সংক্ষিপ্ত জীবন বাণী

রচনাকালঃ ২৪.৩.১৩৭২ – ০৭.৪.১৩৭২

 

বরিশাল জেলার কোতোয়ালি থানাধীন লামচরি গ্রামে ১৩০৭ সনের ৩রা পৌষ এক কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। চার বৎসর বয়সের সময় বিত্তহীন অবস্থায় রাখিয়া পিতা এন্তাজ আলী মাতুব্বর সাহেব পরলোকগমন করেন। বিত্তহীনা বিধবা মাতা রবেজান আমাকে অতিকষ্টে প্রতিপালন করেন।

অন্ন -বস্ত্রের অভাবগ্রস্থ মাতা গ্রামের পাঠশালায় আমাকে যথাসময়ে ভর্তি করাইতে পারেন নাই। দূর-সম্পর্কীয় এক চাচা দুই আনা মূল্যে একখানা ‘আদর্শলিপি’ বই কিনিয়া দিয়া আমাকে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করাইয়া দেন। (১৩২০ সনে)

‘আদর্শলিপি’ পাঠ শেষ করিয়া রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ পাঠ আরম্ভ করিয়াছি, এমত সময় ছাত্রবেতন অনাদায়হেতু পাঠশালাটি বন্ধ হইয়া যায় এবং আমার পাঠশালার শিক্ষা সেখানেই চিরতরে বন্ধ হয়। (১৩২১)

অতঃপর স্থানীয় এক মুন্সি সাহেবের কাছে কোরান শরীফ, রাহে নাজাত ও পাঞ্জেগানা কেতাবের কিছু পড়ার সুযোগ লাভ করি। (১৩২৩-২৪)

আশৈশব প্রবল ছিল আমার অজানাকে জানার স্পৃহা। বিশেষত প্রকৃতি সম্বন্ধে। মুন্সি সাহেবকে সময় সময় প্রশ্ন করিতাম- দিন-রাত, জোয়ার-ভাটা, শীত-গ্রীষ্ম হয় কেন ইত্যাদি। উত্তর যাহা পাইতাম মনোপূত হইত না। অথচ নিজেও সমাধান করিতে পারিতাম না বলিয়া অশান্তি বোধ করিতাম।

এ বাড়ি, সে বাড়ি, সে পাড়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া পুঁথি সংগ্রহ করিয়া বহু আয়াসে বর্ণযোজনাপূর্বক পাঠ করিতাম- প্রতিবেশী এক পুঁথিপাঠকের অনুকরণে পুঁথি পড়ার আগ্রহে। ইহাতে বাংলা ভাষা যথারীতি পড়িতে পারার যোগ্যতা জন্মিয়াছিল। পাঠশালা জীবনে উহা আমার ছিল না। (১৩২৫-২৬)

পিতার দায়বদ্ধ তিন বিঘা জমি দায়মুক্ত হওয়ায় এই সময় কৃষিকাজ আরম্ভ করি। (১৩২৬)

স্থানীয় কতিপয় তরুণের আগ্রহে পুঁথি ও সারি গানের দল গঠনপূর্বক গান করিতে আরম্ভ করি এবং বিভিন্ন মৌলবি সাহেবদের নিকট কোরান, হাদিস, কেয়াস, ফেকাহ ইত্যাদি মুসলিম ধর্মগ্রন্থগুলির ও পুরুত-ভট্টাচাজ্জিদের নিকট বেদ, পুরাণ, গীতা, রামায়ণ-মহাভারতাদি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির বঙ্গানুবাদ পাঠ ও শ্রবণ করি – উক্ত গানের তর্কসমুদ্র পার হওয়ার জন্য। (১৩২৭-৩২)

স্থানীয় মোল্লাদলের তিরস্কারের গানের অবসান ঘটাইয়া ভূমি সংক্রান্ত জ্ঞানার্জনের জন্য ‘সার্ভে’ শিক্ষা করি (১৩৩৩) এবং পরিবারের বস্ত্রাভাব মিটাইবার জন্য শিক্ষা করি বস্ত্রবয়ন। (১৩৩৬)

মাঠের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বরিশাল হাইস্কুলের স্থানীয় ছাত্র আ. আজিজ ও ফজলুর রহমান মিঞার পুরাতন পাঠ্যপুস্তক পাঠ করিতে থাকি। ইহাতে সাহিত্য, গণিত, জ্যামিতি, ভূগোল, ইতিহাস, ব্যাকরণ ইত্যাদিতে কিছু জ্ঞান ও ইংরেজি ভাষায় বর্ণবোধ জন্মে। বিশেষত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধাধি পাঠ করিয়া শৈশবের প্রকৃতি বিষয়ক প্রশ্নসমূহের মনোপুত সমাধান পাইয়া বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হই ও ক্রমে ‘যুক্তিবাদ’ সমর্থন করি এবং ইহার-উহার নিকট হইতে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধযুক্ত বই ও পত্রিকাদি সংগ্রহ করিয়া পাঠ করিতে থাকি। ইহাতে ক্রমশ আমার পুস্তক পাঠের স্পৃহা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। (১৩৩৭-৪৩)

সামান্য কৃষিকাজের আয় দ্বারা যথেচ্ছ পুস্তকাদি খরিদ করিতে অসামর্থ হেতু বরিশালের পাবলিক লাইব্রেরী ও শঙ্কর লাইব্রেরীর মেম্বার হইয়া সেখানকার পুস্তকাদি পাঠ করিতে শুরু করি। সর্বাগ্রে বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করিয়া ক্রমশ ভ্রমণ ও নভেল-নাটকাদি পুস্তকসমূহ পাঠ করিতে আমার কয়েকটি বৎসর অতিবাহিত হয়। কেননা পৈতৃক বৃত্তি রক্ষা করিয়া দিবানিদ্রা ত্যাগ ও রাত্রিজাগরণ ছাড়া হাতে সময় ছিল না। (১৩৪৪ – অদ্যাবধি)

বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় কাজী গোলাম কাদির (এম.এ., ফিলোসোফার) সাহেবের আন্তরিক সাহায্যে কলেজ লাইব্রেরী ও বাহিরের দর্শন-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বহু পুস্তকাদি অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করিয়াছি ও করিতেছি। (১৩৫৫ – অদ্য পর্যন্ত)

বরিশাল ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলের শিক্ষক মি. মরিস সাহেবের সাথে মেলামেশা করিয়া বাইবেল এবং উহাদের অন্যান্য বিবিধ ধর্মপুস্তকাদি পাঠ করিয়াছি ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব বিশেষভাবে জানিবার আগ্রহে। (১৩৫৬)

ধর্মীয় কাহিনী ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে পূর্ব হইতে মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হইতেছিল; বেদ, বাইবেল, কোরান ও দর্শন-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তাহার যুক্তিসম্মত সমাধানের চেষ্টা করি। কিন্তু উহাতে ব্যর্থ হইয়া প্রশ্নগুলি নোট করিতে থাকি এবং প্রশ্নগুলির নাম রাখি ‘নাবুঝের প্রশ্ন’। (১৩৫৬ – ৫৭)

বরিশাল তাবলীগ দলের আমির ও লইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট মাননীয় মৌ. এফ. করিম সাহেব আমার যুক্তিবাদ বিষয়ে লোক পরম্পরায় জানিতে পারিয়া আমাকে তাহার দলভুক্ত করিবার মানসে কতিপয় সাগরেদ-মুরিদ সহ একদা আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হন। ঐসময় আমি কয়েকজন কৃষিমজুর সহ পাঠে কাজ করিতেছিলাম। তখন বেলা ১১টা। করিম সাহেব আমাকে ডাকাইলেন। জৈষ্ঠ মাসের প্রচন্ড রৌদ্রে পোড়া ঘর্মাক্ত দেহে আমি বাড়িতে আসিতেই বিশ্রামের সময় না দিয়া তিনি আমার সহিত তর্কযুদ্ধ আরম্ভ করেন।

অনেক বাদানুবাদের পর করিম সাহেব আমাকে প্রশ্ন করিলেন, আপনি মুসলমান কি না?

উত্তরে আমি বলিলাম, জাতি বা সম্প্রদায় হিসাবে আমি মুসলমান যেহেতু আমার মা ও বাবা মুসলমান।

করিম সাহেব প্রশ্ন করিলেন, আপনি কোরান মানেন কি না?

আমি বললাম, কোরান আমি মানি কি না, তাহা জানি না, যেহেতু আমি কোরান বুঝি না। তবে ইহা সত্য যে, আমি যাহা বুঝি না, তাহা মানি না।

করিম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি বোঝেন না কি?

বলিলাম, আমি যাহা বুঝি, তাহার চেয়ে বুঝি না অনেক বেশি। অর্থাৎ যাহা বুঝি তাহার হয়তো সংখ্যা আছে; কিন্তু যাহা বুঝি না, তাহা অসংখ্য। সুতরাং আপনার কাছে উহার তালিকা দেই কি রকম?

করিম সাহেব বলিলেন, অন্তত দুই-একটি তো বলিতে পারেন।

আমি আমার ‘নাবুঝের প্রশ্ন’ হইতে উদ্ধৃত করিয়া কতিপয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম – 

(১) আমি কে?

(২) প্রাণ কি?

(৩) মন ও প্রাণ কি এক? ইত্যাদি।

করিম সাহেব উত্তর যাহা দিলেন, যুক্তির কাছে তাহা একটিও টিকিল না। অবশেষে, “একমাস পর আপনার প্রশ্নের উত্তর পাবেন” – এই বলিয়া আমার নিকট হইতে কতিপয় প্রশ্নের একটি তালিকা লইয়া প্রস্থান করিলেন। (১২ জৈষ্ঠ, ১৩৫৮)

যথামসয়ে করিম সাহেব মুরিদান সহ পুনঃ আমার বাড়িতে আসিলেন এবং নিকটবর্তী এক মসজিদে বসিয়া বিতর্ক আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে প্রশ্নোত্তর অমীমাংসিত পরিত্যাগ করিয়া আমার সাথে সাথে চল্লিশ দিন ভ্রমণ করিবেন। আল্লাহ চাহে তো আপনি নিজ হইতেই নিজ প্রশ্নের উত্তর পাইয়া যাইবেন। আপনার মাঠের কাজের যে ক্ষতি হইবে, তাহা আমি পূরণ করিব।

আমি দেখিলাম যে, করিম সাহেব গোড়া হইতে যে ভুল ধারণার বশবর্তী হইয়া আমাকে হেদায়েত করিতে আসিয়াছিলেন, এত যুক্তিতর্কেও তাঁহার সে ভুল ধারণা দূর হয় নাই। তাই আমি তাঁহাকে বলিলাম, যদি কোনো শিশু ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদিতে থাকে, তবে তাঁহাকে খাইতে না দিয়া ঘুম পাড়ানোতে লাভ কি? সে জাগিয়া আবার কাঁদিবে কি না? আপনি আমার মনের খোরাকি না দিয়া উহাকে ভুলাইতে চেষ্টা করিতেছেন। হয়তো আপনার সংসর্গে থাকিলে আমি সাময়িকভাবে প্রশ্ন তুলিতে পারি, কিন্তু উহা ত্যাগ করিলে নিশ্চয়ই মনে পুনঃ প্রশ্ন জাগিবে। সুতরাং আমি অযথা সময় নষ্ট করিয়া আপনার সহগামী হইতে রাজি নহি।

করিম সাহেব বিষন্ন হইয়া ধমকের সুরে “আচ্ছা দেখা যাবে” বলিয়া চলিয়া গেলেন। (১৬ আষাঢ় ১৩৫৮)

করিম সাহেবের ধমকানো দেখিয়া আমার মনে হইতে লাগিল যে, তিনি আমাকে শায়েস্তা করিবার জন্য হয়তো অন্য কোন উপায় অবলম্বন করিবেন। তাই আমার প্রশ্নগুলি একত্র করিয়া একখানা পুস্তকে পরিণত করিলাম। ইহাই আমার প্রণীত পুস্তক ‘সত্যের সন্ধান’। (২৪ আষাঢ়, ১৩৫৮)

হঠাত একদিন শুনিতে পাইলাম যে, আমি একজন কমিউনিস্ট আসামী। আমাকে গ্রেফতার করিবার জন্য ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। বরিশাল এস.পি. অফিসের ক্যাশিয়ার মাননীয় বন্ধু মৌ. আ. লতিফ সাহেবের সঙ্গে বরিশাল কোতোয়ালি থানায় যাইয়া জানিতে পারিলাম যে, ঘটনা সত্য। মাননীয় পুলিশ ইন্সপেক্টর মি. জয়নাল আবেদীন ঐ সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমূল ঘটনা শুনিয়া ও আমার ‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তক পাঠ করিয়া সাগ্রহে যুক্তিবাদ সমর্থন করেন এবং ‘আগামী পরশু’ (২৭.৩.৫৮) আমাকে তাঁহার সঙ্গে লইয়া মাননীয় এস.পি. সাহেবের অফিসে যাইবেন বলিয়া ওয়াদা করেন। (২৫ আষাঢ়, ১৩৫৮)

যাহা হউক, শর্তাধীনে হইলেও আশু ফৌজদারি হইতে নাযাত পাইয়া কথা ও কলম বন্ধ করিয়া দিনাতিপাত করিতেছি।

আজ প্রায় চৌদ্দ বৎসর যাবত আমি স্থানীয় বিশেষ সমাজে অবহেলিত ও তিরস্কৃত হইয়া আসিতেছি। সে যাহা হউক, আমার সামান্য জ্ঞানের ও বহু দুঃখ-দৈন্যাবর্তে লিখিত ক্ষুদ্র ‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তকখানা প্রকাশনার্থে সম্প্রতি ‘মিলন সংঘ’-এ (৩১ তোপখানা রোড, ঢাকা) পেশ করিয়াছি। (১৯ আষাঢ়, ১৩৭২)

আমার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ঘটিত ব্যাপারে বরিশাল পুলিশ অফিসের ক্যাশিয়ার মাননীয় বন্ধু মৌ. আ. লতিফ সাহেব, পি.আই. মাননীয় মি. জয়নাল আবেদীন ও ঢাকা ক্যান্ট-এর এল. এ. ও. স্নেহাস্পদ মি. ফজলুর রহমানের আন্তরিক সহযোগিতা লাভ করিয়াছি এবং ‘সত্যের সন্ধান’ পুস্তক প্রণয়নে স্নেহাস্পদ মো. ইয়াসিন আলী শিকদার ও বরিশাল বি. এম. কলেজের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় কাজী গোলাম কাদির সাহেবের আশাতীত সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করিয়াছি। ইহাদের নিকট আমি চিরঋণে আবদ্ধ।

উপসংহার

ভিখারী দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে পেটের ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য। জানি উহা নিতান্ত জঘন্য কাজ, তথাপি আমি উহা করিয়াছি মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। কিন্তু সফল হইতে পারি নাই। যেহেতু একাধিক ভাষায় অধিকার না থাকায় আমি পঙ্গু, যথেচ্ছ গমনে বঞ্চিত। তথাপি চেষ্টা যাহা করিয়াছি তাহারই সামান্য আলোচনা করিয়াছি আমার ক্ষুদ্র ‘জীবন বাণী’তে। ইহা ভিন্ন নিম্নলিখিত জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান সমূহে যোগদান করিয়া কিছু কিছু দেশের কাজ করার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x