রস্তুত বা সুস্থ ।

এরপর যে-কোনো বড় অপারেশনের মতো অভিযুক্তকে ও.টি. বা অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে তাকে দিয়ে কনসেন্ট ফর্ম-এ সই করিয়ে নেওয়া হয় অর্থাৎ সে স্বেচ্ছায় এই টেস্ট দিতে যাচ্ছে। তারপর অ্যানাস্থেটিস্ট তাকে ‘ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ’ বা ধমনীর মধ্যে দিয়ে ইঞ্জেকশনের মতো করে ফোঁটায় ফোঁটায় অজ্ঞান করার ওষুধ প্রয়োগ করেন।

তেলগি তো শুনেছি এত আরাম পেয়েছিল, যে আবার টেস্ট দেওয়ার জন্য আবদার ধরেছিল। FSL-এর ডিরেক্টর ডা. মোহন বলছেন, “এটা যদি অত্যাচার হয়, তা হলে সর্বাগ্রে মনস্তাত্ত্বিকরা মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি বন্ধ করুন। তেলগি তো এই পরীক্ষার পর মানসিকভাবে এত নিশ্চিন্ত ও ভারমুক্ত বোধ করছিল যে আবার পরীক্ষায় যেতে চাইছিল।” ডা. মোহন আরো বলছেন যে এই পরীক্ষায় কোনো শারীরিক ক্ষতি হয় না এবং প্রশ্ন করেন মনোরোগে বিশেষজ্ঞরাই, তাই মানসিক আঘাতের কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এখন পর্যন্ত ৭০০- ৮০০ ব্যক্তির উপর এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে ও তার মধ্যে ২৫% কে নিরপরাধ ঘোষণা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তবু দেশে ও বিদেশে এখনো এই নার্কো টেস্ট ‘বিজ্ঞান’-এর তকমা পায়নি। এখনো কোনো আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে এই বিষয়ে কোনো প্রমাণিত তত্ত্ব প্রকাশিত হয়নি। তবে ডা. মোহনের কথায়—এত তথ্য ও পরিসংখ্যান রয়েছে যে শিগগিরই উনি বিজ্ঞানের দরবারে সেগুলো পেশ করবেন এবং তথ্য প্রমাণ-সহ একটা মাপকাঠি নির্ধারণ করে বিষয়টাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজ’ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

তাহলে কেন অন্যান্য দেশ নার্কো অ্যানালিসিসকে বাতিল করেছে? (১) পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত নয় এখনো, (২) ডাক্তারি পেশার এক্তিয়ারে পড়ে না, যেহেতু এক্ষেত্রে কোনো রোগ সারানো নয়, অপরাধীকে ধরার ও শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, (৩) সব সময় নির্ভুল হয় না কারণ অনেকে সম্মোহনের ঘোরে ইলিউশন বা ডিলিউশনের শিকার হয়ে ভুল বলেন বা কল্পিত কিছু কথা বলেন।

এ বিষয়ে প্রাক্তন আই পি এস অফিসার কিরণ বেদী কী বলছেন শুনি ।

‘সব সময় নির্ভুলভাবে না হলেও এই পদ্ধতি যথেষ্ট উপযোগী। এখনো সময়ের পরীক্ষায় পাস হয়নি, আদালত এখনো ছাড়পত্র দেয়নি। তবু নার্কো টেস্ট সত্য উদ্ঘাটনে অনেক সময়ই যথেষ্ট সাহায্য করে। পদ্ধতিটাকে নিয়মের মাপকাঠিতে এনে একটা স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা হিসাবে আদালতের কাছে পেশ করতে হবে। ওটাই শেষ কথা হবে কি না, তা ঠিক করবে আদালত, অন্যান্য তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করার পর।

যাই হোক, ততদিন আমরা কিরণ বেদীর কথায় একমত হয়ে বলতেই পারি যে শারীরিক অত্যাচারের চেয়ে নার্কো অ্যানালিসিস অনেক মানবিক একটি বিকল্প। অপরাধের সূত্র পেলে তবে তো তথ্যপ্রমাণ খোঁজা হবে ও পাওয়া যাবে। যেমন, কোনো অপরাধী যদি সম্মোহন ঘুমের মধ্যে বলে— ‘হাঁ, আমি খুন করেছি। ছুরিটা ফেলেছি পাশের ঝোপে।’ তা হলে নিশ্চয়ই তার কথার ভিত্তিতে তার শাস্তি ঘোষণা হবে না। তখন ছুরিটা খোঁজা হবে। যদি সত্যি সেটা পাওয়া যায় ও তারপর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেমন আঙুলের ছাপ, DNA পরীক্ষা ইত্যাদি সবকিছু মেলানো যায়, তবেই অন্তিম সিদ্ধান্ত ঘোষণা হবে। তাই ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে উড়িয়ে না দিয়ে এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে এগোনো সম্ভব মানুষের সদিচ্ছা থাকলে।

মানুষের সদিচ্ছাই পারে সব পদ্ধতিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে সত্যে পৌঁছতে।

‘নার্কো টেস্ট’ ও সম্মোহনের ঘুমে তফাত নেই বলা যায়।

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!