সময় এগোচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন থেকে খসে পড়ছে অনেক সংস্কার, অনেক মূল্যবোধ। মানুষ অনেক পুরোন ধ্যান-ধারণা বিদায় দিচ্ছে। মানুষের এই অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধনীরাও শোষণের নানা নতুন নতুন কৌশল বের করছে, বের করছে গরীব মানুষগুলোর মগজ ধোলাইয়ের নানা প্যাঁচ-পায়জার। এইসব কূট কৌশল যেমন ধনীদের ভাড়া করা কিছু বুদ্ধিমানদের কাছে সে-সব ধরাও পড়ে যাচ্ছে। এইসব বিক্রি না হওয়া বুদ্ধিমানদের কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন বঞ্ছিত মানুষদের ঘুম ভাঙ্গাতে। তাঁদের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে উঠছে নানা সংগঠন, নানা গোষ্ঠি। এইসব সংগঠন ও গোষ্ঠি বঞ্ছিতদের ধোলাই করা মগজ আবার ধোলাই করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে চিন্তা, জাগিয়ে তুলছে নতুন চেতনা, গড়ে উঠছে নতুন সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ।

হুজুরের দল অবশ্যই এই অবস্থায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে এক সময় বঞ্ছিত মানুষগুলোর সোচ্চার দাবী ও ক্ষোভকে সম্মান জানিয়ে রাজ্য-পাট ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস নেয় না। ওরা অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তোলে, প্রতিআক্রমণ চালায়। শোষকরা ভালমতই জানে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখে দাবিয়ে চলার মত পুলিশ ও সেনা রাষ্ট্র-শক্তির নেই। তাই নানা কৌশলে চেষ্টা করে শোষিত ক্ষুব্ধ মানুষগুলোকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন পন্থা ও কৌশলের সাহায্য নিতে।

নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের লড়াইতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার পুরোটা যেহেতু ধনী হুজুরের দলই জোগায় তাই রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলকারী রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রশক্তি হয়ে দাঁড়ায় ধনীদের বিশ্বস্ত যো-হুজুরের দল।

এরই সঙ্গে হুজুরের দল আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর বিবেক কিনতে বাজারে নেমে পড়ে। টপাটপ বিক্রিও হয়ে যায় অনেকেই। শোষিত মানুষগুলোর মগজ ধোলাই করতে হুজুরের দল নামিয়ে দেয় রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের। নেমে পড়ে সরকারী ও ধনী মালিকানাধীন প্রচার-মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি। মগজ ধোলাই করা হতে থাকে প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ভাবে। পাশাপাশি তথাকথিত ধর্মীয় চেতনা জনমানসে বাড়াবার চেষ্টা চলতে থাকে। প্রয়োজনে জাত-পাত ও সাম্প্রদায়িক নানা চিন্তাকে উসকে দেওয়ার নানা কৌশলও টপাটপ বের করতে থাকে হুজুরের উচ্ছিষ্টভোগী পরামর্শদাতা ও দালালের দল। ভক্তিরসের বান ডাকান হতে থাকে নানা ভাবে। অদৃষ্টবাদ, অলৌকিকত্বের রমরমা বাজার তৈরি করতে সূক্ষ্ম বুদ্ধির কৌশলেই কাজ হয়। অদৃষ্টবাদ, অলৌকিকত্বের রমরমা বাজার তৈরি করতে সূক্ষ্ম বুদ্ধির কৌশলেই কাজ হয়। জ্যোতিষ ও প্যারাসাইকোলজিস্ট নামধারী প্রবঞ্ছকের দল রাষ্ট্রশক্তির আসকারায় তাঁদের উদ্ভট সব চিন্তা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে নিজেদের আখের গোছাবার পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে ধনীক শ্রণীর স্বার্থ রক্ষা করে। প্রতিটি ক্লাব, গণসংগঠন, লাইব্রেরী, স্কুল, কলেজকে কুক্ষিগত করে নিজেদের ইচ্ছেমত সাংস্কৃতিক চেতনা মাথায় ঢোকাতে কখনো রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজে লাগায় উজুরের দল। কুক্ষিগত করার জন্য লোভ, ভয়, বলপ্রয়োগ ইত্যাদিকে পাথেয় করে রাজনীতি পেশার মানুষগুলো। কখনো বা সাহায্যের বদান্যতায় সংস্থাগুলোর ইচ্ছেমত চলার ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। আবার কখনো বা ওইসব সংস্থার নেতাদের বিবেক কিনেই সংস্থাকে পকেটে পুরে ফেলে হুজুরের দল। কখনো নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে ওই ধরনের সাজান আন্দোলন শুরু করা হয়; আন্দোলনে সামিল মানুষদের বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট করার চেষ্টায়। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রশক্তি আন্দোলনকারীদের দেশের সাধারণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে জাতীয়তাবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্রপন্থী, ইত্যাদি ছাপ মেরে দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারী, বেসরকারী প্রচার মাধ্যমগুলোর নিরবচ্ছিন্ন প্রচারে শোষিত মানুষদের এই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দেশের শোষিত মানুষেরাই বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। কখনো বা সওদা হতে না চাওয়া উন্নত শির, বিপদজনক নেতার চরিত্র-হননের নানা প্রচেষ্টা চালান হয় সাজান আন্দোলনকারীদের সাহায্যে। কখনো বা নেতাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে গুলিবিনিময়ের আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হয়। অথবা গল্প ফাঁদা হয় পতিতাপল্লী রেইড করতে গিয়ে ধরাপড়া নেতার গুলি বিনিময় এবং মৃত্যুর।

এই যে কথাগুলো লিখেছি, এর একটা কথাও কল্পনাপ্রসূত নয়। যখনই কোনও দরিদ্র শোষিত জনগোষ্ঠি ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, আঘাত হেনেছে হুজুরদের দুর্গে, তখনই সেই আন্দোলনকে ধ্বংস করতে শোষকশ্রেণী ও তার সেবক রাষ্ট্রশক্তি এই পদ্ধতিগুলোকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রয়োগ করে চলেছে।

যারা শোষণ করছে, তারা চায়, যাদের শোষণ করছি তাঁদের এমন নানা নেশায় ভুলিয়ে রাখব, মাতিয়ে রাখব যে তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকবে যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোন দিনই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

আন্দোলনকে জয়ী দেখতে চাইলে হুজুরের দল ও তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার আন্দোলন ধ্বংস করতে কি কি কৌশল গ্রহণ করে থাকে সে বিষয়ে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা একান্তই প্রয়োজনীয়। সম্ভাব্য আক্রমণ বিষয়ে অবহিত থাকলে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা এবং পাল্টা আক্রমণ চালান সহজতর হয়।

শোষকশ্রেণী বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন যারা চালাবেন তাঁদের এটা অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর যথেষ্ট নজর রাখে রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার। সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের রয়েছে বহু বিভাগ। আমাদের সরকারের ইন্টেলিজেন্ট ডিপার্টমেন্টেরই রয়েছে তিরিশের ওপর বিভাগ বা সেল। ছাত্র, রাজনৈতিকদল, ডাকাত অপরাধ, নকশাল সংগঠন ইত্যাদি প্রত্যেকটা বিভাগের জন্যে রয়েছে সেল। গোয়েন্দারা এইসব সংগঠনগুলোর ওপর নজর রাখেন। এ-ছাড়াও গোয়েন্দাদপ্তরের ও বিভিন্ন থানারই রয়েছে নিজস্ব ইনফর্মার। এই ইনফর্মাররা প্রতিটি সেলেই তথ্য যোগাচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। এরা সরকারী চাকরি করে না। এদের আত্মপরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে এক একজন বড় পুলিশ অফিসারদের হাতে থাকে সরকারী খরচে নিজস্ব বিশ্বস্ত ইনফর্মার। এরা কোথায় নেই? কোনও সংগঠন সরকারের পক্ষে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে, সন্দেহ করলেই তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ইনফর্মার। এ-ছাড়া গোয়েন্দারাও নজরে রাখেন। সুতরাং বহু আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিষয়েই সরকার ও শোষকশ্রেণী সব সময়ই ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বুঝে তাকে রুখতে সরকার হাজির করে নানা কৌশল।

এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য কৌশল হল, সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে নিজের প্রয়োজনীয় খাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়া।

মানুষের চিন্তাধারাকে কোনও একটা বিশেষ খাতে বওয়াতে, চিন্তায় কোনও বিশ্বাসকে স্থায়ীভাবে গাঁথতে যে পদ্ধতিটি এখনও সবচেয়ে বেশি সফল বলে স্বীকৃত, তা হল অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সুযোগ পেলেই মিথ্যাকেও বার বার নানা ভাবে বিশ্বাসযোগ্য কর পরিবেশন করতে থাকা। কোনও একটি মিথ্যে বিশ্বাসকে মানুষের মাথায় সত্যি বলে ঢোকাতে হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রচার কর ওই বিশ্বাসকে তোমার এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির রয়েছে অগাধ আস্থা ও অচল ভক্তি। সফল রাজনীতিকদের এসব বিষয় জানতে হয়, নইলে শিল্পপতিদের কাছে কলকে পাওয়া যায় না। ওরা ধৈর্য ধরে সুযোগ বুঝে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণকে মাঝে মধ্যেই জানাতে থাকে ওদের জ্যোতিষ-বিশ্বাস ও জ্যোতিষ নির্ভরতার কথা, ঈশ্বর বিশ্বাস ও অলৌকিক ক্ষমতাবান ধর্মগুরুদের প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তির কথা। এতে কিছু কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মগুরুর শিষ্যদের ভোট প্রভাবিত হয়, জনসাধারণের মধ্যে জ্যোতিষ ও ভাগ্য-নির্ভরতা বাড়তে থাকে। কর্মফলে বিশ্বাস, ঈশ্বরনির্ভরতা, গুরুনির্ভরতা ইত্যাদি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাস হ্রাস পেতে থাকে। আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ আত্মনিবেদন করতে জানে, আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে দুঃখ ও বঞ্ছনাকে ভুলতে জানে কিন্তু লড়াকু হতে জানে না। যে লড়াকু নয়, তাকে আবার ভয় কি?

মার্কসবাদের সঙ্গে অপরীক্ষিত এবং শুধুমাত্র বিশ্বাসশাস্ত্রের চূড়ান্ত বিবাদ থাকলেও কিছু কিছু মার্কসবাদী মন্ত্রী কিন্তু জ্যোতিষীদের সম্মেলনে শুভেচ্ছা বাণী-টাণীও পাঠান। মেহনতি মানুষের বন্ধু ওইসব মার্কসবাদী দলগুলো তাদের দলের মন্ত্রীদের এমন মার্কস-বাদ-ই কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার ফতোয়া জারি করেন না কেন? কেন এমন অদ্ভুত আচরণ? ওইসব কার্যকলাপ কি শুধুই মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যক্তিগত চ্যুতি বা নীতিভ্রষ্টতার নিদর্শন? না কি ক্ষমতায় শাঁসে জলে থাকার পরিণতিতে সাধারণ মানুষের চেতনাকে অদৃষ্টবাদী করে তোলার কূট কৌশল?

একটু তলিয়ে দেখলেই দেখতে পাবেন ওইসব তথাকথিত অদৃষ্ট অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতারা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ অদৃষ্টবাদ বিরোধী চরমবাস্তববাদী। ‘’ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবেই’, বলে কোনও রাজনৈতিক নেতা বা দলই নির্বাচনের লড়াইতে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না।

মিটিং, মিছিল, প্রচারের বিশাল ব্যয়, কর্মী, পেশীশক্তি, আগ্নেয়াস্ত্র যোগাড়, বোমের স্টক, জালিয়াতির নব-নব কৌশলকে কাজে লাগানোর প্রয়াস, বুথ দখল ইত্যাদি সকল বিষয়েই বিরোধী প্রার্থীকে টেক্কা দিয়েই জেতার চেষ্টা করে।

error: Content is protected !!