সমকামিতার সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমকামিতা কোথাও থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি, বরং সমকামিতার ব্যাপারটি সব সভ্যতায় সব সময়ই ছিল। সমকামীদের সন্ধান মিলবে পৃথিবীর সর্বত্র। সমকামিতা ছিল গ্রীক এবং রোমান সাম্রাজ্যে, সমকামিতা ছিল সাইবেরিয়ান সামানদের (Shaman) মধ্যে, সমকামিতা ছিল নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে, সমকামিতা ছিল আফ্রিকান ট্রাইবে, সমকামিতা ছিল চৈনিক রাজবংশে, সমকামিতা ছিল আরব কিংবা ভারতীয় সভ্যতায়। এমন কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, যেখানে সমকামিতা নেই, কিংবা ছিল না। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, দর্শন, পুরাণ কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেই গবেষকেরা জেনেছেন, সমকামী মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষেরা ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি স্থানেই ছিলেন। নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে, পৃথিবী বিখ্যাত বহুজনই সমকামী, নিভৃত সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী কিংবা সমান্তরাল যৌনতাসম্পন্ন প্রবৃত্তির মানুষ ছিলেন। সেই তালিকায় স্যাপো, সক্রেটিস, প্লেটো থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, আবু নুয়াস, সুলতান মাহমুদ, হাফিজ, বত্তিচেলি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলএঞ্জেলো, ফ্রান্সিস বেকন, উইলিয়াম সেক্সপিয়র, আইজাক নিউটন, ম্যারি উওলস্টোনক্রাফট, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, লর্ড বাইরন, হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসন, নিকোলাই গোগোল, আব্রাহাম লিঙ্কন, সুসান বি এন্থনি, কার্ল উলরিচস, জন এডিংটন সিমন্ডস, অস্কার ওয়াইল্ড, মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক, ভার্জিনিয়া উলফ, মার্গারেট মীড, সালভাদর দালি, জোয়ান ক্র্যাফোর্ড, হাওয়ার্ড হিউজেস, জন ড্যারো, অ্যালেন টুরিং, লিটল রিচার্ড, ম্যাডোনা, বয় জর্জ, অ্যান্ড্রু সুলিভান, এন্ডারসন কুপার, রেচেল ম্যাডো, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, এঞ্জেলিনা জোলিসহ অনেকেই আছেন। কাজেই সমকামিতা পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট দেশ, কাল, জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, আজও নেই। সমকামিতার অস্তিত্ব সব সবসমইয়ই ছিল, প্রতিটি সভ্যতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারপরও সমকামিতার ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠভাবে লিখতে হলে কোনো কোনো সভ্যতার কথা একটু বেশি গুরুত্ব পাবে। সমকামিতার ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে এ সব প্রাচীন সভ্যতার কথা বিস্তৃতভাবে জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই চলে আসবে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার কথা। তারপর তাকাতে হবে পরবর্তী রোমান সভ্যতার দিকেও। সমকামিতার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই সভ্যতা দুটি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীসো- রোমান সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে পাওয়া যায় যে, সে সময় সমকামিতাকে একটি স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তি হিসবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। সামাজিক কিছু প্রচলিত নিয়ম নীতি ভঙ্গ না করলে সমকামিতাকে গ্রীসে নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই দেখা হতো, এবং সবার কাছেই এটির উল্লেখযোগ্য বৈধতা ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মের উত্থানের আগ পর্যন্ত সমকামিতাকে সামাজিকভাবে হেয় করার প্রচেষ্টাও শুরু হয়নি। এই অধ্যায়ে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতা পর্যন্ত সমকামিতার ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে।
গ্রীক সভ্যতায় সমকামিতা
প্রাচীন গ্রীসে সমকামিতাকে চিহ্নিত করার জন্য আলাদা কোনো শব্দ ছিল না। তবে কাছাকাছি একটি শব্দ গ্রীক সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল – Paiderastia আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ করলে এর মানে দাঁড়াবে ‘কিশোর প্রেম’ (boy love)। গ্রীসে বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কৈশোরোত্তীর্ণ (চোদ্দ থেকে বিশ বছর বয়স্ক) যুবকের প্রেম করার রীতি ছিল। বয়স্ক ব্যক্তিটিকে বলা হতো এরাস্তেস (erastes) বা প্রেমিক, এবং যুবকটিকে বলা হতো এরোমেনোস (eromenos) বা প্রেমাস্পদ।
গ্রীসের সম্পর্কগুলো লিঙ্গভেদের উপর মোটেই নির্ভরশীল ছিল না। আসলে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে কে নারী কিংবা কে পুরুষ – এ নিয়ে গ্রীসের লোকজন মোটেও চিন্তা করতো না। সম্পর্ক তৈরি হতো পারষ্পরিক আগ্রহ এবং আকর্ষনের ভিত্তিতে।
Keith Stern, Queers in History: The Comprehensive Encyclopedia of Historical Gays,
Lesbians and Bisexuals, Ben Bella Books, 2009.
Byrne Fone, Homophobia: A History, Picador, November 3, 2001
Francis Mark Mondimore, A Natural History of Homosexuality, The Johns Hopkins University Press; 1 edition.
শব্দটিকে আধুনিক ‘পেডোফেলিয়া’ বা নাবালকদের প্রতি যৌন-আকর্ষনের সাথে মিলিয়ে না ফেলাই বাঞ্ছনীয় হবে। এপ্রসঙ্গে বার্ন ফোন তার ‘হোমোফোবিয়া’ গ্রন্থে বলেন – Paiderastia, which should not be confused with pedophilia, did not involve sexual use of children, a practice that antiquity viewed with as much horror as we do today. When men pursued younger males, those they perused were theoretically ready for the chase – that is they had reached puberty.’
To be noted that marriages in Ancient Greece between men and women were also age structured, with men in their 30s commonly taking wives in their early teens. 179 Louis Crompton, Homosexuality and Civilization, Belknap Press, 2003.
নারী-পুরুষ ছাড়াও অন্যান্য সব প্রেমের সম্পর্ককেই ‘স্বর্গীয়’ হিসেবে দেখা হতো৷ এবং প্রেমের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের জোর-জবরদস্তিকে হেয় করা হতো। এ প্রসঙ্গে গবেষক ফ্রান্সিস মার্ক মন্ডিমোর তার ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব হোমোসেক্সুয়ালিটি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন –
‘প্রাচীন গ্রীসে প্রেমময় সম্পর্ককে উদযাপন শুধু নয়, ক্ষেত্রবিশেষে মহিমান্বিত করা হতো। এই ধরনের সম্পর্ককে দেখা হতো সামাজিক বিন্যাসের গভীরতম প্রক্রিয়া হিসেবে। গ্রীক সমাজে যৌনতা এবং প্রজননকে (সন্তানোৎপাদন) এক করে দেখা হতো না। যৌনতা ছিল সমাজের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, আর প্রজননের মাধ্যমে উত্তরাধিকার তৈরি করা হতো বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু বিয়ে ছিল বলেই যৌনতার অন্যান্য অভিলাষ বা অপরাপর যৌনতা-কেন্দ্রিক আনন্দ থেকে কেউ, অন্তত পুরুষেরা নিজেদের বিচ্যুত করতো না। গ্রীক সমাজে যৌনতার সামাজিক স্বীকৃতি জেন্ডার দ্বারা নির্ধারিত হতো না, বরং নির্ধারিত হতো সামাজিক ক্ষমতার ভারসাম্যের নিরিখে।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রাচীন গ্রীসে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারটা লিঙ্গভেদের চেয়ে সামাজিক পরিচয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল বেশি। সেখানে ‘আদর্শ সম্পর্ক’ গণ্য করা একজন বয়স্ক পুরুষ এবং কৈশোর উত্তীর্ণ যুবকের মধ্যে। সম্পর্টির মধ্যে বয়স্ক পুরুষটি সক্রিয় (active) এবং যুবকটি অক্রিয় (passive) ভূমিকা পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে ডেভিড হাল্পারইন বলেন-
‘প্রাচীন গ্রীসে যৌনসামগ্রী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে উপস্থিত হতো; নারী কিংবা পুরুষ নয়, বিভক্তিটি ছিল সক্রিয় না অক্রিয় তার উপর ভিত্তি করে”।
এরাস্তেস বা প্রেমিক পুরুষটি সম্পর্কটির মাঝে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। তিনি অনেকটা পথপ্রদর্শক বা দীক্ষাগুরুর আসন নিতেন। তিনি ছিলেন সাহস এবং জ্ঞানের সঞ্চালক। অপরদিকে এরোমেনোস ছিলেন সৌন্দর্য, তারুন্য, শৌর্য এবং বীর্যের প্রতিভূ। তিনি শুধু সম্পর্কে উচ্ছ্বাস এবং উদ্যমেরই যোগান দিতেন না, সেই সাথে সেবা সুশ্রুষা প্রভৃতির দায়িত্ব নিতেন। এরাস্তেস ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত থাকতে পারতেন, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও তার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠতো এরোমেনোসকে ঘিরে। এরোমেনোস হয়ে উঠতেন এরাস্তেসের প্রেমাস্পদ। গবেষক ডেভিড হাল্পারাইন তার ‘One Hundred Years of Homosexuality’ গ্রন্থে বলেন, ‘কৈশোর এবং যৌবনের মাঝামাঝি উত্তাল করা সময়টাই ছিল এরোমেনোস হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত কাল অনেকেটা আজকের দিনের কলেজ পাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিচ্ছু ছাত্রের বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের মত’। এরোমেন্তোসের সেই উচ্ছ্বাসময় রক্তিম সময়টা পেরিয়ে গেলে পাইদাস্তেরিয়া সম্পর্কের সমাপ্তি ঘনিয়ে আসতো। এরোমেনোস তখন ইচ্ছে করলে বিয়ে করতে পারতেন, আর পরে বয়স্ক সঙ্গী বা এরাস্তেস হিসেবে নতুন কোনো তরুণের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন।
যেমন, প্লেটো তার বিখ্যাত Symposium গ্রন্থে ‘common love’ এর বদলে ‘heavenly love’ ব্যবহার করেছিলেন
পূর্বোক্ত।
David Halperin, One Hundred Years of Homosexuality: And Other Essays on Greek Love, Routledge, 1989
গ্রীসের এই পাইদেস্তারিয়ার সম্পর্কের আলামত পাওয়া যায় সে সময়কার অসংখ্য চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য এবং মৃৎশিল্পে। ‘গ্রীক সমকামিতা নামের বইয়ে কে. জে.ডোভার বিশ পৃষ্ঠা ধরে বর্ণনা করেছেন পটে আঁকা চিত্রকর্ম আর মৃৎশিল্পে সমকামিতার নানা কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যের। তবে পটে আঁকা শিল্পকর্মের সাথে তৎকালীন গ্রীক সমাজের বাস্তবতার মিল সত্যই ছিল কিনা এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, সমকামিতার বৈধতা সমাজে ছিল প্রবলভাবেই। শুধু পটুয়াদের শিল্পকর্মে নয়, গ্রীক সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রতিটি শাখাতেই সমকামিতার ব্যাপক উল্লেখ ছিল। সমকামিতার উল্লেখ আছে ‘গ্রীক অ্যান্থোলজী’তে এবং গ্রীক থিয়েটারগুলোতে। ইউরিপিডিসের স্যাটায়ার নাটিকা ‘সাইক্লোপস’-এ বর্ণিত সাইক্লোপস চরিত্রটি খুব পরিষ্কারভাবেই বলে – ‘আমার কাছে মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি পছন্দের’।
সমকামিতার বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হোমারের রচিত ইলিয়াডে। বিখ্যাত যোদ্ধা আকিলিস এবং পেট্রোক্লসের মধ্যকার বন্ধুত্বকে বহু গবেষকই ‘পাইদেরাস্তিক’ বলে অভিমত দিয়েছেন। আকিলিস আর পেট্রোক্লস ছিলেন সম্পর্কে কাজিন, কিন্তু এদের মধ্যকার আবেগময় সম্পর্ক সম্বন্ধে হোমার সরাসরি কিছু না লিখলেও তার লেখা থেকে ইঙ্গিত অনুধাবন করা মোটেই কষ্টকর নয়। পরবর্তীতে Aeschines 90-এর লেখা থেকে এর প্রমাণ মেলে –
“[হোমার] বহু জায়গায় পেট্রোক্লস এবং আকিলিসের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেও তিনি সম্ভবতঃ ইচ্ছে করেই তাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গ অনুরাগ গোপন করেছেন। সম্পর্কটিকে তিনি স্রেফ ‘বন্ধুত্ব’ হিসবেই চিত্রিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন; ভেবেছেন যে, সম্পর্কের ব্যপ্তি কেবল অভিজ্ঞ চোখেই ধরা পড়বে।”
যত অপ্রত্যক্ষভাবেই লেখা হোক না কেন, সমকামিতার উল্লেখ করা এটিই পৃথিবীর সম্ভবতঃ প্রথম সাহিত্যকর্ম। কিন্তু এই সমকামিতাকে গ্রীসের চিরায়ত এরাস্তেস এরোমেন্তোসের ছাঁচে ফেলতে গেলে আমাদের একটু সমস্যাই হবে। তবে সমস্যাটা আমাদের বলা হলেও, সমস্যার মূল হোতা হোমার নিজেই। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, আকিলিস-পেট্রোক্লসের সম্পর্কটিতে আকিলিসেরই প্রভাব ছিল বেশি। সম্পর্কটির মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। আকিলিসের যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি তো ছিলই, সেই সাথে তিনি ছিলেন খ্যাতিমান মল্লবিদ। আকিলিস যখন বাইরে যুদ্ধ এবং ক্রীড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তখন গৃহস্থালির আনুষঙ্গিক কাজগুলো সেরে ফেলতেন পেট্রোক্লুস। তাদের এই পারষ্পরিক শ্রমবিভাজন দেখে মনে হতে পারে ‘সংসারের কর্তা’ আকিলিসই ছিলেন এরাস্তেস আর ‘সুগৃহিনী’ পেট্রোক্লস ছিলেন এরোমেনোস। কিন্তু গোল বাঁধিয়ে দিল হোমারীয় সাহিত্য-রহস্য। হোমার তার লেখায় পেট্রোক্লসকেই বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছেন, আর আকিলিসকে দেখিয়েছেন পেটুকুসের তরুন সাথী হিসেবে (এবং রক্তের সম্পর্ক হিসেবে মামাতো ভাই)। আমরা আগেই জেনেছি যে, গ্রীক সংস্কৃতিতে বয়স্ক ব্যক্তিই হতেন এরাস্তেস এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ সাথীটি হতেন এরোমেনোস, অনেকটা নীচের ছবির মতো। বয়স এবং সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করলে পেট্রোক্লসেরই এরাস্তেস হবার কথা।
J. Dover, Greek Homosexuality, MJF Books, May 1997
John Boswell, Same – Sex Unions in Premodern Europe, Vintage (May 30, 1995 ) Byrne Fone, Homophobia, পূর্বোক্ত।
The Greek Anthology (also called Anthologia Graeca or, sometimes, the Palatine Anthology) is a collection of poems, mostly epigrams, that span the classical and Byzantine periods of Greek literature.
Euripides (480 BCE–406 BCE) was the last of the three great tragedians of classical Athens (the other two being Aeschylus and Sophocles).
I prefer boys to girls” – Euripides, The Cyclopes, quoted in David F. Greenberg, The construction of Homosexuality, Chicago: University of Chicago press, 1948
Louis Crompton, Homosexuality and Civilization, পূর্বোক্ত।
Aeschines (389–314 BC) was a Greek statesman and one of the ten Attic orators.
আকিলিস এবং পেট্রোক্লসকে ঘিরে এরাস্তেস – এরোমেনোস কেন্দ্রিক যত রহস্যই আমরা আজকে তৈরি করি না কেন, হোমার নিজে তেমন কিছু পরিষ্কার করে লেখেননি বলেই মনে হয়। তবে হোমার সরাসরি কিছু না লিখলেও আকিলিস এবং পেট্রোক্লসের মধ্যকার সম্পর্কের মানসিক আবেগ কারো কাছে অব্যক্ত থাকেনি। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল গভীর, সজীব এবং আবেগঘন। তারুন্যের উদ্দামতা এবং মজ্জাগত উদ্ধত স্বভাব আকিলিসের মধ্যে প্রবলভাবেই প্রকটিত থাকলেও পেট্রোক্লসের প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের নম্র এবং বিনীত। পেট্রোক্লস আকিলসের বর্ম পরিহিত অবস্থায় একটি যুদ্ধে নিহত হলে, আকিলিস অত্যন্ত বিমর্ষ এবং সেই সাথে ক্রুদ্ধ হন আর পেট্রোক্লসের হত্যাকারী হেক্টরকে খুঁজে বের করে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হত্যা করেন। এই ট্রয়ের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে হলিউডে উলফগ্যাং পিটারসনের পরিচালনায় একটি ছবি নির্মিত হয়েছে ‘ট্রয়’ নামে। ছবিটিতে আকিলিসের চরিত্রে অভিনয় করেন ব্র্যাড পিট, পেট্রোক্লসের চরিত্রে গ্যারেট হেডলান্ড এবং হেক্টরের ভূমিকায় ছিলেন এরিক বানা। যদিও পেট্রোক্লসকে ছবিতে কেবল আকিলিসের ‘কাজিন” হিসেবেই চিত্রিত করা হয়, তাকে দেখানো হয় আকিলিসের চেয়ে বয়সে ছোট হিসেবে, এবং তাদের মধ্যকার সমপ্রেম উহ্য রাখা হয় পুরোপুরি। আকিলিস এবং পেট্রোক্লসের সম্পর্ক ছাড়াও প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে উল্লিখিত আছে অন্যান্য সমপ্রেমী দম্পতির কথা – হার্মোডিয়াস এবং এরিস্টোগিটন, অরেস্টেস এবং পাইলেডস কিংবা ডেমন এবং পাইথিয়াস – যারা সমপ্রেমী সাথীর জন্য জীবন দিতেও কার্পণ্য করতেন না।
সমকামিতার বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় প্লেটোর দার্শনিক গ্রন্থ সিম্পোজিয়ামে (Symposium)। আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লেখা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের বিচিত্র অভিব্যক্তি। মানুষে মানুষে প্রেমময় সম্পর্কের বিবিধ প্রকাশ ঘটেছে ফায়াডেরাস (Phaedrus), পসানিয়াস (Pausanias), এগাথন (Agathon), অ্যারিস্টোফেনেস (Aristophanes), এরিক্সিমা- চুসের (Eryximachus) নানা বক্তব্যে। সৃষ্টি রহস্য নিয়ে অ্যারিস্টোফেনেসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মানুষের প্রকৃতি প্রথম থেকেই ছিল তিন ধরনের – নারী পুরুষ এবং তৃতীয় প্রকৃতি বা এন্ড্রোজাইনোস’। এই তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা সমকামিতায় আসক্ত হয় বলে অ্যারিস্টোফেনেস মনে করেছেন। তার বর্ণিত উপকথা অনুযায়ী, সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই নারী, পুরুষ এবং তৃতীয় প্রকৃতি নামক সত্ত্বার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেই সত্ত্বাগুলো আমাদের মতো দেখতে ছিল না। এদের সকলেরই ছিল চারটা করে হাত, চারটা পা এবং দুই সেট করে যৌনাঙ্গ। এই অদ্ভুতুরে অসুরকূল স্বর্গের দেব-দেবীদের আক্রমণ করা শুরু করে দিলে দেবতা জিউস তাদের ক্ষমতাকে দুর্বল করার লক্ষ্যে অনেকটা ‘সিদ্ধ ডিমকে একটি সরু চুল দিয়ে যেমন বিভক্ত করে দেয়া যায়’ ঠিক তেমনি ভাবে ফালি করে তাদের দুই ভাগে বিভক্ত করে দেন। যে ভাগে শুধুই পুরুষের আদি উপাদান ছিল, তারা পরিণত হলেন পরিপূর্ণ পুরুষে, তারা যুবক বয়সে প্রেমাসক্ত হতেন কেবলই মেয়েদের প্রতি। আর যে ভাগে ছিল কেবলই স্ত্রী উপাদান – তারা পরবর্তীতে হলেন নারী। এরা পরিণত বয়সে পুরুষের প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। আর তৃতীয় সত্ত্বার মধ্যে থাকে নারী-পুরুষের মিশ্রণ। ফলে তাদের কেউ সমধর্মী, কেউবা বিপরীতধর্মী লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হন আদি উপাদানগুলোর ভিন্নতার রকমফেরে। এই তৃতীয় প্রকৃতিদের নিয়ে এরিস্টোফেন বলেন–
“তারা যখন পরিণত পুরুষ হয়ে উঠে, তারা অন্য যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয় । অনেক সময় তাদের বিবাহ এবং সন্তানোৎপাদনের কাজে জড়িত করার জন্য জোর করতে হয়। তারা প্রকৃতিগতভাবেই নিজধর্মী মানুষের প্রতি আজীবন আকর্ষণ বোধ করে থাকে”।
সিম্পোজিয়ামে আমরা গ্রীসের বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসেরও উল্লেখ পাই। এক ভোজন সভায় আলকিবিয়াডস নামের এক সুদর্শন তরুণ মদ্যপান করে কীভাবে সক্রেটিসের প্রতি প্রেম নিবেদন করেছিল তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। আলকিবিয়াডসের সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল চারিদিকে, আর অন্যদিকে সক্রেটিসের চেহারায় আর যাই থাকুক সৌন্দর্য বলে কিছু ছিল না, কিন্তু সক্রেটিস পরিচিত ছিলেন তার অতুলনীয় জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার জন্য ঢের বেশি। আলকিবিয়াডস ভোজন শেষে তাকে নিরালায় নিয়ে যেতে চাইলে সক্রেটিস তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। একসময় সক্রেটিস ঘুমিয়ে পড়লে আলকিবিয়াডস তাকে জাগিয়ে বলেন, ‘আমার জীবনে যত প্রেমিক এসেছিল, তার মধ্যে তুমিই একমাত্র পূর্ণগুণ সম্পন্ন’। যদিও সক্রেটিসের কিশোর প্রেমের প্রতি আকর্ষণ এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা দুইই ছিল, কিন্তু তিনি আলকিবিয়াডসের প্রস্তাবে কোনো সাড়া দেননি। সক্রেটিসের এই ‘সংযম’ সভাসদদের মাঝে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আলকিবিয়াডস পরবর্তীতে এক দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদে পরিণত হন এবং তাকে প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে শহর থেকে বের করে দেয়া হয়। বহু গবেষক মনে করেন, সেই রাতে আলকিবিয়াডস যদি সক্রেটিসের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হতেন, তার ভালোবাসা এবং প্রজ্ঞা হয়ত দুর্বিনীত আলকিবিয়াডসের ব্যক্তিগত ইতিহাসের চাকাকে অন্যদিকে ঘোরাতে পারতো।
গ্রীক সংস্কৃতিতে জিমনেশিয়াম বা শরীরচর্চাকেন্দ্র ছিল সমকামীদের সমাকামিতা পরিস্ফুটনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। গ্রীক ভাষায় জিমনেশিয়াম এসেছে গ্রীক শব্দ জিমনোস থেকে – যার আভিধানিক অর্থ হলো – নগ্নতা। এমনিতেই নগ্নতার একটি গ্রহণযোগ্যতা সব সময়ই গ্রীক সমাজে ছিল। নগ্ন গ্রীক বীরদের মল্লযুদ্ধের চিত্রায়ণ বহু মৃৎপাত্রে ক্ষুদিত আমরা আজও দেখতে পাই। আর জিমনেশিয়ামগুলো ছিল সে সমস্ত মল্লবিদদের প্রিয় আস্তানা – তারা নগ্ন হয়ে এ সমস্ত জিমনেশিয়ামে শরীরচর্চা করতেন। তবে এই জিমনেশিয়ামে সে সময় কেবল শারীরিক কসরৎই প্রদর্শিত হতো না, সেই সাথে এটি হয়ে উঠেছিল মানুষে মানুষে সামাজিক আলোচনা এবং দর্শনেরও তীর্থস্থান। বহু বাঞ্ছিত প্রেমিক জিমনেশিয়ামে যেত সেখান থেকে তার বাঞ্ছিতাকে খুঁজে নিতে।
গ্রীক সংস্কৃতিতে যদিও কিশোর এবং নারীদের দেখা হতো যৌনতা উভভোগের প্রতীক হিসেবে, কিন্তু তারপরেও ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বহু ব্যক্তি কেবল পুরুষের প্রতি প্রণয়াসক্ত থেকেছেন। তাদের কাছে ‘যৌনতা উপভোগ’ এবং ‘যৌনতার দায়িত্ব’ ছিল আলাদা। ‘যৌনতার দায়িত্ব’ পালন করতে তারা হয়ত একসময় বিয়ে করতেন, কিন্তু যৌনতা উপভোগের জন্য তারা অনেকসময়ই দারস্থ হতেন তার পছন্দের পুরুষ সঙ্গীর কাছে। গ্রীক ইতিহাস থেকে দেখা যায় বিয়ন এবং জেনোর মতো দার্শনিক কিংবা আলেকজান্ডার দি গ্রেটের মতো সম্রাট সমপ্রেমে আসক্ত ছিলেন। আকিলিসের যেমন ছিল পেট্রোক্লস, ঠিক তেমনি আলেকজান্ডারের প্রেমাস্পদ ছিলেন তার প্রিয় যোদ্ধা হেফায়েশন (Hephaestion)। গ্রীক সভ্যতায় খুঁজলে পাওয়া যাবে বহু সমপ্রেমিক দম্পতির অস্তিত্বও। এর মধ্যে সাহিত্যিক ইউরিপিডেস এবং ট্র্যাজিক কবি এগাথনের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যায়।
Greek word Androgynous consists of two words – avýp (anér, meaning man) and yový (gyné, meaning woman), thus refers to the concepts about the third gender that has a mixing of masculine and feminine characteristics.
Plato, The Symposium, Christopher Gill trans, Penguin Classics, 2003.
Simon Goldhill, Love, Sex & Tragedy: How the Ancient World Shapes Our Lives, University Of Chicago Press 2005
Louis Crompton, Homosexuality and Civilization, পূর্বোক্ত।
David F. Greenberg, The Construction of Homosexuality, University of Chicago Press, 1990
স্যাপোর কথা
গ্রীক সভ্যতার সমকামিতার উল্লেখ করলে স্যাপোর কথা আমাদের আলাদা ভাবে উল্লেখ করতেই হবে। কারণ গ্রীক সভ্যতার পাইদেরাস্তিয়া আর এরাস্তেস-এরোমেনোস সহ যে সমকামিতার উদাহরণগুলো আমরা এই অধ্যায়ে দেখেছি তা সবই পুরুষ সমকামিতা নির্ভর। স্যাপো ছিলেন এই ছাঁচের একেবারেই বাইরে। তিনি খ্রীস্টপূর্ব ছয় শতকের গ্রীসের লেসবো দ্বীপের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা, আর পেশায় ছিলেন শিক্ষিকা । তার কবিতা প্লেটোর মতো দার্শনিককে অনুপ্রাণিত করেছিল, প্লেটো তাকে অভিহিত করেছিলেন ‘দশম মুসেস’ হিসেবে। তবে সেপো সম্বন্ধে ঐতিহাসিকভাবে খুব কমই আমরা জানতে পেরেছি। অধিকাংশ তথ্যই এসেছে তৃতীয় সূত্র, কিংবা কখনো অগ্রন্থিত পরস্পরবিরোধী তথ্য থেকে। তবে তারপরেও যেটুকু তথ্য আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তা হলো স্যাপো গান আর কবিতা লিখতেন ফুলের সৌন্দর্য, স্বর্ণ, সূর্যালোক, মন্দিরের বাগান আর সর্বোপরি নারীর সৌন্দর্য নিয়ে। তার একটি কবিতা এরকম
He seems as fortunate as the gods to me,
The man who sits opposite you
And listens nearby to your sweet voice and lovely laughter.
Truly that sets my heart trembling in my breast.
For when I look at you for a moment,
Then it is no longer possible for me to speak:
My tongue has snapped,
At once a subtle fire has stolen beneath my flesh,
I see nothing with my eyes, my ears hum, sweat pours from me,
A trembling seizes me all over,
I am greener than grass,
and it seems to me that I am little short of dying.
প্রেমিক সেপোর প্রিয় গ্রীক দেবী যে আফ্রোদিতি হবেন – এতে আর আশ্চর্য কি ! স্যাপো অঢেল কবিতা লিখেছেন আফ্রোদিতিকে উৎসর্গ করে; একটি নমুনা এরকম
Thorned in bright colors, deathless Aphrodite, Zeus’ most subtle daughter, now I pray you,
Do not violate my soul with sorrow,
And pain, O Goddess!
তারপরেও আজকে- একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে স্যাপোর বহুকিছু নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি করা যাবে। কারণ তার জীবনের কোনো কিছুই নিশ্চিত করে আজ আর বলা সম্ভব নয়। তবু, স্যাপোর জীবন এবং কর্ম থেকে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হয় যে, সে সময় গ্রীসের নারী-পুরুষেরা খোলামেলা ভাবেই তাদের ভালোলাগাগুলোর প্রকাশ ঘটাতে পারতেন। স্যাপো নিজে হয়ত সমকামী ছিলেন না (আগেই বলা হয়েছে যে, আধুনিক কায়দায় কে সমকামী আর কে বিষমকামী -এ ধরনের লেভেল আরোপ তৎকালীন গ্রীক সমাজে প্রচলিত ছিল না), কিন্তু নারীদের নিয়ে প্রেমময় কাব্য তিনি রচনা করেছিলেন স্বতস্ফুর্ত ভাবেই।
রোমান সভ্যতায় সমকামিতা
রোমান সভ্যতা ছিল গ্রীক সভ্যতারই ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ। সমকামিতার ঐতিহ্য রোমানেরা আত্মীকরণ করে নেয় তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই। মূলত খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের আগপর্যন্ত সমকামিতার প্রতি কোনো বিদ্বেষমূলক মনোভাব রোমান সমাজে গড়ে উঠেনি। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত আছে সমকামিতাকে প্রশ্রয় দেয়ার অযুহাতে ঈশ্বর কীভাবে সডোম নগরী ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বাইবেলকে পুঁজি করে সমকামিতার উপর বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয় কনস্টানটিনের হাত দিয়ে রোমে খ্রিষ্টধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হবার পর থেকে। তার আগ পর্যন্ত রোমান সমাজে সমপ্রেমের বৈধতা ছিল অনেকটা গ্রীক সমাজের আদলেই। তবে সংস্কৃতির নিরিখে গ্রীক সভ্যতার সাথে রোমান সভ্যতার সাথে শুরু থেকে কিছুটা পার্থক্য ছিলই। গ্রীক সভ্যতায় আমরা দেখেছি সমপ্রেম সাধারণত আবর্তিত হতো প্রেমিক-প্রেমাস্পদ (erastes – eromenos) সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, একজন প্রৌঢ় এবং তরুণের মধ্যে। অন্যদিকে রোমান সভ্যতায় এ ধরনের কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম ছিল না। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সমকামিতার সবধরনের সম্পর্ককেরই গ্রহণযোগ্যতা ছিল সমাজে। তবে এই নিয়মের বাইরেও সামাজিক অবস্থানগত দিক দিয়ে সমকামিতার একটা আলাদা প্রেক্ষাপট ছিল। এটিকে রোমান সমাজে অনেকসময়ই দেখা হতো সামাজিক ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
মুসেস -গ্রীক উপকথা অনুযায়ী কবিতা এবং সাহিত্যের প্রেরণা ছিলো গ্রীক দেবীরা, যাদের সংখ্যা ছিলো নয়টি।
Ellen Greene, Reading Sappho: Contemporary Approaches (Classics and Contemporary Thought), University of California Press; August 1999
এ প্রসঙ্গে Dolores Klaich তার Woman Plus Woman গ্রন্থে বলেন, ‘Sappho was a poet who loved women. She was not probably a lesbian who wrote poetry’
Louis Crompton, Homosexuality and Civilization, Belknap Press of Harvard University
Press, 2006.
সমকামিতাকেন্দ্রিক এক ধরনের সম্পর্ক প্রচলিত ছিল মনিব-ভৃত্যে কিংবা ক্রীতদাসের মাঝেও। খ্রিষ্টপূর্বাব্দ দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্যে ক্রীতদাসের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এমনকি কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে জনসংখ্যার শতকরা চল্লিশভাগই ছিল কৃতদাস। এদের একটা বড় অংশকেই স্ব স্ব মনিবদের তৃপ্তি দেয়ার জন্য নিয়োগ দেয়া হতো। সে সময় একজন সুদর্শন ক্রীতদাসের চাহিদা এতোটাই বেশি ছিল যে, কারো কারো মূল্যমান আবাদি জমিকেও ছাড়িয়ে যেত। সে সময়কার রোমান শাসকেরা রীতিমত সমকামিতাকে উদযাপন করতেন। বিথ্যানিয়ার (Bithynia) তরুণ রাজা নিকোমেডসের প্রতি সম্রাট জুলিয়াস সিজারের অনুরাগ নিয়ে তার সৈন্যরা পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা করতো এই বলে ‘Caesar may have conquered the Gauls, but Nicomedes conquered Caesar’ 200। সিজার ছাড়াও হাড্রিয়ান, কমোডাস, এলাগাবালাস, ফিলিপ দ্য এরাবিয়ান সহ অনেক সম্রাটেরই সমকামের প্রতি আসক্তি ছিল। এডওয়ার্ড গিবন তার ‘দ্য হিস্ট্রি অব দা ডিক্লাইন এন্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার’ গ্রন্থে বলেন201, ‘প্রথম পনেরজন সম্রাটের মধ্যে ক্লডিয়াস ছাড়া অন্য সকলেরই সমকামের প্রতি আসক্তি ছিল’। সমকামের আসক্তি ছিল বহু রাজনীতিবিদদের মধ্যেও। তার মধ্যে সিসেরো, মার্ক এন্টোনি, অক্টাভিয়াস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মনোবিজ্ঞানী এবং যৌন-ইতিহাসবিদ নরমান সাসম্যান রোমান সাম্রাজ্যে সমকামিতার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন –
‘গ্রীক সভ্যতায় যেমন স্বতস্ফুর্তভাবে সমকামিতাকে মহিমান্বিত করা হতো, তার সাথে তুলনা করে বলা যায়, রোমানেরা একে যৌন-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। বহু গণমান্য রোমানেরাই প্রকৃত সমকামী না হলেও উভকামী যে ছিলেন তা নিশ্চিত। জুলিয়াস সীজারকে তো বলাই হতো তিনি প্রতিটি নারীর পুরুষ এবং প্রতিটি পুরুষের নারী’।
রাজনীতিবিদ ছাড়াও রোমান কবি সাহিত্যিকদের রচনায় ব্যাপক হারে সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। রোমান সাহিত্যে সমকামিতার প্রথমিক উল্লেখ পাওয়া যায় ৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রচিত ভ্যালেরিয়াস ম্যাক্সিমাসের ‘মেমোরেবল ফ্যাক্টস এন্ড সেয়িং’ নামের একটি পুস্তিকায়। পরবর্তীকালে সমকামিতার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ প্রথম শতকে ভার্গিলের লেখা কাব্যগ্রন্থ এনেনেইড (Aeneid)-এ। এ ছাড়া সমকামী সাহিত্যের সন্ধান মিলবে মেলিগার এবং ক্যালিমেচাস, ক্যাটাল্লাস এবং তাইবুল্লাস, থিওক্রিটাস এবং কোরিডন এবং হোরেস প্রমুখের রচনায়। ক্যাটাল্লাসের একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ এরকম –
If I should be allowed to go so far as kissing
Your sweet eyes, Juventius,
I would go on kissing them three hundred thousand times;
Nor would it ever seem I had enough,
Nor if I harvested
Kisses as numerous as the ears of standing corn
পুরুষ সমকামিতার পাশাপাশি এ সময় রোমান সাহিত্যে নারী সমকামিতারও সন্ধান মেলে, যদিও পরিমাণগত দিক থেকে এটি নগন্যই বলা চলে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইফিস, আয়ান্থির গল্প, ফেডারাসের রচনা প্রভৃতিতে।
৩১২ সালে সম্রাট কন্সটানটিন ম্যাক্সেন্টিয়াসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে খ্রিষ্টধর্মগ্রহণ করলে, রোমে খ্রিষ্টধর্ম রাজনৈতিক ভিত্তি লাভ করে। এই সময়টা খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। খ্রিষ্টধর্মের প্রথম শাসক হিসেবে রোমান চার্চকে প্ৰভুত ক্ষমতা প্রদান করেন কন্সটানটিন। পূর্ববর্তী সমস্ত প্যাগান রীতি নীতি রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়। শেষ প্যাগান সম্রাট জুলিয়ান ৩৬৭ সালে মারা গেলে প্যাগানদের প্রভাব একেবারেই কমে আসে। সমকামিতার প্রতি উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ধীরে ধীরে সমাজে লোপ পেতে শুরু করে এসময় থেকেই।
মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময় সমকামিতা
কন্সটানটিন মারা যান ৩৩৭ সালে । কন্সটানটিনের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী তিন ছেলে পরবর্তীতে রোমান শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কন্সটান্টিয়াস এবং কন্সটান্স ৩৪২ সালে সমপ্রেম এবং সমলিঙ্গের বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করেন। একই ধারাবাহিকতায় ৩৯০ সালে খ্রিষ্টান সম্রাট ভ্যালেন্টিনিয়ান ২, থিওডোসিয়াস ১ এবং আর্কাডিয়াস সমকামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সমকামের শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিধান চালু করেন। খ্রিষ্টান সম্রাট জাস্টিনিয়ান ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর জন্য সমকামিতাকে দায়ী করেন এবং শুধু তাই নয় সমকামিতার শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড তা ৫৩৩ সালে পরিষ্কার করে দেন এই বলে –
The Lex Julia … punishes with death not only those who violate the marriages of others, but those who dare to commit acts of vile lust with other man
রোমান সাম্রাজ্য পরবর্তী খ্রিষ্টান সভ্যতা এবং মধ্যযুগের ইতিহাস মূলত সমকামীদের উপর নিপীড়ন এবং নির্যাতনের ইতিহাস। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বহু খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকদের সমকামিতার অযুহাতে এ সময় পুড়িয়ে মারা হয়। এই পীড়ন অব্যাহতো ছিল রেঁনেসার সময়ও প্রবল প্রতাপের সাথেই। ফ্লোরেন্সে প্লেগের কারণে জনসংখ্যা ১২৫০০০ থেকে কমে ৪০০০০০-এ নেমে আসে ১৩৪৮ সাল থেকে ১৪২৭ সালের মধ্যে। ধর্মবাদীরা এর পেছনে সমকামিতাকে দায়ী করে; তারা প্রচার করে সমকামিতার কারণে সডোম এবং গোমরাহর উপর যেমন ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে এসেছিল (বাইবেলে বর্ণিত উপকথা অনুযায়ী), ঠিক একই ভাবে তারা দাবি করে প্লেগের পেছনেও আছে একই কারণে ঈশ্বরের অভিশাপ। ইতালিতে এ সময় সমকামিতা ধরার জন্য বিশেষ ধরনের আদালতের ব্যবস্থা করা হয়, যাদের নৈশ প্রহরী (Officers of the Night) হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এদের কাজই ছিল শহরে সমকামী খুঁজে বের করা। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সবার জন্য কাঠের খোলা বাক্স (tamburos) রেখে দেয়া হতো, আর নাগরিকেরা সন্দেহভাজন কারো নাম পেলেই এই বাক্সে এসে জমা দিয়ে যেতেন। এ সমস্ত অজ্ঞাত অভিযোগ, অনুযোগের ভিত্তিতে এই নৈশ প্রহরীর দল অনুসন্ধান চালাতেন। অনেকটা আজকের দিনের বাংলাদেশের র্যাব বাহিনীর আদলে তৈরি ইতালির এই স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এর কার্যক্রম ১৪৩২ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৫০২ সাল পর্যন্ত চলে, এবং এই সময়ের মধ্যে প্রায় সতের হাজার মানুষকে সন্দেহের তালিকায় আনা হয়। প্রথম সমকামীর বিচার করে হত্যা করার নথিবদ্ধ দলিল আমরা পাই ১৭৪২ সালে ভেনিসে এবং এর পরের ছয় বছরে অন্তত তেরটি সমকামিতার মামলা পরিচালনা সেই একই শহরে করা হয়। রোলান্দিনো রঞ্চাইয়া (Rolandino Ronchaia) নামের এক ব্যক্তিকে সমকামিতার অভিযোগে ১৩৫৪ সালে পুড়িয়ে মারা হয়। একই রকম ভাগ্য বরণ করে নিতে হয় গিওভান্নি দি গিওভান্নি (Giovanni di Giovanni) ১৩৬৫ সালের দিকে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছিল আরো অনেক বেশি। তাকে গাধার পিঠে করে সারা শহর ঘোরান হয়, তারপর তার লিঙ্গচ্ছেদন করে খোঁজা করে দেয়া হয়। শুধু তাই না, তারপর লোহিত তপ্ত লৌহ- শলাকা তার পশ্চাত দেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এহেন শাস্তির ব্যাপারে যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে, তাদের দেহের এই প্রত্যঙ্গটি ‘সমকামিতায় ব্যবহৃত’ হয়েছিল। (Dominique Phinot)।
১৪৯৪ সালে ডোমিসিয়ান পাদ্রী গিরোলামো স্যাভোনারোলার ( Girolamo Savonarola) রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে সমকামিতার উপর নিবর্তন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪৯৫ থেকে ১৪৯৭ সালের মধ্যে ইতালিতে ৭৩১ জনকে ‘সডোমী আইনে’ অভিযুক্ত হতে হয়। এদের অধিকাংশকেই প্রহসনমূলক বিচারের সম্মুখীন করে হত্যা করা হয়। সমকামিতামূলক সম্পর্ক থাকার কারণে বিচারের প্রহসনে হত্যা করা হয় ওয়াটারফোর্ড এবং লিসমোরের বিশপ জন এথেরণকে (John Atherton) ১৬৪০ সালে, শিরোচ্ছেদ করা হয় ইতালির মানবতাবাদী ইতিহাসবিদ জ্যাকোপো বোনফাডিও (Jacopo Bonfadio) কে। হত্যা করা হয় ওয়াল্টার হাঙ্গারফোর্ডকে, সুইডিশ রূপান্তরকামী লিসবেথা ওলসডটারকে (Lisbetha Olsdotter) এবং ১৫৫৬ সালে ফরাসী কম্পোজার ডমিনিক ফিনোটকে।
Suetonius, Tr. J. C. Rolfe. 2 vols. Cambridge: Harvard University press, 1913-1933.
Edward Gibbon. History of the Decline and Fall of the Roman Empire. Vol. 1, London. 1898, p. 313.
(Theodosian Code 9.7.6): All persons who have the shameful custom of condemning a man’s body, acting the part of a woman’s to the sufferance of alien sex (for they appear not to be different from women), shall expiate a crime of this kind in avenging flames in the sight of the people. 204 Justinian Novels 77, 144
কিন্তু পাশাপাশি ইতালির সমাজে ধর্মীয় প্রথা এবং সংস্কারের বিপরীতে একধরনের নবজাগরণের সূচনাও পরিলক্ষিত হতে থাকে। এই নব জাগরণের নেতৃত্ব দেন দোনাতেল্লো, বত্তিচেল্লী, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পীরা, আর সেই সাথে কোপার্নিকাস, গ্যালেলিও, কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা আর ফ্রান্সিস বেকন এবং জিওর্দানো ব্রুনোর মতো তুখোর দার্শনিকেরা। এ সময় খ্রীষ্টিয় গোঁড়ামীকে উপেক্ষা করে শিল্প সাহিত্য এবং ভাস্কর্যে হারিয়ে যাওয়া প্যাগান বিভিন্ন রীতিকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। বিজ্ঞানেও এই সময়ই সূচিত হয় কোপার্নিকাসীয় বিপ্লব, যা দর্শনেও যোগ করে নতুন মাত্রা। প্রকৃতি এবং মহাবিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের ধারণাগুলো যায় বদলে। এমনকি ধর্মীয় চরিত্রগুলোরও ভিন্নধর্মী রূপ দেয়া শুরু হয় এ সময় থেকেই। যেমন, সনাতন ভাবে বাইবেল বর্ণিত পয়গম্বর ডেভিড বা দাউদকে সলটারি হাতে দাঁড়ি গোফওয়ালা প্রৌঢ় হিসবেই চিত্রিত করা হতো। কিন্তু এই প্রথা ভেঙ্গে রেঁনেসার শিল্পীরা আবিস্কার করলেন ডেভিডের অন্য আরেক রূপ। যেমন, স্থপতি দোনাতেল্লো ডেভিডকে মেষপালকের টুপি পরিহিত নগ্নদেহী যুবক হিসেবে চিত্রিত করে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি নির্মাণ করেন ১৪৪০ সালে। সে সময় অনেক দিক থেকেই এই মূর্তিটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। প্রথমতঃ এটিই রেনেসাঁর ইতিহাসে পুরুষের নগ্নদেহের প্রথম শিল্পকর্ম। শুধু তাই নয়, ডেভিডের বুট জুতো থেকে দীর্ঘ পালক বেড়িয়ে যেভাবে মূর্তির পদযুগল প্রদক্ষিণ করেছে, ঐতিহাসিকদের মতে সেটি সে সময়কার সমকামিতার সাক্ষর বহন করে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের মূর্তি তৈরি দোনাতেল্লোর জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ রেনেসাঁর যে সময়ে এই মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়েছিল তখন খোদ ফ্লোরেন্সেই প্রায় চৌদ্দ হাজার লোককে সমকামিতার আইনে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। পরবর্তীতে ১৫০৪ সালের দিকে রেনেসাঁর আরেক দিকপাল মাইকেল এঞ্জেলোও মার্বেল পাথরে ডেভিডের নগ্নদেহের আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। প্রায় ১৭ ফুট লম্বা সুঠামদেহী ডেভিডের অপূর্ব এই প্রতিমূর্তিটিও যথেষ্ট সমকামিতার যৌন উদ্রেগকারী (homoerotic), এবং রেনেসাঁর সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত। শিল্পকর্মগুলোর পাশাপাশি দোনাতেল্লো, বত্তিচেল্লী, লিওনার্দো এবং মাইকেলেঞ্জেলোর জীবনী থেকেও পরিষ্কার আলামত পাওয়া গেছে যে, তারা ব্যক্তি জীবনেও সমকামিতাকে তাদের শিল্পকর্মগুলোর মতই উদযাপন করতে পছন্দ করতেন।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি রেনেসাঁর সময়ের প্রধানতম ব্যক্তিত্ব এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা –সেটা বোধ হয় প্রায় সবারই জানা । কিন্তু যেটা হয়ত অনেকেরই জানা নেই যে, লিওনার্দো ছিলেন সমকামী। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড মনে করতেন, লিওনার্দোর সমকামের প্রতি আগ্রহ থেকেই বৈজ্ঞানিক এবং শিল্প প্রতিভার জন্ম হয়েছিল। ১৯১০ সালে একটি বইয়ে লিওনার্দোর মনোজগত নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘খুব কম বয়স থেকেই লিওনার্দো তার যৌনপ্রবৃত্তিকে জ্ঞানান্বষেণের দিকে ধাবিত করেন’।
ফ্রয়েডের কথায় সত্যতা কতটুকু তা নিয়ে বিতর্ক না করেও বলা যায়, সমকামিতার প্রভাব লিওনার্দোর মানসপটে সেই কিশোর বয়স থেকেই ছিল। এজন্য জেলেও যেতে হয়েছিল দুবার। প্রথমবার শহরের রাস্তায় রাখা কাঠের বাক্সে কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তি কোনো এক সমকামী যৌনকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর ফলে নৈশ প্রহরীর দল (Officers of the Night) ১৪৭৬ সালের ৮ই এপ্রিল চার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন, সেই তালিকায় লিওনার্দোও ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুক্তি পান। দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে এর দুমাস পরেই। এবারে লিওনার্দোকে সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এমনকি লিওনার্দর বাবাও কোনো ধরনের সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু তার কাছের এক প্রভাবশালী চাচার তদ্বিরে লিওনার্দো দু মাস জেল খেটে মুক্তি লাভ করেন ২০৪।
এরপরের ঘটনা তার আটত্রিশ বছর বয়সে যখন লিওনার্দো ছিলেন খ্যাতির শিখরে। বিখ্যাত ভার্জিন অন দ্য রক্স এবং লাস্ট সাপার তিনি এর মধ্যেই এঁকে ফেলেছেন, এবং রহস্যময়ী মোনালিসাও সম্ভবতঃ তার মাথায় ঘুরছে। ঠিক এ সময়ই তিনি গিয়ান গিয়াকোমো ক্যাপ্রোতি নামে এক কিশোরকে তার বাসায় রাখার জন্য নিয়ে আসেন। কিশোরের ডাক নাম ছিল সালাই (Salai)। লিওনার্দো ‘তরুণ সালাইয়ের কোঁকড়ানো চুল, নিষ্পাপ মুখয়ব এবং সর্বোপরি দৈহিক সৌন্দর্যে’ অত্যন্ত মুগ্ধ হন। কিন্তু এক বছরের মাথায় লিওনার্দো বুঝতে পারেন সালাই এতো সহজ সরল নিষ্পাপ নয়, তার ‘ইধার কা মাল উধার’ করার বদ-অভ্যাস আছে। লিওনার্দো এ সময় তার বিভিন্ন লেখায় সালাইকে ‘ladro, bugiardo, ostinato, ghitto’ – মানে ‘চোর মিথ্যেবাদী, গোঁয়ার এবং লোভী’ বলে আখ্যায়িত করেন। সালাইয়ের আলমারী ভর্তি ছিল দামী পোষাক পরিচ্ছদ আর ছিল পচিশ জোড়া জুতো। অন্তত পাঁচটি ঘটনায় লিওনার্দো সালাইয়ের চুরি দারি হাতে নাতে ধরে ফেলেন। কিন্তু তারপরেও সালাইয়ের সৌন্দর্য এবং আবেদনঘন চাহনি লিওনার্দোকে সালাইয়ের বদভ্যাসের কথা বেমালুম ভুলিয়ে দিয়েছিল বলেই মনে হয়। সেজন্যই হাজারটা বদভ্যাসের সন্ধান পেলেও তাকে বাড়ি থেকে বের না করে দিয়ে পরবর্তী পচিশ বছর ধরে লিওনার্দো সালাইকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন।
লিওনার্দোর বিভিন্ন ছবিতে এ সময় কোঁকড়ানো চুলের যুবকের নগ্ন দেহের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। সে সময়কার আঁকা ‘এঞ্জেল ইনকার্নেট’ সহ বহু স্কেচই তার প্রমাণ। আরেকটি ছবিতে কোঁকাড়ানো চুলের অধিকারী এক নগ্ন যুবককে পেছন দিক হতে আঁকা হয়। লিওনার্দোর আঁকা ‘জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট ‘ ছবিতে সালাইয়ের মুখচ্ছবি ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের আরো ছবি হয়ত ছিল, কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পাদ্রীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে লিওনার্দোর বেশ কিছু ‘যৌন-উদ্রেগকারী’ ছবি ধ্বংস করে ফেলায় আমরা এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকের হদিস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
সালাই লিওনার্দোকে ছেড়ে যান যাওয়ার বিশ বছর পরে লিওনার্দোর সাথে ফ্রান্সেস্কো মেলজি নামে আরেক মিলানের অভিজাত ব্যক্তির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। লিওনার্দো তখন বৃদ্ধ, কাজেই তাদের সম্পর্কের মধ্যে তারুণ্যের প্রেমময় উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত থাকলেও তাদের সম্পর্ক ছিল অনেক প্রগাঢ়। মেলজি লিওনার্দোর শেষ দিনগুলোতেও লিওনার্দোকে পর্যাপ্ত সঙ্গ দেন এবং তার দেখভাল করেন। লিওনার্দোর নোটবইগুলোও মেলজির পরিচর্যাতেই থাকতো। লিওনার্দো তার ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠিতে তাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে বলেন– ‘deeply felt and most ardent love’ ।
David was a very controversial statue for many reasons. One reason was the fact that it depicted a nude young man, with much detail on the genitals. Also, a long feather coming from David’s boot that caressed his leg and thigh, had, at the time, implied that David and/or Donatello (the artist), was homosexual (Ref. David, Donatello, wikipedia)
PBS documentary “The Medici”, 2003
Sigmund Freud, Eine Kindheitserinnerung des Leonardo da Vinci, (1910), as cited by Daniel Arasse in his prologue Leonardo and Freud, Leonardo da Vinci.
Keith Stern, Queers in History: The Comprehensive Encyclopedia of Historical Gays, Lesbians and Bisexuals, BenBella Books, 2009
A graceful and beautiful youth with fine curly hair, in which Leonardo greatly delighted, from Giorgio Vasari, The Life of the Artist.
মাইকেল এঞ্জেলো
মাইকেলএঞ্জেলো ছিলেন রেনেসাঁর সময়ের আরেকজন স্বনামধন্য স্থপতি, এবং চিত্রকর। ডেভিড নামে তার অসামান্য স্থাপত্যকর্মটি নরদেহের সৌন্দর্যের অন্তিম প্রকাশ এবং সমকামী যৌনপ্রবৃত্তি শৈল্পিকভাবে প্রকাশের এক অভুতপূর্ব সাক্ষর। তা সত্ত্বেও সেসময়কার সর্বোচ্চ ধর্মবাদী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে মাইকেল এঞ্জেলোর কখনোই কোনো অসুবিধা হয়নি। সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাঁদে চিত্রাঙ্কনের জন্য পোপ জুলিয়াস ২ কর্তৃক মাইকেল এঞ্জেলোর এর মনোনয়ন প্রদান এমনি একটি উদাহরণ।
মাইকেলএঞ্জেলোর সারা জীবনেই অসংখ্য পুরুষের সাথে সান্নিধ্য ছিল। এদের অনেকেই মাইকেল এঞ্জেলোর স্থাপত্যকর্মের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছিলেন। মাইকেল এঞ্জেলোর এই প্রণয়াস্পদদের তালিকায় ছিলেন ঘেরার্দো পেরিনি, নোবেলম্যান তমাসো ক্যাভালিরি, চেচিনো দেই ব্রাক্কি, ফেবো দি পোগিও সহ অনেকেই।পেরিনি মাইকেল এঞ্জেলোর সাথে দশ বছর একসাথে ছিলেন, আর মাইকেলএঞ্জেলো তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে ‘স্বর্গীয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।মাইকেল এঞ্জেলো ব্রাক্কির প্রেমে পড়েছিলেন যখন ব্রাক্কির বয়স ছিল মাত্র তের। তার দু বছরের মাথায় ব্রাক্কি মারা যান। ব্রাক্কির এই অকাল প্রয়াণে মাইকেল এঞ্জেলো অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ভেঙ্গে পড়েন। ব্রাক্কির সমাধিতে মাইকেলএঞ্জেলো নিবেদন করলেন এই পক্তিমালা –
The early flesh and here my
bones deprived
Of their charming face and beautiful eyes,
Do yet attest for him how gracious
I was in bed
When he embraced and in what
the soul doth live.
মাইকেলএঞ্জেলোর ডায়রি কিংবা চিঠি থেকে তার সমপ্রেমের বহু আলামত পাওয়া যায়। সে সসস্ত আলামত ইচ্ছে করেই গোপন করা হয়। এমনকি ক্যাভালিরিকে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে মাইকেল এঞ্জেলো যে আবেগময় কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলো পরে যখন প্রকাশিত হয় সেগুলোর জেন্ডার বদলে দিয়ে প্রকাশিত হয়।
চৈনিক সভ্যতায় সমকামিতা
চীন দেশেও সমকামিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। চীনে সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের তংঝি নামে অভিহিত করা হয়। শব্দটি বর্তমানে সমান্তরাল যৌনতার সকল মানুষকে বুঝালেও এর বুৎপত্তিগত অর্থ গোনায় নিলে এটি মূলত সমকামী প্রবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদেরই বোঝাতো। ‘তং” শব্দের অর্থ ‘সম’ এবং ‘ঝি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রবৃত্তি বা প্রবণতা। কাজেই বুৎপত্তিগত অর্থে ‘তংঝি” বলতে সমলিঙ্গের মানুষদের প্রতি যৌনাকর্ষণ এবং প্রবৃত্তিকে বোঝানো হয়। চীনা গবেষক জিয়াওমিংজিয়ং-এর প্রায় পাঁচ বছরের গবেষনায় লিখিত ‘দ্য হিস্ট্রি অব হোমোসেক্সুয়ালিটি ইন চায়না চীনে সমকামিতার এক প্রামান্য দলিল। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন কালের চীনের রাজা এবং অভিজাত পরিবারের সদস্যরা তংঝিদের সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতেন। এছাড়াও ‘দ্য ড্রিম অব দি রেড চেম্বার’ এবং ‘আউট ল অব দা মার্শ দুটো বিখ্যাত চীনা উপন্যাসেও তংঝি সম্ভোগের উল্লেখ রয়েছে। সেই সময় চীনে অনেক তংঝিই রাজা এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষদের কাছে উপপত্নীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা অনেক সময় তাদের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রসন্তানটিকে ‘মেয়ে হিসেবে’ বড় করতেন, তারপর রাজন্যবর্গ বা অভিজাত পরিবারের কাছে উপপত্নী হিসেবে বিক্রি করে দিতেন। বিভিন্ন নাটকেও তংঝিদের মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যেত। বিখ্যাত ‘বেইজিং অপেরার’ বিভিন্ন নাটকে এরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতো। ১৯২৯ সালে মেইলান ফেং নামের এক তংঝি নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে সাংহাই শহরে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
চীনা গবেষক লি ইনহীর (Li Yinhe) গবেষণা থেকে জানা যায় – চীনের প্রাচীন শ্যাং রাজবংশে (খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টপূর্ব এগারো শতাব্দী) সমকামিতার সুস্পষ্ট অস্তিত্ব ছিল। এটিকে তখন চৈনিক ভাষায় ‘লুয়ান ফেং’বলে অভিহিত করা হত। চৈনিক সমকামিতার আদিতম সাক্ষ্য এটি।
পরবর্তী বিভিন্ন রাজবংশে সমকামিতার নানা ধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ডিউক লিং এর প্রেমিক মিজি শিয়া এবং আরেক সম্রাট ওয়েইয়ের প্রিয়পাত্র লর্ড লং য়্যাং এর কথা আমরা চৈনিক সভ্যতার ইতিহাসে পাই। গবেষক প্যান গুয়ানদানের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, হ্যান ডায়নেস্টির প্রতিটি রাজার এক বা একাধিক পুরুষ যৌনসঙ্গী ছিল। সম্রাট আই (Emperor Ai) নামে পরিচিত লিউ সিং এর সাথে দন জিয়াং-এর সমকামিতার সম্পর্ক ছিল। কথিত আছে একবার ডন জিয়াং সম্রাটের গাউনের উপর ঘুমিয়ে পড়লে ঘুমন্ত প্রেমিককে জাগানোর বদলে তিনি জামার আস্তিন কেটে ফেলে বাকি গাউনটিকে বের করে পরিধান করেন। সে সময়কার ইতিহাসে আমরা নারীর সমকামিতারও কিছুটা হলেও হদিস পাই। সমকামিতা জনপ্রিয় ছিল সং, মিং এবং চিং রাজবংশেও।
১৯১৪ সালে গবেষক সান সিহাও (Sun Cizhou) তার গবেষণা থেকে দেখান যে চীনের বিখ্যাত প্রাচীন কবি চু উয়ান (Qu Yuan) ছিলেন তার রাজার প্রেমিক । সান সিহা ও চু উয়ানের ‘লিসাও’ এবং ‘লংগিং ফর বিউটি’ সহ বেশ কিছু কবিতা বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সে সমস্ত কবিতায় কবি যেভাবে রাজার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন সেটা সেসময় মূলত নারীরাই করতেন তাদের নিজ নিজ প্রেমিকদের সৌন্দর্য তুলে ধরতে। চীনের ইতিহাসে চু উয়ান ছাড়াও আরো নেক সমকামী কবি যুগলের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি শি ক্যাং (Xi Kang) এবং রুয়ান জি (Ruan Ji)’র মধ্যকার সম্পর্কও ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। তাদের বন্ধনকে উপমায় আখ্যায়িত করা হতো এভাবে – ‘ইস্পাতের চেয়ে দৃঢ়, এবং অর্কিডের মতোই সুরভিত’। কথিত আছে একজন কবির স্ত্রী লুকিয়ে লুকিয়ে একদিন তাদের আবেগঘন অবস্থায় দেখে ফেলেন এবং তাদের যৌনস্পৃহার সৌন্দর্যে শিহরিত হয়ে উঠেন-
Robert Payne, Leonardo, Doubleday, 1978
Xiaomingxiong, History of Homosexuality In China, Ng, Siuming (Wu Xiaoming) & Rosa Winkel Press; Revised Edition edition (1997)
Tsao Hsueh-Chin, Dream of the Red Chamber, Anchor, Abridged edition (October 20, 1958)
Shi Nai’An, Outlaws of the Marsh, Foreign Languages Press (January 1, 2001)
Bret Hinsch, Passions of the Cut Sleeve: The Male Homosexual Tradition in China, The University of California Press, 1990
মিং রাজবংশের রাজত্বকালে (১৩৬৮-১৬৪৪) শিল্প কারখানা বিস্তার লাভ করে, সেই সাথে নাগরিক বিবিধ চাহিদাও। সমকামিতা শুধু তখন রাজবংশ কিংবা সম্রাটদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষদের মধ্যেও। তার উল্লেখ পাওয়া যায় ফুজিয়ান রাজ্যের শেন দেফু (১৫৭৮-১৬৪২)র বর্ণনায়-
‘ফুজিয়ানিস লোকেরা ছিল পুরুষদের সৌন্দর্যের বিরাট সমঝদার। কে কত বড়লোক কিংবা গরীব, কিংবা সুদর্শন নাকি কুৎসিৎ এগুলো দিয়ে নয়, তাদের মধ্যে বন্ধন তৈরি হতো সামাজিক পদমর্যাদার নিরিখে। বয়স্কদের মধ্যে সম্পর্ককে বলা হতো চিজিয়ং, আর তরুণদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে বলা হতো চিদি। যখন বড় ভাই ছোটভাইয়ের বাসায় যেতেন, তাকে অভিভাবকেরা অবিকল জামাইয়ের মতো আপ্যায়ন করতেন। বিয়ে সহ ছোট ভায়ের অন্যান্য সকল ব্যয় বড় ভাই বহন করতেন। তারা দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং এমনকি ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত তারা একই বিছানায় শয়ন করতেন স্বামী-স্ত্রীর মতোই।
Vitiello, Giovanni, “The Dragon’s Whim : Ming and Qing Homoerotic Tales from the Cut Sleeve. T’oung Pao 78 (1992), 341-372.
মিং সাম্রাজ্যের সময় পতিতাবৃত্তি বিস্তৃতি লাভ করে এবং সেই সাথে বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্যমাত্রায় পুরুষ যৌনকর্মীর (এদেরকে অভিহিত করা হতো গিগোলোস নামে) সংখ্যাও। কিন্তু এ সময় থেকেই চীনে কনফুসিয়াসের উদারপন্থি দর্শন থেকে সরে এসে পারিবারিক নিয়ম কানুন জোরদার করার প্রচেষ্টাও নেয়া হয়, এবং তার ফলে এ সময় থেকেই মূলত সমকামিতাকে দেখা হতে লাগলো নীতি-নৈতিকতার নিরিখে নিয়মের ব্যতিক্রম হিসেবে।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষে পুরুষে সম্পর্ককে চীনে প্রথম আইনগতভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয় ১৭৪০ সালে, যদিও আইনের প্রয়োগ তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়নি।তারপরেও এটি একারনেই গুরুত্বপূর্ণ যে সমকামিতাকে অবদমনের প্রথম আইনি প্রয়াস ছিল এটি।
সমকামীরা সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয় চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়গুলোতে (১৯৬৬-১৯৭৬)। সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় সমকামিতাকে দেখা হয়েছিল সামাজিক অধঃপতন এবং মানসিক রোগ হিসেবে। পুলিশ প্রতিনিয়ত সমকামীদের আস্তানায় হানা দিতে শুরু করলো, আর হচ্ছিলো সমানে ধরপাকর। কিন্তু সে সময় সমকামিতার কোনো আইনগত উল্লেখ সেসময় না থাকায় পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রেফতার করতো আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করে নাগরিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার অযুহাতে।
তবে আশির দশকের পর থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলে যায়। সমকামীদের অধিকার ধীরে ধীরে সমাজে স্বীকৃত হতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালে চীনে অপরাধের তালিকা হতে সমকামিতাকে অব্যহতি দেয়া হয় এবং ২০০২ সালে মানসিক অসুস্থতার তালিকা হতে।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং সমাজে সমকামিতা
ভারতবর্ষে সমপ্রেম সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে হলে প্রথমে ভারতবর্ষর আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেলতে হবে। আর ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাস আবার জড়িয়ে আছে ভারতীয় সাহিত্যের সাথে। ভারতীয় সাহিত্য বলতে প্রথমেই আসবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যকীর্তি, পুরাণ, স্থানীয় উপাখ্যান এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ”।
তাছাড়াও অনুসন্ধান যোগ্য অন্যান্য ক্ষেত্র হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিলালেখা, তাম্রশাসন ও মূদ্রা।
ভারতবর্ষের সভ্যতাগুলোর কথা বললে সিন্ধুসভ্যতার কথাই চলে আসবে সবার আগে। সিন্ধু-সভ্যতাই হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা। আর সিন্ধু-সভ্যতার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের একটি বড় নিদর্শন হচ্ছে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে অবিস্কৃত মূর্তি, সীল, ভাস্কর্য ইত্যাদি। সিন্ধু-সভ্যতায় প্রাপ্ত পোড়ামাটির মূর্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একটি পুরুষ মূর্তি। লম্বা নাক, মাংসল চিবুক, দাড়িগোঁফবিহীন পুরুষ মূর্তি। গায়ে অলংকার। মুখমন্ডলে নারীসুলভ কোমলতা ফুটে আছে। অনেকে মনে করেন যে, শহরবাসীরা নৃত্য ও নৃত্যশিল্পীর প্রতি অনুরাগী ছিল বলেই ভাষ্কর্যশিল্পী তার দক্ষস্পর্শে অত্যন্ত নিপুনভাবে এ পুরুষ-মূর্তিটি সৃষ্টি করেছিলেন। নিখুঁতভাবে তৈরি এ পুরুষ-মূর্তিটিই সিন্ধু-সভ্যতার পুরুষ-সৌন্দর্যনন্দনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এ-মূর্তিটি হয়ত মাইকেলএঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ মর্মরমূর্তির কথাই অনেককে মনে করিয়ে দেবে।
এ ধরনের অনেক আলামত থেকেই বোঝা যায় যে, আমাদের প্রাচীন অনার্য সভ্যতায় সমপ্রেম ছিল। কিন্তু আর্য বৈদিক-হিন্দুধর্ম সমপ্রেম সম্পর্কে অস্বাভাবিক নীরবতা অবলম্বন করেছে; কখনো বা এ ধরনের বিতর্ক সুনিপূণভাবে এড়িয়ে যাওয়া
হয়েছে, যা সূচনা করেছে এক অনাবশ্যক অস্বস্তির। বৈদিক ধর্মসূত্রে বিয়ে (বংশরক্ষা), ধর্ম (কর্তব্যপালন) ও রতি (সাহচর্য) এ-তিন উদ্দেশ্যের বিধেয় বলে বিধৃত করা হয়েছে। অন্যদিকে বৈদিক-হিন্দুর প্রধান শাস্ত্রগুলো সরাসরি সমপ্রেম বা সমকামিতাকে ঈশ্বর বিরোধিতা বলে গণ্য করেনি; বা এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধানও বাতিয়ে দেয়নি, যদিও মনুস্মৃতির একটি শ্লোকে নারী সমকামিতাকে হেয় করা হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। তারপরেও ভারতীয় প্রাচীন (খৃষ্টপূর্ব ৮ থেকে খৃষ্টপর ৬ শতাব্দী পর্যন্ত) বৈদিক-হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে সমপ্রেম বা বর-বন্ধুর উদাহরণ পাওয়া যায়। কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের প্রিয় সখা। মহাভারতে বর্ণিত কৃষ্ণ ও অর্জুনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই প্রমাণ করে যে, পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব কত গভীর ছিল সেসময়। অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
Thou art mine and I am thine, while all that is mine is thine also! He that hateth thee hateth me as well, and he that followeth thee followeth me! O Partha, thou art from me and I from thee.
ডার্কা থেকে ফিরে আসার সময়, শেষ রাতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হন ধনঞ্জয়ের (অর্জুনের অন্য নাম) এর আশ্রমে রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে। মহাভারতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে”,
…worshipped duly and furnished with every object of comfort and enjoyment, Krishn of great intelligence, passed the night in happy sleep with Dhananjay as his companion.
এ সময়ে বর-বুন্ধত্ব খুবই প্রবিত্র ছিল। একে আরও পবিত্র করার উদ্দেশ্যে সপ্তমচক্কর দেওয়া হতো ‘পবিত্র অগ্নি’ প্রদক্ষিণ করে, অনেকটা যেমন ‘সাত পাক দেওয়া হয় বৈদিক-হিন্দু বিয়েতে। আর পুরুষ-পুরুষের এ-বন্ধনকে বলা হয়ত ‘সপ্তমপদ মিত্র’ বা বন্ধুর সঙ্গে একতালে সাত পাক দেওয়ার বন্ধুত্ব। রাম ও সুগ্রীভ তাঁদের বন্ধুত্বকে সুগভীর করার উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রদক্ষিণ করে সাত চক্কর দিয়েছিলেন”। ভীষ্ম বলছেন যে, পুরুষ শুধু নারীর কাছে যায় বংশরক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
এই সাহিত্যকীর্তির অন্তর্ভুক্ত – বৈদিক সাহিত্য (এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, সূত্র সাহিত্য ও উপনিষদ), মহাকাব্য (মূলত রামায়ণ ও মহাভারত), বৌদ্ধ সাহিত্য (পালি বা প্রাকৃত ভাষায় রচিত ‘জাতক’, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত ইত্যাদি) ও জৈন সাহিত্য (প্রাকৃত ভাষায় রচিত ভগবতী-সূত্র, আচারাঙ্গ-সূত্র ইত্যাদি), আইন এবং কামকলা সংক্রান্ত গ্রন্থ (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং বাৎস্যায়নের কামসূত্র সহ অন্যান্য গ্রন্থ), জীবনী সাহিত্য ও রাজ-প্রশস্তি (হর্ষচরিত, বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, নবসাহসাঙ্গচরিত, রামচরিত, গৌড়বহো, কৃমারপালচরিত, হামির-কাব্য, ভোজ-প্রবন্ধ ইত্যাদি) এবং অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্য (পতঞ্জলির ব্যাকরণ, মুদ্রা-রাক্ষস, দেবীচন্দ্রগুপ্তম, গার্গী-সংহিতা ইত্যাদি)।
পুরাণ – অতি প্রাচীনকালের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও ধর্ম ইত্যাদি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা। সাধারণতঃ পুরাণ বলতে বুঝায় ব্যাসাদি মুনি প্রনীত শাস্ত্র। পুরাণ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। মহাপুরাণ ও উপপুরাণ। মহাপুরাণের সংখ্যা ১৮।
স্থানীয় উপাখ্যানের অন্তর্ভুক্ত দ্বীপবংশ, রাজতরঙ্গিণী, মহাবংশের উপাখ্যানসহ অন্যান্য উপাখ্যান।
পারসিয়া, ইন্ডিকা, তহকিক-ই-হিন্দ সহ অন্যান্য প্রামান্য গ্রন্থ।
সমপ্রেম একটু আভাস, হিমেল সাগর, মুক্তমনা। http://www.mukto-mona.com/ Articles/himel_shagor/shomokaam.pdf
Vana Parva, Mahabharat, Sage Vyas.
Aswamed Parva, Mahabharat, Sage Vyas.
Ramayan, Sage Valmiki
মহাভারতের একটি প্রধানতম চরিত্র। রাজা শান্তনুর ঔরষে এবং গঙ্গার গর্ভে তার জন্ম হয়। কুরু- পান্ডবদের মধ্যকার জ্ঞাতি-বৈরিতা আরম্ভ হলে ভীষ্ম তা নিবারণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কৌরবভবনে বাস করে তাদের অন্নে প্রতিপালিত বলে ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌরবপক্ষ অবলম্বন করেন।
আর এ তখনই যায় যখন পৃথিবীর বুক থেকে বংশধর কমতে থাকে। অন্যদিকে পঞ্চতন্ত্রে দেখা যায় যে, শুধু পশুপাখি ব্যতিত সবগুলো পৌরাণিক চরিত্রই পুরুষ; এদের মধ্যে সমপ্রেম আছে, এমনকি সংসার ধর্মও।
নারী-পুরুষর ‘শারীরিক মিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নেওয়ার উপকথার সন্ধান মিলে রামায়ন এবং মহাভারতের মতো বৈদিক সাহিত্যগুলোতে। এসব কাহিনীতে বর্ণিত বিভিন্ন চরিত্রের জন্মের ক্ষেত্রে কখনও সখনো সমকামিতারও আভাস মেলে, আবার কখনও একেবারেই প্রকৃতি নির্ভর; যেমন, সীতার জন্ম মাটি থেকে আর দ্রৌপদীর জন্ম যজ্ঞের অগ্নি থেকে। জরাসন্ধের জন্ম হয় দু-জন পৃথক নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া অর্ধ অংগবিশিষ্ট পৃথক সন্তানের সংমিশ্রণে। ইন্দ্র এবং স্কন্ধের মধ্যে যুদ্ধের সময় ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে স্কন্ধের দক্ষিন পার্শ্ব হতে জন্ম হয় বিশাখের। কার্তিকের” জন্ম হয় শিবের পুরুষরস অগ্নি পান করার ফলে। অয়াপ্পানের জন্ম হয় শিব ও বিষ্ণুর মিলনে। ২২৩ গণেশের জন্ম হয় আবার জন্মস্থলির বাইরে। দ্রোন কিংবা কৃপ-কৃপী কারো জন্মই স্ত্রী পুরুষের ‘স্বাভাবিক’ মিলনে হয়নি। বালখিল্য মুনিদের জন্ম হয়েছিল ব্রহ্মার লোম থেকে। নারী সমকামিতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে রামায়নে। সগরবংশীয় অংশুমানের পুত্র মহারাজা দিলীপ নিঃসন্তান হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন্ম রক্ষায় সমস্যা দেখা দেয়। শিব সে সময় আবির্ভূত হয়ে রাজার দু-জন বিধবা স্ত্রীকে আদেশ করেন সন্তান লাভের জন্য পরষ্পর দেহমিলন করতে। তাদের মিলনে সন্তান জন্মায় বটে কিন্তু সে সন্তান ছিল অস্থিহীন। পরে ঋষি অষ্টাবক্রের বরে সেই সন্তান সুস্থ এবং উত্তমাঙ্গ হন এবং ভগীরথ নামে রাজ্যশাসন করেন। নারী সমকামিতার আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে রামায়নে। কথিত আছে লঙ্কা পরিভ্রমনের সময় হনুমান রাবনের স্ত্রীগনের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থা চাক্ষুষ দেখেছিলেন। সমকামিতার উল্লেখ ছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে আমরা পাই লিঙ্গ-পরিবর্তনের কাহিনী। বিষ্ণুর মোহিনী অবতাররূপে ধরাধামে এসে শিবকে আকর্ষিত করার কাহিনী এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ ছাড়াও যে দুটো চরিত্র সবার আগে আলোচনায় আসবে তা হচ্ছে- মহাভারতের শিখন্ডী ও বৃহন্নলা। দ্রুপদপুত্ৰ শিখন্ডী পূর্বজন্মে ছিলেন অম্বা নামের এক নারী। মহাদেবের বরে তিনি পুরুষবেশে আবার মর্তলোকে জন্ম নিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন তাকে চিনতে পারলেন তখন ওর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে তিনি নারাজ হন। কারণ ভীষ্ম প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, তিনি নিরস্ত্র, ভূপাতিত, বর্ম ও ধ্বজহীন, বিকলেন্দ্রিয়, স্ত্রী কিংবা স্ত্রী নামধারী কারো সাথে যুদ্ধ করবেন না। শিখন্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন তার রথ পরিচালনা করেন এবং শরাঘাতে ভীষ্মকে ভূতলে ‘শরশয্যায়’ শায়িত করেন।
আর বৃহন্নলা হচ্ছে ক্লীবরূপী অর্জুন। এই ‘তৃতীয় প্রকৃতি’র রূপ অর্জুন পরিগ্রহ করেন যখন তিনি বনবাসে ছিলেন। তিনি বাইরে নারী, অন্তরে নর, আধুনিক ট্রান্সজেন্ডারের উদাহরণ যেন। এভাবেই তিনি বিরাট রাজের নগরে রাজকন্যা উত্তরা এবং অন্যান্য কুমারীদের জন্য নৃত্যগীতের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই সময় তার কানে দীর্ঘ কুন্ডল, হাতে শাখা আর সুবর্ণনির্মিত বলয় থাকতো। দুর্যোধন বিরাটরাজ্য থেকে গো-হরণ করলে বৃহন্নলা সেই গো-সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে উত্তরের সারথী হিসেবে যুদ্ধে যান। কিন্তু যুদ্ধের সময় এত বিপুল কুরু-সৈন্য দেখে উত্তর পালিয়ে যেতে চাইলে বৃহন্নলা তাকে নিবৃত্ত করেন এবং উত্তরকে তার সারথী করে নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং গো-সম্পদ উদ্ধার করেন।
বৌদ্ধ সাহিত্যে বিমলাকৃতিনির্দেশে একটি কাহিনী আছে, সেখানে বলা হয়েছে একজন বৌদ্ধভিক্ষু দেবীর দয়ালাভে নারীর রূপ গ্রহণ করেন। তারপর তাকে আবার পুরুষে পরিবর্তন করা হয়। দেবী তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে, নারীরূপ অধিকার করার পর বৌদ্ধভিক্ষু কি কোনোও রকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে? বৌদ্ধভিক্ষু উত্তরে জানালেন যে, তিনি তেমন আলাদা কিছুই উপলব্ধি করেন নি। দেবী তখন বললেন,
‘তুমি যেমন প্রকৃত নারী নও, কেবল নারীর রূপে ছিলে, তেমনি সকল নারীই সেরকম নারী রূপে থাকে, হয়ত আসলে সত্যিকার নারী নয়। তাই বুদ্ধ বলতেন, সত্যিকার নারী পুরুষ বলে কিছু নেই। .. সকল জিনিসই আসলে এরকমই – অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের মিলনমেলা”।
উপরের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায় যে, শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্কটিই ‘স্বাভাবিক” বলে মেনে নেয়া হয়নি, তারপাশাপাশি সমপ্রেমকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই হয়ত থেরাবেদে বলা হয়েছে, সমকামিতা কিংবা বিপরীতরতি পুরোটাই দু-জন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনুচ্ছার উপর নির্ভরশীল, এ তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। যদি এ সম্পর্ক তাদের মধ্যে আনন্দ ও নির্ভরতা প্রদান করতে পারে তাহলে একে সবারই মেনে নেওয়া উচিত।
জৈন সাহিত্যে স্ত্রীনিরবাণপ্রকারণ (Strinirvanaprakaran) মহা-দার্শনিক সকতয়ন বলেছেন, যে-কোনোও মানুষ সমপ্রেম উপলব্ধি করতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, পৃথিবীতে তিন প্রকার আকাংক্ষা আছে- পুরুষ, নারী ও তৃতীয়-লিঙ্গ। তৃতীয়-লিঙ্গ সম্বন্ধে পতাঙ্গুলির ব্যাকরণ ও জৈন সাহিত্যে বোঝানো হয়েছে যে, এরা ক্লীব, পণ্ডক ও নাপুঞ্জক; তিন হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে সামাজিক প্রথা হিসেবে এদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। পালি ভাষায় রচিত মণিকণ্ঠ জাতককে এক রাজার ধর্মাশ্রমের এক তরুণ ভিক্ষুর সঙ্গে প্রেমে পড়ার কাহিনী উল্লিখিত আছে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ তে সমকামিতার ওপর একটি গোটা অধ্যায় নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কামসূত্রেও লিঙ্গকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- পুং-প্রকৃতি, স্ত্রী-প্রকৃতি ও তৃতীয়া-প্রকৃতি; অর্থাৎ পুরুষ, নারী ও তৃতীয়-লিঙ্গ। তৃতীয়া-প্রকৃতি বলতে বাৎস্যায়ন সমকামিতা বা সমপ্রেমকে বুঝিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন কীভাবে সে-সময়ের সমকামী পুরুষরা চুল-কাটার দোকানে উপস্থিত হয়ে নিজের আকাংখা মিটাতো। সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায় সংস্কৃতভাষায় রচিত বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্রেও।
Theravada বৌদ্ধধর্মের একটি প্রাচীন শাখা। আক্ষরিক অর্থ –‘প্রাচীন জ্ঞান’। ভারতে এক সময় এর উন্মেষ ঘটে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, বার্মা এবং চীনের কিছু অংশে এই শাখার অনুসারী এখনো বিদ্যমান।
Callisto Radiant, Mohini Lord Vishnu in female form,
http://www.transpiritual.com/ 25.html মহাভারত, বিরাট পর্ব।
তিনি দশ দিন ধরে যুদ্ধ করে প্রতিদিন পান্ডবদের দশ সহস্র সৈন্য ও সহস্র রথীকে বধ করেছিলেন। যুদ্ধের দশম দিনে পান্ডবেরা নিরুপায় হয়ে ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাকে বধের উপায় জানতে চাইলে তিনি পান্ডবদের নিজের মৃতুর উপায় বাতলে দেন।
Mahabharat, Sage Vyas.
রাজা রামের স্ত্রী এবং মিথিলার রাজা জনকের কন্যা। হাল দিয়ে যজ্ঞভূমি কর্ষণ করার সময় জনক একে সীতা বা লাঙ্গলের রেখায় প্রাপ্ত হন বলে তার নাম রাখেন সীতা
পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হিসেবে মহাভারতে চিত্রায়িত। তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভুত কন্যা।
কার্তিক হলেন মহাদেব এবং পার্বতীর পুত্র। কথিত আছে মহাদেব অগ্নির শরীরে প্রবেশ করে এই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কার্তিকের জন্ম সম্বন্ধে লিখিত আছে যে, পার্বতীর সাথে বিহার কালে মহাদেবের তেজ পৃথিবীতে পতিত হয়। পৃথিবী এই তেজ ধারণ করতে না পেরে অগ্নিতে নিক্ষেপ করেন। অগ্নি আবার ভয়ে এই তেজ শরবনে নিক্ষেপ করেন। শরবনে এই বীর্য একটি সুন্দর বালকের সৃষ্টি করে। তিনিই কার্তিক।
বিষ্ণু অবশ্য তখন মোহিনী রূপে ছিলেন। কিন্তু শিব তো সবই জানতেন; কারণ তিনি মহাশক্তির অংশ। তাঁর অজানা কিছুই থাকতে পারে না। বিষ্ণু (হরি) এবং শিবের (হর) মিলনের ফসল অয়াপ্পানকে হরিহরপুত্র নামেও সম্বোধন করা হয়।
Shiv Puran দ্রঃ
অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ ষাট হাজার ঋষি। ঋগবেদের উল্লেখ-অনুসারে এরা ব্রহ্মার লোম হতে উদ্ভুত মানসপুত্র।
মহারাজা দিলীপ ছিলেন রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ।
Ruth Vanita and Saleem Kidwai, Same-Sex Love in India Reading from Literature and History, Macmillan India Ltd.
Ruth Vanita and Saleem Kidwai, পূর্বোক্ত।
খাজুরাহ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্দিরে সে-সময়কার মিথুনমূর্তিগুলো পরিদর্শন করলে বেশ কিছু সমপ্রেম বিষয়ক বহু মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু সমপ্রেম নয়, পাওয়া গেছে শিব এবং দুর্গার সমন্বয়ে গঠিত একক মূর্তি। এই মুর্তির মহেশ্বর অর্ধ দিকে নারী এবং অপর দিকে নয়।
শুধু ধর্মীয় পুরাণ কিংবা গ্রন্থেই নয়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায় উর্দু এবং পার্শী ভাষায় লেখা বহু রচনায়। তার মধ্যে আমীর খসরু, জিয়াউদ্দিয়া রারানি, জামশেদ রাজগিরি, মুত্রিবি, হাকিকাত-আল-ফুকারা, মুহম্মদ আকরাম, সিরাজ আব্দুল হাই, দরগাহ কুয়ালি খান, মীর তাকি প্রমুখ অন্যতম।
আমীর খসরু (১২৫৩-১৩২৫) ছিলেন ভারতের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি এবং গীতিকার। তাকে কাওয়ালী গানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমীর খসরুর হিন্দাভী কাব্যে সমকামিতার প্রভাব স্পষ্ট। তার অনেক কবিতায় প্রেমের নৈবদ্য উৎসর্গীকৃত হয়েছে পুরুষকে উদ্দেশ্য করে। আমীর খসরুর একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ এরকম –
Tonight I heard that he whom I want to see will come-
May my head be sacrificed to the road you will take.
The gazelles in the desert carry their heads in their hands,
Hoping that you will come hunting them one day.
The attraction of love will not leave you unaffected –
If you don’t come to my funeral you will come to my grave.
My soul has reached the edge; come so that I may live.
Once I am no more, what use will it be if you come.
আমীর খসরু ছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রিয়শিষ্য। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক বন্ধুত্বেরও অনেক বেশি। তিনি গুরু আওলিয়ার মৃত্যুতে যথার্থই ভেঙে পড়ে লিখেছিলেন –
The beauty sleeps on the bridal bed, her tresses all over her face;
Come Khusro, let’s go home, for darkness settles all around.
Looking at the empty bed, I weep day and night
Every moment I yearn for my beloved, cannot find a moment’s peace.
He has gone, my beloved has crossed the river,
He has gone across, and I am left behind.
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে হৃদয়ের বিচ্ছেদ সামলাতে না পেরে আমীর খসরুও মারা যান নিজামউদ্দিন মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই।
মুত্রিবি (আসল নাম সামারকান্দ) সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে (১৬০৫-১৬২৬) পারস্য থেকে ভারতে আসেন। তার কবিতাতেও সমকামিতার প্রসঙ্গ ধরা পড়েছে খুব পরিষ্কার ভাবেই
A Hindu boy stole my wretched heart
He stole its tranquility and its calmness
My reason, my judgment, any endurance, my patience
All of these he stole with his laugh.
ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনামলে দিল্লিতে সমপ্রেমিকদের রাজ-দরবারে অবাধ গতিতে আসা-যাওয়া ছিল। সমান্তরাল যৌনতা এ সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে কবি মুকারম বক্স ও মোক্কারোম এর প্রসঙ্গ। কবির মৃত্যুর পর ৪০ দিন তাঁর প্রেমিক শোকযাপন করেছিলেন, বিধবার মতো। আর সূফিদের প্রসঙ্গ সম্বন্ধে সকলই মোটামুটি অবগত। তাদের আধ্যাত্মিক গান ও সাহিত্য স্বর্ণস্তবক হয়ে আছে। সূফি কবি আবরু” তো বিপরীতরতিকে সমকামিতাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন,
‘He who prefers a slut to a boy, is no lover, only a creature of lust.’
শেখ খলন্দর বক্স নারীর সমপ্রেমকে কবিতায় স্থান দিতে গিয়ে লিখেছিলেন,
I’d sacrifice all men for your sake, my life,
I’d sacrifice a hundred lives for your embraces
How beautiful is it when two vulvas meet – […]
The way you rub me, ah! […]
When you join your lips to my lips,
If feels as if new life pours into my being,
When breast meets breast, the pleasure is such
That from sheer joy the words rise to my lips:
The way you rub me, ah! […]
How can I be happy with a man as soon as he sits by me
He starts showing me a small think like a mongoose –
I’d much rather have a big dildo
And I know you know all that I know […]
ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতা খুঁজে আরও কিছু উদাহরণ করা যাক –
সুলতান মাহমুদ (৯৭১ – ১০৩০) ছিলেন গজনীর সুলতান এবং ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। এক সময় আফগানিস্তানের গোঁড়া মুসলিম পরিবারে জন্মানো এই অসম সাহসী সৈনিক ১০০১ থেকে ১০২৬ সালের মধ্যে সতেরো বার ভারত আক্রমণ করে লাহোর, সোমনাথ এবং পাঞ্জাব এলাকা নিজদের দখলে নিয়ে আসেন। ছোট্ট এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে একটা সময় তিনি বর্তমান কালের আফগানিস্তান, ইরান এবং পাকিস্তান পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করে ফেলেন। তবে তিনি কেবল বিরাট যোদ্ধাই ছিলেন না, সেই সাথে ছিলেন শিল্প সংস্কৃতির বিরাট সমঝদার। বড় বড় কবি সাহিত্যক নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সুলতানের সাথে আয়াজ মালিক নামে এক কিশোর ভৃত্যের প্রেমের সম্পর্ক। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ইসলামী সাহিত্যের এক প্রসিদ্ধ উপাখ্যান। কথিত আছে, আয়াজের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা সুলতান মাহমুদকে পরিণত করেছিল ‘দাসেরও দাস’ (a slave to his slave) হিসেবে। ভালোবাসার স্বীকৃতি স্বরূপ সুলতান আয়াজকে ভৃত্য থেকে নিজের সেনাবাহিনীতে স্থান করে দেন, এবং আয়াজ যুদ্ধে পারদর্শীতা দেখিয়ে এক সময় সিপাহসালাহরের পদে উন্নীত হন। ১০২১ সালে সুলতান আয়াজকে লাহোরের নবাবে ভূষিত করেন। শুধু তাই নয়, সুলতান তার জীবনের শেষ দিনগুলোর বেশিরভাগই আয়াজের সাথে কাটিয়েছিলেন। বিখ্যাত কবি আত্তার নেশপুরী (১১৪৫-১২২১) তার ইলাহীনামায় বর্ণিত আটটি গল্পে সুলতান এবং আয়াজের এই প্রেমের কাহিনী তুলে ধরেন। এছাড়া কবি শেখ সাদী এবং আলাম্মা ইকবালের কবিতাতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
সুলতান কুতুবুদ্দিন খিলজি, তার পিতা আলাউদ্দিন খিলজির মতো কৃতদাসের সঙ্গে সমপ্রেমে আবদ্ধ হন। কুতুবুদ্দিনের সমপ্রেমিক ছিলেন খসরু খান। সভা- কবি লিখেছেন,
He often wanted to put a sword through the Sultan and kill him while he was doing the immoral act of publicly kissing him. This vile murderer of his father was always thinking of ways to kill the Sultan. Publicly he offered his body to the Sultan like an immoral and shameless woman. But within himself he was seething with anger and choking on a desire for revenge at the way the Sultan forced himself upon him and took advantage of him.
বৃহষ্পতি মিশ্রের ‘স্মৃতিরত্নহার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জগদত্তের পুত্রকে সেনাপতির পদে নিযুক্ত করেছিলন জলালুদ্দিন। আর তাদের বন্ধুত্ব সুগভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে জলালুদ্দিন বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। উপহার সরূপ হাতী, ঘোড়া, সোনা, রুপা প্রভৃতি প্রদান করেছিলেন। এমনকি শঙ্খধ্বনিতে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল।
সুলতান মোহাম্মদ মীর্জা সম্বন্ধে সম্রাট বাবরের আত্মজীবনিতে বলা হয়েছে যে, তিনি তাঁর সুন্দর ছেলে সন্তানগুলোকে তাঁর ‘হুর-হারেমে’ ভর্তি করেন। বাবর নিজেও সুন্দর যুবক দলের সঙ্গ পছন্দ করতেন। এ প্রথা তাঁর রাজ্য জুড়ে উঁচ্চবিত্ত সমাজে প্রচলিত ছিল। সম্রাট বাবর লিখেছেন,
Ruth Vanita and Saleem Kidwai, পূর্বোক্ত।
Pen name of Najmuddin Shah Mubarak. He came from a family of Sufi saints and scholars. A modern critic described him as the chief of boy-worshippers.
সমপ্রেম একটু আভাস, হিমেল সাগর, পূর্বোক্ত।
Encyclopædia Britannica. 2006. Encyclopædia Britannica Online, 2006; Also see Malik Ayaz in Wiki http://en.wikipedia.org/wiki/Malik_Ayaz
Čištī, `Abd al-Rahmān, The History of India, Volume 2, chpt. 134
Tuzk-I-Baburi, autobiography of Babur, founder of the Mughal Empire in India (15th century).
Tuzk-I-Baburi, পূর্বোক্ত।
I maddened and afflicted myself for a boy in the camp-bazaar, his very name, Baburi, fitting in. Up till then, I had had no inclination for any-one, indeed of love and desire, either by hear – say or experience, I had not heard, I had not talked. … One day during that time of desire and passion when I was going with companions along a land and suddenly met him face to face. I got into such a state of confusion that I almost went right off. To look straight at him or to put words together was impossible. With a hundred torments and shames, I went on.
আলী আদেল শাহ সুন্দর সমপ্রেমিক পুরুষ ও যুবক সুংগ্রহ করতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাদের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি আমির আল-বুরাইদকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান যে, আমিরের দরবারে রক্ষিত সুন্দর দুটো সমপ্রেমিক ছেলেকে যেন অতি তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু আমির তাঁর ছেলে দুটোকে আলী আদেল শাহকে পাঠাতে অনুচ্ছিক থাকায় পাঠাননি। পরবর্তিতে যখন মোরতাজাহ নাজিম শাহ বেহারির সঙ্গে যুদ্ধ বাধে আমির আল-বুরাইদের, তখন দু-হাজার সৈন্য দিয়ে আলী আদেল শাহ তাঁকে সাহয্য করনে। যুদ্ধ শেষে আমিরের দরবারে রক্ষিত ‘সুন্দর দুটো ছেলে’কে উপহার দেন আদেল শাহকে।
আধুনিক বাংলা ও অন্যান্য সমসাময়িক সাহিত্যে সমকামিতা বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম কোনো লেখক ‘সমকামিতা’কে সাহিত্যের বিষয়বস্তু করে তুলেছিলেন তা আজ নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বাংলা আধুনিক সাহিত্যে প্রথমসারির লেখকদের মধ্যে যারা সপ্রথম সমপ্রেম নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন যোগেন্দ্রচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘দুই বন্ধু’ (১৮৫৬) গল্পে সুখ-স্পর্শ, বিরহ-বিধুর, হৃদয়-স্নিগ্ধ করা দু-জন বন্ধুর প্রেমের কথা বলা হয়েছে। গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকার কার্ত্তিক সংখ্যায় নীলিমা বসু ‘ঝরাফুল’ নামে একটি গল্পে সমকামিতাকে উপজীব্য করে তুলেছিলেন”। এরপর বাংলাদেশের মাহবুব উল হকের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মফিজন’ এ সমকামিতা অত্যন্ত সূক্ষভাবে হলেও উঠে এসেছে। ১৯৫১ সালে কমল কুমার মজুমদার চতুরঙ্গ পত্রিকার বৈশাখ-আশ্বিন সংখ্যায় ‘মল্লিকা বাহার’ গল্পে স্ত্রী- সমকামিতাকে বিষয় হিসবে নিয়ে আসেন। এখানে গল্পটির শেষাংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো –
শোভনা আপনার মধ্যে মল্লিকাকে এনেছে, সোহাগ করে মালা পরিয়ে দিয়েছে, সে মালা তার কন্ঠে বিলম্বিত চুম্বনে চুম্বনে শোক ভুলিয়ে দিয়েছে। এবার শভনা খাদের গলায় বললে, ‘কই তুমি তো আমায় খেলে না। তুমি আমায় ভালোবাসো না?’ ‘বাসি!’ মল্লিকা শোভনাকে গভীর অপ্লুতার সঙ্গে গভীর ভাবে চুম্বন করলে। শোভনা জিজ্ঞাসা করলে – ‘আগে কাউকে কখনো এমনভাবে …’ ‘হ্যা … আচ্ছা, আপনি?’ ‘আমায় তুমি বলো, আমি তমার কে? বলো?’ ‘আচ্ছা, তুমি?’ ‘না’, দৃঢ় কন্ঠে শোভনা বললে, বধ হয় মিথ্যা। হেসে বললে, ‘আমি তোমার স্বামী তুমি-‘ ‘বউ’ শুনে শোভনা আবেগে চুম্বন করলে।
কমল মজুমদারের আগেও স্ত্রী সমকামিতাকে নিয়ে গল্প লিখেছিলেন জগদীশ গুপ্ত। বস্তুত সময়ের সাথে সাথে সমকামিতা নানাভাবে বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। দু-পার বাংলাতেই সাহিত্যিকেরা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে যৌনতার এই বিশেষ প্রবৃত্তিটি সাহিত্যে তুলে এনেছেন। এ প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ইমদাদুল হক মিলন, শামসুর রাহমান, পারভেজ হোসেন, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, মহম্মদ নুরুল হুদা, রোকন রহমান, সুমন লাহিড়ী, আব্দুর রউফ চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখ্য। এ ছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘উৎসব’ গল্পে সমকামী পুরুষ যৌনকর্মীদের জীবনের কথা বিধৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নলিনী বেরার অপৌরুষেয়, কবিতা সিংহের পৌরুষ, সমরেশ মজুমদারের ‘আমার আমি’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রকাশ্য দিবালোক’ প্রমুখ সাহিত্যকর্মে সমকামিতা স্থান করে নিয়েছে। সম্প্রতি তিলোত্তমা মজুমদার ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ উপন্যাসে নারী সমকামিতার সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বাংলা কবিতাতেও বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে সমকামিতা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের ‘নির্বাসিত কবি’ দাউদ হায়দারের ‘সমকামী কয়েদী’ এই বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। অসীম সাহসিকতার সাথে কবি দাউদ হায়দার গরাদের অভ্যন্তরে সমকামী জীবনের এক বাস্তব চিত্র এঁকেছেন কবিতাটিতে –
অতঃপর গরাদ বেয়ে রাত্রি গভীর হলো। যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে।
কখন যেন নিভে গেছে বাতি। আশে পাশের রাস্তায় চীৎকার নেই।
কোলাহল মানুষেরা ফিরে গেছে ঘরে। নিঃশব্দ চারিদিকে;
কেবল মাঝে মাঝে দু একটা হুইসেল; ঘণ্টার ঢং ঢং দীর্ঘশ্বাস!
রাত্রি গভীর হলো; সমকামী-কল্যানে কয়েকজন তখনো জেগে-
যেন তীব্র মধুর সম্ভোগে ভরে দেবে ভুবন! -আর চোখে চোখে বেছে
নিল পুষ্ট বালক; রাত্রি গভীর হোক চরিতার্থ করা যাবে অমল বাসনা।
মূলত এই আমাদের ইন্দ্রিয় স্বদেশ, বিরাট ব্যাপ্তি -আমাদের
মস্তিষ্কে অবিরাম বিস্ময় আর অতিরঙ্গ সীমানা; অর্থাৎ প্রয়োজন
নেই কোনো নারী নাভীমূল স্তন সমুদ্রদীপ্তি -আমাদের চোখের তারায়
হা-মুখ যোনী নয়, শুধুমাত্র চপল সৈকত।
কোনো কথা নেই, কেবল রূপান্তরের লাস্যময় ডুপের বাউল রাক্ষস আর,
হঠাৎ রক্তিম চুম্বনে ভরে তোলে অমল গুণ্ঠন, শোনিকের গন্ধ আর
ঘূর্ণিত পিছল ছুরিকা !
বালক ঘুমিয়েছিল, হঠাৎ জেগে দেখে ঈশ্বর শুধু উত্থান
পতনে -আদর্শ-দংশনে বিক্ষত করছে নেপথ্য গহবর – কিছুই বলার
নেই, চকিত কেবল বাহুপাশে আবদ্ধ করে নিষ্ফল নিখিল, বন্দী
যৌবন !
Tarekh-I-Farishtah, Mohammed Qasam Farishtah, 16th century.
সমপ্রেম একটু আভাস, হিমেল সাগর, পূর্বোক্ত।
অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু, সমপ্রেম, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৫।
একইভাবে কবি দাউদ হায়দারের মতো সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, শফিক শাহীন এবং সেলিম মোজাহারের কবিতায় বিচ্ছিন্নভাবে সমকামিতা ধরা পড়েছে। নারী সমকামিতা এসেছে তসলিমা নাসরীনের কিছু লেখায় এবং কবিতায়। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামের আত্মজৈবনিক উপন্যাসে তসলিমা কিশোর বয়সে তার বালিকা বন্ধু রুণির প্রতি গভীর ভালোবাসার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুরুষদের যৌন অত্যাচার আর লৈঙ্গিক বৈষম্যে অতীষ্ট পাশ্চাত্যের অনেক নারীবাদিরা এক সময় পুরুষের যৌনাঙ্গকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। তারা যৌনসঙ্গমে পুরুষের যৌনাঙ্গ নারীর যোনিতে অনুপ্রবেশকে প্রভুত্বের সমার্থক মনে করেছিলেন। সেই একই প্রনোদনা লক্ষ্য করা যায় তসলিমার লেখনীতেও। পুরুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ‘নারীবাদী তসলিমা’ নারীদের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করেন তার কবিতায় এভাবে-
যেহেতু নারীরাই দেখতে জানে পালকের মতো খুলে খুলে ক্ষত,
নারীকেই নামাতে হবে ঠোঁট চুম্বনের জন্য স্তনে
নারীকেই মেলতে হবে যোনিফুল নারীর সজল আঙ্গুলে
নারী ছাড়া কার সাধ্য নারীকে আমূল ভালোবাসে।
নারীসমকামিতা প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে উর্দু লেখক ইসমত চুঘতাইয়ের অবিশ্বরনীয় ছোটগল্প ‘লিহফ’ (লেপ) -এর কথা। একটি বাচ্চা মেয়ের জবানিতে বলা এই কাহিনীটি উপমহাদেশের লেসবিয়নিজম সংক্রান্ত হাতে গোনা গল্পের একটি। গল্পের শেষ অঙ্কে এক বিরাট লেপের তলায় মনিবিনী ও পরিচারিকার যৌনক্রিয়ার রহস্যময় ওঠাপড়া দেখে ভীত বালিকার মনে হয় যেন কোনো মত্তহস্তীর আস্ফালন। ভারতীয় সংস্কৃতির জগতে সমকামিতার অবস্থাও অনেকটা চুঘতাইয়ের লেপের তলায় হাতীর মতোই – রহস্যময়, ভীতিপ্রদ ও সম্পূর্ণ লোকচক্ষুরহিত।
সমকামী উর্দু সাহিত্যের কথা বললে পাকিস্তানি সমকামী কবি ইফতি নাসিমের অবদানের কথা বলতেই হবে। প্রথমে উর্দু ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করলেও বর্তমানে ইংরেজি ভাষায় লিখতে শুরু করেছেন। সমকামী জীবনের নানা অবস্থা এবং সঙ্কটের কথাই তার কবিতায় স্থান পায়। যেমন তার বাবাকে নিয়ে ‘মেরে বাবা” নামে একটি কবিতায় ইফতি বলেন –
Mere Baba
sab kahte haiN merii shakl aap se miltii jultii hai
merii aankheN, merii peshaanii, mere hoNT
meraa lahjaa, baateN karne kaa andaaz
uThne, baiThne, chalne phirne ka andaaz
mere hoNToN kii harkat
sab kuchh aap hii jaisaa hai
maiNne sunaa hai beTaa
baap kii nasl kaa vaaris hotaa hai
mere zehn meN ek savaal ubhartaa hai
maiN jo bilkul aap par huuN
to phir merii tarjiih-e-jins aapse kyuuN is darja alag hai?
অনুবাদ –
বাবা আমার, সবাই বলে আমার চেহারার সাথে নাকি তোমার অদ্ভুত মিল
আমার চোখ, কপাল, ঠোঁট, আমার উচ্চারণ, আর যেভাবে আমি কথা বলি
যেভাবে বসি, যেভাবে হাটি
আমার হাতের নড়াচড়া, সবকিছুই নাকি তোমার মতো।
আমি শুনেছি সন্তানের মধ্যে নাকি বয় বাবার রক্তের স্রোতধারা
আমার মনে প্রশ্ন আসে – সব কিছুই যদি আমার তোমার মতোই হবে
তবে আমার যৌনপ্রবৃত্তি তোমার চেয়ে এতটাই আলাদা হলো কেন?
যশোধরা বাগচী, যৌনতা : নারীবাদের আলোয়, যৌনতা ও সংস্কৃতি; সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী; পুস্তক বিপনী, ২০০২
সমকামী কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে ইফতিকে যে চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। ১৬ বছর বয়স থেকে ইফতি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গজল লেখা শুরু করেন। কিছু কিছু গজলের মধ্য দিয়ে তিনি তার সমকামী মননের যন্ত্রণা ও অসহায়ত্বকে তুলে ধরেন। কিন্তু পাকিস্তানি সমাজের রক্ষণশীলতা অনেক ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও কবিতা এবং গজলকে হাতিহার করে নাসিম সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ‘নারমান’ নামে একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘নারমান’ ফার্সি শব্দ। এর অর্থ অর্ধনারীশ্বর। এই বইয়ের কবিতার দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে সমকামিতা আর সমপ্রেম। ‘আহ্বান’ (come) নামে একটি ইংরেজি কবিতা এ’রকম-
Come
and lie down next
to me
play with my hardy chest
and let me
search for the gazelles I lost with time
in the thick jungle of hair
On your chest; in my search
I crossed the line of childhood to puberty.
Come look to me
and look into my eyes
We are the rescuers of
Noah’s ark thrown back into the sonny sea, guilty of
same-sex love.
তাছাড়া কথাসাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টোর কথাও বলা যায় যিনি তার সাহিত্যে যৌনতার অভিযোগে বহুবার আদালতের সম্মুখীন হন এবং অর্থ জরিমানাসহ কারাদণ্ড পর্যন্ত ভোগ করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর উর্দুভাষার রেখতি কবিতায় (Rekhti Poetry) নারী সমকামিতার ঢালাও উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে গবেষকরা সন্দেহ করেন এ সমস্ত কবিতার অধিকাংশই সম্ভবতঃ পুরুষদের লেখা – এগুলো লেখা হয়েছে পুরুষ কবিদের দ্বারাই – ‘নারীসুলভ অলঙ্কার’ ব্যবহার করে। সমকামিতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিদর্শন আছে নাজির আকবরাবাদির উর্দু কবিতায় কিংবা উড়িয়া ভাষায় লেখা গোপাবন্ধুদাসের জেলখানায় লেখা কবিতায়। পুরুষ সমকামিতার প্রাথমিক প্রকাশ পাওয়া যায় ১৯২০ সালে প্রকাশিত পান্ডে বেচান শর্মা (ছদ্মনাম উগ্র)’র হিন্দি ছোট গল্প ‘চকলেট’-এ। এই ছোটগল্পগুলো সে সময়ের পরিবেশ এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অনন্যসাধারণ হিসবেই গন্য হবার যোগ্য। তার ছোটগল্পগুলো সেসময় ভারতের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক তৈরি করে – সে বিতর্কে অংশগ্রহণ করা থেকে মুন্সি প্রেমচাঁদ থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত কেউই বাদ যায়নি। সমকামিতা আছে ফিরাক গোরাখপুরির কবিতায়, সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’র উপন্যাস ‘খুলি ভাট’-এ। সমকামিতার নিদর্শন আছে হিন্দি ভাষায় লেখা রাজেন্দ্র যাদবের ‘প্রতীক্ষা’ তে, চিত্রশিল্পী ভূপেন খাক্করের গুজরাতি ছোটগল্পে, আর কিশোরী চরণ দাসের উড়িয়া গল্পে। সমকামিতার উল্লেখ আছে মালায়ান ভাষায় লেখা ভি.টি নন্দকুমারের ‘দুই নারী’তে। রাজস্থানী ভাষায় লেখা ‘দোহরি জুন’ (দুই জীবন) নামের ছোটগল্পে নারী সমকামিতা এবং উভকামিতাকে নিয়ে এসেছেন পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত রাজস্থানী লেখক বিজয় দান দেত্তা। সমকামিতা এবং উভকামিতাকে বিষয়বস্তু করে লিখেছেন ভারতীয় কবি এবং ঔপন্যাসিক বিক্রম শেঠ। তার একটি ইংরেজি কবিতা Dubious এরকম-
Some men like Jack
and some like Jill; I’m glad I like
them both; but still
I wonder if this freewheeling really is an
enlightened thing –
or is its greater scope a sign
Of deviance from some party line?
In the strict ranks
of Gay and Straight
What is my status:
Stray? Or Great?
সমকামিতা প্রসঙ্গ প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্যভাবে এসেছে মারাঠি ভাষায় নির্মলা দেশপান্ডে কিছু ছোটগল্পে। মারাঠি ভাষায় লেখা বিজয় তেন্ডুলকারের নাটিকা মিত্রাচবি গোস্তা (মিত্রার গল্প) নারী সমকামিতাকে প্রাধান্য দিয়ে লেখা উপমহাদেশের গুটিকয় নাটিকার অন্যতম। সমকামিতার উল্লেখ আছে সি.এস. লক্ষ্মী (আম্বাই)-এর তামিল সাহিত্যে আর সুকিরাতের পাঞ্জাবী সাহিত্য ‘নির্বাসন’-এ। পশ্চিমের মতো ব্যাপক আকারে না হলেও উপমহাদেশের লেখক এবং সাহিত্যিকেরা সব সময়ই সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরতে সমকামিতা সহ অন্যান্য যৌনপ্রবৃত্তিকে তাদের সাহিত্যে তুলে এনেছেন। সমকামী মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের হাওয়াও ক্রমশ লাগতে শুরু করেছে আমাদের সাহিত্যের বাতায়নে। ইন্টারনেট এবং বাংলা ব্লগস্ফিয়ারগুলোতে এ সংক্রান্ত লেখা এবং আলোচনা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আশা করা যায় আগামী বছরগুলোতে এ সাহিত্য চোরা গোপ্তা পথে না চলে সাহিত্যের মূল স্রোতধারায় প্রবেশ করে যাবে।
Ruth Vanita, “Married Among Their Companions”: Female Homoerotic Relations in Nineteenth-Century Urdu Rekhti Poetry in India, Journal of Women’s History – Volume 16, Number 1, Spring 2004, pp. 12-53
Pandey Bechan Sharma ‘Ugra’ Translated from Hindi and with an Introduction by Ruth Vanita Chocolate and Other Writings on Male – Male Desire, Hardcover (Edition: 2006),
Ruth Vanita and Saleem Kidwai, পূর্বোক্ত।
♦ রূপান্তরকামীতা আর উভকামিতার জগৎ
♦ গবেষণার রুদ্ধ দুয়ার খুললেন যারা
♦ গে মস্তিষ্ক এবং গে জিনের খোঁজে
♦ সমকামিতা কি কোনো জেনেটিক রোগ?
“সমকামিতা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ