ডারউইন দিবস এবং ভালোবাসা দিবস
মুক্তমনায় আমরা প্রতি বছর ডারউইন দিবস পালন করি। সেই বিশেষ দিনটিতে চার্লস ডারউইন এবং তার যুগান্তকারী বিবর্তন তত্ত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার চেষ্টা করা হয়। হয়তো অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম ঘটা করে অজানা অচেনা দিনটিকে স্মরণ করার কারণ কী? কারণ আছে। আসলে পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই কিন্তু জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট তার একটি বইয়ে বলেছিলেন,
আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে। নেব।
কাজেই এমন যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব, তার সঠিক উদযাপন না হলে কী চলে! বলা বাহুল্য, মুক্তমনাই প্রথমবারের মতো ডারউইন দিবসকে বাঙালি পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্বটুকু কাঁধে তুলে নিয়েছিল ২০০৬ সালে। আন্তর্জালের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা সে বছর ডারউইন দিবস পালন করে প্রথমবারের মতো। এর পর থেকে প্রতি বছরই পালন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আকারে পালন করেছিলাম আমরা ২০০৯ সালে। কারণ ঐ বছরটাই ছিল ডারউইনের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আর সেই সাথে তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ-এর প্রকাশেরও দেড়শত বছর। এখন তো বাংলাদেশে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, যুক্তিবাদী কাউন্সিল সহ বহু সংগঠনই ঘটা করে ডারউইন দিবস পালন করে, দিনব্যাপী আলচনা অনুষ্ঠান কিংবা র্যালির আয়োজন করে। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের জন্য ডারউইন দিবস ডারউইনের দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত মুখচ্ছবির কোনো স্তব ছিল না, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ডারউইন দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ১২ই ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের প্রায় কেউই এই বিশেষ দিনটির সাথে পরিচিত না হলেও এর দু দিন পরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখটির সাথে প্রায় সবাই পরিচিত। সেই যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই ভালোবাসা দিবস কী, কিংবা কাহাকে বলে তা নিয়ে বোধ হয় বিশদ না বললেও চলবে। কারণ এ ব্যাপারটি কারোরই এখন অজানা কিছু নয়। কিন্তু যেটি অজানা তা হলো, এই ভালোবাসা দিবসের উদযাপিত ভালোবাসার সাথে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা! এই অধ্যায়টি সেই ঘনিষ্ঠ প্রেমময় সম্পর্কেরই উন্মোচন।
গত বছর ২০১০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আমাদের মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব একটি চমৎকার প্রবন্ধ লেখেন ‘ভালোবাসা ও বিবর্তন’ শিরোনামে। দুই দিবসের তাৎপর্যকে বিনি সুতার মালায় তিনি গাঁথলেন এক অনুপম ছন্দে। তিনি তার প্রবন্ধ শুরুই করলেন এই বলে–
রসকষহীন ডারউইন দিবসের পর আসে রসে ভরপুর ভালোবাসাদিবস প্রেমিকদের ডারউইন দিবসের কঠিন শীতল শিক্ষা থেকে রেহাই দিয়ে ভালোবাসার মিষ্টি আমেজের ছোঁয়া নিয়ে। দুটো দিবসের প্রায় একই সময় পালন করাটা হয়তো এক যোগসূত্রহীন কাকতালীয় ব্যাপার। ডারউইনের জন্মদিন আর রোমান পাদ্রী সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনেরমৃত্যুদিবসের মধ্যে কি যোগসূত্ৰই বা থাকতে পারে। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব তথা বিবর্তনের সঙ্গে সত্যই ভালোবাসার এক গভীর যোগসূত্র আছে যা মোটেই কাকতালীয় নয়। ডারউইনের “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)” আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)” বই দুটি প্রকাশিত হবার পর থেকে আজ অবধি ডারউইনের সেই মূল তত্ত্বকে ভিত্তি করে ও নতুন সাক্ষ্য প্রমাণ আর পর্যবেক্ষণলব্ধ। জ্ঞান এর দ্বারা সেই তত্ত্বকে পরিশীলিত ও সংশোধিত করে মানবপ্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টায় জীববিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। প্রেম কী?” “মানব নৈতিকতার উৎস কি? এ ধরনের সনাতন প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসছে সামাজিক-জীববিজ্ঞানী আর বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বদৌলতে, বিশেষ করে বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে প্রখ্যাত গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে। তাঁদের গবেষণা মানব অনূভুতির সকল দিকেরই কারণ হিসেবে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাসের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অন্য সব অনুভূতির মতো প্রেমানুভূতির মূলও বিবর্তনে নিহিত।
অপার্থিব ভুল কিছু বলেননি। বিবর্তনের কল্যাণে প্রেম ভালোবাসার অন্তিম রহস্যগুলোর অনেক কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে কিছু কথা আছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা প্রেম শব্দটিকে কেবল আধো আধো প্লেটোনিক কিংবা স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না থেকে এটাকে অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। ফস্টি নস্টি কিংবা টক ঝাল মিস্টি ভালোবাসার অনুভুতির বাইরে আছে পারস্পরিক মনোদৈহিক আকর্ষণ। পাশাপাশি থাকে রাগ, অভিমান, ঈর্ষা। এর সাথে থাকে সঙ্গী নির্বাচনের কৌশল, আনন্দ, ভয়, ঘৃণা, বিচ্ছেদ এমনকি যৌনমিলনের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাও।
শুরু করা যাক সেই চিরপুরাতন অথচ সদা নতুন প্রশ্নটি দিয়ে। প্রেম কী? শেক্সপিয়র তার একটি নাটিকায় তার সৃষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, “what ‘tis to love?। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি বিখ্যাত গানে একই ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন—
সখি, ভাবনা কাহারে বলে?
সখি, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা
সখি, ভালোবাসা কারে কয়!
সেকি কেবলি যাতনাময়।
সেকি কেবলই চোখের জল?
সেকি কেবলই দুখের শ্বাস?…
ভালোবাসা নিয়ে ইংরেজিতেও অনেক ধরনের গান আছে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটি হচ্ছে–I’ll Never Fall in Love Again। গানের কথাগুলো এরকমের–
What do you get when you fall in love?
A guy with a pin to burst your bubble
That’s what you get for all your trouble
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
What do you get when you kiss a girl
You get enough germs to catch pneumonia
After you do, she’ll never phone you
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
কিন্তু কবিগুরু যখন ‘সখি ভালোবাসা কাহারে বলে?” বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন কিংবা শেক্সপিয়র তার নাটকের সংলাপ লিখেছিলেন, “what ‘tis to love?” বলে, তখন কি তারা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞানসহ বিবর্তনের বিভিন শাখা থেকে পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেয়া সম্ভব।
কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাওভাবে বলে দিতাম ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মতো সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালোবাসার গোপন কুঠুরিতে। চলুন আমরাও সে কুঠুরিতে পা রাখি…
কুদ্দুস সিমির প্রেম : নিশা লাগিলো রে…
কুদ্দুস ‘লবে’ পড়িয়াছে। তাহার মন উড়ু উড়ু। পড়ালেখায় মন নেই। বই খুললেই কেবল সিমির মুখ ভেসে উঠে। আনমনে গাইতে থাকে আগুনের গান–
ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মন বসে না
বই খুললেই দেখি তার মুখখানা
অস্থির মন আর বাধা মানে না।
একা পথে চললেই পাশে চলে সে
নিবিড় হয়ে সে বলে সে মোরে
ভালোবাসি ভালোবাসি ..।
ক্যামন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে কুদ্দুস সর্বক্ষণ। একটা পাখি দেখলে মনে হয়-ইস পাখির মতো ডানা মেলে যদি সিমির সাথে উড়ে বেড়ানো যেতো। একটা গোলাপ ফুল দেখলেই মনে হয়–আহা যদি সিমির হাতে তুলে দেয়া যেত! রাস্তার পাশে চটপটির গাড়ি দেখলে মনে হয়–আহা সিমির সাথে মিলে ফুচকা খাওয়া যেত!
না সিমির সাথে ফুচকা খাওয়া আর কুদ্দুসের হয়ে উঠে না। কারণ সিমি রাস্তার আজে বাজে জিনিস খায় না। সিমি মহা বড়লোকের মেয়ে। বসুন্ধরার আলিশান ফ্ল্যাটে থাকে। পাজেরো জিপে করে ভার্সিটিতে আসে। ড্রাইভার সাহেব দরজা খুলে দেয়, আর সিমি আলতো পায়ে গাড়ি থেকে নেমে সটান হাঁটা দেয় ক্লাসের দিকে। স্টিফেনি মেয়র কিংবা লিসি হ্যারিসনের ইংরেজি উপন্যাসের বই বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। “হাবি জাবি পোলাপাইনরে’ পাত্তাই দেয় না সিমি। মোটের উপর সিমি জানেই না তার জন্য কোন এক মজনু দিওয়ানা!
আর ওদিকে তো মজনু কুদ্দুসের অবস্থা আসলেই কেরোসিন। সারাক্ষণই ঘোরের মধ্যে থাকে। মনে মনে আকাশ-কুসুম কল্পনা। ভাবে কোনোদিন হয়তো চলতে গিয়ে কিংবা সিঁড়ি ভেঙে নামতে গিয়ে সিমি উষ্টা খেয়ে পড়বে, স্টেফানি মেয়ারের বইগুলো বগল থেকে ছিটকে পড়ে যাবে, আর ঠিক সেসময়ই বীর পুরুষের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে নায়করাজ কুদ্দুসের। পড়ে যাওয়া বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সিমির হাতে তুলে দিবে, সিমি প্রথম বারের মতো অবাক নয়নে তাকাবে কুদুসের দিকে, সে দৃষ্টিতে থাকবে আধো কৃতজ্ঞতা, আধো প্রেম, আর আধো রহস্যের ছোঁয়া…
নিশা লাগিলো রে,
বাঁকা দু’নয়নে নিশা লাগিলো রে …
কিন্তু সাতমন ঘিও পুড়ে না, আর সিমিও উষ্টা খায় না। আর কুদুসের প্রেমের শিকেও ছিঁড়ে না। কিন্তু ছিঁড়ে না ছিঁড়ে না বলেও শেষ পর্যন্ত ছিড়লো একদিন। ক্যামনে? ক্যামনে আর, এমনে
চোখ থাকলেই চোখাচোখি হবে।
হলো!
এখানেই শেষ হতে পারত–
না, প্রেম হয়ে গেল!
তা কুদ্দুস-সিমির প্রেম ক্যামনে হলো, আর তারপর আর কী কী হলো আমরা আর সেখানে এখন না যাই। আমরা বরং চিন্তা করি কুদুসের এই সদা ঘোর লাগা অবস্থার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? এ নিয়ে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এবং স্নায়ুচিকিৎসকলুসিব্রাউন, আর্থার অ্যারোন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০ জন প্রেমে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উপর এক গবেষণা চালান[৭২]। তাদের গবেষণার ধরনটি ছিল এরকমের। প্রেমিক-প্রেমিকাঁদের সামনে তাদের ভালোবাসার মানুষটির ছবি রাখা হলো, এবং তাদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) করা হলো। দেখা গেল, এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল এবং কর্ডেট অংশ উদ্দিপ্ত হচ্ছে, আর সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামক এক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটছে। অবশ্য কারো দেহে ডোপামিন বেশি পাওয়া গেলেই যে সে প্রেমে পড়েছে তানাও হতে পারে। আসলে নন-রোমান্টিক অন্যান্য কারণেও কিন্তু ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়তে পারে। যেমন, গাঁজা কিংবা কোকেইন সেবন করলে। সেজন্যই আমরা অনেক সময়ই দেখি ভালোবাসায় আক্রান্ত মানুষদের আচরণও অনেকটা কোকেইনসেবী ঘোরলাগা অবস্থার মতোই টালমাটাল হয় অনেক সময়ই।
তবে ভালোবাসার এই রসায়নে কেবল ডোপামিনই নয় সেই সাথে জড়িত থাকে অক্সিটাইসিন, ভেসোপ্রেসিন সহ নানা ধরনের বিতিকিচ্ছিরি নামের কিছু হরমোন। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই হরমোনগুলো নাকি ‘ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে’ মানে প্রেমিক প্রেমিকার বন্ধন দীর্ঘদিন জোরালো করে রাখতে সহায়তা করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এও বলেন কেউ মনোগামী হবে না বহুগামী হবে–তা অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করছে এই হরমোনগুলোর তারতম্যের উপর। দেখা গেছে রিসেপটর বা গ্রাহক জিনে ভেসোপ্রেসিন হরমোনের আধিক্য থাকলে তা পুরুষের একগামী মনোবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে। বিজ্ঞানীরা প্রেইরি ভোলস আর মোন্টেইন ভোলস নামক দুই ধরনের ইঁদুরের উপর গবেষণা চালিয়ে তারা দেখেছেন, একগামিতা এবং বহুগামিতার মতো ব্যাপারগুলো অনেকাংশেই হরমোনের ক্রিয়াশীলতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম উপায়ে ভেসোপ্রেসিনের প্রবাহকে আটকে দিয়ে একগামী ইঁদুরকে বহুগামী, কিংবা অতিরিক্ত ভেসোপ্রেসিন প্রবেশ করিয়ে বহুগামী ইঁদুরকে একগামী করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। তবে ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেটা সত্য তার পুরোটুকু মানুষের ক্ষেত্রে সত্য কি না তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। অন্তত বহুগামী পুলপুরুষদের লোলুপতাকে কেবল ইঁদুরের মতো হরমোন চিকিৎসার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বললে অধিকাংশই দ্বিমত করবেন।
আমরা না হয় কুদ্দুসের প্রেমময় সময়গুলোই বিশ্লেষণে আনি এই মুহূর্তে। কথা হচ্ছে তীব্র প্রেমের সময়গুলোতে কেন দিগবিদিকশূন্য নেশার ঘোর লাগা ভাবের উদয় হয়, কেন বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই লোপ পায়? কেনই বা ভয়ভীতি উবে যায় রাতারাতি? এ সময় বন্ধুদের পরামর্শও মাথায় ঢোকে না। যদি কেউ কুদ্দুসকে বলতো ‘ঐ ব্যাটা কুদ্দুস সিমির পিছে অযথা ঘুইরা লাভ নাই, ওর জগৎ আর তোর জগৎ আলাদা…’ কুদ্দুসের মাথার দেওয়াল সেই তথ্য পৌঁছুবেই না। কিন্তু কেউ যদি আবার উলটো বলে যে, ‘সিমি আজকে তোর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল … সাথে সাথেই কুদুসের মনে হবে এ যেন ‘মক্কা বিজয়’! আসলে তীব্রপ্রেমের সময়গুলোতে কেন মানুষজনের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায় তার একটা ভালো ব্যাখ্যা আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। আমাদের মস্তিষ্কে অ্যামাগডালা বলে একটি বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গ আছে। সেটা এবং মস্তিষ্কের কর্টেক্সের কিছু এলাকা আমাদের ভয়-ভীতি নিয়ন্ত্রণ করে, অকস্মাৎ বিপজ্জনক পরিস্থিতি এলে আমাদের আগাম সতর্ক করে দিতে পারে। দেখা গেছে প্রেমের রোমাঞ্চকর এবং উত্তাল সময়গুলোতে মস্তিকের এ এলাকাগুলোর কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভয় ভীতি কিংবা ক্রিটিকালি’ চিন্তা করার ব্যাপারস্যাপারগুলো পুরোপুরি লোপ পায় তখন। দুমুখেরা বলে, বেশি পরিমাণে গাঁজা-ভাং খেলেও নাকি ঠিক এমনটিই হয়।
বিবর্তন ও প্রেম
কুদ্দুসের এই কোকেইন মার্কা প্রেমানুভূতির মূল উৎস বা কারণ কী তাহলে? উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা। ঘুরে ফিরে সেই একই ব্যাপার, যা বিবর্তনের একেবারে গোড়ার কথা বংশাণু রক্ষার তাগিদ বা নিজের জিনকে টিকিয়ে রাখার অবচেতন প্রয়াস। আসলে প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকারণের সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন শুধু প্রেমানুভূতিই নয়, বস্তুত এটি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা, প্রণয়, আকাঙ্ক্ষা সহ মানুষের সব ধরনের অনুভূতি ও আচরণেরই জন্ম দেয়।
আসলে বংশাণু রক্ষার জন্য যে কোনো প্রাণী অন্তত দুটি কাজ সুচারুভাবে করতে চায়। এক প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়, আর দুই সঠিক যৌনসঙ্গী নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের বংশাণু পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চায়। সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিই প্রধানত প্রণয়াকাঙ্ক্ষার মূল উপলক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। ডারউইন নিজেও ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করেছিলেন এবং তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের (Natural Selection) পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন (Sexual Selection)কেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। না দিয়ে তো উপায় ছিল না। ডারউইন লক্ষ করেছিলেন যে, প্রাণী জগতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে যা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে টিকে থাকার কথা নয়। এগুলো টিকে আছে, কারণ এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীর দ্বারা বংশপরম্পরায় দিনের পর দিন আদৃত হয়েছে। একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ূরের দীর্ঘ পেখম থাকার উদাহরণ। এমন নয় যে দীর্ঘ পেখম পুরুষ ময়ুরকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোনো। বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিল। বরং দীর্ঘ পেখম স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহতই করার কথা, এবং করেছে। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে ময়ুরের দীর্ঘ পেখমকে ব্যাখ্যা করা যায় না। দীর্ঘ পেখম ময়ুরদের জন্য চরম অসুবিধাজনক। দীর্ঘ পেখম থাকলে দৌঁড়াতে অসুবিধা হয়, শিকারিদের চোখয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশিমাত্রায়। কাজেই টিকে থাকার কথা বিবেচনা করলে দীর্ঘ পেখম ময়ূরের জন্য কোনো বাড়তি উপযোগিতা দেয়নি বিবর্তনের পথ পরিক্রমায়। দীর্ঘ পেখম টিকে গেছে মূলত নারী ময়ূর বা ময়ুরীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে। পুরুষ ময়ূরের লম্বা পেখমকে ভালো বংশাণুর নির্দেশক হিসেবে দেখত ময়ূরীরা। কাজেই দীর্ঘ পেখমের ঢেউ তোলা সুশ্রী ময়ুরেরা যৌনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিল, কারণ বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীদের কাছে তারা ছিল একেকজন ‘ব্রাড পিট’ কিংবা টম ক্রুজ! তারাই শেষপর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিল ময়ূরীদের যৌনাকর্ষণের ভিত্তিতে।
মোটা দাগে, যৌনতার নির্বাচন কোনো বাড়তি সুবিধা দেয় না প্রজাতির বেঁচে থাকায়। এগুলো কেবলই গয়নাগাটির মতো ‘অর্নামেন্টাল প্রোডাক্ট। ময়ূরের পেখমের মতো মানবসমাজেও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অর্নামেন্টাল বা অলংকারিক। কবিতা লেখা, গান করা থেকে শুরু করে গল্প বলা, আড্ডা মারা, গসিপ করা, ভাস্কর্য বানানো প্রভৃতি হাজারো বৈশিষ্ট্য মানবসমাজে দেখা যায় যেগুলো স্রেফ অলংকারিক–এগুলো বেঁচে থাকায় কোনো বাড়তি উপাদান যোগ করেনি, কিন্তু এগুলো টিকে গেছে যৌন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যৌনতার নির্বাচন কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন থেকে একটু আলাদা। যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো বেঁচে থাকায় বাড়তি উপাদান যোগ করে না, এগুলো বৈশিষ্ট্য হিসেবে থেকে যায় কেবল বিপরীত লিঙ্গের পছন্দ এবং অভিপ্রায়কে মূল্য দিয়ে। তারপরও, ময়ূরের যে পেখম বেঁচে থাকায় কোন সহায়তা দিচ্ছে না, সেটা কেন বিপরীত লিঙ্গের অর্থাৎ ময়ূরীর কাছে সৌন্দর্য হিসেবে প্রতিভাত হবে- এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এর কারণ হল, যে ময়ূরের দীর্ঘ পেখম আছে, সে ময়ূর জেনেটিকভাবে অধিকতর ‘ফিট’ বলে ময়ূরীর কাছে প্রতিভাত হয়; কারণ, দীর্ঘ পেখম তৈরি ও এর অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতাকে কাআটিয়ে উঠে টিকে থাকায় কিছু বাড়তি শক্তি ব্যবহার করতে হয়। যারা এটা করতে পারে, ময়ূরীর কাছে তারাই ‘সুন্দর’! ইসরাইলী বিজ্ঞানী জাহাবির একটি প্রিন্সিপাল আছে- Handicap principle । এর আলোকে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। এ নিয়ে এই অধ্যায়ের শেষ দিকে আরো আলোচনা করা হয়েছে।
এই ‘মেটিং সিলেকশনের’ মায়াবী খেলা চলে কম-বেশি সব প্রাণীর মধ্যেই। স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রায় সব প্রজাতিতেই দেখা যায় পুরুষেরা সাধারণত অনেক বড় এবং বলশালী হয়, সেই সাথে দেখা যায় অনেক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের সমাহার (যেমন, উজ্জ্বল রঙ, শিং, কেশর, দ্রুতগামিতা, ক্ষিপ্রতা, নৃত্য এবং সংগীতে পারদর্শিতা ইত্যাদি)। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় চুল রাখা, দামি সানগ্লাস, কেতাদুরস্ত কাপড় পরা থেকে শুরু করে দামি গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষা, বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। মানবসমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের ফল। আমি মুক্তমনা ব্লগে বেশ কিছু যৌনতার নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে বেশ কিছু লেখা আগে লিখেছি[৭৪,৭৫]; সংশপ্তক কিছুদিন আগে মেটিং সিলেকশনে পুরুষের নাচের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তমনায় পুরুষের নৃত্য এবং নারী’ শিরোনামে[৭৬]। এগুলো সবই মানবসমাজে যৌনতার নির্বাচনের গুরুত্বকে সুচারুভাবে তুলে ধরে। অপার্থিব তার ‘ভালোবাসা ও বিবর্তন’ (পূর্বোক্ত) লেখায় লীন মাগুলিস ও ডরিয়ান সেগান “Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality” বই থেকে একটি চমৎকার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন–
“প্রযুক্তি কিংবা সভ্যতা আমাদেরকে আমাদের পশুত্ব থেকে খুব দূরে সরাতে পারেনি, বরং তা আরও জোরাল ভাবে সেটা অধিষ্ঠিত করেছে। সৌখিন চশমা, স্কন্ধালঙ্কার ইত্যাদি যেন অনেকটা ময়ূরের পুচ্ছের মতোই। “
যৌনতার নির্বাচন আমাদের মানসপটে কাজ করে বলেই কারো সুন্দর চেহারা কিংবা মনোহারী ব্যক্তিত্ব দেখলে আমরা সবাই মনের অজান্তেই আন্দোলিত হয়ে উঠি। বঙ্কিমচন্দ্র যে একসময় বলেছিলেন, ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যে নয় একেবারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা সংস্কৃতিভেদে সবাই বিপরীত লিঙ্গের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে সেগুলো হলো–পরিষ্কার চামড়া এবং প্রতিসাম্যময় মুখ, পরিষ্কার চোখ, সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত, সতেজ এবং সুকেশী চুল এবং চেহারার গড়পড়তা। সুন্দর চামড়া[৭৭] (Unblemished skin), স্বচ্ছ চোখ (clear eyes), সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত (intact teeth), সতেজ এবং সুকেশী চুল (luxuriant hair) কেন পছন্দনীয় তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। এগুলো তারুণ্য, সুস্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি প্রজনন ক্ষমতার বাহ্যিক প্রকাশ ছিল আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কাছে। একই ব্যাপার খাটে প্রতিসাম্যময় মুখের (symmetrical face) ক্ষেত্রেও। এ ধরনের সুগঠিত চেহারা বিপরীত লিঙ্গের কাছে প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যে তার পছন্দনীয় মানুষটি অপুষ্টির শিকার নয়, কিংবা জীবাণু কিংবা পরজীবীদের আবাসস্থল নয়। অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল বংশাণু টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে সঠিক যৌনসঙ্গী নির্বাচনের একধরনের ‘সফল মার্কার।
চেহারার গড়পড়তা ব্যাপারটা সাদা দৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কেন গড়পড়তা চেহারাকে আকর্ষণীয় বলে মনে হবে? এটা মনে হয় কারণ, ‘গড়পড়তা চেহারা একটা বিশেষ ব্যাপারকে তুলে ধরে। সেটা হচ্ছে ‘জেনেটিক ডাইভার্সিটি বা বংশানুক্রমিক বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য বজায় থাকা মানে বাহক অধিকতর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম এবং প্রতিকূল পরিবেশে সহজে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। আসলে আমরা যে গড়পড়তা চেহারাকে ‘সুন্দর’ বলে রায় দেই, তা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন একটি ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে। নির্বিচারে ১০ টি চেহারা নিয়ে ফটোশপ কিংবা কোনো প্রফেশনাল সফটওয়্যারে চেহারাগুলো মিশ্রিত (blend) করে উপস্থাপন করলে সেটিকে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। নীচের ছবিটি লক্ষ করুন। প্রথম দুটো ছবিকে মিশ্রিত করে তৃতীয় ছবিটি তৈরি করা হয়ছে। মনঃস্তাত্বিক জরিপে অধিকাংশ লোকই তৃতীয় ছবিটিকে অন্য দুটো ছবির চেয়ে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে রায় দেয়!
পরিষ্কার চামড়া বলতে এখানে সাদা চামড়া বোঝানো হচ্ছে না, বোঝানো হয়েছে Unblemished skin বা নিষ্কলঙ্ক চামড়াকে। বলা বাহুল্য, সাদা, কালো বাদামি সব চামড়াই আনব্লেমিসড বা নিষ্কলঙ্ক হতে পারে। এই নিষ্কলঙ্ক চামড়া এক ধরনের ‘ফিটনেস মার্কার’ ছিল আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে সঙ্গী নির্বাচনে বলে ধারণা করা হয়, কারণ এ ধরণের চামড়া সুস্থতার প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল তাদের কাছে।
তবে যৌনতার নির্বাচন শুধু অভিন্ন মানবপ্রকৃতি গঠন করেছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। বহুক্ষেত্রেই এটি পার্থক্য সূচিত করেছে নারী পুরুষের পছন্দ-অপছন্দে। অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন আবার কাজ করেছে নারী-পুরুষের পার্থক্যসূচক মানসজগৎ তৈরিতেও পলে পলে একটু একটু করে। আসলে সত্যি বলতে কি যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে। এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা। তৈরি এবং ত্বরান্বিত হয়েছে বিভিন্ন লিঙ্গ-ভিত্তিক নানা পছন্দ অপছন্দ। পুরুষ দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছে বলে স্বভাবে হয়ে উঠেছে অনেক সহিংস। আবার নারীরাও একটা সময় পুরুষদের এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এ ধরনের পুরুষেরা নিজ নিজ ট্রাইবকে রক্ষা করতে পারত বহিঃশত্রুর হাত থেকে। এ ধরনের সমর দক্ষ পুরুষেরা ছিল সবার হার্টথ্রব এরা দিয়েছিল নিজের এবং পরিবারের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। এ ধরনের সাহসী পুরুষেরা নিজেদের জিন ছড়াতে পেরেছে অনেক সহজে, আমার মতো কাপুরুষদের তুলনায়! ফলে নারীরাও চেয়েছে তার সঙ্গীটি কাপুরুষ না হয়ে সাহসী হোক, হোক বীরপুরুষ! এই ধরনের চাহিদার প্রভাব এখনও সমাজে দৃশ্যমান। ডেট করতে যাওয়ার সময় কোনো নারীই চায় না তার সঙ্গী পুরুষটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো হোক। সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, শুধু আমেরিকায় নয়, সব দেশেই! বাংলাদেশে বিয়ে করতে গেলে পাত্রের উচ্চতা বউয়ের উচ্চতার চেয়ে কম দেখা গেলেই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গাই-ই শুরু হয়ে যায় মুহূর্তেই। খাটো স্বামীকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীরও মনোকষ্টের সীমা থাকে না। হাই হিল জুতো আর তার পরা হয়ে ওঠে না। আসলে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রভাব মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই এটি ঘটে। লম্বা চওড়া জামাই সবার আদরনীয়, কারণ একটা সময় লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান এই সব পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করতে পেরেছিল স্বীয় গোত্রকে, রক্ষা করেছিল উত্তরপুরুষের জিনকে অন্যদের তুলনায় অনেকে ভালোভাবে। সেই আদিম মানসপট আধুনিক মেয়েদের মনে রাজত্ব করে তাদের অজান্তেই!
আবার পুরুষদের মানসজগতেও নারীদেহের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদগ্র আগ্রহ দেখা যায় সম্ভবত বিবর্তনীয় তথা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানসপট তৈরি হবার কারণেই। যে কোনো দেশের সাহিত্যের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে– নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডৌল নিতম্ব আর ক্ষীণ কটিদেশ নিয়ে যুগের পর যুগ কাব্য করেছে পুরুষ সকল সংস্কৃতিতেই। কারণ নারীদেহের এই বৈশিষ্ট্যগুলোই সকল পুরুষের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম সমাজে পুরুষদের কাছে বৃহৎ স্তন এবং নিতম্বের মেয়েরা অধিকতর আদৃত ছিল প্রাকৃতিক কারণেই। বিপদসঙ্কুল জঙ্গুলে পরিবেশে মেয়েদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পুরুষদের সাথে ঘুরতে হতো। এলাকায় খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিলে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে হতো। অতি আধুনিক কালের কৃষিবিপ্লবের কথা বাদ দিলে মানুষকে আসলেই শতকরা নব্বই ভাগ সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে খাদ্যস্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে নারী দীর্ঘদিন খাদ্যস্বল্পতার প্রকোপ এড়িয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারা টিকে গেছে অনেক বেশি হারে। কাজেই কোনো নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যত-প্রজন্মের জন্য ‘অফুরন্ত খ্যাদ্যের ভাণ্ডার হিসেবে। এ এক অদ্ভুত বিভ্রম যেন। এই বিভ্রম দীর্ঘদিন ধরে পুরুষকে করে তুলেছে পুখুল স্তনের প্রতি আকর্ষিত। তারা লালায়িত হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে–এ ধরনের দৈহিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জৈবিক তাড়নায়। ঠিক একই ভাবে, বহিঃশত্রু যখন আক্রমণ করেছে তখন যে নারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাঁচতে পেরেছে, তাদের জিন রক্ষা পেয়ছে অনেক সহজে। এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নারীর কোমড় হয়েছে ক্ষীণ, আর নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলো পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি আদরণীয়।
নারীর সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষদের আগ্রহের অবশ্য আরও একটি বড় কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বিগত পাঁচ মিলিয়ন বছরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। ফলে এটি বাচ্চার জন্মের সময় তৈরি করেছে জন্মসংক্রান্ত জটিলতার। এই কিছুদিন আগেও সারা পৃথিবীতেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়া মায়েদের সংখ্যা ছিল খুবই উদ্বেগজনকভাবে বেশি। আজকের দিনের সিসেক অপারেশন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি এই জটিলতা থেকে নারীকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আদিম সমাজে তো আর সি-সেকশন বলে কিছু ছিল না। ধারণা করা হয়, সভ্যতার উষালগ্নে ক্ষীণ নিতম্ববিশিষ্ট নারীদের মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছে বড় মাথাওয়ালা বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে। টিকে থাকতে পেরেছে সুডৌল এবং সুদৃঢ় নিতম্ব-বিশিষ্ট মেয়েরাই। কারণ তারা অধিক হারে জন্ম দিতে পেরেছে স্বাস্থ্যবান শিশুর। ফলে দীর্ঘদিনের এই নির্বাচনীয় চাপ তৈরি করেছে। নারী দেহের সুদঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক উদগ্র কামনা!
পুরুষের চোখে নারীর দেহগত সৌন্দর্যের ব্যাপারটাকে এতদিন পুরোপুরি “সাংস্কৃতি ব্যাপার বলে মনে করা হলেও আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহ তার গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন যে, সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারীর কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত ০.৬ থেকে ০.৮ মধ্যে থাকলে সার্বজনীনভাবে আকর্ষণীয় বলে মনে করে পুরুষেরা। অধ্যাপক সিংহের মতে মোটামুটি কোমর নিতম্ব = ০.৭ এই অনুপাতই তৈরি করে মেয়েদের ‘classic hourglass figure’, যা পুরুষদের মনে তৈরি করেছে আদি অকৃত্রিম যৌনবাসনা। সংস্কৃতি নির্বিশেষে এই উপাত্তের পেছনে সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়[৭৮]। সম্প্রতি পোলিশ একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সুডৌল স্তন, সরু কোমড় এবং হৃষ্ট নিতম্ব মেয়েদের সর্বচ্চ উর্বরতা প্রকাশ করে, যার পরিমাপ পাওয়া গেছে দুটো প্রধান যৌনোদ্দীপক হরমোনের (17-B-estradiol & progesterone) আধিক্য বিশ্লেষণ করে[৭৯]। পুরুষের মনে প্রথিত হওয়া যৌনোদ্দীপক কোমর/নিতম্বের অনুপাত আসলে তারুণ্য, গর্ভধারণক্ষমতা (Fertility) এবং সাধারণভাবে সুসাস্থ্যের প্রতীক। কাজেই এটিও পুরুষের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরনের ‘ফিটনেস মার্কার হিসেবে। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর জন্সটন তাঁর “Why We Feel? The Science of Emotions’ বইয়ে বলেন যে মেয়েদের কোমর ও নিতম্বের অনুপাত ০.৭ হলে এন্ড্রোজেন ও এস্ট্রোজেন হরমোনের যে অনুপাত গর্ভধারণের জন্য সবচেয়ে অনুকুল সেই অনুপাতকে প্রকাশ করে। এরকম আরেকটি নিদর্শক হলো সুডৌল ওষ্ঠ। সেজন্যই গড়পড়তা পুরুষেরা এঞ্জেলিনা জোলি কিংবা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের পুরুষ্টু ওষ্ঠ ছবিতে দেখে লালায়িত হয়ে ওঠে। কাজেই দেখা যাচ্ছে সৌন্দর্যের উপলব্ধি কোনো বিমূর্ত ব্যাপার নয়। এর সাথে যৌন আকর্ষণ এবং সর্বোপরি গর্ভধারণক্ষমতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, আর আছে আমাদের দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথপরিক্রমার সুস্পষ্ট ছাপ।
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
শচীন দেব বর্মনের গাওয়া আমার একটা খুব প্রিয় গান আছে। গানটির কথাগুলোর সাথে অবশ্য অনেকেই পরিচিত (এখানে একটি কথা বলে রাখি, গানটির গীতিকার কিন্তু হলেন মীরা দেব বর্মন; শচীন কর্তার স্ত্রী!–
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে
হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
একি তব হোলি খেলা।
তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন
তুমি যে রসেরও ধারা।
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা
করে মোরে দিশাহারা
মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে
তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু
তুমিই শুধু তুমি …
প্রেমের কথা বলতে গেলে গন্ধের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে গন্ধের অনুভূতিই সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। এমনকি এককোষী ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত কেবল ‘গন্ধ শুকে বুঝতে পারে কোন খাবারটা পুষ্টিকর আর কোনটা তাদের জন্য মরণবিষ। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু খাদ্যদ্রব্য শোকাই নয় যৌনতার পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রে কিংবা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও গন্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর, বিড়াল, কুকুরসহ অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীই বেঁচে থাকা কেবল নয়, যৌনসম্পর্কের ব্যাপারেও অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকে গায়ের গন্ধের উপর। আসলে যৌনতার নির্বাচনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয় শরীরের গন্ধকে। আমাদের প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, তেমনি আমাদের প্রত্যেকের শরীরের গন্ধও আলাদা, যা অবচেতন মনেই সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, গন্ধের এই তথ্যগুলো জীবদেহে লিপিবদ্ধ থাকে এক ধরনের জিনের মধ্যে, যার নাম ‘হিস্টোকম্পিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন’ বা সংক্ষেপে MHC gene।
মীরা দেব বর্মনকে কেবল শচীন দেব বর্মনের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত করাটা অবশ্য সত্যের অপলাপ হবে। বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে ছাড়াও শোন গো দখিন হাওয়া, বিরহ বড় ভাল লাগে, সুবল রে বল বল, তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল সহ অনেক জনপ্রিয় গানেরই গীতিকার ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য জিনের পাশাপাশি গন্ধ পরিবহনের পিছনে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থেরও ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন সেটাকে ফেরোমোন (Pheromone) বলে তারা অভিহিত করেন। এই ফেরোমোন নার্ভ জিরো’ নামে এক ধরনের করোটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হয়ে প্রাণিজগতে সঙ্গী নির্বাচন এবং প্রজননকে ত্বরান্বিত করে বলে ধারণা করা হয়[৮২]। দেখা গেছে গন্ধের উপর নির্ভর করে অনেক প্রাণীই লিঙ্গ চিহ্নিতকরণ, সামাজিক পদমর্যাদা, অঞ্চল, প্রজননগত অবস্থানসহ অনেক কিছু নির্ণয় করতে পারে। যেমন, ১৯৫৯ সালে ইঁদুরের উপর হিল্ডা ব্রুসের একটি গবেষণা[৮৩] থেকে পাওয়া গেছে যে, সঙ্গমের পর যদি কোনো ইঁদুর অরচিত কোনো ইঁদুরের গন্ধের খোঁজ পায়, তাহলে তার জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপিত না হয়ে ঝরে পড়ে। কিন্তু পরিচিত বা পছন্দের সঙ্গীর গন্ধ গর্ভধারণে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তার মানে ফেরোমোনের সাহায্যে পছন্দের সঙ্গীর মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে কিংবা বাতিল করতে পারে এ ধরনের ইঁদুরেরা।
২০০৬ সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক এবং তার সহযোগী সিয়াটলের একটি ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে গবেষণারত অবস্থায় নতুন গ্রাহক প্রোটিনের পরিবারের ১৫টি সদস্যকে সনাক্ত করতে সমর্থ হন। ইঁদুরের নাকে খুঁজে পাওয়া এই গ্রাহকগুলো ফেরোমোনকে সনাক্ত করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রাণিজগতে ফেরোমোনের ভূমিকা খুব ভালোভাবে প্রমাণিত হলেও মানুষের মধ্যে এর সরাসরি সম্পর্ক যে খুব জোরালো সেটা কিন্তু এখনও বলা যাবে না[৮৪]। আসলে অন্য প্রাণীরা তাদের বেঁচে থাকা এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গন্ধের উপর খুব বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হলেও বিবর্তনের ক্রমধারায় গন্ধের উপযোগিতা এবং গুরুত্ব মানব প্রজাতিতে কমে এসেছে। মানুষ তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণেন্দ্রিয় কিংবা বুদ্ধিমত্তার উপর যেভাবে নির্ভর করে, ঠিক তেমনভাবে গন্ধের উপর নয়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের ঘাণজ আবরণীকলায় (olfactory epithelium) এখনও প্রায় ৩৪৭টি ভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল নিউরনের অস্তিত্ব আছে। এই নিউরনগুলো ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ সনাক্ত করতে পারলেও আমাদের মাথায় বহুসময়েই গন্ধগুলো মিশ্রিত হয়ে উপস্থাপিত হয়, অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে যেটা আলাদাই থাকে। লিন্ডা বাক ইঁদুরের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ফারমোনের গ্রাহক জিনে খুঁজে পেয়েছিলেন, তার অন্তত ছয়টি মানুষের মধ্যেও আছে।
অন্য প্রাণীদের মতো মানুষের জীবন যাত্রাতেও ফেরোমোনের প্রভাব থাকতে পারে এ ব্যাপারটি বোঝা যেতে শুরু করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্থা ক্লিনটক এবং ক্যাথলিন স্টার্নের একটি গবেষণা থেকে। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই জানেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে কিংবা ছাত্রী-আবাসে একই কক্ষে একাধিক ছাত্রীরা অবস্থান করলে তাদের ঋতু বা রজঃস্রাব একই সময়ে সমাপতিত হয়ে যায়। এই রহস্যময় ব্যাপারটিকে বলে ঋতুচক্রের সমলয়ীকরণ (menstrual synchrony)। মার্থা ক্লিনটক তার ১৯৭১ সালের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন যে এটার পেছনে মূল ভুমিকা পালন করে ফেরোমোন[৮৬]।
১৯৯৮ সালে মার্থা ক্লিনটক তার আগের গবেষণাকে আরও বিস্তৃত করেন। তিনি তার এ পরীক্ষায় দেখান, যে ফেরোমোন শুধু ঋতুচক্রের সমলয়ীকরণই নয়, সেই সাথে মেয়েদের অনিয়মিত মাসিককে নিয়মিত করতেও ভূমিকা রাখে। সাধারণত দেহের লোমশ জায়গাগুলোকে (যেমন, বগলের তলা কিংবা যৌনাঙ্গের এলাকা প্রভৃতি) ফেরোমোনের উৎস বলে মনে করা হয়। মার্থা ক্লিনটক এই পরীক্ষায় কিছু স্বাচ্ছাসেবক পুরুষের বগল থেকে নেওয়া ঘামের ফেরোমোন নারিদের ঠোঁটে লাগিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা করে দেখেন, এর ফলে মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে[৮৭]। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, অন্য প্রাণীদের মতো এত ব্যাপক আকারে না হলেও শরীরের গন্ধ মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধতন্ত্র গঠনে বড় ভূমিকা রাখে, এবং এর পেছনে আছে বিবর্তনীয় কারণ। হেলেন ফিশার তাঁর অ্যানাটমি অফ লাভ বইয়ের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন[৮৮]—
পুরুষের গায়ের গন্ধ (ঘাম) মেয়েদের ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। সেজন্যই ছেলেদের ঘামের গন্ধের প্রতি মেয়েদের (অবচেতন) আকর্ষণ খুব সম্ভবত বিবর্তনজনিত। পুরুষদের সুগন্ধি ব্যবহার করার ও মেয়েদের তা পছন্দ করার কারণ হলো পণ্য উৎপাদনকারীর বিজ্ঞাপকদের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক মগজ ধোলাই যার দরুন ঘাম হওয়াকে অপরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এক করে দেখা হয়।
অর্থাৎ, এ ব্যাপারটি মনে রাখতে হবে যে, ঘামের পচা গন্ধ যে আমরা অপছন্দ করি সেটা এবং ফেরোমোনের গন্ধ কিন্তু এক নয়। ঘামের দুর্গন্ধ তৈরি হয় ঘামের ব্যাক্টেরিয়া পচনের ফলে, যা আবহাওয়ায় ছড়ায় কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু অন্যদিকে ফেরোমোনের গন্ধ মূলত দেহজাত যা খুবই সূক্ষ এবং সেটা সচেতনভাবে পাওয়া যায় না। আমরা যতই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি না কেন, সেটা সবসময়ই দেহ থেকে বের হতে থাকে বলে মনে করা হয়। ছেলেরা যখন এগারো বারো বছর বয়সের দিকে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায়, তখন তাদের দেহ হয়ে উঠে নানা ধরনের নতুন ধরনের গন্ধের আড়ত, যা তার আগেকার শিশু বয়সের গন্ধ থেকে একেবারেই আলাদা। স্নায়ুবিজ্ঞানী লোয়ান ব্রিজেন্ডিন তার সাম্প্রতিক ‘মেইল ব্রেন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই নতুন গন্ধটি টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে পুরুষের দেহজ ঘামগ্রন্থি থেকে নির্গত ফেরোমোন এবং এন্ড্রোস্টেনেডিওনের একধরনের সুষম মিশ্রণ[৮৯]। আর ছেলেদের এই গন্ধটা মেয়েরা পায় প্রবৃত্তিগতভাবে,ঘ্রাণজ আবরণীকলার মাধ্যমে নয়, বরং এর বাইরে আরেকটি পৃথক অঙ্গের মাধ্যমে যাকে বলা হয় ভোমেরোনাসা তন্ত্র (Vomeronasal Organ) বা সংক্ষেপে VNO।
গন্ধ যে মানুষের মনের মেজাজ মর্জি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তা কিন্তু আমরা প্রাত্যহিক জীবনের নানা উদাহরণ থেকে খুব সাধারণভাবেই জানি। পুজা-অর্চনার সময় ধূপধুনা জ্বালানো, কিংবা মিলাদ মাহফিলে আগর বাতি জ্বালানো হয় গন্ধের মাধ্যমে চিত্ত চাঞ্চল্য দূর করে মানসিক ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় রাখার প্রয়োজনেই। গোলাপের গন্ধে মন প্রফুল্ল হওয়া, লেবুর গন্ধে সতেজ থাকা, ফিনাইল এলকোহলের গন্ধে রক্তচাপ কমার কিংবা ইউক্যালিপ্টাস পাতার ঘ্রাণে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়মিত হবার কিছু প্রমাণ বিজ্ঞানীরাও পেয়েছেন। আর বিভিন্ন সৌগন্ধিক কোম্পানিগুলো টিকেই আছে পারফিউমের সুবেশী গন্ধকে প্রফুল্লতায় নিয়ে যাওয়ার নানা রকম চেষ্টার উপকরণের উপরেই। কিন্তু এসবের বাইরেও বিজ্ঞানীরা গন্ধের আরও একটি বড় ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন। আমরা যে ‘হিস্টোকম্পিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন’ বা MHC জিনের কথা আগে জেনেছি, দেখা গেছে অনেক প্রাণী গন্ধের মাধ্যমে MHC জিন সনাক্ত করতে পারে। এভাবে তারা গন্ধ শুকে নিজেদের পরিবারে কিংবা নিকটাত্মীয়দের সাথে সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকতে পারে। এই বিরত থাকার ব্যাপারটা কিন্তু বিবর্তনীয় পথেই সৃষ্ট হয়েছে। মানবসমাজেও খুব কাছের পরিবার পরিজনদের (বাবা, মা ভাই বোন কিংবা নিকটাত্মীয়) মধ্যে যৌনসঙ্গমকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, সামাজিকভাবেই একে ‘ব্যাভিচার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, খুব কাছের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাভিচারের ফলে যে সন্তান জন্মায় দেখা গেছে তার বংশাণু বৈচিত্র্য হ্রাস পায়, ফলে সে ধরনের সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। শুধু তাই নয় জীববিজ্ঞানীরা গবেষনা করে দেখেছেন যে, বাবা কিংবা মায়ের পরিবারে যদি কোনো জিনবাহিত রোগ থাকে, তবে শতকরা ২৫ ভাগের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্ভাবনা থেকে যায় ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান জন্মানোর। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘কনজেনিটাল বার্থ ডিফেক্ট’ (congenital birth defects) বা জন্মগত সমস্যা। নিঃসন্দেহে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যাপারটি অনুধাবন করেছিলেন যে কাছাকাছি পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত মানুষজনের মধ্যে যৌনসম্পর্ক হলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে। এবং সে সমস্ত শিশুর মৃত্যু হার বেশি। সামাজিকভাবেই এটিকে প্রতিহত করার প্রবণতা দেখা দেয়। সেজন্যই বিবর্তনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমাদের প্রবৃত্তিগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের দেখে যৌন আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয় না। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন অন্য প্রাণীদের মতো মানুষও অবচেতনভাবেই গন্ধের সাহায্যে ব্যাপারটির ফয়সলা করে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে জীববিজ্ঞানী ক্লাউস ওয়েডেকাইণ্ডের একটি গবেষণায়[৯১]।
সেই পরীক্ষায় সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ওয়াইল্ড ১০০ জন কলেজ ছাত্রকে আলাদা করে তাদের সুতির জামা পরিয়ে রেখেছিলেন দুই দিন ধরে। সেই দুই দিন তারা কোনো ঝাল-ঝোলওয়ালা খাবার খায়নি, ধূমপান করেনি, কোনো ডিওডারেন্ট ব্যবহার করেনি, এমনি কোনো সুগন্ধি সাবানও নয়, যাতে করে নমুনাক্ষেত্র প্রভাবান্বিত হবার ঝামেলা-টামেলাগুলো এড়ানো যায়। তারপর যেটা করা হলো তা বেশ মজার। তাদের সবগুলো জামা একত্রিত করে একটি বাক্সে ভরে আরেকদল অপরিচিত ছাত্রীদের দিয়ে শোঁকানো হলো। মেয়েদেরকে গন্ধ শুকে বলতে বলা হলো কোনো টি-শার্টের গন্ধকে তারা ‘সেক্সি’ বলে মনে করে। দেখা গেল মেয়েরা সেসমস্ত টি-শার্টের গন্ধকেই পছন্দ করছে কিংবা যৌনোদ্দীপক বলে রায় দিচ্ছে যে সমস্তটি-শার্টের অধিকারীদের দেহজ MHC জিন নিজেদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আর যাদের MHC জিন নিজের জিনের কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয়, তাকে মেয়েরা অনেকটা নিজের ভাইয়ের মতো মনে করে[৯২]!
১৯৯৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বংশগতিবিদ ক্যারোল ওবারের এ ধরনের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে একই MHC জিন বিশিষ্ট বাহকেরা সাধারণত একে অপরের সাথে যৌন সম্পর্কে অনিচ্ছুক হয়[৯৩]। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই পৃথিবীতে দম্পতিদের বন্ধ্যাত্ব এবং গর্ভপাত সমস্যার একটি বড় কারণ আসলে লুকিয়ে আছে দম্পতিদের MHC জিনের সমরূপতার মধ্যে। ডাক্তাররা ১৯৮০ সালের পর থেকেই কিন্তু এ ব্যাপারটা মোটামুটি জানেন। তারা দেখেছেন অনেক নারী দৈহিক এবং মানসিকভাবে কোন ধরনের সমস্যার মধ্যে না থাকা সত্ত্বেও সন্তান হচ্ছে না কেবল দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার MHC জিন তার স্বামীর জিনের কাছাকাছি হওয়ায়। অনেক সময় যদিওবা সন্তান হয়ও তা থাকে পর্যাপ্ত ওজনের অনেক নীচে। আর এ ধরনের একই MHC জিন বিশিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের হারও থাকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি[৯৪]। হিউম্যান লিউকোসাইট এন্টিজেন’ (সংক্ষেপে HLA) নামে আমাদের ডিএনএ-এর একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ আছে যা দেহের রোগ প্রতিরোধের সাথে জড়িত। জুরিখের বংশগতি বিশেষজ্ঞ তামারা ব্রাউনের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে এই HLAর বৈচিত্র্যই ‘সঠিক ভালোবাসার মানুষ’ নির্বাচনে বড় সড় ভুমিকা রাখে। সাধারণভাবে বললে বলা যায়, আপনার হবু সঙ্গীর HLAর বিন্যাস আপনার থেকে যত বেশি বৈচিত্র্যময় হবে, তত বেশি বাড়বে তার প্রতি আপনার আকর্ষণের মাত্রা এবং সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা[৯৫]। এই ধরনের জেনেটিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য জিনপার্টনার ডট কম (genepartner.com)-এর মতো সাইটগুলো ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। এর মাধ্যে এর মক্কেলরা নাকি তাদের থুতু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারবেন, তার ভবিষ্যত সঙ্গীর HLAর বিন্যাস বৈচিত্র্য তাকে কতটুকু আকর্ষিত কিংবা বিকর্ষিত করতে পারে, আর এতে খরচ পড়বে পরীক্ষা প্রতি ৯৯ ডলার! কে জানে হয়তো তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলোতে বহুদিন ধরে চলে আসা এরেঞ্জড ম্যারেজ’-এর জেনেটিক রূপ দেখা যাবে ভবিষ্যতের ‘উন্নত পৃথিবীতে। MHC জিন কিংবা HLAর বিন্যাস দেখে গুনে শুনে দল বেধে সঙ্গী নির্বাচন করছে প্রেমিক প্রেমিকেরা কিংবা বিবাহ ইচ্ছুকেরা[৯৬]!
তবে পাঠকদের নিশ্চয় বুঝতে দেরি হবার কথা নয় যে, কেবল জেনেটিক ম্যাচ বা বংশগতীয় জুড়ির উপর নির্ভর করে সঙ্গী নির্বাচনের চেষ্টা খুব বেশি সফল হওয়ার কথা নয়, কারণ মানব সম্পর্ক এমনিতেই অন্য প্রাণীর চেয়ে অনেক জটিল। মানুষের সম্পর্কের স্থায়িত্ব জিনের বাইরেও অনেক বেশি নির্ভরশীল পরিবেশ এবং সম্পর্কের সামাজিকীরনের উপর। সেজন্যই দেখা যায় অনেক সময় বংশগতীয় পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না আশা সত্ত্বেও অনেকের ক্ষেত্রেই সম্পর্ক তৈরি এবং বিকাশে সমস্যা হয়নি, কেবল সামাজিক উপাদানগুলোর কারণেই। তারপরেও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন বংশগতীয় ব্যাপারটা মিলে গেলে সম্পর্ক তৈরিতে সেটা অনুকূল প্রভাব আনতে পারে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। ক্লাউস ওয়াইন্ড, ক্যারোল ওবার, তামারাব্রাউন সহ অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, আমাদের ডিএনএতে প্রকাশিত এই ভালোবাসার সংকেতগুলো শেষ পর্যন্ত ফেরোমোন প্রবাহের মাধ্যমেই আমাদের মস্তিকে পৌঁছায়, যার ভিত্তি মূলত লুকিয়ে আছে সঙ্গীর গায়ের গন্ধের মধ্যেই। সেজন্যই বিলিয়ন ডলারের ম্যাচমেকিং সাইটগুলো এখন ভালোবাসার রসায়ন বুঝতে ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি গায়ের গন্ধ নিয়েও আগ্রহী হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা জানতে শুরু করেছি যে, আর সব প্রাণীর মতো মানুষও অবচেতন মনেই গন্ধ শোঁকার মাধ্যমে সঙ্গী বাছাইয়ের কাজটি করে থাকে। কথিত আছে, ১৫ শতকে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় হেনরীর শাসনামলে সম্রাটের আমন্ত্রণে মারিয়া নামে এক নর্তকীরাজপ্রাসাদে নাচতে এসেছিল। শোনা যায়, নাচ শেষ হবার পর ঘর্মাক্ত শরীর একটি তোয়ালে দিয়ে মুছে মারিয়া সম্রাটের দিকে ছুড়ে দেয়। সম্রাট সেই তোয়ালে পেয়ে ‘ভালোবাসার গন্ধে এমনই বিমোহিত হন, যে মারিয়াকে আর প্রাসাদ থেকে যেতে দেননি, তাকে সম্রাজ্ঞী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। অবশ্য বলা বাহুল্য, আমাদের মতো অধিকাংশ ছা-পোষা মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের গন্ধকেন্দ্রিক পছন্দগুলো সম্রাট হেনরীর এত প্রকটভাবে দৃশ্যমান নয়। আর আগেই বলেছি, গন্ধের মাধ্যমে পছন্দের এই ব্যাপারটি আসলে সচেতন ভাবে নয়, বরং প্রবৃত্তিগতভাবেই ঘটে, এবং এটি উদ্ভূত হয়েছে বিবর্তনেরই ক্রমিক ধারায়।
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ-তরে।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে।
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ-’পরে।
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন,
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে।
দেহমিলন নামে চতুষ্পদী কবিতার শুরুতে কবিগুরু উপরের যে চরণগুলো লিখেছেন, তা যেন প্রেম ভালোবাসার একেবারে মোদ্দা কথা–”অধর মরিতে চায় তোমার অধরে’! সত্যই তো। চুমুবিহীন প্রেম যেন অনেকটা লবনহীন খিচুড়ির মতোই বিস্বাদ!
তাই ভালোবাসার কথা বললে অবধারিতভাবেই চুমুর কথা এসে পড়বে। ভালোবাসা প্রকাশের আদি এবং অকৃত্রিম মাধ্যমটির নাম যে চুম্বন সেই বিষয়ে সম্ভবত কেউই দ্বিমত করবেন না। কাজেই কেন কবিগুরুর কথামতো আমাদের অধর মরিতে চায় অন্যের অধরে তার পেছনের বিজ্ঞানটি না জানলে আমাদের আর চলছে না।
বাঙালি, আফগানি, জাপানিজ, মালয় থেকে শুরু করে পশ্চিমা সংস্কৃতি সব জায়গাতেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চুম্বন পাওয়া যাবে। সংস্কৃতিভেদে চুম্বনের তারতম্য আর ভেদাভেদ আছে ঠিকই—কোথাও প্রেমিক প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা প্রেমিককে চুমু খায় গোপনে, কোথাও বা প্রকাশ্যে, কারো চুম্বন শীতল, কারোটা বা উদগ্র, কেউ ঘার কাৎ করে চুমু খায় কেউ বা খায় মাথা সোজা রেখে। কিন্তু চুম্বন আছেই মানবসভ্যতার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে[৯৭]। তাই চুম্বনের বিবর্তনীয় উৎসটি আমাদের জানা চাই।
আর শুধু মানুষই নয়, অনেকে জেনে হয়তো অবাক হবেন, চুমুর অস্তিত্ব রয়েছে এমনকি অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেই[৯৮]। ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, পাখি থেকে শুরু করে শিম্পাঞ্জি, বনোবো সহ বহু প্রাণীর মধ্যেই চুম্বনের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে। এ সমস্ত প্রাণীদের কেউ বা চুমু খায় খাদ্য বিনিময় থেকে শুরু করে আদর সোহাগ বিনিময় এমনকি ঝগড়া-ফ্যাসাদ মেটাতেও। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী ফ্রান্স ডি ওয়াল তার প্রাইমেট সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছেন চুম্বনের ব্যাপারটা মানবসমাজেরই কেবল একচেটিয়া নয়, আমাদের অন্য সকল জ্ঞাতিভাই প্রাইমেটদের মধ্যেও তা প্রবলভাবেই দৃশ্যমান।
অবশ্য চুম্বন ব্যাপারটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে সার্বজনীন (কালচারাল ইউনিভার্সাল) কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু গবেষক দেখেছেন যে মানব সমাজের সব জায়গায় চুম্বনের প্রচলন নেই। ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার নাইরোপ তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন ফিনিশ একটি গোত্রে একসাথে নগ্ন হয়ে স্নান করার প্রচলন আছে, কিন্তু চুম্বনের নেই। অনেক জায়গায় চুম্বনকে একটি ঘৃণিত প্রথা বলেও মনে করা হয়। কিন্তু এই স্বল্প কয়েকটি সংস্কৃতি বাদ দিলে মানব সমাজের মোটামুটি সবাই চুম্বন ব্যাপারটার সাথে পরিচিত।
কেউ কি কবুতরের চুমু খাওয়া দেখেছেন? ওরা ঘরের চালে একেবারে উপরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট আংটার মতো করে আটকিয়ে দেয়। তারপরে বিশেষ ছন্দে উঠা নামা করে মিনিট খানেক। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে একে বলে “নালি ভাঙ্গা। তারা বলে, কবুতর “নালি ভাঙছে। বাচ্চা হবে”[৯৯]। কিসিং গোরামি (kissing gourami) নামে এক ধরনের মাছ আছে, যাদের মধ্যেও চুম্বন ব্যাপারটা বেশ প্রচলিত। যারা অ্যাকুরিয়ামে গোরামি মাছ পালেন, তারা প্রায়শই এদের চুম্বনলীলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
তবে কিসিং গোরামিদের চুম্বন আসলে ‘সত্যিকার চুম্বন নয়। এদের চুম্বন আসলে এক ধরনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের স্বরূপ, যার মাধ্যমে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে; আর সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা চুম্বন হিসেবে প্রতিভাত হয়। কুকুর, বিড়াল এবং পাখিদের মধ্যে মুখ দিয়ে অবলেহন (licking) এবং পরিচ্ছন্নতা (grooming) নির্দেশক অনেক কিছু করতে দেখা যায়, যা অনেক সময়ই অনেকের কাছে ভুলভাবে চুম্বন বলে মনে হতে পারে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মানুষের মধ্যে চুম্বনের ক্ষেত্র অনেকটাই ভিন্ন।
তাহলে মানবসমাজে চুম্বনের শুরুটা কোথায়, আর কীভাবে? বলা আসলেই মুশকিল। তবে, ১৯৬০ সালে ইংরেজ প্রাণিবিজ্ঞানী ডেসম মরিস প্রথম প্রস্তাব করেন যে, চুম্বন সম্ভবত উদ্ভূত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেট মায়েদের খাবার চিবানো আর সেই খাবার অপরিণত সন্তানকে খাওয়ানোর মাধ্যমে। শিম্পাঞ্জি মায়েরা এখনও এভাবে সন্তানদের খাওয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই এবং এ কারণেই তৈরি হয়েছিল। মনে করা হয় খাদ্যস্বল্পতার সময়গুলোতে যখন সন্তানকে খাবার যোগাতে পারত না, তখন অসহায় সন্তানকে প্রবোধ দিতে এভাবে মুখ দিয়ে খাবার খাওয়ানোর ভান করে সান্ত্বনা দিত স্নেহবৎসল মায়েরা। এভাবেই একটা সময় চুম্বন মানব বিবর্তনের একটি অংশ হয়ে উঠে, এর পরিধি বৃদ্ধি পায় সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রেমিক প্রেমিকার রোমান্টিকতায়, যার বহুবিধ অভিব্যক্তি আমরা লক্ষ্য করি মানবসমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আনাচে কানাচে, নানাভাবে।
তবে আজকের দিনের চিরচেনা তীব্র রোমান্টিক প্রেমের সাথে চুম্বনের জৈববৈজ্ঞানিক তথা বিবর্তনীয় উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের বের করতে হবে চুমু খাওয়ার এই মাধ্যমটি সম্পর্ক তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কোন ধরনের বাড়তি উপযোগিতা কখনো দিয়েছিল কি না, এবং এখনও দেয় কি না। এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। যেমন, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী গর্ডন জি গ্যালোপের (Gordon G. Gallup) গবেষণা থেকে জানা গেছে, চুম্বন মানবসমাজে মেটিং সিলেকশন বা যৌনসঙ্গী নির্বাচনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে[১০০]। বিশেষ করে প্রথম চুম্বন ব্যাপারটা রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ হিসেবে অনেকের জীবনেই উঠে আসে বলে মনে করা হয়। সাধারণত প্রথম প্রেম কিংবা প্রথম যৌনসঙ্গমের মতো প্রথম চুম্বনের ঘটনাও প্রায় সবাই হাজারো ঘটনার ভিড়ে মনের স্মৃতিকোঠায় সযত্নে জমিয়ে রাখে স্থায়ীভাবে। মহাকবি কায়কোবাদের একটা চমৎকার কবিতা আছে প্রথম চুম্বন নিয়ে–
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে
ফুলরানি বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?
প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালোবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে।
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
তবে কায়কোবাদ প্রথম প্রেমের মাহাত্ম নিয়ে যতই কাব্য করুক না কেন, প্রকৃত বাস্তবতা একটু অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাড ছাত্রদের উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেন, অন্তত ৫৯ ভাগ ছাত্র এবং প্রায় ৬৬ ভাগ ছাত্রীরা স্বীকার করেছে যে তাদের জীবনে প্রথম চুম্বন’-এর পর পরেই সঙ্গীর প্রতি আগ্রহ রাতারাতি উবে গেছে। এমন নয় যে সেই সব খারাপ চুমু আসলেই খুব খারাপ ছিল। কিন্তু প্রথমবার চুম্বনের পরেই তাদের সবারই মনে হয়েছিল কোথায় যেন মিলছে না–সামথিং ইজ নট রাইট! গর্ডন জি গ্যালোপের অভিমত এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য–
While many forces lead two people contact romantically, the kiss, particularly the first kiss, can be a deal breaker.
কিন্তু কেন এমন হয়? সেটাই ব্যাখ্যা করছেন বিজ্ঞানীরা। আমরা যে আগের অংশে ফেরোমোন এবং MHC জিনের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, দেহজ গন্ধের মাধ্যমে সেখানকার ভালোবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। ঠিক এমনটাই ঘটে চুম্বনের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ চুমুর মাধ্যমে সঙ্গীর বংশগতীয় কম্প্যাটিবিলিটির খোঁজ পায় মানব মস্তিষ্ক। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, সঠিক চুমু মানসিকভাবে সঠিক যৌনসঙ্গীকে খুঁজে নিতে সহায়তা করে। চুম্বনের পর যদি কায়কোবাদের মতো সেই “আহা শান্তি প্রস্রবণ” কিংবা “ভীষণ ঝটিকা তুলে, উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ’ আসে আপনার কাছে তাহলে বুঝতে হবে, আপনার মস্তিষ্ক ইঙ্গিত করছে আপনার সঙ্গী বংশগতীয় ভাবে আপনার জন্য সঠিক। আপনার জৈবিক দেহ আপনার সঙ্গীর দ্বারা নিরুপদ্রুপভাবে গর্ভধারণ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে! আর যদি চুম্বনের পর মনে হয় কোথায় যেন মিলছে না’ তাহলে বুঝতে হবে যে, আপনার সঙ্গীর MHC জিনের বিন্যাস আপনার জন্য কম্পিটেবল নয়।
তবে চুম্বনের রসায়নে নারী পুরুষে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধ্যাপক গ্যালোপ এবং তার সহকর্মীরা ১০৪১ জন কলেজ ছাত্র-ছাত্রীর উপর গবেষণা চালান। তাদের গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, তীব্র চুম্বন পুরুষদের জন্য আবির্ভূত হয় যৌনসম্পর্ক সূচিত করার পরবর্তী ধাপ হিসেবে। কিন্তু অন্য দিকে মেয়েরা চুম্বনকে গ্রহণ করে সম্পর্কের মানসিক উন্নয়নের একটি সুস্থিত পর্যায় হিসেবে।
গ্যালপের গবেষণায় আরও দেখা গেছে চুম্বনের ব্যাপারটা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। মেয়েদের কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, অধিকাংশ মেয়েরা চুম্বন ছাড়া এমনকি সঙ্গীর সাথে যৌনসম্ভোগে অস্বীকৃত হয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এতখানি প্রকট নয়। ছেলেদের কাছে একটা সময় পর চুমু খাওয়া না খাওয়া তেমন বড় হয়ে উঠে না– চুমুটুমু না খেয়ে হলেও কোনো আকর্ষণীয় মেয়ের সাথে যৌনসম্ভোগ করতে পারলে ছেলেদের জন্য তাতেই সই! সমীক্ষায় দেখা গেছে কেউ “গুড কিসার’ না হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের চেয়ে অধিক সংখ্যক ছেলেরা তার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়।
মেয়েদের জন্য চুম্বন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার পেছনে কিছু বিবর্তনীয় কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিবর্তনের পথিকৃত চার্লস ডারউইন যৌনতার নির্বাচন তত্ত্বনিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খেয়াল করেছিলেন যে, প্রকৃতিতে প্রায় সর্বত্রই মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে খুব বেশি হিসেবি, সাবধানী আর খুঁতখুঁতে হয়ে থাকে। এই ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানে পরিচিত ‘নারী অভিরুচি (female choice) হিসেবে। ডারউইনের সময়ে ডারউইন ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করলেও এই নারী অভিরুচির পেছনের কারণ সম্পর্কে তিনি কিংবা তার সমসাময়িক কেউ ভালোভাবে অবহিত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালের জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় এর পেছনের কারণটি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যেতে শুরু করে। বিশেষত বিখ্যাত সামাজিক জীববিজ্ঞানী রবার্ট ট্রাইভার্সের ১৯৭২ সালের গবেষণা এ ব্যাপারে একটি মাইলফলক[১০৩]। ট্রাইভার্স তার গবেষণায় দেখান যে, প্রকৃতিতে (বিশেষতঃ স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে) সন্তানের জন্ম এবং লালন পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি শক্তি বিনিয়োগ করে। গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম দেয়া, স্তন্যপান করানো সহ বহু কিছুতে মেয়েদেরকেই সার্বিকভাবে জড়িত হতে হয় বলে মেয়েদের তুলনামূলকভাবে অধিকতর বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। ভবিষ্যৎ জিন বা পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষায় মেয়েদের এই অতিরিক্ত বেশি শক্তি খরচের ব্যাপারটা স্তন্যপায়ী সকল জীবদের জন্যই কমবেশি প্রযোজ্য। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘অভিভাবকীয় বিনিয়োগ’ (parental investment)। মানুষও একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবার পরেও নির্দ্বিধায় বলা যায় মেয়েরাই অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকে। যেহেতু পুরুষদের তুলনায় নারীদের অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকতে হয়, তারা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে হয়ে উঠে অধিকতর হিসেবি এবং সাবধানী। বিবর্তনীয় পথপরিক্রমায় মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকতর সাবধানী হতে বাধ্য হয়েছে, কারণ অসতর্কভাবে দুষ্ট-সঙ্গী নির্বাচন করলে অযাচিত গর্ভধারণ সংক্রান্ত ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় নারীকেই। ডেভিড বাস তার ‘Human Mating Strategies শীর্ষক গবেষণাপত্রে সেজন্যই লিখেছেন[১০৪]—
বিবর্তনীয় যাত্রাপথে যে সকল মেয়েরা হিসেবি কিংবা সাবধানী ছিল না, তারা খুব কমই প্রজননগত সফলতা (reproductive success) অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু যারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শয্যাসঙ্গী নির্বাচন করতে পেরেছে, যেমন যৌনসঙ্গী নির্বাচনের সময় গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেছে তার সঙ্গী সঙ্গমের পরই পালিয়ে না গিয়ে তার সাথেই থাকবে কিনা, বাবা হিসেবে তার ভবিষ্যৎ সন্তানের দেখভাল করবে কিনা, সন্তান এবং পরিবারের পরিচর্যায় বাড়তি বিনিয়োগ করবে কি না ইত্যাদি–সে সমস্ত সতর্ক মেয়েরাই সফলভাবে প্রজননগত উপযোগিতা উপভোগ করতে পেরেছে। কাজেই ট্রাইভার্সের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবজগতে প্রজাতির প্রজননগত সাফল্য এবং সফলভাবে প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার মূলে রয়েছে সেই প্রজাতির নারীদের সতর্ক সঙ্গী নির্বাচনী অভিরুচি (careful mate choice)।
কাজেই যৌনসঙ্গীর ব্যাপারে নারীদের সতর্ক থাকতে হয়, কারণ ভুল সঙ্গীকে নির্বাচনের মাশুল হতে পারে ভয়াবহ। অন্তত একজন নারীর জন্য চুম্বন হয়ে উঠে সঙ্গী বাছাইয়ের একটি অবচেতন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে তার সঙ্গী তার ভবিষ্যৎ সন্তানের অভিভাবকীয় বিনিয়োগে অবদান রাখবে কি না কিংবা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ (committed) কি না ইত্যাদি[১০৫]। আর আগেই বলা হয়েছে, চুমুর মাধ্যমে MHC জিনের মধ্যকার ভালোবাসার সংকেতগুলো পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। পুরুষের লালাগ্রন্থিতে যে সমস্ত যৌন হরমোনের উপস্থিতি থাকে, সেটার উপাত্তই চুমু বিশ্লেষণের জন্য বয়ে নিয়ে যায় মস্তিষ্কে।
চুম্বনের রসায়নে নারী পুরুষে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে মিল পাওয়া গেছে। চুম্বন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে নারী পুরুষ উভয়েরই। মনোবিজ্ঞানী উইন্ডি হিল এবং তার ছাত্রী কেরি উইলসনের গবেষণা থেকে জানা গেছে চুম্বনের পরে দেহের কর্টিসল (cortisol) হরমোন, যার পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়, তার স্তর লক্ষণীয়ভাবে কমে আসে। এর থেকে বোঝা যায় যে, রোমান্টিক চুম্বন আমাদের মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে সহায়তা করে।
কেন হীরার আংটি কিংবা সোনার গয়না হয়ে উঠে ভালোবাসার উপঢৌকন?
আমি যখন এই অংশটি বইয়ের জন্য লিখছিলাম তখন প্রিন্স উইলিয়াম এবং কেট সবে বিয়ে করেছেন। মিডিয়ার গরম খবর। এটি তখন। এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমার অবশ্য এই সব অথর্ব রাজা রানি আর তাদের সুপুত্র কিংবা কুপুত্রদের বিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না কখনই। কেবল বিনোদন হিসেবে মাঝে মধ্যে এ ধরনের খবরে চোখ বোলানোই সার হতো। কিন্তু সেসময় গত কয়েকদিন ধরে এইকেট উইলিয়ামের বিয়ে নিয়ে মিডিয়াযাশুরুকরেছিল তাতে আমি রীতিমতো হতভম্ব। সে সময় এই মিডিয়া কাঁপানো বিয়ের একদিন আগে আমেরিকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছেসময়কালের ভয়ঙ্করীপ্রলঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়। চারশ’র মতো লোক মারা গিয়েছিল। আলাবামার অবস্থা তো যাচ্ছেতাই, এমনকি আমি যে জর্জিয়াস্টেটেথাকি সেখানকার আশেপাশের বেশকিছুবাড়িঘড় ভেঙেছে, মানুষও মারা গেছে কম বেশি। অথচ সিএনএন-এর মতো সংবাদমাধ্যম সে সময় সেসব কিছু বাদ দিয়ে কেবল কেটআর উইলিয়ামের বিয়ের আয়োজন প্রচার করে চলছিল সারাদিন ধরে যেন পৃথিবীতে এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু! কেট কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন, কীরকম পোশাক পড়েছেন, বিয়ের পরে কীভাবে ব্যালকনিতে পরস্পরকে চুম্বন করলেন, আটটি স্তরের কত বড় আয়তনের কেক ছিল বিয়েতে, কীভাবে তারা জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন–এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ চলছে। অবশ্য মিডিয়ার আর কী দোষ। আমার মতো আদার ব্যাপারীর এই রাজকীয় বিয়ে নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও সাড়া বিশ্বের মানুষের আগ্রহের কমতি দেখছি না! ৫০০০ পুলিশ অফিসারসহ আর্মি নেভি আর এয়ারফোর্সের নিয়োগদান সহ কেবল নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই নাকি খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার। কাজেই পুরো বিয়ের আয়োজনের খরচ কত হতে পারে সহজেই অনুমেয়। নিঃসন্দেহে এই বিশাল খরচের বড় একটা অংশের ব্যয়ভার বহন করতে হয় সেই জনগণকেই। তাতেও যে কারো কোনো আপত্তি আছে তা মনে হচ্ছে না। খোদ বাকিংহাম প্যালেসের বাইরেই নাকি প্রায় ৫০০,০০০ মানুষ জমায়েত হয়েছিল বর-বধূকে একনজর দেখার জন্য। কাজেই এই অপব্যয়িতাকে সাদরে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিরাসক্ত হলে আপনিও আমার মতো বিবর্তনীয়ভাবে ‘মিসফিট’ বলে বিবেচিত হয়ে যাবেন!
তাই আমার মতো বিবর্তনীয়ভাবে মিসফিটহবার হাত থেকে বাঁচতে হলে দুচারটি কথা জেনে রাখতে পারেন। প্রিন্স উইলিয়াম তার হবু বধূ কেট মিডেলটনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আট বছর ধরে প্রেম করার পর ২০১০ সালের নভেম্বরের ১৬ তারিখ। প্রায় ৮ ক্যারট হীরার আংটিটি উইলিয়াম কেট কে সে সময় উপহার দিয়েছেন, সেটি একসময় তার মা প্রিন্স ডায়না পরতেন। কাজেই আংটিটি নিয়ে উইলিয়ামের আবেগ সহজেই অনুমেয়। তিনি সেটা মিডিয়ায় বলেছেনও–এটা আমার মায়ের বিয়ের অঙ্গুরি। কাজেই এটা আমার কাছে অবশ্যই বিশেষ কিছু। আমি চাই যে আমার মার স্মৃতি আমার বিয়ের সময় অক্ষুণ্ণ থাকুক। কাজেই এই আংটির পেছনে এত আবেগময় স্মৃতি জড়িত যে, কখনো যদি এই আংটি নিলামে উঠে, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাও এই আংটিটি কেনার জন্য দরদাম করতে ভয় পাবেন। এমনকি যদি শুধু হীরার মূল্যমান হিসেবেও বিচার করি, তাহলেও খোলাবাজারে এ ধরনের আংটি ২০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
কিন্তু কেন এত ব্যয়বহুল বিনিয়োগ? হয়তো ভাবছেন রাজারাজড়াদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। তারা যদি হীরার আংটি নিয়ে লালায়িত না হন, তো হবে কে? কিন্তু আপনি খুঁজলেই দেখতে পাবেন, সাধারণদের মধ্যেও হিরের আংটি নিয়ে বিহ্বলতা কম নয়।
আমার অফিসের এক বান্ধবী প্রায় ৩/৪ ক্যারেটের এক ডায়মন্ডের রিং পরে অফিসে আসে (যদিও ওটা সত্যিকারের হীরা কি না আমার কিছুটা সন্দেহ আছে)। হীরকখচিত আঙুল দুলিয়ে দুলিয়ে এমনভাবে কথা বলে যে, হীরার আংটিটার দিকে যে কারো নজর যেতে বাধ্য। আর সুযোগ পেলেই সে সবাইকে শুনিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে গল্প শোনায়—কোন সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কোন হীরক রাজার দেশ থেকে তার প্রেমিক এই বিশাল এই হীরার আংটি বানিয়ে নিয়ে এসেছিল, আর কত রোমান্টিকভাবে তাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল!
আমার অফিসের আরেক কলিগ গ্রাজুয়েশন করে নতুন চাকরি শুরু করেছে। কিন্তু বেচারা গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারছে না, কারণ গার্লফ্রেন্ডকে তুষ্ট করার মতো হীরের আংটি কেনার সামর্থ নাকি এখনও অর্জন করতে পারেনি। তার গার্লফ্রেন্ড নাকি এমনিতে খুব ভালো, কোনো কিছুই চায় না তার কাছে, কিন্তু একটি কথা নাকি সম্পর্কের প্রথমেই তাকে বলে দিয়েছে বাগদানের সময় যেনতেন হীরের আংটি হলে কিন্তু তার চলবে না। এমন আংটি দিয়ে তাকে প্রপোজ করতে হবে যেন সেটা সবাইকে দেখিয়ে বাহবা কুড়াতে পারে। বেচারা বয়ফ্রেন্ডটি এখন চোখ কান বুজে চাকরি করছে, টাকা জমাচ্ছে। ওভারটাইম করে টু-পাইস একটু বেশি কামানো যায় কি না–তার নানা ফন্দি ফিকির খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। হীরের আংটি দিয়ে প্রেমিকার মন তুষ্ট করতে হবে না!
পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও মেয়েদের মধ্যে গয়নাগাটি পছন্দ করার চল আছে। শুধু চল বললে ভুল হবে, বিয়ের সময় কতভরি সোনার গয়না দিয়ে বৌকে কেমনভাবে সাজানো হলো সেটা সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। একটা সুযোগ পেলে অনেক মেয়েই বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগাটি বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের দেখিয়ে কিংবা কোনো বিয়ে বাড়িতে বা বড় কোনো পার্টিতে গলা কিংবা কানে স্বর্ণালঙ্কারের ঝলক দেখিয়ে সবার মাঝে বাহবা কুড়াতে পছন্দ করে এগুলো আমরা হর-হামেশাই দেখি। কেন পাশ্চাত্যে হীরের আংটি কিংবা আমাদের দেশে সোনার গয়না মেয়েদের এত পছন্দের? এই প্রশ্নটা আমার বরাবরই মনে খচখচ করত। হীরার অঙ্গুরি সোনার গয়নার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই। ভাত, মাংস, পোলাও-কোরমা খেয়ে যেমন উদরপূর্তি করা যায়, বিলাসবহুল বাড়িতে থেকে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম-আয়েশ করা যায়, মার্সিডিস কিংবা রোলস রয়েসে বসে রাজার হালে ঘুরে বেড়ানো যায়, আই ফোনে যেমন সেকেন্ডে সেকেন্ডে কথা বলা যায়, আই প্যাডে যেমন রেস্তোরাঁয় বসে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে ব্রাউস করা যায় হীরা কিংবা সোনার সেরকম কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা কেউ কখনোই খুঁজে পায়নি। অথচ তারপরেও হীরা বা সোনার গয়নার জন্য সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে মেয়েরা। আর ছেলেরাও ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে রাজ-রাজ্য চষে হাজির করে প্রায়োগিকভাবে মূল্যহীন কিন্তু নারীর কাছে অমূল্য সেই সব রত্ন পাথর আর সোনা দানা। কিন্তু কেন?
উত্তরটা খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক পরে। ডারউইনের সেক্সয়াল সিলেকশন তথা যৌনতার নির্বাচনের মধ্যেই যে এই জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে ছিল সেটা কি আর আমি তখন জানতাম?
প্রাণিজগৎ থেকেই শুরু করি। যৌনতার নির্বাচনের বহুল প্রচলিত ময়ুরের পেখমের উদাহরণটি আবারো এখানে চলে আসবে। আমরা জানি, ময়ূরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলত নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে। কীভাবে? ১৯৭৫ সালে ইসরাইলি জীববিজ্ঞানী অ্যামোজ জাহাভি (Amtoz Zahavi) প্রস্তাব করলেন যে, ময়ূরীর এই দীর্ঘ পেখম ময়ূরের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরনের ফিটনেস ইন্ডিকেটর’ বা সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি হিসেবে। জাহাবির মতে, সতোর সাথে সুস্বাস্থ্যের বিজ্ঞাপন দিতে গেলে এমন একটা কিছুর মাধ্যমে সেটা প্রকাশ করতে হবে যাতে খরচের প্রাচুর্যটা এমনকি সাদা চোখেও ধরা পড়ে। সোজা ভাষায় সেই বিজ্ঞপ্তি অঙ্গটিকে নিঃসন্দেহে হতে হবে ‘কস্টলি অর্নামেন্ট। ঠিক এজন্যই যৌনতার অলংকারগুলো প্রায় সবসময়ই হয় বেঢপ আকারে বিবর্ধিত, ব্যয়বহুল, অপব্যয়ী কিংবা জবরজং ধরনের জটিল কিছু।
ময়ূরের পেখম কেবল ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সস্তা প্রচারণা নয়। ময়ূরের পেখম দীর্ঘ, ভারী আর ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। দীর্ঘ পেখম এত অনায়াসে তৈরি করা যায় না, আর এমনকি এই বেয়াক্কেল পেখমের কারণে তার শিকারিদের চোখে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক। বেচারা ময়ূরকে কেবল নিজের দেহটিকেই বয়ে বেড়াতে হয় না, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াতে হয় তার পশ্চাৎদেশের সাথে জুড়ে থাকা এই অবিশ্বাস্য বড় ধরনের বাড়তি একটা পেখমের ঝাঁপি (জাহাভির মতে এই বিলাসিতা এমনই দৃষ্টিকটু যে এটা প্রায় পঙ্গুত্বের সামিল, তার তত্ত্বের নামই এজন্য Handicap principle)। এজন্য ময়ুরকে হতে হয় স্বাস্থ্যবান এবং নীরোগ। কখনোসখনো কোনো স্বাস্থ্যহীন ময়ুরের দীর্ঘ পেখম গজাতে পারে বটে, কিন্তু সেটা বয়ে নিয়ে বেড়িয়ে খাবার খোঁজা, কিংবা শিকারিরা তাড়া করলে দ্রুত দোঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের পক্ষে দুঃসাধ্যই হবে। কেবল মাত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ময়ূরের পক্ষেই এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এ ধরনের পেখমের বিলাসিতা ধারণ করা সম্ভব হয়।
তাই পেখমওয়ালা বিলাসী ময়ূর ময়ূরীর পালের কাছে গিয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করতে পারে—
এই যে মহীয়সী ময়ূরী, আমার ন্যাজের দিকে তাকাও; দেখো-আমি সুস্থ, আমি সুন্দর! আমি এমনই স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী যে, আমি আমার ষাট ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পেখম বয়ে বেড়াতে পারি অবলীলায়। আমি আমার খাদ্য আর দৈহিক পুষ্টিকে সাইফন করে আমার পেখমের আকার-আকৃতিকে তোমারই জন্য বর্ণাঢ্য করে রেখেছি। কোন শিকারি আমাকে পেছনে থেকে আক্রমণ করে পরাস্ত করতে পারে না। ভারী লেজ থাকা সত্ত্বেও আমি উসেইন বোল্টের মতো এক দৌড়ে শিকারিকে পেছনে ফেলে দিতে পারি, আমার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্দান্ত, আমার দেহ কোনো রোগ জীবাণুর আবাসস্থল নয়। তুমি দেখলেই বুঝবে–উজ্জ্বল পেখম আর অন্য সব কিছুমিলিয়ে আমার সঞ্চিত সম্পদ অঢেল ধন সম্পদ আর প্রাচুর্যে আমি ভরপুর। আমাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচণকরলে তুমি সুখে থাকবে হেনারী…”।
তাই ময়ূরীকে আকর্ষণের জন্য স্বভাবগতভাবেই ময়ূরকে বিলাসী হতে হয়। আমরা যতই অপচয়কারীকে ‘শয়তানের ভাই’ বলে গালমন্দ করি না কেন, অপচয় এবং ব্যয়বাহুল্য জৈবজগতে যৌনসম্পর্ক গঠনের (sexual courtship) এক অত্যাবশকীয় নিয়ামক। একটা পুরুষ কোকিলকে তার অতিরিক্ত বিশ ভাগ শক্তি ব্যয় করতে নিজের গলাকে সুরেলা করে তুলতে। কারণ এই সুরেলা গলাই তার আকর্ষণের হাতিয়ার। ঠিক একই কারণে হরিণের শিংকে হতে হয় বর্ণাঢ্য, তার প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি। তার মানে, যৌনতার নির্বাচনেরমাধ্যমেপ্রজাতির বিবর্তন হতে গেলেঅপচয়প্রবণতার প্রকাশ হতে হবে একরকম অবশ্যম্ভাবী। এটা যে কেউই বুঝবে যে, একটাময়ূর তার পেখমনা থাকলে বরং আরও ভালোভাবে চলে ফিরে বেড়াতে পারত। তার এই বেঢপ পেখমের পেছনে এত শক্তি অপচয় না করে খেয়ে দেয়ে আমোদ-ফুর্তি করে বেড়াতে পারত। পেখমের পিছনে শক্তি খরচ না করে শক্তি সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করতে পারত। কিন্তু যৌনতার নির্বাচনী চাপ তাদের মানসজগতে অবিরতভাবে কাজ করে যায় বলেই, সে পেখম গঠনের ব্যাপারে নির্লিপ্তভাবে অপব্যয়ী হয়ে ওঠে; উঠতে তাকে হবেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রকৃতিতে দৃষ্টিকটু রকমের অপব্যয়িতাই হচ্ছে সততার সাথে নিজের সম্পদকে অন্যের সামনে তুলে ধরার একমাত্র সহজ মাধ্যম।
বিজ্ঞানীরা বলেন, বিবর্তনের যাত্রাপথে নারী অভিরুচির ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। নারী অভিরুচির কারণেই পুরুষ ময়ূরের পেখম দীর্ঘ হয়েছে। পুরুষ কোকিলের গলা সুরেলা হয়েছে। পুরুষ বাবুই পাখি শিখেছে মনোরম বাসা বানাতে। নীচে একটি টেবিলের সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করা হলো, কীভাবে নারী অভিরুচিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতিতে ব্যয়বহুল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা নানা অপব্যয়ী বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটেছে—
মানবসমাজেও কি আমরা এরকমের অপব্যয়িতার হাজারো প্রমাণ পাই না? যাদের বেশি টাকা পয়সা আছে, তারা দামি অট্টালিকা বানায়, বনেদি এলাকায় থাকে, রোলস রয়েস কিংবা পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়, সৌখিন এবং দামি ডিজাইনার ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক কিংবা জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। বৈষয়িক দিক থেকে চিন্তা করলে এগুলোর কোনোটারই কিন্তু দরকার ছিল না। বরং দামি গাড়ি কিংবা পোশাক-আশাকের পেছনে নিয়মিত অর্থ ব্যয় না করে টাকাগুলো ব্যাংকে তুলে রাখলে অপব্যয়িতার হাত থেকে মুক্ত থাকা যেত, পয়সা কড়িও একটু বেশি জমতো। কিন্তু তাই কি হয়? কোনো পয়সাওয়ালাই কেবল সুইস ব্যাংকে তার সব টাকা পয়সা তুলে রেখে ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়জামা আর ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায় না। বরং উলটো নিজের অর্জিত সম্পদের সংকেতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরতে চায় আর রাজপ্রাসাদোপম বাড়ি কিংবা দামি গাড়ি, জুতো জামাকেন্দ্রিক অপব্যয়িতা গুলোই হচ্ছে তাদের জন্য সর্বসাধারণের কাছে সম্পদ প্রকাশের ‘ফিটনেস মার্কার’!
নিজের সম্পদকে তথা ব্যয়বহুল অলংকারগুলোকে সতোর সাথে প্রকাশ করে। নিজের ‘ফিটনেস’কে বিজ্ঞাপিতকরতে চায় সকলেই। সম্পদ বলতে কেবলশুধু বাড়ি গাড়ি, টাকা-পয়সা, জুতো-জামার কথাই আমি বোঝাচ্ছি না, সেই সাথে আমাদের বিজ্ঞাপিত সম্পদের তালিকায় চলে আসবে শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান, সাহস, দৈহিক শক্তি, সংগীতপ্রতিভা বাকচাতুর্য, সুদর্শন চেহারা, কৃষ্টি, নৃত্যপটুতা, প্রগতিশীলতা, অধিকার সচেতনতা, উদ্ভাবনীশক্তি, দৈহিক সৌন্দর্য, সততা, নৈতিকতা, দয়াপরবশতা, রসিকতা, হাস্যরসপ্রিয়তাসহঅনেক কিছুই। কারণ দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে মানুষ শিখেছে যে এই দৃষ্টিনন্দন গুণাবলিগুলোর প্রতিটিইবিপরীতলিঙ্গের কাছেহয়ে উঠে আকর্ষণের বস্তু, আর সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরেই সেগুলো মানবসমাজেবিকশিত হয়েছে বিপরীত লিঙ্গের বিভিন্ন চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে। কিন্তু তার পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি এর কোনোটিই বিয়ের সময় হীরার আংটির মতো গুরুত্বপূর্ণ “ভালোবাসারউপঢৌকন হিসেবে উঠে আসেনা। কিন্তু কেন?
হীরার আংটি দিয়ে প্রস্তাব না করে আপনি আপনার প্রেমিকাকে বাজার থেকে একটা আইদাহ আলু কিনে কিংবা সিলেটি কমলালেবু নিয়ে এসে প্রস্তাব করতে পারতেন। যত হাস্যকরই শোনাক না কেন, আলু কিংবা কমলালেবুর ব্যবহারিক উপযোগিতা কিন্তু হীরা কিংবা সোনাদানার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষুধার সময় আলু খেয়ে কিংবা মনের আনন্দে কমলা চিবিয়ে আপনি খিদে দূর করতে পারেন। কিন্তু হীরার আংটি দিয়ে সেসব কিছুই আপনি করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও বাগদানের রোমান্টিক সময়ে হীরার বদলে আলু নিয়ে হাজির হলে, আপনার কপালে কী দুর্গতি হবে সেটা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে! আলু পটল তো কোনো ছার, এমনকি দামি গাড়ি-বাড়ি, কম্পিউটার, আইফোন কোনোকিছু দিয়েই আপনি বিয়ের সম্পর্ক তৈরি করতে পারবেন না, যদিও এগুলোর সবগুলোরই কিছু না কিছু। ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে। রহস্যটি হলো, জাহাভির হ্যাঁন্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল অনুযায়ী, বিয়ের প্রস্তাবের (প্রাণিজগতে অবশ্য যৌনসম্পর্কের) উপহার এমন হতে হবে যার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা হতে পারে ময়ূরের পেখমের অপকারী), কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের চোখে তা হতে হবে অমূল্য। জৈববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘কোর্টশিপ গিফট’ (courtship gift) বা ‘নাপশাল গিফট (nuptial gift)[১০৭,১০৮]। গাড়ি-বাড়ি, আইদাহ আলু কিংবা আইফোন সবকিছুরই ব্যবহারিক কিছু না কিছু উপযোগিতা আছে পুরুষের কাছে। তাই সেগুলো কখনোই ‘কোর্টশিপ গিফট’ হয়ে উঠার যোগ্য নয়। কোর্টশিপ গিফট হতে পারে কেবল হীরা কিংবা স্বর্ণালঙ্কারের মতো অপদ্রব্য গুলোই, যেগুলোর কোনোই ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই পুরুষের কাছে, অথচ নারীর মানসপটে সেটি অমূল্য এক ‘ফিটনেস মার্কার’[১০৯]।
গবেষক পিটার সজু এবং রবার্ট সেইমোর ২০০৫ সালের ‘Costly but worthless gifts facilitate courtship’ নামের একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘কোর্টশিপ গিফট’-ই কার্যকরী যা হবে দৃষ্টিকটুভাবে অপব্যয়ী এবং ব্যবহারিকভাবে মূল্যহীন[১১০]। মানবসমাজের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে সেজন্যই হীরার আংটি কিংবা স্বর্ণালঙ্কার খুব চমৎকার একটি কোর্টশিপ গিফট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একটি কারণ, এর কোনো ব্যবহারিক মূল্য পুরুষের কাছে নেই। কোনো পুরুষই হীরা কিংবা সোনার জন্য লালায়িত থাকে না। হীরা বা সোনা দোকানে নিয়ে বেচে দেয়া ছাড়া একজন পুরুষ কিছুই করতে পারে না। সেটা নিয়ে সে বাঁচতে পারে না, সেটা খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে না, পারে না আমোদিত হতে। কেবল একটি কাজই সে হীরা দিয়ে করতে পারে নারীকে উপহার দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, আর ভালোবাসার সম্পর্কের সূচনা করতে হতে পারে সেই সম্পর্ক স্বল্পমেয়াদি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি। শোনা যায়, কেউ কেউ নাকি স্বল্পমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে হীরার অলংকারের উপর নির্ভর করতেন। চলচ্চিত্রের নায়িকা, গায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল থেকে শুরু করে খবর পাঠিকাসহ শোবিজের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সুন্দরী ললনাদের শয্যাসঙ্গী করার অভিপ্রায়ে তাদের পৃথিবীর আধুনিক নামিদামি কোম্পানির জুয়েলারি পাঠাতেন। তাদের স্বল্পমেয়াদি সম্পর্ক বা শর্ট-টার্ম স্ট্র্যাটিজির জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ করতেন দেখা গেছে, সে ধরনের বিনিয়োগ একই রকম কার্যকরী লং-টার্ম স্ট্র্যাটিজির ক্ষেত্রেও। সেজন্যই বাংলাদেশের বিয়েতে সোনাদানা কিংবা পাশ্চাত্যে হীরার আংটি বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনায় এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
এখানে ‘ফিটনেস মার্কার’ বলতে কেবল শারিরিক ফিটনেসকে বোঝানো হচ্ছে না। এখানে বলা রাখা ভাল, সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌনতার নির্বাচন এক এক প্রজাতিতে একেক রকম ভাবে কাজ করে। যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে ময়ূরের বিবর্ধিত পেখম গজিয়েছে, কোকিলের তো তা হয়নি। কিন্তু কোকিলের সুরেলো গলা তৈরি হয়েছে। বাবুই পাখির ক্ষেত্রে সুরেলো গলা বা পেখম কোনটিই তৈরি হয়নি। বাবুই পাখির ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত বাসা বানানোর ক্ষমতা। গাপ্পি মাছের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল গায়ের রং। এগুলো সবই ‘কস্টলি আরনামেন্ট’ বা ব্যয়বহুল অলঙ্কার।
মানুষের ক্ষেত্রে সেক্সুয়াল সিলেকশনের অপদ্রব্যগুলো শরীরে নয়, সংস্কৃতিতে নিহিত। সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান মানুষের মেটিং স্ট্র্যাটিজিতে ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা দীক্ষা, সুস্বাস্থ্য, ধন সম্পদ সহ অনেক কিছুই এখানে অরনামেন্ট। হীরার আংটি বা সোনাদানা কোন পুরুষের ‘শরীরের ফিটনেস ইনডিকেটর’ বা সুস্বাস্থ্যের প্রমাণ হয়তো নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে পর্যাপ্ত ধন সম্পদের প্রমাণ। এজন্যই ধনী শিল্পপতিরা (অনেক সময় নিজেরা কুৎসিত হওয়া সত্ত্বেও) সহজেই সুন্দরী ও আকাঙ্ক্ষিত নারীকে ঘরে তুলতে পারেন। সবার পক্ষে সম্ভব হয় না পৃথিবী কাঁপানো কাঙ্ক্ষিত নারী যেমন- কেট উইন্সলেট, রানী মুখার্জি, ঐশ্বরিয়া রায়কে ডেট করার। ধন সম্পদ, স্ট্যাটাস এগুলো অবশ্যই বড় ধরণের ইনডিকেটর। সেগুলোই বিভিন্ন ভাবে মানুষের মেটিং স্ট্র্যাটিজি রচনায় কাজ করে। এর পাশাপাশি আছে নিরাপত্তার ব্যাপার। মানুষের মেটিং স্ট্র্যাটিজিতে সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরগুলোর অন্যতম হচ্ছে নিজ এবং সন্তান সন্ততির নিরাপত্তা। স্বাধীন পরিবেশে একজন নারী সেই পুরুষকেই তার প্রকৃত সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় যে এই সার্বিক নিরাপত্তাটুকু দিতে পারে। এটি প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। যে লোকের ৯ ক্যরটের হীরার আংটি নারীকে কিনে দেয়ার ক্ষমতা আছে, তিনি আর যাই হোক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন না এবং ক্ষমতা, জৌলুষ এবং প্রভাবের মাধ্যমে নিরাপত্তার গ্যারান্টি তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরও দিতে পারবেন বলে সাধারণ ভাবে ধরে নেয়া হয়।
মেরেলিন মনরোর কথা আমরা সবাই জানি। পঞ্চাশ ষাটের দশকের সুদর্শনা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি, এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন বহু পুরুষের হার্টথ্রব। অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গাইতেন মনোরো। মনোরোর গাওয়া চমৎকার গান আছে ‘Diamonds are a Girl’s Best Friend’ নামে। মেরোলিন। মনোরো গানটি গেয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে ‘Gentlemen Prefer Blondes’ নামের একটি ছবির জন্য। গানের কথাগুলো এরকমের–
The French were bred to die for love
They delight in fighting duels
But I prefer a man who lives
And gives expensive jewels
A kiss on the hand may be quite continental
But diamonds are a girl’s best friend
A kiss may be grand but it won’t pay the rental
On your humble flat, or help you at the automat
Men grow cold as girls grow old
And we all lose our charms in the end
But square cut or pear shaped
These rocks don’t lose their shape
Diamonds are a girl’s best friend…
আরেকটা বিখ্যাত গান আছে ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ নামে। গানটি ১৯৭১ সালের শন কনরি অভিনিত জেমস বন্ডের একটি সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল। গায়িকা ছিলেন শার্লি ব্যাসি, পঞ্চাশের দশকের আরেকজন জনপ্রিয় শিল্পী (এবং আমার এখনও প্রিয় গায়িকা)। গানের কথাগুলো এরকমের–
Diamonds are forever,
They are all I need to please me,
They can stimulate and tease me,
They won’t leave in the night,
I’ve no fear that they might desert me.
Diamonds are forever,
Hold one up and then caress it,
Touch it, stroke it and undress it,
I can see every part,
Nothing hides in the heart to hurt me.
I don’t need love,
For what good will love do me?
Diamonds never lie to me,
For when love’s gone,
They’ll luster on….
আমাদের দেশ সহ ভারতবর্ষে হীরার মতো সোনাকেও ভালোবাসার খুব মূল্যবান উপঢৌকন হিসেবে ধরা হয়, এবং সেটাও একই কারণে।
সোনা দানার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা পুরুষদের কাছে নেই, কিন্তু নারীর কাছে তা অমূল্য। কেন ভারতবর্ষের নারীরা স্বর্ণালঙ্কার ভালোবাসে? এর ব্যাখ্যা হিসেবে জনপ্রিয় rediff.com একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে[১১৩]—
স্বর্ণালঙ্কার নারীর জন্য কেবল কেবল শক্তিশালী আবেগই তৈরি করে না, পাশাপাশি নারীর অবয়বকে সার্বিক পূর্ণতা দেয়। নারী স্বর্ণালঙ্কার পরে নিজেকে মনে করে লাস্যময়ী, সুন্দরী,সফল, আত্মপ্রত্যয়ী, এবং যৌনাবেদনময়ী।
রোমান কবি অভিড প্রায় একহাজার বছর আগে তার একটি লেখায় বলে গিয়েছিলেন–
নারীরা কবিতা ভালোবাসে। কিন্তু তার জন্য মূল্যবান কিছু উপহার দাও। … Gold buys honor; gold procures love
অভিডের মৃত্যুর পর সহস্র বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও আমরা সেই স্বর্ণযুগেই পড়ে রয়েছি!
আছে ভালোবাসা, আছে ঈর্ষা
সুরঞ্জনা ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার
দূর থেকে দূরে–আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে?–তার সাথে!…
‘আকাশলীনা’ নামের কবিতায় ঈর্ষাপরায়ণ চরিত্রের এক অসাধারণ চিত্রায়ণ করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ,যে কবিতায় ঈর্ষাকাতর প্রেমিক অন্য যুবকের সাথে সুরঞ্জনার কথা বলা নিয়ে চিন্তিত, ঈর্ষান্বিত। হ্যাঁ-প্রেম যেমন আছে, তেমনি আছে ঈর্ষাপরায়ণতা। প্রেমের মতোঈর্ষাপরায়ণতার ব্যাপারটাও বোধ হয় মানুষের মজ্জাগত। একতরফাভাবে প্রেম কখনোই কোথাওই হয় না, প্রেমে ছলনা আছে, আছে প্রতারণা। আর ছলনা বা প্রতারণা থাকলে থাকবেঈর্ষা, থাকবে ঘৃণা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে জিঘাংসাও। শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন ছলনা,বিশ্বাসঘাতকতা,ঈর্ষা বা জিঘাংসার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্মও হয়েছে প্রেমের মতোই একই বিবর্তনীয় যাত্রাপথে। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের এগুলো নিয়েও সঙ্গত কারণেই গবেষণা করতে হয়। ডেভিড বাস তাঁর বই ভয়ঙ্কর আবেগ : প্রেম এবং যৌনতার মধ্যে ঈর্ষাও জড়িত থাকে কেন? নামের বইয়ে দেখিয়েছেন, কেউ প্রেমে প্রতারণা করলে আমরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠি। ঈর্ষা আসলে একটি সারভাইভাল স্ট্র্যাটিজি–বেঁচে থাকার এক সুচতুর পরিকল্পনা। আসলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই ভালোবাসার মতো ঈর্ষার বীজও মানুষের মনে তৈরি হয়েছে, এর পরিস্ফুটন ঘটেছে। আমাদের বর্তমান মানসিকতার মধ্যে ঈর্ষার বীজ দেখে বোঝা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ঈর্ষা যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। যাদের মধ্যে ঈর্ষা ছিল না তাঁরা প্রজননগতভাবে সফল ছিল না, তারা কোনো উত্তরসূরী রেখে যান নি[১১৪]। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের সবাইকে ঈর্ষাপরায়ণ হিসেবে বড় হতে হবে, আর কাউকে দেখলেই ঈর্ষান্বিত হতে হবে। ঈর্ষার ব্যাপারটা বহুলাংশেই সময়। এবং পরিস্থিতি নির্ভর। বিবর্তনের কৌশল সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়, এছাড়া বিবর্তনের কৌশলজনিত যে কোনো মানবিক বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে পারিসাংখ্যিক সীমায় বিস্তৃত, কারও ক্ষেত্রে কম, কারও ক্ষেত্রে বেশি।
তবে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন ঈর্ষা এবং প্রতারণার রকমফের নারী পুরুষে ভিন্ন হয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অনুকল্প অনুযায়ী যৌনতা সংক্রান্ত হিংসা কিংবা ঈর্ষার ব্যাপারটি আসলে জৈবিকভাবে অনেকটাই পুরুষদের একচেটিয়া, যাকে বলে–’সেক্সুয়াল জেলাসি বা যৌন-ঈর্ষা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-কেবল পুরুষদেরই যৌন ঈর্ষা থাকবে কেন? কারণ হচ্ছে, সঙ্গমের পর গর্ভধারণ এবং বাচ্চা প্রসবের পুরো প্রক্রিয়াটা নারীরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে, পুরুষদের আর কোনো ভূমিকা থাকে। ফলে পুরুষরা নিজেদের পিতৃত্ব নিয়ে কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী–আধুনিক ‘ডিএনএ টেস্ট আসার আগ পর্যন্ত আসলে কোনো পুরুষের পক্ষে একশত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব ছিল না যে সেই তার সন্তানের পিতা। কিন্তু মাতৃত্বের ব্যাপারটা কিন্তু নয়। মাকে যেহেতু গর্ভধারণ করতে হয়, প্রত্যেক মাই জানে যে সেই তার সন্তানের মা। অর্থাৎ, পিতৃত্বের ব্যাপারটাশতভাগ নিশ্চিত না হলেও মাতৃত্বের ব্যাপারটা নিশ্চিত। এখন চিন্তা করে দেখি আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বনে জঙ্গলে ছিল অর্থাৎ শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে জীবন চালাতো, তখন কোনো সুনিয়ন্ত্রিত একগামী পরিবার ছিল না। ফলে পুরুষদের আরও সমস্যা হতো নিজেদের ‘পিতৃত্ব নিয়ে। পিতৃত্বের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, কারণ বিবর্তনের স্বার্থপর জিনের (selfish gene) ধারকেরা স্বার্থপরভাবেই চাইবে কেবল তার দেহেরই প্রতিলিপি তৈরি হোক। কিন্তু চাইলেই যে নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে তা তো নয়। সম্পর্কে প্রতারণা হয়। তার স্ত্রী যে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক তৈরি করে গর্ভধারণ করবে না, তা সে কীভাবে নিশ্চিত করবে? আদিম বন-জঙ্গলের কথা বাদ দেই, আধুনিক জীবনেও কিন্তু প্রতারণার ব্যাপারটা অজানা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় শতকরা প্রায় ১৩ থেকে ২০ ভাগ পুরুষ অন্যের সন্তানকে নিজ সন্তান’ ভেবে পরিবারে বড় করে। জার্মানিতে সেই সংখ্যা ৯ থেকে ১৭ ভাগ। সারা বিশ্বেই মোটামুটিভাবে নন-জেনেটিক সন্তানকে নিজ সন্তান হিসেবে বড় করার হার শতকরা ৯ থেকে ১৫ ভাগ বলে মনে করা হয়[১১৫]। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় অন্যের (অর্থাৎ নন- জেনেটিক) সন্তানকে নিজ সন্তান ভেবে বড় করার এই প্রতারণাকে বলা হয় কাকোন্ট্রি (cuckoldry), যার বাংলা আমরা করতে পারি—কোকিলাচরণ।
কাকোল্ড্রি বা কোকিলাচরণ শব্দটি এসেছে কোকিলের অন্য পাখির বাসায় ডিম পেড়ে অন্য পাখিদের সাথে প্রতারনা করার উপমা থেকে। কোকিলেরা এভাবে অন্য পাখির সাথে প্রতারণা করে ডিমে তা দেয় কিংবা সন্তান লালন পালনের হাত থেকে অব্যহতি পায়। মানুষের ক্ষেত্রে কোকিলাচরণের মাধ্যমে অন্য পুরুষের প্যণয়াসক্ত স্ত্রীটি স্বামীর নিজের সন্তান হিসেবে প্রতারিত করে সন্তান লালন পালনে প্রলুব্ধ করে।
এখন কথা হচ্ছে, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রভাবকী? প্রভাব হচ্ছে, কাকোল্ড্রি বা কোকিলাচরণ ঘটলে সেটা পুরুষের জন্য এক ধরনের অপচয়। কারণ সে ভুল ভাবে অন্যের জিনের প্রতিলিপি নিজের প্রতিলিপি হিসেবে পালন করে শক্তি বিনষ্ট করবে। এর ফলে নিজের জিন জনপুঞ্জে না ছড়িয়ে সুবিধা করে দেয় অন্যের জিন সঞ্চালনের, যেটা ‘সেলফিশ জিন’ পারতপক্ষে চাইবে না ঘটতে দিতে। ফলাফল? ফলাফল হচ্ছে, পুরুষেরা মূলত ‘সেক্সয়ালি জেলাস’ হিসেবে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বেড়ে উঠে। তারা নিশ্চিত করতে চায় যে, তার যৌনসঙ্গী বা স্ত্রী, কেবল তার সাথেই সম্পর্ক রাখুক, অন্য পুরুষের সম্পর্ক এড়িয়ে কেবল তার সাথেই চলুক। এইটা বজায় রাখতে পারলেই সে শতভাগনা হোক, অন্তত কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা পাবে যে, তার এই সম্পর্কের মধ্যে কোকিলাচরণ ঘটার সম্ভাবনা কম। এজন্যই ইসলামিক দেশগুলোতে কিংবা অনুরূপ ট্রেডিশনাল সমাজগুলোতে মেয়েদের হিজাব পরানো হয়, বোরখা পরানো হয়, কিংবা গৃহে অবরুদ্ধ রাখা হয়, কিংবা বাইরে কাজ করতে দেয়া হয় না– এগুলো আসলে প্রকারান্তরে পুরুষতান্ত্রিক ‘সেক্সুয়াল জেলাসি’রই বহিঃপ্রকাশ।
আসলে নারীকে অন্তরীণ করে, তাদের অধিকার এবং মেলামেশা সীমিত করার মাধ্যমে সে সব দেশে পুরুষেরা নিশ্চিত করতে চায় যে, কেবল তার জিনের প্রতিলিপিই তার স্ত্রীর শরীরে তৈরি হোক, অন্য কারো নয়। কারণ স্ত্রীর কোকিলাচরণ ঘটলে সেটা তার জন্য হয়ে উঠে সময় এবং অর্থের অপচয়’। পুরুষালি ঈর্ষার মূল উৎস এখানেই। ডেভিড বাস তার ‘Human Mating Strategies’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে সেজন্যই লিখেছেন[১১৮]—
যেহেতু মানব শুক্রাণু দিয়ে ডিম্বাণুর নিষেকের পুরো প্রক্রিয়াটিই নারীর দেহাভ্যন্তরে ঘটে, পুরুষের মধ্যে নিজের সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। অপর পক্ষে মাতৃত্ব নিয়ে একটি নারীর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, এখানে নিশ্চয়তা শতভাগ, তা সেটা যে শুক্রাণু দিয়েই নিষিক্ত হোক না কেন! কাজেই যৌনতার ক্ষেত্রে অবিশ্বস্ততা কেবল একটি পুরুষের (জেনেটিক) পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করতে পারে, নারীর মাতৃত্ব থেকে নয়।… এ সকল কারণে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, যৌনতার অবিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে কোনো আলামত পাওয়া গেলে নারীদের চেয়ে পুরুষেরাই অধিকতর বেশি মনক্ষুণ্ণ হবে।
চিত্র। পেজ ১১১
চিত্র: অধ্যাপক ডেভিড বাস সহ অন্যান্য গবেষকেরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন পুরুষেরা নারীদের চেয়ে অনেক বেশি ‘সেক্সুয়াল জেলাসি’তে ভোগে। যৌনতার অবিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে কোনো আলামত পাওয়া গেলে নারীদের চেয়ে পুরুষেরাই অধিকতর বেশি মনক্ষুণ্ণ হয়।
পুরুষেরা বেশি মনক্ষুণ্ণ হবে কারণ, বিবর্তনীয় পরিভাষায় প্রতারিত পুরুষের সঙ্গী গর্ভধারণ করলে তাকে অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে অন্যের সন্তানের পেছনে অভিভাবকত্বীয় বিনিয়োগ করতে হবে, যার মুল্যমান জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বলে মনে করা হয়। মূলত তার অভিভাবকত্বের পুরোটুকুই বিনিয়োগ করতে হবে এমন সন্তানের পেছনে যার মধ্যে নিজের কোনো বংশাণুর ধারা বহমান নেই। স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা এক ধরনের অপচয়ই বটে। নিজের পিতৃত্বের ব্যাপারে সংশয়ী থাকতে হওয়ায় বিবর্তনীয় যাত্রাপথে পুরুষের মানসপট যৌনতার ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে গড়ে উঠেছে, কিন্তু নারীরা মাতৃত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকায়, তা হয়নি[১১৯]।
অবশ্য স্বার্থপরভাবে নিজের জেনেটিক ধারা তার সঙ্গীর মাধ্যমে যেন বাহিত হয়, তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়। যেমন, পুরুষ ভেলিড মাকড়শা (veliidae water spider) তার সঙ্গীকে কজা করার পর কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত শুয়ে থাকে, যাতে সঙ্গম করুক আর নাই করুক, অন্তত অন্য পুরুষ মাকড়শা যেন তার সঙ্গীর দখল নিতে চেষ্টা না পারে। Plecia nearcticas নামের এক ধরনের পতঙ্গের (জনপ্রিয়ভাবে ‘লাভ বাগ’ হিসেবে পরিচিত) নিষেকের ক্ষেত্রেও পুরুষ পতঙ্গটি বেশ কয়েকদিন ধরে স্ত্রী পতঙ্গটিকে জড়িয়ে ধরে রাখে, যাতে অন্য কোনো পতঙ্গ এসে এর নিষেক ঘটাতে না পারে। আবার, এক ধরনের ফলের মাছি আছে যাদের শুক্ররসের মধ্যে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা স্ত্রী-যোনিতে গিয়ে পূর্বাপর সকল শুক্রাণুকে ধ্বংস করে দেয়, এবং প্রকারান্তরে নিশ্চিত করতে চায় যে, কেবল তার শুক্রাণু দিয়েই নিষেক ঘটুক[১২০]। কিছু মথ এবং প্রজাপতির ক্ষেত্রে শুক্ররসের মধ্যে বিদ্যমান কিছু রাসায়নিক পদার্থ ‘সঙ্গম রোধনী’ (copulatory plug) হিসেবে কাজ করে। এর ফলে যোনির মধ্যে শুক্রাণু ঢুকে ডিম্বাণুর প্রবেশপথে অনেকটা আঁঠার মতো আটকে থাকে যেন পরে অন্য কোনো কোনো পুরুষের শুক্রাণু সেঁধিয়ে গিয়ে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারতে না পারে। তবে সবচেয়ে চরম উদাহরণ আমি পেয়েছি Johannseniella nitida নামের এক ধরনের মাছির ক্ষেত্রে, সঙ্গম শেষে যাদের পুরুষের লিঙ্গ ভেঙে ভিতরে রয়ে যায়। এ যেন অনেকটা সঙ্গমান্তে নারীর যোনি ছিপি দিয়ে আটকে দেয়া যেন অন্য প্রতিযোগীরা এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে না পারে। যদিও কীট পতঙ্গের সাথে মানুষের পার্থক্য উল্লেখ করার মতোই বিশাল, কিন্তু তারপরেও সঙ্গীকে নিজের অধিকারে রাখার ব্যাপারে স্ট্র্যাটিজিগতভাবে মিল লক্ষণীয়[১২১]। দুর্ভাগ্যবশত অন্য পতঙ্গের মতো মানুষের শুক্রাণুতে সঙ্গমরোধনী আঁঠাও নেই, কিংবা পুরুষাঙ্গ ভেঙে যোনিতেও থেকে যায় না, তবে বিভিন্ন সমাজে পর্দা, বোরখা আর হিজাবের বেপরোয়া প্রয়োগ দেখা যায় বৈকি। এগুলো তো এক ধরনের ছিপিই বলা চলে, কারণ এর মাধ্যমে পুরুষেরা নিশ্চিত করতে চায় যে, এ নারী অন্যের কামুক দৃষ্টি এড়িয়ে কেবল তারই অধিকারভুক্ত হয়ে থাকুক।
পুরুষদের ঈর্ষার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মেয়েদেরটা? মেয়েদেরও ঈর্ষাহয়, প্রবলভাবেই হয়–তবে, বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত হলো–সেটাঠিক ‘সেক্সুয়াল জেলাসি’ নয়। মেয়েরা বিবর্তনীয় পটভূমিকায় একজন পুরুষকে রিসোর্স বা সম্পদ হিসেবে দেখে এসেছে। কাজেই একজন পুরুষ একজন দেহপসারিণীর সাথে যৌনসম্পর্ক করলে মেয়েরা যত না ঈর্ষান্বিত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় তার স্বামী বা পার্টনার কারো সাথে রোমান্টিক কিংবা ‘ইমোশনাল’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে। ডেভিড বাস, ওয়েসেন এবং লারসেনের নানা গবেষণায় এর সত্যতা মিলেছে[১২২]। এখানে আমি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার উল্লেখ করব। প্রাথমিক একটি গবেষণার সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালের একটি গবেষণাপত্রে[১২৩]। ২০ জন পুরুষ এবং ২০ জন নারীকে নিয়ে পরিচালিত সেই গবেষণায় ঈর্ষাপরায়ণ হওয়ার বিভিন্ন উপলক্ষ্য থেকে যে কোনো একটি বেছে নিতে বলা হয়। অপশনগুলোর মধ্যে তার সঙ্গীর অন্য কারো সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন থেকে শুরু করে সঙ্গীর সময় এবং সম্পদ অন্য কারো জন্য বরাদ্দ করার মতো সব পথই খোলা ছিল। দেখা গেল বিশ জন নারীর মধ্যে সতের জনই সেই অপশন বাছাই করেছে যেখানে তার সঙ্গী অন্য কারো জন্য নিজের সময় এবং সম্পদ ব্যয় করছে। কিন্তু অন্য দিকে বিশ জন পুরুষ সদস্যদের মধ্যে ষোল জনই অভিমত দিয়েছে তার সঙ্গী অন্য কারো সাথে যৌনসম্পর্ক গড়ে তুললে সেটা তাকে সবচেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ করে তুলবে। এধরনের আরেকটি গবেষণা সত্তুরের দশকে চালানো হয়েছিল পনেরোটি দম্পতির মধ্যে[১২৪]। সে গবেষণা থেকেও একইভাবে উঠে এসেছিল যে, পুরুষেরাঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেযদি তার সঙ্গীর সাথে কোনো তৃতীয়পক্ষের যৌনসম্পর্কের কোনো আলামত পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, তারা বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠে যদি তার সঙ্গী অন্য কোনো মেয়ের সাথে আবেগী কিছু করলে যেমন টাংকি মারা, রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানো, চুমু খাওয়া, এমনকি এগুলো কিছু না করে তার সঙ্গী পুরুষটি অন্য নারীর সাথে কেবল দীর্ঘক্ষণ ধরে কথাবার্তা বললেও সে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। এ গবেষণাগুলো থেকে বোঝা যায়, ছেলেরা তার সঙ্গী কার সাথে কতটুকু কথা বলল না বলল তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকেনা, যতটা থাকে সঙ্গীর যৌনতার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে। কিন্তু অন্যদিকে মেয়েদেরটা একটু ভিন্ন। তাদের সঙ্গী অন্য কোনো মেয়ের জন্য কতটুকু সময় এবং সম্পদ ব্যয় করল, তা তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলে।
এ ব্যাপারে বড়সড় গবেষণা করেছেন অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বাস। ৫১১ জন কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে চালানো এ গবেষণায় তাদের কল্পনা করতে বলা হয় যে, তার সঙ্গী কারো সাথে যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়েছে কিংবা কারো সাথে মানসিক আবেগময় এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি করেছে। কোন ব্যাপারটা তাকে বেশিঈর্ষাকাতর করে তুলবে? প্রায় ৮৩ শতাংশ নারী মনেকরেছে তার সঙ্গী তাকে না জানিয়ে অন্য কোনো মেয়ের সাথে আবেগময় সম্পর্ক গড়ে তুললে সেটা তাকে ঈর্ষাপরায়ণ করে তুলবে, কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র শতকরা ৪০ ভাগ। অন্যদিকে শতকরা ৬০ ভাগ ছেলে মত দিয়েছে তার সঙ্গী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুললে সেটা তাকে চরম ঈর্ষাকাতর করে ফেলবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া গেছে মাত্র ১৭ ভাগ[১২৫]। বাসের এই ফলাফল কেবল আমেরিকার গবেষণা থেকে পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে কোরিয়া, জাপান, চীন, সুইডেনসহ অনেকে দেশেই একই ফলাফল পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে[১২৬]। একই ধরনের ফলাফলের দাবি এসেছে হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, সোভিয়েত রাশিয়া এবং যুগোস্লাভিয়াতে চালানো সমীক্ষা থেকেও[১২৭]। তাই বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন নারী-পুরুষে এই ঈর্ষাগত পার্থক্য সমগ্র মানবজাতির মধ্যেই পারিসাংখ্যিক পরিসীমায় বিস্তৃত। ধারণা করা হয় বিবর্তনের দীর্ঘদিনের যাত্রাপথে নিজের সঙ্গীকে ধরে রাখার অভিপ্রায়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবেঈর্ষা প্রদর্শন করে প্রজননগত সফলতা পেয়েছিল, তার বিবিধ ছাপই দেখা যায় আজকের নারী-পুরুষদের মানসপটে। বলাবাহুল্য, নারী এবং পুরুষেরা ভিন্নভাবে সঙ্গী নিজেদের আয়ত্বে রাখার কৌশল করায়ত্ব করেছিল, সেই পার্থক্যসূচক অভিব্যক্তিগুলোই স্পষ্ট হয় নারী পুরুষের ঈর্ষাকেন্দ্রিক মনোভাব ঠিকমতো বিশ্লেষণ করলে।
তবে সবাই যে অধ্যাপক বাসের এ উপসংহারগুলোর সাথে একমত পোষণ করেছেন তা নয়। যেমন করেননি নর্দার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ডেভিড বুলার। তিনি তার বই ‘অভিযোজনরত মনন’ (Adapting Minds) বইয়ে[১২৮] এবং বেশ কিছু প্রবন্ধে অধ্যাপক বাসের ঈর্ষা সংক্রান্ত গবেষণাগুলোর পদ্ধতিগত সমালোচনা হাজির করেছেন[১২৯]। পুরুষেরা কেবল সঙ্গীর যৌনতার ক্ষেত্রে অবিশ্বস্ততার সন্ধান পেলেই কেবল ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেন, অন্য কিছুতে তেমন নয় বলে বাস যে অভিমত দিয়েছেন, তা সঠিক নয় বলে বুলার মনে করেন। আমরা জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা কবিতায় যুবককে দেখেছি সুরঞ্জনা এক অচেনা যুবকের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন নয়, কেবল কথা বলাতেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। এ ধরনের অনেক পুরুষই আমাদের চারপাশে আছে। আবার যৌনতার ব্যাপারেও উদার পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। যেমন, অধ্যাপক বাসের গবেষণা থেকেই উঠে এসেছে যে, জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডের মতো দেশে যেখানে যৌনতার ব্যাপারগুলো অনেক শিথিল, সেখানে পুরুষেরা সঙ্গীর যৌনতার ব্যাপারে অনেক কম ঈর্ষাপরায়ণ থাকেন। কোরিয়া এবং চীনের মানুষদের উপর গবেষণা করেও দেখা গেছে সেখানকার পুরুষেরা সঙ্গীর যৌনতার ক্ষেত্রে অবিশ্বস্ততার আলামত পেলে অন্য অনেক দেশের পুরুষদের মতো খুব বেশি মনক্ষুণ্ণ হন না। আবার নারীদের ক্ষেত্রেও তারা কেবল সঙ্গীর রোমান্টিক কিংবা ‘ইমোশনাল’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়, সঙ্গীর রোমান্সবিহীন যৌন সম্পর্ককে নয় বলে ঢালাওভাবে উপসংহার টানা হয়েছে সেটাও কতটুকু নিশ্চিত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা কিছুদিন আগেই দেখেছি ক্যালিফোর্নিয়ার ভূতপূর্ব গভর্নর এবং খ্যাতিমান অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্সনেগার এবং তার স্ত্রী মারিয়া শ্রাইভারের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যেতে। আর্নল্ড শোয়ার্সনেগার বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে তার বাসার গৃহপরিচারিকার সাথে যৌনসম্পর্ক রেখেছিলেন। এমন নয় যে, শোয়ার্সনেগার পরিচারিকার সাথে কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। যৌনতার ক্ষেত্রে অবিশ্বস্ততার আলামত পাওয়াতেই মারিয়া শ্রাইভার শোয়ার্সনেগারকে ছেড়ে চলে গেছেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরা সঙ্গীর যৌন-অবিশ্বস্ততাকে খুব গুরুত্ব দিয়েই গ্রহণ করে, অধিকাংশ পুরুষের মতোই। তাই অধ্যাপক বুলারের মতে বিবর্তন পুরুষ নারীতে ঈর্ষার কোনো ‘আলাদা মেকানিজম’ তৈরি করেনি, বরং নারী পুরুষ উভয়ই ঈর্ষাকেন্দ্রিক একই মেকানিজমের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, কেবল এর পরিস্ফুটন পরিস্থিতিভেদে ভিন্ন হয়।
ঈর্ষার পরিণাম
এখন কথা হচ্ছে ঈর্ষার পরিণাম কীরকম হতে পারে? ছোটখাটো সন্দেহ, ঝগড়াঝাটি, দাম্পত্য কলহ, ডিভোর্স থেকে শুরু করে গায়ে হাত তোলা, মারধোর থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত গড়াতে পারে, তা সবাই মোটামুটি জানেন। যেহেতু অধিকাংশ বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ‘সেক্সুয়াল জেলাসি’ জৈবিক কারণে পুরুষদেরই বেশি, তারাই পরকীয়া কিংবা কোকিলাচরণের কোনো আলামত সঙ্গীর মধ্যে পেলে গড়পড়তা বেশি সহিংস আচরণ করে।
সঙ্গী ‘অযাচিত’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে এই সন্দেহ একজন ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষের মনে দানা বাঁধলে তিনি কী করবেন? অনেক কিছুই করতে পারেন। হয়তো স্ত্রী বা সঙ্গী একা বাড়ি থেকে বেরুলে গোপনে তার পিছু নেবেন, হয়তো অফিসে গিয়ে হঠাৎ করেই ফোন করে বসবেন জানতে তার স্ত্রী বা সঙ্গী এখন ঠিক কী করছেন, খোঁজ-খবর নেবেন মার্কেটে যাওয়ার কথা বলে স্ত্রী আসলেই মার্কেটে গিয়েছে নাকি ঢুকে গিয়েছে তার গোপন প্রেমিকের ঘরে। তিনি চোখে চোখে রাখবেন তার সঙ্গী কোনো পার্টিতে, বিয়ে বাড়িতে কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলে কী করেন, কোথায় কার সাথে আড্ডা মারেন। সঙ্গীর অবর্তমানে গোপনে তার ইমেইল পড়বেন, কিংবা সেলফোনের টেক্সটে নজর বুলাবেন, ইত্যাদি। এই আচরণগুলোর সমন্বিত একটি নাম আছে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অভিধানে ভিজিলেন্স (vigilance); এর বাংলা আমরা করতে প্রি ‘শকুনাচরণ’। শকুন যেমন উপর থেকে নজর রাখে তার শিকারের প্রতি, ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষের আচরণও হয়ে দাঁড়ায় তার সঙ্গীর প্রতি অনেকটা সেরকমের।
ভিজিলেন্সের পরবর্তী কিংবা ভিন্ন একটি ধাপ হতে পারে ভায়োলেন্স (violence) বা সহিংসতা। সহিংসতার প্রকোপ অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হয়। কখনো সঙ্গীর গায়ে হাত তোলা, কখনো বা সন্দেহের তালিকাভুক্ত গোপন প্রেমিককে খুঁজে বের করে করে থ্রেট করা, বাড়ি আক্রমণ করা, বেনামে ফোনে হুমকি-ধমকি দেয়া, কিংবা নিজে গিয়ে কিংবা গুন্ডা লেলিয়ে পিটানো, প্রকাশ্যে হত্যা, গুম, খুন ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় আইনে ভিজিলেন্স বা শকুনাচরণ অপরাধ না হলেও ভায়োলেন্স বা সহিংসতা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু অপরাধ হলেও এটা কিন্তু অনেক পুরুষেরই মনোসঞ্জাত স্ট্র্যাটিজি, যা তারা সুযোগ পেলেই ব্যবহার করেছে ইতিহাসের যাত্রাপথে সে কথা কারো অজানা নয়।
এ ক্ষেত্রে ১৯৮০ সালের দিকে পত্রপত্রিকায় সাড়া জাগানো ক্যানাডিয়ান মডেল এবং অভিনেত্রী ডরোথি স্ট্র্যাটেন হত্যার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অনিন্দ্য সুন্দরী ডরোথি স্ট্র্যাটেন তখন কানাডার সেন্টিনিয়াল হাইস্কুলে পড়ছিলেন, আর বাড়ির পাশে ‘ডেইরি কুইন’ নামের ফাস্ট ফুড রেস্তরাঁয় কাজ করতেন। রেস্তরাঁয় কাজ করতে গিয়েই পল স্নাইডার নামে এক লোকের সাথে পরিচয় হয় তার। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ভাবের আদানপ্রদান–পরিচয় থেকে পরিণয়। ডরোথি স্ট্র্যাটেনের বয়স তখন ১৭। আর স্নাইডারের ২৬। পরিচয়ের পর থেকেই স্নাইডার ডরোথিকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে, ডরোথির একটি চমৎকার সুন্দর মুখশ্রী আর আকর্ষণীয় দেহবল্লরী আছে, যা মডেল হবার জন্য একেবারে নিখুঁত। ডরোথি প্রথমে রাজি না হলেও স্নাইডারের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে কিছু ছবি তুলেন। স্নাইডারই তোলেন সে ছবিগুলো তার নিজস্ব ক্যামেরায়। তারপর তা পাঠিয়ে দেন হিউ হেফনারের কাছে। হিউ হেফনার প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা। স্নাইডার হেফনারের কাছ থেকে উত্তর পেলেন দুই দিনের মধ্যেই।
এরপরের সময়গুলো ডরোথি স্ট্র্যাটেনের জন্য খুবই পয়মন্ত। তিনি হিউ হেফনারের বিখ্যাত ‘প্লেবয় প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন স্নাইডারকে সাথে নিয়ে। শুরু হলো ডরোথির প্লেবয় মিশন। তিনি ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হলেন প্লেবয়। ম্যাগাজিনের ‘মাসের সেরা প্লে মেট’ হিসেবে। ১৯৮০ সালে তিনি হন বর্ষসেরা। প্লেবয়ের পাঠককূল যেন আক্ষরিক অর্থেই ডরোথির পরিষ্কার চামড়া এবং প্রতিসাম্যময় দেহ, লাস্যময় কিন্তু নিষ্পাপ মুখশ্রী, আর নির্মল চাহনি দিয়ে আবিষ্ট ছিল সেসময়। রাতারাতি ডরোথি বনে গেলেন তারকা। আর অন্যদিকে স্নাইডারের অবস্থা রইলো আগের মতোই চাকরিবাকরিবিহীন, হতাশাগ্রস্ত। হেফনারের কাছেও স্নাইডার তেমন কোন সহনীয় কিছু ছিল না। একদিন প্লেবয় প্রাসাদ থেকে স্নাইডারকে তাড়িয়েই দেয়া হলো। প্রাসাদরক্ষীকে বলে দেয়া হলো যে, তিনি যেন স্নাইডারকে বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখেন।
এদিকে ডরোথিকে নিয়ে শুরু হলো হেফনারের ম্যালা পরিকল্পনা। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো হলিউডের নায়ক, নায়িকা আর খ্যাতিমান পরিচালকদের সাথে। এদের মধ্যে ছিলেন হলিউডের উঠতি পরিচালক পিটার বোগদানোভিচ। পিটার তখন ইতোমধ্যেই ‘পেপার মুন’ (১৯৭৩) আর ‘দ্য লাস্ট পিকচার শো’ (১৯৭১)’র মতো জনপ্রিয় ছবি তৈরি করে ফেলেছেন। তিনি ডরোথিকে দেখেই তার ভবিষ্যৎ ছবির নায়িকা হিসেবে মনোনীত করে ফেললেন। ডরোথির জন্য এ যেন আকাশের চাঁদ পাওয়া। অবশ্য বর্ষসেরা প্লেবয় হিসেবে মনোনয়নের কারণে ইতোমধ্যেই ডরোথি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন মহলে। তিনি অভিনয় শুরু করেছেন বাক রজার্স এবং ফ্যান্টাসি আইল্যান্ডের মতো টিভি সিরিয়ালে।
ডরোথির দিনকাল ভালোই চলছিল। পিটার বোগদাননাভিচের ‘দে অল লাফড’ ছবিতে অভিনয় শুরু করেছেন। এটিই তার প্রথম ছবি। অন্যদিকে তার সঙ্গী পল স্নাইডার চাকরিবাকরিবিহীন। গ্ল্যামারাস ডরোথির পাশে চলচিত্র জগতে অচ্ছুৎ স্নাইডার ‘নিতান্তই বেমানান’ হয়ে উঠছেন ক্রমশ। কিন্তু তিনি তখনো ডরোথিকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ডরোথিও প্রথমে না করেন নি, কারণ আফটার অল– পল স্নাইডারের কারণেই প্লেবয়ের মাধ্যমে তার খ্যাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ডরোথি স্নাইডারকে বিয়ে করতে রাজি হলেন বটে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অনিবার্যভাবে প্রেমে পড়ে গেলেন পিটার বোগদানোভিচের। স্নাইডারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন ডরোথি। তার সাথে বিচ্ছেদের চিন্তা শুরু করেছেন তিনি।
বেপরোয়া পল স্নাইডার শেষবারের মতো ডরোথির সাথে দেখা করতে চাইলেন। যদিও ডরোথির বন্ধুবান্ধব তাকে স্নাইডারের সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ডরোথি ভাবলেন—হোয়াট দ্য হেক, এই একবারই তো। তিনি ভাবলেন যে মানুষটার সাথে এতদিনের একটা সম্পর্ক ছিল, যার কারণে তিনি এই খ্যাতির সিঁড়িতে তার সাথে দেখা করে কিছুটা কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করলে ক্ষতি কী!
সেই ভাবাই তার কাল হলো। ১৯৮০ সালের ১৪ই অগাস্ট ডরোথি স্নাইডারের সাথে দেখা করলেন। সাথে তার হ্যান্ডব্যাগে নিলেন এক হাজার ডলার। ভাবলেন এ টাকাগুলো স্নাইডারের হাতে তুলে দিলে স্নাইডারের রাগ ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমবে, আর তা ছাড়া চাকরিবাকরিবিহীন স্নাইডারের টাকার দরকার নিঃসন্দেহে। কিন্তু স্নাইডারের মাথায় ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। তিনি তার শটগান ডরোথির মাথায় তাক করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করলেন। হত্যা করলেন ডরোথিকে। পুলিশ পরে বাসায় এসে রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া ডরোথির নিথর দেহ আবিষ্কার করলেন। যে নির্মল চাহনি আর নিষ্পাপ মুখশ্রী এতোদিন আবিষ্ট করে রেখেছিল ডরোথির ভক্তদের, হাজার হাজার ম্যাগাজিনের কভার পেজে যে মুখের ছবি এতোদিন ধরে আগ্রহভরে প্রকাশ করেছেন পত্রিকার প্রকাশকেরা, সেই মুখ বিধ্বস্ত। রক্তস্নাত বিকৃত মুখ, ফেটে যাওয়া মাথার খুলি আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়া মগজের মাঝে পড়ে থাকা নগ্ন দেহ ডরোথির। দেহে নির্যাতন আর ধর্ষণের ছাপও ছিল খুব স্পষ্ট।
স্নাইডারের ঈর্ষাপরায়ণতার মর্মান্তিক বলি হলেন ডরোথি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস মৃত্যুর কিছুদিন আগের এক সাক্ষাৎকারে ডরোথি তার সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ঈর্ষাপরায়ণতা! মাত্র বিশ বছর বয়সেই পৃথিবীর সমস্ত রূপ রস ভালোবাসা ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি জমাতে হলো ডরোথিকে। স্নাইডার নিজেও আত্মহত্যা করেন ডরোথিকে হত্যার পর পরই। ব্যাপারটিকে সাদা চোখে জিঘাংসার জের বলে মনে হলেও সেটি আরেকটু গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ডরোথি ছিলেন সুন্দরী, কিন্তু নিজের সৌন্দর্য নিয়ে তিনি তেমন সচেতন হয়তো ছিলেন না যখন তিনি ডেইরি কুইন রেস্তরাঁয় পার্ট টাইম কাজ করতেন। প্লেবয় ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা প্লে মেট নির্বাচিত হবার পরই তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি পরিণত হয়েছেন বহু শিক্ষা দীক্ষা গুণমান সমৃদ্ধ রথী মহারথী পুরুষের হার্টথ্রবে। অর্থাৎ খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাজারে ডরোথির ‘মেটিং ভ্যালু’ বেড়ে গিয়েছিল অনেকগুণ। আর অন্যদিকে স্নাইডার ছিলেন চালচুলোহীন, চাকরিবাকরিবিহীন বেকার যুবক। তিনি অর্থবিত্তে বলীয়ান সামাজিক প্রতিপত্তিশালী হেফনার কিংবা পিটার বোগদানোভিচদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারবেন কেন? তার মেটিং ভ্যালু ছিল পড়তির দিকে। প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার, অর্থাৎ এতদিনের সুন্দরী সঙ্গী ‘হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই ঈর্ষান্বিত করে তুলেছিল স্নাইডারকে। ভিজিলেন্স থেকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ভায়োলেন্সের পথ। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিবর্তনীয় যাত্রাপথে নারীরা পুরুষ সঙ্গীদের এক ধরনের ‘সম্পদ’-এর যোগান হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে[১৩০]। অর্থবিত্ত, ভালো চাকরি, সামাজিক পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি পুরুষদের জন্য খুব বড় ধরনের মেটিং ভ্যালু। কাজেই চাকরি হারানো কিংবা চাকরি না থাকার মানে সম্পদের যোগান বন্ধ। মেয়েরা সঙ্গী নির্বাচনের সময় চাকরিদার এবং সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিওয়ালা ছেলেদের পছন্দ করে। এগুলো না থাকলে মেটিং ভ্যালু কমে আসবে। স্নাইডারের ক্ষেত্রে ঠিক এটিই ঘটেছিল। ব্যাপারটাকে সামাজিক স্টেরিওটাইপিং বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পুরুষদের জন্য চাকরিবাকরি না করে বেকার বসে থাকাটা কোনো অপশনই নয় বিয়ের বাজারে কিংবা এমনিতেই সামাজিকভাবে, কিন্তু বহু সমাজেই মেয়েদের জন্য তা নয়। আমার ব্যক্তিগত জীবনের উদাহরণ টানি এ প্রসঙ্গে। স্বভাবে আমরা দুজনেই ঘরকুনো হলেও চাপে পড়ে আমাকে আর বন্যাকে মাঝেমধ্যেই কোনো দেশি পার্টিতে যেতে হয় এই আটলান্টায়। অনেক সময়ই নতুন কারো সাথে দেখা হয়, পরিচয়ের এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়–”ভাই আপনি কোথায় চাকরি করেন?’ বন্যার ক্ষেত্রে ঠিক তা হয় না। তার দিকে প্রশ্ন আসে ‘আপা/ভাবী, আপনি বাসায় থাকেন নাকি চাকরি করছেন?’ এ থেকে বোঝা যায় নারীদের ক্ষেত্রে চাকরি না করাটা একটা অপশন মনে হলেও ‘ভালো স্বামীর ক্ষেত্রে তা হয় না কখনোই, তা তিনি যতই শখের বসে বইপত্তর লিখুন কিংবা ব্লগ করুন! সেজন্যই চাকরি না থাকলে একজন নারী যতটা না পীড়িত হয়, একজন পুরুষকে তার বেকার জীবন পীড়িত করে ঢের বেশি। তারা হয়ে উঠে হতাশাগ্রস্ত এবং সর্বোপরি এই ভঙ্গুর সময়টাতেই তারা সঙ্গী হারানোর ভয়ে হয়ে উঠে চিন্তিত এবং ঈর্ষান্বিত। জীববিজ্ঞানী রবিন বেকার এবং মার্ক বেলিস ইংল্যান্ডে চালানো তাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, একজন বিবাহিত নারী যখন অন্য কোনো পুরুষের সাথে পরকীয়ায় জড়ায়, সেই পুরুষের চাকরির স্ট্যাটাস, প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি তার বর্তমান স্বামীর চেয়ে সাধারণত বেশি থাকে[১৩১]। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, শতকরা ৬৪ ভাগ ক্ষেত্রে একজন পুরুষ তার সঙ্গীকে হত্যা করে যখন সে থাকে চাকরিবাকরিবিহীন একজন বেকার ভ্যাগাবন্ড[১৩২]।
এ ব্যাপারাটি সঙ্গী নির্বাচনের মেটিং স্ট্র্যাটিজির সাথে জড়িত। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের সমীক্ষায় দেখা গেছে সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা সঙ্গীর দয়া, সততা, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতির গুণাবলীর পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুন্য এবং সৌন্দর্য। অন্যদিকে মেয়েরাও গড়পড়তা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর স্ট্যাটাস। এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে পরবর্তী অধ্যায়ে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং মিডিয়া ছিল আলোচনার তুঙ্গে। ঘটনাটি হলো ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর দেশে থাকাকালীন সময়ে তার স্বামী হাসান সাঈদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। আঁচড়ে কামড়ে নাক ঠোঁট গালের মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। চোখে আঙুল ঢুকিয়ে তার চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। রুমানাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বাংলাদেশ এবং ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েও লাভ হয়নি, রুমানার দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেছে।
হাসান সাঈদের এই ‘পশুসুলভ আচরণে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সবাই। কী ভীষণ কুৎসিত মন মানসিকতা থাকলে শুধু সঙ্গীনীকে কেবল মারধোর নয়, রীতিমত নাক কান গাল কামড়ে ছিঁড়ে নেওয়া যায়, আঙুল ঢুকিয়ে চোখ উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যায়। পত্রপত্রিকা, ফেসবুক আর ব্লগে চলছিল আলোচনা, প্রতিবাদের ঝড়। কেউ দুষছেন পুরুষতন্ত্রকে, কেউ বা ধর্মকে, কেউ বা আবার দোষারোপ করছেন দেশের আইন-কানুনকে। আবার কিছু মহল থেকে তাকে পাগল প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও হয়েছে।
না হাসান সাঈদ পাগলছাগল কিছুই নন, বরং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তিনি নারীর কাছে মেটিং ভ্যালু কমে যাওয়া একজন হীনম্মন্য ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষ যার শকুনাচরণ ক্রমশ রূপ নিয়েছিল নিষ্ঠুর পুরুষালি সহিংসতায়। সাঈদ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, সে বুয়েটের পড়ালেখা সে শেষ করতে পারেনি, ইটের ভাটি সিএনজি-সহ বিভিন্ন ব্যবসায় হয়েছে ব্যর্থ। সম্প্রতি শেয়ারেও খেয়েছে লোকসান। অন্যদিকে রুমানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সফল শিক্ষিকা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের শেষ পর্যায়ে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে রুমানার মেটিং ভ্যালুর পারদ সাঈদের চেয়ে অনেক উধ্বগামী। সত্য হোক মিথ্যে হোক সাথে যোগ হয়েছিল ইরানি যুবক তাহের বিন নাভিদ কেন্দ্রিক কিছু ‘রসালো’ উপাখ্যান। সঙ্গী হারানোর ভয়ে ভীত এবং ঈর্ষান্বিত সাঈদ ঝগড়া বিবাদ কলহের স্তর পার হয়ে তার দেহ করে ফেলেছে ক্ষতবিক্ষত। মুক্তমনায় লীনা রহমান রুমানা মঞ্জুর ও নরকদর্শন’ শীর্ষক একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন।33। লেখাটিতে সামাজিক বিভিন্ন অসঙ্গতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় বিধিনিষেধ যেগুলো নারীকে অবদমনের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো নিয়েও প্রাণবন্ত আলোচনা ছিল। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। বস্তুত লীনার লেখাটির সাথে সামগ্রিকভাবে একমত হয়েও লেখাটির মন্তব্যে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম–
রুমানার উপর অত্যাচারের পেছনে ধর্মের ব্যাপারটা কতটুকু জড়িত তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। ধর্মের কারণে যে অত্যাচার হয় না তা নয়, অনেকই হয়, তবে রুমানার ক্ষেত্রে ধর্মের চেয়েও প্রবলতর ব্যাপারটি হচ্ছে পুরুষালি জিঘাংসা। নারী যখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠে,শিক্ষা দীক্ষা, সংস্কৃতি এবং আর্থিক দিক দিয়ে তার সঙ্গীকে ছাড়িয়ে যায়, বহু পুরুষই তা মেনে নিতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় রুমানার সফলতা সাঈদের ক্ষেত্রে তৈরি করেছে এক ধরনের হীনম্মন্যতা,ঈর্ষা আর জিঘাংসা। তারই শিকার রুমানা।
আমার বিশ্লেষণ যে ভুল ছিল না, তা দেখা গিয়েছে জনকণ্ঠে (১৮ই জুন ২০১১) প্রকাশিত প্রাথমিক রিপোর্টে। রিমান্ডের প্রথম দিনেই সাঈদ স্বীকারোক্তি দিয়েছিল– ‘নিজ হীনম্মন্যতা থেকেই রুমানার চোখ উপড়ে ফেলতে চেয়েছি’।
রুমানা এপিসোডের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই আলোচনায় আসবে। পুলিশের হাতে দশ দিন পর্যন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা এই তথাকথিত স্বামী রত্নটি রুমানার চরিত্র হননে নেমেছিল। ফাঁদা হয়েছিল মিথ্যে প্রেমিকের সাথে এক রসালো গল্প। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাগুলো এগুলো রসালো চাটনির মতোই পরিবেশন করেছে। রাতারাতি কিছু মানুষের সমর্থনও কুড়াতে সক্ষম হলেন সাঈদ। অনেকেই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে শুরু করলেন ‘এক হাতে তালি বাজে না। নিশ্চয়ই কোনো গড়বড় ছিল। পরে অবশ্য সাঈদ নিজেই স্বীকার করেছিল যে, রুমানার পরকীয়ার গল্পগুলো বানানো, মিথ্যা। আমরা আগেও দেখেছি এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরুষদের একটাই অস্ত্র থাকে নির্যাতিত মেয়েটিকে যে কোনো ভাবে খারাপ মেয়ে ‘ হিসেবে প্রতিপন্ন করা। সেই যে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করেছিল পুলিশেরা। এর পরদিন পুলিশেরা যুক্তির জাল বুনে বলেছিল ইয়াসমিন বেশ্যা, খারাপ মেয়ে। যেন খারাপ মেয়ে প্রমাণ করতে পারলে খুন ধর্ষণ, চোখ খুবলে নেওয়া সব জায়েজ হয়ে যায়! আসলে সত্য কথা হলো সাঈদ বুঝতে পেরেছিল খারাপ মেয়ে প্রমাণ করতে পারলে ‘পুরুষতন্ত্রকে সহজেই হাতে রাখা যায়। ওটাই ছিল সাঈদের তখনকার ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটিজি’। সেজন্যই আমরা দেখলাম যে, রুমানাকে নিয়ে আগে বলা পরকীয়ার ব্যাপারগুলো সাঈদ নিজ মুখে অস্বীকার করার আগ পর্যন্ত বেশ কিছু মানুষের সহানুভূতি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন সাঈদ। বাজারি পত্রিকা পড়ে তৈরি হওয়া জনমতের একটি বড়ো অংশ সাঈদ দোষ স্বীকারের আগ পর্যন্ত ক্রমাগত সন্দেহের তীর হেনেছে রুমানা মঞ্জুরের দিকে। শুধু পুরুষেরা নয়, এমনকি অনেক নারীও রুমানার প্রতি সন্দেহের ‘অনেক আলামত’ পেয়ে গিয়েছিলেন। এ থেকে কিন্তু বোঝা যায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা কেবল পুরুষদেরই আচ্ছন্ন করেনি, দীর্ঘদিনের কালিক পরিক্রমায় এটি অসংখ্য নারীর মানসপটেও রাজত্ব করেছে এবং এখনও করছে।
হ্যাঁ পুরুষতন্ত্রকে কষে গালি দেয়া সহজ, কিন্তু কেন পুরুষতন্ত্রের মানসপট এভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা তেমন সহজ নয়। সহজ নয় এটি বিশ্লেষণে আনা যে পরকীয়া শুনলেই কেন জনচেতনার সহানুভূতিতে আঘাত লেগে যায়, সবাই মরিয়া হয়ে উঠে তার বিপরীতটা প্রমাণ করতে। রুমানার কলঙ্কের কাউন্টার হিসেবে রুমানা কত নিষ্কলঙ্ক আর সতী-সাধ্বী মেয়ে সেটা প্রমাণ করতে আবার কিছু পত্রিকা ফলাও করে প্রচার করতে শুরু করল রুমানা কত মৃদুভাষী ছিলেন, তিনি দিনে পাঁচবেলা নামাজ পড়তেন, মাথায় কাপড় দিয়ে কানাডার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করতেন, সেখানে প্রতিবেশীদের সাথে কত মিষ্টি ব্যবহার তিনি করতেন, কত ভালো রান্না করে তাদের খাওয়াতেন, বিদেশ বিভূঁইয়ে কত ভালোভাবে ইসলামি মতাদর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করতেন, অন্য ছেলেদের সাথে তেমন মিশতেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষেই কানাডা থেকে স্বামী সন্তানকে ফোন করার জন্য ছুটে আসতেন, বাইরে একদমই বেরুতেন না ইত্যাদি। এ সবকিছুই আসলে সেই চিরচেনা মানসপটকে তুলে ধরে—নারীকে গড়ে উঠতে হবে পুরুষদের বানানো ছকে—কথাবার্তায় হবে মৃদুভাষী,চলনে-বলনে শান্ত-সৌম, মাথায় কাপড় টেনে চলতে হবে, স্বামীহীনম্মন্যকিংবা নপুংসক যাই হোক না কেন, তাকে নিয়েই থাকতে হবে, তার প্রতি থাকতে হবে সদা অনুগত। অনেকটা বাংলা সিনেমার এই গানটার মতো—
আমি তোমার বন্ধু, তুমি আমার স্বামী
খোদার পরে তোমার আসন বড় বলে জানি …
পরকীয়া তো দূরের কথা, কোনো ধরনের অবিশ্বস্ততার আলামত পেলে খুন জখম কিংবা চোখ খুবলে নেওয়ার শাস্তিও সামাজিকভাবে লঘু হয়ে যায়। কারণ পুরুষেরা স্ত্রীদের অবিশ্বস্ততাকে প্রজননগতভাবে অধিকতর মূল্যবান বলে মনে করে। যেহেতু পিতৃতন্ত্রের মূল লক্ষ্য থাকে ‘সুনিশ্চিত পিতৃত্বে সন্তান উৎপাদন’ সেজন্য, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে জৈবিক এবং সামাজিক কারণেই স্ত্রীর পরকীয়াকে ‘হুমকি। হিসেবে দেখা হয়। স্ত্রী পরকীয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেলে স্বামী ক্ষতিগ্রস্ত হয় মান সম্মান, সামাজিক পদপর্যাদা সহ বহু কিছুতেই। তিনি সমাজে পরিণত হন ইয়ার্কি ফাজলামোর বিষয়ে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, অনেক দেশের জন্যই সত্য। এমনকি পাঠকেরা জেনে অবাক হবেন যে, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার টেক্সাসে এমন আইন চালু ছিল যে, অবিশ্বস্ততার আলামত পেয়ে স্বামী যদি স্ত্রীকে হত্যা করে তবে সেটি কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না। প্রাচীন রোমে এমন আইন চালু ছিল যে, যদি স্বামীর নিজ গৃহে পরকীয়া বা ব্যাভিচারের ঘটনা ঘটে, তবে স্বামী তার অবিশ্বস্ত স্ত্রী এবং তার প্রেমিকাকে হত্যা করতে পারবেন; ইউরোপের অনেক দেশে এখনও সেসব আইনের কিছু প্রতিফলন দেখা যায়[১৩৬]। তিভ, সোগা, গিসু, নয়োরো, লুয়িয়া, লুয়ো প্রভৃতি আফ্রিকান রাজ্যে হত্যাকাণ্ডের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, সেখানে ৪৬ শতাংশ হত্যাকাণ্ডই সংগঠিত হয় যৌনতার প্রতারণা, অবিশ্বস্ততা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। একইভাবে, সুদান উগান্ডা এবং ভারতেও যৌন ঈর্ষা বা ‘সেক্সুয়াল জেলাসি’ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হবার মূল কারণ বলে জানা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যখনই স্বামী কোনো পরকীয়ার আলামত পেয়েছে, কিংবা স্ত্রী যখন স্বামীকে ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছে তখনই সেই হত্যাকাণ্ডগুলো সংগঠিত হয়েছে। সাঈদের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি স্বামীর সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই রুমানার ঝগড়াঝাটি চলছিলে। কলহের এক পর্যায়ে রুমানা উত্তেজিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর থেকেই মূলত রুমানাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সাঈদ। ২১শে মে বেধড়ক মারধরের পর গলা টিপে রুমানাকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এ সময় রুমানার চিল্কারে বাড়ির সবাই এগিয়ে গেলে সে যাত্রা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরে পরিবারের হস্তক্ষেপে তা মিটমাট হয়। তারপর কিছুদিন পরে রুমানার মা মেহেরপুরে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলে ৫ই জুন আবারো হত্যার চেষ্টা চালায়। সে দিন সাঈদ রুমানাকে ঘরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এ সময় উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রুমানার গলা টিপে ধরে। রুমানা সজোরে আঘাত করে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেন। এ সময় সাঈদের চোখের চশমা পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে রুমানাকে বীভৎসভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাল, নাক, মুখসহ স্পর্শকাতর স্থানে কামড়াতে থাকে। সাঈদ রুমানার নাকে কামড় দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। চোখে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে …
হ্যাঁ, আমরা সবাই সাঈদের কৃতকর্মের শাস্তি চাই। কোনো সুস্থ মাথার মানুষই প্রত্যাশা করবেন না যে, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে সাঈদ অবলীলায় মুক্তি পেয়ে যাক, আর তৈরি করুক আরেকটি ভবিষ্যৎ-অপরাধের সুস্থিত ক্ষেত্র। বরং, তার দুষ্টান্তমুলক শাস্তিই কাম্য। কিন্তু সমাজে যখন নারী নির্যাতন প্রকট আকার ধারণ করে, যখন নৃশংসভাবে একটি নারীর গাল নাক কামড়ে জখম করা হয়, রাতারাতি চোখ খুবলে নেওয়া হয়, এর পেছনের মনস্তাত্বিক কারণগুলোও আমাদের খুঁজে বের করা জরুরি। আমাদের বোঝা দরকার কোনো পরিস্থিতিতে সাঈদের মতো লোকজনের আচরণ এরকম বিপজ্জনক এবং নৃশংস হয়ে উঠতে পারে। আমাদের অস্তিত্বের জন্যই কিন্তু সেগুলো জেনে রাখা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরির প্রত্যাশাতেই এটা দরকার।
সেক্সবম্ব
নীচের ছবি দুটো লক্ষ করুন।
কোন ছবিটিকে আপনার কাছে অধিকতর ‘প্রিয়দর্শিনী’ বলে মনে হয়? জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ পুরুষ এবং নারীই অভিমত দিয়েছেন ডান পাশেরটি অর্থাৎ ২য় ছবিটিকে। এবারে আরেকটু ভালো করে ছবি দুটো লক্ষ করুন। দেখবেন যে ছবি দুটো আসলে একই নারীর। আসলে আরও স্পষ্ট করে বললে একটি ছবি থেকেই পরের ছবিটি তৈরি করা হয়ছে, কম্পিউটারে একটি বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে। আর এটি প্রোগ্রাম করেছেন আইরিশ বংশদ্ভূত বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ড. ভিক্টর জনস্টন[১৩৭]। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, ১ম ছবির সাথে ২য় ছবির পার্থক্য আসলে সামান্যই। প্রথম ছবিটির নারীর চিকন ঠোঁটকে একটু পুরু করা হয়েছে ২য় ছবিতে, চিবুকের আকার সামান্য কমিয়ে দেয়া হয়েছে, চোখের গভীরতা একটু বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর তাতেই অধিকাংশ পুরুষের কাছে ছবিটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞানী ভিক্টর জনস্টন সহ অন্যান্য গবেষকদের মতে, পুরু ঠোঁট আসলে অধিক এস্ট্রোজেন জমা হয়ে মুখমণ্ডল নমনীয় থাকার লক্ষণ, আর অন্য দিকে সরু এবং চিকোনো চিবুক ‘লো টেস্টোস্টেরন’ মার্কার। এ ব্যাপারটা পুরুষদের কাছে। পছন্দনীয় কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো মোটা দাগে নারীর উর্বরাশক্তির বহিঃপ্রকাশ[১৩৮]। এ অধ্যায়ের প্রথম দিকে উল্লেখ করেছিলাম সৌন্দর্য্যের উপলব্ধি কোনো বিমূর্ত ব্যাপার নয়। এর সাথে যৌন আকর্ষণ এবং সর্বোপরি গর্ভধারণক্ষমতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, আর আছে আমাদের দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথপরিক্রমার সুস্পষ্ট ছাপ। আমরা যখন কাউকে প্রিয়দর্শিনী বলে ভাবি, আমাদের অজান্তে আসলে সেই চিরন্তন উপলব্ধিটাই কাজ করে। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের সময় এস্ট্রোজেনের মাত্রা নির্ণয়ের কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি খুঁজে পায়নি, তাদের কাছে সঙ্গীর পরিষ্কার চামড়া, ঘন চুল, কমনীয় মুখশ্রী, প্রতিসাম্যময় দেহ, পিনোন্নত স্তন, সুডৌল নিতম্ব আর ক্ষীণ কটিদেশ ছিল গর্ভধারণ ক্ষমতা তথা উর্বরতার প্রতীক। তাদের কাছে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই ছিল আদরণীয়। তারা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে বিপরীত লিঙ্গের এ সমস্ত দেহজ বৈশিষ্টেরই। যাদের এ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল তারাই সঙ্গী হিসেবে অধিকহারে নির্বাচিত হয়েছে, আর তারা প্রকারন্তরে অর্জন করেছে প্রজননগত সফলতা, আমরা তাদেরই বংশধর। তাই সঙ্গী নির্বাচনের সময় আমাদের মনেও খেলা করে যায় সেই একই ধরনের অভিব্যক্তিগুলো, যেগুলোর প্রকাশ ঘটেছিল আসলে অনেক অনেক আগে প্লেইস্টোসিন যুগে আমাদের পূর্বপুরুষদের সঠিক সঙ্গী নির্বাচনের তাগিদে।
ঠিক একইভাবে মেয়েরাও লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ পছন্দ করে, যাদের রয়েছে। সুগঠিত চোয়াল, চওড়া কাঁধ আর প্রতিসম সুগঠিত দেহ। যেমন অভিনেতা ব্র্যাড পিট তার সুগঠিত দেহ, চওড়া এবং সুদৃঢ় চোয়ালের জন্য সারা পৃথিবীজুড়েই নারীদের কাছে আকর্ষণীয় এবং সুদর্শন পুরুষ হিসেবে খ্যাত। কারণ, পুরুষের এ পুরুষালি বৈশিষ্ট্যগুলোই দীর্ঘদিন ধরে নারীদের কাছে নির্বাচিত হয়েছে এক ধরনের ‘ফিটনেস মার্কার হিসেবে, শিকারি সংগ্রাহক সমাজে এ ধরনের পুরুষেরা ছিল নারীদের কাছে অতিপ্রিয়, তারা ছিল স্বাস্থ্যবান, উদ্যমী, সাহসী, ক্ষিপ্র এবং গোত্রের নিরাপত্তা প্রদানে সফল। তারা অর্জন করতে পেরেছিল বহু নারীর সান্নিধ্য এবং পেয়েছিল প্রজননগত সফলতা। খুব সুচারুভাবে সেই অভিব্যক্তিগুলো নির্বাচিত হয়েছিল বলেই সেগুলো নারীদের মানসপটে রাজত্ব করে এখনও, তারা সুদর্শন পুরুষ দেখে আমোদিত হয়।
অন্যদিকে প্লেবয়, ভোগ কিংবা কসমোপলিটনের কভার গার্ল (বাংলা করলে বলা যায় ‘মলাট সুন্দরী’)-দের দিকে কিংবা ছবির জগতের নায়িকাদের তাকালে বোঝা যায় কেন পুরুষেরা তাদের দেখলে লালায়িত হয়ে উঠে। তাদের থাকে ক্ষুদ্র নাসিকা, চিকোনো চিবুক, বড় চোখ, পুরুষ্ঠ ঠোঁট। তাদের সবার বয়সই থাকে মোটামুটি ১৭ থেকে ২৫-এর মধ্যে যেটি মেয়েদের জীবনকালের সবচেয়ে উর্বর সময় বলে। সাধারণভাবে মনে করা হয়। তাদের দেহ সৌষ্ঠব থাকে প্রতিসম। তাদের কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত থাকে ০.৭ এর কাছাকাছি। শুধু প্লেবয়ের মলাট সুন্দরী নয়, বড় বড় অভিনেত্রী এবং সুপার মডেলদের জন্যও ব্যাপারটা একইভাবে দৃশ্যমান। হলিউড অভিনেত্রী এবং একসময়ের বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাইয়ের দেহের মাপ ৩২ ২৫-৩৪ অর্থাৎ প্রায় ০.৭৩। এঞ্জেলিনা জোলির ০.৭২। জেনিফার লোপেজের ০.৬৭। বিপাশা বসুর ০.৭৬। আর মেরোলিন মনেরোর দেহের মাপ ছিল ৩৬-২৪ ৩৪, মানে একদম খাপে খাপ ০.৭। নারীদেহের এই অনুপাতের একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে পুরুষের কাছে। দেখা গেছে, সারা দুনিয়া জুড়ে শোবিজের সাথে যুক্ত এই কাক্ষিত নারীদের কোমর আর নিতম্বের অনুপাত সবসময়েই ০.৬ থেকে ০.৮ এর মধ্যে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে ০.৭ এর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে। আমরা আগে অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহের একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেছিলাম, যে গবেষণা থেকে জানা গেছে, নারীর কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত ০.৬ থেকে ০.৮ মধ্যে থাকলে তা তৈরি করে সেই ‘ক্লাসিক hourglass figure’ যা সার্বজনীনভাবে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান! অধ্যাপক সিংহ ১৯২০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ‘মিস আমেরিকা’দের মধ্যে এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্লেবয়ের নায়িকাদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছেন মিস আমেরিকাদের ক্ষেত্রে কোমর-নিতম্বের অনুপাত ছিল ০.৬৯ থেকে ০.৭২ এর মধ্যে, আর প্লেবয়ের নায়িকাদের ক্ষেত্রে ০.৬৮ থেকে ০.৭১ এর মধ্যে[১৩৯]। এ সমস্ত আদর্শ দেহবল্ললরীর অধিকারী নায়িকারা এক একজন সেক্সবম্ব, যাদের যৌনাবেদন পুরুষদের কাছে। আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ছোঁয়া। আর, বলা বাহুল্য পুরুষদের মানসপটে এই উদগ্র আগ্রহ তৈরি হয়েছে ডারউইন বর্ণিত যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরে।
কিন্তু সত্যই সেক্সুয়ালের সিলেকশনের মাধ্যমে সত্যিই সেক্সবম্ব তৈরি হয় নাকি? ব্যাপারটা হাতে কলমে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তবে মানুষের ক্ষেত্রে নয়, স্টিকেলব্যাক মাছের ক্ষেত্রে[১৪০]। তার পরীক্ষাটি একধরনের অধিপ্রাকৃতিক উদ্দীপনার (supernormal stimuli) পরীক্ষা বলা যায়। অধ্যাপক ডকিন্স সহ অন্যান্য জীববিজ্ঞানীরা জানতেন যে, স্টিকেলব্যাক মাছের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছেরা যখন উর্বর সময় অতিক্রম করে তখন তাদের পেট হয়ে উঠে ডিমে ভর্তি গোলাকার, লালাভ টসটসে। পুরুষ মাছেরা তাদের দেখে লালায়িত হয়। ডকিন্স তার ল্যাবের একুরিয়ামে সাধারণ রূপালি মাছের পেট কৃত্রিমভাবে বড়, গোলাকার আর লালাভ করে দিয়ে কিছু ‘ডামি মাছ’ পানিতে ছেড়ে দিলেন। ব্যাস দেখা গেল পুরুষ স্টিকেলব্যাক মাছেরা পারলে হামলে পড়ছে সে সব মাছের ওপর। যত বেশি নিখুঁত, গোলাকার আর লালাভ পেট বানানো হচ্ছে, তত বাড়ছে পুরুষ মাছদের যৌনোদ্দীপনা। ডকিন্সের ভাষায় সেই ডামি মাছগুলো ছিল স্টিকেলব্যাক মাছের রাজত্বে এক একটি ‘সেক্সবম্ব’।
অবশ্য দেবেন্দ্র সিংহের গবেষণায় ব্যাপারটা আমার কাছেই ভুল মনে হয়। বিশেষত, বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকাদের দেখলে মনে হয় না যে তাদের শরীরের মাপ দেবেন্দ্র সিংহের দেয়া গবেষণার সাথে মেলে। আমি এ নিয়ে মুক্তমনায় লেখার পর আক পাঠক ব্যাপারটি ব্যাপারটি আমার নজরে এনে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের শোবিজের জন্য এই গবেষণা যে খুব একটা কাজের না তা মৌসুমী, শাবনূর, অঞ্জু ঘোষ সহ সব বাঙ্গালী নায়িকাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়”। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ব্যাপারটি নিয়ে আমিও ভেবেছি। আমার হাইপোথিসিস হল- খাদ্যস্বল্পতার সাথে নায়িকাদের ফিগারের সাথে একটা সম্পর্ক আছে। আমার কাছে হুমায়ুন আজাদের একটি দুর্দান্ত প্রবচনই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা মনে হয়েছে-
“ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে সব দেশে অধিকাংশ
মানুষ অনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর লক্ষণ। এজন্যেই বাংলা ফিল্মের
নায়িকাদের দেহ থেকে মাংস ও চর্বি উপচে পড়ে। ক্ষুধার্ত দর্শকেরা সিনেমা
দেখে না, মাংস ও চর্বি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে” (-হুমায়ুন আজাদ, প্রবচনগুচ্ছ)
না ব্যাপারাটা মোটেও ফাজলামো নয়। দেখুন চিন্তা করে- বাংলা সিনেমার দর্শক এখনো নিম্নমধ্যবিত্তই, যাদের প্রতিনিয়ত খাদ্য স্বল্পতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়। তাদের স্বপ্নের নায়িকারা একটু মোটাসোটাই হবেন আশা করা যায়। দেশের উচ্চমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তরা খুব বেশি সিনেমা হলে যায় না। তাদের নাটকের নায়িকারা (সুবর্ণা, বিপাশা, শমি, আফসানা মিমি , প্রভা প্রমুখ)- এরা কিন্তু ঠিক অঞ্জু ঘোষদের আদলের নন, কিংবা ছিলেনও না।
আরো লক্ষ করলে দেখা যাবে, পশ্চিমা বিশ্বে খাদ্যস্বল্পতা নেই। বরং সেখানে ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং- এর ফাস্টফুড সবচেয়ে সহজলভ্য আর কমদামী। সে সমস্ত খাবার নিয়মিত খেলে ওবিস হয়ে মুটিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সেখানে একটি মেয়েকে খুব কষ্ট করে ব্যায়ামট্যায়াম করে, ফাস্ট ফুডের তেল চর্বি এড়িয়ে, লেটুস, সালাদ খেয়ে নিজের ফিগার অক্ষুন্ন রাখতে হয়। পশিমে তাই চিকন চাকন মানে কোমর আর নিতম্বের ০.৭ অনুপাতের মেয়েরাই সুন্দরী হিসাবে নির্বাচিত হবেন, কারণ তেল চর্বির অঢেল রাজত্বে চিকন থাকাটাই একটা বড় ফিটনেস মার্কার। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের যেখানে আহার জুটে না, সেখানে ফিটনেস মার্কার ‘হাড়গিলগিলে’ হওয়াটা যে হবে না বলাই বাহুল্য।
এমনকি আমেরিকাতেও নাকি অর্থনৈতিক মন্দার সময়গুলোতে একটু মোটাতাজা প্লেমেটদের আধিক্য চোখে পড়ে প্লে বয়ের ম্যাগাজিনগুলোতে। ব্যাপারটি উঠে এসেছে (Terry Pettijohn এবং Brian Jungeberg- এর একটি গবেষণায়।
যে ব্যাপারটা স্টিকেলব্যাক মাছের ক্ষেত্রে সত্য বলে মনে হচ্ছে, মানুষের ক্ষেত্রেও কি সেটার সত্যতা বিভিন্নভাবে পাওয়া যাচ্ছে না? নারীদের সাম্প্রতিক ‘ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট সার্জারির হুজুগের কথাই ধরা যাক। এটা এমন এক ধরনের সার্জারি, যার মাধ্যমে নারীরা স্তনের আকার পরিবর্তন করে থাকেন। এ সার্জারিগুলো এক সময় কেবল পর্নোস্টাররাই করতেন, এখন হলিউড বলিউডের অভিনেত্রীদের কাছেও ব্যাপারটা খুবই সাধারণ, এমনকি বাসার গৃহিণীরাও তা করতে শুরু করেছে। আমেরিকান সোসাইটি অব প্লাস্টিক সার্জন (ASPS)-এর তথ্য অনুযায়ী কেবল ২০০৩ সালেই আট মিলিয়ন মহিলা ‘ব্রেস্ট ইম্পল্যান্ট সার্জারি করেছে, যেটা আবার ২০০২ সালের চেয়ে শতকরা ৩২ ভাগ বেশি। খোদ আমেরিকাতে প্রতি বছর এক লক্ষ বিশ হাজার থেকে দেড় লক্ষ নারী ব্রেস্ট ইম্পল্যান্ট করে থাকে[১৪১]। এমন নয় যে ক্ষুদ্র স্তন তাদের কোনো দৈহিক সমস্যা করে। সার্জারির পুরো ব্যাপারটাই কেবল নান্দনিক (aesthetic), পুরুষদের যৌনোদ্দীপনাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের দেহকে সুন্দর করে উপস্থাপন, আর সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। স্টিকেলব্যাক পুরুষ মাছেরা যেমন বড়, গোলাকার আর লালাভ পেটওয়ালা স্ত্রী মাছদের জন্য লালায়িত হয়, ঠিক তেমনি মানবসমাজে দেখা গেছে পুরুষেরা সুদৃঢ়, গোলাকার আর পিনোন্নত স্তন দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে! পুরুষদের এই পছন্দ অপছন্দের প্রভাব পড়ছে আবার নারীদের আচরণে। এগুলো তারই প্রতিফলন। শুধু ব্রেস্ট ইম্পল্যান্টই নয়, সেই সাথে বোটক্স, ফেসলিফট, ঠোঁটের প্রস্থ বাড়ানো, চোখের ভুরু উঁচু করা, বাঁকা দাঁত সোজা করা, নাক খাড়া করা সহ সকল ধরনের প্লাস্টিক সার্জারির ক্রমবদ্ধমান জনপ্রিয়তা তৈরি করছে মানবসমাজে সেক্সবম্বের স্বপ্নীল চাহিদা!
প্লাস্টিক সার্জারির কথা বাদ দেই, সারা পৃথিবী জুড়ে স্নো, পাউডার লিপস্টিকের কী রমরমা ব্যাবসা। এই সব প্রসাধনসামগ্রীর মূল ক্রেতা কিন্তু মেয়েরাই। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতি মিনিটে ১৪৮৪টি লিপস্টিকের টিউব এবং ২০৫৫ জার ‘স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট বিক্রি হয়। আমরা এগুলোর যত সামাজিক ব্যাখ্যা প্রতিব্যখ্যা করি না কেন, কিংবা যত ইচ্ছে মিডিয়াকে দোষারোপ করি না কেন, এইধরনের ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকার হিসেব খুব সহজ সরল পুরুষেরা মেয়েদের কাছ থেকে যথাসম্ভব তারুণ্য এবং সৌন্দর্য আদায় করে নিতে চায়। আবার মেয়েরাও বিপরীত লিঙ্গের সেই সঙ্গমী মননকে প্রাধান্য দিয়ে অব্যাহতভাবে সৌন্দর্যচর্চা করে যায়, তারা ত্বককে রাখতে চায় যথাসম্ভব মাখনের মতোন পেলব, ঠোঁটকে গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত; কারণ তারা দেখেছে এর মাধ্যমে স্টিকেলব্যাকের ডামি মাছগুলোর মতোই অনেক ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটিজিগতভাবে সঙ্গী নির্বাচন আর ধরে রাখায় সফল হওয়া যাচ্ছে।
এ তো গেল মেয়েদের সঙ্গমী মননের স্ট্র্যাটিজি। অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের গড়ে ওঠা পর্নোগ্রাফিক ইন্ডাস্ট্রি পুরুষদের ‘সেক্সবম্ব’ চাহিদার চরমতম রূপ বললে অত্যুক্তি হবে না। সারা দুনিয়া জুড়ে আট বিলিয়ন ডলারের পর্নোগ্রাফি ব্যবসা টিকে আছে পুরুষের লালসা আর জৈবিক চাহিদাকে মূল্য দিয়ে। মেয়েরা কিন্তু কখনোই পর্নোগ্রাফির মূল ক্রেতা নয়, ছিলও না কখনো। ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করা সিলিকোনো গার্লদের নিখুঁত দেহবল্লরী আর যৌনাবেদনময়ী মায়াবী নারীদের আকর্ষণে পুরুষেরা নিশিরাত জেগে থাকে কম্পিউটারের সামনে। পর্নোগ্রাফি দেখা কোনো সত্যিকার যৌনসঙ্গম নয়, তারপরেও পর্নোভিডিও পুরুষদের নিয়ত উত্তেজিত করে তুলে অনেকটা স্টিকেলব্যাক মাছের মতোই যেন। স্টিকেলব্যাক মাছের পুরুষ মাছেরা যেমনিভাবে লালাভ পেটওয়ালা ডামি মাছ থেকে কামার্ত হয়ে পড়েছিল ডকিন্সের ল্যাবে একুরিয়ামের ভেতর, ঠিক তেমনি মানবসমাজের ‘পুরুষ মাছেরা একইভাবে কামার্ত হয়ে পড়ে কম্পিউটারের ভেতর ডামি মডেলদের নগ্নদৃশ্য দেখে! তার মানে, নিজেদের আমরা ‘আশরাফুল মাখলুকাৎ’ বা সৃষ্টির সেরা জীব ভেবে যতই আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা করি না কেন, আমরা প্রাণিজগতের বাইরে নই, আমাদের মানসজগৎও তৈরি হয়েছে অন্য প্রাণীদের মতোই যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরে, পর্নোগ্রাফি এবং সেক্সবম্বদের প্রতি পুরুষদের উদগ্র আগ্রহ সেই আদিম সত্যকে স্পষ্ট করে তুলে।
ছেলেদের পুরুষাঙ্গের আকার এবং প্রকৃতি কি তবে মেয়েদের যৌনতার নির্বাচনের ফল?
প্রেম ভালোবাসা এবং যৌনতায় পুরুষের পুরুষাঙ্গ যে একটা আলাদা জায়গা দখল করে আছে, তা আর নতুন করে বলে দেবার বোধ হয় দরকার নেই। কিন্তু যেটা অনেকের কাছেই অজানা তা হলো, বহু নারী গবেষকই তাদের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা থেকে ইঙ্গিত করেছেন ভালো যৌনসম্ভোগের জন্য পুরুষাঙ্গের আকার সম্ভবত খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়[১৪২]। কিন্তু তারপরেও বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে পৃথিবীতে অধিকাংশ পুরুষই তার পুরুষাঙ্গের আকার ‘ছোট’ ভেবে হীনম্মন্যতায় ভুগে থাকে। যেমন, গবেষক জে. লিভার ২০০৬ সালে ৫২৩১ জন পুরুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন[১৪৩], প্রায় সকল পুরুষই প্রত্যাশা করে যে, তার পুরুষাঙ্গ আরেকটু বড় হলেই ভালো হতো। প্রতি এক হাজার জনে মাত্র দুজন অভিমত দিয়েছে পুরুষাঙ্গ ছোট হবার পক্ষে। আরেক গবেষক বি.ই. ডিলন এবং তার দলবল ২০০৮ সালে গবেষণায় দেখান যে, কৈশোর থেকে শুরু করে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত সবসময়ই পুরুষদের জন্য পুরুষাঙ্গের ক্ষুদ্র আকার একটি বিশাল উদ্বেগের কারণ[১৪৪]। অনেক পুরুষই আছেন যারা সঙ্গীর সাথে প্রথম যৌন সম্পর্কের আগে এই ভেবে উদ্বিগ্ন থাকে যে, নগ্ন অবস্থায় তার ক্ষুদ্র পুরুষাঙ্গ দেখতে পেয়ে তার সঙ্গীনিশ্চয় যারপরনাই মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু পুরুষেরা তার নিজের যন্ত্রটি নিয়ে যাই ভাবুন না কেন, মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় ৮৫ ভাগ নারী মনে করে তার সঙ্গীর পুরুষাঙ্গের আকার তার প্রত্যাশা এবং মাপমতোই আছে[১৪৫]?
সত্যি কথা হলো পুরুষদের পুরুষাঙ্গের “ক্ষুদ্র” আকার নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার আসলে কোনো কারণ নেই। মানবসমাজে পুরুষদের পুরুষাঙ্গের গড়পড়তা আকার অন্যান্য প্রাইমেটদের চেয়ে ঢের বড় সুপার সাইজ বলা যায়। আর এই ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে নারীর যৌন অভিরুচিকে প্রাধান্য দিয়ে। জিওফ্রি মিলার তার ‘সঙ্গমী মনন’ গ্রন্থের size mattered অংশে পুরুষাঙ্গের আকার নিয়ে নারী বিজ্ঞানীদের সনাতন কিছু ধারণাখণ্ডনকরে অভিমতদিয়েছেন, তারা যেভাবে পুরুষাঙ্গের আকারকেহিসেবের বাইরে রাখতে চেয়েছেন, ব্যাপারটা আসলে এতোটা তুচ্ছ করার মতোনয়। যৌনতার নির্বাচনের মূল জায়গাটিতে আবারো ফেরত যাই। আমরা আগের একটি অংশে দেখেছিলাম নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডৌল নিতম্ব আর ক্ষীণ কটিদেশের প্রতি পুরুষদের সার্বজনীন আকর্ষণের কথা, আমরা দেখেছি কীভাবে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে পুরুষেরা মেয়েদের দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচিত করেছিল, কারণ সে বৈশিষ্ট্যগুলোই হয়ে উঠেছিল তাদের চোখে প্রজনন ক্ষমতা এবং সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। এই যৌনতার নির্বাচন কিন্তু একতরফাভাবে হয়নি। আমরা আগেই বলেছি, যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে এবং তার দেহজ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে। এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা।
অনেক বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন মানবসমাজে পুরুষদের পুরুষাঙ্গের আকার এবং প্রকৃতি অনেকটাই নির্ধারিত হয়েছে নারীর যৌন চাহিদাকে মূল্য দিয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনায় যাওয়া যাক। মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির প্রাইমেট সদস্যদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ম্যাড্রিলদের গাঢ় গোলাপি রঙের অণ্ডকোষ আর লাল রঙের পুরুষাঙ্গ আছে। ভার্ভেট বানরদের নীল রঙের অণ্ডকোষের সাথে রক্তিম লাল বর্ণের পুরুষাঙ্গ আছে, ইত্যাদি। মানুষের মধ্যে অবশ্য সেসব কিছুই নেই। সাদা চোখে মনে হতে পারে মানুষদের পুরুষাঙ্গ বোধ হয় সাদামাটা ম্যারম্যারে একটি অঙ্গ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, আসলে তা নয়। প্রাইমেটদের অন্য প্রজাতির তুলনায় মানব পুরুষাঙ্গ আকারে বড়, মোটা এবং অধিকতর নমনীয়। একটা তুলনামূলক হিসেব দেই। গরিলাদের বিপুল দেহের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এতবড় দেহ থাকলে কী হবে, তাদের পুরুষাঙ্গের আকার পূর্ণ উত্থিত অবস্থাতেও মাত্র দুই ইঞ্চির বেশি হয় না। শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র তিন ইঞ্চি। আর মানুষের ক্ষেত্রে উখিত পুরুষাঙ্গের আকার গড়পড়তা পাঁচ ইঞ্চি। সবচেয়ে বড় পুরুষাঙ্গের আকার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে প্রায় তের ইঞ্চি, যা গড়পড়তা দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণেরও বেশি। আর তার চেয়েও বর কথা হলো, মানব পুরুষাঙ্গের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে, যা অন্য প্রাইমেট বর্গদের থেকে একদমই আলাদা। অন্য প্রাইমেট প্রজাতিতে যেখানে পুরুষাঙ্গে একটি হাড় আছে যেটিকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ব্যাকালাম (baculum) বলে অভিহিত করা হয় সেটি মানব লিঙ্গে একেবারেই অনুপস্থিত। সেজন্য বিশেষ এই মানব প্রত্যঙ্গটি হয়েছে অন্য প্রাইমেটদের তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার গবেষণায় দাবি করেছেন অন্য প্রাইমেটদের পেন্সিল সদৃশ রোগা পুরুষাঙ্গের তুলনায় মানব পুরুষদের দীর্ঘ, চওড়া এবং হাড়বিহীন নমনীয় পুরুষাঙ্গ তৈরি হয়েছে মূলত নারীর সার্বিক চাহিদাকে মূল্য দিয়ে[১৪৬]। মিলার তার ‘সঙ্গমী মনন’ (The Mating Mind) বইয়ে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন এ ধরনের পুরুষাঙ্গ নারীরা পছন্দ করেছে কারণ এটি মেয়েদের চরম পুলক (অর্গাজম) আনয়নে সহায়তা করেছে, এটি হয়েছে তাদের জন্য প্রচণ্ড রকমের আনন্দের উৎস, এবং তাদের ক্রমিক চাহিদা তৈরি করেছে উন্নত পুরুষাঙ্গ গঠনের নির্বাচনী চাপা[১৪৭]। অন্য কিছু গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণাতেও এই দাবির স্বপক্ষে কিছুটা সত্যতা মিলেছে বলে দাবি করা হয়[১৪৮]।
কান টানলে নাকি মাথা আসে। তাই পুরুষাঙ্গের আকারের কথা বলার সাথে সাথে অণ্ডকোষের আকার নিয়েও কিছু কথা এখানে চলে আসবে। পাঠকদের কী মনে হবে জানি না, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে কিন্তু খুবই আকর্ষণীয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন শুক্রাশয় বা অণ্ডকোষের আকারের সাথে বহুগামিতা কিংবা অবিশ্বস্ততার একটা সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। সে ব্যাপারটিতে যাওয়ার আগে আমাদের কাছাকাছি প্রজাতিগুলো থেকে কিছু মজার উদাহরণ হাজির করা যাক। আমরা সবাই চোখে না দেখলেও বই পত্র কিংবা ‘কিং কং’ জাতীয় মুভির মাধ্যমে বিশালকায় গরিলার আকার আয়তনের সাথে পরিচিত। একেকটি ব্রহ্মদৈত্য গরিলা আকারে ওজনে প্রায় সাড়ে তিনশ থেকে চারশ পাউন্ড ছাড়িয়ে যায়। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, দেহের আয়তনের সাথে তাল মিলিয়ে তার শুক্রাশয়ের আকারও হবে মাশাল্লা ফুটবল না হোক, নিদেনপক্ষে হওয়া উচিত টেনিস বলের সাইজ। আসলে কিন্তু তা হয় না। এমন চারশ পাউন্ড ওজনের বহদাকার গরিলাদের শুক্রাশয়ের ওজন হয় মাত্র দেড় আউন্স। আর অন্যদিকে শিম্পাঞ্জিদের দৈহিক আকার কিন্তু অনেক ছোটখাট। কিন্তু সে তুলনায় তাদের শুক্রাশয়ের আকার অনেক বড়। মাত্র ১০০ পাউন্ড ওজনের একটি শিম্পাজির শুক্রাশয়ের ওজন প্রায় চার আউন্স! এ যেন বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি! কিন্তু কেন এমন হলো?
এর কারণ লুকিয়ে আছে শিম্পাঞ্জি আর গরিলাদের সামাজিক সম্পর্কের পার্থক্যের মাঝে। দেখা গেছে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে নারীরা হয় বহুগামী। তারা একই দিনে একাধিক পুরুষ শিম্পাঞ্জির সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়। অধিক সংখ্যক পুরুষের সাথে যথেচ্ছাচার সম্ভোগের মাধ্যমে নারী শিম্পাঞ্জিরা প্রকারান্তরে নিশ্চিত করতে চায় যে, উৎকৃষ্ট জেনেটিক মাল-মশলাসম্পন্ন পুরুষের দ্বারাই যেন তার ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে। কিন্তুনারীশিম্পাঞ্জির এই ধরনের অভিরুচির কারণে পুরুষ শিম্পাঞ্জির জন্য ‘বংশরক্ষা’ হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত কঠিন। তাদেরকে এক অসম বীর্য প্রতিযোগিতার (sperm competition) মধ্যে নামতে হয়। নারী শিম্পাঞ্জির যোনিতে গর্ভধারণ নিয়ে বিভিন্ন পুরুষ শিম্পাঞ্জির শুক্রের মধ্যে নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলে, সেই কারণে একটি পুরুষ শিম্পাঞ্জির পক্ষে কখনোই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না যে, যৌনসম্পর্ক হলেই তার নির্দিষ্ট বীর্য থেকেই নারী শিম্পাঞ্জিটি গর্ভধারণ করবে বা করছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায় যদি তার শুক্রাশয়ের আকার অপেক্ষাকৃত বড় হয়, আর তার শুক্রাশয় যদি সঙ্গমের সময় অঢেল শুক্রের যোগান দিতে সমর্থ হয়। শিম্পাঞ্জির এই বীর্য প্রতিযোগিতার লড়াইকে অনেকটা লটারি টিকেটের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যত বেশি সংখ্যক লটারি টিকেট আপনার দখলে থাকবে তত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হবে আপনার বিজয়ী হবার। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে প্রায় সব লটারি টিকেট কোনোভাবে করায়ত্ত করার, আপনার বিজয়ী হবার সম্ভাবনা পাল্লা দিয়ে বাড়বে। আদিতে হয়তো শিম্পাঞ্জিকুলে বড়, ছোট কিংবা মাঝারি সব ধরনের শুক্রাশয়ওয়ালা পুরুষ শিম্পাঞ্জির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু শিম্পাঞ্জি নারীদের বহুগামিতার সাথে পাল্লা দিতে দিয়ে বড় শুক্রাশয়ওয়ালা শিম্পাঞ্জিরাই বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল, তারাই প্রতিযোগিতায় সফল গর্ভসঞ্চারের মাধ্যমে অধিক হারে সন্তানসন্ততি রেখে গেছে। এই নির্বাচনী চাপই শিম্পাঞ্জিকুলে ত্বরান্বিত করেছে বৃহৎ শুক্রাশয় গঠনের দিকে (গড়পড়তা শিম্পাঞ্জির শুক্রাশয়ের ওজন তার দেহের ওজনের ০.৩ ভাগ, এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ৬০ x ১০৭)।
ঠিক উলটো ব্যাপারটি ঘটে গরিলাদের ক্ষেত্রে। নারী গরিলারা বহুগামী নয়। কেবল পুরুষ গরিলারা বহুগামী। শক্তিশালী পুরুষ গরিলারা বড় সড় হারেম তৈরির মাধ্যমে নিশ্চিত করে বহু নারীর দখল। এভাবে পুরুষ গরিলারা নিশ্চিত করে তাদের অধিনস্ত নারীর দেহে নিরাপদ গর্ভসঞ্চার। কাজেই পুরুষ গরিলাদের জন্য ব্যাপারটা কখনোই পুরুষে পুরুষে বীর্য প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরঞ্চ হয়ে উঠে শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতা। শক্তিশালী পুরুষ গরিলারা স্বীয় শক্তির মাধ্যমে অধিকাংশ নারীর দখল নিয়ে নেয়, অধিকাংশ শক্তিহীনদের জন্য পড়ে থাকে দুর্ভাগ্য। সামাজিক অবস্থানের কারণেই গরিলাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনী চাপ তৈরি করেছে বড়সড় দেহ সমৃদ্ধ শক্তিশালী দেহগঠনের, বৃহৎ শুক্রাশয় তৈরির দিকে নয়। গরিলাদের ক্ষেত্রে বৃহৎ শুক্রাশয় গঠনের কোনো উপযোগিতা নেই। নারী পুরুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কের কারণেই গরিলাদের ক্ষেত্রে দেহ অনুপাতে শুক্রাশয়ের আকার অনেক ছোট (শুক্রাশয়ের ওজন দেহের ওজনের ০.০২ ভাগ, এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ৫x ১০৭)।
আপনার মাথায় নিশ্চয় এখন ঘুরতে শুরু করেছে গরিলা আর শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মানবসমাজের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা কী রকম? এক্ষেত্রে মানুষের অবস্থান হলো গরিলা আর শিম্পাঞ্জির মাঝামাঝি (শুক্রাশয়ের ওজন দেহের ওজনের ০.০৪-০.০৮ ভাগ এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ২৫x১০৭), যদিও গবেষকদের অনেকেই রায় দিয়েছেন শুক্রাশয়ের গতি প্রকৃতি কিছুটা শিম্পাঞ্জির দিকে একটু বেশি করে ঝুঁকে রয়েছে। মানবসমাজে পুরুষমানুষদের শুক্রাশয়ের আকার গরিলাদের মতো এত ছোট নয়, ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, মানবসমাজে নারীরা শতভাগ একগামী মনোভাবাপন্ন নয়। আবার শুক্রাশয়ের আকার পুরুষ শিম্পাঞ্জিদের শুক্রাশয়ের মতো এত বড়সড়ও নয়–ফলে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, মানবসমাজে নারীরা আবার শতভাগ নির্বিচারী বহুগামীও হবে না। মানুষের মধ্যে একগামিতা যেমন আছে তেমনি বহুগামিতার চর্চাও। মানুষ নামের এই প্রাইমেটের এই স্পিশিজটির অধিকাংশ সদস্যই “বিবাহ নামক ইন্সটিটিউশনের মাধ্যমে মনোগামিতার চর্চাকে বৈশিষ্ট্য হিসেবে জ্ঞাপন করলেও এর মধ্যে আবার অনেকেই সময় এবং সুযোগমতো বহুগামী হয়, কাকোন্দ্রির চর্চা করে। অনেক ক্ষমতাবান পুরুষেরা যেমন মহামতি আকবর, চেঙ্গিসখান প্রমুখ) আবার অধিক নারীর দখল নিতে অনেকটা গরিলাদের মতোই। ‘হারেম তৈরি করে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই ‘সিরিয়াল মনোগামি’ অর্থাৎ, একই সময়ে কেবল একজন সঙ্গীর সাথেই জীবন অতিবাহিত করে। নারীদের ক্ষেত্রেও বহুগামিতা ঠিক একই কারণে দৃশ্যমান এবং সেটা সকল সমাজেই। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অধিকাংশ নারীরাই নাকি বিয়ের আগে দু চারটি প্রেম-টেম করে শেষমেষ একটি স্বামী খুঁজে নিয়ে ঘর-সংসার করে, কদাচিৎ স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে পরকীয়া করে লুকিয়ে-ছাপিয়ে, কখনো বা একেবারেই নয়। পশ্চিমেও মেয়েরা বয়ঃসন্ধির পর থেকেই স্বাধীনভাবেই একাধিক ‘ডেট করে, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্য সঙ্গীকে বেছে নেয়। কখনো বা সঙ্গী বাছার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে আজীবন, অনেকটা অধুনা পরলোকগত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের মতো। সেজন্যই জোয়ান এলিসন রজার্স তার “যৌনতা : প্রাকৃতিক ইতিহাস” (Sex: A Natural History) বইয়ে উল্লেখ করেছেন[১৪৯]–
পুরুষের অপেক্ষাকৃত বড় শুক্রাশয় এটাই ইঙ্গিত করে যে, নারীরা বিবর্তনের ইতিহাস পরিক্রমায় একগামী নয়, বরং বহুগামীই ছিল।
মানবেতিহাসের পথপরিক্রমায় নারীরা যে আসলে একগামী ছিল না, তা পুরুষদের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের আকৃতি এবং সেই সাথে সঙ্গমের প্রকৃতি থেকেও তা কিছুটা আঁচ করা যায়। এ নিয়ে জৈব শরীরবৃত্তবিদ গর্ডন জি গ্যালপ এবং তার দলবলের একটি চমৎকার গবেষণা আছে[১৫০]। মানব লিঙ্গ একটি বীর্য প্রতিস্থাপন যন্ত্র (The human penis as a semen displacement device) শিরোনামের এই গবেষণাপত্রে গবেষকদল দেখিয়েছেন, অন্য প্রাইমেটদের থেকে মানুষের পুরুষাঙ্গের গঠন কিছুটা আলাদা। ব্যাকালাম নামের হাড়টি যে আমাদের পুরুষাঙ্গে অনুপস্থিত, তা আমরা আগেই জেনেছি। এর বাইরে, পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ (glans) সুচালো কীলকাকৃতির (wedge shaped)। লিঙ্গের অগ্রভাগের ব্যাস পুরুষাঙ্গের স্তম্ভের ব্যাসের চেয়ে খানিকটা বড় হয়। পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ এবং স্তম্ভের সাধারণ তলে উদ্ভূত হওয়া করোনাল রিজ’-এর অবস্থান থাকে স্তম্ভের সাথে উলম্বভাবে। এ ছাড়া, সঙ্গম শুরুর পর থেকে বীর্যস্থলনের আগ পর্যন্ত যোনির অভ্যন্তরে পুরুষকে উপর্যপুরি লিঙ্গ সঞ্চালনের (repeated thrusting) প্রয়োজন হয়। কাজেই সুচালো কীলকসদৃশ লিঙ্গের অগ্রভাগের আকৃতি এবং সেই সাথে উপর্যপুরি লিঙ্গাঘাতের প্রক্রিয়া এটাই ইঙ্গিত করে যে, নারীর যোনির ভিতরে স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণুর আগমন ঘটে থাকলে সেটাকে বিতাড়িত করার জন্য যথেষ্ট। গ্যালোপের গবেষণাপত্রের ২৭৮ পৃষ্ঠায় সেটারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে[১৫১]—
If a female copulated with more than one male within a short period of time, this would allow subsequent males to “scoop out”‘ semen left by others before ejaculating.
আরও একটি ব্যাপারেও নারীদের পরকীয়ার ভালোই আলামত পাওয়া গেছে। দম্পতিদের দীর্ঘদিন আলাদা করে রেখে এবং বহুদিন পরে সঙ্গমের সুযোগ করে দিয়ে দেখা গেছে এতে পুরুষের বীর্যপাতের হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। যত বেশি দিন যুগলকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রাখা হয়, পুনর্বার মিলনের সময় তত বেশি পাওয়া যায় শুক্রাণু প্রক্ষেপণের হার। দেখা গেছে যদি কোনো দম্পতির মধ্যে স্বামী স্ত্রী শতভাগ সময় জুড়ে একসাথে থাকে, তবে প্রতিবার সঙ্গমে গড়পড়তা ৩৮৯ মিলিয়ন শুক্রাণু প্রক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু যদি শতকরা ৫ ভাগ সময় জুড়ে দম্পতিরা একসাথে থাকে, তবে প্রতি প্রক্ষেপণে শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১২ মিলিয়নে–অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ! আসলে দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর মিলনের সময় স্পার্মের যোগান বেড়ে যায় কারণ, পুরুষেরা ভেবে নেয় যে বিচ্ছেদকালীন সময়টুকুতে স্ত্রীর পরকীয়া ঘটার কিছুটা হলেও সম্ভাবনা থাকে। অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণু স্ত্রী ধারণ করতে পারে এই সম্ভাবনা থেকেই বীর্য প্রতিযোগিতা বা স্পার্ম ওয়ার এ লিপ্ত হয় পুরুষটি তার অজান্তেই। প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে সে নিক্ষিপ্ত করে তার অঢেল শুক্রাণুর যোগান, এবং দাবি করে তার শুক্রের মাধ্যমে নারীর গর্ভধারণের কাঙ্ক্ষিত নিশ্চয়তা। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় নারীদের পরকীয়া এবং বহুগামিতার আলামত প্রচ্ছন্নভাবে আছে বলেই দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর মিলনের সময় খুব প্রত্যাশিতভাবেই শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়।
যদি মানবসমাজে নারীরা অনাদিকাল থেকে বহুগামিতায় অভ্যস্থ না হতো, যদি একগামী সম্পর্কের বাইরেও অতিরিক্ত যুগল মৈথুনে (extra-pair copulations) কখনোই নিজেদের নিয়োজিত না করত, তাহলে পুরুষের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কীলকাকৃতি হওয়ারও দরকার পড়তো না, প্রয়োজন হতো না সঙ্গমকালীন সময়ে উপর্যুপরি লিঙ্গাঘাতেরও152। দরকার ছিল নাদীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর মিলনের সময় শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিরও। আসলে মানবসমাজে নারীর একগামিতার পাশাপাশি বহুগামিতার প্যাটার্নের একটি উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্য এগুলো। শুধু পুরুষের বিশেষ অঙ্গেই নয়, বহুগামিতার নিদর্শন রয়েছে নারীদের নিজেদের শরীরেও। সেটা জানতে হলে আমাদের নারীর চরম পুলক বা অর্গাজম সম্বন্ধে জানতে হবে।
পুলকিত মনন (অর্গাজমিক মাইণ্ড)
বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ এবং বিবর্তন বিজ্ঞানী স্টিফেন জে, গুল্ড মনে করতেন নারীর চরম পুলকের কোনো বিবর্তনীয় উপযোগিতা নেই[১৫৩]। এটা অনেকটা বিবর্তনের সাইড-ইফেক্ট যাকে তিনি ডাকতেন স্প্যান্ড্রেল নামে। বড় বড় ইমারত তৈরি করার সময় দেখা যায় যে, দুটি খিলানের মাঝে স্প্যান্ড্রেল বাড়তি উপাদান হিসেবে এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়,ইমারতের কারিগরি নকশার প্রয়োজনে নয়, বরং উপজাত হিসেবে। এই স্প্যান্ড্রেলগুলো ইমারতকে মজবুত করতেও সাহায্য করে না, আরোপ করে না কোনো বাড়তি গুণাগুণ। কোনো প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়াই এগুলো কাঠামোতে উড়ে এসে জুড়ে বসে। যৌনসঙ্গমের সময় নারীর পুলকের ব্যাপারটাও গুল্ড মনে করতেন অনেকটা সেরকমেরই, যার স্বকীয় কোনো ‘সার্ভাইভাল ভ্যালু’ নেই; এটা স্রেফ বিবর্তনের উপজাত।
এভাবে ভাবার অবশ্য কারণ আছে। পুরুষদের জন্য পুলক বা অর্গাজম সরাসরি বীর্যপাতের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ বীর্যপাতের সময়টাতেই পুরুষেরা চরম পুলক অনুভব করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে পুলকের ব্যাপারটা সরাসরি প্রজননের সাথে যুক্ত থাকায় এ থেকে ‘পুরুষালি অর্গাজমের’ বিবর্তনগত উপযোগিতা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা নয়। নারীর চরম পুলকের সাথে গর্ভধারণের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। সত্যি বলতে কী–চরম পুলক ছাড়াও নারীর পক্ষে গর্ভধারণ সম্ভব, এবং সেটা অহরহই ঘটছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ নারী সঙ্গমের সময় সবসময়ই চরম পুলক লাভ করে, ৪৮ ভাগ নারী অধিকাংশ সময়, ১৯ ভাগ নারী জীবনের কখনো-সখনো, ১১ ভাগ নারী কদাচিৎ আর ৭ ভাগ নারী জীবনের কখনোই অর্গাজম অনুভব করে না[১৫৪]। অর্থাৎ, পুরুষদের অর্গাজমের ব্যাপারটা প্রচ্ছন্ন হলেও মেয়েদেরটা রহস্যময়, জটিল এবং অনেকসময় সাগরতীরে মৎস্যকুমারীর দেখা পাওয়ার মতোই যেন অলভ্য।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সনাতন স্প্যান্ড্রেল আর উপজাত তত্ত্বের বাইরে গিয়ে নারীর পুলকের বেশ কিছু বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা হাজির করেছেন বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা। জীববিজ্ঞানীরা আবার এর মধ্যে খেয়াল করেছেন যে, মানুষ ছাড়াও অন্য প্রাইমেটদের নারীদের মধ্যেও চরম পুলকের অস্তিত্ব রয়েছে[১৫৫, ১৫৬]। ব্যাপারটা সত্যি হয়ে থাকলে নারী অর্গাজমের বিবর্তনগত উপযোগিতা থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
বহু বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানী অভিমত দিয়েছেন যে, এই প্রক্রিয়ায় আসলে নারীরা তাদের অজান্তেই পুরুষদের বীর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে, এবং অর্গাজমের জটিল অথচ মায়াবী প্রক্রিয়ায় যোগ্য কিংবা সঠিক পুরুষটিকে বাছাইয়ের কাজ করে ফেলে। অর্গাজমের সময় একটি নারীর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠে, হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যায়, মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বের হতে থাকে, মাংশপেশীর সংকোচন বা খিচুনির মতো অবস্থা ঘটে, কারো কারো ক্ষেত্রে হয় হ্যালুসিনেশন বা অলীক দর্শন[১৫৭]। নারীর ভেতরে চলা এই জটিল এবং রহস্যময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী সনাক্ত করে নেয় তার কাঙ্ক্ষিত ‘মিস্টার রাইট’কে। সে হিসেবে চিন্তা করলে অর্গাজম আসলে নারীর এক ধরনের ‘মেট সিলেকশন ডিভাইস বা সঙ্গী নির্ণায়ক যন্ত্র। নিউইয়র্ক টাইমসের খ্যাতনামা বিজ্ঞান লেখিকা ন্যাটালি এঞ্জিয়ার সেজন্যই তার বইয়ে লিখেছেন[১৫৮]–
নারীর পুলক হচ্ছে নারী অভিরুচি বাস্তবায়নের এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। … এটা নারীর মতো করে গোপন বিতর্কের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নেওয়ার একটি সচেতন প্রক্রিয়া।
নারীর পুলকের সময় জরায়ুসহ বিভিন্ন মাংশপেশীর অবিরত সংকোচন ঘটে চলে। বিজ্ঞানীরা বলেন এই সংকোচন ঘটার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে। এই জরায়ুর মাংশপেশী সংকোচনের মাধ্যমে একটি নারী নিশ্চিত করে যে, জরায়ুর গ্রীবাদেশীয় শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি (cervical mucus barrier) অতিক্রম করে সে যেন শুক্রাণুকে নিজের দেহভ্যন্তরে পুরোপুরি টেনে নিতে পারে। আমি একটি প্রকাশিত কেস স্টাডি থেকে এমন ঘটনার সন্ধানও পেয়েছি যে, অর্গাজমের চাপে একটি পুরুষের কন্ডম পর্যন্ত ভিতরে শুষে নিয়েছিল একটি নারীর দেহ, পরবর্তী অনুসন্ধানে কন্ডমটি পাওয়া গিয়েছিল নারীটির সার্ভিকাল ক্যানালের সরু পথে আটকে যাওয়া অবস্থায়[১৫৯]। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, অর্গাজম বা নারী পুলকের মূল লক্ষ্য থাকে শুক্রাণুকে যতদূর সম্ভব ডিম্বাণুর কাছাকাছি পৌঁছে দেয়া, এর ফলে বৃদ্ধি পায় গর্ভধারণের সম্ভাবনা।
বিজ্ঞানীরা এটাও দেখেছেন যে, নারীর অর্গাজম হলে সে যে পরিমাণ শুক্রাণু নিজের অভ্যন্তরে ধারণ করে, অর্গাজম না হলে তার চেয়ে অনেক কম শুক্রাণু সে তার মধ্যে ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ অর্গাজম হলে নারীর নিজের অভ্যন্তরে শুক্রাণুর ধারণ ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়[১৬০]। যেমন, দেখা গিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি নারী সাধারণত সঙ্গমের পর মোটামুটি ৩৫ ভাগ শুক্রাণু নিজ দেহ থেকে বের করে দেয়। কিন্তু নারীর অর্গাজম হলে সে প্রায় সত্তর ভাগ স্পার্ম নিজের মধ্যে ধারণ করে, আর বের করে দেয় ৩০ ভাগ। তার মানে চরম পুলক না হবার অর্থ হলো, অধিকতর বেশি শুক্রাণুর বর্জন। এই সাক্ষ্যগুলো সেই ‘স্পার্ম রিটেনশন’ তত্ত্বকেই সমর্থন করে যার মাধ্যমে নারী অধিক সংখ্যক শুক্রাণুকে যোনি থেকে জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের দিকে টেনে নিয়ে প্রকারান্তরে নিশ্চিত করতে চায় সঠিক পুরুষকে দিয়ে নিজের গর্ভধারণের সম্ভাবনা।
এখন কথা হচ্ছে সঠিক পুরুষটি কেমন হতে পারে যে কি না নারীকে নিয়মিত অর্গাজম উপহার দেবে? কোনো কিছু চিন্তা না করেই বলা যায় যে পুরুষটির একটি গুণ হতে পারে—সে দেখতে শুনতে হবে সুদর্শন। জীববিজ্ঞানের ভাষায় সুদর্শন পুরুষের মানে হচ্ছে প্রতিসম (symmetrical) চেহারা আর দেহের অধিকারী পুরুষ। কারণ বিবর্তনীয় পথপরিক্রমায় নারীরা বুঝে নিয়েছে যে, প্রতিসম চেহারা এবং দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী পুরুষেরা স্বাস্থ্যবান, তাদের দেহ রোগ জীবাণুর আবাসস্থল নয়, অর্থাৎ মোটা দাগে তারা ‘সুপেরিয়র জেনেটিক কোয়ালিটি’র অধিকারী। রান্ডি থর্নহিল স্টিভেন গেংস্টাডের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, নারীদের পুলকের পৌনঃপুনিকতা এবং চরম পুলকানুভূতি আনয়নের ক্ষেত্রে সুদর্শন পুরুষেরাই অধিকতর বেশি সফল হয়ে থাকে[১৬১]।
সুদর্শন পুরুষেরাও আবার সে ব্যাপারটি ভালো করেই জানে এবং বুঝে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুদর্শন পুরুষেরা খুব কম সময়ের মধ্যেই (shortest courtship) যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্ককে যৌনসম্পর্কের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এও দেখা গেছে, পশ্চিমা দেশে সুদর্শন পুরুষেরা ডেট করার সময় গড়পড়তা প্রতি নারীর পেছনে কম সময় এবং অর্থ ব্যয় করে। শুধু তাই নয় সুদর্শন স্বামীরা অনেক বেশি হারে স্ত্রীদের প্রতারণা করে অন্য সম্পর্কে জড়ায়[১৬২]।
তবে নারী পুলক নিয়ে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপারটি বেরিয়ে এসেছে বিজ্ঞানী রবিন বেকার এবং মার্ক বেলিসের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে। তাদের গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে সমস্ত নারীরা পরকীয়ায় মত্ত, তাদের অর্গাজম অনেক বেশি হয়। মানে, নিয়মিত সঙ্গীর চেয়ে গোপন প্রেমিকের সাথে সঙ্গমে নারীর চরম পুলকের হার অনেক বেশি থাকে তাদের ক্ষেত্রে। ব্রিটেনের ৩৬৭৯ জন নারীর উপর জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছেন যে, তাদের ঋতুচক্রের সবচেয়ে উর্বর সময়গুলোতেই তারা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে, যে সময়টাতে তাদের গর্ভধারণ করার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি[১৬৩]। এটাও দেখা গেছে যে, পরকীয়ারত নারীরা স্বামীর সাথে অনেক বেশি পুলক জালিয়াতি (fake orgasm) করে স্বামীদের আশ্বস্ত রাখতে চেষ্টা করে সম্ভবত এই ধারণা দিতে যে, সে কেবল তার স্বামীর প্রতিই রয়েছে বিশ্বস্ত[১৬৪]।
নিঃসন্দেহে স্বামীদের জন্য কোনো সুসংবাদ নয় এটি। কিন্তু এ ব্যাপারগুলো থেকে বোঝা যায় যে, মেয়েদের মেটিং স্ট্র্যাটিজি সব সময় স্বামীকে তুষ্ট করে ‘যৌন বিশ্বস্ত হয়ে চলার জন্য বিবর্তিত হয়নি, বরং বিস্তৃত হয়েছে কখনো সখনো উৎকৃষ্ট জিনের সন্ধানে নিজের প্রজনন সফলতাকে বাস্তিবায়িত করার জন্যও। মাথা নেড়ে যতই এটাকে অস্বীকারের চেষ্টা করা হোক না কেন, বিবর্তনের অমসৃণ যাত্রাপথে রয়েছে এর সুস্পষ্ট পদচিহ্ন।
চোখের আলোয় দেখেছিলেম মনের গভীরে
ভালোবাসার কথা বললেই আমাদের সামনে সবার আগে হৃদয়ের কথা চলে আসে। বিদগ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকারা অহরহ ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আসল সত্যটা হলো বিজ্ঞানীরা বলেন, ভালোবাসার উৎস হৃদয় নয়, বরং মস্তিষ্ক। শুধু তাই নয়, বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলারের মতে, মানুষের মস্তিষ্ক বা ব্রেন হচ্ছে এক ‘Magnificent Sexual Ornament, যা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ অভিরুচিকে মূল্য দিয়ে। মিলারের মতে মস্তিষ্কের প্রকৃতিও অনেকটা পুরুষাঙ্গের মতোই যৌননির্বাচনের ফসল। আমরা সে সমস্ত সঙ্গীর সাথেই থাকতে পছন্দ করি যাদের সাথে থেকে আমরা সুখী বোধ করি[১৬৫]। আর কার সাথে সুখী বোধ করব, তা নির্ধারণ করে আমাদের মস্তিষ্ক, হৃদয় নয়। আমরা যেমন স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন সঙ্গী পছন্দ করি, তেমনি পছন্দ করি এমন কাউকে যে রসিকতা বোঝে, প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারে রোমান্টিক এবং বিশ্বস্ত, শিল্প-সাহিত্য সংগীতের ব্যাপারে সমঝদার। আমরা এ ধরনের গুণাবলিগুলো পছন্দ করি কারণ বিপরীতলিঙ্গের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক অভিযোজিত হয়েছে আর আমাদের পছন্দ-অপছন্দ আর ভালোলাগাগুলো বিবর্তিত হয়েছে যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরে। যৌনতার নির্বাচনই আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি করেছে গান-বাজনা, নৃত্য-গীত, কাব্য, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্যকর্ম, খেলাধুলা, বাগ্মীতা প্রভৃতির প্রতি অনুরাগ। যাদের মধ্যে এ গুণাবলি আমরা খুঁজে পাই, তারা অনেক সময়ই হয়ে ওঠে আমাদের পছন্দের মানুষজন।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে, মস্তিষ্কের প্রকৃতি বদলে গেলে ভালোবাসার প্রকৃতিও বদলে যায়। এরকম একটি কেস স্টাডির কথা আমি সম্প্রতি পড়েছি পল ব্লুমের ‘হাও প্লেসার ওয়ার্ক্স’ বইয়ে। ১৯৩১ সালে নথিবদ্ধ এ ঘটনা থেকে জানা যায় এক মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে অহরহ অভিযোগ করতেন–তার সঙ্গী মোটেই পরিশীলিত নয়, কেমন যেন অদক্ষ চাষাভূষা টাইপের। বরদাস্তই করতে পারতেন না তিনি স্বামীকে একেবারে। কিন্তু কিছুদিন পরে কোনো এক রোগে কিংবা দুর্ঘটনায় মহিলাটির মস্তিষ্কের বড় একটা অংশ আহত হয়। দুর্ঘটনার পর স্মৃতিশক্তি ফিরে পাওয়ার পর তার সঙ্গী সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গিয়েছিল। যে লোকটাকে কিছুদিন আগেও অপরিশীলিত চাষাড়ে বলে মহিলার মনে হচ্ছিল, সেই সঙ্গী তার কাছে রাতারাতি আবির্ভূত হলেন “ধনবান, বুদ্ধিদীপ্ত, সুদর্শন এবং বর্ণাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে। সত্যি বলতে কী যৌনাকর্ষণ এবং রোমান্টিক প্রেমের ব্যাপারগুলো রয়ে যায় মস্তিষ্কের খুব গভীরে, মনের গহীন কোণে। মস্তিষ্কের আঘাত সেই মহিলাটিকে সুযোগ করে দিয়েছিল একেবারে নতুনভাবে শুরু করতে, ফলে তার চিরচেনা সঙ্গী তার কাছে আবির্ভূত হয়েছিল একেবারে নতুন মানুষ হিসেবে, অনেক পছন্দনীয় হিসেবে। অর্থাৎ, মস্তিষ্কের প্রকৃতি বদলে যাওয়ায় মহিলাটির ভালোবাসার প্রকৃতিও বদলে গিয়েছিল।
‘A Midsummer Night’s Dream’ নাটিকায় শেক্সপিয়র উচ্চারণ করেছিলেন, ‘Love looks not with the eyes but with the mind’। শেক্সপিয়র মিথ্যে বলেননি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি গানে যে কথাটি বলেছিলেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’; সেই কথাটিকেই সামান্য বদলে দিয়ে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলা যায়–
চোখের আলোয় দেখেছিলেম মনের গভীরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।
আশা করছি রবীন্দ্রনাথের গানে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের কাঁচি চালানোয় রবীন্দ্রভক্তরা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যাবেন না। ভালোবাসার দাবি বলে কথা!
“ভালোবাসা কারে কয়” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ