শ্লোকঃ ১৪

দেবদ্বিজগুরুপ্রাজ্ঞপুজনং শৌচমার্জবম ।

ব্রহ্মচর্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে ॥ ১৪ ৷৷

দেব পরমেশ্বর ভগবান; দ্বিজ — ব্রাহ্মাণ; গুরু গুরু, প্রাজ্ঞ— পূজনীয় ব্যক্তিগণের পূজনম্—পূজা; শৌচম্—শৌচ, আর্জবম্—সরলতা, ব্রহ্মচর্যম্ ব্রহ্মচর্য, অহিংসা- অহিংসা; চ—ও; শারীরম্—কায়িক; তপঃ— তপস্যা, উচাতে—বলা হয়।

গীতার গান

দেব দ্বিজ গুরু প্রাজ্ঞ যে সব পূজন ৷

শৌচ সরলতা ব্রহ্মচর্যের পালন ।।

সেই সব সিদ্ধ হয় শরীর তপস্যা ৷

অনুদ্বেগকর বাক্য কিংবা প্রিয় পোষ্য ।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান, ব্রাহ্মণ, গুরু ও প্রাজ্ঞাণের পূজা এবং শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা–এগুলিকে কায়িক তপস্যা বলা হয়।

তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান এখানে বিভিন্ন ধরনের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাখ্যা করছেন। প্রথমে তিনি কায়িক তক্ষশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলেছেন। পরমেশ্বর ভগবানকে, দেব-দেবীকে, সিদ্ধ পুরুষকে, সাহ্মণকে, সদগুরুকে এবং পিতা-মাতা আদি গুরুজনদেরকে অথবা যাঁরা বৈদিক জ্ঞান সম্বন্ধে অবগত, তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা করা উচিত অথবা তাদের শ্রদ্ধা করার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এদের সকলকে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। বাইরে ও অন্তরে নিজেকে পরিষ্কার রাখার অনুশীলন করা উচিত এবং আচার ব্যবহারে সহজ সরল হতে শেখা উচিত। শাস্ত্রে যা অনুমোদন করা হয়নি, তা কখনই করা উচিত নয়। কখনই অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীসঙ্গ করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোন মতেই নয়। একে বলা হয় ব্রহ্মচর্য। এগুলি হচ্ছে দেহের তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছসাধন।

 

শ্লোকঃ ১৫

অনুজ্ঞগকরং বাক্যং সত্যং প্রিয়হিতং চ য‍ৎ ।

স্বাধ্যায়াভ্যসনং চৈব বাত্ময়ং তপ উচ্যতে ॥ ১৫ ॥

অনুদ্বেগকরম্—অনুদ্বেগকর; বাক্যম্ বাক্য; সত্যম্—সত্য, প্রিয়—প্রিয়; হিত— হিতকর; চ—ও; যৎ—যা স্বাধ্যায় – বেদ পাঠের, অভ্যসনম্ — অভ্যাস; চও এর—অবশ্যই; বাক্সয়ম্ —বাচিক : তপঃ— তপস্যা; উচ্যতে—বলা হয়।

গীতার গান

স্বাধ্যায় অভ্যাস যত বেদ উচ্চারণ

বাঙ্ময় তপস্যা সে শাস্ত্রের বচন ॥

অনুবাদঃ অনুদ্বেগকর, সত্য, প্রিয় অথচ হিতকর বাক্য এবং বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করাকে বাচিক তপস্যা বলা হয়।

তাৎপর্যঃ এমনভাবে কোন কথা বলা উচিত নয়, যার ফলে অন্যদের মন উত্তেজিত হতে পারে। তবে, শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের শিক্ষা দান করবার জন্য সত্য কথা বলতে পারেন, কিন্তু তা যদি অন্যদের, যারা তাঁর শিষ্য নয়, তাদের উত্তেজিত করে তোলে, তা হলে সেখানে তাঁর কথা বলা উচিত নয়। এটিই হচ্ছে বাচোকো দমন করার তপশ্চর্যা। এ ছাড়া অর্থহীন প্রজন্ম করা উচিত নয়। ভক্তমণ্ডলীতে যখন কথা বলা হয়, তখন তা যেন শাস্ত্র-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থাকে। যা বলা হয় তার যথার্থতা প্রতিপন্ন করার জন্য তৎক্ষণাৎ শাস্ত্র-প্রমাণের উল্লেখ করা উচিত। সেই সঙ্গে, ঐ ধরনের আলোচনা অন্যের কাছে শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত। তবেই এই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে পরম মঙ্গল লাভ হতে পারে এবং মানব সমাজের উন্নতি সাধিত হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যের অনন্ত ভাঙার রয়েছে এবং সেগুলি পাঠ করা উচিত। একেই বলা হয় বাচোবেগের তপশ্চর্যা।

শ্লোকঃ ১৬

মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বং মৌনমাত্মবিনিগ্রহঃ ৷

ভাবসংশুদ্ধিরিত্যেত‍ৎ তপো মানসমুচ্যতে ॥ ১৬ ॥

মনঃপ্রসাদঃ- চিত্তের প্রসন্নতা, সৌম্যত্বম্— সরলতা, মৌনম্—মৌন, আত্মবিনিগ্রহঃ -মনঃসংযম, ভাৰসংশুদ্ধিঃব্যবহারে নিষ্কপটতা: ইতি এতং—এগুলিকে, তপঃ — তপস্যা; মানসম্— মানসিক; উচ্যতে বলা হয়।

গীতার গান

চিত্তের প্রসন্নতা যে আর সরলতা ।

আত্মনিগ্রহাদি মৌন ভাব প্রবণতা ॥

সেই সব মানসিক তপ নামে খ্যাত ৷

উপরোক্ত সব তপ ত্রিগুণ প্রখ্যাত ॥

অনুবাদঃ চিত্তের প্রসন্নতা, সরলতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ব্যবহারে নিষ্কপটতা—এগুলিকে মানসিক তপস্যা বলা হয়।

তাৎপর্যঃ মানসিক তপশ্চর্যা হচ্ছে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ইচ্ছা থেকে মনকে মুক্ত করা। মনকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে সর্বক্ষণ মানুষের কি করে মঙ্গল হবে, সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে। মনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হচ্ছে চিন্তায় গাম্ভীর্য। কৃষ্ণভক্তি থেকে কখনই বিচ্যুত হওয়া উচিত নয় এবং সর্বদাই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিত্যাগ করা উচিত। স্বভাবকে নির্মল করে গড়ে তোলার উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া। মনের সন্তোষ তখনই লাভ করা যায়, যখন মনকে সমস্ত ইন্দ্রিয় উপভোগের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। আমরা যতই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের চিন্তা করি, মন ততই অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমান যুগে আমরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য নানা রকম পন্থায় মনকে অনর্থক নিযুক্ত করছি এবং তাই মানসিক শাস্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মানসিক শান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে মহাভারত ও পুরাণ আদি বৈদিক শাস্ত্রে মনকে নিবদ্ধ করা, যা নানা রকম মনোমুগ্ধকর আনন্দদায়ক কাহিনীতে পরিপূর্ণ। এই জ্ঞানের সহায়তা লাভ করে মানুষ পবিত্র হতে পারে। মন যেন সব রকমের কপটতা থেকে মুক্ত থাকে এবং আমাদের উচিত সকলের মঙ্গল কামনা করা। মৌনতা মানে হচ্ছে সর্বক্ষণ আত্মজ্ঞান লাভের চিন্তায় মগ্ন থাকা। এই অর্থে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত হচ্ছেন যথার্থ মৌন। আত্মনিগ্রহের অর্থ হচ্ছে মনকে সব রকমের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা থেকে মুক্ত রাখা।

আমাদের অকপট ব্যবহার করা উচিত, তার ফলে আমাদের অস্তিত্ব শুদ্ধ হয়। এই সমস্ত গুণাবলী হচ্ছে মানসিক তপশ্চর্যা।

error: Content is protected !!