শ্লোকঃ ৮

আয়ুঃসত্ববলারোগ্যসুখীতিবির্ধনা ।

রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ ॥ ৮ ॥

আয়ুঃ—আয়ু; সত্ব—অস্তিত্ব; বল –বল; আরোগ্য — আরোগ্য; সুখ—সুখ; প্রীতি— প্রীতি, বিবর্ধনাঃ-বর্ধনকারী; রস্যাঃ— রসযুক্ত, স্নিগ্ধাঃ – স্নিগ্ধ, স্থিরাঃ — স্থায়ী; হৃদ্যাঃ —মনোরম; আহারাঃ – আহার্য; সাত্ত্বিক — সাত্ত্বিক লোকদের, প্রিয়াঃ প্রিয়।

গীতার গান

আয়ু সত্ত্ব বলারোগ্য সুখ প্রীতি বাড়ে ৷

রস্য স্নিগ্ধ স্থির হৃদ্য সাত্ত্বিক আহারে ॥

অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার আয়ু, সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্ধনকারী এবং রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, স্থায়ী ও মনোরম, সেগুলি সাত্ত্বিক লোকদের প্রিয়।

শ্লোকঃ ৯

কটুম্ললবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্ণরুক্ষবিদাহীনঃ।

আহারা রাজসস্যেষ্টা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ ॥ ৯ ॥

কটু—তিক্ত; অম্ল—টক; লবণ — লবণাক্ত; অত্যুষ্ণ — অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ—তীক্ষ্ণ, রুক্ষ—শুল্ক; বিদাহিনঃ— প্রদাহকর; আহারাঃ – আহার; রাজসস্য—রাজসিক ব্যক্তিদের; ইষ্টাঃ—প্রিয়; দুঃখ–দুঃখ, শোক – শোক, আমপ্রদাঃ— রোগপ্রদ।

গীতার গান

কটু অম্ল লবণাক্ত অতি উষ্ণ যেই ।

জ্বালা পোড়া আময়ী রাজসিক সেই ॥

অনুবাদঃ যে সমস্ত আহার অতি তিক্ত, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি শুষ্ক, অতি প্রদাহকর এবং দুঃখ, শোক ও রোগপ্রদ, সেগুলি রাজসিক ব্যক্তিদের প্রিয়।

শ্লোক ১০

যাতযামং গতরসং পূতি পর্যুষিতং চ যৎ ।

উচ্ছিষ্টমপি চামেধ্যং ভোজনং তামসপ্রিয়ম্ ॥ ১০॥

যাতযামম্—আহারের তিন ঘণ্টা আগে রান্না করা খাদ্য; গতরসম্—রসহীন; স্মৃতি দুর্গন্ধযুক্ত; পর্যুষিতম্—বাসী; চ–ও, য‍—যা; উচ্ছিষ্টম্—অন্যের উচ্ছিষ্ট; অপি— ও, চ–এবং, অমেধ্যম – অমেধ্য দ্রব্য, ভোজনম্ — আহার, তামস — তামসিক লোকদের, প্রিয়ম্—প্রিয়।

গীতার গান

বাসী শৈত্য গতরস পচা বা দুর্গন্ধ ৷

উচ্ছিষ্ট অমেধ্য যেই খাদ্য তমসান্ধ ॥

অনুবাদঃ আহারের এক প্রহরের অধিক পূর্বে রান্না করা খাদ্য, যা নীরস, দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী এবং অপরের উচ্ছিষ্ট দ্রব্য ও অমেধ্য দ্রব্য, সেই সমস্ত তামসিক লোকদের প্রিয়।

তাৎপর্যঃ খাদ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়ু বর্ধন করা, মনকে পবিত্র করা এবং শরীরের শক্তি দান করা। সেটিই হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য। পুরাকালে মুনি-ঋষিরা বলদায়ক, ‘আয়ুবর্ধক সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নির্বাচন করে গেছেন, যেমন দুগ্ধজাত খাদ্য, শর্করা, অম, গম, ফল ও শাক-সবজি। যারা সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন, তাদের কাছে এই ধরনের খাদ্য অত্যন্ত প্রিয়। অন্য কিছু খাদ্যদ্রব্য, যেমন ভুট্টার খই ও গুড় খুব একটা সুস্বাদু নয়, কিন্তু দুধ বা অন্য কোন খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার ফলে সেগুলি খুব সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তখন সেগুলি সাত্ত্বিক আহারে পরিণত হয়। এই সমস্ত খাদ্যগুলি স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র। এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য মদ্য, মাংস আদি অস্পৃশ্য বস্তু থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। অষ্টম শ্লোকে যে স্নিগ্ধ বা স্নেহজাতীয় খাদ্যের বর্ণনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে হত্যা করা পশুর চর্বির কোন সম্পর্ক নেই। সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে খাদ্য দুধ, তাতে যথেষ্ট পরিমাণে স্নেহ পদার্থ আছে। দুধ, মাখন, ছানা এবং এই জাতীয় পদার্থে যে পরিমাণ স্নেহ পদার্থ পাওয়া যায়, তাতে আর নিরীহ পশু হত্যা করার কোন প্রয়োজন থাকে না। শুধুমাত্র পাশবিক মনোবৃত্তির ফলেই এই সমস্ত পশু হত্যা হয়ে চলেছে। সভ্য উপায়ে স্নেহ পদার্থ পাওয়ার পন্থা হচ্ছে দুধ। নরপশুরাই কেবল পশু হত্যা করে থাকে। ছোলা, মটর, গম আদিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন বা অন্নসার পাওয়া যায়।

রাজসিক খাদ্য হচ্ছে সেই সমস্ত খাদ্য, যা তিক্ত, অত্যন্ত লবণাক্ত বা অতি উষ্ণ অথবা অতিরিক্ত শুকনো লঙ্কা মিশ্রিত, যার ফলে উদরে কফ উৎপন্ন হয়ে শ্লেষ্মা প্রদান করে এবং অবশেষে রোগ দেখা দেয়। আর তামসিক আহার হচ্ছে সেগুলি, যা টাটকা নয়। যে খাদ্য আহার করার কম করে তিন ঘণ্টা আগে রান্না করা হয়েছে (ভগবৎ প্রসাদ ব্যতীত) তা তামসিক আহার বলে গণ্য করা হয়। যেহেতু তা পচতে শুরু করেছে, তাই এই সমস্ত খাদ্য দুর্গন্ধযুক্ত। সেগুলি তমোগুণ সম্পন্ন মানুষকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন মানুষেরা তা সহা করতে পারে না।

উচ্ছিষ্ট খাদ্য তখনই গ্রহণ করা উচিত যদি তা পরমেশ্বর ভগবানকে নিবেদিত হয় অথবা তা যদি সাধু মহাত্মার, বিশেষ করে গুরুদেবের উচ্ছিষ্ট হয়। তা না হলে উচ্ছিষ্ট খাদ্য তামসিক বলে গণ্য করা হয় এবং তার ফলে রোগ সংক্রামিত হয়। এই ধরনের খাদ্য তামসিক লোকদের কাছে যদিও খুব সুস্বাদু বলে মনে হয়, কিন্তু সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন মানুষেরা এই ধরনের খাদ্য পছন্দ করেন না, এমন কি স্পর্শ পর্যন্ত করেন না। শ্রেষ্ঠ খাদ্য হচ্ছে সেই খাদ্য, যা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নিবেদন করা হয়েছে। ভগবদ্গীতার ভগবান বলেছেন যে, শাক-সবজি, ময়দা, দুগ্ধ আদি থেকে প্রস্তুত আহার্য যখন ভক্তি সহকারে তাঁকে নিবেদন করা হয়, তিনি তখন তা গ্রহণ করেন। পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্। অবশ্য, ভক্তি ও প্রেম হচ্ছে মুখ্য বস্তু, যা পরম পুরুষোত্তম ভগবান গ্রহণ করেন। কিন্তু এটিরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশেষ বিশেষ বস্তু দিয়ে বিশেষভাবে প্রসাদ তৈরি করতে হয়। শাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে প্রস্তুত এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ বহু বহু দিন পূর্বে প্রস্তুত হলেও তা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্য চিন্ময়। তাই সব মানুষের জন্য খাদ্যদ্রব্য জীবাণুমুক্ত, আহার্য ও সুস্বাদু করে তুলতে হলে, সেগুলি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে নিবেদন করা উচিত।

error: Content is protected !!