১০ই এপ্রিল ১৯৭২ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পরিতাপের বিষয় ঐ সংসদের সব সাংসদরাই ছিলেন পাকিস্তানের সংবিধান এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এলএফও- এর আওতায় নির্বাচিত।
মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সংবিধান গঠনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “বর্তমান সংসদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের LFO (Legal Frame Work) এর অধিনে সংগঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের LFO মোতাবেক নির্বাচিত জাতীয় সংসদের দায়িত্ব ছিল পাকিস-ানের সংবিধান প্রণয়ন করা। আওয়ামী লীগ দল হিসাবে ছয় দফার ভিত্তিতে জনগণের কাছ থেকে ভোট গ্রহণ করেছিল। ছয় দফার দাবি ছিল পাকিস্তানের ভৌগলিক অখন্ডতা বজিয়ে রেখে প্রদেশ ভিত্তিক পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসন কায়েম করা। অতএব স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কোন বৈধ অধিকার তাদের নেই। তিনি সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশন গঠন করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, জাতীয় কনভেনশনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিই থাকবে না তাতে বিভিন্ন সংগঠন যাদের সদস্যরা জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের প্রতিনিধিদেরও অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। ধরণের জাতীয় কনভেনশনের দ্বারা প্রণীত সংবিধান পরে গণভোটের মাধ্যমে গৃহিত হবে।”
আওয়াশী লীগ সরকার ঐ প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে ১২ই অক্টোবরের সংসদ অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন প্রণীত সংবিধান গৃহিত হয়। যদিও সংবিধানে সরাসরিভাবে মুজিববাদের উল্লেখ ছিল না তবুও মুজিববাদের মূলনীতির উপর তথা ভারতীয় সংবিধানের নীতিমালার উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বা শাসনতন্ত্র।
সরকার ঘোষণা করলো দেশে সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা হবে কিন্তু সংবিধানের ৪২নং ধারার মাধ্যমে ব্যক্তি মালিকানা বজিয়ে রাখা হলো। ৩৫, ৩৭, ৩৯ নং ধারার মাধ্যমে অতি চতুরতার সাথে মানুষের মানবিক অধিকারসমূহ কেড়ে নেয়া হলো। আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিকে অতি নির্দয়ভাবে উৎপাটন করার জন্য সংবিধানে ৬৩(৩) ধারা সংযোজিত করে। ‘জননিরাপত্তার নামে আইয়ূব শাহীর বর্বরোচিত আচরণের মতই মুজিবের নেতৃত্বে বিনা বিচারে আটক এবং মিল কারখানায়, অফিস-আদালতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার বিধানও সংবিধানে রাখা হয়।
শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে হত্যা করে
সর্বশেষে শেখ মুজিব তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করে জাতির উপর বাকশালী একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বীজ নিহিত ছিল ১৯৭২ সালের ৭ই মার্চ রক্ষীবাহিনী আদেশ জারি করার মধ্যে।
জাতীয় রক্ষী বাহিনীকে বিনা ওয়ারেন্টে ধরপাকড় এবং তল্লাশীর ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল ঐ আদেশের মাধ্যমে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির মুখে ২৪শে ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট জাষ্টিস আবু সাইদ চৌধুরীকে বিদায় নিতে হয়। ১৪ই জানুয়ারী ১৯৭৪ সংসদ অধিবেশন বসে। আব্দুল মালেক উকিলকে স্পীকার হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। ২৪শে জানুয়ারী ১৯৭৪ ‘হ্যা’ ভোটের মাধ্যমে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইন পাশ করা হয়।
১৩রা জানুয়ারী ১৯৭৫ সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। একই দিন বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় এবং সংবিধানের কতিপয় ধারা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৬ই জানুয়ারী ‘৭৫ এক ঘোষণায় বলা হয় যে, সরকারি কর্মচারীরা সমবায় সমিতি ছাড়া অন্য কোন সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এছাড়া ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেয়ালের সব পোষ্টার মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর ২০শে জানুয়ারী বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংগঠিত সেই কলঙ্কিত অধিবেশন। ২৫শে জানুয়ারী সংসদে কোন রকমের বির্তক ছাড়া গণতন্ত্রকে পুরোপুরি সমাহিত করে পাশ করানো হয় চতুর্থ সংশোধনী। মাত্র এক বেলার সেই অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন জনাব আব্দুল মালেক উকিল।
চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা সংসদ সদস্য না হলে ভোট দিতে পারবেন না। প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী সংসদ সদস্য হবেন তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মন্ত্রী পরিষদ রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন, তবে রাষ্ট্রপতি তা কার্যকর করলেন কি করলেন না সে সংক্রান্ত ব্যাপারে আদালতে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। ঐ অধিবেশনে ‘জরুরী ক্ষমতা বিল’ কোন আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়ে যায়। ২৫শে জানুয়ারী দুপুর ১:১৫ মিনিটে এক সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে জারিকৃত চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয়, “এই আইন প্রণয়নের পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন। এই আইন প্রবর্তনের ফলে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন এমনিভাবে যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধিনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধিনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে যে ক্ষমতা নির্ধারণ করবেন উপ-রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ থাকবে। রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য এরূপ ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও আবশ্যক মনে করলে অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রত্যেক মন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা করতে এবং কার্যাবলীতে অংশ নিতে পারবেন তবে তিনি যদি সংসদ সদস্য না হন তাহলে ভোট দান করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তার নির্দেশে উপ-রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ঐ সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবেন। মন্ত্রীগণ রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। সংশোধিত সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেশে শুধু একটি মাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা জাতীয় দল নামে অভিহিত হবে। সংশোধনীতে কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে না এবং তার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোন আদালত হতে পরোয়ানা জারি করা যাবে না।” জাতীয় দলের ঘোষণায় বলা হয়, “কোন ব্যক্তি জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন কিংবা ভিন্ন ধারার কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।”
ঐ সংশোধনীর পক্ষে ২৯৪ জন সাংসদ ভোট দেন। কেউ বিরোধিতা করেননি। সংসদের ২ঘন্টা ৫মিনিট স্থায়ী ঐ অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিলের বিরোধিতা করে তিনজন বিরোধী ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ওয়াক আউট করেন। এরা হলেন জাসদের আবদুল্লাহ সরকার, আব্দুস সাত্তার ময়নুদ্দিন আহমেদ ও স্বতন্ত্র সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আতাউর রহমান খান আগেই সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসেন। বিলটি উত্থাপন করা হলে আওয়ামী লীগের দলীয় চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে কোন প্রস্তাব উত্থাপনের সুযোগ না দেবার আহ্বান জানান। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান খান বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে আলোচনার সুযোগ দানের জন্য স্পীকার জনাব মালেক উকিলকে অনুরোধ করেন। কিন্তু স্পীকার তা নাকচ করে দেন। পরে কন্ঠভোটে চীফ হুইপের প্রস্তাব গৃহিত হয়। তারপর আইনমন্ত্রী মনরঞ্জন ধর সংসদে জরুরী ক্ষমতা বিল ১৯৭৫’ পেশ করেন। চীফ হুইপ এ ক্ষেত্রেও মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ বিধি প্রয়োগ না করার আবেদন জানালে বিষয়টি কন্ঠভোটে পাশ হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষ প্রানিধানযোগ্য। যদিও বিলটি সংসদে বিনা বাধায় পাশ হয়; তবে গণতন্ত্রের বিকল্প একনায়কত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যেও দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়।
২৪শে ফেব্রুয়ারী ‘৭৫ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান এক আদেশবলে দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করেন এবং নিজেকে দলীয় চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। ঘোষণার ৩নং আদেশে বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি অন্য কোন নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অবলুপ্ত আওয়ামী লীগের দলীয় সকল সদস্য, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সবাই ‘বাংলাদেশ-কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের’ সদস্য বলে গন্য হবেন।
এ আদেশ অমান্য করে বাকশালে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বঙ্গবীর জনাব ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন তাদের সাংসদ পদে ইস্তফা দেন।
বাকশালীরা
বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং জনাব মঈনুল হোসেন যখন বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেন তখন সুযোগ সন্ধানীদের অনেকেই বাকশাল এ যোগদান করার জন্য লাইন দিয়েছিল।
বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ ও মোজাফফর ন্যাপ শেখ মুজিবের এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রণয়নকে অভিনন্দন জানান। তথাকথিত জাতীয় দল গঠিত হওয়ার ফলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে। আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ এবং মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টি সামগ্রিকভাবে বাকশালে যোগদান করেন। সংসদের বিরোধী দলের ৮জন সদস্যের মধ্যে ৪জন বাকশালে যোগদান করেন। প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খানও বাকশালে যোগদান করে সুবিধাবাদী চরিত্র ও রাজনীতির এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২রা জুন ‘৭৫ বাকশালে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবর রহমানের কাছে ৯জন সম্পাদক আবেদন পেশ করেন। তারা হলেন বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক ওবায়েদুল হক, জনাব নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব শামছুল হুদা, বাসস এর প্রধান সম্পাদক জাওয়াদুল করিম, বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলার বাণীর নির্বাহী সম্পাদক শহীদুল হক, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং বিপিআই সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান। ৬ই জুন ‘৭৫ বাকশালের সাংগঠনিক কাঠামো ও গঠনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। তাতে দলের মহাসচিব মনোনীত হন মনসুর আলী। সচিব হন জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি, এবং আব্দুর রাজ্জাক। ঐ দিন বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসাবে ১১৫জনের নাম ঘোষণা করা হয়। তাতে উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানরা, বিডিআর এর মহাপরিচালক, রক্ষীবাহিনীর পরিচালক, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রমুখকে অর্ন্তভূক্ত করা হয়।
দলের কার্যনির্বাহী পরিষদে থাকেন: (১) শেখ মুজিবর রহমান (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৩) মনসুর আলী ( ৪ ) খন্দোকার মোশতাক আহমেদ (৫) আবু হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (৬) আব্দুল মালেক উকিল (৭) অধ্যাপক ইফসুফ আলী (৮) মনরঞ্জন ধর (৯) মহিউদ্দিন আহমেদ (১০) গাজী গোলাম মোস্তফা (১১) জিল্লুর রহমান (১২) শেখ ফজলুল হক মনি (১৩) আব্দুর রাজ্জাক।
কেন্দ্রিয় কমিটিতে থাকেনঃ ( ১ ) শেখ মুজিবর রহমান (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ( ৩ ) মনসুর আলী ( ৪ ) আব্দুল মালেক উকিল ( ৫ ) খন্দোকার মোশতাক আহমেদ (৬) কামরুজ্জামান (৭) মাহমুদ উল্লাহ (৮) আব্দুস সামাদ আজাদ (৯) ইউসুফ আলী ( ১০ ) ফনিভূষণ মজুমদার (১১) ডঃ কামাল হোসেন (১২) সোহরাব হোসেন (১৩) আব্দুল মান্নান (১৪) আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (১৫) মনোরঞ্জন ধর (১৬) আব্দুল মতিন ( ১৭ ) আসাদুজ্জামান ( ১৮) কোরবান আলী (১৯) ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক ( ২০ ) ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (২১) তোফায়েল আহমেদ (২২) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (২৩) আব্দুল মোমেন তালুকদার (২৪) দেওয়ান ফরিদ গাজী (২৫) অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী (২৬) তাহের উদ্দিন ঠাকুর (২৭) মোসলেম উদ্দিন খান (২৮) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর (২৯) একেএম ওবায়দুর রহমান (৩০) ডঃ ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল (৩১) রিয়াজুদ্দিন আহমদ (৩২) এম বায়তুল্লাহ (৩৩) রুহুল কুদ্দুস সচিব (৩৪) জিল্লুর রহমান (৩৫) মহিউদ্দিন আহমদ এমপি (৩৬) শেখ ফজলুল হক মনি (৩৭) আব্দুর রাজ্জাক (৩৮) শেখ শহীদুল ইসলাম (৩৯) আনোয়ার চৌধুরী (৪০) সাজেদা চৌধুরী (৪১) তসলিমা আবেদ (৪২) আব্দুর রহিম (৪৩) ওবায়দুল আউয়াল (৪৪) লুৎফর রহমান (৪৫) একে মুজিবর রহমান (৪৬) ডঃ মফিজ চৌধুরী (৪৭) ডঃ আলাউদ্দিন (৪৮) ডঃ আহসানুল হক (৪৯) রওশন আলী (৫০) আজিজুর রহমান আক্কাস (৫১) শেখ আবদুল আজিজ (৫২) সালাহউদ্দিন ইউসূফ (৫৩) মাইকেল সুশীল অধিকারি (৫৪) কাজী আব্দুল হাশেম (৫৫) মোল্লা জালাল উদ্দিন (৫৬) শামসুদ্দিন মোল্লা (৫৭) গৌর চন্দ্র বালা (৫৮) কাজী গোলাম মোস-ফা (৫৯ ) শামসুল হক (৬০) শামসুজ্জোহা (৬১) রফিকুদ্দিন ভূইয়া (৬২) সৈয়দ আহমদ (৬৩) শামসুর রহমান খান (৬৪) নূরুল হক (৬৫) এম এ ওহাব (৬৬) ক্যাপ্টেন সুজ্জাত আলী (৬৭) এম আর সিদ্দিক (৬৮) এমএ ওহাব (৬৯) চিত্তরঞ্জন সুতার (৭০) সৈয়দা রাজিয়া বানু (৭১) আতাউর রহমান খান (৭২) খন্দোকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ( ৭৩) সংপ্রু সাইন (৭৪) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (৭৫) আতাউর রহমান (৭৬) পীর (৭৬) পীর হাবিবুর রহমান (৭৭) সৈয়দ আলতাফ হোসেন (৭৮) মোহাম্মদ ফরহাদ (৭৯) মতিয়া চৌধুরী (৮০) হাজী দানেশ (৮১) তৌফিক ইমাম সচিব (৮২) নূরুল ইসলাম (৮৩) ফয়েজ উদ্দিন সচিব (৮৪) মাহবুবুর রহমান সচিব (৮৫) আব্দুল খালেক (৮৬) মুজিবুল হক সচিব (৮৭) আব্দুর রহিম সচিব (৮৮) মঈনুল ইসলাম সচিব (৮৯) সহিদুজ্জামান সচিব (৯০) আনিসুজ্জামান সচিব (৯১) ডঃ এ সাত্তার সচিব (৯২) এম এ সামাদ সচিব (৯৩) আবু তাহের সচিব (৯৪) আল হোসাইনী সচিব (৯৫) ডঃ তাজুল হোসেন সচিব (৯৬) মতিউর রহমান টিসিবি চেয়ারম্যান (৯৭) মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ (৯৮) এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দোকার (৯৯) কমোডর এমএইচ খান (১০০) মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান (১০১) একে নজিরউদ্দিন (১০২) ডঃ আব্দুল মতিন চৌধুরী (১০৩) ডঃ মাযহারুল ইসলাম (১০৪) ডঃ এনামুল হক (১০৫) এটিএম সৈয়দ হোসেন (১০৬) নূরুল ইসলাম আইজি পুলিশ (১০৭) ডঃ ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম (১০৮) ডঃ নূরুল ইসলাম (পিজি হাসপাতাল ) (১০৯) ওবায়দুল হক (সম্পাদক অবজারভার) (১১০) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (ইত্তেফাক) ( ১১১ ) মিজানুর রহমান (বিপিআই) (১১২) মনোয়ারুল ইসলাম (১১৩) ব্রিগেডিয়ার এ এম এম নূরুজ্জামান (রক্ষীবাহিনী প্রধান (রক্ষীবাহিনী প্রধান) (১১৪) কামরুজ্জামান শিক্ষক সমিতি (১১৫) ডঃ মাজহার আলী কাদরী।
একই ঘোষণায় বাকশালের পাচঁটি অঙ্গ সংগঠনও গঠন করা হয়। সেগুলো হচ্ছেঃ
জাতীয় কৃষকলীগ,
জাতীয় শ্রমিক লীগ,
জাতীয় মহিলা লীগ,
জাতীয় যুবলীগ ও
জাতীয় ছাত্রলীগ।
এগুলোর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন যথাক্রমে ফনিভূষণ মজুমদার, অধ্যাপক ইউসূফ আলী, সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ ও শেখ শহীদুল ইসলাম। এসমস্ত সংগঠনের কেন্দ্রিয় কমিটিগুলোতে মোজাফফর ন্যাপ ও মনি সিংএর কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতাদের গ্রহণ করা হয়। বাকশালের এ সূত্র ধরেই ১৬ই জুন ‘সংবাদপত্র বাতিল অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। তার বলে পার্টি নিয়ন্ত্রণাধীন শুধুমাত্র চারটি দৈনিক ও কয়েকটি সাপ্তাহিক বাদে সকল পত্র- পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। গণতন্ত্রের হত্যাযজ্ঞ শেষে দেশ জুড়ে চলে তান্ডব উৎসব। রুদ্ধশ্বাস মানুষ জীবনের নিরাপত্তা হারিয়ে জন্মভূমিতেই বন্দী হয়ে পড়েন স্বৈরশাসনের নিষ্পেষনে।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার সীমাহীন হয়ে পড়ে
শেখ মুজিব কর্তৃক বাকশাল কায়েম হবার পর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।
জনতার সাথে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ বাধে বিভিন্ন স্থানে। শহরবাসীরা ঐসব হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। ৮ই জুন মাইজদীতে জনতার সাথে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটে। ৯ই জুন ঐ হামলা ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়। এর পিছনে কোনো রাজনৈতিক উস্কানি ছিল না। ঐ দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার তদন্ত করার জন্য মাইজদী যেতে বাধ্য হন। তারপর ১০ই জুন ‘৭৩ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল ঘোষণা করেন, “মাইজদীর ঘটনার জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।” কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল সে খবর কোথাও ছাপা হয়নি। আজঅব্দি জানতে পারেননি এদেশের নির্যাতিত জনগণ সেখানে কি ঘটেছিল।
১০ই জুন বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত কম্যুনিষ্ট পার্টির এক সভায় দলীয় প্রধান জনাব মনি সিং উচ্চকন্ঠে বলেন, “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদী চীনের নেতৃত্ব এবং তাদের দেশীয় সহযোগী ভাসানী ন্যাপ উগ্রপন্থী জাসদ, মুসলিম লীগ ও জামায়াতপন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।” এরপর ১৯৭৩ সালের ১৯ই জুন ঢাকার প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় নির্দেশ জারি করেন, “শহরে বিনা অনুমতিতে মাইক ব্যবহার করা যাবে না।” মাইক ব্যবহারের উপর এই নিষেধাজ্ঞা ছিল সুষ্পষ্টভাবে বিরোধী দলের জনসভার উপর। মোজাফফর ন্যাপ বা সিপিবি- এর কোন প্রতিবাদ করেনি। বরং ২৪শে জুন মোজাফফর ন্যাপের সভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, “তার দল বাস্তব অবস্থাতে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে সস্থা জনপ্রিয়তা অর্জনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।” ঐ জনসভাতেও তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীকে সাম্রাজ্যবাদের চর বলে অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে মজুতদারী, চোরাচালানী, দুর্নীতিতে ছেয়ে যায় দেশ। রক্ষীবাহিনীর হামলা ও হত্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের ২৭শে জুন পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুসারে দেখা গেল যে, ‘৭২ সালের তুলনায় দ্রব্যমূল্য চারশ গুন বেড়েছে।
এই সময় ২৯শে জুন চট্টগ্রামে ঘটে এক চমকপ্রদ ঘটনা৷ চট্টগামের ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর বাসের উপর রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণে নিহত হয় একজন কর্মচারী। গুরুতর আহত হয় দু’জন শ্রমিক। ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর একটি বাস কর্মচারীদের রিফাইনারীতে নিয়ে যাবার পথে রক্ষীবাহিনীর একটি ট্রাককে ওভারটেক করে। এ কারণে রক্ষীবাহিনীর ক্রুদ্ধ সদস্যরা একটি রেল ক্রসিংয়ের মুখে ঐ গাড়ি ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এমনি সামান্য ছুতোঁতেই রক্ষীবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে স্বাধীন এ দেশের সাধারণ মানুষকে।
এই সময় দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক নির্মল সেন (অনিকেত) মার্চের নির্বাচনের ক’দিন পরে লিখেছিলেন, “আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই” শীর্ষক একটি উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ। লেখায় তিনি এক সপ্তাহের একটি ঠিকুজি তুলে ধরেন ১৩টি হত্যাকান্ডের। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন যে, এ খবর সব খবর নয়। সব খবর সংবাদপত্রে পৌঁছে না। সব খবর পৌঁছে না থানায়। দূর-দূরান্ত থেকে কে দেয় কার খবর? আর দিতে গেলে জীবনের যে ঝুঁকি আছে সে ঝুঁকি নিতেই বা কতজন রাজি? এই নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করে নির্মল সেন জানতে চেয়েছিলেন।
(১) ১৯৭২ সাল হতে আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়টি হত্যাকান্ডের কিনারা হয়েছে?
(২) কয়জন হত্যাকারী গ্রেফতার হয়েছে?
(৩) ক’টি গাড়ি হাইজ্যাক হয়েছে? সে হাইজ্যাকার কারা? কি তাদের পরিচয়? কি তাদের ঠিকানা?
(8)কারা গ্রেফতার হয়েছে?
(৫) পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে, অভিযুক্তদের ধরা হলে ফোনের জন্য তাদের মুক্তি দিতে হয়। এ অভিযোগ কতটুকু সত্য? এই ফোন কারা করে থাকেন? তিনি বলেন, “খুঁজে দেখতে হবে এই হত্যাকারীরা কাদের প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। নইলে দিনের পর দিন হত্যা, রাহাজানীর খবর বের হয়? অথচ একটি অপরাধীরও শাস্তি হয় না। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি করে?” এ প্রশ্ন শুধু নির্মল সেনেরই ছিল না এ প্রশ্ন ছিল দেশের জনগণেরও। আওয়ামী লীগ সরকার এ প্রশ্নগুলোর কোন জবাব দিতে পারেনি।
চট্টগ্রামের রিফাইনারী কর্মচারীদের উপর গুলিবর্ষণের অকারণ হত্যার জন্য রক্ষীবাহিনীর কেউ সাজা পায়নি। উপরন্ত ১৯৭৩ সালের ২৭শে জুলাই প্রেসিডেন্টের অগণতান্ত্রিক ৫০নং ধারা অনুযায়ী রক্ষীবাহিনীকে দেয়া হল নতুন ক্ষমতা। তাতে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি লিডার ও তার উপরস্থ সকল অফিসারকে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া অপরাধ করেছে সন্দেহে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও তল্লাশীর ক্ষমতা দেয়া হয়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ২১শে অক্টোবর অভিযোগ করে যে, রক্ষীবাহিনী তাদের রাজবাড়ি জেলা শাখার সম্পাদককে গ্রেফতার করে পিটিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছে। ২৪শে অক্টোবর তারা অভিযোগ করেন যে, বাগমারার জাসদ নেতাকে রক্ষীবাহিনী খুন করেছে। একই অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যজোটের মোজাফফর ন্যাপ, ১৬ই অক্টোবর পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকে রক্ষীবাহিনীর গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করে জেলা ন্যাপ কমিটি একটি বিবৃতি দেন। ২রা নভেম্বর মোজাফফর ন্যাপের সম্পাদক পংকজ ভট্টাচাৰ্য্য অভিযোগ করেন যে, তার কর্মীদের উপর রক্ষীবাহিনীর হামলা, হত্যা, নির্যাতন চলছে। তিনি বলেন, “১লা নভেম্বর সুনামগঞ্জ মহকুমার ন্যাপ প্রধান বঙ্কু দাসকে রক্ষীবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পীরগাছার ন্যাপ কর্মীদের নির্বিচারে মারধর করা হয়েছে। ৩০শে অক্টোবর নাটোরে ন্যাপ কর্মীকে রক্ষীবাহিনী অপহরণ করেছে।” সেই সঙ্গে পংকজ ভট্টাচাৰ্য্য অনুনয় করেন যে, এদের উপর হামলা হলে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের শক্তিই বৃদ্ধি পাবে।
‘৭৩ সালের ২৫শে অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মালেক উকিল জানান, “গ্রামরক্ষী দল গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে শর্টগান দেয়া হবে। কাজের মেয়াদ শেষ হলে এসব অস্ত্র থানায় জমা দেয়া হবে।” তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেন, “এ ব্যাপারে মহকুমা হাকিমের অনুমোদন সাপেক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং এম পির সাথে আলোচনা করে গ্রামরক্ষী দল গঠনের জন্য ওসির প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
এরপর ২৯শে নভেম্বর সরকারের অস্ত্র সংক্রান্ত এক ঘোষণায় বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রীগণ, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা লাইসেন্স ছাড়াই নিষিদ্ধ (প্রোহিবেটেড বোরের) অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন।” এর বৈধতার প্রশ্ন ছাড়াও এই সিদ্ধান্ত থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠে যে দেশের আইন্তশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটেছিল।
‘৭৩ সালের প্রারম্ভ থেকেই গ্রামে গ্রামে চলে রক্ষীবাহিনীর বর্বর, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক অভিযান। মুজিব আমলের স্বৈরাচার ও বিরোধী নির্যাতনের একটি দলিল আত্মগোপনকারী কম্যুনিষ্ট নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী শ্রীমতি অরুণা সেনের বিবৃতি। অরুনা সেন, রানী সিংহ ও হনুফা বেগমকে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার রামভদ্রপুর গ্রাম থেকে রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করেনি। তাদেরকে কোন আদালতেও হাজির করেননি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় এবং পরে সুপ্রীম কোর্টে তাদের পক্ষে রীট আবেদন করার পর কোর্টের নির্দেশে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়৷ মামলার শুনানির সময় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণযোগ্য অভিযোগ আনতে অক্ষম হওয়ায় সুপ্রীম কোর্ট অবিলম্বে তাদের তিনজনকেই বিনা শর্তে মুক্তিদানের নির্দেশ দেন। অরুণা সেন ও অন্যান্যদের পক্ষে এই মামলা পরিচালনা করেছিলেন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিষ্টার জমিরুদ্দিন সরকার।
মুক্তি পাবার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-নির্যাতনের স্বরূপ প্রকাশের জন্য শ্ৰীমতি অরুণা সেনের সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “গত ১৭ই আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লোকেরা আমাদের গ্রামের ওপর হামলা করে। ঐদিন ছিল দূর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। খুব ভোরে আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে বেদম মারপিট করে। লক্ষণ নামের একটি কলেজের ছাত্র ও আমাকে ধরে তারা নড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী শান্তি সেন ও পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? বলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের ধরিয়ে দিন। আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। লক্ষণকে সেদিন রেখে পরদিন ছেড়ে দেয়। সে যখন বাড়ি ফেরে, দেখি বেদম মারের ফলে সে গুরুতররূপে আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চার/পাঁচ দিন পর আবার তারা আমাদের গ্রামের উপর হামলা চালায়। অনেক বাড়ি তল্লাশী করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামের দু’জন যুবককে তারা মারতে মারতে নিয়ে যায়। আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। তাদের আত্মীয়রা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের খোঁজ করলে বলে দেওয়া হয় তারা সেখানে নেই। তাদেরকে খুন করে গুম করে ফেলা হয়েছে বলেই মনে হয়। এরপর মাঝে মাঝেই তারা গ্রামে এসে যুবক ছেলেদের খোঁজ করত। গত ৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ রাতে রক্ষীবাহিনী এসে সম্পূর্ণ গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। ভোরে আমাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম, গ্রামের উপস্থিত প্রায় অধিকাংশ সক্ষম দেহী পুরুষ এমনকি বালকদের পর্যন্ত এনে হাজির করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হোসেন খাঁ সবকিছুর তদারকি করছে। আমার সামনে রক্ষীবাহিনী উপস্থিত সকলকে বেদম মারপিট শুরু করে। শুনলাম এদের ধরতে গিয়ে বাড়ির মেয়ে-ছেলেদেরও তারা মারধর করে এবং অনেকক্ষেত্রে অশালীন আচরণ করেছে। এরপর আমাকে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার হুকুম করল পানিতে নেমে দাড়াতে। সেখানে নাকি আমাকে গুলি করা হবে। আমি নিজেই পানির দিকে নেমে গেলাম। ওরা রাইফেল উচিয়ে তাক করল গুলি করবে বলে। কিন্তু পরষ্পর কী সব বলাবলি করে রাইফেল নামিয়ে নিল। আমি কাদাঁ-পানিতে দাড়িয়েই থাকলাম। কমান্ডার গ্রেফতার করা সবাইকে হিন্দু মুসলমান দুই কাতারে ভাগ করে দাড় করালো। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বলল, ‘মালাউনরা আমাদের দুশমন। তাদের ক্ষমা করা হবে না। তোমরা মুসলমানরা মালাউনদের সাথে থেকো না। তোমাদের এবারের মত মাফ করে দেয়া হল।’ এই বলে কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফা নামের দু’জন মুসলমান যুবককে রেখে বাকি সবাইকে এক একটা বেতের বাড়ি দিয়ে বলল, ‘ছুটে পালাও’। তারা ছুটে পালিয়ে গেল। আমার পাক বাহিনীর কথা মনে পড়ল। তারাও বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভক্ত করতে এমনিভাবে সাম্প্রদায়ীকতার আশ্রয় নিয়েছিল। পার্থক্য শুধু তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়ীকতার আশ্রয় নিত আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধব্জাধারীরা ভন্ডামীর আশ্রয় নিচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফাসহ ২০জন হিন্দু যুবককে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হল। তিনজন ছাড়া এরা সবাই পেশায় জেলে। মাছ ধরে কোনরকমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সব আকুল হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকল। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! সন্ধ্যার সময় কলিমুদ্দিন, মোস্তাফা, গোবিন্দনাগ ও হরিপদ ঘোষ ছাড়া বাকি সবাই গ্রামে ফিরে এল। আমি গেলাম তাদের দেখতে। দেখলাম তারা সবাই চলতে অক্ষম। সর্বাঙ্গ ফুলে গেছে তাদের। বেত ও বন্দুকের দাগ শরীর কেটে বসে গেছে। চোখ-মুখ ফোলা। হাতপায়ের গিরোতে রক্ত জমে আছে। তাদের কাছে শুনলাম, সারাদিন দফায় দফায় তাদের চাবুক মেরেছে। গলা ও পায়ের সঙ্গে দড়ি বেধে পানিতে বার বার ছুড়ে ফেলে ডুবিয়েছে। পিঠের নিচে ও বুকের উপর পা দিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন লোক তাদের উপর উঠে দাড়িয়েছে। মই দিয়ে ডলেছে। এদের অনেককেই আত্মীয়রা বয়ে এনেছে। এদের অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, যারা দিনরাত্রি পরিশ্রম করেও একবেলা পেটপুরে খেতে পায়না, অনাহার, দুঃখ- দারিদ্রের জ্বালায় আজ অর্ধমৃত তাদের ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’র অবসান কবে হবে? যে শাসকরা মানুষের সামান্য প্রয়োজন ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানী, শোষণ, নির্যাতন যারা বন্ধ করতে পারছে না, তারা কোন অধিকারে আজ নিঃস্ব মানুষের উপর চালাচ্ছে এই বর্বর নির্যাতন? অবশেষে চরম নির্যাতন আমার উপরও নেমে এল। ৬ই ফেব্রুয়ারীর রাতে ভোর না হতেই রক্ষীবাহিনী ঘুম থেকে আমাকে তুলল। আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলে দেখলাম রানীও রয়েছে। আমাদের নিয়ে তারা দুই মাইল দূরে ভেদরগঞ্জ রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হল। রাস্তায় তারা রানীর প্রতি নানারকমের অশ্লীল উক্তি করেছিল। ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলাম সেখানে কলিমুদ্দিন, মোস্তাফা, গোবিন্দনাগ এবং হরিপদও রয়েছে। বুঝতে পারলাম তাদের উপর চরম দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে। বিশেষ করে কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফাকেই বেশি অসুস্থ দেখলাম। কলিমুদ্দিন ও মোস্তাফা দুই ভাই। এদের সংসারে আর কোন সক্ষম ব্যক্তি নেই। অপরের জমিতে চাষ করে ওরা কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা বিবাহিত ও ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জনক। আমরা ক্যাম্পে আসতেই অনেক রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের ঘিরে দাড়াল। কেউ অশ্লীল মন্তব্য করে, কেউ চুল ধরে টানে, কেউ চড় মারে, কেউ খোঁচা দেয়। এমন সব বর্বরতা। কিছুক্ষণ পর আমাদের রোদের মধ্যে বসিয়ে রেখে তারা চলে গেল। সন্ধ্যায় আমাকে উপরে দোতালায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম রানীর হৃদয়বিদারী চিৎকার। প্রায় আধঘন্টা পর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে থেমে গেল। নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছিল বেতের সপাং সপাং শব্দ আর পাশবিক গর্জন। রানীকে যখন এনে তারা কামরার মধ্যে ফেলল, রাত্রি তখন কত জানিনা। রানীর অচৈতন্য দেহ তখন বেতের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝড়ছে। জ্ঞান ফিরলে রানী পানি চাইলো, আমি তাকে পানি খাওয়ালাম। রানী আস্তে আস্তে কথা বলতে পারল। রাত্রি তখন ভোর হয়ে এসেছে। রানীর মুখে শুনলাম উপরে ভেদরগঞ্জ ও ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সম্পাদকরা এবং ঐ দুই স্থানের ক্যাম্প কমান্ডাররা উপস্থিত ছিল। তারা শান্তি সেন ও চঞ্চলকে ধরিয়ে দিতে বলে এবং অস্ত্র কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করে। রানী কিছুই জানে না বলায় তাকে এমন সব অশ্লীল কথা বলে যা কোন সভ্য মানুষের পক্ষে বলা তো দূরের কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ ও গালি বর্ষণের পর ভেদরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার বেত নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাতাড়ি এমন পেটাতে থাকে যে তিনখানা বেত ভেঙ্গে যায়। আবার জিজ্ঞাসা করে, শান্তি ও চঞ্চল কোথায়? রানীর একই উত্তর। ক্ষীপ্ত হয়ে রানীকে তারা সিলিং এর সাথে ঝুলিয়ে দেয় এবং দুই কমান্ডার এবার একই সাথে চাবুক দিয়ে পেটাতে শুরু করে। মারার সময় অসহ্য যন্ত্রণায় রানী বলেছিল, ‘আমাকে এভাবে না মেরে গুলি করে মেরে ফেলুন।’ জবাবে একজন বলে, ‘সরকারের একটা গুলির দাম আছে। তোকে সাতদিন ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলব। এখন পর্যন্ত মারার দেখেছোটা কি?” অল্পক্ষণ পরেই রানী অচেতন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের চাবুক চালানো বন্ধ হয়নি। যখন জ্ঞান ফেরে রানী দেখে সে মেঝেতে পরে আছে। পানি চাইলে তারা তাকে পানি দেয় নাই। ৮ই ফেব্রুয়ারী প্রথমে আমাকে ও পরে রানীকে দোতালায় নেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডামুড্যার আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী ফজলু মিঞা ও ভেদরগঞ্জের সেক্রেটারী হোসেন খাঁ। তারা চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে বলল, তোমার স্বামী ও ছেলেকে ধরিয়ে দাও। অস্ত্র কোথায় আছে বলে দাও। তারা ডাকাত, অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে। আমি বললাম, তারা ডাকাত নয়। তারা সৎ দেশপ্রেমিক, আমার স্বামী রাজনীতি করেন এ কথা কে না জানে। দেশের সাধারণ লোকের অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় তিনি। রানীকে তারা একই প্রশ্ন করেন। রানী কিছুই জানে না বলায় তারা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে। ডামুড্যা ক্যাম্পের কমান্ডার করম আলী এবং ভেদরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার ফজলুর রহমান আমাদের অশ্লীল গালাগাল দিতে শুরু করে এবং আমাকে ও রানীকে একসঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে রানীর বস্ত্র খুলে নেয়। তারপর আমাদের দু’জনকে দু’দিক থেকে চাবুক মারতে থাকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান হলে দেখি দু’জনেই মেঝেতে পরে আছি। রানীর সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার গায়ে কাপড় থাকায় অপেক্ষাকৃত কম আহত হয়েছি। তবুও এই রুগ্ন বৃদ্ধ দেহে এই আঘাতই মর্মান্তিক। সর্বাঙ্গ ব্যাথায় জর্জরিত। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। নড়বার ক্ষমতা নেই। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে নারকীয় হাসি হাসছে। এদের হুকুমে দু’জন সিপাই আমাকে টেনে তুলল। আমি অতিকষ্টে দাড়াতে পারলাম। রানী পারল না। দু’জন রক্ষী তার দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলল ও তার গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিল। তারপর টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে এল। কমান্ডার পেছন থেকে নির্দেশ দেয় ওকে ভালো করে হাটা নয়তো মরে যাবে। সকালে কমান্ডার কয়জন রক্ষীসহ রানীকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হল। বলল, ‘বাচঁবিতো না, চল তোর মাকে দেখিয়ে আনি।’ রানীর সর্বাঙ্গ ফুলে কালো হয়ে গিয়েছে। পা ফেলবার ক্ষমতা নেই। সে অবস্থায় তাকে হেচঁড়াতে হেচঁড়াতে দু’মাইল পথ টেনে নিয়ে যাওয়া হল। রানীর মা রানীকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে যান। কমান্ডার রানীকে তার মার মাথায় পানি দিতে বলে। রানীর মার জ্ঞান এলে রানীর চেহারা এমন কেন জিজ্ঞেস করায় কমান্ডার বলে পুকুর ঘাটে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। রানীকে ছেড়ে দেবার অনুরোধ জানালে কমান্ডার বলে ‘খাসী খাওয়ালে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।’ এরপর আবার দু’মাইল রাস্তা হেঁচড়াতে হেচঁড়াতে তাকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হল। ঐ দিন ছিল ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪। হনুফাকেও তারা ধরে নিয়ে এল ঐদিন। করিম নামের আর একটি কৃষক যুবককেও ওরা ধরে এনেছে দেখলাম রামভদ্রপুর থেকে। তাকে এত মারা হয়েছে যে তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। নড়িয়া থানার পন্ডিতসার থেকেও একজন স্কুল শিক্ষক ও দু’জন যুবককে এনেছে দেখলাম। বিপ্লব নামের একটি ছেলে নাকি মারের চোটে পথেই মারা যায়। রক্ষীবাহিনীর সিপাইরা বলাবলি করছিল। একজন জল্লাদ গর্জন করে বলছিল, ‘দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে!’ শুনেছি মতি নামের আর একটি যুবককেও তারা পিটিয়ে মেরেছে। আর আমাদের ধরে আনার দু’দিন আগে কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটাবার পর হাত-পা বেধে দোতালার ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে। ৯ তারিখ দুপুরের অল্প পরে তারা হনুফা, রানী ও আমাকে নিয়ে গেল পুকুরের ধারে। সেখানে আমাদের একদফা বেত দিয়ে পিটিয়ে চুবানোর জন্য পানিতে নামাল। প্রথমে ওরা আমাদের সাতরাতে বাধ্য করল। আমরা ক্লান্ত হয়ে কিনারায় উঠতে চেষ্টা করি, ওরা আমাদের বাঁশ দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিশ্রান্ত হয়ে যখন আমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না তখন পানি থেকে তুলে আবার বেত মারতে থাকে। শেষের দিকে আমরা যখন আর সাতরাতে পারছিলাম না, তখন আমাদের পানিতে ডুবিয়ে দেহের উপর দু’পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকত।
এভাবে আমাদের তিন দফা পেটানো ও চুবানো হয়। কিছুক্ষণ আগেই করিম মারের চোটে মরে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে আর একটি অল্প বয়সী যুবককে চুবিয়ে অচেতন করে ফেলেছিল। তাকে ঘাটলার উপর ফেলে রাখে। আমার আঁচল দিয়ে গা মোছানোর সময় হঠাৎ ছেলেটি চোখ খুলে তাকায়। আমি চোখের জল রাখতে পারলাম না। রক্ষীরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি ছেলেটাকে নাকি মেরে ফেলেছে। সন্ধ্যার অল্প আগে আমাদের পানি থেকে তুলে ভিজা কাপড়েই থাকতে বাধ্য করল। দারুন শীতে আমরা কাঁপছি। প্রচন্ড জ্বর এসে গেছে সকলের। এমনি করেই রাতভর ছালার চটের উপর পরে থাকলাম। পরদিন রাতে রানীকে আবার নিয়ে গেল দোতালায়। সেখানে আবার তাকে ঝুলিয়ে বেত মারল। ১১ তারিখে আবার রানীর ওপর চলল একই অত্যাচার। রানী জ্ঞান হারাল। রক্ষী সিপাইদের বলাবলি করতে শুনলাম ‘রানী মরে গিয়েছে’। রানীর কাছে শুনলাম তার যখন জ্ঞান হল তখন সে দেখে তার পাশে ডাক্তার বসা৷ রানী জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কে,আমি কোথায়?’ ডাক্তার জবাব দেয়, ‘আমি ডাক্তার, তুমি কথা বলো না।’ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে গেলে রানীকে তারা ধরাধরি করে নিচে আমাদের কাছে নিয়ে এল।
একজন সিপাই রানী ও হনুফাকে বলল, ‘তোরাতো মরেই যাবি। তার আগে আমরা প্রতি রাতে পাঁচজন করে তোদের ভোগ করব। তারা অবশ্য ‘ভোগ’ শব্দটি বলে নাই, বলেছিল অতি অশ্লীল কথা। একদিন রাতে দু’জন রক্ষী সিপাই ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দেয় এবং রানী ও হনুফার মুখ চেপে ধরে। ধস্তাধস্তি করে তারা ছুটে গিয়ে চিৎকার করে। চিৎকার শুনে ক্যাম্পের অন্য রক্ষীরা ছুটে আসে। কমান্ডারও আসে। ওরা তাকে সব বললে সে বলে, “খবরদার এ কথা প্ৰকাশ করবি না। তাহলে মেরে ফেলব।’
রক্ষী সিপাইদের কারও কারও মাঝে মানবতাবোধের লক্ষণ পাচ্ছিলাম। তাদেরই একজন সিপাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছ?’ প্রশ্ন শুনে সে চমকে উঠল। বলল, ‘বাংলাদেশে লেখাপড়া দিয়ে কি করব? আমরা জল্লাদ, জল্লাদের আবার লেখাপড়ার দরকার কি?” এই বলে সে দে ছুট। মনে হয় যেন চাবুক খেয়ে একটি ছাগল ছুটে পালাল। রক্ষী সিপাইদের কানাঘুষায় শুনছিলাম, আমাকে আর হনুফাকে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দেবে আর রানী ও অন্যান্য পুরুষ বন্দীকে মেরে ফেলা হবে। ১২ই ফেব্রুয়ারী আমাকে ও হনুফাকে নিয়ে রক্ষীরা রওনা দিল। আমরা রানীকে ফেলে যেতে আপত্তি জানালাম। রানীও আমাদের সাথে যেতে খুব কান্নাকাটি করছিল। কমান্ডারের কাছে অনুনয়-বিনয় করছিল। কমান্ডার তার সহকর্মীদের সাথে কি যেন আলাপ করে সেদিন আমাদের পাঠানো স্থগিত রাখল। ১২তারিখ রাতেও ওরা আবার রানীকে ঝুলিয়ে হান্টার দিয়ে পেটায়। ১৩ তারিখে তারা রানীকে মারে না, কিন্তু নির্যাতনের নতুন কৌশল নেয়। দম বন্ধ করে রাখে। জোর করে চেপে ধরে রাখে নাক-মুখ-চোখ। এমনি করে জ্ঞান হারালে ওরা তাকে ছেড়ে দেয়।
১৯শে ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে ওরা আমাদের তিনজনকে নিয়েই রওনা দিল প্রায় চার মাইল দূরে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। কলিমুদ্দিন, মোস্তাফা, গোবিন্দ ও হরিপদ থেকে গেল। রক্ষীরা বলাবলি করছিল তাদের মেরে ফেলা হবে। আমরা কিছুদূর এলে ক্যাম্পের দিক থেকে চারবার গুলির আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম ওদের বুজি মেরে ফেলল। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আমাদের শরীরের অবস্থা এমন ছিল যে, হাটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবু আমরা বাধ্য হচ্ছিলাম হাটতে। বোধ হয় আমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। বোধ হয় বেঁচে যাব। এ চিন্তাই আমাদের হাটতে শক্তি যোগাচ্ছিল। অনেক রাতে ডামুড্যা রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ রেখে স্পীডবোট করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। সর্বক্ষণ আমাদের কম্বল চাপা দিয়ে মুর্দার মত ঢেকে রাখা হল। বেদনা জর্জরিত ক্ষত-বিক্ষত শরীর। তার উপর কম্বল চাপা থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। যেন জ্যান্ত কবর! সমস্ত দিন আমাদের ওভাবেই রাখল। খেতে দিল না৷ শেষরাতে আবার কম্বল চাপা দিয়ে জিপে করে ঢাকার দিকে রওনা দিল। আবার সেই সুদীর্ঘ পথ জ্যান্ত কবরের যন্ত্রণা। ঢাকায় আমাদের প্রথমে রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে গেল৷ সে আমাদের খুব ধমকাল। সেখান থেকে নিয়ে গেল তেজগাঁ থানায়, তারপর লালবাগ থানায়। রাতে সেখানে থাকলাম। পরদিন পাঠাল সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে পাঁচদিন রাখার পর আমাদের নিয়ে এল তেজগাঁ গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে। জেলে আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের মত রাখা হত। দিনরাত সেলে বন্দী। একই আহার্য দেয়া হত। সেখানে রাজনৈতিক অভিযোগে আরোও বন্দিনী আছেন। তার মধ্যে ১৭ই মার্চে গ্রেফতারকৃত জাসদ নেত্রী মোমতাজ বেগম আছেন। অস্ত্র আইনে সাজাপ্রাপ্ত পারভীন। আরও একজন আছেন নাম রুমা। সবাইকেই তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী করে রাখা হয়েছে। সাধারণ কয়েদীদের মত খাটানো হচ্ছে। কয়েদীদের মত খাটানো হচ্ছে। এর উপর জমাদারনীরা (মেয়ে সিপাই জমাদার) তাদের নিজেদের জামা-কাপড় সেলাই, কাথাঁ সেলাই, কাপড়-চোপড় ধোয়ানো সবকিছুই মেয়ে কয়েদীদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ”
এমনই হাজার হাজার করুণ কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসন আমলে বাংলাদেশে। যার সবগুলো গুমড়ে মরেছে নির্বিচারে, প্রকাশিত হতে পারেনি। রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার আর একটি চিত্র তুলে ধরা যাক। ঘটনাটি ঘটেছিল পাবনার বাজিতপুরের কোরাটিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আলীর ছেলে রশীদকে খুন করার কাহিনী।
আবদুল আলীর সাক্ষাৎকারটা ছিল নিম্নরূপঃ –
“আমার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল, ‘মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলবো।’ আমি কি তা পারি! আমি যে বাপ। কিন্তু অকথ্য নির্যাতন কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে ছেলের মাথা কেটে দিয়েছি। রশীদ নাকি রাজনীতি করত আমি জানতাম না। একদিন মাতু আর শাহজাহান এসে ধরে নিয়ে গেল। আওয়ামী লীগ অফিসে সারারাত ওরা ওকে বেদম মার মারল। সকালে বলল এক হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। রশীদ স্বীকার করে এল এক হাজার টাকা দেবার। আমার কাছে টাকা চাইল। কিন্তু আমি দিন আনি দিন খাই, মজুর মানুষ। হঠাৎ তিন দিনের মধ্যে এক হাজার টাকা কোত্থেকে দেব? বললাম, তুই বরং পালিয়ে সিলেট চলে যা। রশীদ সিলেট চলে গেল। কিন্তু ১০-১২ দিন পর ফিরে এসে বলল, ‘বাবা মন মানেনা তোমাদের ফেলে থাকতে।’ সিলেট থেকে ফেরার পরই কঠিন অসুখে পড়ল। টাইফয়েড। অসুখ সারার পর একদিন তার মাকে বলল, ‘মা আজ ভাত খাব।’ তার মা শৈলমাছ দিয়ে তরকারী রানল। এমন সময় আওয়ামী লীগের পান্ডারা রক্ষীবাহিনীসহ বাড়ি ঘেরাও করল। অসুস্থ মানুষ। কোন রকমে বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে দৌড় দিল। বাবা আমার জানত না সেখানেও ঘাপটি মেরে বসে আছে আজরাইল। পাষন্ডরা দৌড়ে এসে ধরল তাকে। রশীদ সিরাজের পা ধরে বলল, ‘সিরাজ ভাই, বিমারী মানুষ আমায় ছেড়ে দেন।’ ছাড়ল না। তারপর বাপ-বেটা দু’জনকেই বেধে মার শুরু করল। কত হাতে পায়ে ধরলাম। এরপর মাতু গুলি করল রশীদকে। ঢলে পড়ল রশীদ। আমি নির্বাক তাকিয়ে রইলাম। মরার পর একজন বলল, ‘চল ওর কল্লাটা নিয়ে যাই ফুটবল খেলব।’ মাতু বলল, ‘হ্যাঁ। তাই নেব। তবে ওর কল্লা আমরা কাটব না। তার বাবা কেটে দেবে।’ বলেই আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল কেটে দিতে। আমার মুখে রা নেই। বলে কি পাষন্ডগুলো? চুপ করে আছি দেখে বেদম পেটাতে শুরু করল। বুড়ো মানুষ কতক্ষণ আর সহ্য হয়। সিরাজ এসে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, ‘এক্ষুনি কাট, নইলে তোকেও গুলি করব।’ ইতিমধ্যে দেড় ঘন্টার মত সময় পার হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম না কাটলে ওরা সত্যি আমাকেও মেরে ফেলবে কিনা? শেষে কুঠার দিয়ে কেটে দিলাম মাথা। নিয়ে সউল্লাসে চলে গেল তারা। আল্লায় কি সহ্য করব?”
সিরাজ সিকদার হত্যা মামলায় রাজ্জাক, তোফায়েল এবং নাসিমসহ ৭জন অভিযুক্ত
শেখ মুজিবের হুকুমে সর্বহারা পার্টির প্রধান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে অকথ্য নির্যাতনের পর বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যা প্রসঙ্গে দৈনিক সংগ্রামে ৫ই জুন ১৯৯২ সালে যে প্রতিবেদন ছাপা হয় তা থেকে শুধু তার হত্যা সম্পর্কেই অনেক কিছু জানা যাবে তাই নয়; শেখ মুজিব সরকারের অধিনে তৎকালীন সার্বিক অবস্থা এবং সেই প্রেক্ষাপটে সর্বহারা পার্টির কার্যক্রম সম্পর্কে ও অনেক তথ্য জানা যাবে।
রাজ্জাক, তোফায়েল, নাসিমসহ ৭জন আসামী। সিরাজ সিকদার হত্যা মামলা দায়ের।
স্টাফ রিপোর্টার: পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল ও মোহাম্মদ নাসিমসহ ৭জনকে আসামী করে গতকাল বৃহঃস্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামীরা হলেন: ( ১ ) সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ( ২ ) আব্দুর রাজ্জাক এমপি (৩) তোফায়েল আহমদ এমপি (৪) সাবেক আইজি পুলিশ ইএ চৌধুরী (৫) সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক বর্তমানে সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কর্নেল (অবঃ) নূরুজ্জামান (৭) মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং।
আসামীদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নং ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার আর্জিতে বলা হয়, বিশিষ্ট প্রকৌশলী নিহত সিরাজ সিকদার ছিলেন একজন আজাদী পাগল মুক্ত বিবেকের অধিকারী ও স্বাধীনচেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তার জীবদ্দশায় নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রথমে শ্রমিক সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে কাজ করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তৎকালীন সরকার প্রধান মরহুম শেখ মুজিবর রহমান ঈর্ষান্বিত হয়ে জনসমর্থন হারানোর কারণে, ক্ষমতাচুত্যির ভয়ে ভীত হয়ে সর্বহারা পার্টির কর্মীদের ওপর দমন নীতি চালাতে থাকেন। এমনকি পার্টি প্রধান সিরাজ সিকদারকে হত্যার জন্য বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন ৷
আর্জিতে বলা হয় আসামীরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধিনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১নং থেকে ৬নং আসামী তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্যান্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সাথে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীল নকশায় অংশগ্রহণ করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উল্লেখিত আসামীরা তাদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ইএ চৌধুরীর একজন নিকট আত্মীয়কেও চর হিসাবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারী চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে ঐদিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরাতন বিমান বন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দীদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২রা জানুয়ারী সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা বঙ্গভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাধাঁ অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সাথে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলীসহ আসামীরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন।
আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সকলে তার উপর ঝাপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেন। সে সময় ১নং আসামী মাহবুব উদ্দিন তার রিভলবারের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ঐ সময় সকল আসামী শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। এরপর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং দুই থেকে সাত নং আসামী সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১নং আসামীকে নির্দেশ দেন। ১নং আসামী মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামীদের সাথে বন্দী সিরাজ সিকদারকে শের-এ-বাংলা নগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যায়। এরপর তার উপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২রা জানুয়ারী আসামীদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১নং আসামীর সাথে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যগণ পূর্ব পরিকল্পনা মত বন্দী অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়না তদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে। কিন্তু সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা পুলিশ এনকাউন্টারে সিরাজ সিকদার নিহত হন। আর্জিতে উল্লেখ করা হয় যে, সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবর রহমান জাতীয় সংসদে ভাষণ দেয়ার সময় ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ এই দম্ভোক্তি উচ্চারণের মাধ্যমে তার জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। বিলম্বে মামলা দায়ের করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ঘটনার সাথে সাথে সিরাজের পিতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক মামলা দায়ের করতে যান। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসন ও রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাসের ভয়ে পুলিশ মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শাসকদের সন্ত্রাসের মুখে মোকদ্দমা দায়ের করা যায়নি। দেশে অস্থির অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রী পরিবেশের কারণে আইন-শৃঙ্খলার অস্বাভাবিক অবনতি, ক্ষমতায় থাকা একনায়কত্ব ফ্যাসিবাদী দলের ক্ষমতার দাপটে ভয়ভীতি ও সন্ত্রস-তায় দীর্ঘ ১৭বছর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতার বিচার নীরবে কেঁদে ফিরেছে। ঐ অবস্থায় মরহুমের পরিবার ও সহকর্মীদের পক্ষ থেকে এজাহার ও মামলা দায়েরের ক্ষুদ্রতম সাহসও কারো ছিল না এবং এখনও নেই। বাদী নিজে সিরাজ সিকদারের আদর্শের এক তরুণ, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই আর্জি পেশ করছে।”
এ আর্জির প্রেক্ষিতে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম দরখাস্তখানা তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ জারি করেন। বাদী পক্ষে মামলা পেশ করেন এডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান। তাকে সহায়তা করেন জনাব মোঃ আফজাল হোসেইন। এভাবে চরম নিষ্ঠুরতায় পার্টি নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যার পর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে এবং সরকারি নিষ্পেষণে সর্বহারা পার্টির সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। পার্টিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। জাতীয় পরিসরে পার্টির প্রভাব ও কর্মকান্ড এবং শক্তি ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে। নেতৃত্বের দুর্বলতায় কর্মীরা উদ্দামহীন হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। ফলে জনগণও হতাশ হয়ে সন্দিহান হয়ে উঠে সর্বহারা পার্টির ভবিষ্যত সম্পর্কে। এভাবেই সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর সাথে সাথে হঠাৎ করে জেগে উঠা গণমানুষের মুক্তির এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় স্বৈরশাসনের আগ্রাসী জিঘাংসায়।
শেখ কামাল প্রধানমন্ত্রীর জেষ্ঠ পুত্র ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করে
১৯৭৩ সালের শেষের দিকে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় অবস্থা। সেই সময় ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয় শেখ কামাল।
১৯৭৬ সালের শেষ নাগাদ দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। দেশে বিশৃংখলা সরকারের হাতের বাইরে চলে যায়। প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কিচ্ছা-কাহিনী তখন প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছিল। জনগণ খোলা দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরোধিতা করছিল। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধগতি দৈনন্দিন জীবন সামগ্রী সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে গিয়ে দাড়িয়েছিল। জীবনধারণের নুন্যতম প্রয়োজন মেটাতে জনগণের তখন নাভিশ্বাস অবস্থা। এই অবস্থায় সরকার ৬৩ কোটি টাকার নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লো। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেল। ঐ নৈরাজ্যিক সময়ে এক লোমহর্ষক ব্যাংক ডাকাতি সংঘঠিত হয় রাজধানী ঢাকায়। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ ধাওয়া করে ডাকাতদের। ধাওয়াকালে দু’পক্ষেই গুলি বিনিময় হয়। ৬ জন ডাকাত ধরা পড়ে। এই ৬ জনের একজন ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের জেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। শেখ কামালসহ কয়েকজন দুস্কৃতিকারী আহত হয় পুলিশের গুলিতে। কিন্তু পুলিশের বিবৃতিতে পরে পরে বলা হয়, “দুস্কৃতিকারীদের ধাওয়াকালে দুর্ঘটনাক্রমে শেখ কামাল ও তার সঙ্গীরা পুলিশের গুলিতে আহত হয়।”
মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনী সাহায্য প্রদান কমিটি’ গঠন করা হয়
‘মানুষের জীবন যখন প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল, জীবনের নিরাপত্তা হয়ে উঠেছিল অনিশ্চিত ঠিক তখনই কিছু বিবেকবান নাগরিক মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনী সাহায্য প্রদান কমিটি গঠন করেন।
এ সময় ৩১শে মার্চ ১৯৭৪, জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সভায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ডঃ আহমদ শরীফ। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন কবি সিকান্দার আবু জাফর। এ ছাড়া মীর্জা গোলাম হাফিজকে আইন পর্যালোচনা সাব কমিটির, ডঃ আহমদ শরীফকে প্রকাশনা সাব কমিটির, বিনোদ দাশগুপ্তকে তথ্য অনুসন্ধান সাব কমিটির চেয়ারম্যান, এনায়েতউল্লাহ খানকে কোষাধ্যক্ষ, মওদুদ আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও সৈয়দ জাফরকে সহ-সম্পাদক নির্বাচিত করে ৩৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির ঐ সভায় জনগণের মৌলিক অধিকার ও তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি বিশেষ প্রস্তাবও গৃহিত হয়। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল :-
(১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘গণতন্ত্র’ রাষ্ট্রের একটি নিয়ামক নীতি হিসাবে সংযোজিত হয়েছে। ৩১, ৩২ এবং ৩৩ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শাসনতন্ত্র মোতাবেক জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে এবং প্রত্যেক নাগরিকই নিজেকে গ্রেফতার ও আটকের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আইনের সাহায্য প্রার্থনা করার অধিকার ভোগ করবেন।
(২) কিন্তু এরূপ সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা সত্ত্বেও উপরোক্ত শাসনতান্ত্রিক ওয়াদা এবং নাগরিক অধিকার খেলাপ করা হচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত খবর পাওয়া যায়। এসব খবরে জানা যায় যে, কোন আদালতে হাজির না করেই অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং যে সব সংস্থার নাগরিকদের অধিকার রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার কথা তাদের হাতেই অনেক লোক শারীরিকভাবে গুম হয়ে যাচ্ছে।
(৩) কাজেই যেসব দায়িত্বশীল নাগরিক আইনের শাসনের বিশ্বাসী তাদের মতামত সংগঠিত করা দরকার। এবং এই কাজের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও শান্তিকামী ব্যাপক জণগণের মৌলিক অধিকার হরণের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অভিহিত করে জনমত সংগঠিত করা প্রয়োজন। যাতে শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত আইনের শাসনের নিশ্চয়তাকে নগ্নভাবে উপেক্ষা করে যে ব্যক্তি নিপীড়নের কাজ চলছে তা প্রতিরোধ করা যায়।
(৪) এর সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিগণকে বিনা বিচারেই ধরে রাখা এবং অনেককেই আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই সাজা দেয়া হচ্ছে। সুতরাং এ ধরণের আটক ব্যক্তিদেরকে আইনের সাহায্য দেয়া প্রয়োজন।
(৫) আইনের এই সাহায্য দেয়ার জন্য উপযুক্ত সংগঠন ও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
(৬) তহবিল ছাড়া সংগঠনের প্রয়োজনীয় কাজ যথাযথভাবে চালানো সম্ভব নয়। ককাজেই সুষ্টভাবে এই কাজ চালানোর জন্য একটি তহবিল সৃষ্টি করাও প্রয়োজন।
(৭) এই কমিটির কাজ শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কমিটিকে একটি কার্যকর সংগঠন পরিণত করার জন্য এবং সারাদেশের জনগণ যাতে আইনের সাহায্য পেতে পারে তার জন্য জেলা পর্যায়ে এমনকি তার নিম্ন পর্যায়ে ও এই কমিটি গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে নিম্ন আদালতেও জনগণ আইনের সাহায্য লাভ করতে পারে।
(৮) এই সংগঠন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিক অধিকার রক্ষামূলক সমিতিগুলোর সঙ্গেও ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখবে। ঐ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ঐ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত প্রস্তাবলী ছিল নিম্নরূপঃ
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১, ৩২ এবং ৩৩ নং ধারায় ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কে যে সমস্ত অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে সেগুলো নানান সরকারি বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রের দ্বারা খর্ব বা হরণ করা হচ্ছে শুধু তাই নয়; নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত অনেক অধিকারকে ইতিমধ্যেই কাগুজে অধিকারে পরিণত করা হয়েছে। এই সভা সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সমস্ত আইন প্রত্যাহার করে নেয়া এবং বিভিন্ন সরকারি বাহিনীও প্রশাসন যন্ত্র কর্তৃক ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ ও হামলা বন্ধ করার জন্য সাধারণভাবে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তিকে কোন কারণ না দেখিয়ে অনির্দিষ্টিকালের জন্য আটক রাখা, যে কোন সংবাদপত্রকে যে কোন সময় বন্ধ করে দেয়া এবং ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহের উপর যে কোন প্রকার হামলার তীব্র নিন্দা করা হচ্ছে। সভা বিশেষ ক্ষমতা আইনকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং বর্তমান সংবিধানের বিরোধী বলে মনে করছে এবং তা বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
রক্ষীবাহিনী আইনের মাধ্যমে যে সমস্ত ক্ষমতা রক্ষীবাহিনীর হাতে অর্পন করা হয়েছে সে ক্ষমতাগুলি এতকাল পুলিশের হাতেই একান্তভাবে ন্যস্ত ছিল। যে ক্ষমতা পুলিশের হাতে এতকাল ন্যস্ত ছিল এবং এখনও ন্যস্ত আছে সে একই ক্ষমতা আবার একটি নতুন বাহিনীর হাতে আইনের মাধ্যমে নতুন করে অর্পন করার উদ্দেশ্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রচেষ্টা নয় বরং নানা ক্ষেত্রে যারা সরকারি নীতির সমালোচনা ও বিরোধিতা করবে তাদের ব্যক্তিগত অধিকার হরণ এবং তাদের উপর রাজনৈতিক নির্যাতন পরিচালনা করাই হল এর প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে সংবাদপত্রে বহু বিবরণ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। কমিটি রক্ষীবাহিনীর এই নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করছে এবং রক্ষীবাহিনী আইন বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।
সভা বর্তমান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য ব্যক্তিকে বিনা বিচারে এবং কোন কারণ না দেখিয়ে এ দেশের নাগরিকদের জেলে আটক রাখার নীতি ও কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা ও বিরোধিতা করছে এবং বিনা বিচারে আটক সকল বন্দীর আশু মুক্তির দাবি জানাচ্ছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত হয়েছে। সংবাদপত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সরকার বিভিন্ন বিরোধী মতালম্বী সংবাদপত্রের ওপর নিয়মিত হামলা করে সংবাদপত্র সম্পাদক ও কর্মীদের উপর রাজনৈতিক নির্যাতন চালাচ্ছে এবং এ ব্যাপারে প্রচলিত সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহ নিজেরাই খর্ব ও হরণ করেছে। দৈনিক গণকন্ঠের ওপর সামপ্রতিক হামলা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই সভা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির কার্যকরী সংসদের সদস্য গণকন্ঠ সম্পাদক জনাব আল মাহ্মুদসহ অন্যান্য আটক বা গ্রেফতারী পরোয়ানাপ্রাপ্ত সংবাদপত্র কর্মীদের মুক্তি ও তাদের বিরুদ্ধে জারিকৃত পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।
২৯শে অক্টোবর সারাদেশে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই দিন একই দিন মজুতদারী আর কালোবাজারের দায়ে আওয়ামী লীগের আর একজন সংসদ সদস্য গ্রেফতার হন। ৩০ তারিখে লবন মজুতের জন্য আওয়ামী লীগের এমপি ডঃ শামসুদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।
এ অবস্থায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির উদ্যোগে ১লা নভেম্বর ১৯৭৪ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে শিক্ষক, আইনজীবি, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চিত্রশিল্পী ও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান মন্বন্তর প্রতিরোধের জন্য আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে এক বিরাট সমাবেশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবিদের এত বিরাট সমাবেশ ইতিপূর্বে আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির’ সভাপতি সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দুই ঘন্টার উপর এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এডভোকেট মির্জা গোলাম হাফিজ, ডঃ আহমদ শরীফ, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েত উল্লাহ খান, কামরুন্নাহার লাইলী, নিজামুদ্দিন আহমদ, মহিউদ্দিন আলমগীর, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির মুহাম্মদ জাকারিয়া এবং বদরুদ্দিন উমর। সমাবেশে বিদ্যমান মন্বন্তর পরিস্থিতি ও মৌলিক আধিকার সম্পর্কে ১৭টি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সমাবেশের পর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে একটি মিছিল বের হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায় এবং সেখানেই সমাবেশের কর্মসূচী শেষ হয়। সমাবেশে গৃহিত প্রস্তাববলীর বিবরণঃ
১৯৭৪ সালের ১লা নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মন্বন্তরের গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতাকেও অতিক্রম করেছে এবং এই মম্বন্তর, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্টি হয়নি বরং শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগীদের গণবিরোধী নীতি ও কর্মকান্ডেরই প্রত্যক্ষ পরিণতি। সমাবেশের প্রস্তাবে এই মন্বন্তরকে ‘প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা’ বলে বর্ণনা না করে একে মন্বন্তর বলে ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে বৈদেশিক সাহায্যের একটি শ্বেতপত্র ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের প্রস্তাবে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনে সরকারের বিরোধিতার নিন্দা করে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করার দাবি জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহের প্রতি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও রেশনিং এলাকা সম্প্রসারন ও টেষ্ট রিলিফ চালু করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশের প্রস্তাবে লঙ্গরখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। মন্বন্তর প্রতিরোধ আন্দোলন সমাবেশে রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়। রাজনৈতিক নির্যাতন বন্ধ ও মিথ্যা মামলায় আটক ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি জানানো হয়।
দেশবাসীর মৌলিক অধিকার প্রশ্নে জুলাই মাসে ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি’-র কার্যনির্বাহী পরিষদ জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং এ বিষয়ে সরকারি নীতি লক্ষ্য করে এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সরকার বিরোধী মতামত ও সরকার বিরোধী ব্যক্তিদের দমন করার জন্য রক্ষীবাহিনীকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারা ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এর অস্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে সজ্জিত করেছেন। বাহ্যতঃ সমাজ বিরোধী লোকদের মোকাবেলা করার জন্য প্রণীত এই আইন বস’ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন নির্যাতনের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এর স্থল স্থল ও দারুন অপব্যবহার এবং গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বেপরোয়া রক্ষীবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে সরকার মূলতঃ ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সব ধরণের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং রক্ষীবাহিনী আইনের মধ্যেও তাদেরকে আদালতে উপস্থিত করার যে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে তা না করে তাদের উপর তারা হিংসাত্মক শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মীদের উপর অস্বাভাবিক নির্যাতন ও তাদের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির কাহিনী বিভিন্ন সংবাদপত্রে এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের মাধ্যমেও ফাঁস হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলীয় মতামতকে দমনের চেষ্টা করছেন শুধু তাদেরকে জেলে দিয়ে এবং নির্যাতন ও শারীরিকভাবে খতম করেই নয়; তারা এর জন্য ১৪৪ ধারাও দেশব্যাপী জারি করেছেন। বাহ্যতঃ এটা তারা করেছেন দুই মাস পূর্বে আরম্ভ করা তাদের তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সুবিধার জন্য। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হল এ দেশে বিরোধী মতামত প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে সংগঠিত হতে না দেওয়া। আর একটি বিষয়ে আমরা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। একমাত্র সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই মত প্রকাশে যারা ইচ্ছুক তাদেরকে তা প্রকাশ করার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে ভয়ানক রকম কড়াকড়ি করে এবং নিউজপ্রিন্টের কোটা দিতে অস্বীকার করে সরকার বর্তমানে বিরোধী দলীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোর প্রকাশনা ক্ষেত্রে নিদারুন অসুবিধার সৃষ্টি করেছেন। উপরে উল্লেখিত ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ আইন সাহায্য কমিটি কারাগারের অবস্থার উন্নতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের আশু মুক্তি দাবি করছে।
জনগণের আশা এবং প্রত্যাশা এবং নেতৃবৃন্দের বিশ্বাসঘাতকতা
জনগণ সর্বকালে ত্যাগের বিনিময়ে কিছুই পায়নি কিন্তু নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করে ফুলে ফেপে কলাগাছ হয়েছেন।
সদ্যমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। অনেক আশার বাংলাদেশ। জনগণকে সোনার বাংলার যে স্বপ্ন নেতারা এতদিন দেখিয়ে এসেছেন তা বাস্তবায়িত করার সুযোগ এসেছে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে। জাতীয় পরিসরে মুক্তি সংগ্রাম শ্রেণীভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে-চুড়ে একাকার করে দিয়েছে। ফলে শ্রেণীভেদের অহমিকা ভুলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা : নেতারা তাদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠি এবং দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থে জনগণকে একত্রিত করে তাদের দেশপ্রেম এবং কর্মউদ্দীপনাকে গঠনমূলক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পূর্ণগঠন করে গড়ে তুলবেন এক সোনার বাংলা। সমৃদ্ধ এবং দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্ভর করে বিশ্ব পরিসরে সর্গবে মাথা উঁচু করে দাড়াবে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক। অতীত ঐতিহ্য, নিজস্ব স্বতন্ত্রতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুদূরপ্রসারী বিচক্ষণতা, সঠিক দিক নির্দেশনা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, কঠিন পরিশ্রম সর্বোপরি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাংলাদেশকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে উন্নতির চরম লক্ষ্যে। সুখী সমৃদ্ধ এবং গতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলে তার সুফল প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেবার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। লাখো শহীদের রক্তের বদলে অর্জিত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ।
কিন্তু জনগণের মনে অনেক সন্দেহ। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে কাজের চেয়ে কথার ফুলঝুরি ঝরেছে বেশি, তার চেয়ে বেশি থেকেছে প্রতিশ্রুতি। ‘ক্ষমতায় গেলে জনগণের সার্বিক মুক্তি এনে দেব’ এ ধরণের গালভরা বক্তব্য জনগণ হামেশাই শুনে এসেছে দীর্ঘকাল থেকে। কিন্তু ‘যেই গেছেন লংকা সেই হয়েছেন রাবন’ অর্থাৎ ক্ষমতায় গিয়ে বক্তৃতাকারীরাই নির্মমভাবে পদদলিত করেছেন জনগণ এবং জনগণের দাবিকে। এর মূলে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গণবিচ্ছিন্নতা। দেশের ব্যাপক জনগণের সাথে তাদের কোন সংযোগ নেই। এখানে শাসকের সাথে শাসিতদের কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তাই শাসক গোষ্ঠির বক্তৃতা-বিবৃতি সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করে না। তারা যখন যা খুশি তাই বলেন, তাই করেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে তাদের নীতি ও কাজ হালাল করে নেন। জনগণ ঘুরে ফিরে একই প্রতারণার শিকারে পরিনত হয় বারবার। মোহ এবং ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ রাজনীতিকরা নির্দ্বিধায় বিসর্জন দেন সাধারণ গণমানুষের স্বার্থ।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ১৯৪৭ সাল হতে পরবর্তিকালে যত সরকার এসেছে তারা প্রত্যেকেই মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ধুঁয়া তুলেছে। ১৯৪৭ সালে সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ধুঁয়া তুললেন ইসলামের। ধর্মপ্রাণ মানুষ অতি সহজেই মোহিত হয়েছিল সেই ধূম্রজালে। ১৯৫২ সালে তারা ভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করলেন ইসলাম বিরোধী সংগ্রাম বলে। ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এলান করলেন মৌলিক গণতন্ত্রের। মানুষ বারবার আশাহত হয়েছেন এসমস্ত সরকারের কাছ থেকে। তাদের বিভিন্ন সব শ্লোগান পরিণত হয়েছে শুধু ফাঁকা আওয়াজে। সাধারণ মানুষের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশার বোঝা ক্রমান্বয়ে গিয়েছে বেড়ে। গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে সামাজিক সংকট। অর্থনৈতিকভাবে তারা হয়েছেন দেউলিয়া। পরিণামে জনগণ হয়েছে পশ্চাদমুখী। তাই শুনতে পাই তাদের আক্ষেপ, “পাক আমলেই ভালো ছিলাম। বৃটিশ আমলে ছিলাম আরও ভালো।” ১৯৭১ সালের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের মন- মানসিকতায় কোন গুনগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। তাই তারাও তাদের পূর্বসুরীদের মত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পন করেই পুরনো কায়দায় ধুঁয়া তুললেন মুজিববাদ কায়েম করতে হবে। কিন্তু মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় যখন মুজিববাদের অসাড়তা পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত হল তখন জনাব শেখ মুজিব আবারো একই কায়দায় সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী প্ৰণয়ন করে এবং জরুরী আইন ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করে একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করেন। নজীরবিহীন তার এই শাসনতান্ত্রিক ক্যু’কে তিনি তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার এই সর্বক্ষমতা হরণের ফলে বাহ্যিকভাবে অবস্থা স্থিতিশীল মনে হলেও দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এই অবনতির একটি প্রধান কারণ ছিল শেখ মুজিব ও তার সরকার মনে করত কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি এবং ক্ষমতাবলয়ের লোকজনের মাঝে সুখ-সুবিধা বন্টন করে তাদের খুশি রাখতে পারলেই ক্ষমতায় থাকার সমর্থন লাভ করা যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, আদর্শ অথবা নীতিগত বিশ্বাসের অভাব সর্বোপরি তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশসমূহের সমস্যাদি এবং সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামের মাধ্যমে সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের পূর্ণগঠনের সমস্যা সম্পর্কে তার জ্ঞানের অভাবের জন্যই শুধুমাত্র সুখ-সুবিধা বন্টনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। যে কোন নীতি নির্ধারনের ব্যাপারে তিনি তার অভিমতকেই প্রাধান্য দিতেন। কারো কোন যুক্তিই তার কাছে গ্রহণযোগ্য হত না। তার এই সবজান্তা ভাবও তার প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। পার্টি ও রাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারেও তার যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব ছিল। ঐ ধরণের মানসিকতার জন্যই ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে শেখ মুজিবের মতবিরোধ ঘটে। জনাব খানের অভিমত ছিল প্রশাসনকে নির্দলীয় রাখতে হবে। প্রশাসনের উপর কোন প্রকার দলীয় প্রভাবের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ বিঘ্নিত হবে। কিন্তু শেখ মুজিব তার এই মনোভাবের বিরোধিতা করে যুক্তি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “পার্টির আনুগত্যকে প্রাধান্য দিতে হবে প্রশাসনকে তাদের নিরপেক্ষতা বর্জন করে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্যদের কাজকে সহায়তা করাই হবে প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব এবং এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব বাড়তে সহযোগী হতে হবে প্রশাসনিক যন্ত্রকে।” শেখ মুজিবের দাপটের কাছে জনাব আতাউর রহমান খানকে নিশ্চুপ থাকতে হয়। ফলে ১৯৫৬-৫৭ সালে শেখ মুজিব যখন শিল্পমন্ত্রী তখন তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়৷ তিনি তার সরকারি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তার প্রিয়জন ও পার্টির লোকদের অনেক পারমিট, ব্যাংক লোন, ইনডেটিং লাইসেন্স, শিল্প কারখানা গড়ার পারমিশন প্রভৃতি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি তার স্বভাবসুলভ প্রথায় তার পার্টির লোকজনদের নানাভাবে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। কাউকে দেয়া হয় টাকা, কাউকে চাকুরী, কাউকে অযৌক্তিক পদোন্নতি, কাউকে বানানো হয় রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এভাবেই দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই অযোগ্য ও অসৎ পরিচালকগণ রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মেশিনপত্র, স্পেয়ার পার্টস, কাচাঁমাল ভারতে পাচাঁর করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠেন। সব রকম দেশী ও বিদেশী আমদানিকৃত পন্য সরবরাহ করা হত লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলারদের মাধ্যমে। তাদের সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সুপাত্রগণ !
তাদের কেউই পেশাগতভাবে ব্যবসায়ী ছিল না। তারা তাদের লাইসেন্স পারমিটগুলো মধ্যসত্ব ভোগী হিসাবে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত। ফলে জিনিসপত্রের দাম অনেকগুন বেড়ে যেত। এছাড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের পরিত্যাক্ত ৬০,০০০ বাড়ি আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এভাবেই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের যোগ-সাজসে পাট, চাল, অন্যান্য কাচাঁমাল ও রিলিফের বিস্তর মালামাল ভারতে পাচাঁর করা হয়। এরই ফলে ব্যাঙের ছাতার মত দেশে একশ্রেণীর হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে ভূঁইফোড় বড়লোকের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আমার সাথে শেখ মুজিবের একান্ত আলাপের সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য উল্লেখ্য।
মুজিব পরিবারের সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি প্রায়ই যেতাম ৩২নং ধানমন্ডিতে। কখনো তিনি ডেকে পাঠাতেন, কখনো যেতাম স্বেচ্ছায়। এমনই একদিন দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম,
– দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আপনার পার্টির লোকজনদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আপনি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন।
জবাবে তিনি বলেন,
– আমার দলের লোকজন কি পাক আমলে নির্যাতন ভোগ করে নাই? তারা কি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নাই? তারা কি বিষয়-সম্পদ খোয়ায় নাই? আজ যদি তারা কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেয়েই থাকে তাইলে দোষের কি আছে? তাদেরতো আমি ফালাইয়া দিতে পারি না। এতে কেউ বেজার হইলে আমি কি করতে পারি।
এমন একটি জবাবের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মনে মনে ভেবেছিলাম, আজতো তিনি জাতীয় নেতা, রাষ্ট্রের কর্ণধার। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শুধু দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখা কি তার উচিত? জাতিই বা সেটা আশা করে কি? এ বিষয়ে আর আলাপে না গিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলাম এক অবর্ণনীয় অস্বস্তি নিয়ে। শাসকদলের এই সমস্ত নব্য পুজিঁপতিরা জাতীয় অর্থনীতিতে কোন প্রকার বিনিয়োগ করেননি, তারা শুধু যা ছিল সেটাকেই লুট করে বড়লোক হয়েছেন। জাতীয় সম্পদ শুষে নিয়ে খোকলা করে দিয়েছেন অর্থনীতিকে। এভাবে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মত রাতারাতি বাংলাদেশ কয়েক হাজার পরিবার সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের প্রভাবে পরিচালিত দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। জ্ঞানের অভাব নাকি জনতাকে বোকা বানাবার অতি চালাকি বোঝা মুশকিল! শুধু যে কর্মীরা অসৎ হয়ে উঠেছিল, তা নয়। মুজিব পরিবারের সদস্যগণ ও তার আত্মীয়-স্বজনও দুর্নীতি ও চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। শেখ মুজিবের অতি বিশ্বাসভাজন গাজী গোলাম মোস্তফা জাতীয়ভাবে ‘কম্বল চোর’ উপাধি পান এবং রিলিফের জিনিসপত্র নিয়ে কেলেংকারী ও চোরাচালানের জন্য আর্ন্তজাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের শুধু খুলনায় বাড়িঘর এবং অবাঙ্গালীদের ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়েই ক্ষান্ত হননি। ভারতে চোরাচালানের রিং লিডারও ছিলেন তিনি। শেখ মুজিবের প্রত্যেকটি ভাগীনা (শেখ মনি, আবুল হাসনাত, শেখ শহিদুল ইসলাম) মামুর জোরে শুধু যে রাজনৈতিক আধিপত্যই বিস্তার করে রাতারাতি নেতা বনে যান তাই নয়; অসৎ উপায়ে অর্জিত ধনদৌলতের পাহাড় গড়ে তোলেন তারা। শেখ মুজিবের পুত্রদ্বয় বিশেষ করে শেখ কামালও অসৎ উপায়ে টাকা-পয়সা আয় করতে থাকে। এক ব্যাংক ডাকাতির সাথে শেখ কামালের জড়িত হয়ে পড়ার ব্যাপারে পূর্বেই বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
আওয়ামী সরকারের আমলে দুর্নীতি সম্পর্কে বিখ্যাত সাংবাদিক জনাব লরেন্স লিফসুলজ ৩০শে আগষ্ট ১৯৭৪ সালে Far Eastern Economics এ লিখেন, “অসৎ কাজ ও অসাধু তৎপরতা কোন আমলেই নতুন কিছু নহে। কিন্তু ঢাকাবাসীদের অনেকেই মনে করেন যেভাবে মুজিব আমলে সরকারের ছত্রছায়ায় খোলাখুলিভাবে দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদের লুটপাট হয়েছে তার নজির ইতিহাসে বিরল।” স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে লুটপাট ও দুর্নীতির ফলে কোনরূপ অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক সুফল লাভ করা সরকারের পক্ষে ছিল অসম্ভব। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কহীন পরগাছার মত গজিয়ে উঠা নব্য ধনীদের বিলাসবহুল জীবনধারা ও সহজ উপায়ে অর্জিত অর্থের অস্বাভাবিক অপচয় জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছিল একদিকে, অন্যদিকে তাদের নীতি বর্জিত ক্রিয়াকর্ম সরকার ও সরকারি দলের ভাবমুর্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল জনসাধারণের চোখে। আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই হারানো মর্যাদা আর কখনো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মানুষের আকাশচুম্বি চাহিদা এবং সীমিত জাতীয় সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু লোককে ফায়দা দিতে পারলেও বেশিরভাগ জনগণের কাছ থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় গড়ে তুলে সুষম সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরণের পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত করবে সমাজের প্রতি স্তরে, এটাকে জনগণ জাতীয় বেঈমানীর সমান বলেই মনে করেছিল। আওয়ামী নেতৃত্বের প্রতি তারা বীতঃশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জনগণের আস্থা হারায় আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয় জনগণের সাথে সাথে ক্ষমতাবলয়ের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের আস্থা থেকেও বঞ্চিত হয় আওয়ামী সরকার। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল প্রশাসন, ছাত্র ও যুব সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা বাহিনী।
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ৮ কোটি লোকের অন্নের সংস্থান করা ছিল অতি দুরূহ কাজ। বৈদেশিক বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এবং সাহায্য সংস্থাগুলো মুক্তহস্ত নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুর্নগঠনের জন্য। তাদের সহানুভূতির ফলে ১৯৭৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বমোট ১৩৭৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান লাভ করতে সমর্থ হয়। এছাড়া ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত UNROB এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণের রিলিফ সাহায্যও দান করা হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে।
মাওলানা ভাসানী ছিলেন দিব্যদৃষ্টির অধিকারী
বাংলাদেশের পরিসীমা সম্পর্কে মাওলানার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পরিষ্কার। কিংবদন্তীর নেতা আমাদের শেষ বৈঠকে সেটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।
১৯৭৬ সালের আগষ্ট মাসে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন অপারেশনের জন্য। আমিও তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিলাম। খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খবর পেয়েই তিনি একদিন আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সাংবাদিক জনাব গাজীউল হাসান খানের মাধ্যমে ডেকে পাঠান। সময়মত আমি ও গাজী তার ফ্ল্যাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম সকাল ১০টার দিকে। হাসপাতাল থেকে অপারেশনের পর বাংলাদেশ দূতাবাসই তাকে সেই ফ্ল্যাটে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম তার পুত্র জনাব নাসের খান ভাসানী মাওলানা সাহেবের ঘরে উপস্থিত রয়েছেন। হুজুর আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবছিলেন! অপারেশনের ক্ষত তখনও শুকায়নি। চলাফেরা, পথ্য সব কিছুই রেসট্রিকটেড। আমরা এসেছি শুনে তিনি চোখ মেলে আমাকে ইশারায় তার বিছানায় গিয়ে বসতে বললেন। আমি তার আদেশ অনুযায়ী তাঁর শিয়রে গিয়ে বসলাম। গাজী কাছেই একটা চেয়ার টেনে নিল। সালাম দোয়ার পর হুজুর জিজ্ঞেস করলেন,
-নাস্তা করছস?
-হ্যাঁ হুজুর, নাস্তা কইরাই আইছি। জবাব দিলাম।
-ভালো কথা। তাইলে আমারে নাস্তা খাওয়া। আমি ডিম খামু। স্বল্প দূরে দাড়িয়ে থাকা জনাব নাসের ভাসানীর সাথে চোখাচোখি হল। নিচুগলায় তিনি আপত্তি জানালেন। বললেন, -ডাক্তারকে না জানিয়ে ডিম দেয়া ঠিক হবে না। ক্ষেপে গেলেন মাওলানা। জেদ ধরে বসলেন ডিম তিনি আজ খাবেনই। অগত্যা দু’টো ডিমের পোঁচ করে আনলেন নাসের ভাসানী। ডিমের প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ইশারায় সেটা আমাকে দিতে বলে তাকে বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিলেন মাওলানা। নাসের ভাসানী চলে গেলেন। গাজী বসে আছে চুপচাপ। হুজুর বললেন,
-নে শুরু কর। খাওয়াইয়া দে।
আমি আস্তে একটু একটু করে চামচ দিয়ে তাঁকে ডিম খাওয়াতে শুরু করলাম। এ বয়সে অপারেশনের ধকলে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কথা বলছিলেন অতি ক্ষীণ স্বরে খাওয়ার ফাকেই তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে নিলেন। লন্ডনে কবে এলাম? কেন এলাম? পরিবার কোথায়? সবকিছুরই সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম। খাওয়া শেষে মুখ ধুইয়ে মুছে দিলাম৷ খাওয়ার পর কিছু ঔষধ খাওয়ার ছিল সেগুলোও তাকে খাইয়ে দিলাম। এবার তাকে কিছুটা রিলাক্সড মনে হচ্ছিল। পাশে বসে আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, মাওলানা যেন কোন এক গভীরে তলিয়ে গেছেন। বেশ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করেই বলা শুরু করলেন,
-বাবা, ৯৭ বছরের বেশি বয়স হইয়া গেছে। কবে আছি, কবে নাই কে জানে! তবে একটা কথা তোরে কইয়া যাইবার চাই। এ বুড়া সারাজীবনে যা করতে পারে নাই তুই ও তোর সাথীরা সেটা কইরা বাংলাদেশের ১০কোটি জনগণরে বাচাঁইছোস জালেমের হাত থ্যাইকা। এ বুইড়া তোদের দোয়া দিতাছে, আল্লাহ তোদের হায়াত দারাজ করুক। বলেই তিনি আমার মাথায় গায়ে তার ক্ষীণ হাত বুলিয়ে শরীরে, বুকে ফুঁক দিলেন। তার চোখের কোল ঘেষে তখন পানি বেরিয়ে এসেছে। চোখ বোঁজা অবস্থায় তিনি আমার জন্য দোয়া করছিলেন বিড়বিড় করে। কাছে বসেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না কোন সুরা বা আয়াত পড়ছিলেন তিনি। আমি তার অশ্রুধারা মুছিয়ে দিয়ে আবেগে বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। আমার প্রতি তার স্নেহ ও মমতা দেখে আমার চোখ দু’টোও অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কেমন যেন এক ঐশ্বরিক স্তব্ধতায় মহীয়ান হয়ে চোখ বুজে ছিলেন কিংবদন্তীর নায়ক বাংলাদেশের মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী। সে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ! অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তার হাত ধরে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। তিনি চোখ খুললেন,
-বাবা, তোর জায়গা লন্ডন না, দেশে যাইতে হইবো।
হুজুরের কথার জবাব কি দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে সময় আমাদের সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ভাবছিলাম হুজুরকে সব খুলে বলবো কিনা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনিই বলে উঠলেন,
-জিয়ার সাথে মতের অমিল হইছে; সেইডা আমি জানি; কিন্তু জিয়ারই সব ভুল। আমি গিয়া তারে বুঝামু। কথা শুনলে ভালো আর না বুঝলে আমি জানি কি করতে অইবো। তুই তৈরি থাকিছ। তবে বাবাজান একটা কথা। বুড়া মানুষের কথাটা মন দিয়া হুনিস। যে কাজ শুরু করছস তার শেষ বহুদূরে। বাংলাদেশের মধ্যেই চোখ বন্ধ কইরা উট পাখি হইয়া বইসা থাকলে চলব না৷ চোখ খুইলা চাইতে হইবো সীমানার বাইর। কথাটা একটু ভাল কইরা চিন্তা কইরা দেখিছ। কথা বলতে বলতে তিনি বেশ কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। আমি আস্তে আস্তে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-হুজুর আপনি দোয়া করবেন যাতে আমি আমার নিয়তে কায়েম থাকতে পারি। আল্লাহ্পাক যেন আমারে সুযোগ দেন যাতে একজন মুজাহিদ হিসাবে আপনার ইশারা অনুযায়ী সঠিক রাস্তায় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে প্রয়োজনে কোরবান করতে পারি।
আমার জবাব শুনে বিছানায় শুয়েই তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় আমার বুক ভরে উঠেছিল। ডাক্তার এসে গেছে। আমাদের বিদায় নিতে হবে। সালাম করে আমি আর গাজী বেরিয়ে এলাম। বুকের মাঝে গেথে নিয়ে এলাম মহান নেতার অমূল্য দিক নির্দেশ। সেটাই মাওলানা ভাসানীর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। এর অল্প কিছুদিন পরই তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে……..রাজেউন)। তার মৃত্যুতে জাতি হিসেবে আমরা হারালাম একজন জনদরদী অভিজ্ঞ মুরুব্বী এবং দূরদর্শিতা সম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ।
অর্থনৈতিক সংকট, হতাশা, শেখ মুজিবের ভারত তোষণ নীতি এবং দুর্নীতিপরায়ন অত্যাচারী সরকার সর্ম্পকে জনগণের নেতিবাচক মনোভাব, আইন-শৃঙ্খলা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য সবকিছু মিলিয়ে দেশে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে তখনকার সবকয়টি প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অগ্রণীর ভূমিকায় এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। দেশের সাধারণ গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন চিরজীবন দেখেছেন মাওলানা ভাসানী। মার্কসীয় দর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মুক্তি আসতে পারে এটা সম্পূর্ণভাবে মাওলানা ভাসানী কখনই মেনে নেননি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামী রাষ্ট্রীয় ধারণাকে তিনি অধুনাকালের বৈজ্ঞানিক ও বৈপ্লিবক রাষ্ট্রীয় চেতনায় বাস্তবায়িত করে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে রাষ্ট্রীয় দুঃশাসনের অবসান করতে চেয়েছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক চিন্তার ব্যাখ্যায় তিনি সর্বদা স্রষ্টা ও সৃষ্টির হকের কথা বলতেন। এ সমস্ত কিছু নতুন কথা নয়। ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শন, ক্রিশ্চিয়ান সোস্যালিজম ও আঞ্চলিক সাম্যবাদ, ইউরো কম্যুনিজম এর মধ্যেও একই ভাবধারা বিরাজমান। ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো চেয়েছিলেন ধর্ম, জাতীয়তাবাদ এবং কম্যুনিজমকে একত্রিকরণের মাধ্যমে ‘নাসাকম’ কায়েম করতে। পরে কম্যুনিজম বাদ দিয়ে সে জায়গায় সোস্যালিজম গ্রহণ করে তিনি স্থাপন করেন ‘নাসাসোস’। মাওলানা ভাসানী চেয়েছিলেন ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে কায়েম করতে ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’। ১৯৭১ সালে ভারতে নজরবন্দী হিসেবে মাওলানা ভাসানীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব সাইফুল ইসলাম যখন শেষ বিদায় নিয়ে দেশে ফিরছিলেন তখন মাওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন,
–চাইছিলাম লন্ডন যাব, প্রবাসী সরকার গঠন করব। কিন্তু কুটুম বাড়ি বেড়াইয়া গেলাম। অনেক বড় স্বপ্ন দেইখা দায়িত্ব কান্ধে নিয়া আমার সাথে আসছিলা। স্বপ্ন আমারও ছিল, বাংলার দুঃখী গরীব মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সেটা পাইতে হইলে আর একটা লড়াই লড়তে হইবো। এতো রক্ত ঝরাইলো কিন্তু দ্যাশের মানুষ তো মুক্তি পাইবো না৷ আধা স্বাধীনতা নিয়া দ্যাশে ফিরলে আবার লাইগবো খটাখটি, তাই ভাইবতাছি—-।
– হুজুর কথা ঠিক! কিন্তু সে লড়াইতো বাইরের দুশমনের সাথে সরাসরি নয়। দেশের মধ্যেই সে লড়াই ঘরে ঘরে।
– সেই জন্যই আরও কঠিন আরও হিংসার মনডা পোক্ত কইরা নিয়া যাইতে হইবো৷
একাত্তরের বিচক্ষণ নেতা তার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের যে অবস্থা দেখেছিলেন ঠিক সে অবস্থাই পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছিল মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালী চক্র বাংলার মাটিতে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব কায়েম করে। স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্ত করার সংগ্রামে অগ্রণীয় ভূমিকা গ্রহণ করে অকুতোভয় মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালে জনাব সাইফুল ইসলামের কাছে তার ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ঠিক সেই দায়িত্বই আন্তরিকভাবে পালন করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন মাওলানা। না ভারতের প্রতি দুর্বলতা, না পাকিস্তানের পায়রবী। প্রয়োজনে চৈনীক নীতির তিরষ্কার, মার্কিনীদের অবিশ্বাস, সোভিয়েতের সমালোচক এই হল সিংহ পুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
মুজিবের সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
মুজিব সরকারের ‘দাস-প্রভু’ সম্পর্ক জনগণের মনে ভারত বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলে।
পাকিস্তানী বাহিনীর সারেন্ডারের পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশী সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশে থেকে চলে যায়। বিজয়ী সেনা হিসেবে বা অন্য কোন কারণেই হোক চলে যাবার আগে তারা হাতিয়ার, অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, যুদ্ধের অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং মিল কারখানার মেশিনপত্রও খুলে নিয়ে যায় ভারতে। তারা অধিকৃত শহর ও সেনানিবাসগুলো থেকে আসবাবপত্র, ফিটিংস ফার্নিচার, এমনকি কমোড-বেসিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যেতে থাকে। অনিক পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর ইস্যুতে ছাপা হয়, “ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১০০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র, মেশিনপত্র, যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও কাচাঁমাল ভারতে নিয়ে যায়।” স্বাধীনতার পর খুলনায় ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ভারতের কাছে সরকারিভাবে এক প্রটেষ্ট নোটের মাধ্যমে জানান যে, তার জেলা থেকে ভারতীয় বাহিনী লক্ষ লক্ষ টাকার মালসামগ্রী অন্যায়ভাবে ভারতে নিয়ে গেছে। তিনি ভারতীয় বাহিনীর এ ধরণের লুটপাটের ঘোর বিরোধিতা করেন। ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে আগেও চোরাকারবার চলতো। কিন্তু বাংলাদেশ হবার পর চোরাকারবারের মাত্রা বেড়ে যায় চরমভাবে। স্বাধীনতার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সীমান্ত সম্পূর্ণ খোলা রাখা হয়। মাওলানা ভাসানী দাবি করেন, “বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ে যাওয়া অস্ত্র ও যুদ্ধসম্ভার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে সর্বমোট ৬০০০ কোটি টাকা মুল্যের জিনিসপত্র ও কাঁচামাল ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে চোরাচালানের মাধ্যমে ২০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্রব্য সামগ্রী ভারতে পাচাঁর হয়েছে বলে দাবি করেন বাংলা সংবাদপত্র অনিক। বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরেই ভারতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রফতানির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে নেয়। এর ফলে খোলা বর্ডার দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত দ্রব্যের একটি বৃহৎ অংশ ভারতে চলে যাওয়ার পথ আরো সুগম হয়। ১লা জানুয়ারী ১৯৭২ সরকার বাংলাদেশী টাকার মান কমিয়ে দিয়ে ভারতীয় রুপির সমপর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সরকার একই সাথে আরো ঘোষণা করে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে পাট ও পাটজাত সংক্রান্ত সমস্ত দ্রব্যের ব্যাপারে রফতানির সকল চুক্তি বাতিল বলে গন্য করা হবে। দি বাংলাদেশ অবজারভার ২/১/১৯৭২ সংখ্যায় লেখে, “ব্যবসায়ী এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে উল্লেখিত সরকারি তিনটি সিদ্ধান্তই ভারতের স্বার্থে প্রণীত হয়েছে। ভারতীয় সরকারের চাপের মুখেই এ ধরণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।” এরপর সরকার কর্তৃক টাকার মান কমাবার পর পাটের দাম পুনঃনির্ধারণ করার ফলে সৎভাবে ব্যবসা করার চেয়ে চোরাচালান অনেক লাভজনক হয়ে দাড়ায়। ফলে বাংলাদেশের জীবন সোনালী আশের রপ্তানী হ্রাস পায়। এতে জাতীয় বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যায় এবং জাতীয় সঞ্চয়ও কমে যায়। উৎপাদনে ভাটা পড়ে। ১৯৭৪ সালে রহস্যজনকভাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ফলে অনেক জায়গায় পাটের গুদাম আগুনে পুড়ে যায়। গুদামে ভরা কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য এভাবে পুড়ে যাওয়ার ফলে পাট শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারের প্রচন্ড ক্ষতি হয়। গুদামে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা করতে গিয়ে পাটমন্ত্রী ১৯৭৪ সালে সংসদে বলেন, “আগুন লেগে প্রায় ১৩৯২ মিলিয়ন টাকার শুধু পাটই পুড়ে যায়। পাটজাত দ্রব্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।” প্রচন্ড এই ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে BJMC এবং BJTC সরকারি ভুর্তুকির উপর চলতে থাকে। আজঅব্দি পাট শিল্পক্ষেত্রে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে চলেছে। একদিনের সোনালী আশঁ আজ জাতির গলায় হয়ে পড়েছে ফাঁস।
পক্ষান্তরে যে ভারত কখনোই পাট রফতানি করতে পারত না, এমন কি পাটের অপর্যাপ্ত উৎপাদনের ফলে অনেক জুট মিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অবস্থা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। ১৯৭৩ সালে ভারত ১ মিলিয়ন বেল পাট রফতানি করে বিদেশের মার্কেটে এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে শুধু যে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলোই আবার ফুল শিফটে চালু করা হয় তা নয়; তারা ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে আরো নতুন দু’টো মিল স্থাপন করে। দুই সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত বর্ডার চুক্তি বাংলাদেশের কোন উপকার না করে চোরাচালানের পথকেই প্রশস্ত করে দিয়েছিল। পরে জনগণের জোর আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার ঐ চুক্তি বছর শেষ না হতেই বাতিল করতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে চারটি ঋণ চুক্তি এবং একটি বাণিজ্য চুক্তি সই করে। কিন্তু চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় দিক থেকে গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে চুক্তি অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে ভারতের বিমুখিতা বাণিজ্য ঘাটতির সৃষ্টি করে। ভারত বাংলাদেশের জন্য টাকা ছাপায়। সেই কারণে নকল নোটে সারাদেশ ছেয়ে যায়। ফলে দু’দেশের সরকার বিব্রত হয় জনসম্মুখে। নকল টাকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করে। দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্বল্পতা এবং উচ্চ মূল্য জনগণের জীবনকে যতই আঘাত করতে থাকে ততই জনগণ ভারত বিরোধী হয়ে উঠে। কালোবাজারী, মুনাফাখোররা বৈধ ব্যবসার পরিবর্তে ভারতে চোরাচালান করে বেশি ফায়দা লাভের মানসিকতা জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এভাবে একদিকে সরকার ও জনগণ এবং অপরদিকে বাংলাদেশের জনগণ ও ভারত সরকারের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন, ভারতীয় আমলাদের জাতীয় প্রশাসনে হস্তক্ষেপ, সীমান্ত দিয়ে অবাধ চোরাচালান, ভারতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ভারতে বাংলাদেশী মুদ্রা ছাপানো, রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি, বাংলাদেশের টাকার মূল্য কমানো, ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান এসমস্ত কারণগুলিই ক্রমান্বয়ে জনগণের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে বাংলাদেশের জনগণ।
যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারত সরকার শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে বলে ভুল করে যে বীজ বপন করেছিল তারই প্রতিফল ‘ভারতীয় শোষণ হিসাবে ক্রমশঃ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মনে শিকড় গড়তে থাকে। বন্ধুবেশে বাংলাদেশকে শোষণ করে, জাতীয় সম্পদ লুটপাট করে, বাংলাদেশকে তাদের পশ্চাদভূমি ও মার্কেটে পরিণত করে তাদের নিয়ন্ত্রণে একটি করদ রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নীল নকশায় আওয়ামী লীগ তাদের সহযোগী এ ধারণাও প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীর মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠে। তাদের এ ধারণা আরো জোরদার হয় ভারত কর্তৃক সিকিম দখল করে নেয়ার পর। জনগণের এ চেতনার যথার্থ মূল্য না দিয়ে আওয়ামী সরকার এবং ভারত সরকার এ ধরণের বৈরী মনোভাব দূর করার জন্য কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। ফলে এর প্রভাব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়ে উঠে সুদূরপ্রসারী। এভাবে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে ফাঁটলের সৃষ্টি হয়। সরকারি পর্যায়ে যদিও বা সম্পর্ক বন্ধুসুলভ ও অটুট বলে আখ্যায়িত করা হয় তবুও এটাই সত্যি যে বাংলাদেশের জনগণ ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠে সেই দিন থেকেই যেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে সবকিছু পাঁচার করতে শুরু করল ভারতে এবং দু’দেশের সীমান্ত খোলা রাখা হল ভারতেরই স্বার্থে।
স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান দেশে বিদেশে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়। তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ সরকার দেশ শাসন করতে অক্ষম সে ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। এতে করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারেও প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তান ও তার স্বপক্ষের শক্তিগুলো এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে আর্ন্তজাতিকভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, বাংলাদেশ ভারতীয় দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ভারত অন্যায়ভাবে পাকিস্তানের একটি অংশকে জবরদখল করে রেখেছে। তাদের এ প্রচারণার ফলে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানের বাস্তবতায় আর্ন্তজাতিকভাবে অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অসম্মত হয়। দেশে ফিরে শেখ মুজিব যদিও বা ভারতীয় বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন কিন্তু জনগণ তাদের জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন ও অন্যান্য কার্যকলাপে তাদের ভবিষ্যত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে। মুজিব জনগণের মনোভাব বুঝতে পারেন কিন্তু তার তেমন বিশেষ কিছুই করার ছিল না। মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পর ভারত সরকারের বাংলাদেশে তাদের সামরিক বাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত ও তার বিরুদ্ধে জনরোষের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন রাখার কোন যুক্তিই তখন ভারতের পক্ষেও দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না৷ শুধু তাই নয়, ‘নন এলাইনড মুভমেন্টে’ এর প্রবক্তা এবং পঞ্চশীলা নীতির প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর একটি হয়ে অন্য দেশে তার সেনাবাহিনী রাখার জন্য বিশ্ব পরিসরে ভারতের ভাবমুর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছিল এবং ভারতকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থার চাপে ব্যবস্থা গৃহিত হয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা রদবদল করে স্বাক্ষরিত হবে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত ইশতেহার। চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ধারাও সংযুক্ত করা হবে চুক্তিতে।
এ চুক্তি এবং যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর মাঝে ১৯শে মার্চ ১৯৭২ সালে যখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের আমন্ত্রনে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে আসেন ৷ এ সফরের সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ট্রানজিট ট্রেড এবং বর্ডার ট্রেড বজিয়ে রাখা হবে। দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়গুলোর দু’দেশের কর্মকর্তারা ছয় মাস অন্তর নিয়মিতভাবে মিলিত হয়ে মতবিনিময় ও কার্যপ্রনালী নির্ধারণ করবেন। ঐ সময় ‘জয়েন্ট রিভার কমিশন’ও সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির আলোকেই প্রণীত হয়েছিল। এভাবেই দেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে পূর্বের সুইজ্যারল্যান্ড বানাবার ঘোষণা দিয়ে মূলতঃ ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত করলেন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশকে। তিনি চালনা এবং চট্টগ্রামের বন্দর পরিষ্কারের অজুহাতে সোভিয়েত ও ভারতীয় নৌ বাহিনীকেও আমন্ত্রন জানান। এভাবেই বাংলাদেশকে রুশ-ভারত অক্ষ শক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর উপমহাদেশের আধিপত্যবাদী ভারত নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে দাবি করে ঘোষণা দেয়, “দক্ষিন এশিয়া থেকে বিজাতীয় সবশক্তিকে চলে যেতে হবে।” শুধু তাই নয়; উপমহাদেশের জন্য ভারত এক নতুন ‘মনরোডকট্রেন’ তৈরি করে। ফলে উপমহাদেশের সব ছোট দেশগুলো ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকারে পরিণত হওয়ার আশংকায় ভীত হয়ে পড়ে। ভারতের জন্য এত কিছু করার পরও শেখ মুজিব পানি সমস্যা, সীমান্ত নির্ধারন, সমুদ্রসীমা এবং অর্থনৈতিক জলসীমা নির্ধারণ, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসমূহের দখল প্রভৃতি মূল সমস্যাগুলোর বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারেননি। শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় জাতীয় রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জনমনে সন্দেহ হয় শেখ মুজিব ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই ভারতের পরামর্শে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছেন।
১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারত সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সিকিম দখল করে নেবার পর দক্ষিন এশিয়া উপমহাদেশের জনগণ বিশেষভাবে ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ বাদে দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সাথে ২৫ বছরের চুক্তিকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করে অবিলম্বে ঐ চুক্তি নাকচ করে দেবার দাবি জানায়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সাত দলীয় এ্যাকশন কমিটি সরকারের কাছে যে ১৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন তার প্রথম দাবিই ছিল ভারতের সাথে অসম মৈত্রী চুক্তি বাতিল করতে হবে। তারা অভিমত প্রকাশ করেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বজিয়ে রাখার নীল নক্শা অনুযায়ী এ চুক্তি করা হয়েছে এবং সমগ্র উপমহাদেশের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করার জন্য এই চুক্তি সহায়ক হবে। পাঠকদের অবগতির জন্য ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির কয়েকটি ধারা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে বোধ করছি।
চুক্তির ৬নং অনুচ্ছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৮, ৯ এবং ১০নং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সমস্ত অনুচ্ছেদগুলো দুই দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে। অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হয়, “কোন দেশ অপর দেশের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না এবং অপর দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না এবং তার সীমানাধীন স্থল, জল এবং আকাশ অপর রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতি অথবা অপর রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন কাজে ব্যবহার করতে দিতে পারবে না।” অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত রয়েছে, “প্রত্যেক পার্টিই অন্য পার্টির বিপক্ষে কোন তৃতীয় পার্টিকে যে কোন সামরিক সংঘর্ষে কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না। যদি কোন পার্টি আক্রমণের শিকার হয় কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মুখাপেক্ষি হয়, তবে অনতিবিলম্বে দুই পার্টিই পারষ্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই আক্রমণ কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মোকাবেলা করার জন্য। এভাবেই দুই দেশের শান্তি ও সংহতি বজিয়ে রাখা হবে।” অনুচ্ছেদ ১০-এ বর্ণিত আছে, “এই চুক্তির পরিপন্থী কোন প্রকার অঙ্গীকার কোন পার্টিই অন্য কোন দেশ বা একাধিক দেশের সাথে খোলাভাবে কিংবা গোপনে করতে পারবে না।” স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এ ধরণের কোন চুক্তির কি প্রয়োজন ছিল? ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তিন দিকই ঘিরে রয়েছে ভারত। পূর্বদিকে সামান্য সীমান্ত রয়েছে বার্মার সাথে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। অনেকের মতে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এ ধরণের কোন চুক্তির প্রয়োজন ছিল না। যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা নেই বিধায় কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চুক্তির ৮,৯ এবং ১০নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সামরিক সাহায্য চাওয়ার মানে দাড়ায় বাংলাদেশ ভারতের কাছে সম্পর্কের দিক দিয়ে হীনভাবে অনুগত।
চুক্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্কে যে শর্ত ছিল তার ফলে ভারত একটি অগ্রবর্তী শিল্পে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি প্রকৌশলিক সাহায্য, ভারী এবং মাঝারি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষি দুই ক্ষেত্রেই অবকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ভারতের অর্থনীতি ও শিল্প কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে আকারে অনেক বড় ও উন্নত। তারা প্রায় প্রয়োজনীয় সবকিছুই নিজেরা তৈরি করে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট ও দুর্বল। শিল্প ক্ষেত্রেও অনগ্রসর। প্রয়োজনীয় তেমন কিছুই বাংলাদেশে তৈরি হয় না। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের মাঝে উল্লেখিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অর্থনৈতিক সহযোগিতার মানেই হচ্ছে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে সব বিষয়ে একটি বাজারে পরিণত করা। অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে ভারতের বিশাল অর্থনীতির অঙ্গীভূত করে নেয়া। চুক্তিতে ব্যক্ত ইচ্ছানুযায়ী ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং গঙ্গা অববাহিকার পানি সম্পদের উন্নয়ন ও সুব্যবস্থা করার ধারার প্রভাব হচ্ছে অনেক সুদূরপ্রসারী। সাহায্য ও সহযোগিতার যে কোন চুক্তি যদি অসম দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত হয়, একটি বৃহৎ এবং ক্ষমতাশালী এবং অপরটি ছোট এবং দুর্বল রাষ্ট্র তাহলে সেই চুক্তির সুবিধা সাধারণভাবেই পাবে তুলনামূলকভাবে যে দেশ বড় ও শক্তিশালী। এ অকাট্য সত্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের অনেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু তাদের প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের ভেতরের ভারতপন্থীদের প্ররোচণায় শেখ মুজিব ২৫ বছরের আত্মঘাতী মৈত্রী চুক্তি সই করেছিলেন।
সার্বভৌমত্বের মত বিষয়েও ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। স্থলসীমা ছাড়াও, ইকোনমিক জোন সম্পর্কে দু’দেশের ভিন্ন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জলসীমা নির্ধারণ করতেও দীর্ঘ সময় লাগবে। আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের উপকূলের সমুদ্র সীমানাও এ পর্যন্ত ঠিক করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালে বিতর্কিত কিছু জায়গার ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা ভারতের কাছ থেকে পাইনি। সমুদ্রসীমা ও ইকনোমিক জোন সর্ম্পকে ভারতের অবস্থানের ভিন্নতার কারণে যে ছয়টি তেল কোম্পানী ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। তাদের একটি কোম্পানী এ্যাসল্যান্ড অয়েল কোঃ-কে তৈলকুপ খনন করতে বাধা দেয় ভারত। ভারতীয় প্রতিবাদের মুখে ঐ তেল কোম্পানীকে খনন কার্য বন্ধ করে ফিরে চলে যেতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কয়েক জায়গায় নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও কিডন্যাপিং এর মত পদক্ষেপের মাধ্যমে কোম্পানীগুলোকে ভয়ও দেখান হয় । এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিছুই করতে পারেনি। বঙ্গোপসাগরের মুখে জেগে ওঠা ভূ-খন্ড বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। হারিয়াভাঙ্গা নদীর মোহানায় দক্ষিণ তালপট্টি নামের এক ভূ-খন্ড জেগে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে দুই সরকারের মাঝে সমঝোতা হয় যৌথ সার্ভের মাধ্যমেই তালপট্টির মালিকানা নির্ধারন করা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে সমঝোতার বরখেলাপ করে ভারতীয় নৌ বাহিনী একদিন তালপট্টি দখল করে নিয়ে সেখানে ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয় একতরফাভাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পানি ভাগাভাগির সমস্যা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালার পানিই হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জীবন। দেশের বেশিরভাগ নদ-নদীর উৎপত্তি হয়েছে উত্তরে হিমালয় পর্বতমালায় এবং বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, তিস্তা, যমুনা, গোমতি, মুহুরী, সুরমা, থোয়াই, কুশিয়ারা, পদ্মার প্রবাহের উপরেই নির্ভরশীল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। আর্ন্তজাতিক নদী গঙ্গার উপর একতরফাভাবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করায় জনগণের উপর নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ অভিশাপ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ আজ মরু প্রায়। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে; একই হারে বাড়ছে লবনাক্ততা। লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তন আজ বাংলাদেশের জন্য এক হুমকির সৃষ্টি করেছে। গঙ্গার পানি বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের জীবনসংস্থানের জন্য অতি প্রযোজন। ফারাক্কা বাঁধের ফলে পানির অপ্রতুলতা দু’দেশের মধ্যে তিক্ততাই বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজনের প্রতি সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে একটি ন্যায়সংগত সমাধান খুঁজে পাবার চেষ্টা না করা হলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে ভবিষ্যতে। ভারত তিস্তা নদীর উপরও বাঁধ দিয়েছে একতরফাভাবে। এ নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারেও তারা এখন পর্যন্ত কোন আলোচনা করছে না। বাঁধ দেয়ার ফলে নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা ক্ষতিগ্রস’ হচ্ছে। এছাড়া ভারত খোয়াই, গোমতি এবং আরো প্রায় দশটা নদীতে বাঁধ দিচ্ছে একতরফাভাবে, কোন আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। এর ফলে খরার সময় বা শুষ্ক মৌসুমে কৃষির জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন হবে কৃষকরা তা পাবে না। ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং গঙ্গা অববাহিকার পানি সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারের জন্য ভারত ইতিমধ্যে আবার এক লিংক ক্যানালের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। তারা চাচ্ছেন ক্যানাল খুড়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি সরবরাহ করা হবে গঙ্গা ও হুগলী নদীর নাব্যতা বাড়াবার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোন যুক্তিতেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মত পোষণ করেন। যদিও মৈত্রী চুক্তিতে বলা হয়েছে, “আমাদের দুই দেশের মাঝে সীমান্ত হবে শান্তি ও বন্ধুত্বের অনন্তকালের সাক্ষী।” কিন্তু সামরিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একথার ভিন্ন মানেও খুজে পাওয়া যায়।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন অংশগুলোকে একত্রিকরণের মাধ্যমে একটি অখন্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থা কায়েম করার যে সামরিক উদ্দেশ্য ভারত অনেকদিন ধরে মনে পোষণ করে আসছে তার সাথে স্বাধীনতার পরপর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচারণা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার ‘বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র আর গরীব দেশের জন্য কোন বড় আকারের সেনা বাহিনীর প্রয়োজন নেই’ এর একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। ভারতের লক্ষ্য অর্জন করার জন্যই আওয়ামী সরকার এ ধরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। অনন্তকালের শান্তি আর বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনার সব পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমেই। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সময় ও বাস্তবতার সাথে পরিবর্তনশীল। তাছাড়া দু’টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যেখানে রয়েছে হাজারও সমস্যা সেখানে অনন্তকালের শান্তি আর বন্ধুত্বের গ্যারান্টি পাওয়া অসম্ভবই শুধু নয় অবাস্তবও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি যেখানে সম্পুরক না হয়ে অনেকক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতামূলক এবং অসম অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ফলে যেখানে চোরাচালান ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে দুর্বল প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্ব কি করে জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারে? তথাকথিত অনন্তকালের শান্তিই বা কি করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরণের সমস্যাই থাকতে পারে। তাই বলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সেগুলোর সমাধান করা যাবে না এমনটা ভাবাও যেমন ঠিক নয় তেমনি দু’দেশের মধ্যকার সব সমস্যা সংঘাতের মাধ্যমেই শুধু নিরসন করা সম্ভব এ ধারণাও সঠিক নয়। দু’দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা, পরিপক্কতা, গতিশীলতা ও মানবিক দৃষ্টিকোন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার আন্তরিকতাই শুধু গড়ে তুলতে পারে বন্ধুত্ব। এর জন্য পোষাকি চুক্তির প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে অবিশ্বাস, দমন নীতি, একে অপরকে ঠকাবার প্রচেষ্টা যেথানে প্রকট সেখানে স্বাক্ষরিত চুক্তিও কোন কাজে আসে না।
“এক নেতা এক দেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ !”
এ ধরণের শ্লোগান কোনভাবেই গণতান্ত্রিক নয়। হিটলারের জার্মানির ফ্যাসিস্ট নাজিদের অথবা মুসোলিনির ইতালির ফ্যাসিস্টদের শ্লোগানের সাথে এর মিল খুজে পাওয়া যায়। ব্যক্তি পুজাঁ যে কোন নেতার জন্য ভালোর চেয়ে মন্দই ডেকে আনে। ইতিহাসে এ ধরণের বহু নজির রয়েছে।
১৯৭৫ সালের আগে আইনজীবিরা সুপ্রীম কোর্ট এবং হাই কোর্টের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক বিষয়ে রায় দেন। সরকার কর্তৃক বেআইনীভাবে আটককৃত অনেক রাজবন্দীদের তারা মুক্তিও দিয়েছিলেন সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। রক্ষীবাহিনীর অসামাজিক বেআইনী কার্যকলাপ সম্পর্কে আইনজীবিরা বিশেষভাবে সমালোচনা করতে থাকেন। কোন একটি কেসের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্ট রায় দানকালে বলে, “দেশের প্রচলিত সব আইন ও প্রচলিত বিধি লঙ্ঘন করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।” সুপ্রীম কোর্ট অভিমত প্রকাশ করে, “রক্ষীবাহিনী কোন আইনের ভিত্তিতে তাদের কার্যকলাপ জারি রেখেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।” এ ব্যাপারে Far Eastern Economic Review এর জানুয়ারীর ১০তাং ১৯৭৫-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন Mujib’s Private Army’ এর প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আইনজীবিদের সরকার বিরোধী কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ মুজিব আইন বিভাগের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার জন্য আদেশ জারি করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে তার অধ্যাদেশে বলা হয়, “দেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ দেশের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগ করা হবে। প্রেসিডেন্টের আদেশক্রমে যেকোন বিচারককে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে তার খারাপ ব্যবহার কিংবা অযোগ্যতার কারণে।” ফলে আইন বিভাগ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রধানের ত্রিয়াণকে পরিণত করা হয়।
জনগণের ফান্ডামেন্টাল রাইটস ও মানবিক অধিকার কায়েম রাখার জন্য সুপ্রীম কোর্টের সাহায্য নেবার পথও বন্ধ করে দেন শেখ মুজিবর রহমান। সংশোধিত বিধিতে বলা হয়, “এ আইনের বলে সংসদ গণতান্ত্রিক কোর্ট, ট্রাইবুনাল কিংবা কমিশন গঠন করতে পারবে। এসমস্ত গঠিত করা হবে জনগণের ফান্ডামেন্টাল এবং মানবিক অধিকারগুলো যে সম্পর্কে শাসনতন্ত্রের পার্ট থ্রি-তে বর্ণিত রয়েছে সেগুলোর নিশ্চয়তা প্রধান করার স্বার্থে।” এভাবেই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং দেশের সব আইন তার মুঠোয় নিয়ে শেখ মুজিব দেশে কায়েম করলেন স্বৈরাচারী একনায়কত্ব। শ্লোগান তোলা হল, ‘এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ !
এ শ্লোগান গণতান্ত্রিক শ্লোগান নয়। এটা ছিল নাৎসী জার্মানীর হিটলার কিংবা ইটালীর মুসলিনির শ্লোগান। ব্যক্তি পুজাঁ কোন নেতার ভাবমুর্তিকে উজ্জ্বল করার পরিবর্তে তার চরম ক্ষতিই সাধন করেছে। এর নজির ইতিহাসে অনেক খুজে পাওয়া যাবে।
১৯৭৫ সালের ২১শে জুন রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সারা বাংলাদেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। ১৬ই জুলাই শেখ মুজিব ৬১ জন জেলা গভর্ণরের নাম ঘোষণা করেন। তারা ১লা সেপ্টেম্বর থেকে জেলা প্রশাসনের সর্বময় অধিকর্তা হয়ে বসবেন সেটাই ছিল সরকারি সিদ্ধান্ত। ৬১জনের মাঝে ৪৪ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং বাকি ২৭ জন ছিলেন বাছাই করা সাংসদ। জাতীয় সংসদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেয়া সদস্যবৃন্দ। নিয়োজিত গভর্ণরদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন প্রাক্তন CSP অফিসার, ৬ জন ছিলেন প্রাক্তন EPCS অফিসার, কাদের সিদ্দিকী, সেনা বাহিনীর একজন কর্নেল এবং পার্বত্য চট্টগাম থেকে দু’জন উপজাতীয় নেতা।
এই ৬১জন গভর্ণরদের বিশেষ রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়। প্ল্যান অনুযায়ী ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে প্রশিক্ষণ শেষে তারা যার যার জেলায় গিয়ে তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। তাদের প্রত্যেকের অধিনে দেয়া হবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অর্ধেক ব্যাটেলিয়ন। তারা সরাসরিভাবে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের কাছেই জবাবদিহি থাকবেন। রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতি গভর্ণরের অধিনে একটি পূর্ণাঙ্গ রক্ষীবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন নিয়োগ করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। এসমস্ত গভর্ণরদের অধিনে রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের অধিনস্থ জেলায় বাকশাল বিরোধীদের সমূলে নির্মূল করে মুজিব ও তার পারিবারিক শাসন বংশানুক্রমে বাংলাদেশের মাটিতে পাকাপোক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের পদানত একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা।
করবেন। তাদের প্রত্যেকের অধিনে দেয়া হবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অর্ধেক ব্যাটেলিয়ন। তারা সরাসরিভাবে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের কাছেই জবাবদিহি থাকবেন। রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতি গভর্ণরের অধিনে একটি পূর্ণাঙ্গ রক্ষীবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন নিয়োগ করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। এসমস্ত গভর্ণরদের অধিনে রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের অধিনস্থ জেলায় বাকশাল বিরোধীদের সমূলে নির্মূল করে মুজিব ও তার পারিবারিক শাসন বংশানুক্রমে বাংলাদেশের মাটিতে পাকাপোক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের পদানত একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা।
নির্যাতন ও সংগ্রাম
আওয়ামী বাকশাল শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন বিশদ পর্যালোচনার দাবি রাখে।
আওয়ামী-বাকশাল বিরোধী আন্দোলনকালে বিভিন্ন বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। তাদের দলীয় অবস্থা, আন্দোলনের স্বরূপ, দলীয় নীতি ও কার্যপ্রনালী, সাফল্য, ব্যর্থতা, দলীয় দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্ন তৎপরতা প্রভৃতি বিষয় এবং তাদের প্রতি জনসমর্থন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারা যাবে এ আলোচনার মাধ্যমে। বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দলীয় প্রতিরোধ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকরী ছিল এবং তারা কি কখনও একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে পারত কি না সে সম্পর্কেও জনগণের মনোভাব বোঝা যাবে৷ সে সংগ্রাম ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি কেন? ঐক্য গঠন করার পথে বাধা ছিল কোথায়? ঐক্য প্রতিষ্ঠার আদৌ কোন চেষ্টা হয়েছিল কিনা? এসমস্ত বিরোধী দলগুলোর প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল উৎপাটন করার ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী সরকার কি নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তারা তাদের উদ্দেশ্যে কতটুকু সফলকাম হয়েছিল, এসমস্ত প্রশ্নের জবাব খুজে পাবার মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক পট পরিবর্তনের যুক্তিকতা।
গোড়া থেকেই আওয়ামী-বাকশালী বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। কিন্তু তার সেই বিরোধিতার আগুন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জাতিকে সংগঠিত করতে পারেনি তার দল। ‘৭১ এর সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ভাসানী ন্যাপের দলীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর ভেঙ্গে পড়া সেই দলকে আবার গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করার মত অবস্থা ছিল না মাওলানা ভাসানীর। বার্ধক্যের জড়া এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যই ছিল এর প্রধান কারণ।
আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসনের বিরোধিতা করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই জন্ম হয়েছিল জাসদের। ষাটের দশকের প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একাংশ দাবি জানায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই কায়েম করতে হবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। জনাব সিরাজুল আলম খানই ছিলেন এ দাবির মূল প্রবক্তা। জনাব আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকেই জনগণের মধ্যে এ দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা করেন এবং এ দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই গ্রুপ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দিলে ১লা মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন বলে দাবি তোলেন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রসিদ্ধ বটতলায় জনাব রব সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর পরদিনেই এক সভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে হঠাৎ করেই জনাব সিরাজ স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। রব-সিরাজ গ্রুপ মনে করেন ইয়াহিয়া সরকারের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনার ফলে জনগণের বিপ্লবী চেতনা নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল; তাই তারা শেখ মুজিবকে সব আলোচনা বন্ধ করে দেবার জন্য অনুরোধ জানান। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ছাত্রলীগের ঘোষণাপত্র এর সাক্ষ্য দেয়। ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেছিলেন জনাব মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রতি আস্থা প্রদর্শন না করে জনাব তাজুদ্দিনকে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করার পরামর্শ দেন ও তাদের কথা মেনে নেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ফলে জনাব তাজুদ্দিনের সাথে তাদের মত পার্থক্য দেখা দেয়। জনাব তাজুদ্দিন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের উপর এই গ্রুপের প্রচন্ড প্রভাব ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজুদ্দিন যখন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তখন তারা বুঝতে পারলেন প্রবাসী সরকারের অধিনে মুক্তিযুদ্ধ করলে তারা তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা দু’টোই হারাবেন। তাই তারা পরবর্তিকালে ভারতীয় সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সহায়তায় তাজুদ্দিন সরকারের আওতার বাইরে মুজিব বাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনীর সার্বিক কর্তৃত্ব ছিল তাদের হাতে। ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এ বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলতে ভারত সরকার সাহায্য প্রদান করে। যদিও মুজিবের ফিরে আসার পর তার প্রধান্যই বজায় রাখার জন্য আপাতঃ দৃষ্টিতে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে বলে জনগণ মনে করে।
কিন্তু রব-সিরাজ গ্রুপ মুজিব পূজায় কতটুকু বিশ্বাস রাখতেন সেটা ছিল একটা বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২ সালেই ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, এর মাঝে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেন সর্বদা পর্দার অন্তরালে থাকা নেপথ্যের নায়ক জনাব সিরাজুল আলম খান। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে ৩১শে অক্টেবর ১৯৭২ সালে মেজর জলিলকে প্রেসিডেন্ট এবং জনাব রবকে সাধারণ সম্পাদক করে আত্মপ্রকাশ ঘটে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ বা জাসদ-এর। নতুন রাজনৈতিক দলের মূল তাত্ত্বিক গুরু হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জনাব সিরাজুল আলম খান। জাসদের অভিমত ছিল- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন জাতির মুক্তি সংগ্রামের রূপ নিচ্ছিল ঠিক তখনই তাকে বন্ধ করে দেয়া হয় চক্রান্তের মাধ্যমে। স্বাধীনতা সংগ্রামকাল থেকেই জাসদ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে আসছিলেন বলে তারা দাবি করেন। তাদের সেই প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর। তারা দাবি তোলেন জনগণের ৮% সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্পদের ৮৫% লুট করে নিয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করছে। ( জাসদের ১৯৭৩ সালের ঘোষণাপত্র দ্রষ্টব্য)। জাসদ নিজেকে সত্যিকারের সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ (BCL) এর গণসংগঠক হিসাবে দাবি করে। বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট লীগ গঠন করেন জনাব সিরাজুল আলম খান। এটি ছিল একটি গোপন সংগঠন। যুদ্ধকালীন সময় থেকে জাসদের জন্ম পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন- – বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ কতৃর্ক গণকন্ঠ নামে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। অতি পরিচিত ও বিখ্যাত প্রগতিশীল কবি আল মাহমুদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।
দেশের অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলোর মতই দেশের বিভিন্ন সমস্যাগুলি জনগণের কাছে তুলে ধরে জাসদ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগের ছাত্রফ্রন্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে তৎকালীন জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বসমূহের বিশ্লেষন করে জাতীয় বিপ্লবকে বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে দ্বন্দ্বগুলোর অবসান ঘটানোর জন্য বিপ্লবের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে দলিলে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ সমাজতন্ত্রের উত্তরণে তিনটি ধাপ নির্ণয় করে বলে, “স্বাধীনতা সংগ্রামের তৃতীয় ধাপের পরিসমাপ্তি ঘটবে আওয়ামী লীগ ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টদের সাথে সর্বহারাদের রক্তক্ষয়ী ভবিষ্যত সংগ্রামের মাধ্যমে।” সংসদীয় রাজনীতিকে স্বার্থবাদী মহলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসাবে বর্ণনা করা হয়। গ্রামের সামন্তবাদীর অবশেষ, মধ্যসত্বভোগী এবং উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের সর্বহারাদের শত্রু শ্রেণী বলে অভিহিত করা হয় সেই দলিলে। তাদের দলিলে বলা হয় জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারার শাসন কায়েম হওয়ার আগে জনগণ বর্হিঃশোষণের শিকারে পরিণত হবে কারণ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদের পদানত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগের তত্ত্ব অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদী শোষণ পরিচালিত হবে মূলতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঋন ও অনুদানের মাধ্যমে । তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হবে রুশ ও ভারতের দ্বারাও। এজন্য প্রয়োজনীয় শোষণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্কের নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাদের রিপোর্টে বলা হয়- যুক্তিহীন এবং অন্যায়ভাবে ঢাকার পরিবর্তে দিল্লীতে ইন্দো-বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ মনে করে কোন লীগ মনে করে কোন এক পর্যায়ে গণচীন বাঙ্গালীদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। এই প্রেক্ষিতে যদিও কম্যুনিষ্ট লীগ আর্ন্তজাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের দ্বন্দ্বের বাইরে নিজেদের রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল; তথাপি চীনপন্থী অন্যান্য সাম্যবাদী লেনিনবাদী জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে বন্ধুসুলভ মনোভাব পোষণ করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়েছিল রিপোর্টে। জাসদ মুক্তি বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের মাঝ থেকে দলীয় সদস্য রিক্রুট করতে থাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও তাদের প্রকাশনী লাল ইশতেহার এর মাধ্যমে গোপন সেল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে জাসদ।
২০শে জানুয়ারী ১৯৭৪ সালে জাসদ, বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ এবং জাতীয় শ্রমিক লীগ (জাসদপন্থী) যুক্তভাবে বাংলাদেশের উপর মার্কিন, রুশ এবং ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরোধিতা করে এক হরতালের ডাক দেয়। হরতালের সময় নেতারা শিক্ষক এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি জানান। তারা বাংলাদেশের সর্বোপরিসরে দুর্নীতি, বিশেষ জরুরী আইন, সরকারের স্বজনপ্রীতি এবং বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে পারমিট লাইসেন্স বিতরণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেশব্যাপী সেদিন পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ১৭ই মার্চের মধ্যে সরকার তাদের দাবি না মানলে তারা ঘেরাও এর হুমকি দেন। ১৭ই মার্চ জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে। পুলিশ ঘেরাও ভঙ্গ করে। পুলিশের গুলিতে ৩জন নিহত ও ১৪ জন গুরুতরভাবে আহত হন। মেজর জলিল, জনাব রব এবং আরো ৪০জন জাসদ কর্মী আহত অবস্থায় বন্দী হন। গোপন সংগঠনের অন্যান্য নেতাদের সাথে জনাব সিরাজুল আলম খান সেদিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে তারা গ্রামাঞ্চলে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। সেদিনের ঘটনাকে অনেকে চরম হঠকারী প্ররোচণা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাসদ সম্পর্কে তার ‘স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়’ গ্রনে’ লেখেন, “মুসলিম লীগের ঘর ভেঙ্গে একদা আওয়ামী লীগ বের হয়ে এসেছিল। অনেকটা সেই পদ্ধতিতেই আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এরা নিজেদেরকে বলছে র্যাডিকেল- চরমপন্থী। তাদের তরুণ ও বিরাট কর্মী বাহিনী যে সমাজতন্ত্রের ডাকেই এই দলে এসে যোগ দিয়েছিল তাতে সন্দেহের কোনই কারণ নেই। কিন্তু নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা মনে হয় সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। আওয়ামী লীগারই ছিলেন আসলে। তাদের ইচ্ছা ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করবেন। কিন্তু শেখ মুজিব তার অবস্থান ছেড়ে বিপ্লবী হতে রাজি হননি ফলে এরা এগিয়ে গেছেন নিজেদের পথ ধরে। এদের দলের নামের সঙ্গে ‘জাতীয়’ এর যোগাযোগ আপতিক ঘটনা বলে মনে হয় না। এরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন। নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থই দেখছিলেন (যার সঙ্গে তাদের নিজেদের ভবিষ্যত ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত)। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের আওয়াজ দিয়েছেন যাতে লোক জড়ো করা যায়, নায়ক হওয়া যায় নতুন প্রজন্মের ও নতুন বাংলাদেশের। শেখ মুজিব যদি আর না ফেরেন তাহলে বামপন্থীদের কি করে মোকাবেলা করা যাবে তার আগাম ব্যবস্থা হিসেবে এরা একাত্তরে মুজিব বাহিনী গড়েছিলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের রাজনীতি ছিল বুর্জুয়াদের রাজনীতিই। যদিও তাদের আওয়াজগুলো ছিল ‘বিপ্লবী’; ফলে তাদের নেতারা জাতীয় পুর্নগঠনের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকেই সমর্থন দান করে যাচ্ছিলেন এতে বিস্ময়ের কোন অবকাশ নেই।”
তার এই বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার ভার রইলো পাঠকদের উপর। জাসদের এবং মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠে। ভারতীয় সরকার চার খলিফার মাধ্যমে প্রথমে মুজিব বাহিনী, পরে খলিফাদের মূল ব্যক্তিত্ব জনাব সিরাজুল আলম খানের প্রচেষ্টায় জাসদ সৃষ্টি হওয়ায় বিশেষভাবে উপকৃত হয়। শুধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ‘র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সাথেই জনাব সিরাজুল আলম খানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল তা নয়; সংগ্রামকালে ১৯৭১ সালে ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সাথেও জনাব সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রনেতারা দিল্লী গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজুদ্দিনের বিরোধিতা করে তাদের নেতৃত্বে মুজিববাহিনী গঠন করার প্রস্তাব পেশ করলে ভারত সরকার প্রধান শ্রীমতি ইন্দীরা গান্ধী ও ‘র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং তাদের সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন মূলতঃ দু’টো সুদূরপ্রসারী কারণে।
প্রথমতঃ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে এদের গুটি হিসাবে ব্যবহার করার জন্যে।
দ্বিতীয়তঃ এ বাহিনীর মাধ্যমে মুজিব ও তার সরকারকে সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল করে তুলে শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে। অনেকের মতে জাসদকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল ভারতের ক্ষমতা বলয়ের একাংশের সমর্থন ও মদদেই । জাসদের মূল্যায়ন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে যেভাবেই করা হোক না কেন একটি সত্যকে কোন ঐতিহাসিকই অস্বীকার করতে পারবেন না- স্বৈরাচারী নির্যাতনের হাত থেকে জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করার জন্য জাসদের ডাকে হাজার হাজার নিবেদিত প্রাণ কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। নেতারা কে কি ভেবেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়, তবে কর্মীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের মধ্যে ছিল না কোন খাঁদ কোন কলুশতা। মুজিবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তাদের বীরোচিত সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি প্রজন্ম। তাদের রক্ত প্রেরণা যোগাবে প্রতিটি বাংলাদেশী দেশপ্রেমিককে তাদের ভবিষ্যত সংগ্রামে। তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার সঠিক মূল্যায়নের মাঝে খুজে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের সঠিক দিক নির্দেশনা। আওয়ামী-বাকশালী শাসনের বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী (BCPL)। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পিকিংপন্থী ৫টি কম্যুনিষ্ট গ্রুপ একত্রিত হয়ে যে বিপ্লবী সমন্বয় কমিটি কোলকাতায় গঠন করেছিল তাদেরই চারটি গ্রুপের ঐক্যের মাধ্যমে স্বাধীনতার পর সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী। এ পার্টিতে যোগ দেয় (১) কম্যুনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি (২) পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি মার্কসবাদী, লেনিনবাদী (৩) খুলনার কিছু কম্যুনিষ্ট কর্মী জনাব মারুফ হোসেন ও ডঃ সাইদুর দাহারের নেতৃত্বে। ( ৪ ) জনাব নাসিম খানের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক কম্যুনিষ্ট। এই দলের নেতারা মনে করেন পূর্ব বাংলায় কম্যুনিষ্টরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত থাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামে কম্যুনিষ্টদের পক্ষে নেতৃত্ব দান করা সম্ভব হয়নি। তাই তারা কম্যুনিষ্ট ঐক্য গঠন করে অসম্পূর্ণ বিপ্লব সম্পূর্ণ করার আহ্বান জানান। ‘একটি ঐক্যবদ্ধ কম্যুনিষ্ট পার্টি গড়ে তুলুন’ শিরোনামের একটি ইশতেহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট সংহতি কেন্দ্র এ আহ্বান ঘোষণা করে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। এরই ফলে গঠন করা হয় বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী (BCPL)। এই পার্টি প্রকাশ্য এবং একই সাথে গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। BCPL বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি ছাত্রফ্রন্টও গঠন করেন। শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য গঠন করা হয় বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন। পরবর্তিকালে বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী দল তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (UPP) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জনাব নাসিম আলী খান এই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা করেন। UPP এর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে BCPL এর দর্শনের মিল পাওয়া যায়। দু’টো দলের মতেই বাংলাদেশের জাতীয় বিপ্লব অসম্পূর্ণ থেকে যায় ১৯৭১ সালে, যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল বুর্জুয়াদের হাতে। দু’দলই অভিমত পোষণ করে সোভিয়েত রাশিয়া একটি সংশোধনবাদী দেশ এবং রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নাগপাশে আবদ্ধ করা। ভারতকে ও দু’টো দলই সম্প্রসারণবাদী শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু দু’টো দলই ভারতের নকশাল আন্দোলনের সমালোচনা করে এবং আন্দোলনকে শৃঙ্খলাহীন হঠকারীতা বলে আখ্যায়িত করে। (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী অমল সেনের ১৯৭২ সালের ঘোষণাপত্র। ) UPP এর তুলনায় তাদের গণসংগঠন শ্রমিক এবং ছাত্রসংগঠন অনেক দুর্বল ছিল ফলে দেশব্যাপী তাদের আবেদনও ছিল কম এবং অঞ্চলভিত্তিক। যদিও BCPL এর বেশিরভাগ নীতি আদর্শের সাথে মিল ছিল দেবেন সিকদার ও আবুল বাশারের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) মূল সমন্বয় কমিটির অপর একটি দলের তবুও সামান্য কয়েকটি বিষয়ে মত পার্থক্যের ফলে এ দলটি BCPL এর সাথে ঐক্য স্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। এই দলটি বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী নির্যাতনকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কারণ বলে আখ্যায়িত করে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্যকেই মূল দ্বন্দ্ব বলে নির্ধারণ করে। এ দলের নেতৃবৃন্দ অভিমত পোষণ করেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামে গণচীনের কম্যুনিষ্ট পার্টিই মুখ্য ভূমিকা রাখবে। এ ব্যাপারে BCPL নেতৃবৃন্দের অভিমত ছিল কিছুটা নমনীয়। এ ব্যাপারে বিশদভাবে জানতে হলে পাঠকদের ১৯৭২ সালে ‘পূর্ববাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টির আবেদন’ নামে সলিডারিটি সেন্টার অফ বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহারটি এবং ‘বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলুন’ BCPL কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহার দু’টি পড়ে দেখতে হবে। সিকদার-বাশার গ্রুপের পার্টিকে পরে বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি বলা হয়। এই দলও প্রকাশ্য এবং গোপন রাজনীতি পাশাপাশি চালিয়ে যাবার পক্ষে ঘোষণা দেয়৷ এ দলেরও নিজস্ব ছাত্র, শ্রমিক সংগঠন গঠন করেন নেতৃবৃন্দ। কৌশলগত কারণে দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেয়৷ BCPL এবং UPP দু’টো দলই প্রকাশ্য গণসংগঠন এবং পার্টি সেল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এদের ছাড়া আরো চারটি রাজনৈতিক সংগঠন শুধুমাত্র তাদের গোপন পার্টি সেল এবং গোপন সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে তাদের তৎপরতা চালাতে থাকে। এই চারটি দলের দু’টো দল ছিল EPCP (ML) থেকে বেরিয়ে আসা কম্যুনিষ্টদের নিয়ে গঠিত। তৃতীয় দলটি ছিল পূর্ববাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ। পূর্ব বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে সিকদার-বাশারও গঠন করেছিল BCP (বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি)।
চতুর্থ দলটি ছিল এসমস্ত দলগুলোর উৎস থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে গড়ে ওঠা সর্বহারা পার্টি (পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি)। বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন। এ আন্দোলন থেকেই পরে গড়ে উঠে সর্বহারা পার্টি। ১৯৭৫ সালে মুজিব সরকারের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পার্টির নেতৃত্ব দেন। এ দলের নেতৃত্বে মূলতঃ ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ছাত্রবৃন্দ। যার ফলে তাদের বিপ্লব সম্পৰ্কীয় গবেষণা এবং প্রচারণা অন্যান্য পার্টিগুলোর চেয়ে ছিল ভিন্নতর এবং অধিক কার্যকরী। লাল ঝানডা এবং সংবাদ বুলেটিন ছাড়াও এ পার্টি নিয়মিতভাবে তাদের কেন্দ্রিয় কমিটির বৈঠক সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লিখিত দলিল প্রকাশ করতো। বেশিরভাগ দলিলগুলো জীবিত অবস্থায় ছিল সিরাজ সিকদারের নিজ হাতে লেখা। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সুবিন্যাস্ত এবং প্রচার মাধ্যম ছিল অতি উত্তম। দেশের যে কোন প্রান্তে তাদের প্রকাশিত দলিলপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। সর্বহারা পার্টি অন্যান্য প্রগতিশীল ও বিপ্লবী পার্টিগুলোর সাথে একমত হয়ে মত প্রকাশ করে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে তড়িঘড়ি করে শেষ করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় বাংলাদেশের বিপ্লব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা ভারতের পুতুল সরকার বলে অভিহিত করেন। পার্টির প্রকাশনায় প্রচারিত হয় স্বাধীনতার পর ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে লুটপাট করে ভারতীয় নীল নক্শা বাস্তবায়নের পরিল্পনাকেই সহায়তা করতে থাকে। সর্বহারা পার্টি মনে করে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত বিকল্প প্রথায় বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ বজিয়ে রাখার উদ্দেশ্য তাদের সামরিক অবস্থানকেই অটুট রাখে। বাংলাদেশ আওয়ামী সরকারের অধিন মার্কিন ও রুশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হুমকির সম্মুখীন বলেও সর্বহারা পার্টি জনগণকে হুশিয়ার করে দেয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের আহবানকে সর্বহারা পার্টি ট্রটস্কাইডপন্থী হঠকারীতা বলে আখ্যায়িত করে। কারণ জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার আগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয় বলে পার্টির তাত্ত্বিকরা অভিমত প্রকাশ করেন। তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে জাতীয় বিপ্লব সম্পূর্ণ করা অসম্ভব কারণ তারা চারিত্রিকভাবে জাতীয় বুর্জুয়াদের প্রতিনিধি নয়, তারা হল সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের দালাল এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর প্রতিনিধি। সর্বহারা পার্টির মতে বাংলাদেশের অসম্পূর্ণ বিপ্লবকে ধাপে ধাপে চুড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার জন্য সর্বহারা পার্টি কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত জনতা, বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গোষ্ঠির সমন্বয়ে গড়ে তোলে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নামে একটি গণসংগঠন। সর্বহারা পার্টির তাত্ত্বিকরা মনে করেন যেহেতু বাংলাদেশ তিন দিক দিয়েই ভারত বেষ্টিত, সেক্ষেত্রে বিপ্লবের জন্য বাইরের কোন সাহায্য পাওয়া হবে অতি দুঃষ্কর। তাই বিপ্লবীদের নিজস্ব শক্তির উপরই মূলতঃ নির্ভরশীল থাকতে হবে। সিরাজ সিকদারের গতিশীল নেতৃত্বে এবং সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী কার্যক্রমে মুজিব সরকারের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। অসীম সাহসিকতার সাথে সর্বহারা পার্টির সদস্যরা একের পর এক সফল অভিযান চালিয়ে সরকার ও তার বিভিন্ন বাহিনীকে নাজেহাল করে তুলতে সমর্থ হয় অতি অল্প সময়ে। তাদের সাফল্যে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। তরুণ সমাজের কাছে পার্টির ভাবমুর্তি বেড়ে যায়। ফলে তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দলে দলে জনগণের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত লোকজন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিতে শুরু করে এবং পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে। এত অল্প সময়ে এ ধরণের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয়নি। জাসদের চেয়েও ক্রমান্বয়ে সর্বহারা পার্টি বেশি জনসমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয়।
১৯৭৩ সালের ২রা ডিসেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী সর্বহারা পার্টিকে সমর্থন জানান এবং সিরাজ সিকদারকে অভিনন্দন জানান। ১৯৭৫ সালের ২রা জানুয়ারী শেখ মুজিবের নির্দেশে রক্ষীবাহিনীর শেরেবাংলা নগরের ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় অকথ্য নির্যাতনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বহারা পার্টির শীর্ষ নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এভাবে চরম নিষ্ঠুরতায় পার্টি নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যার পর অর্ন্তদন্ধ ও নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে এবং সরকারি নিষ্পেষণে সর্বহারা পার্টির সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। পার্টিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। জাতীয় পরিসরে পার্টির প্রভাব ও কর্মকান্ড এবং শক্তি ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে। নেতৃত্বের দুর্বলতায় কর্মীরা উদ্দামহীন হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। ফলে জনগণও হতাশ হয়ে সন্দিহান হয়ে উঠে সর্বহারা পার্টির ভবিষ্যত সম্পর্কে। এভাবেই সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর সাথে সাথে হঠাৎ করে জেগে উঠা গণমানুষের মুক্তির এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় স্বৈরশাসনের আগ্রাসী জিঘাংসায়।
জনাব তোহা ও শরদীন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল গোপন সংগঠন হিসেবে মুজিব বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করছিল। মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে ১৯৬৮ সালে পিকিংপন্থী হিসাবে দলের উৎপত্তি ঘটে। স্বাধীনতার পর এই দল তাদের মুখপত্র গণশক্তির মাধ্যমে দাবি জানায়, “বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। রুশ-ভারত চক্ৰ মুলতঃ বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের প্রতিষ্ঠিত মুজিবের পুতুল সরকারের মাধ্যমে।” সর্বহারা পার্টির মতই সাম্যবাদী দল বাংলাদেশের রক্ষীবাহিনীকে পরোক্ষভাবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর উপস্থিতি বলেই মনে করে। কারণ এই রক্ষীবাহিনী সর্বোতভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যেই গঠন করা হয়েছিল। সাম্যবাদী দল অভিমত প্রকাশ করে যে, রক্ষীবাহিনী তৈরি করে তাদের সাথে যৌথভাবে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলোকে দমন করার চেষ্টা করছে। মুজিব তার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্যই রক্ষীবাহিনী তৈরি করার ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। সর্বহারা পার্টির মতই সাম্যবাদী দল একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করে এবং একই সাথে গোপনে গণবাহিনী সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রধানত: ঢাকা, রাজশাহী, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর জেলাতেই সাম্যবাদী দল তাদের ঘাটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফলে ঐ জেলাগুলোতেই তাদের সরকার বিরোধী সংগ্রাম তীব্রতা লাভ করে। প্রগতিশীল এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী ভূমিকায় মূল্যবান অবদান রাখলেও দলীয় মতবিরোধ ও পার্থক্য নিয়ে দলগুলো একে অপরের প্রকাশ্য সমালোচনা ও নিন্দা করতে থাকে।
সাম্যবাদী দল সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে BCPL এবং BCP এর অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে। BCPL এবং BCP আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের উপর নির্ভরশীল বলে দাবি করলে সাম্যবাদী দল এ বক্তব্যের সমালোচনা করে বলে, “আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের পুতুল সরকার। তাকে ভারতের উপর নির্ভরশীল বলা মানেই হচ্ছে তাদের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখা।” সর্বহারা পার্টির সমালোচনা করে সাম্যবাদী দল বক্তব্য দেয়, “সাম্যবাদী দল সর্বহারা পার্টিকে একটি হঠকারী গ্রুপ বলেই মনে করে। এ গ্রুপ আত্মম্ভর সিরাজ সিকদারের ভুল প্ররোচণায় পরিচালিত হচ্ছে।” সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বন্দ্বকে প্রধান্য দেওয়ায় সাম্যবাদী দল সর্বহারা পাটির্কে তাত্ত্বিক দিক দিয়েও ভুল এবং দুর্বল বলে দাবি তোলে। সাম্যবাদী দলের তত্ত্ব অনুযায়ী, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের পক্ষ এবং বিপক্ষ শত্তিগুলোর দ্বন্দ্বই মূল দ্বন্দ্ব। ( দ্রষ্টব্য: সাম্যবাদী দলের প্রকাশিত ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের দলিল- ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল’, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ- ‘এক ভূঁইফোড় বিপ্লবী সম্পর্কে’) একইভাবে জাসদ সম্পর্কে সাম্যবাদী দলের অভিমত ছিল, আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে ভারতই এই সংগঠন গড়ে তোলায় সাহায্য করে। মুজিব ও তার অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যেই ভারত জাসদ গঠনে মদদ যোগায়। (দ্রষ্টব্য: এপ্রিল-মে ১৯৭৩ সালে গণশক্তিতে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ‘ইষ্পাত কঠিন শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিকে গড়ে তুলুন’) জনযুদ্ধ EPCP (ML)-এর মুখপাত্র হিসেবে সেই সময় আব্দুল হকের সম্পাদনায় বের হত। পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম এল) থেকে বেশিরভাগ কর্মীকে বের করে এনে জনাব তোহা এবং শরদীন্দু দস্তিদার সাম্যবাদী দল গঠন করলেও জনাব আব্দুল হক পার্টির নাম পরিবর্তন না করার প্রশ্নে অটল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম এল) বা EPCP (ML) নামে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই গ্রুপটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অস্বীকার করে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতীয় আগ্রাসন বলে EPCP (ML) আখ্যায়িত করে। জনযুদ্ধের মাধ্যমে আগ্রাসী শক্তির কবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার লাইন গ্রহণ করে EPCP (ML)। এই দল তাদের নাম না বদলানোয় সরকারি নির্যাতনের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়। গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যই মারা যায় নতুবা কারাবন্দী হয়। জনাব আব্দুল হককে বন্দী অথবা হত্যা করার সরকারি সব প্রচেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়।
পূর্ব বাংলা কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম এল) EBCP (ML) এবং সাম্যবাদী দলের মধ্যে তত্ত্বগতভাবে খুব একটা ব্যবধান দেখা যায় না। তবে EBCP (ML) কৃষক ও সামন-বাদের অবশেষের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বকে বেশি প্রধান্য দেয়। এ দল ভারতের বিপ্লবীদের সাথে একত্রিতভাবে বিশেষ করে নকশালীদের সাথে সম্পর্ক রেখে বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার ঘোষণা ব্যক্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য প্রায় বিপ্লবী সব দলগুলোর কাছে নকশাল আন্দোলন একটি চরমপন্থী হঠকারীতা বলেই গৃহিত হয়। নকশালীদের দলগুলো বিশ্বাস করতেও রাজি ছিল না৷ আত্রাই, রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে EBCP (ML) বিশেষভাবে তৎপরতা চালায়। প্রগতিশীল ও বামপন্থী তৎকালীন প্রায় সবগুলো দলই একমত প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব ১৯৭১ সালে অসমাপ্ত থেকে যায়। মুজিব সরকার বাংলাদেশের উপর রুশ- ভারতের আধিপত্য কায়েমে সহযোগিতা করে। মুজিব সরকার মূলতঃ ভারতের একটি পুতুল সরকার।
উপরের পর্যালোচনা থেকে একটা জিনিসই পরিষ্কার হয়ে উঠে। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রবীণ নেতৃত্বের চেয়ে নবীনরাই সংগ্রামে অভূতপূর্ব গতিশীলতার সৃষ্টি করে। তারা যখন জনসমর্থন পেয়ে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত তখন পুরনো নেতৃত্ব তাত্ত্বিক কচকচানি নিয়েই ব্যস্ত থেকে নিজেদের দেউলিয়াপনা প্রকাশ করে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের দেউলিয়াপনা, নেতৃত্বের লোভ, ভাববাদী তাত্ত্বিক চর্চা, সন্দেহপ্রবণতা, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস প্রভৃতি কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা উল্লেখযোগ্য বা আশানূরূপ অবদান রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে ক্রমশঃ তারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণভবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। নবীন প্রজন্ম তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। নেতাদের অনেকের ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকলেও এটাই বাস্তব সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের ব্যর্থতা সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি সেটাও আজ প্রমাণিত। অতীতে বিভিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ যখন সত্যিকারের মুক্তির জন্য পরিস্থিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তখন নেতাদের ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ভূমিকার ফলেই ইপ্সিত লক্ষ্য জনগণ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ সর্বদা চলেছে আগে আর নেতারা চলেছেন পেছনে। আমাদের দেশের জনগণের সংগ্রামের ঐতিহ্যে এটাই বড় সত্য। লজ্জাকর হলেও এ সত্যকে খন্ডাবার উপায় নেই। সত্যকে মিথ্যা করার প্রচেষ্টা থেকেছে সর্বকালে। কিন্তু সত্যকে মেনে নিয়ে এগুলেই আশানূরূপ ফল পাওয়া যায়। মিথ্যার আবর্তে পাওয়া যায় শুধু বঞ্চনা ও প্রতারণা। ব্যর্থতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে না চাইলে নতুন প্রজন্মকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চলতে হবে ভবিষ্যতপানে। তারুণ্যের উদ্দাম ও গতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে প্রবীণরা নবীনদের পথ থেকে সরে দাড়ালেই অক্ষুন্ন থাকবে তাদের সম্মান। আর যদি তারা স্বার্থপরের মতো নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন তবে তারুণ্যের প্লাবনের দুর্বার স্রোত তাদের টেনে নিয়ে ফেলবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। সময়কে হাতের মুঠোয় পুরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা না করে সময়ের দাবিকে মেনে নেয়াটাই হবে নেতাদের জন্য কল্যাণকর। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা। সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলো অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার এবং লুটপাটের বিরোধিতার সংগ্রামে উজ্জ্বল প্রতীক। তারা লড়েছেন বিভিন্ন অবস্থানে থেকে। কেউ তাদের নিজস্ব এলাকায় জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ সংগ্রাম করেছেন রাজনৈতিক বিরোধী দলের ছত্রছায়ায়। কেউ বা লড়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে। তাদের এ বহুমুখী ধারার সচেতনাকে সাংগঠনিক রূপ দেবার প্রচেষ্টা না থাকায় প্রতিরোধ দানা বেধে উঠতে পারেনি। যারা রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন দলীয় গন্ডির মাঝেই তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের মাঝে যে দেশপ্রেম জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং নিঃস্বার্থ কর্মপ্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিল তাকে সুষ্ঠ নেতৃত্বের অধিনে সুসংহত করতে পারলে বাংলাদেশের বর্তমান অনেক সংকটের অবসান হত সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদিও তৎকালীন সরকার তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে বাড়তি সুবিধাদী দিয়ে হাত করার চেষ্টা করেছিলেন তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা তাদের সততা, দেশপ্রেম সামান্য প্রলোভনে কারো কাছে বিক্রি করে দেননি।
তুলনামূলকভাবে জামায়াত এবং গোলাম আযমের চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক ছিল শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেছিল জামায়াত। কিন্তু তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রক্ষক আওয়ামী-বাকশালীরা স্বাধীনতার পর অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল শত সহস্ৰ মুক্তিযোদ্ধা।
‘৯০ এর দশকের প্রথম যখন প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্বের বিষয়টি কোর্টে বিবেচনাধীন তখন তথাকথিত ‘৭১ এর চেতনার ধারক-বাহকরা জাহানারা ইমামকে সামনে রেখে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এ বিষয়ে কোন বিতর্কে না গিয়ে সহজেই বলা চলে ঐ ধরণের উদ্যোগ নেবার আগে নিজেদের অতীতের দিকে তাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত ছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই ভারত ও পাকিস্তান সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ত্রিপাক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৯ই এপ্রিল ১৯৭৪ সালে। চুক্তিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ অপরাধীদের বিনা বিচারে মুক্তি দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন মুজিব। আপোষকামী এবং সুবিধাবাদী চরিত্রের শেখ মুজিবর রহমান সর্বোপরিসরে স্বাধীন বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসিত করে স্বাধীনতার চেতনার সাথে বেঈমানীর এক অবিশ্বাস্য নজীর স্থাপন করেছিলেন। সে সময় অধুনাকালের তথাকাথিত স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির চ্যাম্পিয়নরা সব কোথায় ছিলেন? কেন সেদিন শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়ে উঠলেন না? শেখের আমলে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণআদালত গঠন করা হল না কেন? গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের কারণে। তিনি যদি অপরাধী হন তবে তার চেয়েও বড় অপরাধী শেখ মুজিব, তার দল আওয়ামী- বাকশালীরা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এককভাবে কুক্ষিগত করে নিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে সমূলে উৎপাটন করার চক্রান্ত করে জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তিনি ও তার দল। নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের মাটিতে গণআদালতে গোলাম আযম ও তার দোসরদের বিচারের আগে বিচার করতে হবে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী-বাকশালীদের। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর মা জাহানারা ইমাম। পুত্র হারাবার শোকে তার স্বামীও মারা যান। বিশ বছর পর তথাকথিত গণআদালত গঠন করে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে একই মঞ্চে দাড়িয়ে গোলাম আযমের বিচারের প্রহসন করে তিনি তার ছেলে শহীদ রুমীর বুকের রক্তের সাথেই বেঈমানী করার অপরাধে অপরাধী হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা নিধনকারী আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তার সম্মান হারিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার এ ধরণের উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে আমিও দুঃখ পেয়েছি। জনাব রব, মেনন এন্ড গং এবং তথাকথিত প্রগতিশীল বিপ্লবী দলগুলোর নেতারা যারা বর্তমানে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন তারাও আজ একই অপরাধে অপরাধী। তাদের নেতৃত্বে স্বৈরাচারী আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও দলীয় কর্মী। হালে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদেরকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার তাদের অপচেষ্টা জনগণকে বিস্মিত করেছে। নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে গিয়ে তারা নিজেদের আওয়ামী-বাকশালীদের ‘বি’ টিম বলে জনগণের মনে যে সন্দেহ বিরাজমান ছিল তাকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছেন। হারিয়েছেন বিশ্বাসযোগ্যতা৷ লাখো শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানীর শাস্তিস্বরূপ তারা নিক্ষিপ্ত হবেন ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। ইতিহাসের বিধান অমোঘ। সত্যকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব ঐতিহাসিকদের। সত্যের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয়েছে গতিশীল মানব সভ্যতার ইতিহাস। বাংলাদেশের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ