বৈদিক সাহিত্য, বৈদিক ধর্ম ও আর্যভাষীদের নিয়ে গত একশো বছরে কম বই প্রকাশিত হয়নি। এইসব বইয়ের লেখক দু’শ্রেণীর। (১) ধর্মগুরু, স্বামীজী ইত্যাদি, (২) তথাকথিত দার্শনিক, ইতিহাস-গবেষক, ধর্ম-গবেষক, সমাজ-বিজ্ঞানী ইত্যাদি।

২য় শ্রেণীর বইগুলোর লেখার ধারাকেও প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) নিজের ইচ্ছে মতো করে বৈদিক ধর্ম ও আর্যভাষীদের হাজির করতে, আদর্শ মডেল হিসেবে হাজির করতে, একেশ্বরবাদী হিসেবে হাজির করতে, গৌরবের শিখরে তুলতে যতটা নামতে হয় নেমেছেন লেখকরা। কতটা চাপবেন, কতটা ছাপবেন— এ’ ক্ষমতা লেখকের হাতের মুঠোয়। সেই ক্ষমতার অপব্যবহারেও তাঁরা ক্ষান্ত হননি । ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন ইচ্ছে মতো। চড়া মেক-আপ দিয়ে প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যের কথা পরিবেশন করে পাঠক-পাঠিকাদের মোহাবিষ্ট করে রাখতে চেয়েছেন। আর এঁরাই হলেন মূলস্রোত। এঁরা বৈদিক ঐতিহ্য আমাদের একান্ত আপন ও মহান ঐতিহ্য বলে চিত্রিত করে আমজনতার আবেগ জয় করেছেন। ‘জাতিয়তাবাদী’ হিসেবে গ্রহণীয় হয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছেন। (২) আরও একটি ধারা ক্ষীণ হলেও আছে, তাঁরা বৈদিক সাহিত্যকে, বৈদিক যুগের ভাল কিছুকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে নারাজ। তাঁরা বেদের যুগের নানা কুসংস্কারকে তুলে ধরে নিন্দা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে দায়িত্ব খালাস করেছেন।

অকারণ প্রশংসা ও অকারণ নিন্দা— কোনওটাই ভাল নয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লেখা আমাদের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আবার সত্যকে জানতে ও গ্রহণ করতে অনেক উদার হতে হয়, মুক্তচিন্তার মানুষ হতে হয়। আজও আমরা এত বেশি ব্যক্তি-স্বার্থ ও ভিত্তিহীন অহমিকাবোধের দ্বারা পরিচালিত হই যে, স্বার্থ-হানিকর বা অহমিকাবোধে আঘাত দেয়—এমন সত্যকে প্রত্যাখ্যান করি ।

আমার-ই প্রতিবেশী এম টেক ইঞ্জিনিয়র তরুণ আমাকে বললেন, তাঁর ঠাকুরদা যোগ বলে একটু একটু করে শূন্যে উঠে যেতেন। আমি এর কী ব্যাখ্যা দেবো, জানতে চাইলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, “ঠাকুরদা কি বেঁচে আছেন? তিনি আমার সামনে শূন্যে উঠে দেখতে পারলে, আমিও করে দেখাবো, ব্যাখ্যাও দেবো।”

আমার কথা শুনে শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে তরুণটি হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, “ঠাকুরদা মারা গেছেন। বাবা নিজের চোখে ঠাকুরদার এই যোগ-ক্ষমতা দেখেছেন। বাবা কি তবে মিথ্যে বলেছেন?”

যেন যাঁরা মিথ্যে কথা বলেন, তাঁদের বাবা-মা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। একজন এম টেক, সত্যকে গ্রহণ করতে চাইছেন না, আর তাঁর বাড়ির ড্রইরুমে একটা ওয়ালম্যাটে শিবের ছবির তলায় লেখা রয়েছে, “সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্।” এ শুধু একজন এম টেকের সমস্যা নয়, আমাদের সামাজিক সমস্যা। পরিবারে পরিবারে ঢুকে গেছে প্রগতিশীল সাজার হুজুগ।

বৈদিক সাহিত্য আমাদের রামায়ণ মহাভারতের মতো দুটো আসাধারণ মহাকাব্য দিয়েছে, এটা সত্যি। বৈদিক সাহিত্য আমাদের রসায়ন ও আয়ুর্বেদের প্রাথমিক জ্ঞানের সূচনাকারী, এও সত্যি। বেদ আমাদের নৃত্যকলা ও কামকলার বর্ণপরিচয়, স্বীকার করি। বেদের যুগের দেবতারা যজ্ঞশক্তির কাছে ক্ষমতাহীন, এ’কথা বেদ-ই শিখিয়েছে। যোগেও যৌনাচারের ভয়ংকর রকমের ছড়াছড়ি। এ’সব বৈদিক সাহিত্য পড়লেই জানা যায়।

বেদের যুগের মুনি-ঋষি ও দেবতারা এতই কামুক ছিলেন যে, কন্যা, পরস্ত্রী,

অনিচ্ছুক নারী, স্বর্গের বারবনিতা যে কোনও নারী দেখলেই খেপে

উঠতেন। এমনকী, সুন্দরী দেখলে দেবতা থেকে এইসব

ঋষিরা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়তেন

যে, যজ্ঞস্থানেই বীর্য বের

করে ফেলতেন।

বৈদিক সাহিত্যে এ’সব পর্ন-বর্ণনা পড়ে শিউরে উঠেছি, এ’ও সত্যি। আমরা যাদের মুনি-ঋষি বলি, সেসব জাদু পুরোহিতরা যোগের মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার কিছু কিছু আসন যেমন শিখিয়েছেন, তেমনই শারীর-বিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞান বিরোধী পাগলামো শিখিয়েছেন, এ’ও তো সত্যি।

শক্তি-উপাসক, তান্ত্রিক স্বামীজীরা একদিকে ব্রহ্মচর্যের নামে বিজ্ঞান বিরোধী কু- শিক্ষা দিয়েছেন, আর এক দিকে তাঁদের তন্ত্রই বলছে—“যত নারী তত শক্তি।” যত বেশি নারীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হবে, তত বেশি শক্তির অধিকারী হবে।

কেন আমরা স্ববিরোধিতার ভণ্ডামী, না জেনে জানার ভণ্ডামী নিয়ে বাঁচবো? কেন আমরা বৈদিক যুগের ভালোকে ‘ভালো’, খারাপকে ‘খারাপ’ বলার আগে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে বসবো? মুক্তমনই সত্য জানার একমাত্র পথ। বলিষ্ঠ সততাই সত্যি বলার একমাত্র শক্তি।

error: Content is protected !!