অগ্নি আবিস্কার

আজকাল অগ্নি উৎপাদন করা আমাদের কাছে একান্তই খেলো। বিজ্ঞানের বদৌলতে রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক নানা উপায়ে অগ্নি উৎপাদন করা হইয়াছে একান্ত সহজ। একটি দেশলাই পকেটে ফেলিয়া উহা দ্বারা মুহুর্মুহু আমরা অগ্নি উৎপাদন করিয়া থাকি। কিন্তু আদিম মানবদের এইসকল সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তখন অগ্নি উৎপাদন করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

অগ্নি দুই প্রকার –প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম।

প্রাকৃতিক অগ্নি

 বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সূর্য একটি অগ্নিপিণ্ড এবং পৃথিবী উহারই একটি অংশ। আদিতে এই পৃথিবীটিও অগ্নিময় ছিল এবং উহা নির্বাপিত হইতে সময়.লাগিয়াছিল লক্ষ লক্ষ বৎসর। ভূপৃষ্ঠ এখন ঠাণ্ডা হইয়া জীববাসের যোগ্য হইয়াছে এবং নানা রকম জীব বাস করিতেছে। ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও সেই আদিম অগ্নির নামগন্ধও নাই। তবে সেই আদিম অগ্নির বীজ এখনও সুপ্ত আছে পৃথিবীর কেন্দ্রপ্রদেশে এবং উহার সাক্ষাত পাই আমরা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে। কিন্তু সেই অগ্নি মানুষের স্বার্থের অপেক্ষা অনর্থই ঘটায় বেশি।

এককালে পৃথিবীর অনেক জায়গাই ছিল ঘন বনে আবৃত। লোকবৃদ্ধির সাথে সাথে ভূপৃষ্ঠ ক্রমশ বনশূন্য হইতেছে। সেকালে কোনো কোনো সময় বনমধ্যে কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণের ফলে হঠাৎ আগুন জ্বলিয়া উঠিত এবং তাহাতে বনকে-বন জ্বলিয়া ছারখার হইয়া যাইত ও বনের পশু পাখিরা জ্বলিয়া-পুড়িয়া মারা যাইত। উহাকে বলা হইত দাবানল। দাবানল এতই উগ্রমূর্তি ধারণ। করিত যে, মানুষ বা কোনো প্রাণীই উহার কাছে ঘেঁষিত না। মহাভারতে উক্ত আছে যে, ঐরূপ একটি দাবানলে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটস্থ খাণ্ডব বন দগ্ধ হইয়াছিল। খাণ্ডব অধুনা মধ্যপ্রদেশের নিমার জিলার প্রধান নগর। প্রবাদ আছে যে, ঐখানেই খাণ্ডবদাহ হইয়াছিল। সে যাহা হউক, দাবাগ্নি মানুষের কোনো উপকারে আসে না।

প্রাকৃতিক অগ্নির আর একটি উৎস হইল উল্কা। উল্কারা পতনের সময় বায়ুর ঘর্ষণে জ্বলিয়া উঠে এবং কোনো কোনো সময় উহারা প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় ভূপতিত হয়। কিন্তু উহা এতই ক্ষণস্থায়ী যে, কোনো মানুষ উল্কার আগুনের নাগাল পায় না।

উল্কাপাতের ন্যায় বজ্রপাতও ভূপৃষ্ঠে অগ্নি বহন করিয়া আনে। কিন্তু উহাও মানুষের কোনো উপকার করে না, করে শুধু অপকার। তবে বর্তমানে কোনো কোনো বিজ্ঞানী কৃত্রিম বজ্রপাতের দ্বারা ভূমি উর্বরা করিবার গবেষণা চালাইতেছেন।

কৃত্রিম অগ্নি

 সচরাচর আমরা যে আগুন ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা হইল কৃত্রিম আগুন। এই আগুন কখন কাহারা আবিষ্কার করিয়াছিল, তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই। মানব সভ্যতার একটি প্রধান ধাপ আগুনের আবিষ্কার।

পুরাতত্ত্ববিদগণ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষ এককালে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করিত। একখানা পাথরকে আর একখানা পাথর দিয়া ঠুকিয়া ঠুকিয়া মনের মতো আকার দেওয়া বা দেওয়ার চেষ্টা করা হইত। পাথরে পাথর ঠুকিলে অনেক সময় তাহা হইতে ফুলকি নির্গত হইয়া থাকে এবং উহা ঐ সময়ও হইয়াছিল। বোধ হয় যে, ঐ রকম ফুলকিকে ভিত্তি করিয়া বা কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণ করিয়া পুরানো পাথর যুগেই আগুনের আবিষ্কার হইয়াছিল।

আগুন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ মানুষ’ নামের অধিকারীই ছিল না। তখনকার মানুষদিগকে বলা যাইতে পারে– দ্বিপদ পশু না হইলেও দ্বিপদ জানোয়ার; কেননা, আগুন আবিষ্কারের পূর্বে বা কিছুকাল পরেও উহারা মাছ-মাংস কাঁচাই ভক্ষণ করিত। আদিম মানুষদের মাছ-মাংস কাঁচা ভক্ষণ করা যে কতটুকু কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা ভাবাও সহজ নহে। মাছগুলিকে না হয় আঁচড়াইয়া-কামড়াইয়া থেঁতো করিয়া কোনো রকম উদরস্থ করা যাইত, কিন্তু গণ্ডার, ভালুক ইত্যাদি বড় বড় জন্তুগুলির চামড়া বা মাংস ছেঁড়া বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশেষত হাতের ও সঁতের জোর ভিন্ন হাতিয়ারের জোর পাথর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তথাপি যে রকম করিয়াই হউক, উহারা যে ঐসকল জন্তুর মাংস ভোজন করিত, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। আদিম মানবদের আস্তানার কাছাকাছি ঐ জাতীয় জন্তুদের হাড়গোড় দেখিয়া।

ফুলকির আগুনের দ্বারা খড়-কুটা জ্বালানো সহজ ব্যাপার নহে। কোথায়ও কোনোরূপ কায়ক্লেশে আগুন জ্বালাইতে পারিলে গোটা অঞ্চল উহাকে বীজরূপে ব্যবহার করিত এবং আগুনটিকে অনির্বাণ রাখা হইত। বর্তমান কালেও কোনো কোনো ধর্মমন্দিরে অনির্বাণ অগ্নি রক্ষার নিয়ম আছে।

আগুনের তাপ ও আলোর অলৌকিক শক্তি দেখিয়া আদিম মানবেরা বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছিল নিশ্চয়ই। তাহারা দেখিয়াছিল যে, অগ্নির কোমল দেহের কঠিন আঘাত সহ্য করিতে বাঘ, ভালুক বা হাতিও পারে না। আগুন দেখিলে উহারা কেহই উহার কাছে আসিতে সাহস পায়। না। সুতরাং আগুন দ্বারা হিংস্র জন্তু তাড়ানো যায়। আগুনে সেঁক দিলে মাছ-মাংস কোমল ও সুগন্ধী হয় (আগুনে সেঁকা মাংস ‘কাবাব’ খাওয়ার রেওয়াজ এখনও কিছু কিছু আছে)। আগুনকে দেখিলে বাঘ-ভালুকের অপেক্ষাও দ্রুত পালায় অন্ধকার। অন্ধকার ছিল আদিম মানবদের চিরশত্রু ও চিরসহচর। কেননা চাঁদ-সূরুজের উপস্থিতি ভিন্ন জীবনের বাকি সময় অন্ধকারেই কাটাইত আদিম মানবেরা। অন্ধকার প্রহরগুলি উহাদের শুইয়া, বসিয়া, জাগিয়া বা ঘুমাইয়া কাটাইতে হইত; কেহ কাহারও মুখ পর্যন্ত দেখিতে পাইত না। আগুন আবিষ্কারের পর দেখা গেল যে, আগুনের আলোয় রাত্রেও দেখা-সাক্ষাত ও কাজকর্ম করা বেশ চলে। বিশেষত দারুণ শীতের সময় যখন দেহ ঠকঠক করিয়া কাপিতে থাকে, তখন আগুনের কাছে আসিলে দেহ চাগা হয়।

আদিম মানবেরা লক্ষ্য করিয়াছিল, আগুনের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা এই যে, আগুনে পোড়াইলে কোনো পদার্থেরই পূর্বরূপ বজায় থাকে না; জীব বা উদ্ভিদ, এমনকি মাটি পাথরেরও। আগুন বহু রূপকে পরিণত করে এক রূপে, অগার বা ভস্মে।

মানুষ তখন আর শিয়াল-কুকুরের মতো কঁচামাংসভোজী নহে, সে তখন সেঁকা বা পোড়ামাংসভোজী জীব। যখন তাহারা লক্ষ্য করিল যে, মাটি পোড়াইলে উহা কাষ্ঠাদির ন্যায় কয়লা বা ভস্মে পরিণত হয় না বটে, কিন্তু কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন এই তথ্যটির সাহায্যে বানানো হইল পোড়ামাটির পাত্র। শুরু হইল মাছ-মাংস রান্না করিয়া খাওয়া। কিন্তু এই রান্নার অর্থ আধুনিক রান্না নহে। উহাতে হলুদ-মরিচ বা তৈল-লবণের সম্পর্ক ছিল না, উহা ছিল মাছ মাংস সিদ্ধ করিয়া খাওয়া।

আগুন আবিষ্কারের পর মানুষ পশুর কোঠা পার হইয়া অনেক দূর আগাইয়া গিয়াছিল। কিন্তু একদল ভাবুক তাহাদের ভাবনা চালাইলেন অন্য পথে। তাহারা ভাবিলেন, অগ্নি আমাদের পরম উপকারী এবং সময়ে অপকারীও বটে। সুতরাং উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও অপকারের জন্য উহার স্তুতিগান করা উচিত। অগ্নিকে কল্পনা করা হইল ব্যক্তি রূপে, দেওয়া হইল দেবত্ব, প্রবর্তিত হইল উহার পূজার বিধি।

প্রথমে ভারতের দিকেই চাহিয়া দেখা যাক, ভারতীয়রা আগুনকে লইয়া তাহাদের কল্পনার ঘোড়া দৌড়াইয়াছেন কতদূর। কথিত হয়, পরম পুরুষের মুখ হইতে ইহার জন্ম হয়। মতান্তরে ধর্মের ঔরসে বসুভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম হয়। ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে যে, অগ্নি স্থুলকায়, রক্তবর্ণ ও লম্বোদর; হঁহার কেশ, শ্মশ্রু, ভূ ও চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ; হস্তে শক্তি ও অক্ষসূত্র। ইহার বাহন ছাগ।

অগ্নি একজন দিকপাল, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের অধিপতি। হঁহার স্ত্রীর নাম স্বাহা। মহাভারতে উক্ত আছে যে, একদা স্বেতকী রাজার যজ্ঞে প্রচুর পরিমাণে হবিভোজন করিয়া অগ্নির পেটে অসুখ হইয়াছিল। ব্রহ্মার নিকট রোগের প্রতিকারের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি অগ্নিকে বলিলেন যে, খাণ্ডব বন দগ্ধ করিতে পারিলে তোমার রোগ আরোগ্য হইতে পারিবে। অনন্তর অগ্নি খাণ্ডব বন দগ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।

কিন্তু দেবাশ্রিত বন সহজে দগ্ধ করিতে সমর্থ হইবেন না বুঝিতে পারিয়া অগ্নি কৃষ্ণার্জুনের সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। অর্জুন সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইলেন বটে, কিন্তু বলিলেন যে, দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে হইলে যে সকল অস্ত্র-শস্ত্রের প্রয়োজন, তাহা তাহার নাই। অগ্নি অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করিয়া দিবেন বলিয়া স্বীকৃত হইয়া স্বীয় সখা বরুণদেবের নিকট গমনপূর্বক অনেকগুলি অস্ত্র সংগ্রহ করিলেন। তাহা হইতে কপিধ্বজ রথ, গাণ্ডীব ধনু ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় অর্জুনকে এবং সুদর্শন চক্র, কৌমোদকী গদা কৃষ্ণকে প্রদত্ত হইল। খাণ্ডব বন দহনে দেবগণ বাধা দিলে কৃষ্ণার্জুনের সহিত তাহাদের ঘোরতর যুদ্ধ হইল। যুদ্ধে দেবগণ হারিয়া গেলেন। অগ্নি খাণ্ডব বন দগ্ধ করিলে তাহার পেটের অসুখ সারিয়া গেল।

পারসিকগণ মনে করেন যে, অগ্নি মঙ্গলময়, তাহাদের ইহকাল ও পরকালের মগল বিধান করিবেন অগ্নি। তাই তাহাদের পরমারাধ্য দেবতাই হইলেন অগ্নি।

ইহুদিগণ মনে করেন যে, মাংসপোড়া পূতগন্ধ মানুষের কাছে যখন লোভনীয়, নিশ্চয়ই উহা জাভে (ইহুদিদের ঈশ্বর)-এর নিকটও লোভনীয়। তাই ইহুদিরা জাভে-এর তুষ্টার্থে গো-মেষাদি বলি দিয়া উহার মাংস অগ্নিদগ্ধ করিয়া আকাশে ধুয়া উড়াইতেন।

কৃষি ও পশুপালন

সেমিটিক জাতির মতে, কৃষি ও পশুপালন শুরু করিয়াছিলেন বাবা আদম বেহেশত হইতে পৃথিবীতে আসিয়াই। হালের বলদ, লাঙ্গল-জোয়াল ও ফসলের বীজ বেহেশত হইতে আমদানি হইয়াছিল কি না, তাহা জানি না, তবে তিনি নাকি চাষাবাদ করিয়াই জীবন যাপন করিতেন। তাহার চাষের ফসল ছিল বোধ হয় গন্ধ)ম। কেননা, তিনি নাকি খাইতে ভালোবাসিতেন উহাই।

সেকালের মিশরবাসীদের লাগলে ছিল একটি ফাল ও দুইটি হাতল। একজন চাষী দুই হাতে হাতল চাপিয়া ধরিত এবং অপর একজন গরু তাড়াইত, জোয়াল জোড়া হইত গরুর শিং-এর সাথে।[২৯] বাবা আদমের লাগলের আকৃতি কিরূপ ছিল, জোয়াল কিভাবে জুড়িতেন এবং রশা রশি কোথায় পাইয়াছিলেন –সেই বিষয়ে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

পুরাতত্ত্ববিদগণের মতে, কৃষি ও পশুপালন কোনো বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা কোনো এক সময়ে প্রবর্তিত হয় নাই। উহা হইয়াছে বহু দেশের, বহু লোকের, বহু দিনের প্রচেষ্টার ফলে। তবে কৃষি ও পশুপালন বা মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হিসাবে ধরা হয় মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ভারতবর্ষের সিন্ধু প্রদেশকে।

কৃষি ও পশুপালন –ইহার কোনটি আগে শুরু হইয়াছে, তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। হয়তো সমসাময়িক, নচেৎ পশুপালন কিছুটা আগের। পশুপালন আরম্ভ হইয়াছিল শিকারী যুগেই।

কৃষি ও পশুপালন প্রচলিত হইবার পূর্বে আদিম মানবদের খাদ্যব্যবস্থা ছিল পশু-পাখিদের মতো। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দল বাঁধিয়া উহারা খাদ্যের সন্ধানে বাহির হইত এবং সমস্ত দিন ঘোরাফেরা করিয়া পশু-পাখি শিকার বা ফল-মূল সংগ্রহ যাহা করিতে পারি, তাহা দিয়াই উদরপূর্তি করিয়া আস্তানায় আসিয়া নিদ্রা যাইত। আবার প্রভাতে যাত্রা, ঘোরাফেরা, জোটে তো খাওয়া, আর না জোটে তো না খাওয়া, সন্ধ্যায় আস্তানায় আসিয়া শোয়া। এইরূপ চলিত আদিম মানবদের জীবন যাপন। উহাদের কোনোরূপ সঞ্চয় বা মজুদ খাদ্য ছিল না, ছিল যখন পাওয়া তখন খাওয়া। আবার সকল দিন সমান যাইত না। হয়তো কোনদিন প্রচুর খাদ্য জুটিত, আবার কোনোদিন আদৌ জুটিত না।

হিন্দুদের ঈশ্বর নাকি গোমাংস ভক্ষণে নিষেধ করিয়াছেন, আবার মুসলমানদের আল্লাহ বলিয়াছেন, “শূকরের মাংস খাইও না”। কিন্তু খ্রীস্টানদের প্রভু বলিয়াছেন গরু ও শূকর উভয়ই খাইতে। কিন্তু খাদ্যাখাদ্য সম্বন্ধে ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো তালিকা ছিল না আদিম মানবদের কাছে। তাহারা খাদ্য নির্বাচন করিত উহা পাইবার ও খাইবার সুযোগ-সুবিধা মতো। আজিও দেখা যায় যে, ধর্মরাজ্যের বাহিরের বিভিন্ন উপজাতি ও অসভ্য সমাজে ছাগল, গরু, বাঘ, ভালুক, শূকর, কুমির, সাপ, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি খাওয়া হইতেছে সবই।

কোনো কোনো সময় শিকারীদের হাতেই কতক পশু জীবন্ত ধরা পড়িত। তখন আবশ্যকীয় খাদ্যের জোগান থাকিলে ঐগুলিকে আর বধ করা হইত না, বাঁধিয়া রাখা হইত –যেদিন শিকার। জুটিবে না, সেইদিন খাইবার জন্য। আবার কোনো কোনো সময় নিরীহ পশুর বাচ্চাদের বন। হইতে ধরিয়া আনা হইত। খাদ্যের অভাব না হইলে ঐরূপ কোনো কোনো পশু দীর্ঘদিন বাঁধা থাকিত এবং তখন দেখা যাইত যে, উহাদের সকলেই ছুট পাইলে পালায় না, আস্তানার কাছে। কাছে ঘোরাফেরা করে ও শিকারীদের দেওয়া খাবার খায়।

আদিম মানবেরা যখন দেখিল যে, দুই-চারিটি পশু এইরূপ মজুদ রাখিতে পারিলে তাহাদের আর খাদ্যের অনিশ্চয়তা থাকে না, তখন ঐ জাতীয় পশুদের আর সহজে বধ না করিয়া প্রতিপালন করিতে লাগিল। ইহাতে দেখা গেল যে, সময়ে উহারা বাচ্চা প্রসব করে এবং পালের। পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অধিকন্তু উহাদের দুগ্ধও ব্যবহার করা চলে। অবস্থা যখন এইরূপ হইল, তখন দলের সকলেই শিকারে বাহির না হইয়া কেহ কেহ থাকিতে লাগিল পালিত পশুর তত্ত্বাবধানে রাখালরূপে। এইভাবে হইয়াছিল পশুপালনের সূত্রপাত। অনেকের মতে আদিম। মানবদের প্রথম পালিত পশু ছিল বুনো ভেড়া ও বুনো ষড়।

কুকুর মানুষের পোষ মানিয়াছিল গবাদি পশু পোষ মানিবার অনেক আগেই। আদি মানবদের আস্তানার আশেপাশে পড়িয়া থাকিত বন্য পশুর হাড়গোড় ও ত্যাজ্য অংশ। একদল নেকড়ে জাতীয় বন্য পশু (কুকুর) উহা খাইতে আসিত ও আস্তানার কাছে কাছে নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করিত, তাড়াইয়া দিলেও আবার আসিত। শিকারীরা উহাদের কিঞ্চিৎ সহানুভূতি দেখাইলে উহারা শিকারীদের অনুগত ও সহচররূপে গণ্য হইয়াছিল।

কালক্রমে গবাদি পালিত পশুর সংখ্যাবৃদ্ধি হইয়া অবস্থা এইরূপ দাঁড়াইল যে, সংবৎসর উহাদের দুগ্ধ ও মাংস খাইলেও উহাদের সংখ্যা বাড়ে বৈ কমে না, তখন বন্যপশু শিকার ত্যাগ করিয়া দলের সকলেই মনোযোগ দিল পশুপালনে। কিন্তু অচিরেই একটি অসুবিধায় পড়িতে হইল পশুপালকদের। স্থায়ী আস্তানায় থাকিয়া শত শত বা হাজার হাজার পশুর খাদ্য জোগানো হইল অসম্ভব। কাজেই উহারা আস্তানা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল অন্য অঞ্চলে পশুপাল সহ। সেখানকার তৃণাদি পশুখাদ্য নিঃশেষ হইলে আবার খোঁজ করিতে ও চলিয়া যাইতে হইত যেখানে তৃণসমাকুল মাঠ আছে সেখানে। এইভাবে পশুপালনরত ভ্রাম্যমান মানবদলসমূহই বনিয়াছে যাযাবর জাতি।

শিকার ও সংগ্রহের যুগের প্রথম দিকে নারী ও পুরুষের কাজের ভাগাভাগি ছিল না। সকলে মিলিয়া দল বাধিয়া বাহির হইত ও ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার তাড়াইয়া-ঝাপাইয়া হাতেই ধরিত এবং এই কাজে মেয়েরা যথাসাধ্য সাহায্য করিত। কিন্তু বল্লম আবিষ্কারের পর যখন হরিণ, মহিষ ও ভালুকাদি বড় বড় জন্তু শিকার শুরু হইল, তখন আর সেই কাজে মেয়েদের সাহায্য করা সম্ভব হইল না। কেননা মেয়েদের উপর আর একটি অতিরিক্ত কাজের ভার ছিল— শিশুপালন। মেয়েরা তখন বনে বনে ঘুরিয়া ফলমূল সংগ্রহ করিত মাত্র।

সেই আদিম কালের মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ করিবার সময় এমন দুই-একটি ফলের থোকা পাইয়াছিল যে, উহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফলগুলি বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। ফলগুলি ক্ষুদ্র বলিয়া উহা যখন তখন খাওয়া চলিত না। তাই ঐগুলি আস্তানায় লইয়া আসিত এবং অবসর সময়ে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উহার দানা খাইত। হয়তো ঐ রকম দুই-চারিটি ফলের গোটা আস্তানার আশেপাশে পড়িয়া তাহা হইতে গাছ জন্মিত ও ফল ধরিত। মেয়েরা যখন উহার উৎপত্তি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হইল, তখন বুঝিতে পারিল যে, দানাগুলি সরস মাটিতে চাপা থাকিয়াই উহাদের অকুরোদগম হইয়াছে। তাই উহারা সরস মাটিতে বীজ পুঁতিয়া গাছ জন্মাইয়া উহা হইতে বেশি বেশি ফসল পাইতে লাগিল এবং খুঁটিয়া খাওয়ার পরিবর্তে পাথরে পিষিয়া উহার মণ্ড ভক্ষণ শুরু করিল। ইহাতে। ফলমূল সংগ্রহের ব্যাপারে উহারা অনেকটা আত্মনির্ভরশীল হইয়া উঠিল। এইভাবে আদিম কালের মেয়েদের হাতেই প্রবর্তন হইল গম ও বার্লির চাষ অর্থাৎ কৃষিকাজের সূচনা। বস্তুত পৃথিবীতে কৃষিকাজের প্রবর্তন করিয়াছে নারীরা, যীশু খ্রীস্ট জন্মিবার প্রায় সাড়ে চারি হাজার বৎসর আগে।[৩০]

গরু মহিষের শিং, সূঁচালো কাঠ বা অনুরূপ অন্য কিছুর দ্বারা খেচাইয়া খোঁচাইয়া মাটি আলগা করিয়া বীজ বপন করাই ছিল তখনকার দিনের কৃষি। বোঝাই যাইতেছে যে, এইভাবে বেশি জমি চাষ করা সম্ভব নহে। কৃষিকাজের সামান্য প্রসার হইয়াছিল কোদাল আবিষ্কারের পর। সে কিন্তু আধুনিক কোদাল নহে। হরিণের শিং, বাঁকানো কাঠ বা কাঠে বঁধা একখণ্ড সূঁচালো পাথর মাত্র। উহা দ্বারা কোপাইয়া (খোঁচাইয়া নহে) মাটি আলগা করিয়া বীজ বপন করা হইত। এই ব্যবস্থামতো শত শত বৎসর কৃষিকাজ চালাইয়াছিল আদিম মানবেরা। এই সময়টিকে বলা হয় কোদাল দ্বারা চাষ করার যুগ, সংক্ষেপে কোদাল যুগ। এই যুগে চাষ বা ফসলের মাত্রা কিছু বাড়িয়াছিল বটে, কিন্তু শিকার ও সংগ্রহ ত্যাগ করিয়া মানুষ স্বাবলম্বী হইতে পারে নাই। তবে। শিকারের তাগিদ কিছু কমিয়াছিল।

যীশু খ্রস্টের জন্মের তিন হাজার বৎসর আগেই মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং ইহার কিছুকাল। পরে ভারতবর্ষ, সাইপ্রাস, চীন ও গ্রীসে বঁড় বা গাধা দিয়া লাঙ্গল টানাইবার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন শিকার ও সংগ্রহের যুগ শেষ হইয়া আসিয়াছে। কোদাল যুগের পরিবর্তে রীতিমতো কৃষিযুগ শুরু হইয়াছে। আবাদী জমি ও ফসলের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়াছে। মানুষ খাদ্যের ব্যাপারে হইতে পারিয়াছে স্বাবলম্বী। বস্তুত খাদ্যসংস্থানে পশু-পাখির পর্যায় হইতে মানুষকে মানুষ পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছে পশুপালন ও কৃষি।

আজকাল যেমন নিতান্ত নীরস ও অনুর্বর মাটিতেও নানান কৌশলে সেচ ও সারের ব্যবহার করিয়া ফসলোৎপাদন করা হইয়া থাকে, আদিতে কিন্তু তাহা ছিল না। তখন চাষের কাজের সম্পূর্ণ নির্ভর ছিল প্রকৃতির উপর। যে দেশের মাটি স্বভাবতই সরস ও উর্বর, মাত্র সেই দেশেই। ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ শুরু হইয়াছিল সবচেয়ে আগে। তাই নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং সিন্ধু। নদীর বদৌলতে মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সর্বাগ্রে ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ শুরু হইয়াছিল। আর যে দেশের মানুষ বৎসরের এক বিশেষ সময়ে ফসল জন্মাইয়া সংবৎসরের খাদ্যের সংস্থান করিতে পারে, তাহারাই পারে অবসর সময়ে অন্যান্য চিন্তা ও কাজ করিতে। তাই শিল্পক্ষেত্রেও ঐ তিনটি দেশ হইয়াছিল অগ্রণী। কাজেই উক্ত দেশত্রয়কেই বলা হয় মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। নানা রকম প্রমাণ হইতে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তই করিয়াছেন যে, ঐ তিনটি দেশে সভ্যতার জন্ম হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৩৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে।[৩১]

ধাতু ও গৃহ

 বলা হয় যে, পাখিরা বিমানবিহারী জীব। কিন্তু বিমানে বিহার কতক্ষণ? বেশির ভাগ সময়ই উহাদের দাঁড়াইতে হয় বৃক্ষশাখায়। আবার বৃক্ষশাখায় দাঁড়াইয়া থাকা চলে না, বসতে হয়, অন্তত ডিম পাড়া বা ডিমে তা দিবার সময়ে। তাই উহারা খড়কুটা বা অন্য কিছুর দ্বারা একটু স্থান করিয়া লয় বসার, বলা হয় –বাসা। মানুষ যখন বৃক্ষচারী ছিল, যে রকমই হউক, তখন তাহারাও তৈয়ার করিত বাসা। কালক্রমে মাটিতে নামিয়া আসিবার পর মানুষ গিরিগুহা বা বৃক্ষকোটরে বাস করিত। আবার কোনো সময়ে বাসা তৈয়ার করিয়া উহাতে বাস করিত। আজিও আমরা অফিসাদি কর্মস্থল হইতে ফিরিবার সময়ে বলি, “বাসায় যাই”।

আদি মানবেরা গুহাবাসী ছিল বটে, কিন্তু সবসময়েই গুহা পাওয়া যাইত না। তখন পর্বত বা বৃক্ষের গা ঘেঁষিয়া ডালপালা জড়ো করিয়া তাহার উপর লতা-পাতার ছাউনি দিয়া বাসা বানানো হইত, যেন কৃত্রিম গুহা। উহাকে গৃহ বলা চলে না। কেননা উহাতে থাম-খুঁটি বা ভিটি-বেড়া ছিল না। তখন ডালপালা ও লতা-পাতা ইত্যাদি সরঞ্জাম সবই সংগ্রহ করিতে হইত ভাঙ্গিয়া বা ছিঁড়িয়া। যেহেতু হাতিয়ার বলিতে উহাদের কিছুই ছিল না, একমাত্র পাথর ভিন্ন। মানুষ প্রকৃত গৃহবাসী হইয়াছে ধাতু বিশেষত লৌহ আবিষ্কারের পর।

প্রায় পাঁচ লক্ষ বৎসর আগে মানুষ গাছ হইতে নামিয়া মাটিতে চলাফেরা শুরু করে। তখন তাহারা খাদ্য তৈয়ার করিতে জানে না, নির্ভর মাত্র শিকার ও সংগ্রহের উপর। মানুষের এই অবস্থাকে মর্গান বলিয়াছেন বন্যদশা, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলেন পুরানো পাথর যুগ এবং ভূতত্ত্ববিদগণ বলেন প্লিসটোসেন। উক্ত পাঁচ লক্ষ বৎসরের প্রায় পৌনে ষোল আনা সময়ই কাটিয়াছে মানুষের বন্যদশায়।

মানুষ কৃষি ও পশুপালন শিখিয়াছে এবং নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করিতে জানে –মর্গান এই অবস্থার নাম দিয়াছেন বর্বরদশা, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলেন নতুন পাথর যুগ এবং ভূতত্ত্ববিদগণ বলেন হলোসেন। এই যুগটি প্রায় দুই হাজার বৎসর স্থায়ী ছিল।

প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর আগে নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং সিন্ধু উপত্যকায় যে সভ্যতা গড়িয়া উঠে, মর্গান উহার নাম দিয়াছেন সভ্যদশা। এই সভ্যদশার দুইটি ভাগ আছে। যথা –১. তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ, প্রায় দুই হাজার বৎসর এবং ২. লৌহ যুগ, প্রায় তিন হাজার বৎসর।

ধাতু যুগের শুরুতে পাথরের হাতিয়ারের পরিবর্তে মানুষ তাম্র বা ব্রোঞ্জ দ্বারা হাতিয়ার নির্মাণে সক্ষম হইয়াছিল এবং উহাতে সুবিধাও হইয়াছিল অনেক। কিন্তু লৌহ আবিষ্কারের মতো উহা সুদূরপ্রসারী ছিল না। ব্রোঞ্জ বা তাম্ৰধাতু আজিও আছে এবং শিল্পক্ষেত্রে উহার কিছু গুরুত্বও আছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা পুরাপুরি নির্ভর করিতেছে লৌহের উপর, ব্রোঞ্জ বা তাম্রের উপর নহে।

লৌহযুগের প্রাথমিক মামুলি হাতিয়ার ছিল কাটারি, কাস্তে, কোদাল, কুড়াল, করাত ইত্যাদি এবং ইহারই সাহায্যে সম্ভব ও সহজ হইয়াছিল ভূমিকৰ্ষণ, বৃক্ষছেদন, গৃহনির্মাণ, নৌকা তৈয়ার ইত্যাদি। ফলে উন্নত হইয়াছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য, এক কথায় জীবনযাপন প্রণালী। প্রকৃতপক্ষে লৌহ আবিষ্কারই করিয়াছে জগতে আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিপত্তন।

তাঁত

পবিত্র বাইবেল গ্রন্থের মতে, আদিমানব আদম সৃষ্ট হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে। অর্থাৎ এখন (১৯৭০) হইতে প্রায় ছয় হাজার বৎসর পূর্বে। ঐ সময়ে হযরত আদম এদন উদ্যানে (বেহেশতে?) বাস করিতেন এবং তিনি ঐখানে উলঙ্গ ছিলেন। তৌরিতে লিখিত আছে, “তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডাকিয়া কহিলেন, তুমি কোথায়? তিনি কহিলেন, আমি উদ্যানে তোমার রব শুনিয়া ভীত হইলাম, কারণ আমি উলঙ্গ, তাই আপনাকে লুকাইয়াছি। … আর সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম ও তাহার স্ত্রীর নিমিত্ত চর্মের বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া তাহাদিগকে পরাইলেন।”  (আদিপুস্তক ৩; ৯, ১০, ২১)

 জীবতত্ত্ববিদগণ বলেন যে, চেহারায় পশুর কোঠা পার হইবার পরেও আহার-বিহার ও চাল চলনে মানুষ পশুবৎ ছিল এবং উলঙ্গ থাকিত। জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে বৃক্ষপত্র বা বল্কল এবং পশুচর্ম পরিধান করিতে থাকে। এমনকি শীত নিবারণের জন্যও তাহারা পশুচর্মই ব্যবহার করিত। বর্তমান যুগেও এস্কিমো বা অনুরূপ অসভ্য জাতিরা পশুচর্ম পরিধান করিয়া থাকে।

পোষাক-পরিচ্ছদে মানুষ সুসভ্য হইতে পারিয়াছে সুতা তৈয়ার ও তাত আবিষ্কারের পরে। বস্তুত সভ্যতা বিকাশের একটি বিশিষ্ট ধাপ হইল বস্ত্রবয়ন বা তঁত আবিষ্কার।

মাল বহিবার কাজে পশু

আদিম মানবেরা মালবহন কাজে ব্যবহার করিত তাহাদের হাত, মাথা, ঘাড়, পিঠ ইত্যাদি। কিন্তু এইভাবে মাল বহন করা, পরিমাণে অল্প ও সামান্য দূরেই সম্ভব। বেশি পরিমাণ মাল লইয়া দেশান্তরে গমন করা ছিল দুঃসাধ্য। কৃষি ও পশুপালনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল যে, কতক পশুর দ্বারা মাল বহনের কাজও করানো যায়, যেমন –ঘোড়া, গাধা, উট ইত্যাদি। দশটি মানুষের বহনযোগ্য মাল হয়তো একটি পশুই অনায়াসে বহুদুর বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। তাই শুরু হইল মাল বহনের কাজে পশুর ব্যবহার। ইহাতে এক দেশের মানুষের সহিত আর এক দেশের মানুষের লেনদেন অর্থাৎ স্থলপথে বাণিজ্য সম্ভব হইয়াছিল। মানুষকে সভ্যতার আর এক ধাপ উপরে উঠাইয়া দিয়াছিল মাল বহিবার কাজে পশুর ব্যবহার।

চাকা

কোনো ভারি পদার্থ উত্তোলন করিয়া লওয়া অপেক্ষা টানিয়া লওয়া সহজ এবং পদার্থটি গোল হইলে উহাকে গড়াইয়া লওয়া আরও সহজ। গোল পদার্থ গড়াইবার সহজ পদ্ধতিটি লক্ষ্য করিয়াই সেকালের মানুষ করিয়াছিল চাকা আবিষ্কার এবং তাহা হইতে হইয়াছিল টানাগাড়ি, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি মানুষ চালিত গাড়ির সৃষ্টি। চাকা আবিষ্কারের বহু আগেই মানুষ লাঙ্গল টানিবার কাজে পশু ব্যবহার করিতে শিখিয়াছিল। কাজেই মানুষচালিত গাড়িকে পশুচালিত গাড়িতে রূপায়িত করিতে বেশিদিন লাগে নাই। সেকালের গাড়ির উন্নত সংস্করণ ছিল রথ। উহা দুই বা চারি চাকা বিশিষ্ট অশ্বচালিত গাড়ি। সেকালের রাজ্যপালেরা উহা ব্যবহার করিতেন আনন্দবিহার এবং যুদ্ধের কাজে।

খ্রী. পূ. ১২৮৫ সালে ফেরাউন দ্বিতীয় রেমেসিস হজরত মূসার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিলেন। রথে চড়িয়া (যাত্রাপুস্তক ১৪; ২৩, ২৫)। ইহাতে জানা যায় যে, তিন হাজার বৎসরের অনেক আগেও চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ছিল। গাড়ি আবিষ্কারের ফলে লোক চলাচল ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছিল।

আদিম মানবেরা যখন হইতে কঁচা মাছ-মাংস ভোজন ত্যাগ করিয়া রান্নাবান্না আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতেই শুরু হইয়াছে মৃৎপাত্র তৈয়ার ও উহার উন্নতির প্রচেষ্টা। কিন্তু চেষ্টা যতই হইয়া থাকুক, উহা সর্বাঙ্গসুন্দর হইতে পারে নাই চাকা আবিষ্কারের পূর্বে।

শুধু হাতে পিটিয়া-টিপিয়া মাটির পাত্র তৈয়ার করিতে গেলে উহা বাকাচোরা ও এবড়োখেবড়ো হওয়াই স্বাভাবিক। তখনকার যে সকল শিল্পীরা চাকা নির্মাণ ও উহার গবেষণার কাজে লিপ্ত ছিলেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, কোনো চাকার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি শলাকা প্রবেশ করাইয়া উহাকে ঘুরাইয়া ছাড়িয়া দিলে, সে অনেক সময় ধরিয়া ঘুরিতে থাকে; তখন উহার ঐ ঘূর্ণায়মান গতি ও শক্তিকে লক্ষ্য করিয়াই শিল্পীরা করিয়াছিলেন কুমারের চাকা আবিষ্কার। আর ইহার ফলে হইয়াছিল মৃৎশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি। সভ্যতা বিকাশের একটি বিশেষ ধাপ হইল চাকার আবিষ্কার। অধুনা বাস, ট্রাক, ট্রেন ইত্যাদি শত শত রকম স্থলযান বা গাড়ি উদ্ভাবন করা হইয়াছে এবং উহাতে কল-কৰ্জাও সন্নিবেশিত হইয়াছে নূতন নূতন, কিন্তু ইহার চাকাটি হইল প্রায় তিন হাজার বৎসরের পুরাতন।

নৌকা ও পাল

পদব্রজে যাতায়াতের যতই সুবিধা থাকুক না কেন, আদিম মানবদের জলপথে গমনের কোনো উপায়ই জানা ছিল না, সাঁতার কাটা ভিন্ন। অভিজ্ঞতাবৃদ্ধির সাথে সাথে যখন দেখা গেল যে, কতিপয় ভাসমান কাঠ একত্র বাঁধিয়া লইলে, উহার উপর আরোহণ করিয়া জলাশয় পার হওয়া যায়, তখন হইতে শুরু হইল ভেলার সাহায্যে জলাশয় পার হওয়া। ইহার পরবর্তী কালের মানুষ বড় বড় গাছের আস্ত খুঁড়ি গুঁড়িয়া এক প্রকার নৌকা প্রস্তুত করিতে শিখিয়াছিল। এই প্রকার নৌকা প্রস্তুতের প্রথা কোনো কোনো অঞ্চলে এখনও আছে। উহাকে বলা হয় গাছ নৌকা। এই নৌকার একটি বিশেষত্ব এই যে, আকারে উহা যত ছোট বা বড় হউক না কেন, উহার গড়ন হয় প্রায় একই রকম। কাজেই আদিম মানবেরা যতদিন গাছ নৌকা ব্যবহার করিয়াছিল, ততদিন পর্যন্ত নৌশিল্পের কোনো উন্নতিই হয় নাই। নৌশিল্পের উন্নতি শুরু হইয়াছে কাঠের তক্তা তৈর করিয়া তদ্বারা জোড়াতালি দিয়া নৌকা প্রস্তুতের কৌশল জানার পর।

তক্তা দ্বারা নৌকা প্রস্তুতের মস্ত বড় সুবিধা হইল এই যে, উহা দ্বারা আবশ্যকমতো যত বড় ইচ্ছা তত বড় এবং যে কোনোও গড়নের নৌকা তৈয়ার করা যায়। কালক্রমে নানা ধরণের নৌকা যথা –বজরা, ময়ূরপঙ্খী বা পানসি, ছিপ, আল্কি ইত্যাদি প্রস্তুত হইতেছিল এবং বড় বড় জলাশয়ে পাড়ি জমানো সম্ভব হইয়াছিল, এমনকি সাগরবুকেও।

জলপথে যাতায়াত সম্ভব এবং ছোট ছোট নৌকা চালানো সহজসাধ্য হইল বটে, কিন্তু বড় বড় নৌকা চালনা করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কালক্রমে এই কষ্টসাধ্য নৌ-চলাচল সহজসাধ্য হইল, যখন হইতে হইল নৌকায় পাল খাটাইবার ব্যবস্থা। খ্রী. পূ. ৩০০০ বৎসর পূর্বেই পালের নৌকার আবিষ্কার হইয়াছিল।[৩২]

নৌকা ও পাল আবিষ্কারের ফলে দেশান্তরে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম হইয়াছিল। মানুষ পাইয়াছিল জলে ও স্থলে অবাধে চলিবার স্বাধীনতা। আধুনিক যন্ত্রযুগের দ্বার পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে আগাইয়া দিয়াছে নৌকা ও পাল। বলা বাহুল্য যে, এই যান্ত্রিক জলযানের যুগেও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পালের নৌকা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে।

লিপি ও কাগজ

আদিম মানবদের একের মনোভাব অপরকে জানাইতে মৌখিক আলাপ ও অঙ্গভঙ্গি ভিন্ন অন্য কোনো উপায় ছিল না। জ্ঞানোন্মেষের সাথে সাথে আবিষ্কৃত হইল চিত্রের মাধ্যমে মনোভাব ব্যক্ত করিবার কৌশল। কিন্তু উহা ছিল ভাবপ্রকাশের অতি সংক্ষিপ্ত আভাস মাত্র। যদি বলিতে হইত যে, তিনজন লোক নৌকাযোগে তিনদিনে একটি হ্রদ পার হইয়াছে, তবে চিত্রে দেখাইতে হইত– একখানা নৌকায় তিনজন আরোহী এবং তিনটি সূর্য।

মিশরে চিত্রলিপি শুরু হইয়াছিল প্রায় ছয় হাজার বৎসর পূর্বে। চিত্রলেখা বেশি সময়সাপেক্ষ এবং উহাতে যোগ্যতাও লাগে যথেষ্ট। তাই পরবর্তীকালে ছবি আঁকার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল বিভিন্ন ধরণের দাগ কাটিয়া মনোভাব ব্যক্ত করিবার রীতি এবং বিভিন্ন দাগের সমন্বয়ে অক্ষর ও শব্দের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য যে, বিভিন্ন দেশের লোক একই রীতির অনুসরণ করে নাই এবং তৎকালীন সকল রকম লিখনপ্রণালীও অধুনা প্রচলিত নাই। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে পুরাকালের যে সমস্ত লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, এখনও তাহার অনেকগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নাই।

সেকালের চিত্রলিপির পাত্র ছিল সাধারণত গুহাপ্রাচীর, পর্বতগাত্র ইত্যাদি এবং অক্ষরলিপির পাত্র ছিল মৃৎচাকতি, শিলাখণ্ড, পশুচর্ম, ধাতুপাত, বৃক্ষপত্র ইত্যাদি। এইদেশে তাল, কদলী, ভূর্জ ইত্যাদি বৃক্ষপত্রে লিখন প্রচলিত ছিল কিছুদিন আগেও এবং চিঠি বা পুস্তকাদি লিখা হইত উহাতেই। তাই এখনও আমরা চিঠিকে পত্র এবং বইয়ের পৃষ্ঠাকে পাতা বলিয়া থাকি।

খননকার্যের ফলে পাঁচ-ছয় হাজার বৎসর পূর্বের কঁচা বা পোড়ামাটির চাকতির বহু লিপি আবিস্কৃত হইয়াছে। বারোখানা চাকতির উপর লিখিত তিনশত পঙক্তি সমন্বিত গিলগামেশ নামক একখানা মহাকাব্য উদ্ধার করা হইয়াছে, তাহার কতক পাওয়া গিয়াছে নিনেভ-এ আসুরবানিপাল এর গ্রন্থালয়ের ভগ্নস্তূপের মধ্যে। খ্রী. পূ. তিন হাজার বৎসর আগে প্যালেস্টাইনে লিখন প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ আছে। ঐখানে শতাধিক শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে।

আরবের মজা সমুদ্রের উত্তর-পূর্ব দিকে কোনো পাহাড়ের গুহায় ১৯৪৭ সালে পাওয়া গিয়াছিল কতগুলি মাটির জালার সারি, উহা সরা দিয়া ঢাকা। সরা উঠাইয়া দেখা গেল যে, জালাগুলিতে মেষচর্মের তাড়া ভর্তি এবং তাহার উপর আলকাতরার মতো কালো কালিতে হিব্রু অক্ষরে লেখা প্রাচীন বিধান বাইবেলের কতিপয় অংশ। উহাতে রহিয়াছে খ্রী. পূ. ২২৫ অব্দে লিখিত ‘স্যামুয়েল’! গ্রন্থের নানান অংশ এবং খ্রী. পূ. ১০০ অব্দে লিখিত সম্পূর্ণ ‘ইসায়া’ গ্রন্থ। ঐগুলিকে বলা হয় ডেড সি স্ক্রোল। স্ক্রোলগুলির মধ্যে যীশুখ্রীস্টের নিজের ভাষা আরামাইক-এ লিখিত গ্রন্থও আছে।

আদিম মানবেরা মাটি, পাথর, গাছের পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদিতেই লিখিত। কিন্তু মিশরীয়রা কালি, কলম ও কাগজ আবিষ্কার করিয়াছিল। উদ্ভিদের আঠার সঙ্গে হাঁড়ির গায়ের কালো স্কুল গুলিয়া, সেই গাঢ় তরল পদার্থকে আগুনে জ্বাল দিয়া কালি প্রস্তুত করা হইত এবং খাগের কলম ব্যবহৃত হইত। প্যাপিরাস নামক নলখাগড়া জাতীয় কোনো জলজ উদ্ভিদকে থেঁতো করিয়া মণ্ড তৈয়ার করা হইত এবং উহাকে বিস্তার করিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া মসৃণ, শক্ত, হলুদ রঙের কাগজ প্রস্তুত করা হইত। এইরূপে প্রস্তুত হইয়াছিল প্রথম কাগজ। মিশরীয় জলজ উদ্ভিদ প্যাপিরাস হইতেই কাগজের ইংরাজি নাম হইয়াছে ‘পেপার’। কেহ কেহ বলেন যে, সর্বাগ্রে কাগজ প্রস্তুত হইয়াছিল চীন দেশে।

ধর্ম

আদিতে মানুষের মন ছিল পশু-পাখিদের মনের মতোই সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে। কোনো ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত ও করিত। জ্ঞানোন্মেষের সাথে সাথে মানুষ। প্রথমে দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করিলে, এই দল ও সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাধা হইল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধীন প্রবৃত্তিগুলিকে সু ও কু– এই দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল এবং কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল বন্দী। এই সু ও কু অর্থাৎ সৎ ও অসৎ কার্যবিভাগ করিয়াছিলেন বোধহয় সেকালের অঞ্চলবিশেষের গোষ্ঠীপতি বা সমাজপতিরা। আর ইহাই ছিল সম্ভবত মানুষের সমাজজীবন উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপ।

কালক্রমে মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে তৎকালীন বিশিষ্ট জ্ঞানীগণ যখন বিশ্ব-প্রকৃতি সম্বন্ধে ভাবিতে শুরু করিয়াছিলেন এবং চিন্তা করিতেছিলেন মানবজীবনের অতীত ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে, তখন হইতে তাঁহাদের মনে জাগিতেছিল দৈবশক্তি বা ঈশ্বর ও পরকাল সম্বন্ধে নানা কথা। এই ঈশ্বর ও পরকাল সম্বন্ধে যাহাদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছিল এবং জনগণের মধ্যে উহার বিশদ ব্যাখ্যা প্রচার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাঁহারাই ছিলেন সেকালের ধর্মগুরু, যেমন –বৈদিক ঋষিগণ, জোরওয়াস্টার, বুদ্ধ প্রভৃতি। ধর্মগুরুরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক এবং দেশ ও কালভেদে উঁহাদের সকলের মতামতও এক ছিল না। তবে বুদ্ধাদি দুই-একজন ধর্মগুরু ভিন্ন জগতের প্রায় সকল ধর্মগুরুই দেবতা বা ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসী, পার্থক্য মাত্র ঈশ্বরের সংখ্যায়। কেহ বলিয়াছেন, ঈশ্বর এক এবং কেহ বলিয়াছেন, অনেক।

ধর্মগুরুরা নীতিবাক্য প্রচার করিয়াছেন অজস্র। আর উহাতে কাজও হইয়াছে ১৯৮৮ যথেষ্ট। অসংখ্য নর-নারী অসৎকাজ ত্যাগ করিয়া সৎকাজে ব্রতী হইয়াছেন ধর্মগুরুদের কথিত স্বর্গসুখের প্রত্যাশা ও নরকজ্বালার ভয়ে। মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করাইয়া মানুষকে সুসভ্য করিয়া গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারে ধর্মগুরু বনাম ধর্মের দান অপরিসীম।

ধর্ম মানুষকে করিয়াছে নীতিপরায়ণ। শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, খাদ্যনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধনীতি, শাসননীতি ইত্যাদি এমন কোনো নীতি নাই, যাহা ধর্মগুরুরা প্রচার করেন নাই। জন্মনীতি, মৃত্যুনীতি, যৌননীতি, বাহ্য-প্রস্রাব, এমনকি জলশৌচ করারও নীতি প্রচারিত হইয়াছে; তবে এককালে ঐ সবের আবশ্যকও ছিল।

ধর্মীয় নীতি বা নিষেধাজ্ঞাসমূহের অনেকগুলি যুগোপযোগী হইলেও উহার যাবতীয় বিধি নিষেধকে প্রচার করা হইয়াছে চিরস্থায়ী বলিয়া। কিন্তু যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যক হইয়াছিল উহার কিছু কিছু সংশোধনের এবং সংশোধন শুরু হইয়াছিল মধ্যযুগেই।

ধর্মগুরুরা শাসক ছিলেন না, ছিলেন উপদেশক। কেননা আদিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না, ছিল পুরোহিততন্ত্র। মধ্যযুগে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলে, যখন দেখা গেল যে, শুধু নীতিবাক্য আওড়াইয়া এবং পাপ আর নরকের ভয় দেখাইয়া মানুষকে সৎপথে রাখা যায় না, তখন ধর্মগুরুদের পিছনে রাখিয়া সম্মুখে দাঁড়াইলেন রাষ্ট্রপতিরা; পাপকে অপরাধ আখ্যা দিয়া পরকালের শাস্তির পূর্বেই তাহারা শুরু করিলেন অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড, হস্তচ্ছেদন, চাবুকাঘাত ইত্যাদি আশু শাস্তির ব্যবস্থা। আবার বর্তমান যুগে ধর্মীয় নীতির তালিকাভুক্ত প্রায় সমস্ত নীতিই হইয়াছে রাষ্ট্রনীতির তালিকাভুক্ত এবং স্বর্গ বা নরকবাসের পূর্বে হইয়াছে দণ্ড ও পুরস্কারের বিধান।

অধুনা আন্তর্জাতিক নীতিতে কতক ধর্মীয় নীতি পড়িয়াছে বাতিলের পর্যায়ে। যেমন –অবরোধ প্রথা, চিত্রাঙ্কন, গান-বাজনা, খেলাধুলা, কুসীদ গ্রহণ, মদনমিরাস ইত্যাদি বিষয়ক নীতিসমূহ।

ধর্মীয় শিক্ষার ফলে আদিম মানবদের লাভ হইয়াছে যথেষ্ট। এবং বর্তমান যুগেও উহার আবশ্যকতা ফুরায় নাই।

আধুনিক সভ্যতা

বর্তমান যুগটিকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ এবং যন্ত্রযুগও। বিজ্ঞানের যুগ বলা হয় এই জন্য যে, পূর্বে যে কোনো তত্ত্ব নির্ণয় করিতেন সেকালের তত্ত্বজ্ঞানীরা নিজেদের অনুমান ও কল্পনার সাহায্যে এবং উহা জনসমাজে গৃহীত হইত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। কেননা তখন পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ রীতি ছিল না। আর বর্তমান যুগে কোনো তত্ত্বই তত্ত্ব বলিয়া গৃহীত হয় না, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া। এই পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণই হইল বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। আজ ভূতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সমস্ত তত্ত্বই নির্ণীত হইয়া থাকে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ রীতিতে, অর্থাৎ জ্ঞানের ভিত্তিতে। গান, বাজনা, চিত্র ইত্যাদি শিল্পকলা এমনকি সমাজ বা রাষ্ট্রবিধানও আজ বিজ্ঞানভিত্তিক। তাই এই যুগটিকেই বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ।

এই যুগের মানুষ কোনো কাজই শুধু গায়ের জোরে করিতে চাহে না, চাহে কৌশলে অর্থাৎ যন্ত্রের সাহায্যে করিতে। নানাবিধ কাজ অতি সহজে সম্পন্ন করিবার জন্য অধুনা এত অধিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হইয়াছে যে, সেই সবের নাম জানা বা সংখ্যা নির্ণয় করাই মুশকিল। এই জন্য এই যুগটিকে বলা হয় যন্ত্রযুগ।

আজকাল যন্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে হাজার হাজার রকম এবং প্রতিটি আবিষ্কারই মানব সভ্যতাকে কিছু না কিছু আগাইয়া দিয়াছে সম্মুখের দিকে। কিন্তু সকল রকম আবিষ্কার বা যন্ত্রের মূলে রহিয়াছে তিনটি প্রধান আবিষ্কার। যথা –বাষ্পীয়, বৈদ্যুতিক ও পারমাণবিক শক্তি।

বাষ্পীয় শক্তি

প্রকৃতপক্ষে আধুনিক সভ্যতার প্রধান উৎস বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কার। এই শক্তিটি আবিষ্কারের পূর্বে যে সকল মামুলি ধরণের যন্ত্র বানানো হইত, তাহা চালানো হইত মানুষ বা পশুর শক্তিতে এবং তাহাতে কাজ পাওয়া যাইত সামান্য। তখনও কোনো কোনো দেশে রেল বসানো রাস্তা ছিল, কিন্তু উহাতে মালগাড়ি চলিত গাধার সাহায্যে এবং ঘোড়ার সাহায্যে চলিত ডাকগাড়ি।

একটি প্রবাদ আছে যে, জেমস্ ওয়াট একদা একটি কেতলির ফুটন্ত পানি হইতে বাষ্প নির্গত হওয়ার দৃশ্য দেখিয়া বাষ্পীয় শক্তির সন্ধান পান। সুতরাং বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কারক তিনিই। বস্তুত মানুষ বাষ্পীয় শক্তির সন্ধান পাইয়াছিল ইহার অনেক আগেই এবং বাষ্পীয় ইঞ্জিনও তৈয়ার হইয়াছিল ওয়াটের আগে। তবে উহা তেমন কার্যকর ছিল না এবং উহার ব্যবহার হইত শুধু কয়লার খনিতে।

জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন তৈয়ারের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে ডার্টমাউথ নিবাসী নিউকোমেন একটি স্টিম ইঞ্জিন নির্মাণ করিয়াছিলেন। এইটিও ব্যবহৃত হইত কয়লা উত্তোলনের কাজে। তবু বিংশ শতকের প্রথম দিকেই বাষ্পচালিত এইরূপ টারবাইন নির্মাণ করা হইয়াছিল, যাহার এক একটির সাহায্যে ৪৩,৭০০টি অশ্বের শক্তির সমান কাজ করা সম্ভব ছিল।

যদিও ওয়াট বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা নহেন, তবুও তাহাকে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ‘জনক’ বলা হয়। বস্তুত ফুটন্ত পানি হইতে উৎপন্ন বাষ্পকে জগদ্ব্যাপী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার উন্নততর পদ্ধতি প্রথমে তিনিই দেখাইয়াছেন। জলযানে স্থাপিত হইল বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং জর্জ স্টিফেনসন নির্মাণ করিলেন বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে বাষ্পীয় ইঞ্জিন হইল উন্নত হইতে উন্নততর এবং উহা ব্যবহৃত হইতে লাগিল জলে ও স্থলে, বিবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে। পূর্বে যেখানে ছিল পশুচালিত গাড়ি ও দাঁড়-পালের নৌকা, যাহার গতিবেগ ঘণ্টায় ৭-৮ মাইলের বেশি ছিল না, এখন সেখানে চলিতেছে রেলগাড়ি ও ইঞ্জিনচালিত জাহাজ, যাহার গতিবেগ ঘণ্টায় ক্ষেত্রবিশেষে একশ’ মাইলেরও বেশি। উহাতে যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছে পরিবহন ক্ষমতা, তেমনি হ্রাস পাইয়াছে সময়ের অপব্যয়।

বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে পরম উৎকর্ষ দেখা দিয়াছে শিল্পক্ষেত্রে। ইহাতে যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছে বিবিধ শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন, তেমনই বৃদ্ধি পাইয়াছে আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের পরিমাণ। সুলভ ও সহজলভ্য হইয়াছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ফলত, মানুষের সমাজজীবনোন্নয়নের মস্তবড় একটি সোপান হইল বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার।

বৈদ্যুতিক শক্তি

সেকালের মানুষের ধারণা ছিল যে, বিদ্যুৎ একটি স্বর্গীয় পদার্থ এবং উহা ব্যবহার করেন দেবতা বা ফেরেশতারা। বিদ্যুৎচমক বা বজ্রপাত সম্বন্ধে মুসলমানগণ বলেন যে, উহা শয়তানের প্রতি ফেরেশতাগণের তীরনিক্ষেপ এবং ‘লা হাওলা অলাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিওল আজিম’ –এই বাক্যটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। পক্ষান্তরে হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা বজ্রবাণ তৈয়ারী এবং উহা ব্যবহার করেন দেবরাজ ইন্দ্র, তাহার– শত্ৰুনিপাতের জন্য; ‘জৈমিনিশ্চ সুমন্তু বৈশম্পায়ন এব চ। পুলস্ত্যঃ পুলহো জিফ ষড়েতে বজ্ৰবারকা’ –এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। সে যাহা হউক, দেবতাদি বোধ হয় কালসমুদ্রে ডুবিয়া মরিয়াছেন; বর্তমানে বিদ্যুতের স্বত্বাধিকারী হইয়াছে একমাত্র মানুষ।

কাঁচে রেশম ঘষিলে উহাতে যে বিদ্যুৎ জন্মে এবং তাহা যে হাল্কা জিনিষকে আকর্ষণ করে, ইহা অনেকদিন আগে লোকে জানিত। কিন্তু জলপ্রবাহের মতো বিদ্যুতেরও যে প্রবাহ আছে, তাহা বিজ্ঞানীরা জানিয়াছেন মাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে।

১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দে একদিন গ্যালভনি নামক ইতালির একজন বিজ্ঞানী একটি ব্যাঙ মারিয়া তাহার পেশী-স্নায়ু পরীক্ষা করিতেছিলেন। মরা ব্যাঙটি তামার আংটায় ঝুলানো ছিল এবং কাছেই লোহার গরাদ ছিল। হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটনা দেখা গেল। মরা ব্যাঙের দেহ যেমনই গরাদের গায়ে ঠেকিতে লাগিল, অমনি সেইটি জীবিত ব্যাঙের মতো পা ছুঁড়িতে লাগিল। গ্যালভনি তো অবাক। তিনি ভাবিলেন যে, প্রাণীর শরীরে এক রকম বিদ্যুৎ আছে। ধাতু যখন ব্যাঙের দুই অংশে সংযুক্ত করা হইল, তখন সেই বিদ্যুতই তাহার পা সঙ্কুচিত করিল। এই ঘটনা প্রকাশে দেশে বিদেশে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।

এই সময় ভল্টা নামে একজন মহাজ্ঞানী লোক ছিলেন ইতালিতে। তিনি ঐ বিষয়ে পরীক্ষা করিয়া বলিলেন যে, শরীরের বিদ্যুৎ মরা ব্যাঙের পা সঙ্কুচিত করে নাই, উহার গায়ে যে তামা ও লোহা ঘেঁয়ানো ছিল, তাহাই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করিয়াছিল এবং সেই বিদ্যুতই মরা ব্যাঙের পা টানিয়া ধরিয়াছিল। দুই রকম ধাতুকে একত্রে ছোঁয়াইলে যে মরা ব্যাঙ পা ছেড়ে, ভলটা তাহা সকলকে প্রত্যক্ষ দেখাইতে লাগিলেন। অতঃপর তিনি ব্যাঙকে বাদ দিয়া দুইটি পৃথক ধাতুকে গায়ে গায়ে লাগাইলেন এবং তাহার মধ্যে একটি ধাতু যে ধনবিদ্যুতে (Positive Electricity)। এবং অন্যটি ঋণবিদ্যুতে (Negative Electricity) পূর্ণ হইল, তাহা সকলকে দেখাইলেন।

ভলটা তামা ও দস্তা, এই দুইটি পৃথক ধাতুর কতগুলি চাকতি তৈয়ার করিয়া, তামার উপরে দস্তা ও তাহার উপরে তামা পরে পরে সাজাইয়া একটি যন্ত্র নির্মাণ করিলেন এবং তামা ও দস্তার চাকতির মাঝখানে সালফিউরিক অ্যাসিডে ভিজানো ন্যাকড়া রাখিয়া দিলেন। ইহাতে দেখা গেল যে, উপরকার দস্তায় ঋণবিদ্যুৎ এবং সকলের নিচেকার তামায় ধনবিদ্যুৎ জমিয়াছে। তাহার পর। সব তলাকার তামার চাকতির সঙ্গে উপরকার দস্তার চাকতিকে তার দিয়া সংযুক্ত করায় ঐ তার দিয়া বিদ্যুৎ প্রবাহ চলিতে লাগিল। এই যন্ত্রটিকে বলা হয় ‘ভলটার পাইল’।

গ্যালভনির সূচনায় ভলটা তামা, দস্তা ও সালফিউরিক অ্যাসিডের সাহায্যে যে ক্ষীণ বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিচয় পাইয়াছিলেন, বর্তমান কালের সব রকম বিদ্যুৎ উৎপাদক কোষ (Battery Cell) তাহারই উপর প্রতিষ্ঠিত। সব রকম বিদ্যুৎ কোষেই থাকে পৃথক দুইটি জিনিষের ফলক এবং একটি সংযোজক বস্তু, আর বাহিরে থাকে ঐ ফলক দুইটিকে সংযুক্ত করিয়া তামা প্রভৃতি ধাতুর তার বা অন্য কিছু। তবে পরে শত শত বিজ্ঞানী নানা চেষ্টায় বিদ্যুতের ক্ষীণ প্রবাহকে প্রবল করিয়া তুলিয়াছেন এবং তদ্বারা মানুষকে ভেল্কিবাজি দেখাইতেছেন। ভলটার নামানুসারে বিদ্যুৎ প্রবাহের বলকে বলা হয় ভোল্ট।

অধুনা বিদ্যুৎ উৎপাদন করিবার পদ্ধতি দুইটি –রাসায়নিক ও যান্ত্রিক। ভলটার কোষে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে বলা হয় রাসায়নিক বিদ্যুৎ। ইহাতে বিদ্যুতের পরিমাণ এবং প্রবাহক বল খুব বেশি হয় না। তাই উহা দ্বারা বর্তমান সময়ের ঢাকা, কলিকাতা ইত্যাদির মতো বড় বড় শহরের বিদ্যুতের চাহিদা মিটানো যায় না। উহার জন্য আবশ্যক হয় যান্ত্রিক বিদ্যুৎ। যে যন্ত্রের সাহায্যে যথেচ্ছ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, তাহার নাম ডাইনামো। একটি সাধারণ ডাইনামো যন্ত্রে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, হাজার হাজার কোষ সাজাইয়াও তাহা পাওয়া সম্ভব নহে। এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করিলেন লিগ শহরের ‘গ্রাম’ নামক একজন বিজ্ঞানী, মাত্র কয়েক বৎসর আগে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল জানার পর বিজ্ঞানী মহলে উহা লইয়া নানারূপ গবেষণা চলিতে থাকে এবং কয়েকটি সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীগণ জানিতে পারিলেন যে, কোমল লৌহদণ্ডের উপর তার জড়াইয়া ঐ তারে বিদ্যুৎ চালাইলে লৌহদণ্ডটি চুম্বকত্বপ্রাপ্ত হয়। যে কোনোও চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে সংযুক্ত করিয়া কতগুলি চৌম্বক বলরেখা বিদ্যমান থাকে। চুম্বকের বলরেখার মধ্যে রাখিয়া কোনো ধাতব তারের বেষ্টনী (কয়েল বা আর্মেচার) নাড়াচাড়া করিলে উহাতে বিদ্যুতের আবেশ হয় (উহাকে আবিষ্ট বিদ্যুৎ বলে)। পরীক্ষায় ইহাও প্রমাণিত হইল যে, চুম্বকের শক্তি ও বেষ্টনীর তারের প্যাঁচের সংখ্যা যতই বাড়ানো যায় এবং বেষ্টনীকে যত দ্রুত ঘুরানো যায়, বিদ্যুতের পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পায়।

উক্ত সূত্র কয়টি অবলম্বনে গ্রাম সাহেব একটি বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র তৈয়ার করিলেন। ঘোড়ার পায়ের নালের মতো একটি বাঁকানো কোমল লোহার গায়ে তামার তার জড়াইয়া উহাতে ক্ষীণ বিদ্যুৎ প্রবাহ চালানো হইলে লৌহটি চুম্বকে পরিণত হইল। অতঃপর বাঁকানো চুম্বকটির মাঝখানে অর্থাৎ চুম্বকের বলক্ষেত্রে বহুপ্যাঁচবিশিষ্ট একটি বেষ্টনী (আর্মেচার) দ্রুত ঘুরাইতে থাকিলে উহাতে খুব শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইল। রাসায়নিক বিদ্যুৎ ততক্ষণই পাওয়া যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোষে রাসায়নিক ক্রিয়া অব্যাহত থাকে, অতঃপর বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত চুম্বকের বলক্ষেত্রে আর্মেচার ঘুরানো যায়, ততক্ষণ ডাইনামো যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইতে থাকে এবং উহা পরিমাণেও হয় কোষের বিদ্যুতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাই বর্তমানে সব দেশেই ডাইনামো যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হইতেছে। মূলত সকল ডাইনামো যন্ত্রই গ্রামের উদ্ভাবিত ডাইনামো যন্ত্রের উন্নত সংস্করণ মাত্র।

বিদ্যুৎশক্তির দ্বারা বর্তমান দুনিয়ায় বহু অসাধ্য সাধন করা হইতেছে। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, বাতি, পাখা, মোটর, ট্রাম, এক্সরে ইত্যাদি হইতে শুরু করিয়া রান্না-বান্না, এমনকি ঘর ঝাট দেওয়া পর্যন্ত অসংখ্য কাজ বিদ্যুৎশক্তির দ্বারা সম্পন্ন করা হইতেছে। বর্তমান জগতের যাবতীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে বিদ্যুতের ক্ষেত্র সুবিশাল। বিশেষত বিদ্যুৎভিত্তিক যাবতীয় আবিষ্কারগুলিই অতিশয় আশ্চর্যজনক, বলিতে হয় অলৌকিক। বিদ্যুৎশক্তি মানুষকে পৌঁছাইয়া দিয়াছে এক যাদুর রাজ্যে।

পারমাণবিক শক্তি

 মানুষ আজ পর্যন্ত প্রকৃতির গর্ভে যত রকম শক্তির সন্ধান পাইয়াছে, তন্মধ্যে পারমাণবিক শক্তি অতুলনীয়। ইহা মানবকল্যাণের অসংখ্য সম্ভাবনায় ভরপুর। সামান্য কয়েক বৎসরের মধ্যে বহুবিধ জনহিতকর কাজে ইহার ব্যবহার শুরু হইয়াছে এবং এই শক্তিটির সাহায্যে মানুষের গ্রহান্তরে গমনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। কিন্তু নাগাসাকি ও হিরোশিমার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটিবার নিশ্চয়তাবিধান এখনও হয় নাই। আজও কোনো কোনো দেশের ভূগর্ভে বা সাগরবুকে পারমাণবিক বোমা ফাটার শব্দ কানে আসিতেছে। শান্তিবাদীরা ইহাকে যেমন সৃজনাত্মক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রকাশ্যে চেষ্টা চালাইতেছেন, তেমন সাম্রাজ্যবাদীরা ইহার ধংসাত্মক শক্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য গবেষণা চালাইতেছেন গোপনে।

পারমাণবিক শক্তিটির প্রথম সাক্ষাত মেলে পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিক। তত্ত্বের মাধ্যমে (১৯০৫)। তিনি বলিলেন যে, শক্তির সংহতিতে হয় জড়ের উৎপত্তি এবং জড়ের ধংসে হয় শক্তির উদ্ভব। অর্থাৎ পদার্থ ও তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি আসলে একই জিনিষ। তিনি সূত্র করিলেন –E = Mc2।

আমরা জানি যে, ইলেকট্রন-প্রোটনাদি শক্তিকণিকার সংখ্যার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জাতীয় পরমাণু তথা মৌলিক পদার্থের রূপায়ণ। শক্তিকণিকাগুলির প্রত্যেকের স্বকীয় ভর বা ওজন আছে। তাই শক্তিকণিকাগুলির সংখ্যানুপাতে নির্দিষ্ট হয় পরমাণুর ওজন। একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে থাকে ১টি ইলেকট্রন ও ১টি প্রোটন এবং উহার আণবিক ওজন হয় ১.০০৮১৩।[৩৩] হাইড্রোজেনের এই আণবিক ওজনের অর্থ হইল এক জোড়া ইলেকট্রন-প্রোটনের ওজন। একটি হিলিয়ামের পরমাণুতে থাকে ২টি ইলেকট্রন, ২টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন; ইহার আণবিক ওজন হওয়া উচিত ৪.০৩৪১৮। কিন্তু দেখা গেল যে, তাহা না হইয়া একটি হিলিয়াম পরমাণুর ওজন পাওয়া যায় ৪.০০৩৮৪, অর্থাৎ সামান্য কিছু কম। ইহার কারণ কি? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কোনো বিজ্ঞানী তখন দিতে পারিলেন না।

বিজ্ঞানীপ্রবর আইনস্টাইন বলিলেন যে, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন লইয়া হিলিয়াম পরমাণু যখন প্রথম গঠিত হয়, তখন একটুখানি পদার্থ বিনষ্ট হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বহু পরিমাণ শক্তি বাহির হইয়া যায়। আইনস্টাইনের অঙ্কের হিসাবে দাঁড়াইল— একটি হিলিয়াম পরমাণুর উৎপত্তির জন্য পদার্থের বিলোপে যে শক্তির উদ্ভব হয়, তাহা তিন কোটি বিভবের (potential) তড়িৎ দ্বারা চালিত একটি ইলেকট্রনের শক্তির সমান। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী এডিংটন বলেন যে, সূর্যের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত হাইড্রোজেনের শতকরা দশভাগ যদি হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়, তবে তাহাতে যে শক্তির উদ্ভব হইবে, তাহা সূর্যের বর্তমান তেজকে বজায় রাখিতে পারিবে ১০০ কোটি বৎসর।

ঐ সম্পর্কে বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলিয়াছেন, “ভবিষ্যতে কোনো গবেষক যদি পদার্থের অন্তর্নিহিত শক্তিকে এইরূপভাবে মুক্ত করিতে পারেন, যাহাতে উহা মানুষের কাজে আসিতে পারে, তবে মনুষ্য জাতি যে প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হইবে, তাহা বিজ্ঞানের কল্পনার অতীত। এই শক্তি মুক্ত হইলে, হয়তো উহা মানুষের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাইবে এবং উহার প্রচণ্ডতা হয়তো নিকটবর্তী যাহা কিছু আছে, সব ধ্বংস করিবে। এইরূপে হয়তো পৃথিবীর সমস্ত হাইড্রোজেন মুহূর্তের মধ্যে রূপান্তরিত হইয়া শক্তিতে পরিণত হইবে এবং তাহা হইলে এই পরীক্ষার সাফল্যে আমাদের পৃথিবী হয়তো ব্রহ্মাণ্ডের একটি নূতন নক্ষত্ররূপে প্রকাশিত হইবে।”

বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের আইনস্টাইনের সূত্র ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কল্পনাসমূহ পরবর্তী বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে বাস্তব রূপ পাইল কয়েক বৎসরের মধ্যেই। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশের ও কানাডার বহু বিজ্ঞানীই পরমাণু ভাঙ্গিয়া উহার। শক্তি সংগ্রহের জন্য নানারূপ গবেষণা করিতে থাকেন এবং বিজ্ঞানী অটোহান ও স্ট্রাসমান পরমাণু ভাগিতে সক্ষম হন। এই সময়টিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয় এবং হিটলারের স্বেচ্ছাচারিতায় উত্ত্যক্ত হইয়া জার্মানি, ইতালি, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি হিটলারের প্রভাবাধীন দেশসমূহের নীলস্ বোর, এনরিকো ফার্মি, ইউজিন ওয়াইগনার, হান, মাইটনার, স্ট্রাসমান ও আইনস্টাইন প্রভৃতি বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্বদেশ ত্যাগ করিয়া যুক্তরাষ্ট্রে চলিয়া যান। যুক্তরাষ্ট্র সরকার নবাগত ইউরোপীয়ান বিজ্ঞানীগণকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং আবশ্যকীয় অর্থ ও মাল-মশলা দ্বারা পারমাণবিক শক্তি উন্মোচনে তাহাদিগকে যথাযোগ্য সাহায্য করিতে থাকেন।

ইতালির বিজ্ঞানী ফার্মির পরিচালনায় তত্ৰত্য দেশী ও বিদেশী বিজ্ঞানীগণের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের একটি স্কোয়াশ কোর্টে ইউরেনিয়ামের পরমাণু ভাঙ্গিয়া পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন সাধ্যায়ত্ত হয় ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর।

পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কৃত হইলে বিজ্ঞানীগণ মনোনিবেশ করেন পারমাণবিক বোমা তৈয়ার করিতে। আমেরিকার ওপি, ইতালির ফার্মি ও সেগ্রি, ডেনমার্কের নীলস বোর, বৃটিশ মিশনের নেতা শ্যাডউইক প্রমুখ বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী ও তাহাদের সহকর্মীদের সমবেত গবেষণার ফলে অচিরেই তাঁহারা পারমাণবিক বোমা তৈয়ার করিতে সক্ষম হইলেন –নিউ মেক্সিকোর লস আলাম-এ।

পারমাণবিক বোমা তৈয়ার হইলে ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে উহার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় লস আলামস হইতে দুইশত মাইল দূরে মেক্সিকোর আলমো গোর্ডো মরুবক্ষে। ট্রিনিটিতে। ইহাই দুনিয়ার সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ।

পারমাণবিক বোমার কার্যকর ব্যবহার হইল জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমা নিবাসী হতভাগ্য মানুষদের প্রাণের উপর, আগস্ট ১৯৪৫-এ। শুধু মানুষই বা বলি কেন, বাদ গেল না পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং জলজন্তুরাও। নিমেষে ধংস হইল অসংখ্য প্রাণী।

পারমাণবিক বিস্ফোরণের সময়ে যে সব তেজস্ক্রিয় রশ্মি বাহির হইয়া আসে, তাহা জীবদেহে। নানারূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই সম্বন্ধে জাপানের বিজ্ঞানী ডাক্তার মাসাও সুজুকি বলিয়াছেন, “আণবিক পরীক্ষাকার্য এখন বন্ধ করে দিলেও, যা বিস্ফোরণ এ পর্যন্ত হয়েছে, তার ফলেই ২৬ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার লোক লিউকেমিয়া রোগের কবলে পতিত হবে।” তেজস্ক্রিয়, রশিমালা প্রথমত জীবদেহে ঢুকিয়া রক্তের শ্বেত কণিকার সংখ্যা বাড়াইয়া তোলে এবং লোহিত কণিকাগুলি নষ্ট করিয়া দেয়, ফলে রক্তশূন্যতাজনিত পূর্বোক্ত লিউকেমিয়া রোগ দেখা দেয় ও কোনো কোনো কোষ মারাও যায়। রুগ্ন কোষগুলির বংশবৃদ্ধির ফলে ক্যানসার বা কর্কট রোগ ও চক্ষুর ছানি রোগ দেখা দেয়।

আমরা জানি যে, জীবের জন্মমুহূর্তে থাকে একটি মাত্র জীবকোষ (জননকোষ) এবং তাহাতে ৪৬টি ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমে আবার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম একটি পদার্থ থাকে, যাহাকে বলা হয় জীন। এই জীনগুলিই হইল জীবের বংশগতির বৈশিষ্টের নিয়ামক। পারমাণবিক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এই জীনগুলির বিশেষ ক্ষতি করে। কোনো স্ত্রীলোক বিকিরণাহত হইলে তাহার সন্তানোৎপাদিকাশক্তি রহিত হইয়া যায় বা কোনো কোনো অবস্থায় গর্ভপাত হয়, কোনো কোনো সময়ে পুরুষেরাও বন্ধ্যাত্ব লাভ করে।

আবার কোনো কোনো সময় তেজস্ক্রিয় রশ্মির ছোঁয়ায় জীনগুলির বিশেষ পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানী স্লেটিস-এর মতে, এই পরিবর্তন বংশানুক্রমে চলিতে থাকে এবং পরিবর্তিত জীনধারী দম্পতির জন্মে অপূর্ণ, অপরিণত ও স্বল্পায়ু সন্তান।

পরম সুখের বিষয় এই যে, বর্তমানে প্রায় সকল রাষ্ট্রই পারমাণবিক মহাশক্তিকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার জন্য উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে এবং বিজ্ঞানীগণ কৃষি, চিকিৎসাদি নানা ক্ষেত্রে ইহার ব্যাপক ব্যবহারের গবেষণা চালাইতেছেন। বিজ্ঞানীদের কাছে এখন আর অসম্ভব বলিয়া বেশি কিছু নাই। এই পারমাণবিক মহাশক্তির দ্বারা হয়তো একদিন সম্ভব হইবে মেরু অঞ্চলকে উত্তপ্ত এবং মরু অঞ্চলকে শীতল ও উর্বরা করিয়া উভয়ত প্রাণীবাসের সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা, জীবকোষের স্বাভাবিক ক্ষয় রোধ বা পূরণ করিয়া জীবকে অমর বা দীর্ঘায়ু করা এবং অনুরূপ আরও অনেক কিছু; হয়তোবা প্রাণসৃষ্টিও।

পারমাণবিক শক্তি একটি মহাশক্তি। শত শত বিজ্ঞানী আজ ব্যস্ত রহিয়াছেন এই শক্তিসমুদ্র মন্থনে। সমুদ্রমন্থনের একটি পৌরাণিক আখ্যান মনে পড়িল। আখ্যানটি এইরূপ — মহর্ষি দুর্বাসার শাপে দেবরাজ ইন্দ্র শ্রীহীন হইলে লক্ষ্মী সমুদ্রগর্ভে গিয়া বাস করেন। তাহাতে ত্রিলোক শ্রীভ্রষ্ট হয়। পরে ব্রহ্মার উপদেশে দেবগণ মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড এবং বাসুকিকে মন্থনরঙ্কু করিয়া সমুদ্রকে মন্থন করিতে থাকেন। এইরূপ মথিত হইলে সমুদ্র হইতে লক্ষ্মী, চন্দ্র, পারিজাত, ধন্বন্তরী, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈশ্রবাঃ অশ্ব প্রভৃতি ও অমৃত উত্থিত হয়। দেবতারা উহা ভাগ করিয়া লন ও অমৃত পান করিয়া অমর হন।

মন্থন শেষ হইলে মহাদেব পুনরায় সমুদ্র মন্থনে প্রবৃত্ত হন এবং তাহাতে ভীষণ হলাহল (বিষ)-এর উৎপত্তি হয়। সেই বিষ এতই অত্যুগ্র যে, ধরিত্রীর কোথায়ও উহা রাখিলে, বিষের জ্বালায় সেই স্থান জ্বলিয়া-পুড়িয়া ছারখার হইয়া যাইবে। অগত্যা মহাদেব স্বয়ং উহা পান করিলেন। কিন্তু গলাধঃকরণ করিলেন না, কণ্ঠে ধারণ করিলেন; তাহাতে তাহার কণ্ঠ হইল নীলবর্ণ। তাই মহাদেবের এক নাম নীলকণ্ঠ।

বর্তমান জগতের বিজ্ঞানীদেবগণ পারমাণবিক শক্তিসমুদ্র মন্থন করিয়া অমৃত উৎপন্ন করিলে পৃথিবী হইবে মানুষের অমরাপুরী, না হইলেও শান্তিনিকেতন। কিন্তু মহাদেব বিজ্ঞানীরা হলাহল উৎপন্ন করিলে, উহার জ্বালায় পৃথিবী জুলিয়া পুড়িয়া হইবে অগ্নিকুণ্ড বা নরকপুরী, যাহাকে বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলিয়াছেন ‘জ্বলন্ত নক্ষত্র’। উহাকে নীলকণ্ঠের মতো আয়ত্তাধীনে আনিবার ক্ষমতা বিজ্ঞানী। মহাদেবদের হইবে কি?


২৯. প্রাচীন মিশর, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৪৮।

৩০. পৃথিবীর ইতিহাস, দেবীপ্রসাদ, পৃ. ১৯৮, ১৯৯।

৩১. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৫, ৬।

৩২, প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১০।

৩৩. বিশ্বের উপাদান, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, পৃ. ৪২।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x