শ্লোকঃ ২০
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে ।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্ ৷। ২০ ৷।
দাতব্যম—দান করা কর্তব্য; ইতি—এভাবে; যৎ- যে; দানম দান; দীয়তে— দেওয়া হয়; অনুপকারিণে — প্রত্যুপকারের আশা না করে, দেশে — উপযুক্ত স্থানে; কালে—উপযুক্ত কালে; চ—ও; পাত্রে—উপযুক্ত পাত্রে; চ–এবং; তৎ—তাকে; দানম্—দান; সাত্ত্বিকম্ — সাত্ত্বিক; স্মৃতম্ বলা হয়।
কর্তব্য জানিয়া যেই দানক্রিয়া হয় ।
দেশ কাল পাত্র বুঝি দাতব্য করয় ৷
অনুপকারীকে দান সে সাত্ত্বিক হয় ।।
অনুবাদঃ দান করা কর্তব্য বলে মনে করে প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলা হয়।
তাৎপর্যঃ পারমার্থিক কর্মে নিযুক্ত যে মানুষ, তাকেই দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। নির্বিচারে দান করার কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। পারমার্থিক উন্নতিই জীবনের পরম উদ্দেশ্য। তাই তীর্থস্থানে, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময়, মাসের শেষে অথবা সাহ্মণ বা বৈষ্ণবকে অথবা মন্দিরে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন কলের আকাঙ্ক্ষা না করে দান করা উচিত। কখনও কখনও অনুকম্পার বশবর্তী হয়ে গরিবদের দান করা হয়, কিন্তু সেই গরিব লোকটি যদি দানের যোগ্য না হয়, তা হলে সেই দানের ফলে কোন পারমার্থিক উন্নতি সাধিত হয় না। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, নির্বিচারে দান করার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি।
শ্লোকঃ ২১-২২
যত্তু প্রত্যুপকারার্থং ফলমুদ্দিশ্য বা পুনঃ ৷
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং তদ্দানং রাজসং স্মৃতম্ ।। ২১ ।।
অদেশকালে যদ্দানমপাত্রেভ্যশ্চ দীয়তে ।
অসৎকৃতমবজ্ঞাতং তত্তামসমুদাহৃতম্ ।। ২২ ৷।
যত্যা: তু—কিন্তু; প্রত্যুপকারার্থম্ — প্রত্যুপকারের আশায়; ফলন—ফল: উদ্দিশ্য—কামনা করে, বা—অথবা, পুনঃপুনরায়, দীয়তে— দেওয়া হয়; চ ও; পরিক্লিষ্টম্—অনুতাপ সহকারে; তৎ- সেই; দানম্—দানকে; রাজসম্ রাজসিক, স্মৃতম্–বলা হয়, অদেশ — অশুচি স্থানে, কালে— অশুভ সময়ে; যৎ- যে; দানম্—দান; অপাত্রেভ্যঃ — অনুপযুক্ত পাত্রে; চ—ও; দীয়তে— দেওয়া হয়; অসংকৃতম্—অনাদরে; অবজ্ঞাতম্—অবজ্ঞা সহকারে; তৎ—তাকে; তামসম্ তামসিক; উদাহৃতম্ বলা হয়।
গীতার গান
প্রত্যুপকারের জন্য ফলানুসন্ধান ।
কিংবা দান করি হয় অনুতাপৰান ॥
রাজসিক দান সেই শাস্ত্রের বিচার ।
তামসিক দান যাহা শুন এই বার ॥
অদেশকালে যে দান অপাত্রেতে হয় ।
অসৎকার অবজ্ঞা যেই তামসিক কয় ।৷
অনুবাদঃ যে দান প্রত্যুপকারের আশা করে অথবা ফল লাভের উদ্দেশ্যে এবং অনুতাপ সহকারে করা হয়, সেই দানকে রাজসিক বলা হয়। অশুচি স্থানে, অশুভ সময়ে, অযোগ্য পাত্রে, অনাদরে এবং অবজ্ঞা সহকারে যে দান করা হয়, তাকে তামসিক দান বলা হয়।
তাৎপর্যঃ কখনও কখনও স্বৰ্গলোকে উন্নীত হওয়ার জন্য দান করা হয়, কখনও আবার গভীর বিরক্তির সঙ্গে দান করা হয় এবং কখনও দান করার পরে অনুশোচনা হয় যে, “কেন আমি এভাবে এতগুলি টাকা নষ্ট করলাম।” কখনও আবার গুরুজনের অনুরোধে বাধা হয়ে দান করতে হয়। এই ধরনের দানগুলিকে রাজসিক বলে গণ্য করা হয়।
অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে লিপ্ত প্রতিষ্ঠানদের উপহার সামগ্রী দান করে থাকে। এই ধরনের দানকে বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদন করা হয়নি। কেবল মাত্র সাত্ত্বিকভাবে দানের নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
নেশা করা বা জুয়াখেলার জন্য দান করতে এখানে উৎসাহিত করা হয়নি। এই ধরনের সমস্ত দান তামসিক। এই ধরনের দানের ফলে কোন লাভ হয় না। উপরন্তু পাপকর্মে লিপ্ত সমস্ত মানুষগুলি প্রশ্রয় পায়। তেমনই, কেউ যদি আবার অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং অবহেলা করে যোগ্য পাত্রেও দান করে, তা হলেও সেই দানকে তামসিক বলে গণ্য করা হয়।
শ্লোকঃ ২৩
ওঁ তৎসদিতি নির্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ
ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরা ॥ ২৩ ॥
ওঁ—ব্রহ্মের নির্দেশকারী প্রণব; তৎ- সেই; সৎ — নিত্য; ইতি—এই; নির্দেশঃ- নির্দেশক নাম, ব্রহ্মণঃ—ব্রহ্মের; ত্রিবিধঃ – তিন প্রকার; স্মৃতঃ — কথিত আছে, ব্রাহ্মণাঃ—ব্রাহ্মণগণ; তেন—তার দ্বারা, বেদাঃ – বেদসমূহ; চ—ও; যজ্ঞাঃ- যজ্ঞসমূহ; চ—ও; বিহিতাঃ বিহিত হয়েছে, পুরা পুরাকালে।
গীতার গান
যজ্ঞ দান তপস্যাদি যাহা শাস্ত্রের নির্ণয় ।
ওঁ তৎসৎ সে উদ্দেশ্যে অন্য কিছু নয় ॥
সে উদ্দেশ্যে পূর্বকালে ব্রাহ্মণদিগণ ।
যজ্ঞ দান তপ আদি করিল পালন ॥
অনুবাদঃ ওঁ তৎ সৎ–এই তিন প্রকার ব্রহ্ম-নির্দেশক নাম শাস্ত্রে কথিত আছে। পুরাকালে সেই নাম দ্বারা ব্রাহ্মণগণ, বেদসমূহ ও যজ্ঞসমূহ বিহিত হয়েছে।
তাৎপর্যঃ পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তপস্যা, যজ্ঞ, দান ও আহার তিনভাগে বিভক্ত— সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। কিন্তু উত্তমই হোক, মধ্যমই হোক বা কনিষ্ঠই হোক, সে সবই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কলুষিত। যখন সেগুলি পরব্রহ্মা- ওঁ তৎ সৎ বা শাশ্বত পরম পুরুষোত্তম ভগবানের উদ্দেশ্যে সাধিত হয়, তখন সেগুলি পারমার্থিক উন্নতি সাধনের উপায়-স্বরূপ হয়ে ওঠে।। শাস্ত্রের নির্দেশসমূহে সেই উদ্দেশ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওঁ তৎ সৎ—এই তিনটি শব্দ নির্দিষ্টভাবে পরমতত্ত্ব পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে সূচিত করে। বৈদিক মন্ত্রে সর্বদাই ওঁ শব্দটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।
যে শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে আচরণ করে না, সে কখনই পরম-তত্ত্বকে প্রাপ্ত হতে পারবে না। তার পক্ষে কোন সাময়িক ফল লাভ হতে পারে, কিন্তু তার জীবনের পরম অর্থ সাধিত হবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, দান, যজ্ঞ ও তপস্যা অবশ্যই সাত্ত্বিকভাবে অনুষ্ঠান করতে হবে। রাজসিক বা তামসিকভাবে সেগুলি অনুষ্ঠিত হলে তা অবশ্যই নিকৃষ্ট। ওঁ তৎ সং—এই তিনটি শব্দ পরমেশ্বর ভগবানের পবিত্র নামের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়, যেমন ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ। যখনই কোন বৈদিক মন্ত্ৰ বা পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য নামের উচ্চারণ করা হয়, তার সঙ্গে ওঁ শব্দটি যুক্ত হয়। সেই কথা বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে। এই তিনটি শব্দ বৈদিক মন্ত্র থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওঁ ইত্যেতদ ব্ৰহ্মণো নেদিষ্ঠং নাম (ঋক্ বেদ) প্রথম লক্ষ্যকে সূচিত করে। তারপর তত্ত্বমসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/৮/৭) দ্বিতীয় লক্ষ্য সূচনা করে এবং সদেব সৌম্য (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/১) তৃতীয় লক্ষ্যকে সূচিত করে। একত্রে তারা ওঁ তৎ সৎ। পুরাকালে প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মা যখন যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, তখন তিনি এই তিনটি শব্দের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নির্দেশ করেছিলেন। অতএব শুরু-পরম্পরাতেও এই তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং, এই মন্ত্রটির বিপুল তাৎপর্য রয়েছে। তাই ভগবদ্গীতায় অনুমোদিত হয়েছে যে, যে- কোন কর্মই করা হোক না কেন, তা যেন ওঁ তৎ সৎ অথবা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের জন্য করা হয়। কেউ যখন এই তিনটি শব্দ সহকারে তপস্যা, দান ও যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করছেন। কৃষ্ণভাবনা হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান সমন্বিত অপ্রাকৃত কর্ম, যা অনুশীলন করার ফলে আমরা আমাদের নিত্য আলয় ভগবৎ-বামে ফিরে যেতে পারি। এই রকম অপ্রাকৃত কর্মে কোন রকম শক্তি ক্ষয় হয় না।