অর্ণব দত্ত
বিশ্বব্যাপী সমকামীরা* একপ্রকার ঘৃণা ও বঞ্চনার শিকার হন। তার প্রধান কারণ সমকাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানের মতে সমকামিতা কখনই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ নয় । সে প্রেমে প্রেম থাকে না, বা সমকামী মাত্রই শরীর সর্বস্ব ব্যভিচারী। বর্তমান প্রবন্ধে আমি তাই বিজ্ঞান ও যুক্তির সাহায্যে সমকামিতাকে বুঝবার চেষ্টা করেছি।
সমকামিতা কি? বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপেডিয়ায় সমকামিতা বা Homosexuality-এর সংজ্ঞায় লিখেছে,
“Since its coining, the term homosexuality has acquired multiple meanings. In the original sense, it refers to a sexual orientation characterized by aesthetic attarction, romantic love, and sexual desire exclusively for members of the same sex or gender identity. It can also refer to the manifestation of that orientation in the identity of an individual, which may or may not be at odds with that person’s sexual behavior. Finally, it can refer to sexual relations with another of the same sex regardless of one’s sexual orientation, self-identification or gender identity.”
দেখা যাচ্ছে সমকামিতা শুধু যৌন প্রবৃত্তি (sexual urge) দিয়ে নির্ধারিত হয় না। তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে প্রেম ও সৌন্দর্যবোধও। শেক্সপিয়রের সনেটগুচ্ছ বা মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডের মর্মরমূর্তি তার বাস্তব প্রমাণ ।
সমকামিতা প্রসঙ্গে সকল কুসংস্কারের মূলে যেসব ভ্রান্ত ধারণাগুলি সর্বাপেক্ষা কার্যকর তার মধ্যে একটি হল, সমকামিতাকে যৌন প্রবৃত্তি হিসাবে একটি পছন্দ বা choice মনে করা । Time পত্রিকার বিগত একটি সংখ্যায় প্রকাশিত মাইকেল ডি. লেমনিকের লেখা একটি প্রতিবেদন এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত ৷ লেমনিক লিখেছেন,
Sure enough, when the Swedish scientists ran the experiment this time, the results were striking: when gay men were exposed to male pheromones, their hypothalamus lit up just like a woman’s. Female hormones did nothing for them. “What the studay does not show, however – despite what some scientists claimed is that sexual preference is biologically hardwired and thus present from birth. That idea is pretty much accepted by most gays and many biologists as well. But it is refuted by those – generally on the religious right – who have a stake in believing that homosexuality is a personal choice rather than an inborn trait.” Time, ( Asian Edition) 23 May, 2005. p.42
ধর্ম ও সমপ্রেমের সংঘাতের জায়গাটা কোথায়? আসুন এবার তা আলোচনা করা যাক ৷
পৃথিবীর প্রাচীনতম সংগঠিত ও বর্তমান ধর্ম হিন্দুধর্মে সমপ্রেম সম্পর্কে আশ্চর্য নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে । বলা যেতে পারে হিন্দুশাস্ত্র এই বিতর্ক সুনিপুণভাবে এড়িয়ে গেছে। সে কারণে বর্তমানকালে সমপ্রেম বিষয়ে হিন্দুধর্মের অবস্থান নিয়ে এক বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে প্রেম ও কাম নিছক শরীর রঞ্জনের উপায় না থেকে এক সনাতন শক্তির স্তরে উন্নীত হয়েছে। নরনারীর যে মিলন সন্তান উৎপাদনে সক্ষম তাকে জীবনের ধারা রক্ষার একটি মুখ্য উপায় বলে বর্ণনা করে তাকে এক পবিত্র কর্তব্যের পর্যায়ে পর্যবাসিত করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মসূত্রে বিবাহকে প্রজা (বংশরক্ষা), ধর্ম (কর্তব্যপালন) ও রতি (প্রিয় সাহচার্য) এই তিন উদ্দেশ্যের বিধেয় বলে বিধৃত হলেও হিন্দুদের প্রধান শাস্ত্রগুলি সরাসরি সমকামকে ঈশ্বর বিরোধীতা বলে গণ্য করেনি বা তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দেয়নি । শোনা যায় বাৎস্যায়নের কামসূত্রেও সমকামিতা বিষয়ের একটি গোটা অধ্যায় নির্দিষ্ট করা ছিল। সেটিও রহস্যজনকভাবে অবলুপ্ত হয়। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের মিথুন মূর্তিগুলি পরিদর্শন করলে বেশ কিছু সমপ্রেম বিষয়ক মুর্তিও দেখা যাবে ।
সমপ্রেম ও খ্রিষ্টধর্মের বিরোধ সর্বজনবিদিত। পৃথিবীতে সমপ্রেম সর্বাপেক্ষা বেশি নিন্দিত হয়েছে এই ধর্মেই অথচ প্রাচীন প্যাগানদের (যথা গ্রীক ও রোমান) বাদ দিলে সমপ্রেমের সর্বাধিক অনুশীলন এই মতাবলম্বীদের মধ্যেই দেখা যায় । মারলো, শেক্সপীয়র, বায়রণ, অস্কার ওয়াইন্ড, মাইকেল এঞ্জেলো, দ্য ভিঞ্চি থেকে হালের উইলফ্রেড ওয়েন, এলটন জন, জর্জ মাইকেল প্রমুখ বেশিরভাগ সমকামী সেলেব্রিটিই ছিলেন খ্রিষ্টান। ইহুদি ধর্মে সমপ্রেমের অবাধ প্রচলন ছিল। আদি বাইবেলে তার অনেক সূত্র রয়েছে। মনে করা যেতে পারে প্যাগান ও ইহুদিদের থেকে স্বতন্ত্র বজায় রাখার জন্য খ্রিষ্টীয় শাস্ত্রকারগণ এই সমপ্রেম বিরোধিতা আমদানি করেন ।
ইসলামের বিভিন্ন চিন্তাধারায় (school) সমকাম সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করা হয়েছে। কোথাও বিধেয় হয়েছে সামান্য দণ্ড, তো কোথাও প্রস্তরাঘাতে হত্যারও বিধান দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে সমপ্রেমকে ধর্মগ্রন্থ আকারে ইঙ্গিতে ঈশ্বরের আইনবিরোধী বলেছেন, তা কতটা প্রকৃতির নিয়ম বিরোধী।
মনুষ্যেতর জীবের মধ্যে ৪৫০টিরও বেশি প্রজাতি সমকাম অনুশীলন করে। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সেখানকার সেন্ট্রাল পার্ক পশুশালায় একজোড়া পুরুষ পেঙ্গুইন নিজেদের সঙ্গী নির্বাচন করেছে। নিউইয়র্ক শহরে অনেক পেঙ্গুইনই এরূপ সমকামী নির্বাচন করেছে বলে খবরে প্রকাশ। হয়ত অনেকেই জানেন না বৈজ্ঞানিকরা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে দেখেছে’, পেঙ্গুইন, গিরগিটি, ভেড়া, চিত্রিত হায়না (spotted hyena) বা বোতলনাক ডলফিনের মত প্রাণীও সমকামিতায় অভ্যস্ত। জাপান, জার্মানি পশুশালাগুলিতে পেঙ্গুইনদের সমসঙ্গী নির্বাচন করে নিতেও দেখা গেছে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে মানবসমাজে সমকামিতা কোনো জৈব অস্বাভাবিকতা নয়, তা প্রাকৃতিক একটি প্রথামাত্র। তাই নিছক ধর্মীয় কুসংস্কারের বশে সমপ্রেমকে নিষিদ্ধ করে রাখা অযৌক্তিক
সমকামিতা সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগের জবাব না দেওয়াটা অন্যায়। অনেকে মনে করেন সমকামিতা একপ্রকার শরীরসর্বস্বতা। এ অভিযোগ অযৌক্তিক বলে মনে হয়, আধুনিক ভোগবাদী সমাজে সমকাম অসমকাম সবচাইতেই একই প্রকার শরীরসর্ব্বস্বতা দেখা যায় না কি? এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হন। সে কি শরীরসর্বস্বতার চরম উদাহরণ নয়? নিষিদ্ধ বস্তুকে পাবার আগ্রহ ও নিষিদ্ধ সমাজের গণ্ডী সমকামীকে বিকারের পথে পরিচালিত করছে।
সমকামকে সমপ্রেম বলতে আমার কোন বাধা নেই। কারণ আমি সমপ্রেমীদের ভালোবাসার যথেষ্ট উদাহরণ প্রত্যক্ষ করেছি। কলকাতার খ্যাতনামা মনস্তত্ববিদ ড. নীলাঞ্জনা সান্যাল কথা প্রসঙ্গে একবার আমায় বলেছিলেন, সচিনকে দিয়ে জোর করে বাঁ হাতে ক্রিকেট খেলালে আমরা সচিনকে পেতাম না। কারণ তার প্রতিভার বিকাশের পথটিও এর দ্বারা বন্ধ হয়ে যেত। তেমনই যে সমকামী তাকে জোর করে অসমকামীতে পরিণত করা বোকামি। কারণ, সেই বিজ্ঞান। সমকাম মধুমেহ রোগ নয় যে মিষ্টি নিষিদ্ধ করে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব। এ হল মানব চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা খুব কম মানুষই পান । ভাবুন তো কি হত যদি শেক্সপীয়র তার অপূর্ব সনেটগুচ্ছ রচনায় হাত না দিতেন, যদি মাইকেল এঞ্জেলো ও দ্য ভিঞ্চি তাদের অপূর্ব পুরুষমূর্তিগুলি না বানাতেন । মানব সংস্কৃতিকে সমপ্রেমিক মন যে অপূর্ব সম্পদ দান করেছে, তা কোন অংশে ন্যূন বা হীন নয় ৷ একথা বুঝতে পেরিয়ে গেল দুটি সহস্রাব্দ।
তবে সুখের বিষয়, পৃথিবীব্যাপী সমকামীদের বিশাল আন্দোলনের চাপে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় ধীরে ও বিলম্বিত লয়ে হলেও— হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রগতিশীল দেশে সমকামিতা আইনসিদ্ধ। বহুদেশ সে পথেই হাঁটছে। কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে এ সম্পর্কে একটি পজিটিভ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তিলোত্তমা মজুমদার ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ উপন্যাসে নারী সমকামিতার সমস্যাগুলি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। ভারতে দিল্লি, মুম্বাই বা চেন্নাই শহরে আজ সমকামীরা যে রকম সংঘবদ্ধ, কলকাতায় তা হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে সম্ভব হয়নি । তবে সাধারণ মানুষের এ সম্পর্কে ধারণা পাল্টাচ্ছে । প্রতি বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত সমকামী মানুষদের বিশাল পদযাত্রা ও তাদের প্রতি মিডিয়ার সংস্কারশূন্য মনোবৃত্তি অনেক আশা সঞ্চার করেছে । সর্বোপরি ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট মাস কয়েক আগে ভারতীয় সংসদকে এক নির্দেশ দিয়ে সমকাম আইনসিদ্ধ করার পরামর্শ দেয়।
বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে সমকামিতা নিয়ে সচেতনতা কিঞ্চিৎ কম । সমকাম সম্পর্কে অযথা ভীতি ও অবৈজ্ঞানিক মধ্যযুগীয় ধারণা নির্মূল করার কাজে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের মত কুসংস্কারও মানবতার এক প্রধান শত্রু । কবিগুরুর ভাষায়ঃ
যে জাতি জীবনধারা অচল অসার
পদে পদে বাধে তারে জীর্ণ লোকাচার ।
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ