একঃ সরকার বা শাসক গোষ্ঠী

আমাদের দেশের সংসদীয় নির্বাচনের চেহারাটা আমাদের কারুরই অজানা নয়। সংসদীয় নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা দখলের দিকে এগোতে চাইলে, লোকসভায় বা বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়ে দাপট বজায় রাখতে চাইলে সেই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে বিপুল অর্থ সামলাতেই হবে। বর্তমানে নির্বাচন মানেই এক-রাজসূয় যজ্ঞ। বিশাল প্রচার-ব্যয়, রিগিং, বুথদখল, ছাপ্পা ভোট এ-সব নিয়েই এখনকার নির্বাচন। এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মাসলম্যানদের পিছনেও বইয়ে দিতে হয় অর্থের স্রোত। এই শত-সহস্র কোটি টাকা গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের এক-টাকা দু-টাকা বা পাঁচ-টাকা চাঁদায় তোলা যায় না। তোলা হয়ও না।

নির্বাচনী ব্যয়ের
শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি টাকা যোগায় ধনকুবেররা।
বিনিময়ে তারা এইসব দলগুলোর কাছ থেকে পায়
স্বস্তিতে শোষণ চালাবার গ্যারান্টি।
বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো
কৌশল হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে
নির্বাচনী তহবিলের জন্য চাঁদা আদায় করতে দেখাতে চায়
“মোরা তোমাদেরই লোক।”

এইসব রাজনৈতিক দলের নেতারা যখন মাঠে-ময়দানে, পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে গরিবি হটানোর কথা বলেন, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন, মেহনতি মানুষের হাতিয়ার বলে নিজেদের ঘোষণা করেন, তখন কিন্তু এইসব তর্জন-গর্জনে শোষকশ্রেণীর সুখনিদ্রায় সামান্যতম ব্যাঘাত্য ঘটে না। শোষকশ্রেণী জানে তাদের কৃপাধন্য, তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এইসব বজ্রনির্মোঘ স্রেফ ছেলে-ভুলানো ছড়া ; সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষকে ভুলিয়ে রাখার এ এক কৌশল। হুজুরের দল চায় এ-ভাবেই তাদের ক্রীড়নক রাজনৈতিক দলগুলো শোষিতদের আপনজনের মুখোশ পরে শোষিতদের বিভ্রান্ত করুক, যাতে তাদের সম্মিলিত ক্ষোভ দানা বেঁধে বিস্ফোরিত হতে না পারে। এই সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শোষণ কায়েম রাখার স্বার্থেই শোষণকারীদের দালাল রাজনৈতিক দলগুলো শোষিত সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নানা ভাবে।

হুজুরদের কৃপাধন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মধুর লোভে স্ব সময়ই চায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে।

ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই চায় মানুষ অদৃষ্টবাদী হোক, বিশ্বাস করুক পূর্বজন্মের কর্মফলে, ঘুরপাক খাক নানা সংস্কারের অন্ধকারে। এমন বিশ্বাসগুলো শোষিত মানুষ তাদের প্রতিটি বঞ্চনার জন্য দায়ী করবে নিজের ভাগ্যকে, কর্মফলকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে।

দেশের আর্থিক ক্ষমতার লাগাম যে ধনকুবের গোষ্ঠীর হাতে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিকদের, রাজনৈতিক দলগুলোকে। ধনকুবেররা সেইসব রাজনৈতিক দলগুলোকেই অর্থ দিয়ে লালন-পালন করে, যারা গদি দখলের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ক্ষমতা রাখে, অথবা ক্ষমতা রাখে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে দাপট প্রকাশের। বিনিময়ে এইসব রাজনৈতিক দলগুলো শোষণ প্রক্রিয়াকে সমস্ত রকম ভাবে মসৃণ রাখবে।

বিভিন্ন ধনকুবেরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়াবার প্রতিযোগিতা। তারই ফলে কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখল করার পরও প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন মন্ত্রী বাছাই নিয়েও চলে ধনকুবেরদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। উল্টো দিক থেকে রাজনীতিকরাও বড় বড় কুবেরদের সমর্থন পেতে গোলাম থাকার দাসখৎ লিখে দেন।

বিষয়টা স্পষ্টতর করতে চলুন আমরা ফিরে তাকাই ১৯৯১-এর জুন মাসটির দিকে। এই সময় আমরা দেখলাম, শ্রীনরসিনহা রাও যিনি কিনা নিজেকে একনিষ্ঠ জ্যোতিষ বিশ্বাসী ও ঈশ্বর বিশ্বাসী বলে ‘প্রজেক্ট’ করেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রীর গদিটি বাগাবার জন্য ভাগ্য ও ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই না দিয়ে, ‘অবতার’ নামক ঈশ্বরের এজেন্টদের শুকনো আশীর্বাদের উপর ভরসা না করে ধনকুবেরদের কৃপাপ্রার্থী হতে দোরে দোরে দৌড়চ্ছেন। অন্যদিকে শ্রীশরদ পাওয়ারকেও আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর গদি বাগানোর লড়াইতে শামিল হতে এবং একইভাবে ধনিকদের দোরে ধরনা দিতে।

তারপর যা ঘটল, তা সবই ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষি পত্রিকায় চাটনি হিসেবে পরিবেশিত হল। শ্রীপাওয়ারকে পরাজিত করে নিজের পাওয়ারকে বজায় রাখতে শ্রীরাও বিড়লা, হিন্দুজা, আম্বানিদের মত বিশাল শিল্পপতিদের স্বার্থেই এবং এইসব শিল্পপতিদের অঙ্গুলি হেলনেই নির্ধারিত হবে ‘ভারত’ নামক দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতি। দেশের রাজা ওইসব শিল্পপতিরাই হবেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ ও সেই পদের ক্ষমতায় যেটুকু সম্পত্তি স্বআত্মীয়ে কাচিয়ে তুলতে পারবেন, তাতেই তিনি বিলকুল খুশি থাকবেন।

পত্র-পত্রিকা পাঠে আমরা জানতে পেরেছি, শ্রীরাও নিজের পিছনে সাংসদদের সমর্থন আদায় করতে নাকি নিজের দলের সাংসদ পিছু ৫০ লক্ষ টাকা করে ভেট দিয়েছিলেন। টাকা যুগিয়েছিলেন ‘মিনিস্টার মেকার’ শিল্পপতিরা।

শ্রীপাওয়ারের পিছনেও ছিল একগুচ্ছ শিল্পপতির সমর্থন, তাঁর শিবিরে শামিল ছিলেন কিলোস্কার, বাজাজ, নাসলি ওয়াদিয়া, গুলাচাঁদ প্রমুখ শিল্পপতিরা। তাঁরাও শুধু হাতে নামেননি। টাকার থলির ভেট তাঁরাও পেশ করেছিলেন সাংসদদের। কিন্তু বেশি সাংসদদের কিনে ফেলেছিলেন শ্রীরাও সমর্থক শিল্পপতিরা। এইসব খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১-এর ২০, ২১, ২২ জুনের বিভিন্ন ভাষাভাষি দৈনিক পত্রিকায়।

পত্রিকাগুলো কি তবে সেই দিনগুলোতে সিস্টেমকে আঘাত হেনেছিল? আদৌ তা নয়। কারণ তারা পত্রিকার বিক্রি বাড়াতে রসালো চাটনি সরবরাহ করেছিল মাত্র। এইসব সংবাদ কেনা-বেচার হাটে শিল্পপতিদের দালালের ভূমিকায় সেদিন অনেক নামী-দামী সাংবাদিকও অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এমন খবরও পত্র-পত্রিকাতেই আমরা দেখেছি বরং এই ধরনের খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রচার-মাধ্যম কয়েকটি ধারণা সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলঃ (ক) রাজনীতি ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দ। ফলে অসাম্যের রাজনীতিকে (যা দুর্নীতির উপর নির্ভর করেই টিকে থাকে) হটাতে সাম্যের সমাজ গড়ার রাজনীতিতে শামিল তরুণ-তরুণীদের সামাল দেবেন তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকরাই। যুক্তি দেবেন, “রাজনীতির মধ্যে ঢুকিস না, যত সব নোংড়া ব্যাপার”। (খ) স্বার্থপর একটি শ্রেণী গড়ে উঠবে ও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকবে যারা মনে করবে বেঁচে-বর্তে থাকতে গেলে, চাকরি জোটাতে গেলে, মস্তানি করে ‘টু-পাইস’ কামাতে গেলে, প্রমোটর হয়ে সাচ্ছল্যের জীবন কাটাতে হলে, ধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে হলে, নিরুপদ্রবে ব্যবসা করতে গেলে, স্কুল-কলেজে অ্যাডমিশন পেতে হলে রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় থাকতেই হবে। (গ) খোলাখুলিভাবে দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এমন দুর্নীতি এবং তারও পর নেতাদের বুক চিতিয়ে চলা, এবং এই দুর্নীতিগ্রস্থদের ঘৃণা ছুঁড়ে দেবার পরিবর্তে দেশের সম্মানিত সব বুদ্ধিজীবীদের, শিক্ষাবিদদের গদগদ ভক্তি প্রকাশের যে ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে প্রচার মাধ্যমগুলো, তাতে দুর্নীতিকে ঘৃণা করা সাধারণ মানুষ, সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা মানুষ নিরাশার শিকার হয়ে পড়েন। এমন দুর্নীতির সঙ্গে, অসাম্যের সঙ্গে আগাপাশতলা জড়িত থাকা সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টানো এক অসম্ভব চিন্তা মনে করেই আসে নিরাশা ও অবদমিত বিষণ্ণতা বর্তমান সমাজ কাঠামোরে স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতেই সহায়তা করে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনারা ভাবুন, বাস্তবিকই কি বৃহৎপত্রিকাগুলো সততার সঙ্গেই এই রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতেই এমন খবর প্রকাশ করছেন? না কি, এই সংবাদ প্রকাশের পিছনে ছিল সেই সব উদ্দেশ্য, যেগুলো নিয়ে এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম। ভাবুন প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনাদের শানিত যুক্তিই আপনাদের সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে।

বহু কোটি টাকার মূলধন বিনিয়োগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এক একটি সংবাদ পত্র, এক একটি প্রচার মাধ্যমের সম্রাজ্য। এই সব সম্রাজ্যের মালিক কোটিপতিদের কাছে এই সব পত্র-পত্রিকা প্রচার-মাধ্যমগুলো সাধারণভাবে স্রেফ একটা রোজগারের মাধ্যম, একটা ব্যবসা মাত্র ; যেমন ব্যবসা করেন শেয়ার দালাল, বিল্ডিং প্রমোটার, ফিল্ম প্রডিউসার কিংবা বস্ত্রশিল্পের মালিক। এরা নিশ্চয়ই অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে লোটা-কম্বল নিয়ে নিজেদের বঞ্চিত মানুষদের সারিতে দাঁড় করাতে চাইবে না, চাইতে পারে না। এই সত্যটুকু আমাদের বুঝে নিতেই হবে, সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থেই বুঝে নিতে হবে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন- আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শোষকশ্রেণীর দালালের অধিকার লাভের প্রতিযোগিতা।

গণতন্ত্র মানে কি শুধুই ভোট দেওয়ার অধিকার? সেটাই বা ক’জনের আছে? ছাপ্পা ভোট, বুথ দখল, চতুর রিগিং সেই অধিকারে তো অনেক দিনই থাবা বসিয়েছে।

তারপরও যদি ভোট দেওয়ার অধিকারের প্রসঙ্গ টেনে কেউ বলেন এই দেশের মানুষই কখনো ইন্দিরাকে তুলেছেন, কখনো নামিয়েছেন, কখনো রাজীবকে সিংহাসনে বসিয়েছেন, কখনো বা ছুঁড়ে ফেলেছেন, কখনো এনেছেন ভি. পি-কে, কখনো পি. ভি-কে, তাঁদের আবারও মনে করিয়ে দেব পরম সত্যটি, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বলব কথাটি- মন্ত্রী যায় মন্ত্রী আসে, এঁদের বহু অমিলের মধ্যে একটাই শুধু মিল- এরা প্রত্যেকেই শোষকশ্রেণীর কৃপাধন্য, পরম সেবক। এঁরা শোষকদের শোষণ বজায় রাখার ব্যবস্থা করে দেবার বিনিময়ে আখের গোছান।

error: Content is protected !!