সপ্তদশ অধ্যায়

শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ

শ্লোকঃ ১

অর্জুন উবাচ

যে শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়ানিতাঃ।

তেষাং নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বমাহো রজস্তমঃ ।। ১ ।।

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; যে— যারা; শাস্ত্রবিধি ——শাস্ত্রের বিধান; উৎসৃজ্য— পরিত্যাগ করে; যজন্তে—পূজা করে; শ্রদ্ধয়া — শ্রদ্ধা সহকারে, অন্বিতাঃ —যুক্ত হয়ে; তেষাম্—তাদের; নিষ্ঠা — নিষ্ঠা; তু—কিন্তু, কা— কি রকম, কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ; সত্ত্বম্—সত্ত্বগুণে; আহো – অথবা রজঃ—রজোগুণে; তমঃ- তমোগুণে।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

শাস্ত্রবিধি নাহি জানে কিন্তু শ্রদ্ধান্বিত ।

যজন করয়ে যারা কিবা তার হিত ।।

কিবা নিষ্ঠা তার কৃষ্ণ সত্ত্ব, রজ, তম ।

বিস্তার কহ’ত সেই শুনি ইচ্ছা মম ৷।

অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন – হে কৃষ্ণ! যারা শাস্ত্রীয় বিধান পরিত্যাগ করে শ্রদ্ধা সহকারে দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের সেই নিষ্ঠা কি সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক ?

তাৎপর্যঃ চতুর্থ অধ্যায়ের ঊনচত্বারিংশত্তম শ্লোকে বলা হয়েছে যে, কোনও বিশেষ ধরনের কালক্রমে জ্ঞান লাভ হয় এবং পরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। ষোড়শ অধ্যায়ের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, যার। শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধির অনুশীলন করে না, তাদের বলা হয় অসুর এবং যাঁরা শ্রদ্ধা সহকারে শাস্ত্রের অনুশাসনাদি মেনে চলেন, তাঁদের বলা হয় সূর বা দেব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি শ্রদ্ধা সহকারে কোন নীতির অনুশীলন করে যার উল্লেখ শাস্ত্রে নেই, তার কি অবস্থা? অর্জুনের মনের এই সংশয় শ্রীকৃষ্ণকে দূর করতে হবে। যারা একটি মানুষকে বেছে নিয়ে তার উপর বিশ্বাস অর্পণ করে এক ধরনের ভগবান তৈরি করে নেয়, তারা কি সত্ত্বগুণ, রজোগুণ, কিংবা তমোগুণের বশবর্তী হয়ে আরাধনা করতে থাকে? ঐ ধরনের লোকেরা কি জীবনে সিদ্ধি লাভের পর্যায়ে উপনীত হয়? তাদের পক্ষে কি যথার্থ জ্ঞান লাভ করে পরম সিদ্ধির স্তরে উন্নীত হওয়া সম্ভব? যারা শাস্ত্রবিধির অনুশীলন করে না, কিন্তু শ্রদ্ধা সহকারে বিভিন্ন দেব-দেবীর ও মানুষের পূজা করে, তারা কি তাদের প্রচেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে? অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এই সমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন।

শ্লোকঃ ২

শ্রীভগবানুবাচ

ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাং সা স্বভাবজা

সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি তাং শৃণু ॥ ২॥

শ্রীভগবান্ উবাচ— শ্রীভগবান বললেন; ত্রিবিধা — তিন প্রকার; ভবতি হয়, শ্রদ্ধা- শ্রদ্ধা; দেহিনাম্ — দেহীদের; সা—তা; স্বভাবজা – স্বভাব- জনিত; সাত্ত্বিকী — সাত্ত্বিকী রাজসী—রাজসী; চ–ও; এব— অবশ্যই, তামসী—তামসী; চ–এবং; ইতি— এভাবে; তাম্——তা; শণু—শ্রবণ কর।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

স্বভাবজ তিন নিষ্ঠা শ্রদ্ধা সে দেহীর।

সাত্ত্বিকী, রাজসী আর তামসী গভীর ।।

বিবরণ কহি তার শুন দিয়া মন ৷

যার যেবা শ্রদ্ধা হয় গুণের কারণ ।।

অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন – দেহীদের স্বভাব জনিত শ্রদ্ধা তিন প্রকার – সাত্ত্বিকী, রাজনী ও তামসী। এখন সেই সম্বন্ধে শ্রবণ কর।

তাৎপর্যঃ যারা শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও আলস্য বা বৈমুখ্যবশত এই সমস্ত বিধির অনুশীলন করে না, তারা জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের পূর্বকৃত সত্ত্বগুণ, রজোগুণ অথবা তমোগুণাশ্রিত কর্ম অনুসারে তারা বিশেষ ধরনের প্রকৃতি অর্জন করে। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণাবলীর সঙ্গে জীবের আসঙ্গ চিরকাল ধরেই চলে আসছে, যেহেতু জীবসত্তা জড়া প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে, সেই জন্য জড় গুণের সঙ্গে তার আসঙ্গ অনুসারে সে বিভিন্ন ধরনের মানসিকতা অর্জন করে থাকে। কিন্তু যদি সে কোনও সদগুরুর সঙ্গ লাভ করে এবং তার নির্দেশিত অনুশাসনাদি ও শাস্ত্রাদি মেনে চলে, তা হলে তার প্রকৃতি বদলাতে পারা যায়। ক্রমশ, সেভাবেই মানুষ তম থেকে রজ, কিংবা রজ থেকে সত্ত্বে তার অবস্থার উন্নতি সাধন করতে পারে। এই থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রকৃতির কোনও এক বিশেষ গুণের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের ফলে মানুষ পূর্ণ সার্থকতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। সব কিছুই সতর্কতার সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে, সদগুরুর সান্নিধ্যে বিবেচনা করতে হয়। এভাবেই মানুষ প্রকৃতির উচ্চতর গুণগত পর্যায়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারে।

শ্লোকঃ ৩

সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত।

শ্রদ্ধাময়োহয়ং পুরুষো যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ ॥ ৩॥

সত্ত্বানুরূপা— অন্তঃকরণের অনুরূপ; সর্বস্য— সকলের; শ্রদ্ধা — শ্রদ্ধা; ভৰতি — হয়; ভারত -হে ভারত; শ্রদ্ধা—শ্রদ্ধা; ময়ঃ—পূর্ণ; অয়ম্—এই; পুরুষঃ—জীব; যঃ—যে; যং—যেই রকম শ্রদ্ধঃ শ্রদ্ধা; সঃ – সেই প্রকার; এর – অবশ্যই; সঃ— সে।

গীতার গান

নিজ সত্ত্ব অনুরূপা শ্রদ্ধা সে ভারত ৷

শ্রদ্ধাময় পুরুষ যে শ্রদ্ধা যে তেমত ।।

অনুবাদঃ হে ভারত। সকলের শ্রদ্ধা নিজ-নিজ অন্তঃকরণের অনুরূপ হয়। যে যেই রকম গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান ।

তাৎপর্যঃ প্রতিটি মানুষেরই, সে যেই হোক না কেন, কোন বিশেষ ধরনের শ্রদ্ধা থাকে। কিন্তু তার স্বভাব অনুসারে সেই শ্রদ্ধা সাত্ত্বিক, রাজসিক অথবা তামসিক হয়। এভাবেই তার বিশেষ শ্রদ্ধা অনুসারে সে এক এক ধরনের মানুষের সঙ্গ করে। এখন প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে, পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি জীবই মূলত পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য বিভিন্ন অংশ-বিশেষ। তাই, মূলত প্রতিটি জীবই জড়া প্রকৃতির এই সমস্ত গুণের অতীত। কিন্তু কেউ যখন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা ভুলে যায় এবং বদ্ধ জীবনে জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে, তখন সে বৈচিত্র্যময় জড়া প্রকৃতির সঙ্গ অনুসারে নিজের অবস্থান গড়ে তোলে। তার ফলে তার যে কৃত্রিম বিশ্বাস ও উপাধি তা জড়-জাগতিক কেউ যদিও কতকগুলি সংস্কার বা ধারণার বশবর্তী হয়ে পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে হচ্ছে নির্গুণ বা গুণাতীত। তাই, পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে তার জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত জড় কলুম থেকে মুক্ত হতে হবে। সেটিই হচ্ছে নির্ভয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার একমাত্র পন্থা—কৃষ্ণভাবনামৃত। কৃষ্ণভাবনামৃত যিনি লাভ করেছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে সিদ্ধ স্তরে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু কেউ যদি আত্মজ্ঞান লাভের পন্থা অবলম্বন না করেন, তা হলে তিনি অবশ্যই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হবেন।

এই শ্লোকে শ্রদ্ধা অর্থাৎ ‘বিশ্বাস’ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রদ্ধা অর্থাৎ বিশ্বাসের প্রথম উদয় হয় সত্ত্বগুণের মাধ্যমে। কারও শ্রদ্ধা দেব-দেবীর প্রতি অথবা মনগড়া কোন ভগবান কিংবা কোন রকম অলীক কল্পনার প্রতি থাকতে পারে। এই যে সুদৃঢ় বিশ্বাস, তা জড় জগতের সত্ত্বগুণের কর্ম থেকে উদ্ভূত। কিন্তু জড়-জাগতিক বদ্ধ জীবনে কোন কাজই পরিপূর্ণভাবে পরিশুদ্ধ নয়। সেগুলি হয় মিশ্র প্রকৃতির। সেগুলি শুদ্ধ সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন হয় না। শুদ্ধ সত্ত্ব হচ্ছে অপ্রাকৃত, সেই শুদ্ধ সত্ত্বে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের যথার্থ প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারা যায়। কারও শব্দা যতক্ষণ পর্যন্ত না শুদ্ধ সত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা জড়া প্রকৃতির যে কোন গুণের দ্বারা কলুষিত হতে পারে। জড়া প্রকৃতির কলুষিত গুণগুলি হৃদয়ে বিস্তার লাভ করে। অতএব ভাড়া প্রকৃতির বিশেষ কোন গুণের সংস্পর্শে হৃদয়ের স্থিতি অনুসারে জীবের শ্রদ্ধার প্রকাশ হয়। বুঝতে হবে যে, কারও হৃদয় যদি সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত থাকে, তা হলে তার শ্রদ্ধা হবে সাত্ত্বিক। তার হৃদয় যদি রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত থাকে, তা হলে তার শ্রদ্ধা হবে রাজসিক এবং তার হৃদয় যদি তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত থাকে বা মোহাচ্ছন্ন থাকে, তা হলে তার শ্রদ্ধাও হবে সেই রকমই কলুষিত। এভাবেই এই জগতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন রকমের শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস দেখতে পাই এবং ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের থেকে নানা রকম ধর্মের উদয় হয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের যথার্থ তত্ত্ব শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত, কিন্তু হৃদয় কলুষিত হয়ে পড়ার ফলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসের উদয় হয়। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস অনুসারে নানা রকম উপাসনা পদ্ধতির উদ্ভব হয়।

error: Content is protected !!