কলেজ-জীবনে পা রাখা আর দীক্ষার শুরু—একই সময়ে। দীক্ষা মানে ধর্মগুরুর কাছ থেকে দীক্ষা। মাথার দুষ্টুবুদ্ধি নড়ে-চড়ে উঠেছিল। ঠিক করলাম বিভিন্ন ধর্মগুরুদের দীক্ষামন্ত্র বা বীজ মন্ত্রগুলো জানতে হবে। যেমন-ই ভাবা, অমনি কাজে নেমে পরলাম ।

বাবা তখন রেলের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বছরে দুটো ‘পাস’ পেতেন। আমি ছাত্র, বাবার ওপর নির্ভরশীল। তাই আমার নামেও বিনে পয়সায় রেলে চড়ার পাস পেতেন। দূরের গুরুদের আশ্রমে হাজির হতে পাসগুলোই ছিল ভরসা। কাছাকাছিদের কাছে ট্রামে-বাসে-ট্রেনেই মেরে দিতাম। এসব নবজন্মের অভিযানে প্রায়শই আমার সঙ্গী হত তপন চট্টোপাধ্যায় আর গোরাচাঁদ দত্ত। দুজনেই আমার কৈশোরের সঙ্গী ও সহপাঠী। হাঁটতেও পারতাম তখন। পাঁচ-দশ মাইল হাঁটাটা কোনও ব্যাপারই ছিল না।

গুরুদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে আন্তরিকতা ছিল একশো ভাগ। যাঁদেরকে আমার মনে ধরেছে, তাঁদের কাছেই দীক্ষা নিতে চেয়েছি এবং পেয়েছি। ‘দীক্ষা’ মানে নবজন্ম ৷

গুরুদের সংখ্যা পঁচিশ অবশ্যই পেরিয়েছে। এঁদের কাছে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত মতে দীক্ষা হয়েছে। গুরুদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সব সময়-ই ছিল একটু অদ্ভুত। গুরুদের কাউকে প্রণাম করতাম না, ‘আপনি’ সম্বোধন করতাম না। এ’জন্যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হত। উত্তরে বলতাম, আমার গুরু আর আমি দু’জনেই পরমব্রহ্মেরই অংশ, সুতরাং অন্তরের শ্রদ্ধা বাইরে দেখাবার কোনও প্রয়োজন দেখি না। বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলে সম্মান দেখাবার কথা বলছেন। আমাদের সবার আত্মাই তো চির কালই ছিল, জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। সুতরাং আমি বলতে আমার শরীরের বদলে আত্মাকে বোঝালে, আমরা সবাই বয়সে সমান।

গুরুদের প্রায় সকলেই আমাদের যত্ন-টত্ন করতেন। যা যা খেতে চাইতাম, খাবার ব্যবস্থা করে দিতেন। এঁদের অনেকেই শিষ্যদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমি ঈশ্বরের অংশ, অবতার। এ’সবই ছিল আমার দুষ্টুমির ফল। আমাকে দলে টানলে লাভ বেশি—হয়তো তাঁদের মধ্যে এমন চিন্তা ছিল। অথবা, একটু বাড়তি তোল্লাই দিলে গুরুর ভাণ্ডাফোড় থেকে বিরত থাকবো—এমন ভাবনা ছিল।

আমার ওপর অবতারত্ব চাপিয়ে দেওয়ায় একবার খুব মুশকিলে পড়েছিলাম। গোরাচাঁদদের পরিবারের সকলেই জন্মসিদ্ধ বালক ব্রহ্মচারীর শিষ্য। গোরার সামনেই একগাদা শিষ্যদের কাছে আমাকে দাঁড় করিয়ে বালকব্রহ্মচারী বাছা বাছা বিশেষণে বুঝিয়ে দিলেন, আমি একজন অবতার। ব্যস। গোরাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য গোরা বারবার অনুরোধ করতে লাগলো। বিপদের গন্ধ পেলাম। শেষ পর্যন্ত অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। আর ওদের বাড়িতে পা দিতেই কেলেংকারির একশেষ। গোরার মা-বাবা গুরুর কথায় বিশ্বাস করে আমাকে অবতার ঠাওরে আমার পা ধুইয়ে, মুছিয়ে প্রণাম নিবেদন করতে চান। গুরুভক্তদের ‘সত্যি’ বোঝানো যে কী কঠিন, তা সে’দিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।

হিন্দু উপাসনা ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আর পাঁচটা উপাসনা-ধর্মের মতো কোনও একজন ঈশ্বর প্রেরিত দূত ঈশ্বরের বাণী প্রচার করে বাণীগ্রহণকারীদের নিয়ে হিন্দু উপাসনা, ধর্ম গড়ে তোলেননি। এ’দেশে নানা পর্যায়ে, নানা কালে, নানা ভাবে ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে ছিল নানা ধরনের জাদু-বিশ্বাস। এলো মুনি-ঋষি নামধারী জাদু-পুরোহিতদের রমরমার যুগ। তাঁরা দেবতার ওপরে নিজেদের স্থান পাকা করতে কৌশল-টৌশল করলেন। রসে-বসে দিব্বি রইলেন।

হিন্দু উপাসনা-ধর্মের মূল ধারাগুলো খুঁজে বের করার পর আর এক

সমস্যা। যত ধর্মগুরু, তত ধর্মমত। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত—যে,

দিকেই তাকান দেখতে পাবেন, যত গুরু ততই

গুরুতর বিভেদ। এই ঐতিহ্য আমরা

আজও বহন করে চলেছি।

আরও একটা মস্ত ঐতিহ্য বৈদিক ঋষিদের কাল থেকে আজও বজায় রেখে চলেছি—কিছু জ্ঞান দেওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন বোধ করি না।

 

হিন্দু উপাসনা-ধর্মের ‘পঞ্চোসাধনা’ ও তন্ত্র

বর্তমানে ভারতে হিন্দু উপাসনা-ধর্মের ধারা পাঁচটি। (১) বৈষ্ণব, (২) শৈব, (৩) শাক্ত, (৪) সৌর, (৫) গাণপত্য। এই পাঁচটি ধারাকে একত্রে বলা হয় ‘পঞ্চোসাধনা’। একটা ভুল ধারণা বহুল প্রচলিত—শাক্ত ধর্মেই শুধু তান্ত্রিক নীতি প্রয়োগ করা হয়। বৈষ্ণব ধর্মেও তান্ত্রিক নীতি আছে। তার প্রমাণ মিলবে লক্ষ্মীতন্ত্রে (নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত) ও মার্কণ্ডেয় পুরাণে। শৈব ও শাক্ত ধর্মের মূল তন্ত্রতত্ত্ব একই। পার্থক্য এই যে, শৈব ধর্মে পুরুষ নিষ্ক্রিয় হলেও প্রধান। শাক্ত ধর্মে প্রকৃতি বা নারী শক্তিই প্রধান। বৈষ্ণব ধর্মে বিষ্ণুপুরুষ। লক্ষ্মী প্রকৃতি বা নারীশক্তি। কৃষ্ণ পুরুষ শক্তি, রাধা নারী শক্তি। শৈব ধর্মে শিবের শক্তি কালী, তারা ইত্যাদি। তন্ত্রের আকর গ্রন্থ ‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ-এ বলা হয়েছে, “ইনি (গণেশ) হস্তে পদ্ম, অঙ্কুশ এবং রত্নকুম্ভ ধারণ করিয়াছেন। ইঁহার ক্রোড়ে পদ্মের ন্যায় কান্তি বিশিষ্ট শক্তি আছেন, ঐ দেবীর যোনিদেশে ইঁহার (গণেশের) এক হস্ত নিহিত আছে এবং ঐ ক্রোড়স্থিতা শক্তি হস্তদ্বারা তাঁহার (গণেশের) ধ্বজাগ্রভাগ (লিঙ্গের মাথা) স্পর্শ করে রয়েছেন।” (পৃষ্ঠা ২০৮)।

এই পুরুষ ও প্রকৃতি বা পুরুষ ও শক্তির মিলন নির্ভর ধর্মীয়

ধারাগুলো তন্ত্র-সাধনারই ধারা। “পঞ্চোসাধনাতে’-ই এই

পুরুষ-প্রকৃতির মিলন নির্ভরতা আছে।

 

বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের খিচুড়ি

ভারতে প্রাচীন আমল থেকেই বৌদ্ধতন্ত্রের একটি ধারা ছিল এবং এখনও বর্তমান ৷ ভারতে বৌদ্ধতন্ত্রের যে ধারাটি বর্তমান তা হল মহাযান ও মহাযান থেকে উৎপন্ন নানা শাখা, উপশাখা ইত্যাদি। এগুলো আসলে হিন্দুতন্ত্রে-ই ‘প্রোডাক্ট’ ।

মহাযান বৌদ্ধধর্মে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকবিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। স্থানীয় নানা দেব-দেবী বৌদ্ধধর্মে ঢুকে পড়েছিল। যেহেতু সে সময়কার ভারতীয় সমাজ ছিল কৃষিনির্ভর, তাই ভারতে দেবীপ্রাধান্য ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মেও আমরা দেখলাম নানা দেবীর প্রাধান্য নিয়ে অনুপ্রবেশ। বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বকে পুরুষ কল্পনা করে দেবীদের তাঁর সাধন-সঙ্গিনী, নারীশক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হল ।

তন্ত্রে বিশ্বাস প্রাক্-আর্য যুগ থেকেই ভারতবর্ষে ছিল। এবং এই তন্ত্রের ধারা ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি উপাসনা-ধর্মকেই প্রভাবিত করেছিল। বৌদ্ধধর্মের মহাযান এই মূলস্রোতের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়েছিল।

অনঙ্গবজ্রের ‘প্রজ্ঞোপায় বিনশ্চয়সিদ্ধি’ মহামানপন্থীদের একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। এই- গ্রন্থে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পঞ্চ ম’কার সাধনার নির্দেশ। অর্থাৎ মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা বা নানা বিচিত্র মৈথুন পদ্ধতি গ্রহণের নির্দেশ। মৈথুন-ই হল তন্ত্র সাধনার মূল অনুষঙ্গ। মহমুদ্রার অভিজ্ঞতার জন্য, অর্থাৎ নানা মুদ্রার সঙ্গে নিজের পরিচয় ঘটাবার জন্য নির্বিচারে নারী সম্ভোগের কথা গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। তন্ত্র গ্রন্থটিতে আরও বলা হয়েছে—তন্ত্র যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সাধককে তাঁর মাতা, কন্যা, ভগ্নি, ভাগিনেয়ীর সঙ্গে উপগত হতে হবে দ্বিধাহীন মনে। দ্বিধা-ই পাপ। কী ভয়ংকর অজাচার চাপিয়ে দেওয়া ধর্মের নামে।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে ‘ধারণী’ নামের এক ধরনের তন্ত্রশাস্ত্রের পরিচয় মেলে। এখানে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের উল্লেখ রয়েছে।

বৌদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থটিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম্’ মন্ত্রটির। ‘মণিপদ্মে

শব্দের অর্থ ‘যোনিতে লিঙ্গ’। জানি না, যাঁরা শান্ত পরিবেশে ‘ওঁ

মণিপদ্মে হুম্’ শব্দটি ব্যবহার করে একটা দারুণ কিছু মন্ত্ৰ

উচ্চারণের আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, তাঁরা

শব্দটির অর্থ জানেন কি না?

বৌদ্ধতন্ত্রের দুটি উল্লেখযোগ্য আকরগ্রন্থ ‘মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ ও ‘গুহ্যসমাজ’। বই দু’টির রচনাকাল খ্রিস্টিয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক ।

বৌদ্ধতন্ত্রের এই দুই গ্রন্থের মতে, প্রতিটি সৃষ্টির পিছনেই রয়েছে নারী-পুরুষের মিলন। মিলনের ক্ষেত্রে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাই শ্রেষ্ঠ। প্রজ্ঞার সঙ্গে উপায়ের (পুরুষের) মিলনই প্রকৃত বোধ আনতে সক্ষম। সর্বোচ্চ অধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভের জন্য নারী ও পুরুষের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক মিলনের প্রয়োজন। এই তিনের মিলনে সত্যের উপলব্ধি ঘটে। এই কথা মাথায় রেখে নারী-পুরুষের মিলন গুহ্য অর্থাৎ গোপন সাধনা হিসেবে কাম্য। এখানে নারী-পুরুষ সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক । প্রজ্ঞা নারী অর্থ ভগবতী নারী। অর্থাৎ ‘ভগ’ বা ‘যোনি’ বিশিষ্টা নারী। ‘প্রজ্ঞা’র আসল অর্থ পুষ্ট যোনি। ‘উপায়’ বা আদর্শ-পুরুষের আর এক নাম বজ্র, যার অর্থ বজ্রের মত পুরুষাঙ্গ। প্রজ্ঞা ও উপায় অর্থাৎ পুষ্ট যোনি ও বজ্র কঠিন লিঙ্গের দীর্ঘ মিলন। শারীরিক মিলনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক মিলন জগতের সব কিছুকে ভুলিয়ে দিয়ে এক অনন্য সুখ ও আনন্দের জগতে নিয়ে যায়। এই মহাসুখ, এই অপার আনন্দই হচ্ছে নির্বাণ। এটাই মহাযানপন্থীদের বিভিন্ন শাখার মূল বিশ্বাস ।

মহাযান থেকে মন্ত্রযান, মন্ত্রযান থেকে বজ্রযানের উৎপত্তি। বজ্রযানের একটি শাখা কালচক্রযান। বজ্রযানের দেবীরা হলেন প্রজ্ঞাপারমিতা, আর্য-তারা, লোচনা ইত্যাদি। কালচক্রযানের দেবীদের যেমন নাম, তেমনই ভয়ংকর তাদের চেহারা। এরা ভয়ংকর সব রক্তপিপাসু ডাকিনী। বঙ্গদেশ, মগধ, নেপাল ও কাশ্মীরে কালচক্রযান যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই ডাকিনীরা আসলে কালীর অংশ। এরা উচ্চকলরব তুলে হাসে, ভয়ংকর ঝড় তুলে সমুদ্রকে আলোড়িত করে, রক্তপানে আনন্দ পায়।

বজ্রযান থেকেই উৎপত্তি সহজযানী বৌদ্ধধর্মের। সহজযানীরা তাদের ধর্মকে বাস্তবিকই সহজ-সরল রূপ দিয়েছিল। সহজযানীরাও মনে করতো——যাহা আছে ব্ৰহ্মাণ্ডে, তাহা আছে দেহভাণ্ডে’। তারাও যোগের নীতিতে বিশ্বাস করতো। বিশ্বাস করতো মানব দেহের ছয়টি চক্র ও মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্মের অস্তিত্বে।

সহজযান মূলত বঙ্গদেশের নিজস্ব এক বৌদ্ধ মত। পাল আমলে সহজযানী বৌদ্ধদের রমরমা ছিল বঙ্গদেশে। পাল আমল বলতে ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৩০ খ্রিস্টাব্দ। এই সময় বৌদ্ধধর্মের নামে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল ব্যাপক। পাল রাজারা বহু বৌদ্ধ মঠ ও বিহার তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেইসব মঠ ও বিহারগুলোতে তন্ত্র গবেষণার জন্য অঢেল অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। সেখানে বিভিন্ন ঘরে বৌদ্ধ- যুগনন্ধ সাধনা অর্থাৎ মৈথুন সাধনা চলত। যার অর্থ হল নানা মুদ্রায় নারী-পুরুষের মিলনলীলা। এই মিলনের জন্য অঢেল নারী সরবরাহ করা হত। কারণ—যত নারী, তত শক্তি। যত বেশি নারীর সঙ্গে মিলিত হবে তত বেশি শক্তি অর্জন করবে, তত বেশি অলৌকিকক্ষমতা অর্জন করবে, ততই নির্বাণের দিকে এগোবে।

‘রুদ্রযামল’, ‘মহাচীনাচারক্রম’ ইত্যাদি তন্ত্রগ্রন্থে বশিষ্ঠ মুনির সিদ্ধিলাভ নিয়ে একটি কাহিনীর উল্লেখ আছে। বশিষ্ঠ মুনি কামরূপের কামাখ্যা দেবীর কাছে দীর্ঘকাল সাধনা করেও সিদ্ধি লাভে ব্যর্থ হন। স্বয়ং তারাদেবী বশিষ্ঠকে দেখা দিয়ে বলেন, চিনদেশে গিয়ে বুদ্ধের কাছ থেকে তন্ত্র শিক্ষা নিতে। বশিষ্ঠ চিনে যান। বুদ্ধকে প্রথম যখন দেখলেন, তখন বুদ্ধ অসংখ্য নগ্না নারী পরিবৃত হয়ে রক্ত ও মদ্যপান করছেন। অবাক বশিষ্ঠকে বুদ্ধ বললেন, বিস্মিত হইও না। পঞ্চমকার ছাড়া সিদ্ধি বা নির্বাণের কোনও পথ নেই।

“মদ্যং মাংসং তথা মৎস্যং মুদ্রাং মৈথুনং এব চ।

পুনঃ পুনঃ সাধয়িত্বা পূর্ণ-যোগী বভুব সঃ।

মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন দ্বারা বারবার সাধনা করে পূর্ণ-যোগী হতে

হয়। কী ভয়ংকর কথা? ‘পূর্ণ-যোগী’ শব্দের প্রকৃত অর্থ কি

‘পূর্ণ-ভোগী’? প্রাচীন জাদু পুরোহিতরা সাধারণ মানুষদের

কী আহাম্মক-ই না বানিয়েছিল। ‘বানিয়েছিল’

বলে ভুল করলাম—এখনও

বানিয়ে চলেছেন।

মহাযানপন্থীদের অনেক শাখাই বুদ্ধের তিনটি মূর্তি রেখে পুজো করে। এই ত্রিমূর্তিকে বলে “ত্রিকায়’। মূর্তি তিনটি হল : (১) ধর্মকায় অর্থাৎ বুদ্ধের অধ্যাত্মিক দেহ, (২) সম্ভোগকায় অর্থে-সম্ভোগের আনন্দপূর্ণ দেহ, (৩) রূপকায় অর্থে বাস্তব দেহ তিন বুদ্ধই সত্য। তিন বুদ্ধকে রেখে তাই পুজো করা হয়। সম্ভোগ বুদ্ধ হলেন তান্ত্রিক-বুদ্ধ ৷

বৌদ্ধতন্ত্র, বৈদিক যুগের যোগ ও পরবর্তীকালের তন্ত্র কুলকুণ্ডলিনী শক্তিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে চূড়ান্ত মিলনের বিস্ফোরণ কালে মস্তিষ্কের উষ্ণীষকমল হাজার পাপড়ি মেলে দেয়।

 

বৈষ্ণবধর্ম ও তন্ত্র

হিন্দু উপাসনা-ধর্মের অন্যতম প্রধান ধারা বৈষ্ণবধর্ম। সাধন-সিদ্ধ হওয়ার জন্য তন্ত্রের সেই পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব বৈষ্ণবধর্মেরও সার কথা ।

যাঁরা মনে করেন বৈষ্ণবধর্ম ভক্তিযোগের ধর্ম, এখানে তন্ত্রের স্থান নেই—তাঁরা জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ভুল বলেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।

হিন্দু উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে যে সম্প্রদায় বিষ্ণু, নারায়ণ, বাসুদেব, কৃষ্ণ বা গোপাল ইত্যাদিকে উপাস্য দেবতা মনে করে, তারাই বিষ্ণুধর্মী বা বৈষ্ণব। ভারত বিরাট দেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈষ্ণবদের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে।

বৈষ্ণবধর্মের শুরু সম্ভবত পশ্চিম ভারতে। বৈষ্ণবরা আদিতে যাদব উপজাতির মানুষ ছিলেন। কৃষ্ণ এই যাদব উপজাতির একজন বুদ্ধিমান বীর ছিলেন। কৃষ্ণকে পরবর্তীকালে দেবতা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এক সময় কৃষ্ণ ও বৈদিক বিষ্ণুকে এক ও অভিন্ন বলে যাদবগোষ্ঠীরা মনে করতে থাকে। পরবর্তীতে অন্যরাও।

যাদবদের মধ্যে কৃষ্ণকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা, ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়া, এবং কৃষ্ণ ও বিষ্ণুকে অভিন্ন মনে করে নিজেদের বৈষ্ণবধর্মী বলে ঘোষণা করার আনুমানিক কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক।

নারায়ণকে যদিও কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর সঙ্গে অভিন্ন বলে বৈষ্ণবরা মনে করেন, কিন্তু নারায়ণ সম্ভবত ‘নর’ গোত্র বা ‘ক্ল্যান’-এর কোনও বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। তৈত্তিরীয় অরণ্যকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নারায়ণ, বাসুদেব ও বিষ্ণুকে অভিন্ন বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। মহাভারতের শান্তিপর্বে আমরা দেখতে পেলাম কৃষ্ণ, হরি, নর, নারায়ণ চারজনকে অভিন্ন বলা হয়েছে।

পশ্চিম ভারতের পশুপালক উপজাতিগোষ্ঠী আভীর। তাদের নেতা ‘কৃষ্ণ’ গোপীদের সঙ্গে যে সব রসলীলা করেছিলেন—তা নিয়েও গড়ে উঠেছে আরও এক কৃষ্ণ চরিত্র।

কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম (১০৮টি নাম) দেখে মনে হয় আরও কিছু উপজাতিদের জাতির নায়ক বা দেবতার সঙ্গে কৃষ্ণের ট্রাইবাল চরিত্রগত মিল থাকার কারণে এক সময় এঁরা অভিন্ন চরিত্রের মান্যতা পায়। এইসব চরিত্রগুলো অভিন্নভাবে উঠে এসেছে মহাভারতে, গীতায়, পতঞ্জলির মহাভাষ্যে।

মথুরার কাছে ‘মোরা’ থেকে একটি শিলালেখ পাওয়া যায়। লেখটি খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের। এতে পাঁচ বৃষ্ণি বীরের কথা আছে। এরা হলেন, সংকর্ষণ (কৃষ্ণের বড় ভাই, বাসুদেব, প্রদ্যুম্ন (বাসুদেব বা কৃষ্ণের ছেলে), শাম্ব (বাসুদেবের আর এক ছেলে এবং অনিরুদ্ধ (প্রদ্যুম্নের ছেলে)।

বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা জেলায় দ্বিতীয় শতকের তৈরি পাঞ্চাল রাজের যে মুদ্রা পাওয়া গেছে, তাতে শঙ্খ, চক্র, গদাধারী একটি চতুর্ভুজ মুর্তি উৎকর্ণ দেখা যায়। অনুমান করা যায়, এ’ও বিষ্ণুধর্মের প্রভাবেরই ফল। কুষাণ আমলের শিলেও শঙ্খ, চক্র, গদাধারী চতুর্ভুজ মূর্তি পাওয়া গেছে।

এ’সব শিলালেখ, বৈদিক সাহিত্য, নানা উপজাতিদের ইতিহাস থেকে এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দেবতারা এক সময় অভিন্ন বলে ঘোষিত হয়েছিল। এইসব দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু, কৃষ্ণ, নারায়ণ, বাসুদেব, মধুসূদন, গোপাল ইত্যাদি প্রধান। এইসব অভিন্ন দেবতাদের উপাসনা পদ্ধতি বৈষ্ণবধর্ম বলে ঘোষিত হয়েছে।

 

আঢ়বার

ষষ্ঠ থেকে নবম শতকে দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ধর্মের বিশাল প্রভাব ছিল। ‘আঢ়বার’ নামের বৈষ্ণব সাধক সম্প্রদায় চার হাজারের বেশি ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। এইসব গান ছিল কৃষ্ণ, নারায়ণ, বলরাম, ইত্যাদিদের নিয়ে

একাদশ শতকে রামানুজ শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আচার্য হন। এই সময় ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত মহলে শংকরাচার্যের বেদান্ত সূত্র যথেষ্টর বেশি প্রভাব ফেলেছে। শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদ বা বেদান্ত সূত্রের মূল কথা—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। দৃশ্যমান বস্তুজগতের সব কিছুই মিথ্যা। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রামানুজ বললেন, ব্রহ্ম থেকেই সবের উৎপত্তি। সবেই ব্রহ্ম বর্তমান। ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় হলেও তিনি তিনটি রূপের প্রতীক। তিনিই জীব ও জড়জগতের স্রষ্টা বা নিমিত্ত, ভোক্তা এবং ধ্বংসের কারণ। রামানুজের রচনাবলীর মধ্যে বেদান্ত সূত্রের বৈশিষ্ট্য, দ্বৈতবাদী ভাষ্য, বেদান্তসার, বেদান্তদীপ ইত্যাদি বিখ্যাত ।

 

নিম্বার্ক ও বল্লবপন্থী

নিম্বার্ক ছিলেন দ্বাদশ শতকের মানুষ। দক্ষিণ ভারতীয় হলেও তাঁর সাধনক্ষেত্র ছিল বৃন্দাবন। নিম্বার্কপন্থী বৈষ্ণবরা কপালে ও কণ্ঠে তিলক লাগান। গলায় তুলসীর মালা ধারণ করেন। উপাস্য গোপীজনবল্লভ হলেন পুরুষ এবং প্রকৃতি বা শক্তি হলেন রাধা।

বল্লভের জন্ম ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে। দক্ষিণ ভারতের মানুষ হলেও তাঁর ধর্মীয় জীবন কেটেছে মথুরা, বৃন্দাবন ও বারাণসীকে কেন্দ্র করে। বল্লভপন্থীরা কৃষ্ণকে প্রেমিক, শৃঙ্গার রসের আধার, আনন্দময় পুরুষ বলে মনে করেন। বস্তুত কৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ এবং সব জীবাত্মাই নারী—এমনটা বিশ্বাস করেন। তাই নারীভাবে তাঁরা কৃষ্ণ ভজনা করেন। পরিধান করেন শাড়ি। এবং তাঁরা কৃষ্ণকেই স্বামী মনে করেন। গুজরাট ও রাজস্থানে বল্লভপন্থী বৈষ্ণবদের প্রভাব খুবই বেশি। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে গুরুবাদ অত্যন্ত প্রবল। সব কিছুই তাঁরা প্রথমে গুরুকে নিবেদন করে তারপর নিজেদের ভোগে লাগান। সব কিছুই । স্বামীনারায়ণ একজন বল্লভপন্থী বৈষ্ণব। তাঁকে কেন্দ্র করে স্বামীনারায়ণ গোষ্ঠী ও স্বামীনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণবধর্ম

বল্লভেরই প্রায় সমসাময়িক ছিলেন শ্রীচৈতন্য। জন্ম ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর জন্ম বঙ্গদেশে হলেও কর্মক্ষেত্র ছিল বঙ্গদেশ ও ওড়িশা। তিনি বৈষ্ণব ছিলেন। ভক্তিবাদের ও প্রেমের প্লাবন এনেছিলেন। তাঁর বৈষ্ণবধর্মে জাত-পাত, ধর্মা-ধর্ম, নারী-পুরুষে কোনও ভেদ ছিল না। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে মানসিকভাবে জর্জরিত অন্তজ শ্রেণীর মানুষরা আরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে অত্যাচারিত নারীরা দলে দলে বৈষ্ণবধর্মকে গ্রহণ করলো।

শ্রীচৈতন্যের মতবাদ ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’ নামে খ্যাত। তাঁর এই মতামত অনুসারে— ব্রহ্মা স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক প্রেমময়। এই মত শংকরাচার্যের মতের সম্পূর্ণ বিরোধী ।

চৈতন্যের মতে, স্রষ্টা-প্রভু-ঈশ্বর-ব্রহ্মা যে নামেই ডাক, সবই হলেন কৃষ্ণ। আর তাঁর শক্তি হলেন শ্রীরাধা। চৈতন্য বঙ্গদেশে ও ওড়িশায় ভক্তিবাদের প্লাবন এনেছিলেন, যে ভক্তির আবেগ যুক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু।

পাল রাজাদের আমলে বৈষ্ণবদের মধ্যে বৌদ্ধ সহজযানের বিকাশ ঘটতে দেখেছি আমরা। আবার বৈষ্ণবধর্ম সহজযানীদের প্রভাবিত করেছিল। বাংলাদেশের বৈষ্ণবধর্মে ও বৈষ্ণব সাহিত্যে পরকিয়া প্রেমের জয়গান সহজিয়াপন্থাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নারী-পুরুষের ভাললাগার সঙ্গে কন্ঠি-বদল, ঘর বাঁধা বা দেহতত্ত্বের গান গেয়ে যাযাবর জীবনে ভেসে যাওয়া—এ’সব মিলিয়েই ‘সহজিয়াধর্ম’। যখন মনের মিলে চিড় ধরতো, তখন সম্পর্কের ভারি বোঝা টেনে না বেড়িয়ে আবার দু-জন যেত দু’পথে। সম্পর্ক খারাপ না করেই দু’পথে। এ’যেন আধুনিক যৌথজীবনের বাস্তব রূপ।

অকিঞ্চন দাসের ‘বিবর্তবিলাস’ গ্রন্থ থেকে আমরা বেশ কিছু বৈষ্ণব সাধকদের সাধনসঙ্গিনী বা তন্ত্রসঙ্গিনীর নাম জানতে পারি।

চৈতন্যের সাধনসঙ্গিনী ছিলেন সাঠি। রঘুনাথের মীরাবাঈ, শ্রীরূপের মীরা,

ভট্টরঘুনাথের, কর্ণবাঈ, সনাতনের লক্ষ্মীহীরা। কৃষ্ণদাসের সাধনসঙ্গিনী

ছিলেন গোপকন্যা পিঙ্গলা, শ্রীজীবের নাপিতকন্যা শ্যামা।

জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, সনাতন, গোপাল

ভট্ট—প্রত্যেকেরই বৈষ্ণবতন্ত্র মত

অনুসারে সাধনসঙ্গিনী ছিল।

লক্ষ্মীতন্ত্র মতে— নারায়ণ বা বিষ্ণু পুরুষ এবং লক্ষ্মী তাঁর শক্তি। লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর চেয়ে অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে। বিষ্ণু এখানে বীজ দানকারী, কিন্তু লক্ষ্মীই সৃষ্টির কারণ। শক্তিরূপী লক্ষ্মীকে তুষ্ট করার জন্য পঞ্চমকার সহযোগে রামাচারী সাধনার কথা বলা হয়েছে।

‘গুহ্যাতিগুহ্য’ তন্ত্রে বিষ্ণুর দশ অবতারের সঙ্গে দশ শক্তি মহাবিদ্যার সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে।

বিষ্ণু মন্ত্রে দীক্ষিত হলেও পঞ্চমকার ও বামাচার ছাড়া সাধনায়

সিদ্ধিলাভের কোনও উপায় নেই। শুধু ভক্তিবাদে উত্তোরণের

উপায় নেই। তাই ভক্তিবাদের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যকেও

শক্তিরূপা সাঠির সঙ্গে মিলনসাধনা

করতে হয়েছিল।

এখানে, পুরোহিত নির্ভরতা বা যাগ-যজ্ঞ, আচার সর্বস্বতা, উৎকট যৌনাচার ইত্যাদি ছিল না। সে’দিক থেকে বৈষ্ণব দেহতত্ত্ব অনেক বেশি মানবিক, অনেক বেশি প্রগতিশীল।

 

শৈবধর্ম ও তন্ত্র

মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন যা পাওয়া গছে, তা থেকে এই সিদ্ধান্তে দ্বিধাহীনভাবে পৌঁছে যাওয়া যায় যে, সেই সময়ে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কারণে উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ নিয়ে আমরা আগেই যথেষ্ট আলোচনা করেছি। পুরানিদর্শন হিসেবে প্রচুর শিব লিঙ্গ পাওয়া গেছে— তাও বলেছি। যা বলা হয়নি তা হল, এখনও মন্দিরে মন্দিরে যোনি ও লিঙ্গের যুগল মূর্তিকে পুজো করা হয়। প্রাক অর্থ যুগ থেকে গুপ্ত সম্রাটদের যুগের (৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) সময় পর্যন্ত শিব লিঙ্গের সঙ্গে যোনি যুক্ত ছিল না। লিঙ্গ ও যোনিকে পৃথক পৃথক মূর্তিতেই পুজো করা হত।

শিব পুজোর বা লিঙ্গ পুজোর সঙ্গে তন্ত্র জড়িত হওয়ারই ফল হিসেবেই যোনি মধ্যে লিঙ্গ যুক্ত করে পুজোর শুরু।

ঋক্‌বেদে শিব নেই। আছে লিঙ্গ পুজোর নিন্দে। যজুর্বেদেও শিব অনুপস্থিত। অথর্ববেদে পশুপতি ও মহাদেব নামের দুই দেবতাকে আমরা পেলাম। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আমরা শিব নামটি পেলাম, তবে রুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করে।

 

পাশুপত

মহাভারতের শান্তিপর্বে আমরা শিবের নাম পাচ্ছি, যিনি পাশুপত ধৰ্ম, প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশুপত ধর্মের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হল, কার্য, কারণ, যোগ, বিধি ও দুঃখান্ত । পাশুপতপন্থীরা কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন যোগ সাধনায়, নিয়ম-বিধি পালনে। বিশ্বাস করেন, দুঃখ আছে, তার নিবৃত্তির উপায়ও আছে। পাশুপত ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের একটা মিল পাওয়া যায়। দুই ধর্মেই জাত-পাতের ভেদ নেই।

বৌদ্ধধর্ম আগে এসেছিল, না পাশুপত ধর্ম? উত্তর খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে মহাভারতের রচনাকালের দিকে। মহাভারতের আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক। শান্তিপর্ব লেখা হয়েছে বুদ্ধের মৃত্যুরও কয়েক’শ বছর পরে। ফলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, পাশুপত ধর্মে বুদ্ধের প্রভাব ছিল।

পাশুপত ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মিল যেমন আছে, অমিল তেমন আছে। বৌদ্ধ ধর্ম নৈতিক অনুশাসনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। পাশুপত ধর্ম যোগ ও তন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়েছিল সর্বাধিক। বৌদ্ধ ধর্ম নিরীশ্বরবাদী।। পাশুপত ধর্মে ঈশ্বর আছেন। সেই ঈশ্বর হলেন শিব।

পাশুপত ধর্ম অনুসারে দুঃখের নিবৃত্তি করা যায় দুটি পথে। (১) যোগ। যোগ নিয়ে আগেই বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে, তাই আবার আলোচনা অপ্রয়োজনীয় । (২) বিধি। বিধি বলতে বলা হয়েছে—শরীরে ছাই মাখবে, ছাইয়ের গাদায় শোবে, হাসবে-গাইবে-নাচবে, জেগে থেকে ঘুমোবার ভান করবে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাঁপাবে, মেয়েদের দেখলে আদিরসাত্মক শারীরিক ভঙ্গি প্রদর্শন করবে। এমন সব আচরণ করবে, যাতে সাধারণ মানুষ পাগল বলে মনে করে। এদের আমরা দেখতে পাই কুম্ভমেলায় ‘নাগা (নাঙ্গা)’ সন্ন্যাসীরূপে

 

নায়নার

দক্ষিণ ভারতে শৈব ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। এখান থেকেই বেশ কিছু শৈব মতবাদ উঠে এসেছিল। ‘নায়নার’ এমনই এক শৈব সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় শৈব ধর্মের উপর বহু গ্রন্থ ও হাজার হাজার শ্লোক রচনা করেছেন। ‘পেরিয়াপুরাণম’ গ্রন্থে নায়নার সম্প্রদায়ের ৬৩ জন শৈব সিদ্ধ সাধকের জীবনী লেখা আছে। গ্রন্থটি পড়ে, বোঝা যায় নায়নার শৈব সম্প্রদায় জাত-পাত মানতো না। কারণ এই ৬৩ জন সিদ্ধ পুরুষদের মধ্যে ব্রাহ্মণ থেকে পতিত জাতির মানুষ সবই আছেন। তামিল সাহিত্যে ভক্তিবাদের প্রচলন ও প্লাবন আসে ‘নায়নার’ সম্প্রদায়।

 

শৈব সিদ্ধান্ত

‘শৈব সিদ্ধান্ত’ দক্ষিণ ভারতের আরও একটি শৈব সম্প্রদায়ের নাম। এঁরা ছিলেন চূড়ান্ত ভক্তিবাদী। এঁদের মতে ‘যোগ জ্ঞান’ দ্বারা পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটানোর পথ যথেষ্ট কঠিন। তারচেয়ে অনেক সোজা চর্যা মার্গের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা বা ঈশ্বর লাভ। সাধকের জীবনচর্যাই হবে এমন যে সে নিজেকে শিবের অনুচর ভৃত্য বলে মনে করবে। এভাবেই ভক্তির দ্বারা সবচেয়ে সহজে ঈশ্বরের কাছের মানুষ হওয়া যায়। শিবকে উপলব্ধি-ই মোক্ষ বা সিদ্দি ।

এখানেও আমরা দেখলাম ভক্তির বন্যা। আবেগের আধিক্য।

 

আগমাস্ত

দক্ষিণ ভারত থেকেই উঠে এসেছিল আরও একটি শৈব ধর্মীয় সম্প্রদায়। নাম- আগমান্ত শৈবধর্ম। এই সম্প্রদায় মনে করে ‘আগম শাস্ত্র’ অপৌরুষেয়। এগুলো স্বয়ং শিব তাঁর পঞ্চমুখে বর্ণনা করেছিলেন। আগমশাস্ত্র আসলে তন্ত্রশাস্ত্রেরই একটা ধারা। এই সম্প্রদায় ‘অষ্টযোগ’ প্রক্রিয়ার দ্বারা নানা অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করার কথা বিশ্বাস করে। ‘যোগ’ নিয়ে আলোচনায় আগেই আমরা অষ্টযোগের কথায় এসেছি। এছাড়াও ওঁরা বিশ্বাস করেন, মানুষের দেহে যচক্রের অবস্থানে। বিশ্বাস করেন, কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে মাথার খুলির নীচে থাকা সহস্রদল পদ্মকুঁড়ি ফুটে উঠবে। পদ্ম পাপড়ি মেলতেই কুড়ির ওপর ফণা মেলে থাকা সাপ ফণা গুটিয়ে নেবে। এই সাপই মহাশক্তি। পদ্মের বীজে রয়েছেন স্বয়ং শিব।

এই শৈব সম্প্রদায় যে শিব-শক্তির মিলন বা দেহতত্বে বিশ্বাস করেন, এ’কথা বোধহয় আরও একবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন ছিল না, যোগে দেহতত্ত্বের কথা শিব-শক্তির মিলনে পরম ব্রহ্ম বা শিব লাভের কথা বহুবার উল্লিখিত হয়েছে।

 

বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত্

শৈব ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রগতিশীল সম্প্রদায় হল ‘বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত্’। এই শৈব সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ ছিলেন কন্নড় ব্রাহ্মণ বাসব। বাসব ছিলেন চালুক্যরাজ বিজ্জলের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী। চেয়েছিলেন কর্ণাটক থেকে জৈনদের ঝেঁটিয়ে, বিদায় করে শৈব ধর্মকে সংস্কার করে প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি একদিকে যেমন প্রকৃতই ধর্ম-সংস্কারকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, আর একদিকে তেমন-ই জৈনধর্মকে কর্ণাটক থেকে উৎখাত করে ছেড়েছিলেন।

বাসবের এই বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত্রা জাত-পাত ও নারী-পুরুষের

ভেদাভেদে বিশ্বাস করে না। বাসব স্ত্রী-পুরুষের সমান

অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের বুদ্ধি ও

পদমর্যাদাকে ব্যবহার করেছিলেন।

উচ্চবর্ণদের কায়িক শ্রমের উপর নিষেধাজ্ঞার ঐতিহ্য চলে আসছিল বৈদিক যুগ থেকে। উচ্চবর্ণদের মধ্যেও কায়িকশ্রমে উৎসাহ দিলেন বাসব। তিনি বাণিজ্যের ওপরেও জোর দিলেন।

এইসব নিত্য নতুন নিয়ম প্রবর্তন ও সমাজ-সংস্কার করতে গিয়ে রাজা বিজ্জলের সঙ্গে বাসবের মতবিরোধ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, পরিণতিতে বাসবের চক্রান্তে বিজ্জন নিহত হন। এতে বাসবের রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন বাড়ে, তেমনই গতি পায় সমাজ সংস্কার।

বাসবের উপদেশগুলো ‘বচন’ নামে পরিচিত এবং বীরশৈব বা লিঙ্গায়েৎদের পবিত্র ধর্ম উপদেশ হিসেবে গৃহীত। বীরশৈবরা শক্তির প্রাধান্যকে স্বীকার করে। বীরশৈব মতকে অনেক দার্শনিকই ‘শক্তিবিশিষ্টদ্বৈতবাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত্রা শিবলিঙ্গের মূর্তি বা খোদিত মূর্তি অথবা ছবি নারী- পুরুষ নির্বিশেষে ধারণ করেন। এই সম্প্রদায়ে বাল্য-বিবাহ নিষিদ্ধ। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে এই হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠী বিধবা বিবাহকে নিজেদের সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছিল। উচ্চবর্গের অনগ্রসর, প্রাচীন ও স্থবির ধ্যান-ধারণাকে দূর করতে বাসব যথেষ্ট কড়া হাতে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর কাজে জনসমর্থন যোগাড় করতে বীরশৈবপন্থীদের যথেষ্ট উদ্দীপ্ত করেছিলেন, লড়াকু চরিত্র দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বীরশৈবদের অবশ্য পালনীয় নীতিতে স্থান পেল—অন্নদান, জল দান, ওষুধ দান ও বিদ্যা দান।

শংকরাচার্যের মায়াবাদকে বাসব খণ্ড করেছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। তিনি শিব ও শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।

বাসবের মতে জীব ও জড় জগতের সৃষ্টি ও তার ক্রমবিবর্তনকে বাস্তব

সত্য বলে স্বীকার করলে শংকরাচার্যের ‘মায়াবাদকে’ অস্বীকার

করতেই হয়। ক্ষিদে, তৃষ্ণা ও অসুখ হলে অন্ন, জল

ও ওষুধ গ্রহণ না করে ‘সবই মায়া’ বলে

শংকরাচার্যপন্থীরা কি চুপ

করে বসে থাকেন।

তাঁদের অন্ন, জল, ওষুধ, গ্রহণ করেই বাঁচতে হয়। নীতি এক রকম, চৰ্যা (জীবনযাপনপ্রণালী) আর এক রকম হওয়াটা নীতিহীনতারই লক্ষ্মণ।

 

বৈদিক সাহিত্যে শিব

বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্যে শিব সম্পর্কে কিছু কিছু কথা লেখা হয়েছে। এসব পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না নিম্নবর্গের মানুষদের দেবতা শিবের প্রতি তাদের বিরূপতা ছিল স্পষ্ট।

ভাগবত পুরাণে শিবকে তমোগুণের আধার; উন্মাদ ও উন্মাদদের প্রিয়, শ্মশানচারী, বাঁদরের মতো চোখ, কাজ-কর্মহীন, দিগম্বর, জটাধারী চিতাভস্মে স্নানকারী, মুণ্ডমালা ধারণকারী, অমঙ্গলকারী ইত্যাদি বলে ধিক্কার জানানো হয়েছে।

ঋকবেদের কেশীসূক্তে বলা হয়েছে—শিব-পূজকরা ধুলো-ছাই মাখা, মলিন বস্ত্রধারী, দীর্ঘকেশধারী উন্মত্তপ্রায় এক শ্রেণীর মুনি ।

 

নাঙ্গা সন্ন্যাসী ও শৈবধর্ম

এই শিব পূজকরাই আজকের নাঙ্গা সন্ন্যাসী। কুম্ভমেলা থেকে সাগরমেলা- সর্বত্রই এরা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। এরা মেলার ভিভিআইপি । অসাধারণ এদের দাপট। নগ্নশরীরে ছাই মাখা। মাথার জটা ধরা দীর্ঘ চুল। চোখ সব সময়ই নেশায় টক্‌টকে লাল। এর দামী এসি লাগানো তাঁবুতে থাকে। কানে ওয়াকম্যান। দামি মটোরবাইকে ঝড় তুলে ছুটে বেড়ায়। সুন্দরী তরুণী দেখলে লিঙ্গ প্রদর্শন করে প্রকাশ্যে অশ্লীল আহ্বান জানায়। স্নানের যোগে বা মুহূর্তে এদের স্নানের অধিকার সবার আগে। অশ্লীল, বেপরোয়া এইসব মানুষগুলোকে দেখে ভক্তি-গদগদ হন মন্ত্রী থেকে আমলা ও তাদের পরিবারের লোকজন। প্রতিবার মেলাতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলছে।

এদের ‘পাবলিক নুইসেন্স অ্যাক্ট’-এ ধরার কেউ নেই। আসলে ধর্মের নামে যে কোনও আইন-ই বোধহয় এ’দেশে ভাঙা যায়।

“শিবঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে।”

error: Content is protected !!