‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ (Contempory Rationalism) একটি বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি, একটি সম্পূর্ণ দর্শন ও একটি সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম।

কথা হচ্ছিল স্বপ্নময় চক্রবর্তীর সঙ্গে। স্বপ্নময় ভাল গল্প লেখেন, উপন্যাসও। কলকাতা বেতার কেন্দ্রের বিজ্ঞান বিভাগের প্রযোজক ছিলেন। এখন চাইবাসার স্টেশন ডিরেক্টর।

বেতারের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর উপর কিছু দায়িত্ব বর্তেছিল এই নিয়ে ‘পেপার’ তৈরি করার। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমাকে বলছিলেন, “আমি আমার তৈরি ‘পেপার’এ লিখলাম, ৭৫ বছরের সেরা ‘টক শো’ ছিল আপনার জ্যোতিষের বিরুদ্ধে করা প্রোগ্রামটা। ১৯৮৫ তে প্রোগ্রামটা ব্রডকাস্ট হয়েছিল। সেই সময় আপনি প্রায়ই নতুন নতুন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব নিয়ে আসতেন। তাতে আমাদের বেতারের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল।

“এই কথাগুলো আমি লিখলাম। সত্যি মনে হয়েছিল বলেই লিখলাম। কিন্তু সত্যি কথাগুলোর প্রচার বন্ধ করতে লড়ে গেলেন ‘৮৫-র বিজ্ঞান বিভাগের প্রোডিউসার। আমি জানি, গোটা পরিকল্পনাটাই ছিল আপনার। কিন্তু …….. বাবু কৃতিত্বটা পুরোপুরি নিজে নিতে কোথায় নামলেন, ভাবা যায় না।

“এ দেশের যুক্তিবাদী আন্দোলনের শুরুরও একটা ইতিহাস আছে। নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো। তাঁরাই গড়ে তুললেন যুক্তিবাদী আন্দোলন। সে আন্দোলন যে আপনারই ‘ব্রেন-চাইল্ড’, আপনিই যে পথিকৃৎ—এটাকে অস্বীকার করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।”

স্বপ্নময়ের অনুভবে—যুক্তিবাদী আন্দোলন একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বিপ্লব পরিস্থিতি তৈরিতে যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। তাঁর অনুভব মিথ্যে নয় । ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র প্রকাশিত ২০০২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম ‘দলিল’-এর সুরুটা এ’রকম : “আমরা মনে করি আধুনিক ‘দর্শন’ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’-এর স্রষ্টা প্রবীর ঘোষা … সমকালীন যুক্তিবাদ’ শুধু বিচার বিশ্লেষণের কিছু পদ্ধতিগত কায়দা-কানুন নয়, এই ‘যুক্তিবাদ’ একটি সামগ্রিক জীবন-দর্শন, একটি বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি, একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।”

‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র এই দলিলের কোনও কথাই মিথ্যে নয়। বহু বিবর্তনের পথ ধরে আজ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন হয়ে উঠেছে। এই দর্শন চির আধুনিক। কারণ ‘সমকালীন যুক্তিবাদী’ দর্শন শিখতে শিখতে পাল্টায়, পাল্টাতে পাল্টাতে শেখে।

‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ যখন ছিল না, তখনও যুক্তি ছিল, যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া ছিল, যুক্তিকে ‘দর্শন’ হিসেবে দাঁড় করাবার প্রয়াসও ছিল। স্থান ও কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জগতকে দেখার সামগ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি, পুরনো মতাদর্শ, মূল্যবোধকে ত্যাগ করার একটা বড় বাধা প্রাচীনপন্থী সমাজ। চিন্তায় এগিয়ে থাকা মানুষই পারে যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে ভালোকে গ্রহণ করতে ও খারাপকে ফেলে দিতে। এই যে চিন্তার সঙ্গে নিজের জীবনে তার প্রয়োগের মেলবন্ধন—এটাই সমাজকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় । সমাজ ততটাই এগোয় যতটা আমরা এগিয়ে নিয়ে যাই ।

সমাজ-প্রগতির অর্থ সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেণীর প্রগতি হতে পারে না। শোষণের অবসান ছাড়া গোটা সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। ধনী-গরিব থাকলে শোষণ থাকবে। সমাজ-প্রগতির স্বার্থে, মানব প্রজাতির প্রগতির স্বার্থে যুক্তিবাদীরা শোষণের অবসান চায়। শুধু চাইলে তো হবে না, চাওয়াটাকে সফল করে তোলাটাই বড় কথা। যতক্ষণ আপনি শুধু চাইছেন, ততক্ষণ ধনীদের এ’নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। আপনি সার্থক প্রয়োগের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ অনিবার্য।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধনীরা নিত্য-নতুন কৌশল নিচ্ছে গরিবদের পায়ের তলায় রাখতে। পুঁজিবাদীদের কৌশলের সঙ্গে সার্থক মোকাবিলা করতে হলে যুক্তিবাদীদেরও নতুন নতুন কৌশল বের করতেই হবে। পুঁজিবাদের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিবাদকেও নতুন ভাবে সাজাতে হবে। পাল্টাতে হবে। যুক্তিবাদ’কে স্থবির মতবাদ করে রাখলে তা হবে যুক্তিবাদেরই মৃত্যু।

‘যুক্তিবাদ’ হঠাৎ করে আকাশ থেকে এসে পড়েনি। এই মতবাদের

পরিপূর্ণ দর্শন হয়ে ওঠার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বুদ্ধ, মহাবীর,

চার্বাক থেকে দেকার্ত, স্পিনোজা, হেগেল, কান্ট, মার্কস, লেনিন,

মাও—প্রত্যেকেরই অবদানের পরিণতিতে আজ ‘যুক্তিবাদ: একটা

সম্পূর্ণ দর্শনের রূপপেয়েছে। ‘যুক্তিবাদ’ ও ‘নব্য-যুক্তিবাদ-

এর পথ পরিক্রমা শেষে ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’-

এ এসে পৌঁচেছে। ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’

চিরকাল-ই সমকালীন থাকবে—

এমন-ই এক যুক্তিবাদ।

আমরা আগে যা আলোচনা করেছি, পরে যা আলোচনা করবো, তাতে আশা =করি যুক্তিবাদের ইতিহাস ও আধুনিক যুক্তিবাদের স্বরূপ কিছুটা স্পষ্ট হবে।

 
যুক্তিবাদ ও যুক্তিবাদী সমিতি

‘যুক্তিবাদ’কে সম্পূর্ণ দর্শন হিসেবে গড়ে তুলতে ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’, চিন আধুনিক যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ একটা রূপ দিতে এবং ‘যুক্তিবাদী আন্দোলন’কে সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে প্রয়োগ করার চিন্তা থেকে ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র জন্ম। জন্মের সময় ১ মার্চ ১৯৮৫। সে সময় অবশ্য নাম ছিল ভারতের যুক্তিবাদী সমিতি’। লোকে সংক্ষেপে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ বলেন।

যুক্তিবাদী সমিতি গড়ে তোলার আগে ছিল একটা প্রস্তুতি পর্ব। সে সময়কার জনপ্রিয়তম বাংলা সাপ্তাহিক ছিল ‘পরিবর্তন’। কয়েক বছর ধরে পরিবর্তনে ‘লৌকিক, অলৌকিক’ শিরোনামে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরিবর্তনের ব্যাপক প্রচারের কল্যাণে আমার লেখাগুলো বেশ কিছু সংখ্যক পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাই। সে’সব লেখাকে ভালোবাসার মানুষ পেয়েছিলাম প্রচুর। লেখার মূল সুরের সঙ্গে সহমত মানুষদের একটা নিবিড় সম্পর্কে গড়ে তুলি। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান করা শুরু করি। এক সময় মনে হল, এ’বার সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার সময় হয়েছে। তারপর এলো ১ মার্চ ১৯৮৫।

সমিতির একটা উদ্দেশ্যসূচী বা manifesto-র প্রয়োজন আমরা অনুভব করলাম। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই লেখা হলো ‘সংস্কৃতি : সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ গ্রন্থটি। প্রকাশিত হল ‘৯৩-এর ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বইমেলায়। গ্রন্থটিতে একই সঙ্গে দুটি বিষয়কে স্পষ্ট করা হল। (১) যুক্তিবাদ একটি সম্পূর্ণ দর্শন। (২) যুক্তিবাদ একটি সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী, সাম্যের স্বপ্ন দেখা রাজনীতিক এবং চিন্তাবিদদের অনেকের কাছেই গ্রন্থটি অসাধারণ গ্রহণযোগ্যতা পেল। দেখা গেল একটা বই বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী ও নেতৃত্বের মধ্যে স্পষ্ট Polarization আনলো। অর্থাৎ বইটা এইসব রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃত্বকে সরাসরি দুই শিবিরে বিভক্ত করলো। একদল গ্রন্থটির বক্তব্যের পক্ষে, একদল বিপক্ষে। বি.বি.সি-র প্রোডিউসর ইনচার্জ রবার্ট ঈগল ভারতে এলে ১৯৯৪-এ। উদ্দেশ্য ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলনের উপর এক ঘণ্টার একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করা।

গুরু বাস্টার্স’ নামের তথ্যচিত্রটির শেষ অংশে বিশেষজ্ঞের মতামতে

বিশিষ্ট সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্ত জানালেন—ভারতের বাম

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সরাসরি বিভাজন আছে,

প্রবীর ঘোষের পক্ষে অথবা বিপক্ষে। ভারতের

রাজনীতিতে প্রবীর ঘোষ এবং ‘ভারতীয়

বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’

একটা ‘ফ্যাক্টর’।

তথ্যচিত্রটির বক্তব্য শুনে ও গোয়েন্দা দপ্তরের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে রাষ্ট্রশক্তি যথেষ্ট শঙ্কিত হল। যুক্তিবাদী আন্দোলন ধ্বংস করতে দালালদের অনুপ্রবেশ ঘটলো যুক্তিবাদী সমিতিতে। নকশাল আন্দোলন ধ্বংসের জন্য যে সব কৌশল রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল, তার একটা ছিল, নকশালদের মধ্যে নিজেদের ইনফরমার বা দালাল ঢুকিয়ে দেওয়া ।

গোটা যুক্তিবাদী সমিতি ও তার শাখা হিউম্যানিস্ট অ্যাসোশিয়েশনকে

সরকারি ও বেসরকারি অর্থসাহায্যপুষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়

রূপান্তরের পরিকল্পনা নিল রাষ্ট্র। পরিকল্পনা বা

ষড়যন্ত্রকে সার্থক করতে নেমে পড়লো

অনুপ্রবেশকারী দালালরা।

রাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি এবং জ্যোতিষী, অলৌকিক বাবাজী-মাতাজীরা দালালদের ক্ষমতা দখলের কাজে পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল।

এত করেও রাষ্ট্র যুক্তিবাদী আন্দোলনকে শেষ করতে পারেনি। দালালরা পারেনি সমিতির দখল নিতে, সমিতিকে তৃণভোজী বানাতে ।

যুক্তিবাদীরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছুই শিখেছিল। শিখেছিল ‘মস্তিষ্ক যুদ্ধ’-এর পাল্টা ‘মস্তিষ্ক যুদ্ধ’ প্রয়োগ করতে। শিখেছিল—মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতার অর্থ—ধ্বংস। শিখেছিল লড়াইতে জনগণকে কাছে টানতে। ফলে যুক্তিবাদী আন্দোলনে শামিল করতে পেরেছে সাধারণ থেকে অসাধারণ মানুষেদের। তাঁরাই ছিলেন এই ভাঙার চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তিবাদী সমিতির সহায়ক শক্তি। তাই আগুন থেকে ফিনিক্স পাখির মতই উঠে এসে আবারও ডানা মেলেছে যুক্তিবাদী আন্দোলন।

দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন দার্শনিক ‘দর্শন’ বা সামগ্রিকভাবে বিশ্বকে দেখার প্রজ্ঞা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, সমাজের হিত নির্ধারণ ও তার প্রয়োগ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখানেই প্রয়োজন ছিল এক মানবতাবাদী নীতিশাস্ত্রের। তাই সমকালীন যুক্তিবাদের প্রয়োজনে ১৯৯৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর জন্ম নিল ‘হিউম্যানিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’। তারপর অনেক ঐতিহাসিক জয় এনেছে ‘হিউম্যানিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন। ১০ অক্টেবার ১৯৯৩ একটি ঐতিহাসিক দিন। এ’দিন ‘Religion’ কলামে ‘মানবতাবাদী’ লেখার আইনি অধিকার এনে দিল অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৯৪-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফর্ম’ থেকে ‘Religion’ কলাম বিদায় নিল।

১৯৯৯-এর ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হল একটি বই, ‘কাশ্মীর সমস্যা : একটি ঐতিহাসিক দলিল’। প্রকাশক হিউম্যানিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন। দলিলটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রে, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তা প্রকাশিত এরপর কাশ্মীর প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের মতবাদ-ই গেল পাল্টে।

দেহ ব্যবসাকে আইনি করার একটা চক্রান্ত চলছিল গত কয়েক বছর ধরে। ২০০০ সালের আগস্টে বিলটা সংসদে ওঠার কথা ছিল। প্রচারের বদলে পাল্টা প্রচারে নামতে হয়েছিল। টিভি-তে বেশ কিছু এপিসোডে হিউম্যানিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন এই চক্রান্তের স্বরূপ বে-আব্রু করেছে। সঙ্গে পেয়েছে বহু লেখক-সাংবাদিক- সমাজবিজ্ঞানীসহ অনেক বিশিষ্টদের এবং বিভিন্ন রাজনীতিকদের। ফলে শেষ পর্যন্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে।

এমনই প্রায় অসম্ভব জয়ের তালিকা বড়-ই দীর্ঘ।

error: Content is protected !!