জাদুকরেরা মঞ্চে যে সম্মোহন দেখান, তা কতটা সত্যি?
জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশনী সংস্থা ‘মিত্র ঘোষ’-এ। এক সময়ে এলো সম্মোহনের প্রসঙ্গ। প্রকাশনী সংস্থার অন্যতম মালিক প্রবীণ বিখ্যাত সাহিত্যিক গজেন্দ্রনাথ মিত্র সম্মোহন নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। পি. সি. সরকারের ম্যাজিক দেখতে গেছি নিউ এম্পায়ারে। মানে এখনকার পি. সি. সরকারের বাবা আর কী। ছ’টায় শো শুরু হওয়ার কথা। ছ’টা দশ, ছ’টা পনের, ছ’টা তিরিশ—পর্দা ওঠার নাম নেই। দর্শকরা অধৈর্য হয়ে উঠছে। চিৎকার, চেঁচামেচি সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। যখন পর্দা উঠল তখন অনেকের মতোই আমিও ঘড়িতে একবার চোখ রাখলাম। সাতটা। পাক্কা এক ঘণ্টা দেরি। বেশ কিছু ক্ষুব্ধ দর্শক দেরির জন্য কৈফিয়ত তলব করতে শ্রীসরকার তাঁর বিচিত্র হাসিটি বজায় রেখেই নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন—কই, এক মিনিটও দেরি করিনি তো!
কী বলে? নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে অবাক! ঠিক দেখছি তো? এতো সত্যিই ছ’টা! তা হলে? এতক্ষণ যে সাতটা দেখছিলাম। আর সে তো শুধু আমি নই। হলঘর ভর্তি সক্কলেই যে ছ’টাকে এতক্ষণ সাতটাই দেখেছিলেন! বিপুল হাততালি দিয়ে সেদিন দর্শকরা শ্রীসরকারের গণসম্মোহনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
গল্পটা বলে গজেনদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো সম্মোহন বিশেষজ্ঞ, ব্যাপারটি কীভাবে পি. সি. সরকার করেছিলেন বল তো? তুমি পারবে এমন ঘটাতে?”
স্বীকার করে নিলাম, “না পারব না। আমি কেন পৃথিবীর কোনও জাদুকরই এমনটা ঘটাতে পারবেন না। অতীতেও কেউ এমনটা ঘটাতে পারেননি। এ’ধরনের গণসম্মোহন কোনো দিনই দেখানো সম্ভব নয়।”
“তা হলে আমি কি মিথ্যে বললাম?” সরাসরি ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করলেন গজেনদা।
কঠিন সত্যি বলতে গেলে মাঝে-মধ্যে এমন অবস্থায় পড়তেই হয়। একটা ভুল ধারণা যাতে অনেকের মনের ভিতর ঢুকে না পড়ে, সেটা দেখতে গিয়ে অনেক সময় অপ্রিয় সত্যি- কথা বলতেই হয়। এখানেও হল। কথাগুলোকে একটু মোলায়েম করে বললাম, “আপনি মিথ্যে বলছেন, বলছি না। হয়তো আপনার স্মৃতি আপনার সঙ্গে রসিকতা করেছে। অনেক সময় এমনটা হয়। একটা শোনা গল্প যদি কারো মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয় তবে অনেক সময় গল্পটা অনেকের কাছে বলতে বলতে একসময় সে বিশ্বাস করে ফেলে, ঘটনাটা সে নিজেই দেখেছে। অনেক সময় বহুকথিত হওয়ার ফলে আমরা বিশ্বাসও করে ফেলি। আমি বিশ্বাস করি, আপনার স্মৃতি একটু গোলমাল পাকিয়েছে।
পি. সি. সরকারের আগেও এমনি ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়ার গণসম্মোহনের আষাঢ়ে গল্প আরো অনেক জাদুরককে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে চালু ছিল। এইসব জাদুকররা হলেন রাজা বোস, জাদুকর গণপতি, রয়-দি-মিসটিক। পৃথিবীতে যাঁকে নিয়ে আষাঢ়ে গল্পটির শুরু, তিনি হলেন এক মার্কিন জাদুকর হাওয়ার্ড থার্সটন।
জাদুকররা মাঝে-মধ্যে কেন, কোনো সময়ই সম্মোহনের সাহায্যে জাদু দেখান না। শূন্যে মানুষ ভাসিয়ে রাখতে, একটা ডাণ্ডার উপর মানুষকে ঝুলিয়ে রাখতে, করাতে দেহ দু’টুকরো করার খেলা দেখাতে বা অন্য কোনো খেলায় জাদুকর সম্মোহন করেন না। কৌশলের সাহায্যে করেন। জাদুকর চোখ বড় বড় করে দু’হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে যে ‘সম্মোহন’ (?) করেন, সেটা আদৌ সম্মোহন নয়। অভিনয়। জাদুকরের সঙ্গিনী বা সঙ্গী সম্মোহিত হওয়ার অভিনয় করেন। তারপর যা দেখানো হয়, তা সম্পূর্ণই কৌশলে দেখান জাদুকরদের এই অভিনয় বা প্রতারণামূলক সম্মোহন কয়েক প্রজন্ম ধরে দেখতে দেখতে দর্শকরা ‘সম্মোহন’ সম্বন্ধে ভুল ধারণা একটু একটু করে নিজের মনের মধ্যে গড়ে তুলেছেন।
কোনো জাদুকর যখন জাদু দেখান, তখন সে’সবই দেখান নিছক কৌশলে, কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় নয়। প্রতিটি জাদুকরই সে’কথা মঞ্চে ও মঞ্চের বাইরে স্বীকারও করেন। কিন্তু কেউ যদি তেমনটা না করে কোনো জাদু দেখাতে গিয়ে দাবি করেন—এটা এবার দেখাচ্ছেন মন্ত্রশক্তিতে, ঈশ্বরের কৃপায় বা ভূতকে কাজে লাগিয়ে, তবে তা হবে সত্য- লঙ্ঘন, প্রতারণা। এবং এক্ষেত্রে যুক্তিবাদী প্রতিটি মানুষের উচিত এমন এক ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরা। ঠিক একইভাবে অভিনয়কে সম্মোহন বলে মানুষকে প্রতারণার যে ঘটনা সুদীর্ঘকাল ধরে ঘটেই চলেছে, তাকে বন্ধ করা। সম্মোহন বা মস্তিষ্কে ধারণা সঞ্চারের মধ্য দিয়ে বাস্তবিকই যা হয় তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেই সীমাবদ্ধতাকে, সেই সত্যকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার স্বার্থেই এইসব ‘না- সম্মোহন’কে ‘সম্মোহন’ বলে চালানোর বুজরুকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ কি আদৌ কোনো কৌশলে দেখানো সম্ভব? ওই ব্যাপারটার পিছনে কি গণসম্মোহন কাজ করেনি? এ’জাতীয় অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। উত্তরে প্রত্যেককেই যা জানিয়েছি, তা আবারো জানাচ্ছি—ট্রেন ভ্যানিশের ম্যাজিকে না ছিল অমৃতসর এক্সপ্রেস, না একজন দর্শকও ট্রেনটাকে ভ্যানিশ হতে দেখেননি। ম্যাজিকটা আদৌ দেখানোই হয়নি। কেউ দেখেনি। গোটা ম্যাজিকটার ভিত্তি ছিল মিথ্যে প্রচার। পুরো ঘটনাটা বিস্তৃতভাবে জানাব এই গ্রন্থেই।
জাদুকর ম্যানড্রেকের কাহিনিতে যেসব সম্মোহন শক্তির কথা আপনারা কমিক্সের বইতে পড়েন, সে’সব নেহাতই ‘গুল-গপ্পো’। অথচ অনবরত ওসব কাহিনি পড়তে পড়তে অনেকেই ভাবেন, সম্মোহনের সাহায্যে সত্যিই বোধহয় এমনটাও ঘটানো সম্ভব। মজার কথা কী জানেন, বছর কয়েক আগে ‘আনন্দমেলা’র পুজো সংখ্যায় আমার প্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার ম্যানড্রেকের গল্পে প্রভাবিত হয়ে তাঁর উপন্যাসে ম্যানড্রেকি সম্মোহন হাজির করেছিলেন। এমনকি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৪০২ (ডিসেম্বর, ১৯৯৫) সংখ্যা সত্যজিৎ রায়ের অপ্রকাশিত নতুন যে ফেলুদা-উপন্যাস ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’ প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে সূর্যকুমার নামে এক জাদুকর লালমোহনবাবুকে মঞ্চে ডেকে এনে তাঁকে সম্মোহন করে পেন্সিল খাওয়াচ্ছেন অথচ সম্মোহিত লালমোহনবাবু ভাবছেন তিনি চকোলেট খাচ্ছেন। বাস্তবে এমনটি ঘটে না, এবং এ-সবই হল ম্যানড্রেকি গল্পের প্রভাবের ফল মিথ্যে সম্মোহনের ফল।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ