শ্লোকঃ ৪
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ ।
প্রেতান্ ভূতগণাংশ্চান্যে যান্তে তামসা জনাঃ ॥ ৪ ॥
যজান্তে — পূজা করে; সাত্ত্বিকাঃ – সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা; দেবান—দেবতাদের; যক্ষরক্ষাংসি —যক্ষ ও রাক্ষসদের, রাজসা:- রাজসিক ব্যক্তিরা, প্রেতান্ প্রেতাত্মাদের; ভূতগণান্ ভূতদের; চ—এবং; অন্যে অন্যেরা; যজন্তে—পূজা করে; তামসাঃ – তামসিক; জনাঃ ব্যক্তিরা।
গীতার গান
সাত্ত্বিকী যে শ্রদ্ধা সেই পূজে দেবতারে ।
রাজসী যে শ্রদ্ধা পূজে যক্ষ রাক্ষসেরে ।।
তামসী যে শ্রদ্ধা তাহে ভূতপ্রেত পূজে ।
যার যেই শ্রদ্ধা হয় সেই তথা ভজে ৷।
অনুবাদঃ সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা দেবতাদের পূজা করে, রাজসিক ব্যক্তিরা যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে এবং তামসিক ব্যক্তিরা ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা করে।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বিভিন্ন ধরনের উপাসকদের বহিরঙ্গা কর্মধারা অনুসারে তাদের বর্ণনা দিচ্ছেন। শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে পরম পুরুষোত্তম ভগবানই হচ্ছেন একমাত্র উপাস্য, কিন্তু যারা শাস্ত্রসিদ্ধান্ত সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবগত নয় অথবা শ্রদ্ধাবান নয়, তারা তাদের জড়া প্রকৃতির বিশেষ বিশেষ গুণ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর উপাসনা করে থাকে। যারা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত, তারা সাধারণত দেব-দেবীদের পূজা করে। এই সমস্ত দেব-দেবীরা হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্ৰ, চন্দ্র, সূর্য আদি। এই রকম অনেক দেব-দেবী আছেন। যারা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত তারা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোন বিশেষ দেবতার পূজা করে। তেমনই, যারা রজোগুণে অধিষ্ঠিত তারা যক্ষ, রাক্ষস আদির পূজা করে। আমাদের মনে আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় কোন এক ব্যক্তি হিটলারের পূজা করতে শুরু করে, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে সে কালোবাজারী করে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পেরেছিল। তেমনই যারা রজ বা তমোগুণে আচ্ছন্ন, তারা সাধারণত কোন শক্তিশালী মানুষকে ভগবান বলে নির্ধারণ করে। তারা মনে করে, যে-কোন জনকেই ভগবান বলে পূজা করা যায় এবং তাতে একই রকম ফল লাভ করা যায়।
এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যারা রাজসিক তারা এই ধরনের ভগবান তৈরি করে তাদের পূজা করে এবং যারা তামসিক, তারা ভূত-প্রেত আদির পূজা করে। কিছু লোককে কোন মৃতলোকের সমাধিতে গিয়ে পূজা করতে দেখা যায়। যৌন আচারগুলিকেও তামসিক আচার বলে গণ্য করা হয়। তেমনই, ভারতের অজ পাড়াগাঁয়ে ভূত-প্রেতের পূজার প্রচলন দেখা যায়। ভারতবর্ষে আমরা দেখেছি যে, নিম্ন স্তরের লোকেরা যদি জানতে পারে যে, জঙ্গলে কোন গাছে ভুত আছে, তা হলে তারা নানা রকম নৈবেদ্য অর্পণ করে সেই গাছের পূজা করে।
এই রকম যে সমস্ত পূজা তা প্রকৃতপক্ষে ভগবানের আরাধনা নয়। ভগবৎ উপাসনা হচ্ছে তাঁদের জন্য, যাঁরা গুণাতীত শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত। শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/৩/২৩) বলা হয়েছে, সত্ত্বং বিশুদ্ধ বসুদেবশব্দিতম্—“কোন মানুষ যখন বিশুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হন, তিনি তখন বাসুদেবের আরাধনা করেন।” এর তাৎপর্য হচ্ছে যে, যারা জড় জগতের সমস্ত গুণ থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তারাই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে পারেন।
নির্বিশেষবাদীরাও ও সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত বলে মনে করা হয় এবং তারা পাঁচ রকমের দেব-দেবীর উপাসনা করে। তারা জড় জগতে নির্বিশেষ বিষ্ণুরূপ বা মনোধর্ম- প্রসূত বিষ্ণুতত্ত্বের উপাসনা করে। বিষ্ণু হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের স্বাংশ প্রকাশ, কিন্তু নির্বিশেষবাদীরা যেহেতু পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে বিশ্বাস করে না, তাই তারা কল্পনা করে যে, বিষ্ণুরূপও নির্বিশেষ ব্রহ্মের একটি রূপ মাত্র। তেমনই, তারা মনে করে যে, ব্রহ্মাও হচ্ছেন রজোগুণের নির্বিশেষ প্রকাশ মাত্র। এভাবেই তারা পাঁচ জন উপাস্য দেব-দেবীর কথা বর্ণনা করে থাকে। কিন্তু যেহেতু তারা মনে করে যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্ম, তাই পরিণামে তারা সব উপাস্য বস্তুকে পরিত্যাগ করে। সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের বৈশিষ্ট্যগুলি গুণাতীত ব্যক্তির সান্নিধ্যের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতে পারে।
শ্লোকঃ ৫-৬
অশাস্ত্রবিহিতং ঘোরং তথ্যন্তে যে তপো জনাঃ
দম্ভাহঙ্কারসংযুক্তাঃ কামরাগবলান্বিতাঃ ॥ ৫॥
কর্ষয়ন্তঃ শরীরস্থং ভূতগ্রামমচেতসঃ ।
মাং চৈবান্তঃশরীরস্থং তান্ বিদ্যাসুরনিশ্চয়ান্ ॥ ৬॥
অশাস্ত্রবিহিতম্ — শাস্ত্রবিরুদ্ধ; ঘোরম্—অপরের পক্ষে ক্ষতিকর; তথ্যন্তে— তপশ্চর্যা অনুষ্ঠান করে, যে যারা, উপঃ – তপস্যা; জনাঃ – ব্যক্তিগণ, দত্ত – দত্ত; অহঙ্কার- অহঙ্কার: সংযুক্তাঃ—যুক্ত; কাম—কাম; রাগ — আসক্তি: বল—বল: অন্বিতা:- বিশিষ্ট; কর্ষয়ন্তঃ— ক্লেশ প্রদান করে; শরীরস্থম্—শরীরস্থ; ভূতগ্রামম্ভূতসমূহকে অচেতসঃ—অবিবেকী; মাম্—আমাকে, চ–ও, এর – অবশ্যই; অন্তঃ অন্তরে; শরীরস্থম— দেহস্থিত; তান—তাদের; বিদ্ধি— জানবে; আসুর — আসুরিক নিশ্চয়ান্—নিশ্চিতভাবে।
গীতার গান
শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করি যে তপস্যা করে ।
দত্ত দর্প কাম রাগ যুক্ত অহঙ্কারে ।।
বৃথা উপবাস করে ক্লেশ সহিবারে ।
শরীরেতে ভূতগণে মূর্খ কর্ণিবারে ৷।
আমাকেও অন্তর্যামী শরীর ভিতরে ।
আসুরিক জান সেই তার ব্যবহারে ।।
অনুবাদঃ দন্ত ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কিছু মানুষ আছে যারা নানা রকম তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন উদ্ভাবন করে, যা শাস্ত্রবিধানে উল্লেখ নেই। যেমন, কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনশন করা। এই ধরনের অনশন করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়নি। শাস্ত্রের নির্দেশ হচ্ছে কেবলমাত্র পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্যই অনশন করা উচিত। কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তা করা উচিত নয়। এই ধরনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা তপশ্চর্যা করে, ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, তারা অবশ্যই আসুরিক ভাবাপন্ন। তাদের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিধির বিরোধী এবং তার ফলে জনসাধারণের কোন মঙ্গল হয় না। প্রকৃতপক্ষে, তারা গর্ব, অহঙ্কার, কাম ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে ঐ সমস্ত কর্ম করে। এই ধরনের কাজকর্মের ফলে যে সমস্ত জড় উপাদান দিয়ে দেহ তৈরি হয়েছে তা-ই যে কেবল বিক্ষুব্ধ হয় তা নয়, পরম পুরুষোত্তম ভগবান যিনি এই শরীরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, তিনিও ক্ষুব্ধ হন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই ধরনের অবিধিপূর্বক অনশন বা তপস্যা অপরের কাছেও একটি উৎপাত-স্বরূপ। এই রকম তপশ্চর্যার নির্দেশ বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়নি। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা মনে করতে পারে যে, এই উপায় অবলম্বন করে তারা তাদের শত্রুকে অথবা অন্য দলকে তাদের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য করাতে পারে, কিন্তু এই ধরনের অনশনের ফলে অনেক সময় তাদের মৃত্যু ঘটে। পরম পুরুষোত্তম ভগবান এই ধরনের কাজ অনুমোদন করেননি এবং তিনি বলেছেন যে, যারা এই ধরনের কাজে প্রবৃত্ত হয়, তারা অসুর। এই ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতিও অসম্মানসূচক, কারণ বৈদিক শাস্ত্রের অনুশাসন আদি অমান্য করে তা করা হয়। অচেতসঃ কথাটি এই সম্পর্কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুস্থ স্বাভাবিক মনোভাবাপন্ন মানুষেরা অবশ্যই শাস্ত্রের অনুশাসনগুলি পালন করে চলেন। মনোভাবাপন্ন নয়, তারা শাস্ত্রের নির্দেশ অবহেলা করে তাদের নিজেদের মনগড়া তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনের পন্থা উদ্ভাবন করে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষের যে পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সব সময় মনে রাখা উচিত। ভগবান তাদের আসুরিক যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। তার ফলে তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তাদের নিত্য সম্পর্কের কথা জানতে না পেরে, জন্ম-জন্মান্তরে আসুরিক জীবন যাপন করতে থাকবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই ধরনের মানুষেরা যদি সদ্গুরুর কৃপা লাভ করতে পারে, যিনি তাদের বৈদিক জ্ঞানের পথ প্রদর্শন করেন, তা হলেই তারা এই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
শ্লোকঃ ৭
আহারস্তপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ ।
যজ্ঞস্তপস্তথা দানং তেষাং ভেদমিমং শৃণু ।।
আহারঃ—আহার; তু—অবশ্যই; অপি-ও; সর্বসা— সকলের, ত্রিবিধঃ – তিন প্রকার; ভৰতি — হয়, প্রিয়ঃ—প্রীতিকর; যজ্ঞঃ— যজ্ঞ, তপঃ— তপস্যা; তথা — তেমনই; দানম্—দান; তেষাম্—তাদের; ভেদম্—প্রভেদ; ইমম্—এই; শৃণু—শ্রবণ কর।
গীতার গান
আহারও ত্রিবিধ সে যথাযথ প্রিয় ।
সাত্ত্বিকী, রাজসী আর তামসী যে হেয় ॥
যজ্ঞ, জপ, তপ, দান সেও সে ত্রিবিধ
যার যেবা ভেদ গুণ ভিন্ন বহুবিধ ॥
অনুবাদঃ সকল মানুষের আহারও তিন প্রকার প্রীতিকর হয়ে থাকে। তেমনই যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানও ত্রিবিধ। এখন তাদের এই প্রভেদ শ্রবণ কর।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির গুণের বিভিন্ন অবস্থা অনুসারে আহার, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, তপশ্চর্যা ও দান বিভিন্নভাবে সাধিত হয়। এই সমস্ত একই পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হয় না। খারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন যে, জড় জগতের কোন্ গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোন্ কর্ম সাধিত হয়েছে, তাঁরাই হচ্ছেন যথার্থ জ্ঞানী। যারা মনে করে, সব রকমের যজ্ঞ, খাদ্য অথবা দান সমপর্যায়ভূক্ত, তাদের পার্থক্য নিরূপণ করবার ক্ষমতা নেই, তারা মূর্খ। কিছু ধর্ম-প্রচারক এখন প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, মানুষ নিজের ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা তাই করে যেতে পারে এবং এই ধরনের যথেচ্ছাচার করার ফলেই তাদের পরমার্থ সাধিত হবে। কিন্তু এই ধরনের মূর্খ প্রচারকেরা বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশের অনুসরণ করছে না। তারা নিজেদের মনগড়া পন্থা তৈরি করে জনসাধারণকে বিপথগামী করছে।