৮০ বছর বয়সি সত্য সাঁইবাবা একটি বিশাল বিতর্কিত নাম। সাঁইবাবার ৮০ বছরের জন্মদিনে পুট্টাপাটির প্রশান্তিনিলায়মে ছিল ক্রিকেট জগতের ও বলিউডের সুপার স্টারদের ভিড়। শ্রদ্ধা জানাতে দক্ষিণের ও কেন্দ্রের মন্ত্রীদের এবং হাই প্রোফাইল মানুষদের ঢল নেমেছিল আশ্রমে। জীবন্ত ভগবানের আশীর্বাদ নিয়ে সবাই তাদের স্বপ্নপূরণ করতে চাইছিলেন।

জরায় জবুথবু জীবন্ত ভগবানকে দেখে করুণা হচ্ছিল। ওঁর কাছে কী চাইব–সুস্থ শরীর, জরাকে জয় করার ক্ষমতা, যশ?

ভগবান সাঁইবাবা আজকাল অসুস্থ থাকছেন প্রায়ই। জরা তাঁকে অথর্ব করে দিয়েছে। তিনি ভক্তদের যশের আলো দেখাবেন কী? নিজেই তো বহু অপযশের অন্ধকারে ডুবে আছেন সাঁইবাবা কি সমকামী (Homosexual)

সাঁইবাবার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে—তিনি সমকামী। ভারতে সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। Google সার্চ করলে সত্যসাঁইয়ের সমকামিতা বিষয়ে ৫ হাজারের বেশি রেফারেন্স মিলবে। এঁদের প্রত্যেকেই কি মিথ্যেবাদী? নাকি অনেকেই সত্যি বলছেন? এরা বেশির ভাগই কিন্তু পাশ্চাত্যের মানুষ।

ছবি থেকে বিভূতি

দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চলে সাঁইভক্তদের রমরমা ভারতের ৬০০ জেলার মধ্যে এক অথবা দু-নম্বরে। ওখানে বাড়িতে বাড়িতে সাঁইয়ের ছবি। সন্ধ্যায় সাঁই-ভজন। বিশেষ বিশেষ ভক্তদের

বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ছবি থেকে সুগন্ধি বিভূতি ঝরে পড়ে। ওইসব ‘ভাগ্যবান’ ভক্তেরা সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধা পান।

দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং-এ অনেক নামী-দামি স্কুল-কলেজ রয়েছে। সেইসব স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র (Rationalists’ Association)-এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ওরা ২০০৭-এর গোড়া থেকেই একটা কাজ শুরু করেছে। ওদের বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো দাদু-দিদার ছবি থেকেও বিভূতি ঝরাচ্ছে। পড়শিদের ডেকে এনে দাদু-দিদার ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ দেখাচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষক ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক গোপাল ছেত্রী প্রকাশ্য সভায় ছবি থেকে বিভূতি ঝরার অলৌকিক রহস্য ফাঁস করেছেন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যে কোনও ছবির কাচে ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল লাগিয়ে রাখলেই কেল্লা ফতে। ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল বাতাসের সংস্পর্শে এলেই মিহি ছাই হয়ে ঝরে পড়ে।

সাঁইবাবার অসুখ-বিসুখ

যেসব ভক্তেরা রোগ মুক্তির জন্য সাঁইবাবার আশ্রমে দৌড়োন, তাঁরা কী একবারও ভেবে দেখেছেন—সাঁইবাবা নিজের অসুখ করলে কেন সব সময় আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য নেন? যিনি নিজের অসুখ অলৌকিক ক্ষমতায় সারাতে পারেন না, তিনি অন্যের অসুখ সারাবেন কী করে ?

সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার বিচিত্র আমার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। রেজেস্ট্রি ডাকে চিঠিটি পাঠিয়েছেন শ্রীসত্যসাঁইবাবার চরণাশ্রিত ‘শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যাশনাল’-এর ভাইসচান্সেলারের সেক্রেটারি অগ্নিকা বসাক। প্যাডের কোনায় লেখা Ref. No. 710 / 88. 10 April 1988. চিঠিটি এখানে তুলেন দিলামঃ

মহাশয়,

৩০ মার্চ ৫ এপ্রিল ১৯৮৮-এর সংখ্যায় ‘পরিবর্তন’-এ আপনার (অ) লৌকিক অভিজ্ঞতার কথা পড়ে আমাদেরও অভিজ্ঞতা হল।

আমাদের আশ্রমের উপাচার্য শ্রী বিভাস বসাকের নির্দেশক্রমে এক (অ) সত্য ঘটনা আপনাকে জানানো যাইতেছে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা করা আপনার ইচ্ছাধীন।

উনার কাছে শ্রীসত্যসাঁইবাবার সৃষ্টি করা কিছু বিভূতি (ছাই) আছে, যে কেউ রবিবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আসতে পারে পরীক্ষা করার জন্য। সম্পূর্ণ খালি পেটে আসতে হবে—সঙ্গে একজন মাত্র দর্শক বা সাক্ষী থাকতে পারে।

বিভূতি জলে গুলে খাইয়ে দেওয়া হবে। সন্দেহ নিবারণের জন্য গোলা বিভূতির খানিকটা অংশ উনি নিজেই খেয়ে নেবেন। খাবার তিনদিন পরে কম করে ৬টি, বেশি ১১টি স্বর্ণমুদ্রা পাকস্থলী বা অন্ননালির কোনও অংশে নিজেই সৃষ্টি হবে। চতুর্থ দিনে কোনও সুযোগ্য Surgen-কে দিয়ে operation করে বের করা যাবে, বা প্রত্যেকদিন পায়খানা পরীক্ষা করতে হবে ৩০ দিন পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যেই ২৫ নঃ পঃ আকৃতিতে স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যাবে।

দক্ষিণা—৫০০। পশ্চিমবঙ্গ মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে স্বেচ্ছাদান করে রসিদ সঙ্গে আনতে হবে। বিভূতি খাওয়ানো উপাচার্যের ইচ্ছাধীন। পত্রে আলাপ করে পরীক্ষার দিন ধার্য করতে পারেন। আপনি নিজে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলেই প্রচার করবেন, নতুবা নয়।’

চিঠিটা আমাদের সমিতির অনেকেই পড়ে সাঁইবাবার নামের সঙ্গে জড়িত এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে কোণঠাসা করার সুযোগ পেয়ে উত্তেজিত হলেন। তাঁরা চাইলেন, আমি বিভূতি খেয়ে ওঁদের বুজরুকির ভাণ্ডাফোড় করি। কিন্তু আমার মনে হল—আপাদদৃষ্টিতে উপাচার্যের চ্যালেঞ্জটা যতটা বোকাবোকা ও নিরীহ মনে হচ্ছে, বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত। এই নিরীহ চ্যালেঞ্জের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকমের বিপদজনক হয়ে ওঠার সমস্তরকম সম্ভাবনা।

‘শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যাশনাল’-এর উপাচার্যকে আগস্টের শেষ সপ্তাহে চিঠি পাঠিয়ে জানালাম—

আপনি যে অলৌকিক একটি বিষয় নিয়ে আমাকে সত্যানুসন্ধানের সুযোগ দিচ্ছেন তার জন্য ধন্যবাদ। এই অলৌকিক ঘটনা প্রমাণিত হলে সাঁইবাবার অলৌকিক ক্ষমতাও প্রমাণিত হবে। কিন্তু পাশাপাশি এও সত্যি— আপনি ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার দায় বর্তাবে কেবলমাত্র আপনার উপর। আপনি কৃতকার্য হলে সাফল্যের ক্রিমটুকু খাবেন সাঁইবাবা। এই ব্যাপারটা আমাদের পছন্দ নয় । আপনার ব্যর্থতার দায় সাঁইবাবা নেবেন কী না, জানতে উৎসুক হয়ে রইলাম। সাঁইবাবার নির্দেশমতো বা জ্ঞাতসারেই এই চ্যালেঞ্জ আপনি করেছেন—এটা ধরে নিতেই পারি। কারণ তাঁকে না জানিয়ে তাঁর সম্মান নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস নিশ্চয়ই আপনার হত না। এমন অবস্থায় পরবর্তী পর্বে লিখিতভাবে জানিয়ে দেবেন, এই চ্যালেঞ্জ সাঁইবাবার নির্দেশ অনুসারে/জ্ঞাতসারে হচ্ছে কিনা?

বিভূতিতে বিষ নেই—নিশ্চিত করতে খানিকটা বিভূতি খাবেন জানিয়েছেন। সন্দেহ নিরসনের জন্য আপনার এই সৎ চেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কিন্তু তারপরও যুক্তির খাতিরে বলতেই হচ্ছে—এতে সন্দেহ নিরসন হয় না। কারণ প্রায় সমস্ত বিষেরই প্রতিষেধক বিজ্ঞানের জানা। যুক্তির খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই, আপনি বিভূতিতে বিষ মেশাবেন, তবে বিষটির প্রতিষেধক আপনার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। আমি অজানা বিষ খেয়ে ফেললে মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে উঠবে। তিন দিনের মধ্যে আমি মারা গেলে পেটে সোনার টাকা তৈরি হওয়ার প্রশ্নই থাকবে না।

এই মৃত্যুর জন্য আপনাকে দায়ী বলে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমি যে বিভূতি খেয়েই মারা গেছি—তার প্রমাণ কী? আমি যে মৃত্যুর আগে অন্য কিছু খাওয়ার সময় বিষ গ্রহণ করিনি, তার প্রমাণ কী? খাবারে বিষ মিশে যেতে পারে, কেউ শত্রুতা করে বিষ খাওয়াতে পারে, এমনকী নিজেই কোনও কারণে বিষ খেতে পারি।

এই অবস্থায় আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলতে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখছি—

১) যে কোনও প্রাণীকে বিভূতি খাইয়েই যদি তিনদিন পরে পেটে সোনার টাকা তৈরি করে অলৌকিকত্ব প্রমাণ করা যায়, তবে আমাকে নিয়ে আর টানাটানি কেন? পরীক্ষার জন্য ছাগল-টাগল কিছুকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

২) ছাগলটিকে আগের রাতেই আপনার আশ্রমে নিয়ে আসব আমরা। উদ্দেশ্য বিভূতি খাওয়ার আগে পর্যন্ত ছাগলটি যে সম্পূর্ণ খালি পেটে আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত করা।

৩) সঙ্গে নিয়ে আসব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া ৫০০ টাকার রসিদ । ৪) ছাগলটিকে বিভূতি খাওয়াবার পর ছাগলটি আমাদের, আপনাদের ও ইচ্ছুক সাংবাদিকদের পাহারায় থাকবে। উদ্দেশ্য—আপনারা যাতে কোনওভাবে ছাগলটিকে স্বর্ণমুদ্রা খাওয়াতে না পারেন।

৫) ছাগলটিকে বটপাতা, কাঁঠালপাতা জাতীয় খাবার খাওয়ানো হবে। খাবারের জোগান দেবেন আপনারা। উদ্দেশ্য যাতে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেলে আপনাদেরকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

না।

৬) তিনদিন পর ছাগলটির পেটে এক্স-রে করে দেখা হবে সোনার টাকা তৈরি হয়েছে কি

৭) টাকা তৈরি হলে সাঁইবিভূতির অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণিত হবে। আমি পরাজয় মেনে নিয়ে আপনার হাতে প্রণামি হিসেবে তুলে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা। (তখন ‘চ্যালেঞ্জ মানি’ ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা।)

৮) ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এই অলৌকিকত্ব দেখার পর সংগত কারণেই আর অলৌকিত্বের বিরোধিতা না করে সত্য-প্রচার করবে এবং আমাদের সমিতির সদস্যরা প্রত্যেকে সাঁইবাবার কাছে দীক্ষা নেবে।

আপনার তরফ থেকে পেটে টাকা তৈরির বিষয়ে অন্য কোনও গভীর পরিকল্পনা না থাকলে, এবং বাস্তবিকই বিভূতির অলৌকিক ক্ষমতায় আপনি প্রত্যয়ী হলে আমার এই প্রস্তাবগুলো নিশ্চয়ই গ্রহণ করবেন। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর আমরা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি ‘প্রেস কনফারেন্স’ করে বিষয়টা সাংবাদিকদের জানাব। তারপর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমরা পরীক্ষার দিন ধার্য করে সাংবাদিকদেরও এই সত্যানুসন্ধানে অংশ নিতে আহ্বান জানাব । এই পরীক্ষায় আপনি কৃতকার্য হলে তা আমার পরাজয় হবে না; হবে সত্যকে খুঁজে পাওয়া আপনার ইতিবাচক চিঠির প্রত্যাশায় রইলাম।

উত্তর পেলাম সেপ্টেম্বরে। অগ্নিকা উপাচার্যের পক্ষে আমাকে জানালেন—

আপনার অমানবিক চিঠিটি পেয়েছি। আপনি শুধু অমানবিকই নন, ভীতু। আপনি নিজে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে চাইছেন অবলা, নিরীহ একটি প্রাণীকে। একটি ছাগল বা মুরগির প্রাণ কি প্রাণ নয়? তাদের প্রাণ কি মানুষের প্রাণের চেয়ে কম মূল্যবান ? আপনার ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আমাদের ব্যথিত করেছে।

অলৌকিকতার প্রমাণ চাইতে হলে আপনাকেই বিভূতি খেতে হবে। আপনার কোনও পরিবর্তন

চলবে না। আপনি এতে রাজি থাকলে প্রেস কনফারেন্সে হাজির থাকতে আমরা রাজি। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ রবিবার প্রেস কনফারেন্স করব ঠিক হল। প্রেস কনফারেন্স প্রেস ক্লাবে না করে ময়দান টেন্টে করব ঠিক করলাম। ময়দান টেন্টটা ডাঃ অরুণকুমার শীলের।

৯ ডিসেম্বর ‘আজকাল’-এ এবং ১০ ডিসেম্বর ‘গণশক্তি’-তে প্রকাশিত হল ১১ ডিসেম্বর ময়দানে হতে যাওয়া লড়াইয়ের খবর।

এসে গেল ১১ ডিসেম্বর। The Telegraph পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার তলায় চার কলম জুড়ে (পত্রিকার পরিভাষায় একে বলে anchor story, যা অতি গুরুত্বপূর্ণ) আমার ছবি ও প্রেস কনফারেন্সের

খবরটি ছাপা হল। খবরটি শিরোনাম ছিল ‘Calcuttan to take on Satya Sai Baba’

১১ ডিসেম্বর এসে গেল। সকাল হওয়ার আগেই তাঁবুতে জায়গা নিয়েছি। দুপুর থেকে তাঁবুর লনে পড়েছে কয়েকশো চেয়ার। বিকেলে প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই হাজির কয়েকশো উৎসাহী জনতা। প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগেই প্রতিটি পত্র-পত্রিকা ও প্রচার-মাধ্যমের প্রতিনিধিরা টেন্ট ভরিয়েছেন। খবর শুনে এসেছেন দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক। চারটেতে প্রেস কনফারেন্স শুরু করার কথা। তাই শুরু হল । তবে তখনও উপাচার্য, তাঁর সচিব বা কোনও প্রতিনিধির দেখা নেই। মাইকে বারকয়েক আহ্বান জানানো হল, তাঁরা থাকলে যেন এগিয়ে আসেন। এগিয়ে এলেন না। সাঁইবাবার বিভূতি লীলার মতোই এও এক লীলা। নিজের বিভূতির গপ্পো প্রচার, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া এবং চ্যালেঞ্জ গৃহীত হওয়ার পর আপন খেয়ালে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। পুরাণের কুর্ম অবতার চরিত্রটি সাঁইবাবার সম্ভবত সবচেয়ে পছন্দসই। তাই সাঁই অবতারের মধ্যেও বিপদে খোলসে মুখ লুকোবার প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

১২ ডিসেম্বর The Telegraph পত্রিকায় আবার ৪ কলাম জুড়ে খবর। চ্যালেঞ্জে কেউ এল না। সব পত্রিকায় সেদিন খবরটি বেরিয়েছিল ছবি সমেত।

কলকাতায় সাঁইয়ের ছবি থেকে ছাইঃ একটি হুজুগ

সাঁইবাবার সঙ্গে পবিত্র ছাই বা বিভূতির একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সাঁইবাবা নাকি শূন্য থেকে বিভূতি সৃষ্টি করে ভক্তদের দেন। তাঁর ছবি থেকেও নাকি বিভূতি ঝরে পড়ে। গত শতকের

আটের দশকে কোলকাতায় জোর গুজব ছড়িয়ে ছিল যে, অনেকের বাড়ির সাঁইবাবার ছবি থেকেই নাকি বিভূতি ঝরে পড়ছে। প্রতিটি মিথ্যে গুজবের মতোই এই ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁদের মুখেই এইসব গুজব শুনেছি তাঁদেরই চেপে ধরেছি। আমার জেরার উত্তরে প্রায় সকলেই জানিয়েছেন যে তাঁরা নিজের চোখে বিভূতি ঝরে পড়তে দেখেনি। যাঁরা সত্যিই বাস্তবে ছবি থেকে বিভূতি পড়তে দেখেছেন, তাঁরা শতকরা হিসেবে সংখ্যায় খুবই কম। তাঁরা দেখেছেন ভক্তদের বাড়ির ছবি থেকে বিভূতি পড়তে বা ছবির তলায় বিভূতি জমা হয়ে থাকতে। এই বিভূতি বা ছাই সৃষ্টি হয়েছে দু’রকম ভাবে। (১) কোনও সাঁইবাবার ভক্ত অন্য সাঁই ভক্তদের চোখে নিজেকে বড় করে তোলার মানসিকতায় সাঁইবাবার ছবির নিচে নিজেই সুগন্ধি ছাই ছড়িয়ে রাখে। (২)

সাঁইবাবার ছবির কাচে যদি ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল মাখিয়ে ঘষে

দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ল্যাকটিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল বাতাসের

সংস্পর্শে এলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছাইয়ের

মতো ঝরে পড়তে থাকবে।

ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সাঁইবাবার ওপর অনুসন্ধানের জন্য ১২ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় Saibaba Exposure Committee। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার উপাচার্য ডঃ নরসিমাইয়া ছিলেন এই কমিটির উদ্যোক্তা। সাঁইবাবার সহযোগিতার অভাবে কমিটি শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে ব্যর্থ হন।

শূন্য থেকে হিরের আংটি

মেয়েদের একটি বাংলা সাময়িক পত্রিকায় ১৯৮১ সালের জুলাই মাসের সংখ্যায় লেখা হয়েছিল সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটা হিরের আংটি সৃষ্টি করে নাকি পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দিয়েছিলেন। শূন্য থেকে হিরে সৃষ্টির ঘটনা একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে যে কোনও জাদুকরই শূন্য থেকে হিরের আংটি এনে দিতে পারেন। আর এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেখালেই কি ওই জাদুকরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ধরে নেওয়া হবে?

শূন্য থেকে সৃষ্টির ক্ষমতা যদি থাকে তবে খোলামেলা

পরিবেশে একটা স্কুটার কী একটা মোটর বা

বিমান সৃষ্টি করে উনি দেখান না।

ব্ল্যাক-আর্টের দ্বারা জাদুকরেরা শূন্য থেকে হাতি বা জিপ-কার সৃষ্টি করেন। জাদুকরদের এই সৃষ্টির মধ্যে থাকে কৌশল। সাধু বাবাজিদের সৃষ্টির মধ্যে এই ধরনের কোনও কৌশল থাকলে চলবে না। কোনও বাবাজি যদি শূন্য থেকে এই ধরনের বড়-সড় মানের কোনও কিছু সত্যিই সৃষ্টি করতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই প্রমাণিত হবে অলৌকিক বলে কিছু আছে, এবং তাবৎ বিশ্বের যুক্তিবাদীরাও আর এইসব নিয়ে কচকচানির মধ্যে না গিয়ে অলৌকিক বলে কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে নেবে।

লন্ডনের চ্যানেল ফোরে ধরা পড়ল সাঁইবাবার বুজরুকিঃ

১৯৯৩ সালে লন্ডনের ‘চ্যানেল ফোর’ এসেছিল ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলনের উপর একটা তথ্যচিত্র তুলতে। নাম ‘Gurubusters’ (গুরুবাস্টার্স)। ছবির সিংহভাগ জুড়ে আমাদের সমিতির কাজকর্ম ছিল। পরিচালক রবার্ট ঈগল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সাঁইবাবার শূন্য থেকে হার, আংটি ইত্যাদি তৈরি করার হাতসাফাই কি হাতে-নাতে ধরতে পারবে? ওর আশ্রমে গিয়ে ধরতে হবে।

বলেছিলাম, পারব নিশ্চয়-ই। তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের সমিতির সদস্য ফুল কন্ট্যাক্ট ক্যারাটের জনা দশ-বারো ছেলে-মেয়েকে আশ্রমে ঢোকাব। খরচ তোমার। ওকে হাতে-নাতে ধরলে একটা বড় রকমের গোলমাল হবেই। সেই গোলমালের মোকাবিলা করার জন্যই ওদের ঢোকাতে চাই।

রবার্ট ঈগল আমার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে এক বাঙালি জাদুকরের নাম করে বললেন, উনি তো একটা পত্রিকায় লিখেছিলেন—সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটা সন্দেশ তৈরি করে জাদুকরকে দিতেই জাদুকরও শূন্য থেকে রসগোল্লা এনে দিয়েছিলেন। তাই দেখে সাঁইবাবা ভয়ে ভক্তদের ছেড়ে নিরাপদ ঘরে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। উনি পারলে তুমি পারবে না কেন?

বললাম, পত্রিকায় যা-যা লেখা হয়, তার সব সত্যি নয়। তুমি সাঁইবাবার আশ্রমে গেলেই দেখতে পাবে, কয়েকজন ভক্ত-পিছু একজন করে ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট ‘স্বেচ্ছাসেবক’ রয়েছে। রসগোল্লা এনে চমকাবার চেষ্টা কেউ করলে ধরে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে শেষ করে দেবে যে গপ্পো লেখার সুযোগ-ই পাবে না।

বিভূতি আনছেন সাঁইবাবা
বিভূতি আনার কৌশল ?

যাকগে, আসল কথায় আসি। আশ্রমে সাঁইবাবা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন। শূন্য থেকে হার তৈরি করলেন, লকেট তৈরি করলেন। ছবি তুলল চ্যানেল ফোর। তারই সাথে সাথে গোপন ক্যামেরায় এক যুক্তিবাদী তুললেন সাঁইবাবা কার হাত থেকে কী ভাবে হার নিচ্ছেন ও হাত সাফাই করে শূন্য থেকে সৃষ্টির অভিনয় করছেন। ১৯৯৪ সালে গুরুবাস্টার্স পৃথিবী জুড়ে রিলিজ করতেই বিশাল বিস্ফোরণ। পৃথিবীর প্রায় চল্লিশটি দেশের কোটি কোটি মানুষ দেখলেন সাঁইবাবার বুজরুকি। আপনারা যারা দেখতে উৎসাহী www.thefreethinker.tk খুলুন। দেখতে পাবেন সাঁইবাবার অলৌকিক ক্ষমতার চিচিংফাঁক।

সাঁইবাবার সেবামূলক কাজ

সাঁইবাবা পুট্টাপাটির জনগণের জন্য কলেজ করেছেন, হাসপাতাল করেছেন। স্থানীয় মানুষ এতে খুশি—সাঁই বড় দয়ালু। এলাকায় ইমেজ বাড়াতে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করে থাকে রক্ত হিম করা সমাজবিরোধী শাহাবুদ্দিন থেকে পাপ্পু যাদব পর্যন্ত সবাই।

ভগবান সাঁই কেন গোটা পৃথিবী বা গোটা দেশের মানুষকে দারিদ্র্য ও রোগ থেকে মুক্ত করতে পারছেন না?

একটা খোলা চ্যালেঞ্জ

সাঁইবাবা কি প্রকাশ্যে আমার চাওয়া কোনও বস্তু অলৌকিক উপায়ে সৃষ্টি করে দেখাবেন ? অথবা পোশাক ও শরীর পরীক্ষা করার পর তিনি শূন্য থেকে বিভূতি সৃষ্টি করে দেখাবেন ? ২০০৮ সালের মধ্যে সাঁইবাবা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করলে যুক্তিমনস্ক মানুষ ধরে নিতে বাধ্য হবেন, তাঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। কৌশলের সাহায্যে তিনি এতদিন মানুষকে প্রতারিত করেছেন।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!