আমাদের ছোটবেলায় নাপিতের দোকানে কিছু ‘অতি আবশ্যকীয় চিত্রকলা সাজানো থাকতো। এমন কোন নাপিতের দোকান ছিল না যেখানে (১) তীরবিদ্ধ বোররাকের ছবি, (২) ক্ষুদিরামের ফাঁসির ছবি, (৩) তাজমহলের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি না ঝুলতো। এই তিন ছবির সঙ্গে চুল কাটার কি সম্পর্ক আমি জানি না–নাপিতরা হয়ত জানেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়নি।
এই তিন ছবির একটি, তাজমহলের প্রচার অনেক বেশি ছিল। প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বসার ঘরে ফ্রেমে বাঁধানো সূচিকর্ম হিসেবে তাজমহল থাকত। তার সঙ্গে থাকত দু’লাইনের কবিতা–
ভেতরে তাহার মমতাজ নারী
বাহিরেতে শাহজাহান।
সবার শেষে থাকত সৃচি শিল্পীর নাম এবং তারিখ। তারিখের শেষে ইং অর্থাৎ ইংরেজি সন কিংবা বাং অর্থাৎ বাংলা সন। সেই সময়ে বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশনে ঢোকার আগে মেয়েদের অবশ্য শিক্ষণীয় কর্মকাণ্ডের একটি ছিল–সেলাইয়ের কাজ। সেলাইয়ের কাজের অনেকগুলি ধাপ ছিল। জরীর তাজমহল হচ্ছে সর্বশেষ ধাপ। সঁচকর্মের এম.ফিল. ডিগ্রীর মত। মেয়ে দেখতে এসে মুরব্বিরা এক পর্যায়ে বলতেন–কই, তাজমহলটা দেখি?
রূপালী জরীর একটি তাজমহল আমার মাও বানিয়েছিলেন (কবিতা সহ)। সেই তাজমহল দীর্ঘদিন আমাদের বসার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে শোভা পেয়েছে। মা’র তাজমহল দেখে আমি তাজমহলের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এটাকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য কেন বলা হয় কিছুতেই বুঝতে পারি না। মসজিদের মত একটা দালান, সুন্দর হলেই বা কতটা সুন্দর হবে? যেমন মস্কোর ঘণ্টা। এটিও সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। ব্যাপার হচ্ছে একটা ঘণ্টা বড় হলেও সেটা ঘণ্টাই। তার সামনে গিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে থাকার কি থাকতে পারে? এরচে’ ব্যবিলনের শূন্যোদ্যানকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। নাম শুনলেই মনে হয়–চমৎকার একটা বাগান আকাশে ঝুলছে। ব্যবিলনের শূন্যোদ্যান দেখতে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাজমহল না।
লেবু কচলে তিতা বানানোর ব্যাপার তাজমহলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, গান লিখে তাজমহলকে শুধু যে তিতা বানানো হয়েছে তাই না–যক্ষতিতা বানানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে–অধিকাংশ কবি তাজমহল নিয়ে কবিতা লিখেছেন তাজমহল না দেখে। এর মধ্যে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। তাজমহল না দেখেই তিনি যে কবিতা লিখলেন–তার নাম ‘তাজমহল’। তবে তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা ‘শা-জাহান’ অবশ্যি তাজমহল দেখার পরে লেখা পূর্ণেন্দু পত্রী ও সাহিত্যের তাজমহল।]
কবিদের তাজমহল নিয়ে এত যে উচ্ছ্বাস, এত যে লেখালেখি তার সবটাই প্রেম বিরহ নিয়ে। তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে কাউকে তেমন মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। তাজমহলের সৌন্দর্য হয়ত তাঁদের আকৃষ্ট করেনি–তাজমহলে প্রেমের মীথটাই তাঁদের আকৃষ্ট করেছে। যাঁরা তাজমহল দেখেছেন তাঁরা সবাই যে মুগ্ধ হয়ে আহা-উঁহু করেছেন তা না। অনেকের কাছেই ভাল লাগেনি। অনেকের মধ্যে একজন হলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কথাশিল্পী)। অন্যজনও অতি বিখ্যাত মানুষ। এলডুস হাক্সলি। তিনি বললেন -”The Taj was a disappointment.
তারপরও প্রতিবছর পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জড় হয়। তারা ফিরে যায়। তাদের মধ্যে একদল আবার আসে। অনেকের নেশা ধরে যায়। ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকে। এমন একজন হলেন–নর্থ ডাকোটায় আমি যে বাড়িতে থাকতাম, তার বাড়িউলী। মহিলার বয়স আশির উপরে। তিনি এ পর্যন্ত চারবার ‘তাজ’ দেখেছেন–আবারো যাবার ইচ্ছা। আমি ‘তাজের’ এত কাছাকাছি থেকেও তাজ দেখিনি শুনে তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি প্রস্তরযুগের একজন মানুষ–‘পিকিংম্যান’। তিনি প্রায় ধমক দেয়ার মত বললেন, দেখনি কেন?
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, দেখতে ইচ্ছা করেনি।
কেন দেখতে ইচ্ছা করেনি?
আমি তাজমহল সম্পর্কে এত শুনেছি যে দেখতে ইচ্ছা করে না। আমার নিজের কল্পনায় একটা তাজমহল আছে–সেই তাজমহল বাস্তবের চেয়ে সুন্দর বলে আমার ধারণা।
বুড়ি বলল, খুব ভুল বললে। বাস্তবের তাজমহল তোমার কল্পনার চেয়ে অনেক সুন্দর!
আমি বললাম, কি করে বলছ–আমার কল্পনার তাজমহল তো তুমি দেখনি! ।
আমি অনুমান করতে পারি। তুমি আমার উপদেশ শোন–একবার দেখে এসো।
আচ্ছা, সময় পেলে এবং সুযোগ পেলে যাব।
.
সময় সুযোগ দুই-ই পেয়েছিলাম–দেখতে ইচ্ছা করল না। দু’বার খুব কাছ থেকে (দিল্লী) ঘুরে এসেছি। ট্রেনে চেপে ঘন্টা দু-একের মধ্যে আগ্রা যাওয়া যায়–যেতে ইচ্ছা করল না। আমি আমার কল্পনা নষ্ট করতে চাই না। কল্পনা নষ্ট হলে আঘাত পেতে হয়। চীনের মহাপ্রাচীর দেখে এই কষ্ট পেয়েছিলাম। কল্পনায় ভয়াবহ কিছু ভেবে রেখেছিলাম–কাছে গিয়ে মন খারাপ হল। মনে হল–মানুষের ক্ষমতার কি বিপুল অপচয়!
তাজমহল তৈরির কাহিনীও আমাকে কষ্ট দেয়। সম্রাট শা-জাহান যে মূল্যে যমুনার তীরে এ সমাধি সৌধ তৈরি করলেন–সেই মূল্যে প্রেমের সৌধ তৈরি করা যায় না। কিংবদন্তী বলে, ওস্তাদ ইসা আফেন্দি ছিলেন মূল স্থাপত্যবিদ। তিনি কুড়ি হাজার শ্রমিক। নিয়ে বাইশ বছরে শেষ করলেন তাজমহল। সম্রাট দেখলেন। তাঁর কাছে মনে হল–সম্রাটের প্রেমের যথাযথ রূপ দেয়া হয়েছে। তিনি খুশি হলেন–এবং ওস্তাদ ইসা খা আফেন্দির মৃত্যুদণ্ডের হুকুম দিলেন। যেন এই ওস্তাদ দ্বিতীয় কোন তাজ তৈরি করতে না পারেন। শুধু তাই না–তিনি হুকুম দিলেন ক্যালিগ্রাফারদের চোখ উপড়ে ফেলতে–যেন তাজের ক্যালিগ্রাফির মত ক্যালিগ্রাফি আর না হয়। স্থাপত্য বিভাগের সব। প্রধানদেরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ হল। যারা মর্মর পাথর কাটত তিনি তাদের হাত কেটে ফেলার হুকুমও দিলেন। একটি মহান শিল্পকর্মের জন্যে এই ছিল তাদের পুরস্কার।
তাজ নিয়ে প্রচলিত এই কিংবদন্তী আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। প্রথমত, শা-জাহান একজন প্রেমিক মানুষ। পত্নী বিয়োগ-ব্যথায় কাতর। এমন একজন মানুষ–এত নিষ্ঠুর হতে পারেন না। তার চেয়েও বড় যুক্তি হচ্ছে–শাজাহান যমুনার অপর তীরে একটি কালো তাজমহল বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন। যা হবে মূল তাজমহলের হুবহু ছবি–শুধু তা করা হবে কালো পাথরে। স্থপতিদের তিনি যদি হত্যা করেন তাহলে কারা বানাবে ‘কৃষ্ণতাজ’?
অবশ্যি সম্রাটরা তো সাধারণ মানুষদের মত না। আমাদের কাছে যা নিষ্ঠুরতা তাদের কাছে তা হয়ত না। সম্রাট হুমায়ুনের মত দরদী সম্রাটকেও তো দেখি কত সহজে তার বিদ্রোহী ছোটভাই মীর্জা কামরানের চোখ উপড়ে ফেলার হুকুম দেন। চোখ উপড়ে ফেলার পর সেই অক্ষিগহ্বরে লেবুর রস ঢেলে দেয়া হয়। মীর্জা কামরানের চিৎকারে দিল্লীর পশুপাখি কাঁদতে থাকে। কিন্তু দিল্লীর বাদশাহ হুমায়ূন বিচলিত হন না। তিনি শান্তমুখে তাঁর প্রিয় লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতে চলে যান।
যাই হোক, এই বহু-বিতর্কিত তাজমহল দেখতে যাবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত করলাম। তিন কন্যা এবং স্ত্রীকে নিয়ে এক বিকেলে উপস্থিত হলাম তাজের সামনে–।
বিস্ময়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল না–মানুষের হাত এই জিনিস তৈরি করেছে। মহান শিল্পকর্মের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালে হৃদয়ে প্রবল হাহাকার তৈরি হয়। চোখে জল আসে। আমার চোখ জলে ভরে গেল। জলভরা চোখে দেখলাম–সম্রাটের স্বপ্ন–মানুষের হাতে তৈরি শ্বেতপদ্ম। আমার কল্পনা। কখনো এর কাছাকাছি যেতে পারেনি।
“আমার আপন আঁধার” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ