পৃথিবীর কোনো মহৎ কাজই নারীর অবদান ব্যতীত পূর্ণতা লাভ করে নি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনে নারী সমাজের ভূমিকা ছিল অন্যতম। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, গেরিলা যুদ্ধে শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেকির ভূমিকায়, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রন্ধনশালায়, হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষায়, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দূতাবাসে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গমন করে, সর্বোপরি স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর মনোবল দৃঢ় রাখার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করে এবং গঠিত সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে প্রবাসে বাংলাদেশের নারী সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে ব্যতিক্রমী অবদান রাখার জন্য পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বীরপ্রতীক খেতাব প্রদান করা হয় মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে।
বীরত্বগাথার ক্ষেত্রে এমন অবদান রাখা সত্ত্বেও সাংগঠনিক প্রতিনিধিত্বের অভাবে অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা আড়ালে পড়ে থাকেন । তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া দূরের কথা তাঁদের পরিচিতি সংরক্ষণ করার কাজটিও উপেক্ষিত হয়ে এসেছে দেশের স্বাধীনতার ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যাপৃত অনুসন্ধানীদের কাছে প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের অবদান রাখা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও ত্যাগের ইতিহাস।
আমরা কি ভুলতে পারি কসবার কুল্লাপাথরের ৫১জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল গড়ে ওঠার অতীত ইতিহাস! মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিমের মা মহিয়সী নারী তারজাতুন নেসা তার স্বামী আব্দুল মান্নানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস এই এলাকায় এবং এলাকার আশেপাশে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে এবং গোসল করিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বীরের মর্যাদায় দাফন করার দায়িত্ব পালন করেছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল এবং লাশ ধোয়ানোর চৌকিটি যার স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। গোটা দেশেই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের এরকম বীরত্বগাথা রয়েছে, যা এখনো মুক্তিযুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করছে।
সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য এ দেশের নারীরা বড় মূল্য দিয়েছে পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে। আমরা স্বাধীনতার পরে তাঁদের যথাযথ সম্মান জানাতে পারি নি । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন, কিন্তু আমাদের নিম্নমানের সামাজিক সাংস্কৃতিক রুচির কারণে আমরা তাঁদের অবদানের মূল্যায়ন করি নি। বীরাঙ্গনা নারীদের অবদান সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার সময় হয়েছে। বীরাঙ্গনা বলে তাঁদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার মানসিকতা থাকা উচিত নয়। আমি বীরাঙ্গনা শব্দটির মধ্যে কোনো ধরনের অগৌরব দেখি না। এটি একটি গৌরবময়, মর্যাদাপূর্ণ শব্দ, যে নারী এই মূল্য দিয়েছেন তিনি আমাদের নমস্য। তাঁকে মাথায় তুলে রাখা উচিত। যে যেভাবে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিয়েছে সেই যোদ্ধা।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র’ নামে ১৬টি খণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এর একটি খণ্ডে পঁচিশ মার্চের গণহত্যা পরবর্তী সময়ের বিবরণ দিয়েছে ঢাকা শহরের ডোমেরা। তাদের বিবরণ পড়লে গা শিউরে ওঠে, বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ডোম রাবেয়া খাতুন যে বর্ণনা করেছেন তা যেমন ভয়াবহ তেমন নৃশংস। তিনি বলেছেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যেসব মেয়েদের ধরে আনা হতো, তাদের শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি পাকসেনারা, নির্মমভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো টুকরো করেছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে মেয়েদেরকে অত্যাচার করেছে। এমনকি রাজারবাগ পুলিশ ক্লাবে মেয়েদের উলঙ্গ করে লোহার রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। বিবরণ অজস্র আছে, পড়লে চোখ ভিজে যায় না, ঘৃণায় ক্রোধ জন্মায়।
যে-কোনো দেশে যে-কোনো কালে এ কথা সত্য যে, যুদ্ধ কিংবা রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের সামাজিক দায়ভার এভাবেই বহন করতে হয় নারীদের। প্রাকৃতিক কারণেই একে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই এই মূল্য দান যে-কোনো বড় অর্জনের অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দেশের নারীরা আরো অনেক ধরনের ত্যাগের বাইরেও স্বাধীনতার মতো বড় অর্জনের মধ্যে নিজেদের এভাবেই যুক্ত করেছে। কোনো বিচারেই এ ত্যাগের মূল্য ছোট করে দেখা উচিত নয়। যে যুবক চোখ এবং হাত বাঁধা অবস্থায় নিহত হয় এবং যে যুবতী লোহার শিকে ঝুলে মৃত্যুবরণ করে তাতে কোনো তফাত নেই। কারণ একটি — স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের এমন গৌরবগাথার ইতিহাস সংরক্ষণে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। প্রশিকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সেলের উদ্যোগে ৩৯জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় পর্যায়ে সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ২৬ মার্চ, ২০০৩ সালে। আর আসন্ন ২৫ মার্চ ০৪ দেশের ৫১জন নারী মুক্তিযোদ্ধার জীবনভিত্তিক প্রফাইল সংবলিত পুস্তক প্রকাশ করা হচ্ছে প্রশিকার পক্ষ থেকে। এ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রশিকার প্রেসিডেন্ট ড. কাজী ফারুক আহম্মদের ব্যক্তিগত উৎসাহ ও সম্পৃক্ততা প্রশংসার দাবি রাখে।
এছাড়া প্রশিকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সেলের দেওয়ান রাশেদুল শাহীন, মোঃ আবু সাঈদ ও শাম্মিন সুলতানা মুন্নির অবদান অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধ সেলের এ দলটি দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে ৫১জন নারী মুক্তিযোদ্ধার জীবন, কর্ম ও বর্তমান অবস্থানের বর্ণনা সংগ্রহ করেছেন। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করার ক্ষেত্রে সংগ্রহকারী দলকে সহযোগিতা করেছেন উন্নয়ন কর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বোনেরা, তাঁদের সবাইকে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। এই বইয়ের সব উক্তি রচনা করেছেন আবু সাঈদ। তাঁর পরিশ্রম ও নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ-এর সত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বইটি জরুরি ভিত্তিতে প্রকাশ করতে সম্মত হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃতজ্ঞ।
এ বইটি সম্পাদনা করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করায় আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃক গৃহীত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সকল কার্যক্রম সফল হোক— এ প্রত্যাশা করছি।
সেলিনা হোসেন
তারিখঃ ২৪ মার্চ, ২008