ভাগ – ৪
গঠনের বছরগুলো
পরিচ্ছেদ : ১ – শৈশব
কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং নারী হয়ে ওঠে। সমাজে যেভাবে দেখা দেয় স্ত্রীলিঙ্গ মানুষ কোনো জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক নিয়তি তার রূপ নির্ধারণ করে না; সার্বিকভাবে সভ্যতাই উৎপাদন করে পুরুষ ও খোজার মাঝামাঝি এ-প্রাণীটি, যাকে বলা হয় নারী। শুধু অন্য কার হস্তক্ষেপই একটি মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে অপর-রূপে। যখন সে অস্তিত্বশীল নিজের মধ্যে ও নিজের জন্যে, তখন কোনোশিশুর পক্ষে নিজেকে লৈঙ্গিকভাবে পৃর্থক ভাবাই কঠিন। যেমন ছেলেদের বেলা, তেমনি মেয়েদের বেলাও সবার আগে দেহ হচ্ছে এক ব্যক্তিতার বিকিরণ, এটা এমন এক হাতিয়ার, যা সম্ভব করে তোলে বিশ্বকেবোঝা : হাত দিয়ে, চোখ দিয়ে শিশুরা বোঝে বিশ্বকে, যৌনাঙ্গ দিয়ে নয়। জন্মলাভের ও দুধ ছাড়ানোর নাটক একইভাবে উন্মোচিত হয় উভয় লিঙ্গের শিশুর কাছেই; এগুলোর আকর্ষণ ও আনন্দ একই; স্তন্যপান প্রথমে তাদের সবচেয়ে সুখকর ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলোর উৎস; তারপর তারা যায় এক পায়ুপর্বের ভেতর দিয়ে, যখন মলমূত্র ত্যাগে তারা পায় তাদের চরম সুখ, যা দুজনে একই রকম। তাদের যৌনাঙ্গের বিকাশও একই রকম; তারা একই আগ্রহে ও একই নৈর্ব্যক্তিকতার সাথে লাভ করে নিজেদের শরীর সম্বন্ধে জ্ঞান; ভগাঙ্কুর ও শিশ্ন থেকে তারা পায় একই রকম অস্পষ্ট সুখ। তাদের সংবেদনশীলতার যেহেতু দরকার হয়একটা বস্তু, তাই সেটি হয় মায়ের অভিমুখি : কোমল, মসৃণ, স্থিতিস্থাপক নারীশরীর জাগায় যৌনকামনা, এবং এ-কামনাগুলো পরিগ্রাহী; ছেলের মতোই আক্রমণাত্মকভাবে মেয়ে চুমো খায় তার মাকে, তাকে নাড়াচাড়া করে, আদর করে; আরেকটি নতুন শিশু জন্ম নিলে তারা বোধ করে একই রকম ঈর্ষা। বারো বছর বয়স পর্যন্ত বালিকা থাকে তার ভাইদের মতোই সবল, এবং তার থাকে একই মনোবল; কোনোক্ষেত্রেই সে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত থাকে না। বয়ঃসন্ধির বেশ আগে এবং কখনো কখনো শৈশবের শুরু থেকেই, মেয়েকে যদি আগে থেকেই লৈঙ্গিকভাবে নির্ধারিত মনে হয় আমাদের, সেটা এজন্যে নয় যে রহস্যময় প্রবৃত্তি তাকে সরাসরি দণ্ডিত করেছে অক্রিয়তা, ছেনালিপনা, মাতৃত্বের জন্যে; বরং এজন্যে যে প্রায় শুরু থেকেই শিশুর ওপর অন্যদের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এবং এভাবে শৈশব থেকেই তাকে দীক্ষিত করা হয় তার বৃত্তিতে।
নবজাতক শিশুর কাছে বিশ্ব প্রথম ধরা পড়ে শুধু তার সহজাত ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে; সে তখনও মগ্ন থাকে সমগ্রের বুকে যেমন ছিলো যখন সে ছিলো অন্ধকার জরায়ুর ভেতরে; যখন তার মুখে দেয়াহয় স্তন বা দুধের বোতল তখনও সে পরিবৃত থাকে মায়ের মাংসের উষ্ণতা দিয়ে। একটু একটু করে সে নিজের থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন বলে বুঝতে শেখে বস্তুদের, এবং নিজেকে তাদের থেকে পৃথক করতে পারে।এর মাঝে কম বা বেশি নৃশংসভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয় পুষ্টিকর শরীরটি থেকে। অনেক সময় শিশু প্রচণ্ড সংকট দিয়ে এ-বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানায়, তা যাই থোক, যখন এ-বিচ্ছিন্নতা সম্পূর্ণতা লাভ করে, হয়তো ছ-মাস বয়সে, তখন শিশু নানা রকম অনুকৃতির মাধ্যমে দেখাতে থাকে অন্যদের আকৃষ্ট করার বাসনা, যা পরে হয়ে ওঠে আসলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা। নিশ্চিতভাবেই এ-মনোভাব একটা সুবিবেচিত পছন্দের মাধ্যমে ঘটে না। দুধের শিশু প্রত্যক্ষভাবে যাপন করে প্রতিটি অস্তিত্বশীলের মৌল নাটক : অপর-এর সঙ্গে তার সম্পর্কের নাটক। মানসিক যন্ত্রণার সাথে পুরুষ বোধ করে তার বাঁধনমুক্তি, তার অসহায়ত্ব। তার স্বাধীনতা, তার মন্ময়তা থেকে পলায়নের সময় সে নিজেকে সানন্দে হারাতে চায় সমগ্রের বুকে। এখানেই, আসলে, আছে তার বিস্মৃতির জন্যে আকুলতার জন্যে, নিদ্রার জন্যে, পরমোল্লাসের জন্যে, মৃত্যুর জন্যে মহাজাগতিক সর্বেশ্বরবাদী স্বপ্নের উৎস।
এ-পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যাখ্যা করতে হবে শিশুর আচরণ : দৈহিক রূপে এক অদ্ভুত বিশ্বে সে আবিষ্কার করে সসীমতা, একাকীত্ব, অসহায় পরিত্যাগ। সে তার অস্তিত্বকে একটি মূর্তিতে প্রক্ষেপ করে প্রয়াস চালায় এ-বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণের, অন্যরা প্রতিষ্ঠিত করবে যার বাস্তবতা ও মূল্য। এমন মনে হয় যে সে-সময় সে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে শুরু করে তার স্বরূপ যখন সে আয়নায় চিনতে পারে তার। প্রতিফলন–এ-সময়টা মিলে যায় দুধ ছাড়ার সময়ের সাথে : তার অহং এতোটা পরিপূর্ণভাবে অভিন্ন হয়ে হয়ে ওঠে এ-প্রতিফলিত ছবির সাথে যে প্রক্ষিপ্ত হয়েই শুধু এটি গঠিত হয়। আয়না প্রকৃতপক্ষে একটি বড়ো ভূমিকা পালন করুক বা না করুক, এটা নিশ্চিত যে শিশু ছ-মাস বয়সের দিকে তার বাবা-মাকে অনুকরণ করতে, এবং তাদের স্থিরদৃষ্টির তলে সে নিজেকে একটি বস্তু হিশেবে গণ্য করতে শুরু করে। ইতিমধ্যেই সে হয়েউঠেছে এক স্বায়ত্তশাসিত কর্তা, যে সীমাতিক্রমণ করতে শুরু করেছে বাইরের বিশ্বের দিকে; কিন্তু সে নিজের মুখোমুখি হয় শুধু এক প্রক্ষিপ্ত রূপে।
যখন শিশু আরো বেড়ে ওঠে, আদি পরিত্যাগের বিরুদ্ধে সে লড়াই করে দুরকমে। সে উদ্যোগ নেয় বিচ্ছিন্নতাকে অস্বীকার করার : মায়ের বাহুতে গিয়ে পড়ে সে খোঁজে তার সজীব উষ্ণতা এবং দাবি করে তার আদর। এবং সে নিজের যাথার্থ প্রতিপাদন করতে চায় অন্যদের অনুমোদনের মাধ্যমে। তার কাছে প্রাপ্তবয়স্কদের মনে হয় দেবতা, কেননা তাদের আছে তাকে অস্তিত্বে ভূষিত করার ক্ষমতা। সে অনুভব করে এ-বোধের যাদু, যা তাকে একবার পরিণত করে আনন্দদায়ক ছোট্ট দেবতায়, আবার পরিণত করে দানবে। প্রথম তিন-চার বছর ছেলে ও মেয়ের মনোভাবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না; উভয়েই চায় দুধ ছাড়ার আগে তারা যে-সুখের মধ্যে ছিলো, সে-অবস্থাটিকে স্থায়ী করে রাখতে; উভয় লিঙ্গেই দেখা দেয় অন্যদের মনে প্রলোভন জাগানোর ও নিজের গরিমা প্রদর্শনের স্বভাব : তাদের বোনদের মতোই ছেলেরাও চায় বড়োদের খুশি করতে, তাদের হাসাতে, তাদের প্রশংসা পেতে।
প্রাপ্তবয়স্কদের স্থিরদৃষ্টির যাদু চপল। শিশু ভান করে যেনো সে অদৃশ্য হয়ে গেছে; এ-খেলায় প্রবেশ করে তার মা-বাবা, অন্ধের মতো তাকে খোঁজার চেষ্টা করে এবং হাসতে থাকে; তবে অবিলম্বে তারা বলে : ‘তুমি ক্লান্তিকর হয়ে উঠছো, তুমি একেবারেই অদৃশ্য নও’। শিশুটি তাদের একটি চমৎকার কথা বলে মজা দিয়েছে; সে এটা আবার বলে, এবং এবার তারা তাদের কাঁধ ঝাঁকায়। এ-বিশ্বে, যা কাফকার মহাবিশ্বের মতো অনিশ্চিত ও ভবিষ্যদ্বাণী-অসম্ভব, পদে পদে মানুষ হোঁচট খায়। এজন্যেই অনেক শিশু বেড়ে উঠতে ভয় পায়; তারা হতাশ হয় যখন তাদের পিতামাতা আর তাদের হাঁটুর ওপরে তোলে না বা উঠতে দেয় না বড়োদের বিছানায়। দৈহিক হতাশার মধ্য দিয়ে তারা অধিকতর নিষ্ঠুরভাবে অনুভব করতে থাকে অসহায়ত্ব, পরিত্যাগ, যন্ত্রণাবোধ ছাড়া যা কোনো মানুষ বুঝতে পারে না।
ঠিক এখানেই ছোটো মেয়েদের প্রথম মনে হয় বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত বলে। একটি দ্বিতীয় বারের জন্যে দুধ ছাড়া, যেটি প্রথমটির থেকে কম নিষ্ঠুর ও অনেক বেশি ধীর, মায়ের দেহকে দূরে সরিয়ে নেয়শিশুর আলিঙ্গন থেকে; তবে একটু একটু করে ছেলেদেরই অস্বীকার করা হয় আর চুমো খেতে বা আদর করতে, যাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। ছোটো মেয়ের বেলা, তাকে ভুলিয়ে রাখা হয় মিষ্টি মিষ্টি কথায়, তাকে লেগে থাকতে দেয়া হয় তার মায়ের স্কার্টের সাথে, তার বাবা তাকে পায়ের ওপর তুলে দোলায়, তার চুলে হাত বুলোয়। সে পরে ছোটো ছোটো মিষ্টি পোশাক, লাই দেয়া হয় তার চোখের জল ও খেয়ালখুশিকে, সুন্দরভাবে তার চুল বেঁধে দেয়া হয়, বড়োরা মজা পায় তার ভাবভঙ্গি ও ছেনালিপনায়–শারীরিক সংস্পর্শ ও আদরভরা চাহনি তাকে রক্ষা করে নিঃসঙ্গতার উদ্বেগ থেকে। এর বিপরীতে ছেনালিপনা করতে দেয়া হয় না ছোটো ছেলেকে; তার অন্যদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা, তার ছলছলনা বিরক্তিকর। তাকে বলা হয় ‘পুরুষ চুমো চায় না… পুরুষ আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে না… পুরুষ কাঁদে না’। তাকে বলা হয় একটি ছোট্ট পুরুষ হতে; বড়োদের থেকে স্বাধীন হয়ে সে পায় বড়োদের সম্মতি। তারা খুশি হয় যদি সে তাদের খুশি করার চেষ্টা না করে।
বহু ছেলে, তাদের যে-কঠোর স্বাধীনতায় দণ্ডিত করা হয়েছে, তাতে ভয় পেয়ে মনে করে যে মেয়ে হলেই ভালো ছিলো; আগের দিনে ছোটো বয়সে যখন ছেলেদের পরানো হতো মেয়েদের মতো পোশাক, তারা কাদাকাটি করতো যখন তাদের মেয়ের পোশাক ছেড়ে পরানো হতো ট্রাউজার, কেটে ফেলা হতো তাদের ঝুঁটি। তাদের কেউ কেউ একগুয়েভাবে চাইতো নারী থাকতেই–এটা সমকামিতার সাথে পরিচিত হওয়ার একটা ধরন। মরিস সাক (ল্য সাবাতে) বলেন : ‘আমি সংরক্তভাবে চেয়েছিলাম মেয়ে হতে এবং পুরুষ হওয়ার মহিমা সম্পর্কে অসচেতনতাকে আমি এতো দূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলাম যে আমি ভান করতাম বসে প্রস্রাব করার’।
যদি প্রথম প্রথম মনেও হয় যে ছেলেকে তার বোনদের থেকে দেখানো হচ্ছে কম অনুগ্রহ, তা এ-কারণে যে তার জন্যে অপেক্ষায় আছে বড়ো বড়ো ব্যাপার। তার কাছে যা দাবি করা হয়, তা নির্দেশ করে উচ্চ মূল্যায়ন। মাওরা তার স্মৃতিকথায় বর্ণনা করেছেন যে তিনি ঈর্ষা বোধ করেছিলেন তার এক কনিষ্ঠ ভাইয়ের প্রতি, যাকে তার মা ও দাদী স্তোকবাক্যে ভুলোনোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর বাবা হাত ধরে তাকে ঘর থেকে নিয়ে যান, বলেন : ‘আমরা পুরুষ, চলো আমরা এসব নারীদের ছেড়ে কোথাও যাই’। শিশুকে বোঝানো হয় যে ছেলেদের কাছে বেশি দাবি করা হয়, কেননা তারা। শ্রেষ্ঠতর; যে-কঠিন পথে তাকে চলতে হবে, তাতে চলার সাহস দেয়ার জন্যে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় পুরুষত্বের গর্ব; এ–বিমূর্ত ধারণাটি তার মধ্যে রূপায়িত হয় একটি মূর্ত বস্তুতে : এটা মূর্ত হয় তার শিশ্নে। স্বতস্ফূর্তভাবে সে তার লিঙ্গে কোনো গর্ব বোধ করতে পারে না, বোধ করে তার চারপাশের লোকজুনের মনোভাবের মধ্য দিয়ে। মায়েরা ও ধাত্রীরা বাঁচিয়ে রাখে সে-প্রথাটি, যা শিশ্ন ও পুরুষত্বের ধারণাকে করে তোলে অভিন্ন; তারা শিশুর শিশ্নকে দেখে অসামান্য আত্মপ্রসাদের সাথে। একটু বেশি বিনয়ী নারীরা আজো বালকের লিঙ্গকে ডাকে ডাকনামে, তার সাথে এটার সম্পর্কে এমনভাবে তারা কথা বলে যেনো এটা একটি ছোটো মানুষ, যেনোএটা সে নিজে এবং তার থেকে ভিন্ন কেউ : তারা একে করে তোলে একটা ‘বিকল্প সত্তা, যে শিশুটির থেকে সাধারণত একটু বেশি রঙ্গিলা, বেশি বুদ্ধিমান, এবং বেশি চতুর’।
শারীরসংস্থানগতভাবে শিশ্ন এ ভুমিকার জন্যে খুবই উপযুক্ত; দেহ থেকে বেরিয়ে থাকে বলে এটাকে মনে হয় একটা প্রাকৃতিক খেলনা, এক রকম পুতুল। বয়স্করা শিশ্নটিকে তার ডবলে পরিণত করে মূল্য দেয় শিশুকে। এক বাবা আমাকে বলেছিলেন তার এক ছেলে তিন বছর বয়সেও বসে প্রস্রাব করতো; বোনদের ও চাচাতো বোনদের দ্বারা পরিবৃত থেকে সে হয়ে উঠেছিলো এক ভীতু ও বিষন্ন শিশু। একদিন তার বাবা তাকে পায়খানায় নিয়ে বলে, ‘তোমাকে দেখাচ্ছি পুরুষেরা এটা কীভাবে করে’। তারপর থেকে সে গর্ববোধ করতে থাকে সে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে বলে, এবং তিরষ্কার করতে থাকে মেয়েদের ‘যারা একটা ছিদ্র দিয়ে প্রস্রাব করে’; মূলত মেয়েদের শিশ্ন নেই বলে তার ঘেন্না জাগে নি, বরং জাগে এ-কারণে যে মেয়েদের কেননা আগে খুঁজে বের করা হয় নি, এবং বাবা কেননা তার মতো করে তাদের এতে দীক্ষিত করে নি। এভাবে, শিশ্ন এমন কোনো প্রত্যক্ষ সুবিধা নির্দেশ করে না যার থেকে বালক আহরণ করতে পারে শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, এর উচ্চ মূল্যকে বরং মনে হয় দ্বিতীয়বার দুধ ছাড়ার দুর্ভোগের ক্ষতিপূরণ বলে–বয়স্করা যা আবিষ্কার করেছে ও অতি আকুলতার সাথে শিশু যা গ্রহণ করেছে। এভাবে তাকে রক্ষা করা হয় দুগ্ধপোষ্য শিশু হিশেবে তার মর্যাদা হারানোর এবং মেয়ে না হওয়ার দুঃখ থেকে। পরে সে তার সীমাতিক্ৰমণতা ও গর্বিত সার্বভৌমতুকে মূর্ত করবে তার লিঙ্গে।
ছোটো বালিকার ভাগ্য এর থেকে অনেক ভিন্ন। মায়েরা ও ধাত্রীরা তার যৌনাঙ্গের প্রতি কোনো ভক্তি বা স্নেহ দেখায় না; তারা তার ওই গোপন প্রত্যঙ্গটি, ঢাকনাটি ছাড়া যেটি অদৃশ্য, এবং যেটিকে হাত দিয়ে ধরা যায় না, সেটির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে না; এক অর্থে তার কোনো যৌনাঙ্গই নেই। এটির এ-অনুপস্থিতি তার কাছে কোনো অভাব বলে মনে হয় না; তার কাছে স্পষ্টতই তার দেহ সুসম্পূর্ণ; কিন্তু সে দেখতে পায় বিশ্বে সে আছে ছেলের থেকে ভিন্ন অবস্থানে; একরাশ ব্যাপার এপার্থক্যকে, তার চোখে, রূপান্তরিত করতে পারে নিকৃষ্টতায়।
নারীদের প্রসিদ্ধ ‘খোজা গূঢ়ৈষা’র থেকে কম প্রশ্নই অধিক ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন মনোবিশ্লেষকেরা। আজকাল অধিকাংশই স্বীকার করবেন যে শিশ্নাসূয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় বিচিত্ররূপে। শুরুর পর্যায়ে, বহু ছোটো মেয়েই কিছু বছর অজ্ঞ থাকে পুরুষের দেহসংস্থান সম্পর্কে। আছে পুরুষ ও নারী, এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় এমন মেয়ের কাছে, যেমন সূর্য ও চাঁদ থাকা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় : সে বিশ্বাস করে শব্দের নিহিত সারার্থে এবং প্রথমে তার ঔৎসুক্য বিশ্লেষণধর্মী নয়। অন্য অনেক মেয়ের কাছে ছেলেদের দু-পায়ের মাঝখানে ঝুলন্ত এ-ছোটো মাংসখণ্ডটিকে গুরুত্বহীন বা এমনকি হাস্যকর মনে হয়; এটা এমন এক বিশেষত্ব, যা মিলেমিশে যায় পোশাক বা চুলের ছাঁটের সাথে। প্রায়ই এটা চোখে পড়ে নবজাতক ছোট্ট ভাইয়ের দেহে এবং, যেমন বলেন হেলেন ডয়েটশ, ‘ছোটো বালিকা যখন খুবইছোটো থাকে, তখন ছোটো ভাইয়ের শিশ্ন তার মনে দাগ কাটে না’। এমনও ঘটতে পারে যে শিশ্নটি গণ্য হতে পারে একটা অস্বাভাবিক বস্তু বলে। একটা উপবৃদ্ধি, একটা অস্পষ্ট জিনিশ, যা ঝুলে থাকে ব্যাধিত মাংসপিণ্ড, স্তন, বা আঁচিলের মতো; এটা জাগিয়ে তুলতে পারে বিরক্তি। পরিশেষে, বহু উদাহরণ পাওয়া যায় যাতে ছোটো মেয়ে আগ্রহ বোধ করে ভাইয়ের বা খেলার সাথীর শিশ্নের প্রতি; তবে তা বোঝায় না যে সে বাস্তবিকভাবে যৌন ধরনে এটির প্রতি ঈর্ষা বোধ করে, এবং এ-প্রত্যঙ্গটির অনুপস্থিতি দিয়ে সে আক্রান্ত হয় আরো অনেক কম; সে যেমন প্রতিটি ও সব জিনিশই চায়, তেমনি এটাও চাইতে পারে, তবে এ-বাসনা খুবই অগভীর।
সন্দেহ নেই যে নিঃসরণের কাজগুলো, বিশেষভাবে প্রস্রাবের কাজটি, শিশুদের কাছে সংরক্ত আগ্রহের ব্যাপার; বিছানায় প্রস্রাব করা, আসলে, অনেক সময়ই অন্য সন্তানের প্রতি পিতামাতার সুস্পষ্ট পছন্দের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। অনেক দেশে পুরুষেরা বসে প্রস্রাব করে, এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীরা প্রস্রাব করে দাঁড়িয়ে, যেমন প্রচলিত অনেক কৃষকদের মধ্যে; তবে সমকালীন পাশ্চাত্য সমাজে চাওয়া হয় যে। নারীরা বসে বা নত হয়ে পেশাব করবে, আর দাঁড়ানো অবস্থাটি নির্ধারিত পুরুষদের জন্যে। ছোটো মেয়ের কাছে এ-পার্থক্যকে মনে হয় অত্যন্ত লক্ষণীয় লৈঙ্গিক পার্থক্য বলে। পেশাব করার জন্যে তাকে নত হতে হয়, নিজেকে ন্যাংটো করতে হয়, তাই লুকোতে হয় নিজেকে : এটা এক লজ্জাজনক ও অসুবিধাজনক পদ্ধতি। এ-লজ্জা প্রায়ই বৃদ্ধি পায়, যখন মেয়েটির ভেতর থেকে তার অনিচ্ছায় বেরিয়ে আসে প্রস্রাব, উদাহরণস্বরূপ যখন সে প্রচণ্ডভাবে হাসে; সাধারণভাবে তার নিয়ন্ত্রণ ছেলেদের মতো ততোটা ভালো নয়।
ছেলেদের কাছে প্রস্রাবের কাজটিকে মনে হয় খেলা, সব খেলার আনন্দের মতোই এটি তাদের দেয় কর্মসাধনের স্বাধীনতা; শিশ্নকে নিপুণভাবে ব্যবহার করা যায়, এটা সুযোগ দেয় নানা ক্রিয়াকর্মের, যা শিশুর কাছে গভীরভাবে আকর্ষণীয়। একটি ছোটো মেয়ে একটি ছেলেকে প্রস্রাব করতে দেখে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলো : ‘কী সুবিধা!’ প্রস্রাবের ধারাটি যে-দিকে ইচ্ছে সে-দিকে তাক করা যায় এবং বেশ দূরে ফেলা যায়, যা ছেলেকে দেয় সীমাহীন শক্তির বোধ। ফ্রয়েড বলেছেন যথাসময়ের আগে মূত্রবর্ধকতত্ত্বের তীব্র আকাঙ্খর কথা; স্টেকেল এ-সূত্রটি আলোচনা করেছেন কাণ্ডজ্ঞানের সাথে, তবে এটা সত্য, যেমন বলেছেন কারেন হোরনি, যে ‘সীমাহীন শক্তিবোধের উদ্ভট কল্পনা, যেগুলো বিশেষভাবে ধর্ষকামী ধরনের, প্রায়ই জড়িত থাকে পুরুষের মূত্রস্রাবের সাথে’; এ-উদ্ভট কল্পনাগুলো, যা দীর্ঘস্থায়ী কিছু পুরুষের মধ্যে, শিশুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। ‘নমনীয় নলের সাহায্যে বাগানে জল সিঞ্চন করে নারীরা যে অসামান্য আনন্দ পায়’, তার কথা বলেছেন আব্রাহাম; সার্ত্র ও বাখেলারের তত্ত্বের সাথে একমত হয়ে আমি বিশ্বাস করি যে নলটিকে শিশ্নের সাথে অভিন্ন বলে বোধ। করা আবশ্যিকভাবে এ-সুখের উৎস নয়–যদিও অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে তা-ই। বাতাসের মধ্যে প্রতিটি জলস্রোতকেই অলৌকিক ব্যাপার বলে অভিকর্ষকে অস্বীকার করা বলে মনে হয় : একে পরিচালিত করা, শাসন করা হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মের ওপর একটি ছোটো বিজয়; এবং তা যাই হোক ছোটো ছেলে এর মাঝে পায় একটি প্রাত্যহিক মজা, যা তার বোনেরা পায় না। এটা প্রস্রাবের ধারার মাধমে বহু কিছু, যেমন জল, মাটি, শ্যাওলা, তুষার প্রভৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয়। অনেক ছোটো মেয়ে আছে, যারা এ-অভিজ্ঞতার অংশী হওয়ার জন্যে চিৎ হয়ে শোয় এবং চেষ্টা করে ওপরের দিকে মুততে বা দাঁড়িয়ে পেশাব করার অনুশীলন করে। কারেন হোরনির মতে, ছেলেদের আছে প্রদর্শন করার সম্ভাবনা, তারা তাকেও ঈর্ষা করে। কারেন হোরনি জানিয়েছেন যে ‘একজন রোগী রাস্তায়একটি লোককে প্রস্রাব করতে দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিলো: “বিধাতার কাছে আমি যদি একটি বর চাইতে পারতাম, তাহলে চাইতাম যেন জীবনে অন্তত একবার আমি পুরুষের মতো প্রস্রাব করতে পারি।”’ বহু ছোটো মেয়ে মনে করে ছেলেরা যেহেতু তাদের শিশ্ন ছুঁতে পারে, তাই তাকে তারা খেলনা হিশেবেও ব্যবহার করতে পারে, আর সেখানে তাদের যৌনাঙ্গগুলো ট্যাবু।
বহু কারণে একটি পুরুষাঙ্গের অধিকারী হওয়া যে বহু মেয়ের কাছে কাম্য বলে মনে হয়, এটা এমন এক সত্য যা প্রমাণিত হয়েছে অসংখ্য অনুসন্ধানে এবং মনোবিজ্ঞানীদের কাছে ব্যক্ত গোপন কথায়। হ্যাভলক এলিস উদ্ধৃত করেছেন ডঃ এস ই জেলিফের কাছে জিনিয়া নামে তার এক রোগিণীর উক্তি : ‘ফোয়ারা বা ছিটোনোর মতো জলের তীব্র উদগীরণ, বিশেষ করে বাগানের দীর্ঘ নমনীয় নল থেকে, সব সময়ই আমার কাছে মনে হয়েছে ইঙ্গিতপূর্ণ, যা আমার মনে জাগিয়ে তোলে বাল্যকালে দেখা আমার ভাইদের, এমনকি অন্য ছেলেদের প্রস্রাব করার দৃশ্যের স্মৃতি’। এক পত্ৰলেখিকা, মিসেস আর এস, এলিসকে জানিয়েছে যে শৈশবে সে খুবই চাইতো ছেলেদের শিশ্ন নাড়তে এবং কল্পনা করতে প্রস্রাবের সময় এমন আচরণ; একদিন তাকে বাগানের নল ধরতে দেয় হয়। ‘একে একটি শিশ্ন ধরার মতো আনন্দদায়ক বলে মনে হয়’। সে জোর দিয়ে বলেছে যে তার কাছে শিশ্নের কোনো যৌন তাৎপর্য ছিলো না; সে জানতো শুধু প্রস্রাবের কাজের কথা।
যে-মনোবিশ্লেষকেরা, ফ্রয়েডের অনুসরণে, মনে করেন যে শুধু শিশ্ন আবিষ্কারই ছোটো মেয়ের স্নায়ুরোগ সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট, তাঁরা সুগভীরভাবে ভুল বোঝেন শিশুর মানসিকতাকে; তাঁরা যতোটা মনে করেন বলে মনে হয়, তার থেকে অনেক কম যুক্তিধর্মী এ-মানসিকতা। ছোটো মেয়ে যখন শিশ্ন দেখতে পায় এবং ঘোষণা করে : ‘আমারও একটি ছিলো, বা আমিও একটি নেবো,’ অথবা এমনকি ‘আমারও একটি আছে,’ তখন এটা এক আন্তরিকতাহীন আত্ম-যাথার্থপ্রতিপাদন নয়; উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি পারস্পরিকভাবে একচেটে নয়। সোস্যুর চার বছরের একটি মেয়ের কথা বলেছেন, যে ছেলেদের মতো দরোজার শিকের ফাঁক দিয়ে প্রস্রাব করতে গিয়ে বলে, যদি তার থাকতো ‘একটা লম্বা ছোটো জিনিশ, যার ভেতর থেকে ধারা বেরোয়’। সে তখন জ্ঞাপন করছিলো যে তার একটি শিশ্ন ছিলো এবং একটি শিশ্ন ছিলো না, যা। পিয়াজের বর্ণিত শিশুদের ‘অংশগ্রহণ’-এর মাধ্যমে চিন্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছোটো মেয়ে অবলীলায় বিশ্বাস করে যে সব শিশুই একটি শিশ্ন নিয়ে জন্মে, পরে মা-বাবারা মেয়ে বানানোর জন্যে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির শিশ্ন কেটে ফেলে; এ-ভাবনা পরিতৃপ্ত করে শিশুর সে-কৃত্রিমতাবাদ, যে-শিশু, পিতামাতাকে অমান্য করে, ‘ওগুলোকে মনে করে তার সমস্ত কিছুর উৎস’, যেমন বলেছেন পিয়াজে; শিশু প্রথমে খোজা করাকে একটা শাস্তি হিশেবে দেখে না।
তার অবস্থার একটি হতাশাগ্রস্ত রূপ নেয়ার জন্যেও বালিকার, কোনো-না-কোনো কারণে, ইতিমধ্যেই হতাশা বোধ করা দরকার হয় তার অবস্থান সম্পর্কে; যেমন হেলেন ডয়েটশ ঠিকই মন্তব্য করেছেন যে শিশ্নের মতো একটা বাহ্যিক ঘটনার পক্ষে একটা আভ্যন্তর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো না : ‘পুরুষাঙ্গ দেখার ঘটনা ফেলতে পারে অবিস্মরণীয় দুঃখজনক প্রভাব,’ তিনি বলেন, ‘তবে এ-শর্তে যে এর আগে থাকতে হবে এমন অভিজ্ঞতার দীর্ঘপরম্পরা, যা ফেলতে পারে এমন প্রভাব’। যদি ছোটো বালিকা হস্তমৈথুন বা নিজেকে প্রদর্শন করে তার কামনা মেটাতে না পারে, যদি তার মা-বাবা বাধা দেয় তার আত্মমেহনে, যদি তার মনে হয় তাকে সবাই কম ভালোবাসে, কম আদর করে তার ভাইদের থেকে, তবে তার হতাশাবোধ সে প্রক্ষিপ্ত করে পুরুষাঙ্গের ওপর। ‘ছোটো মেয়ে যখন আবিষ্কার করে ছেলের থেকে তার শারীরসংস্থানগত ভিন্নতা, তখন এটা প্রতিষ্ঠিত করে আগে থেকেই অনুভূত তার একটি অভাবকে বলা যায় এ দিয়েই সে প্রতিষ্ঠা করে তার অভাবের যৌক্তিকতা’। অ্যাডলার এ-ঘটনার ওপর বিশেষ জোর দেন যে তার পিতামাতা ও তাদের বন্ধুদের মূল্যায়নই বালককে দেয় বিশেষ মর্যাদা, ছোটো বালিকার চোখে শিশ্নটি হয়ে ওঠে যার ব্যাখ্যা ও প্রতীক। লোকজন তার ভাইকে মনে করে শ্রেষ্ঠ; সে নিজে স্ফীত থাকে তার পুরুষত্বের গর্বে; তাই মেয়েটি তাকে ঈর্ষা করে এবং বোধ করে হতাশা। অনেক সময় এর জন্যে সে দায়ী করে তার মাকে, খুব কম সময়ই তার বাবাকে; বা অঙ্গচ্ছেদের জন্যে সে দোষ দিতে পারে নিজেকে, বা নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে একথা ভেবে যে শিশ্নটি দেহের ভেতরে লুকিয়ে আছে এবং কোনো একদিন বেরিয়ে আসবে।
তরুণীর যদি তীব্র শিশ্নামূয়া নাও থাকে, তবু প্রত্যঙ্গটির অভাব তার নিয়তিতে পালন করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার যেহেতু আছে এমন একটি প্রত্যঙ্গ, যেটি দেখা যায় এবং ধরা যায়, তাই বালক এটির থেকে যে-প্রধান উপকার পায়, তা হচ্ছে অন্তত আংশিকভাবে হলেও সে নিজেকে এটির সাথে অভিন্ন বলে ভাবতে পারে। সে তার শরীরের রহস্যকে, এর হুমকিগুলোকে, প্রক্ষেপ করে নিজের বাইরে, তাকে সমর্থ করে নিজের থেকে ওগুলোকে দূরে রাখতে। এটা সত্য যে শিশ্নের ব্যাপারে সে ভয়ের আভাস পায়, সে ভয় পায় যে এটাকে কেটে নেয়া হতে পারে; কিন্তু ছোটো বালিকা তার ‘অভ্যন্তর’ সম্পর্কে বোধ করে যে-বিকীর্ণ আশঙ্কা, যা প্রায়ই থেকে যায় জীবনভর, তার তুলনায় বালকের ভীতি কাটানো সহজতর। তার অভ্যন্তরে যা-কিছু ঘটে, সে-সম্পর্কে বালিকা থাকে অতিশয় উদ্বিগ্ন, পুরুষের থেকে শুরু থেকেই সে।নিজের চোখেই অনেক বেশি অনচ্ছ, জীবনের অবোধ্য রহস্যে সে অনেক বেশি। গভীরভাবে নিমজ্জিত। বালকের যেহেতু আছে একটি বিকল্প সত্তা, যার মাঝে সে দেখে নিজেকে, তাই সে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে মন্ময়তার মনোভঙ্গি; যেবস্তুটিতে সে প্রক্ষেপ করে নিজেকে, সেটি হয়ে ওঠে স্বায়ত্তশাসনের, সীমাতিক্ৰমণতার, ক্ষমতার প্রতীক; সে পরিমাপ করে শিশ্নের দৈর্ঘ্য; সে সঙ্গীদের সাথে তুলনা করে তার প্রস্রাবধারার; পরে, দাঁড়ানো ও বীর্যপাত হয়ে উঠবে পরিতৃপ্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তি। কিন্তু ছোটো বালিকা তার নিজের কোনো অঙ্গে নিজেকে মৃত করতে পারে না। এর ক্ষতিপূরণের এবং তার বিকল্প সত্তারূপে কাজ করার জন্যে, তাকে দেয়া হয় একটা বাইরের জিনিশ : পুতুল। লক্ষণীয় যে ফরাশি ভাষায় পুপে (পুতুল) শব্দটি ক্ষতার্ত আঙুলে জড়ানো পাট বোঝানোর জন্যেও ব্যবহৃত হয়; একটি পটি-বাঁধা আঙুল, যেটি ভিন্ন অন্যগুলোর থেকে, সেটিকে দেখা হয় কৌতুকের চোখে এবং এক ধরনের গর্বরূপে, শিশু এর সাথে কথা বলে এর সাথে অভিন্ন বোধের লক্ষণ দেখাতে থাকে। কিন্তু এটি মানুষের মুখাবয়বসম্পন্ন একটি ক্ষুদ্রমূর্তি–অথবা, তার অভাবে, একটা একটা শস্যের শিষ, বা এক টুকরো কাঠ–যা বালিকার কাছে সন্তোষজনকভাবেই কাজ করে সে-ডবলের, সে-স্বাভাবিক খেলনার : শিশ্নের।
প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, একদিকে, পুতুল বোঝায় পুরো শরীর, আবার, অন্য দিকে, এটি এক অক্রিয় ব। এজন্যে বালিকা তার সমগ্র শরীরকে এর সাথে অভিন্ন বলে মনে করতে থাকে এবং দেহকে মনে করতে থাকে এক অক্রিয় জড় বস্তু বলে। বালক যখন তার শিশ্নে নিজেকে খোঁজে এক স্বায়ত্তশাসিত কর্তা হিশেবে, তখন বালিকা তার পুতুলকে বুকের কাছে কোলে নিয়ে আদর করে এবং জামাকাপড় পরায়, যেমন সে স্বপ্ন দেখে কেউ তাকে বুকের কাছে কোলে নিয়ে আদর করছে এবং জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছে; উল্টোভাবে, সে নিজেকে মনে করে এক বিস্ময়কর পুতুল। প্রশংসা ও তিরষ্কারের সাহায্যে, ছবি ও কথার ভেতর দিয়ে, সে শেখে সুন্দর ও সাদাসিধে শব্দ দুটির অর্থ; অবিলম্বে সে শিখে ফেলে যে মনোহর হওয়ার জন্যে তাকে হতে হবে। ‘ছবির মতো সুন্দর’; সে চেষ্টা করতে থাকে যাতে তাকে ছবির মতো দেখায়, পরতে থাকে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, নিজেকে দেখতে থাকে আয়নায়, নিজেকে তুলনা করতে থাকে রাজকুমারী ও পরীদের সাথে। মারি বাশকির্তসেভ এ-শিশুসুলভ ছেনালিপনার এক চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন আমাদের। এটা আকস্মিক ঘটনা নয় যে বেশ দেরি করে দুধ ছেড়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে–চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে তিনি তীব্রভাবে বোধ করেন যে নিজেকে আকর্ষণীয় করতে হবে যাতে মুগ্ধ হয়অন্যরা, অন্যদের সুখী করে বাঁচতে হবে। এতোটা বয়স্ক শিশুর কাছে দুধ ছাড়ার আঘাতটি নিশ্চয়ই ছিলো প্রচণ্ড, এবং তিনি নিশ্চয়ই সংরক্তভাবে ক্ষতিপূরণ করতে। চেয়েছেন তার ওপর চাপানো বিচ্ছিন্নতার; তাঁর জর্নালে তিনি লিখেছেন : ‘পাঁচ বছর বয়সে আমি সেজেছি আমার মায়ের কারুকার্যময় ফিতেয়, চুলে পরেছি ফুল, এবং ড্রয়িংরুমে নাচতে গেছি। আমি ছিলাম মহানর্তকী পেতিপা, এবং আমাকে দেখার জন্যে ছিলো সারা পরিবার’।
বালিকার মধ্যে এ-আত্মরতি দেখা দেয় এতো অকালে, নারী হিশেবে এটা তার জীবনে পালন করবে এতো মৌল ভূমিকা যে এটা উদ্ভূত হয় এক রহস্যময় নারীপ্রকৃতি থেকে, এমন মনে করা সহজ। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে প্রকৃতপক্ষে শারীরসংস্থানগত নিয়তি তার মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে না। যে-পার্থক্য ছেলেদের স্বতন্ত্র করে তোলে, তাকে একটি মেয়ে নানাভাবে গ্রহণ করতে পারে। শিশ্ন থাকা যে একটি বিশেষ সুবিধা, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর মূল্য স্বাভাৰিক ভাবেই কমে যায় শিশুর কাছে, যখন সে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে মলমূত্রত্যাগের কর্মগুলোর প্রতি। যদি। আট বা ন-বছর বয়সের পরেও শিশুর মনে টিকে থাকে এর মূল্য, তার কারণ শিশ্নটি হয়ে উঠেছে পুরুষত্বের প্রতীক, যাকে সামাজিকভাবে মূল্যবান মনে করা হয়। সত্য হচ্ছে এ-ব্যাপারে শিক্ষা ও প্রতিবেশের প্রভাব অসীম। দুধ ছাড়ার ভেতর দিয়েতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যে-বিচ্ছিন্নতা, সব শিশুই তার ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে অন্যদের প্ররোচিত করে ও নিজেকে জাহির করার আচরণের মাধ্যমে; বালক বাধ্য হয় এ-অবস্থা পেরিয়ে যেতে; নিজের শিশ্নের প্রতি মনোনিবেশের মাধ্যমে সে মুক্তি পায় আত্মরতি থেকে; আর তখন ছোটো মেয়ে নিবদ্ধ হয়ে থাকে নিজের প্রতি অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণের প্রবণতার মধ্যে, যা সব ছোটো শিশুর মধ্যে দেখা যায়। পুতুল একটি সহায়ক, কিন্তু এর নেই আর কোনো নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা; ছেলেও লালন করতে পারে একটা খেলনা ভালুক, বা পুতুল, যাতে সে প্রক্ষেপ করে নিজেকে; তাদের জীবনের সমগ্রতার মধ্যেই প্রতিটি ব্যাপার–শিশ্ন অথবা পুতুল–অর্জন করে তার গুরুত্ব।
তাই ‘নারীধর্মী’ নারীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যে-অক্রিয়তা, তা এমন এক চারিত্রিক গুণ, যা তার ভেতরে দেখা দেয় তার জীবনের আদিকাল থেকেই। তবে এর মূলে আছে এক জৈবিক তথ্য, এমন দাবি করা ভুল; প্রকৃতপক্ষে এটা এমন এক নিয়তি, যা তার ওপর চাপিয়ে দেয় তার শিক্ষকেরা ও সমাজ। ছেলে যে-বিশাল সুবিধা উপভোগ করে, তা হচ্ছে এই যে অন্যদের সাথে সম্পর্কে তার অস্তিত্বের ধরন তাকে তার কর্তৃমূলক স্বাধীনতা জ্ঞাপনের দিকে নিয়ে যায়। জীবনের জন্যে তার শিক্ষানবিশির মূল উপাদান হচ্ছে বাইরের বিশ্বের দিকে স্বাধীন অগ্রগতি; অন্য ছেলেদের সাথে সে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাহসিকতা ও স্বাধীনতার মধ্যে, সে তাচ্ছিল্য করে মেয়েদের। গাছে চড়ে, তার সঙ্গীদের সাথে মারামারি করে, কষ্টকর খেলাধুলোয় তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে নিজের দেহকে বোধ করে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য করার একটি উপায়হিশেবে এবং লড়াই করার একটা অস্ত্র বলে; সে তার পেশি নিয়ে গর্ব করে যেমন গর্ব করে তার যৌনাঙ্গ নিয়ে; খেলাধুলোয়, ক্রীড়ায়, মারামারিতে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায়, শক্তির পরীক্ষায় সে দেখতে পায় তার ক্ষমতার একটা ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগ; একই সময়ে সে আত্মীভূত করে হিংস্রতার কঠোর পাঠ; অল্প বয়স থেকেই সে শেখে ঘুসি সহ্য করতে, যন্ত্রণা তাচ্ছিল্য করতে, অশ্রু ধরে রাখতে। সে দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে আবিষ্কার করে, সে স্পর্ধা দেখায়। নিশ্চয়ই সে নিজেকেও পরখ করে এমনভাবে যেনো সে অন্য কেউ; সে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ডাকে নিজের পৌরুষকে, এবং বয়স্কদের ও অন্য শিশুদের সাথে সম্পর্কে দেখা দেয় বহু। সমস্যা। কিন্তু যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সে যে-বস্তুগত মানবমূর্তি, তার জন্যে তার যে-আগ্রহ, ও বস্তুগত লক্ষ্যের মধ্যে আত্ম-উপলব্ধির ইচ্ছার মধ্যে কোনো মৌল বৈপরীত্য নেই। করার মাধ্যমেই সে সৃষ্টি করে নিজের অস্তিত্ব, এক ও অভিন্ন কর্মের মধ্যে।
শুরু থেকেই, এর বিপরীতে, নারীর মধ্যে থাকে তার স্বায়ত্তশাসিত অস্তিত্ব ও তার বস্তুগত সত্তার, তার ‘অপর-হওয়ার’, মধ্যে বিরোধ; তাকে শেখানো হয় অন্যদের খুশি করার জন্যে তাকে চেষ্টা করতে হবে খুশি করার, নিজেকে করে তুলতে হবে বস্তু; তাই তাকে অস্বীকার করতে হবে তার স্বায়ত্তশাসন। তাকে দেখা হয় একটি জীবন্ত পুতুলরূপে এবং অস্বীকার করা হয় তার স্বাধীনতা। এভাবে গড়ে ওঠে এক দুষ্টচক্র; কেননা তার চারপাশের বিশ্বকে বোঝার, তাকে আয়ত্ত ও আবিষ্কার করার জন্যে সে যতোই কম প্রয়োগ করতে থাকে তার স্বাধীনতা, সে নিজের ভেতরে পেতে থাকে ততোই কম শক্তি, আর সে ততোই কম পেতে থাকে নিজেকে কর্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস। যদি তাকে এতে উৎসাহিত করা হতো, তাহলে সে ছেলের মতো দেখাতে পারতো একই প্রাণপ্রাচুর্য, একই ঔৎসুক্য, একই উদ্যোগ, একই সাহসিকতা। এটা মাঝেমধ্যে ঘটে, যখন মেয়েকে লালনপালন করা হয় ছেলের মতো; এ-ক্ষেত্রে সে বেঁচে যায় নানা সমস্যা থেকে। লক্ষণীয় যে বাবারা তাদের কন্যাদের এ-ধরনের শিক্ষা দিতেই পছন্দ করে; পুরুষের অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠে যে-নারীরা, তারা মুক্ত থাকে নারীর দোষত্রুটিগুলো থেকে। কিন্তু প্রথা মেয়েদের ছেলেদের মতো লালনপালন করার বিরোধী। তিন বা চার বছর বয়সের কয়েকটি গ্রামের মেয়ের কথা আমি জানি, যাদের বাবারা তাদের বাধ্য করে ট্রাউজার পরতে। অন্য সব মেয়ে তাদের উপহাস করতো : ‘এরা কি মেয়ে না ছেলে?’–এবং তারা পরখ করে ব্যাপারটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইতো। আক্রান্তরা আবেদন জানাতে ড্রেস পরার। যদি কোনো ছোটো মেয়ে অস্বাভাবিক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন না করে, তাহলে তার পিতামাতার সম্মতি সত্ত্বেও ছেলের মতো জীবন যাপন আহত করবে তার সহচরদের, তার বন্ধুদের, তার শিক্ষকদের। বাবার প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্যে চারপাশে সব সময়ই থাকবে খালারা, পিতামহীরা, চাচাতো-খালাতো ভাইবোনেরা। সাধারণত কন্যার শিক্ষার বেলায় পিতাকে দেয়া হয়একটা গৌণ ভূমিকা। একটা বিঘ্ন, যা নারীদের ওপর প্রচণ্ড ভার হিশেবে চেপে থাকে–মিশেলে যা যথার্থভাবে নির্দেশ করেছেন–তা হচ্ছে শৈশবে লালনপালনের ভার নারীদের হাতে ছেড়ে দেয়া। ছেলেও প্রথমে লালিত হয় মায়ের দ্বারাই, কিন্তু সে পুত্রের পুরুষত্বকে ভক্তি করে এবং ছেলে সত্বর মুক্তি পেয়ে যায়; সেখানে মা চায় তার মেয়েকে নারীর জগতের সাথে সম্পূর্ণরূপে খাপ খাইয়ে দিতে।
পরে আমরা দেখতে পাবো কন্যার সাথে মায়ের সম্পর্ক কতো জটিল : মায়ের কাছে তার কন্যা একই সময়ে তার ডবল এবং এক ভিন্ন মানুষ, মা একই সময়ে তার কন্যার প্রতি অতিশয় স্নেহপরায়ণ এবং শক্রতাপ্রবণ; মা তার শিশুর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় তার নিজের নিয়তির বোঝা; এটা হচ্ছে সগর্বে একে নিজের নারীত্ব বলে দাবি করার একটি উপায় এবং এর জন্যে নিজের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করারও একটি উপায়। একই প্রক্রিয়া দেখা যাবে বালকমেহনকারী, জুয়োরি, মাদকাসক্তদের মধ্যে, তাদের সকলের মধ্যে যারা একই সঙ্গে গর্ববোধ করে বিশেষ একটি। ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এবং লজ্জিতবোধ করে এ-সংঘের জন্যে : ধর্মান্তরিতকরণের ব্যগ্রতার সাথে তারা প্রয়াস চালায় নতুন অনুগামী লাভের। সুতরাং যখন কোনো শিশুকে লালনপালনের ভার পড়ে নারীদের ওপর, তখন তারা সর্বাত্মকভাবে নিজেদের নিয়োগ করে শিশুটিকে নিজেদের মতো নারীতে পরিণত করার কাজে, দেখায় এমন উদ্দীপনা যাতে মিশ্রিত থাকে উগ্রতা ও ক্ষোভ; এমনকি মহানুভব মা, আন্তরিকভাবেই যে কল্যাণ চায় তার কন্যার, স্বাভাবিকভাবে সেও মনে করে মেয়েকে ‘খাঁটি নারী’ করে তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কেননা এটা করা হলেই সমাজ মেয়েটিকে সানন্দে গ্রহণ করবে। তাই তাকে খেলা করতে দেয়া হয় ছোটো মেয়েদের সাথে, তাকে দেয়া হয় মহিলা শিক্ষকদের কাছে, গ্রিসের গাইনিকিউমের মতো সে থাকে বৃদ্ধা নারীদের সাথে, তার জন্যে বাছাই করা হয় এমন সব বই আর খেলাধুলো, যা তাকে দীক্ষিত করে তার নির্ধারিত এলাকায়স্ত্রীবুদ্ধিরাশি ঢেলে দেয়া হয় তার কানে, তার কাছে চাওয়া হয় নারীর গুণাবলি, তাকে সেখানো হয় রান্নাবান্না, সূচিকর্ম, ঘরকন্না, শেখানো হয় শরীর ও রূপের যত্ন নিতে, বিনয়ী হতে; তাকে পরতে হয়। অসুবিধাজনক ও ঝালরঅলা পোশাক, যার জন্যে তাকে সব সময় সাবধানে থাকতে হয়, তার চুল বাঁধা হয় নয়নাভিরাম ভঙ্গিতে, তাকে শেখানো হয় চালচলনের নিয়মকানুন : ‘সোজা দাঁড়াও, পাতিহাঁসের মতোহেঁটো না’; সৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্যে তাকে দমন করতে হয় তার স্বতস্ফূর্ত চলাফেরা; তাকে বলা হয় ছেলে হয়ে ওঠার মতো ক্রিয়াকলাপ না করতে, তাকে নিষেধ করা হয় কঠোর ব্যায়াম করতে, তাকে। মারামারি করতে দেয়া হয় না। সংক্ষেপে, তাকে চাপ দেয়া হয় তার প্রবীণদের মতো দাসী ও মূর্তি হওয়ার জন্যে। আজকাল, নারীদের জয়ের কল্যাণে, ক্রমিকভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে শিক্ষা নেয়ার জন্যে ছোটো মেয়েকে উৎসাহিত করা, খেলাধুলোর প্রতি তাকে আগ্রহী করে তোলা; তবে এসব ক্ষেত্রে তার অসাফল্যকে ছেলেদের থেকে অনেক বেশি নির্ধিধায় ক্ষমা করা হয়; তার কাছে আরেক রকম অর্জন দাবি করে সাফল্যকে কঠিন করে তোলা হয় : যাই হোক তাকে একটি নারীও হতে হবে, সে তার নারীত্ব হারাতে পারবে না।
যখন মেয়ে খুবই ছোটো থাকে তখন সে হেলাফেলায় বিশেষ বিঘ্ন সৃষ্টি না করে মেনে নেয় এসব। শিশুটি চলতে থাকে খেলা ও স্বপ্নের স্তরে, অভিনয় করতে থাকে সত্তার, অভিনয় করতে থাকে কর্মের; যখন কেউ শুধু কাল্পনিক অর্জন নিয়ে ব্যাপৃত থাকে, তখন করা ও হওয়ার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য করা হয় না। ছোটো মেয়ে ছেলেদের বর্তমান শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষতিপূরণ করতে পারে তার নারীসুলভ নিয়তির মধ্যে নিহিত যে-সব প্রশ্রুিতি এবং অভিনয়ের মাধ্যমে সে যেগুলো চরিতার্থ করে, সেগুলোর সাহায্যে। যেহেতু এ-পর্যন্ত সে জানে শুধু তার শৈশবের মহাবিশ্বকে, তাই প্রথমে মাকে তার মনে হয় পিতার থেকে অধিক কর্তৃত্বে ভূষিত বলে; সে বিশ্বকে এক ধরনের মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে কল্পনা করে; সে তার মাকে অনুকরণ করে এবং তার সাথে নিজেকে অভিন্ন করে তোলে; প্রায়ই সে বদলে দেয় নিজেদের ভূমিকা : ‘যখন আমি বড়ো হবে, আর তুমি ছোটো…’ সে ভালোবাসে তার মাকে বলতে। পুতুলটি শুধুই তার ডবল নয়; এটি তার সন্তানও। এ-ভূমিকা দুটি পরস্পরকে বাদ দেয় না, যেহেতু মায়ের কাছে আসল শিশুটিও একটি বিকল্প সত্তা। যখন সে তার পুতুলকে বকে, শাস্তি দেয়, এবং তারপর সেটিকে সান্ত্বনা দেয়, তখন সে একই সঙ্গে মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে এবং নিজে ধারণ করে মায়ের মর্যাদা : সে নিজের মধ্যে সম্মিলিত করে মাতা-কন্যা যুগলের দুটি উপাদান। সে নিজের গোপন কথা বলে পুতুলকে, সে এটিকে লালন করে, এর ওপর প্রয়োগ করে তার সার্বভৌম কর্তৃত্ব, এমনকি অনেক সময় খসিয়ে ফেলে তার হাত, তাকে মারে, পীড়ন করে তাকে। এর অর্থ হচ্ছে পুতুলের মাধ্যমে সে অভিজ্ঞতা লাভ করে কর্তৃত্বপরায়ণ আত্মঘোষণার ও স্বরূপনির্ণয়ের। প্রায়ই মাকে জড়ানো হয় এ-কাল্পনিক জীবনে : শিশুটি তার মায়ের কাছে অভিনয় করে যেনো সে পুতুলটির পিতা ও মাতা, তৈরি করে এমন একটি দম্পতি, যাতে বাদ দেয়া হয় পুরুষটিকে। ছোটো মেয়ে স্থির করে যে শিশুদের যত্ন নেয়ার ভার পড়ে মায়ের ওপর, তাকে তা-ই শেখানে হয়; যতো গল্প সে শুনেছে, পড়েছে যতো বই, তার ছোট্ট অভিজ্ঞতা সপ্রমাণ করে এ-ধারণাকেই। তাকে উৎসাহিত করা হয় ভবিষ্যতের এসব সম্পদের যাদু অনুভব করতে, তাকে পুতুল দেয়া হয় যাতে এর পর এসব মূল্যবোধ লাভ করে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। তার ‘বৃত্তি’ সজোরে ছেপে দেয়া হয় তার ওপর।
ছোটো মেয়ে যেহেতু অনুভব করে শিশু জন্ম দেয়া হবে তার নিয়তি, এবং যেহেতু সে ছেলের থেকে তার ‘অভ্যন্তর’ সম্পর্কে বেশি আগ্রহী, সে বিশেষভাবেই উৎসুক হয় সন্তান উৎপাদনের রহস্য সম্পর্কে। সে আর বিশ্বাস করে না যে শিশুরা জন্ম নেয় বাঁধাকপির ভেতরে, বা শিশুদের নিয়ে আসা হয় ডাক্তারের থলেতে করে, বা নিয়ে আসে সারসেরা; সে শিগগির জানতে পারে, বিশেষ করে যদি এর মধ্যে জন্ম নেয়ভাইবোন, যে বাচ্চারা জন্ম নেয় মায়ের দেহের ভেতরে। তাছাড়া, আধুনিক মা-বাবারা ব্যাপারটিকে আর আগের দিনের মতো রহস্যে পরিণত করে না। ছোটো বালিকা ভয় পাওয়ার বদলে সাধারণত অভিভূত হয়বিস্ময়ে, কারণ প্রপঞ্চটিকে ঐন্দ্রজালিক বলে মনে হয় তার কাছে; সে তখনও সমস্ত শারীরবৃত্তিক নিহিতার্থ বুঝে উঠতে পারে না। প্রথমে সে অজ্ঞ থাকে বাবার ভূমিকা সম্পর্কে এবং ধারণা করে যে নারীরা বিশেষ কোনো খাবার খেয়ে গর্ভবতী হয়। এটা এক কিংবদন্তিমূলক বিষয় (রূপকথায় রাণীরা বিশেষ কোনো ফল, বা বিশেষ ধরনের মাছ খেয়ে জন্ম দেয় ছোট্ট মেয়ে বা সুন্দর ছেলে), এবং এটা অনেক নারীর মনে গর্ভধারণের ব্যাপারটিকে সম্পর্কিত করে পরিপাকতন্ত্রের সাথে। এসব সমস্যা ও আবিষ্কার বালিকার মনে জাগায় ঔৎসুক্য এবং লালন করে তার কল্পনা।
এ-ইতিহাস বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যদিও ছোটো মেয়ে প্রায়ই বাবার ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো প্রশ্ন করে না, বা মা-বাবারা এড়িয়ে যায় এ-ব্যাপারটি। অনেক ছোটো মেয়ে তার জামার নিচে বালিশ নিয়ে গর্ভবতী হওয়ার খেলা খেলে, বা জামার ভাজের। টোপরে একটি পুতুল নিয়ে হাঁটে এবং সেটিকে ফেলে দোলনায়; সে এটিকে স্তন্যদান করতে পারে। ছেলেরা, মেয়েদের মতোই, বিস্ময় বোধ করে মাতৃত্বের রহস্যে; সব শিশুই ‘গভীরতা সম্পর্কে’ কল্পনা করে, যা তাদের দেয় জিনিশপত্রের অভ্যন্তরে গুপ্তধনের ধারণা বোধ করতে; তারা সবাই চারদিক ঘিরে ফেলার, পুতুলের ভেতরে পুতলের, বাক্সের ভেতরে বাক্সের, ছবির ভেতরে ক্রমিকভাবে ছোটো আকারের ছবির অলৌকিত্ব অনুভব করে; সবাই উল্লাস বোধ করে কুঁড়ি ছিড়েফেড়ে, ডিমের খোলসের ভেতরে ছানা দেখে, জলের গামলায় ভাসানো ‘জাপানি ফুল’-এর প্রস্ফুটিত হওয়া দেখে।ছোটো ছোটো চিনির ডিমে বোঝাই একটা ইস্টারের ডিম খুলে একটি ছোটো ছেলে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলো : ‘আহ, এটা একটা মা’। কারো দেহের ভেতর থেকে একটি শিশুকে বের করা : তাভোজবাজির কৃতিত্বপূর্ণ কাজের মতোই চমৎকার। মাকে মনে হয় বিস্ময়কর পরীর ক্ষমতায় তৃষিত। অনেক ছেলে দুঃখ পায় তাদের এমন বিশেষাধিকার নেই বলে; পরে যখন তারা পাখির ডিম চুরি করে ও মাড়িয়ে যায় ছোটো ছোটো চারাগাছ, যখন তারা এক ধরনের প্রবল ক্ষিপ্ততায় ধ্বংস করে জীবন, তারা তা করে তাদের যে জীবন আনয়নের সামর্থ্য নেই, তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে; আর তখন ছোটো মেয়েকথা ভেবে সুখ পায় যে একদিন সে জীবন সৃষ্টি করবে।
পুতুল নিয়ে খেলা যে-আশাকে মূর্ত করে তোলে, তার সাথে পারিবারিক জীবন যোগ করে ছোটো মেয়ের আত্মপ্রকাশের আরো নানা সুযোগ। গৃহস্থালির বেশ কিছু কাজ ছোটো মেয়ের সামর্থ্যের মধ্যে; বালককে সাধারণত রেহাই দেয়া হয়, কিন্তু তার বোনকে অনুমতি দেয়া হয়, এমনকি আদেশ দেয়া হয় ঝাট দিতে, ধুলো ঝাড়তে, আলুর খোসা ছুলতে, শিশুকে স্নান করাতে, রান্নার দিকে চোখ রাখতে। বিশেষ করে বড়ো বোেনটিকে সাধারণত জড়িয়ে ফেলা হয় মাতৃসুলভ কাজে; হয়তো নিজের
সুবিধার জন্যে বা হয়তো শত্রুতা ও ধর্ষকামিতাবশত মা নিজেকে মুক্ত করে নেয় নিজের অনেক দায়িত্ব থেকে; এভাবে মেয়েটিকে অকালেই খাপ খেতে বাধ্য করা হয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জগতের সাথে; নিজের গুরুতুবোধ তাকে সাহায্য করে নারীত্ব অর্জনে। কিন্তু সে বঞ্চিত হয় আনন্দময় স্বাধীনতা থেকে, শৈশবের ভাবনাহীনতা থেকে; অকালেই একটি নারী হয়ে উঠে সে জেনে ফেলে এ-অবস্থা একটি মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় কেমন অসামর্থ; সে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরূপে পৌছে বয়ঃসন্ধিকালে, যা তার ইতিহাসকে দেয় এক বিশেষ চরিত্র। মাত্রাতিরিক্ত কাজের ভার বয়ে একটি শিশু অকালেই পরিণত হতে পারে একটি ক্রীতদাসে, যার জন্যে নির্ধারিত এক নিরানন্দ জীবন। মায়ের কাজগুলো মেয়ের পক্ষে করা বেশ সম্ভব; ‘সে এর মাঝেই হয়ে উঠেছে এক ছোটো নারী,’ তার মা-বাবারা বলে থাকে এমন কথা; এবং কখনোবা মনে করা হয় যে সে ছেলের থেকে বেশি মূল্যবান। প্রকৃতপক্ষে, যদি সে প্রাপ্তবয়স্ক স্তরে পৌছেই থাকে, তাহলে তা এ-কারণে যে অধিকাংশ নারীতেই এ-স্তরটি প্রথাগতভাবে থাকে কম-বেশি শিশুধর্মী। ঘটনা হচ্ছে যে বালিকা সচেতন তার অকালপকৃতা সম্বন্ধে, তাই সে ছোটো শিশুদের সামনে ছোটো মায়ের অভিনয় করে গর্ব বোধ করে; গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সে আনন্দ পায়, সে যথোচিতভাবে কথা বলে, সে আদেশ দেয়, সে তারছোটো ভাইদের কাছে গুরুজন হওয়ার ভাব করে, সে তার মায়ের সমান অবস্থান থেকে বলে কথাবার্তা।
এসব ক্ষতিপূরণ সত্ত্বেও তার জন্যে নির্ধারিত ভাগ্যকে সে খেদহীনভাবে মেনে নেয়; যতোই সে বড়ো হতে থাকে, ততোই ছেলেদের সে ঈর্ষা করতে থাকে তাদের বলিষ্ঠতার জন্যে। পিতামাতা ও পিতামহ-মহীরা একথা গোপন করে রাখে না যে সে মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেই তারা বেশি পছন্দ করতো; বা তারা বোনটির থেকে ভাইটির প্রতি দেখায় বেশি স্নেহ। অনুসন্ধানে সুস্পষ্টভাবে জানা গেছে যে মেয়ে হওয়ার থেকে ছেলে হওয়াই পছন্দ করতো অধিকাংশ পিতামাতা। ছেলেদের সাথে কথাবার্তা বলা হয় অনেক বেশি গুরুত্ব ও শ্রদ্ধার সাথে, তাদের দেয়া হয় অনেক বেশি অধিকার; তারা নিজেরা মেয়েদের তাচ্ছিল্য করে; তারা নিজেরা খেলা করে, মেয়েদের তাদের দলে যোগ দিতে না দিয়ে তারা মেয়েদের অপমান করে : একদিকে, মেয়েদের প্রিসি বা ও-রকম কিছু বলা এবং এভাবে ছোটো মেয়ের মনে তার গোপন অবমাননা জাগিয়ে তোলা। ফ্রান্সে, মিশ্র বিদ্যালয়গুলোতে, ছেলেদের জাত ইচ্ছাকৃতভাবে পীড়ন ও অত্যাচার করে মেয়েদের জাতকে।
যদি মেয়েরা লড়াই করতে চায় ছেলেদের সাথে এবং লড়াই করে তাদের অধিকারের জন্যে, তাহলে তাদের কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়। তারা দ্বিগুণ ঈর্ষা বোধ করে একান্তভাবে ছেলেদের কাজকর্মের প্রতি; প্রথমত, বিশ্বের ওপর তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্যে তাদের স্বতস্ফূর্ত বাসনা আছে বলে, এবং, দ্বিতীয়ত, তাদের যে-নিকৃষ্ট অবস্থানে দণ্ডিত করা হয়েছে, তারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলে। একদিকে, গাছে ওঠা এবং মই বাওয়া বা ছাদে ওঠা যে তাদের জন্যে নিষিদ্ধ, এতে তারা কষ্ট পায়। অ্যাডলার মন্তব্য করেছেন যে উচ্চ ও নিম্ন ধারণার আছে মহাগুরুত্ব, স্থানিকভাবে উচ্চতা জ্ঞাপন করে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব, যেমন দেখা যায় বিচিত্র ধরণের বীরত্বব্যঞ্জক কিংবদন্তিতে; কোনো শিখরে, কোনো চুড়োয় আরোহণ হচ্ছে সার্বভৌম কর্তা (অহং) হিশেবে ঘটনার সাধারণ বিশ্ব পেরিয়ে ওপরে ওঠা; ছেলেদের মধ্যে প্রায়ই আরোহণ করা হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দিতার ভিত্তি। ছোটো মেয়ে, যার জন্যে এসব কাজ নিষিদ্ধ এবং কোনো গাছ বা সমুদ্রতীরের উঁচু খাড়া পাহাড়ের পাদদেশে বসে যে তার থেকে অনেক ওপরে দেখে বিজয়দৃপ্ত ছেলেটিকে, সে অবশ্যই অনুভব করে যে সে, দেহে ও আত্মায়, তাদের থেকে নিকৃষ্ট। একই রকম ঘটে যদি সে দৌড় বা সাফ দেয়ার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, যদি হাতাহাতির সময়তাকে ফেলে দেয়া হয় বা তাকে রাখা হয় শুধু দর্শক হিশেবে।
সে যখন আরো বড়ো হয়, তার বিশ্ব সম্প্রসারিত হয়, এবং তখন সে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আরো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে। মায়ের সাথে অভিন্নতাবোধ করা প্রায়ই আর সন্তোষজনক সমাধান বলে মনে হয় না; যদি ছোটো মেয়ে প্রথমে মেনেও নেয় তার নারীসুলভ বৃত্তি, এটা এ-কারণে নয় যে সে দাবি ত্যাগ করতে চায়; এটা বরং শাসন করার জন্যে; সে মাতৃকা হতে চায়, কেননা মাতৃকাদের বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত মনে হয়; কিন্তু যখন তার সঙ্গীরা, তার পড়াশুনো, তার খেলাধুলো, তার পাঠ, তাকে বের করে নেয় মাতাদের বৃত্ত থেকে, তখন সে দেখতে পায় নারীরা নয়, পুরুষেরাই নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব। এ-উপলব্ধিই–শিশ্ন আবিষ্কারের থেকে অনেক বেশি–অপ্রতিরোধ্যভাবে বদলে দেয় তার নিজের সম্বন্ধে ধারণা।
লিঙ্গ দুটির আপেক্ষিক মর্যাদা, স্তরক্রম, প্রথমে তার চোখে পড়ে পারিবারিক জীবনে; একটু একটু করে সে বুঝতে পারে যে যদিও পিতার কর্তৃত্ব প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সব সময় অনুভব করা যায় না, তবে বাস্তবিকভাবে তার কর্তৃত্বই চূড়ান্ত। এটুকু বোেঝার বুদ্ধি তার থাকে যে বাবার ইচ্ছেই সবার আগে; গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে মা বাবারই নামে, তারই কর্তৃত্বের মাধ্যমে, দাবি করে, পুরস্কার দেয়, শাস্তি দেয়। বাবার জীবনের আছে এক রহস্যময় মর্যাদা : যে সময়টুকু সে বাড়িতে থাকে, যে-ঘরে সে কাজ করে, তার চারপাশে থাকে যে-সব জিনিশপত্র, তার কর্মগুলো, তার শখগুলোর আছে পবিত্র চরিত্র। সে ভরণপোষণ করে পরিবারের এবং সে পরিবারের দায়িত্বশীল কর্তা। সাধারণত তার কাজের জন্যে তাকে বাইরে যেতে হয়, এবং তাই তার মাধ্যমেই পরিবারটি যোগাযোগ করে বাইরের জগতের সাথে : সে হচ্ছে বিশাল, দুরূহ, ও বিস্ময়কর দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের জগতের প্রতিমূর্তি; সে সীমাতিক্ৰমণতার মনুষ্যমূর্তি, সে বিধাতা। মেয়ে এটাই শারীরিকভাবে অনুভব করে যখন ওই শক্তিশালী বাহু তাকে তুলে ধরে পরের দিকে, সে দোলে যে-শক্তির কাঠামোর আশ্রয়ে। একদা যেমন আইসিসকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলো রা, পৃথিবীকে সূর্য, তেমনি তার মাধ্যমেং সিংহাসনচ্যুত হয় মা।
কিন্তু এখানে গভীরভাবে বদলে যায় শিশুর পরিস্থিতি : তার একদিন হওয়ার কথা ছিলো তার সর্বশক্তিমান মায়ের মতো এক নারী–সে কখনো সার্বভৌম পিতা হবে; যে-বন্ধন তাকে জড়িয়ে রেখেছিলোতার মায়ের সাথে, সেটা ছিলো একটা সক্রিয় সমকক্ষ হওয়ার সাধনা–অক্রিয়ভাবে সে শুধু প্রতীক্ষা করতে পারে পিতার সম্মতির একটা লক্ষণ। ছেলে তার পিতার শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভাবে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুভূতি নিয়ে; কিন্তু মেয়েকে এটা মেনে নিতে হয় নিবীর্য প্রশস্তিবোধের সাথে। আমি। ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি যে ফ্রয়েড যাকে ইলেক্ট্রা গূঢ়ৈষা বলেন, সেটা, তিনি যেমন মনে করেন, তেমন কোনো যৌন কামনা নয়; এটা হচ্ছে কর্তার পুরোপুরি দাবি ত্যাগ করে আনুগত্য ও ভক্তির মধ্যে কর্ম হওয়ার সম্মতি। যদি তার পিতা কন্যার প্রতি স্নেহ দেখায়, তাহলে সে বোধ করে যে মহিমান্বিতরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে তার অস্তিত্বের সত্যতা; সে ভূষিত সে-সমস্ত গুণে যা অন্যদের অর্জন করতে হয় অনেক কষ্টে; সে লাভ করেছে পরিপূর্ণতা ও সে অধিষ্ঠিত হয়েছে দেবীত্বে। সারাজীবন আকাঙ্খভরে সে খুঁজতে পারে প্রাচুর্য ও শান্তির সেই হারানো অবস্থা।
সব কিছুই কাজ করে ছোটো বালিকার দৃষ্টিতে এ-স্তরক্ৰম সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। যেঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক সংস্কৃতির সে অন্তর্ভুক্ত, তার যে-সব গান ও রূপকথা দিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানো হয়, তার সবই পুরুষের এক সুদীর্ঘ স্তবগান। পুরুষেরা গড়ে তুলেছিলো গ্রিস, রোমান সাম্রাজ্য, ফ্রান্স ও অন্য সব দেশ, তারা আবিষ্কার করেছে সারা পৃথিবী এবং এর সম্পদ কাজে লাগানোর জন্যে উদ্ভাবন করেছে হাতিয়ার, তারা একে শাসন করেছে, তারা একে ভরে তুলেছে ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সাহিত্যসৃষ্টিতে। শিশুদের বইপত্র, পুরাণ, রূপকথা, উপকথা সব কিছুতেই প্রতিফলিত হয় পুরুষের গর্ব ও কামনা থেকে জন্ম নেয়াকিংবদন্তি; তাই পুরুষের চোখ দিয়েই ছোটো বালিকা আবিষ্কার করে বিশ্ব এবং তাতে পাঠ করে তার নিয়তি।
পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব, বাস্তবিকই, অভিভূতকর : পার্সিউস, হারকিউলিস, ডেভিড, একিলিস, লাসলো, প্রাচীন ফরাশি যোদ্ধা দ্য গয়েসলি ও বায়ার্দ, নেপোলিয়নএকজন জোয়ান অফ আর্কের স্থানে এতো পুরুষ; এবং মেয়ে তার পেছনে দেখতে পায় মহাদেবদূত মাইকেলের মহান পুরুষমূর্তি! বিখ্যাত নারীদের জীবনীগুলোর থেকে কিছুই আর বেশি ক্লান্তিকর নয় : মহাপুরুষদের তুলনায় তারা নিতান্তই ফ্যাকাশে মূর্তি; এবং তাদের অধিকাংশই পোয় কোনো বীরপুরুষের গৌরবের রোদ। হাওয়াকে তার নিজের জন্যে সৃষ্টি করা হয় নি, করা হয়েছিলো আদমের সঙ্গিনীরূপে, এবং তাকে তৈরি করা হয়েছিলো আদমের পাঁজরের হাড় থেকে। বাইবেলে প্রকৃত খ্যাতিসম্পন্ন নারী কমই আছে : রুথ নিজের জন্যে একটি স্বামী যোগাড়ের বেশি কিছু করে নি। এসথার ইহুদিদের জন্যে অনুগ্রহ লাভ করেছে আহাসুয়েরাসের কাছে নতজানু হয়ে, তবে সে ছিলো মোরডেকাইর হাতে একটি সহজে-বশ-মানা হাতিয়ার মাত্র; জুডিথ ছিলো অনেক বেশি দুঃসাহসী, তবে সে ছিলো পুরোহিতদের কাছে দাসভাবাপন্ন, এবং তার দুঃসাহসিক কাজগুলোকে, যেগুলো সন্দেহজনক ধরনের, কিছুতেই তুলনা করা যায় না তরুণ ডেভিডের পরিচ্ছন্ন, অত্যুজ্জ্বল বিজয়ের সাথে। পৌত্তলিক পুরাণের দেবীরা লঘুচপল বা অস্থিরমতি, এবং তার সবাই কেঁপে ওঠে জুপিটারের সামনে। পোমিথিউস যখন সূর্য থেকে মহিমান্বিতভাবে চুরি করে আনে আগুন, প্যান্ডোরা তখন জগতের সামনে খোলে তার অশুভের বাক্স।
একথা সত্য যে রূপকথা ও উপকথায় আছে ডাইনিরা ও কুৎসিত বুড়ীরা, যাদের আছে ভীতিকর ক্ষমতা। অ্যান্ডারসনের গার্ডেন অফ প্যারাডাইস-এর বায়ুদের মায়ের চরিত্রটি স্মরণ করিয়ে দেয় আদিম মহাদেবীকে; তার চারটি দানবাকার পুত্র ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মান্য করে তাকে, দুষ্টুমি করলে সে তাদের পিটিয়ে ভরে রাখে ছালার ভেতরে। তবে এগুলো আকর্ষণীয় চরিত্র নয়। এর থেকে অনেক বেশি সুখকর পরী, সাইরেন, ও আনডাইনরা, এরা পুরুষের আধিপত্যের বাইরে; তবে এদের অস্তিত্ব সন্দেহজনক, এদের নেই স্বাতন্ত্র; এরা হস্তক্ষেপ করে মানুষের কর্মকাণ্ডে, কিন্তু এদের নিজেদের কোনো নিয়তি নেই : অ্যান্ডারসনের ছোটো সাইরেন যেদিন নারী হয়ে ওঠে, সেদিন বুঝতে পারে প্রেমের জোয়াল কাকে বলে, এবং দুঃখভোগ হয়ে ওঠে তার নিয়তি।
যেমন প্রাচীন কিংবদন্তিতে তেমনি আধুনিক কাহিনীতে পুরুষ হচ্ছে সুবিধাপ্রাপ্ত বীর। রোমাঞ্চ উপন্যাসে ছেলেই বেয়োয় পৃথিবী পর্যটনে, যে ভ্রমণ করে জাহাজের নাবিক হয়ে, যে জঙ্গলে রুটিফল খেয়েবেঁচে থাকে। পুরুষের সক্রিয়তায়ই ঘটে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এসব উপন্যাস ও উপকথা যা বলে, বাস্তবতা তা সপ্রমাণিত করে। ছোটো মেয়ে যদি পত্রিকা পড়ে, যদি সে শোনে বড়োদের কথাবার্তা, সে বুঝতে পারে যেমন আজকাল তেমনি চিরকাল পুরুষেরাই চালিয়েছে বিশ্ব। যে-সব রাজনীতিক নেতা, সেনাপতি, অভিযাত্রী, সঙ্গীতস্রষ্টা, ও চিত্রকরের সে অনুরাগী, তারা সবাই পুরুষ; এটা নিশ্চিত যে পুরুষেরাই তার মনে জাগায় প্রবল উৎসাহ।
এ-মর্যাদা প্রতিফলিত হয় অতিপ্রাকৃত জগতে। সাধারণত, নারীর জীবনে ধর্মের বৃহৎ ভূমিকার পরিণতিরূপে, বালিকা তার ভাইয়ের থেকে মাকে দিয়ে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হয় বলে, তার ওপর ধর্মের প্রভাব পড়ে অনেক বেশি। পশ্চিমের ধর্মগুলোতে বিধাতা একজন পুরুষ, পুরুষের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে ভূষিত একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক : তিনি শুভ্র শুশ্রুমণ্ডিত। খ্রিস্টধর্মীদের কাছে খ্রিস্ট আরো স্পষ্টভাবে রক্তমাংসের পুরুষ, যার আছে উজ্জ্বল শত্রু। ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে দেবদূতদের কোনো লিঙ্গ নেই; কিন্তু। তাঁদের নামগুলো পুরুষের এবং তাঁদের সুদর্শন তরুণদের মতো দেখায়। পৃথিবীতে বিধাতার প্রতিনিধিরা :পোপ, বিশপ (যার আংটিতে চুমো খেতে হয়), পুরোহিত, যিনি খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্বে মন্ত্রপাঠ করেন, যিনি ধর্মোপদেশ দেন, যার সামনে লোকজন নতজানু হয় স্বীকারোক্তির গোপনীয়তার সময়—তাঁরা সবাই পুরুষ। ক্যাথলিক ধর্ম ছোটো মেয়ের ওপর ফেলে এক অত্যন্তু বিভ্রান্তিকর প্রভাব। কুমারী নতজানু হয়ে শোনে দেবদূতের বাণী এবং উত্তর দেয়- ‘দ্যাখো বিধাতার দাসীকে’। মেরি ম্যাগডালিন পড়ে খ্রিস্টের পদতলে, পদতল ধুয়ে দেয় নিজের অশ্রুতে এবং শুকিয়ে দেয় নিজের মাথার কেশে, তার নারীর দীর্ঘ চুলে। সন্তরা নতজানু হয়ে দীপ্ত খ্রিস্টের প্রতি ঘোষণা করেন তাঁদের প্রেম। ধূপের গন্ধ নিশ্বাসে নিয়ে নতজানু বালিকা আত্মবিসর্জন করে বিধাতা ও দেবদূতদের স্থিরদৃষ্টির সামনে : পুরুষের স্থিরদৃষ্টির সামনে। আশ্লেষের ভাষা ও নারীদের বলা অতীন্দ্রিয় ভাষার সাদৃশ্যের ওপর প্রায়ই। জোর দেয়া হয় : উদাহরণস্বরূপ, সেইন্ট তেরেসা জেসাস সম্পর্কে লিখেছেন : ‘হে আমার প্রিয়তম, তোমার প্রেমের মাধ্যমে, এইখানে নিয়ে, আমি তোমার মুখের। অনির্বচনীয় চুম্বন অনুভব করতে চাই না… তবে আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি তোমার প্রেমে আমাকে প্রজ্জ্বলিত করো… আহ, আমার দাউদাউ উন্মত্ততায় আমাকে তোমার হৃদয়ে লুকোতো দাও… আমি তোমার প্রেমের শিকার হবো…’ ইত্যাদি।
তবে এমন সিদ্ধান্তে পৌছোনো ঠিক হবে না এসব অপ্রতিরোধ্য ভাবোচ্ছ্বাস সব সময়ই যৌন; বরং সত্য হচ্ছে যখন বিকশিত হয় নারীর কাম, তাতে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে ধর্মানুভূতি যা নারী সাধারণত আবাল্য চালিত করে পুরুষের দিকে। একথা সত্য যে ছোটো মেয়ে তার স্বীকারোক্তিগ্রহণকারীর মুখখামুখি, এবং একলা বেদিমূলে, বোধ করে একটা চাঞ্চল্য, যা সে পরে অনুভব করবে তার প্রেমিকের আলিঙ্গনে : এটা বোঝায় যে নারীর প্রেম হচ্ছে অভিজ্ঞতার এমন এক রূপ যাতে এক সচেতন অহং সে-সত্তার জন্যে নিজেকে পরিণত বস্তুতে করে, যে এর সীমাতিক্রমণ করেছে; এসব অক্রিয় সুখানুভবও ছায়াচ্ছন্ন গির্জায়বিলম্বকারী তরুণী ভক্তের আনন্দ।
অবনত মস্তকে, আপন হাতে মুখ ঢেকে, সে বোঝে আত্ম-অস্বীকৃতির অলৌকিকত্ব : জানুতে ভর দিয়ে সে ওঠে স্বর্গের দিকে; মেঘ ও দেবদূতদের উর্ণাজালের মধ্যে বিধাতার বাহুতে তার আত্মসমর্পণ তাকে দেয় স্বর্গে প্রবেশের নিশ্চয়তা। এ-চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা থেকেই সে নকল করে তার পার্থিব ভবিষ্যৎ। শিশু এটা পেতে পারে আরো নানা পথেও; এক গৌরবের স্বর্গে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্যে সব কিছুই দিবাস্বপ্নে। তাকে আমন্ত্রণ জানায় পুরুষের বাহুতে নিজেকে সমর্পণ করতে। সে শেখে যে সুখী হওয়ার জন্যে তাকে প্রেম পেতে হবে; প্রেম পাওয়ার জন্যে তাকে অপেক্ষা করতে হবে প্রেমিকের আগমনের জন্যে। নারী হচ্ছে নিদ্রিতা রূপসী, সিন্ডেরেলা, তুষারশুভ্রা, যে গ্রহণ করে এবং বশ্যতা স্বীকার করে। গানে ও গল্পে দেখা যায় যুবক অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছে নারীর খোঁজে; সে হত্যা করে ড্রাগন, সে যুদ্ধ করে দানবদের সাথে; নারী বন্দী থাকে কোনো মিনারে, প্রাসাদে, উদ্যানে, গুহায়, সে শৃঙ্খলিত থাকে পাথরের সাথে, সে বন্দিনী, গভীর দ্রিামগ্ন : সে অপেক্ষা করে।
একদিন আসবে আমার রাজকুমার… একদিন আসবে সেই পুরুষ, যাকে আমি ভালোবাসি জনপ্রিয়গানের ভাষা তাকে ভরে দেয়ধৈর্য ও আশার স্বপ্নে ।
তাই নারীর কাছে চরম প্রয়োজনের ব্যাপার হচ্ছে কোনো পুরুষের হৃদয়কে মুগ্ধ করা; তারা হতে পারে অকুতোভয় ও রোমাঞ্চাভিলাষী, সব নায়িকারই অভিকাঙ্খী হয় পুরস্কারপ্রাপ্তির; এবং অধিকাংশ সময়ই রূপ ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো গুণই চাওয়া হয় না। তাই বোঝা যায় যে তার শারীরিক সৌন্দর্যের যত্ন নেয়াই হয়ে ওঠে বালিকার প্রকৃত আবিষ্টতা; তারা রাজকন্যাই হোক আরা রাখালীই হোক, ভালোবাসা ও সুখ পাওয়ার জন্যে সব সময় রূপসী হতেই হবে তাদের; সাদাসিধে ভাবের সাথে নির্মমভাবে জড়ানো হয় খলস্বভাবকে, আর কুৎসিত মেয়ের ওপর যখন নেমে আসে দুর্ভাগ্য, বোঝা যায় না তারা শাস্তি পাচ্ছে তাদের অপরাধের জন্যে, না তাদের অসুন্দর চেহারার জন্যে। মাঝেমাঝেই রূপসী তরুণী জীবদের, যাদের জন্যে রক্ষিত আছে এক উপভোগ্য ভবিষ্যৎ, তাদের প্রথম দেখা যায় শিকাররূপে; ব্ৰাৰ্বরের জেনেভিয়েভের, গ্রিসেলদার কাহিনী যতোটা সরল মনে হয় আসলে ততটা সরল নয়; তাদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে মিশ্রিত হয়ে আছে প্রেম ও দুঃখভোগ; নারী প্রথমে শোচনীয় দুর্দশার গভীরে পতিত হয়েই নিশ্চিত করে তার চরম স্বাদু বিজয়গুলো; বিধাতা বা পুরুষ যে-ই জড়িত থাক-না-কেনো ছোটো বালিকা জানে সে সর্বশক্তিমান হয়ে উঠবে গভীরতম দাবিত্যাগের মাধ্যমে : সে আনন্দ পায় এমন এক মর্ষকামিতায়, যা তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় পরম বিজয়লাভের। সেইন্ট ব্লাদিন, সিংহের থাবায় গাঁথা তার রক্তের ডোরাকাটা দেহ, মৃতের মতো কাঁচের কফিনে শায়িত তুষারশুভ্রা, নিদ্রিতা রূপসী, মূৰ্ছিতা আতালা, একপাল ভঙ্গুর নায়িকা ক্ষতবিক্ষত, অক্রিয়, আহত, নতজানু, অবমানিত, তাদের বালিকা বোনের কাছে প্রদর্শন করে শহিদ হওয়ার, পরিত্যক্ত হওয়ার, দাবিত্যাগী সৌন্দর্যের মোহনীয় মর্যাদা। আমরা বিস্মিত হই না যখন তার ভাই পালন করে বীরের ভূমিকা, তখন বালিকা স্বেচ্ছায় পালন করে শহিদের ভূমিকা : পৌত্তলিকেরা তাকে ছুঁড়ে দেয় সিংহের মুখে, নীলশ তাকে চুল ধরে টেনে হিচড়ে নেয়, তার স্বামী, মহারাজ, তাকে নির্বাসিত করে অরণ্যের গভীরে; সে বশ্যতা স্বীকার করে, দুঃখভোগ করে, মৃত্যুবরণ করে, এবং তার মাথা পরে গৌরবের জ্যোতিশ্চক্র।
ছলচাতুরি ও দিবাস্বপ্ন ছোটো মেয়েকে পরিচিত করিয়ে দিতে থাকে অক্রিয়তার সাথে; তবে নারী হওয়ার আগে সে একটি মানুষ, এবং সে ইতিমধ্যেই জানে যে নিজেকে নারী হিশেবে মেনে নেয়া হচ্ছেদাবি ত্যাগ করা এবং নিজের অঙ্গহানি করা; দাবি ত্যাগের ব্যাপারটি প্রলোভনজাগানো হলেও অঙ্গহানিত্ব জাগায় ঘৃণা। ভবিষ্যতের কুয়াশার মধ্যে পুরুষ, প্রেম এখনো সুদূর; বর্তমান মুহূর্তে ছোটো মেয়ে, তার ভাইদের মতোই, চায় সক্রিয়তা ও স্বাধীনতা। শিশুদের ওপর স্বাধীনতা গুরুভার নয়, কেননা এর সাথে দায়িত্ব জড়িত নয়; তারা জানে প্রাপ্তবয়স্কদের তত্ত্বাবধানের মধ্যে তারা নিরাপদ : তারা পালিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা বোধ করে না। জীবনের দিকে তার স্বতস্ফূর্ত উদ্বেলন, খেলাধুলোয় তার আনন্দ, হাসাহাসি, রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড ছোটো মেয়েকে দেখিয়ে দেয় যে মায়ের এলাকাটি সংকীর্ণ ও শ্বাসরুদ্ধকর। তার ইচ্ছে হয়মায়ের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেতে, এ-কর্তৃত্ব প্রয়োেগ করা হয় এমন ঘনিষ্ঠ ও প্রাত্যহিক রীতিতে যার মতো কিছু ছেলেদের ওপর প্রয়োগ করা হয় না।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সুখ পায়, যখন তারা তার সাথে এমনভাবে আচরণ করে যেনো সে আছে তাদের সমান অবস্থানে, এবং সে চেষ্টা করে অদের অনুমোদন পাওয়ার। সুবিধাপ্রাপ্ত জাতের অন্তর্ভুক্ত হলে তার ভালো লাগতো। মার্জিত আচরণের বিধিবিধান দ্বারা, নিজের পোশাকের ঝামেলা দিয়ে, গৃহস্থালি কাজকর্মের কাছে বন্দী হয়ে নিজের সব উড়ালকে প্রতিহত করতে সে পছন্দ করে না। অসংখ্য অনুসন্ধান।চালানো হয়েছে এ-ব্যাপারে, প্রায় অধিকাংশ থেকেই পাওয়া গেছে একই ফলাফল : বাস্তবিকভাবে সব ছেলেই–প্লাতোর কালের প্লাতোর মতোই–ঘোষণা করেছে যে। মেয়ে হতে তারা ভয় পায়; আর প্রায় সব মেয়েই দুঃখ পায় যে তারা ছেলে হয় নি। হ্যাভলক এলিসের পরিসংখ্যান অনুসারে, একশোর মধ্যে একটি ছেলে পছন্দ করে মেয়ে হতে; আর শতকরা পঁচাত্তরজনেরও বেশি মেয়ে পছন্দ করে তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে। অধিকাংশ মেয়েই অভিযোগ করে যে তাদের পোশাক বিরক্তিকর, তাতে চলাফেরার স্বাধীনতা থাকে না, তাদের সাবধান থাকতে হয় যাতে তাদের হালকা রঙের স্কার্ট ও ড্রেসে দাগ না লাগে।
দশ বা বারো বছর বয়সে অধিকাংশ ছোটো মেয়েই খাঁটি গারস মাক- অর্থাৎ, এমন শিশু, যারা কোনো একটি অভাবের ফলে ছেলে হতে পারে নি। একে তারা শুধু একটা বঞ্চনা ও অবিচার বলেই মনে করে না, তারা দেখতে পায় তারা দণ্ডিত হয়েছে যে-অবস্থায় থাকার জন্যে, সেটি অশুভ। দমিত হয় মেয়েদের প্রাণোচ্ছলতা, তাদের নিষ্ক্রিয় শক্তি রূপান্তরিত হয় স্নায়বিক দৌর্বল্যে; তাদের অতিশান্ত কাজগুলোনিঃশেষ করতে পারে না তাদের শক্তির প্রাচুর্য; তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে ওঠে, এবং অবসাদের মধ্য দিয়ে ও তাদের হীন অবস্থানের ক্ষতিপূরণের জন্যে নিজেদের তারা সমর্পণ করে বিষাদগ্রস্ত ও রোম্যান্টিক দিবাস্বপ্নের কাছে; তারা সুখ পায় এসব সহজমুক্তির প্রক্রিয়ার মধ্যে এবং হারিয়ে ফেলে তাদের বাস্তবতাবোধ; তাদের আবেগের কাছে তারা ধরা দেয় অদম্য উত্তেজনায়; কাজ করার বদলে তারা কথা বলে, অধিকাংশ সময় খিচুড়ির ধরনে মিলিয়েমিশিয়ে দেয় গুরুতুপূর্ণ কথার সাথে নিরর্থক কথা। অবহেলিত, ‘ভুলভাবে বোঝা’, তারা সান্ত্বনা খোঁজে আত্মরতিক কল্পনায় : নিজের প্রতি অনুরাগ ও করুণার সাথে নিজেদের তারা কল্পনা করতে থাকে উপন্যাসের রোম্যান্টিক নায়িকারূপে। খুবই স্বাভাবিকভাবে তারা হয়ে ওঠে ছেনাল ও নাটুকে, এ-ক্রটিগুলো লক্ষণীয় হয়ে ওঠে বয়ঃসন্ধিকালে। তাদের অসুস্থতা ধরা পড়েধৈর্যহীনতায়, বদমেজাজের ঘোরে, অশ্রুপাতে; তারা কান্না উপভোগ করে। অনেক নারী এ-অভ্যাস টিকিয়ে রাখে বুড়ো বয়স পর্যন্ত অনেকটা এজন্যে যে তারা দণ্ডিতের ভূমিকায়। অভিনয় করতে পছন্দ করে : এটা যুগপৎ তাদের নির্মম ভাগ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার উপায়। ছোটো বালিকারা প্রায়ই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেখে নিজেদের, তাদের সুখ দ্বিগুণ করার জন্যে।
তবে এভাবে তার অক্রিয় ভূমিকা মেনে নিয়ে, প্রতিবাদ না করে বালিকা রাজি হয় এমন এক নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, যা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হতে যাচ্ছে তার ওপর, এবং এ-দুর্যোগ তাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। কোনো ছেলে, সে উচ্চাভিলাষী, বা চিন্তাভাবনাশূন্য, বা ভীতু, যাই হোক, সে চোখ রাখে এক মুক্ত ভবিষ্যতের দিকে; সে নাবিক হবে বা হবে প্রকৌশলী, সে খামারে কাজ করবে বা শহরে চলে যাবে, সে বিশ্বটাকে দেখবে, সে ধনী হবে; সে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবে সেভবিষ্যতের মুখোমুখি, যার ভেতরে তার জন্যে অপেক্ষায় আছে অভাবিত। বালিকা হবে স্ত্রী, মা, মাতামহী; সে ঘরবাড়ি গুছিয়েরাখবে যেমন রাখতো তার মা, ছোটো বয়সে সে যেমন সেবাযত্ন পেয়েছে, তাই সে দেবে তার সন্তানদের–তার বয়স বারো, কিন্তু এর মাঝেই তার উপাখ্যান লেখা হয়ে গেছে স্বর্গে। সে একে তৈরি না করে একে আবিষ্কার করবে দিনের পর দিন; সে ঔৎসুক্য বোধ করে, তবে ভয় পায় যখন গভীরভাবে চিন্তা করে এ-জীবনের কথা, যার প্রতিটি স্তরই আগাম জানা হয়ে গেছে এবং যার দিকে অপ্রতিরোধভাবে সে এগিয়ে চলছে প্রতিদিন।
এটাই ব্যাখ্যা করে কেনো ছোটো বালিকা তার ভাইদের থেকে বেশি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কামের রহস্যের ভাবনা দিয়ে। ছেলেরাও এসব ব্যাপারের প্রতি বোধ করে সংরক্ত আকর্ষণ; কিন্তু ভবিষ্যতে স্বামী ও পিতা হিশেবে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা ভাবেই না। সেখানে বিয়ে ও মাতৃত্ব হয়ে ওঠে বালিকার সমগ্র নিয়তি; এবং যখন থেকে সে ওগুলোর গুপ্তকথা সামান্যও বোঝে, তার মনে হয় যেনো কদর্যভাবে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে তার দেহ। মাতৃত্বের ইন্দ্রজাল দূরীভূত হয়ে গেছে : মোটামুটি ঠিকভাবেই এখন এটা জেনে গেছে বালিকা, এবং আগে হোক বা পরে হোক সে জেনেছে যে শিশু দৈবক্রমে এসে উপস্থিত হয় না মায়ের দেহের ভেতরে এবং এটা একটা যাদুকাঠি নাড়ানোর ফলে দেহ থেকে বেরিয়ে আসে না; সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে উদ্বেগের সাথে। এটা আর বিস্ময়কর মনে হয় না তার কাছে, বরং তার দেহের ভেতরে বিস্তার লাভ করবে একটা পরজীবী দেহ, এটা তার কাছে বীভৎস মনে হয়; এবং এ-দানবিক ফুলে ওঠার সামান্য ভাবনাই তাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে।
এবং শিশুটি বেরোবে কীভাবে? এমনকি যদি কেউ তাকে সন্তানপ্রসবের আর্তনাদ ও যন্ত্রণার কথা নাও বলে থাকে, সে হয়তো হঠাৎ শুনে ফেলেছে এ-সম্পর্কে কথা বা পড়েছে বাইবেলের কথাগুলো : ‘কষ্টের ভেতর দিয়ে তুমি সন্তান জন্ম দেবে’; একটি পূর্ববোধ আছে তার ওই পীড়ন সম্পর্কে, যা সে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কল্পনাও করতে পারে; সে অদ্ভুত সব ক্রিয়া উদ্ভাবন করে নাড়ির এলাকায়। যদি সে অনুমান করে জণটি বেরোবে পায়ুদ্বার দিয়ে, তাহলেও ওই ভাবনা তাকে আশ্বস্ত করে না : জানা গেছে যে ছোটো মেয়েরা মানসিক চাপজনিত কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে যখন তারা মনে করে যে তারা প্রসবের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছে। যথাযথ ব্যাখ্যাও বিশেষ কাজে আসে না : তার ভেতর আনাগোনা করতে থাকে ফোলার, ছেঁড়ার, রক্তক্ষরণের ছবি।
গর্ভধারণ ও প্রসবের শারীরিক প্রকৃতি অবিলম্বে নির্দেশ করে যে শারীরিক কিছু একটা ঘটে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে। ‘একই রক্তের সন্তান’, ‘বিশুদ্ধ রক্ত’, ‘মিশ্র রক্ত’ প্রভৃতি কথায় ‘রক্ত’ শব্দটি প্রায়ই উপস্থিত থেকে অনেক সময় পরিচালিত করে। শিশুসুলভ কল্পনাকে; উদাহরণস্বরূপ, এমন মনে হতে পারে যে বিয়ে হচ্ছে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে রক্তসঞ্চালনের এক ধরনের ধর্মীয় ব্ৰতানুষ্ঠান। তবে ‘শারীরিক কিছু একটা’ অধিকাংশ সময়ই সম্পর্কিত থাকে মূত্র ও বিষ্ঠাঘটিত প্রত্যঙ্গের সাথে; শিশুরা বিশেষ করে বিশ্বাস করতে চায় যে পুরুষটি প্রস্রাব করে নারীটির ভেতরে। যৌনক্রিয়াকে মনে করা হয় নোংরা। এটা অত্যন্ত বিপর্যস্তকর শিশুর কাছে, যার জন্যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘নোংরা’ জিনিশ : তাহলে বড়োরা কীভাবে এমন জিনিশ মেনে নিতে পারে জীবনের অচ্ছেদ্য অংশরূপে?
শিশুদের যখন সাবধান করা হয় অচেনাদের সম্পর্কে বা কোনো যৌন ব্যাপার ব্যাখ্যা করা হয় তাদের কাছে, এটা সম্ভব যে তখন নির্দেশ করা হয় রোগগ্রস্তদের প্রতি, প্রচণ্ড উন্মাদদের প্রতি, বিকৃতমস্তিষ্কদের প্রতি; এটা এক সুবিধাজনক ব্যাখ্যা। যে-শিশু সিনেমায় ছোঁয়া বোধ করে পাশের লোকটির, বা যে রাস্তায় কাউকে ন্যাংটো হতে দেখেছে, সে বিশ্বাস করে তারা পাগল। একথা সত্য যে উন্মত্তের মুখোমুখি হওয়া অপ্রীতিকর : মৃগীরোগীর আক্রমণ, স্নায়ুবিকারগ্রস্তের ক্রোধের বিস্ফোরণ, বা। প্রচণ্ড কলহ বিপর্যস্ত করে বয়স্কদের জগত, যে-শিশু এটা দেখে সে বিপন্ন বোধ করে; তবে সুদৃশ্যভাবে সজ্জিত সমাজে যেমন আছে কিছু সংখ্যক ভিখিরি, ঘোড়া, ও জঘন্য ঘায়েভরা জরাগ্রস্ত, সমাজের ভিত্তি বিচলিত না করে তাই সেখানে পাওয়া যেতে পারে কিছু অস্বাভাবিকও। কিন্তু সন্দেহ করা হয় যে পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকেরা গোপনে উদযাপন করে কৃষ্ণ ম্যাস, তখন শিশু সত্যিসত্যিই ভয় পায়।
বস্ত্রপরিহিত ও সম্মানিত ভদ্রলোকগণ, যাঁরা নির্দেশ করেন শোভনতা, সংযম, যুক্তির জীবন, এ-ভাবনা থেকে কী করে যাওয়া যায় পরস্পর ধস্তাধস্তিরত দুটি পশুর ভাবনায়? এখানেই আছে বয়স্কদের আত্ম-মানহানি, যা কাঁপিয়ে তোলে তাদের স্তম্ভভিত্তি, যা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে আকাশ। শিশু প্রায়ই ফাস-হয়ে-যাওয়া এ-গুপ্ততথ্য মেনে নিতে একগুয়েভাবে অস্বীকার করে : ‘আমার মা-বাবা ওটা করে না’, বালিকা জোরের সাথে বলে। বা সে নিজে গঠন করার চেষ্টা করে সঙ্গমের একটা শোভন চিত্র : যেমন একটি ছোেটা মেয়ে বলেছে, ‘যখন শিশুর দরকার হয়, তখন পিতামাতা যায় চিকিৎসকের রোগী দেখার ঘরে; তারা নগ্ন হয়, তারা নিজেদের চোখ বেঁধে নেয় কেননা তাদের কিছু দেখা নিষেধ; তারপর চিকিৎসক তাদের একত্র করে এবং দেখে যাতে সব কিছু ঠিকঠাক মতো হয়’; সে প্রণয়কর্মটিকে একটি শল্যচিকিৎসায়রূপান্তরিত করেছে, যা নিঃসন্দেহে অপ্রীতিকর, তবে দন্ত্যচিকিৎসকের সাথে একটা বৈঠকের মতো নির্ভুল। তবু অস্বীকার ও বাস্তব থেকে পলায়ন সত্ত্বেও, শিশুর মনে চুপিসারে ঢোকে অস্বস্তি ও সন্দেহ এবং সৃষ্টি হয় দুধ ছাড়ার মতো বেদনাদায়ক একটা প্রভাব।
এবং যা বাড়িয়ে তোলে ছোটো মেয়ের বিপন্নতা, তা হচ্ছে তার ওপর চেপে আছে দ্ব্যর্থবোধক যে-অভিশাপ, তার রূপ সে স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারে না। তার তথ্য বিশৃঙ্খল, বইগুলো পরস্পরবিরোধী; এমনকি কৌশলসংক্রান্ত ব্যাখ্যাও গাঢ় অন্ধকার দূর করতে পারে না; শত শত প্রশ্ন দেখা দেয় : সঙ্গমের কাজটি কি যন্ত্রণাদায়ক? না কি আনন্দদায়ক? এটা কততক্ষণ চলে–পাঁচ মিনিট না কি সারারাত? সে এখানে পড়ে যে একবার আলিঙ্গনেই এক মহিলা মা হয়েছে, আবার অন্য জায়গায় পড়ে যে ঘন্টার পর ঘন্টা যৌন সুখের পরেও নারী বন্ধ্যা থাকে। লোকজন কি প্রতিদিনই ‘এটা করে’? না কি মাঝেমাঝে? শিশু বাইবেল পড়ে, অভিধান ঘেঁটে, তার বন্ধুদের কাছে এসম্পর্কে জিজ্ঞেস করে নিজেকে অবহিত করতে চায়, সুতরাং সে অস্পষ্টতা ও ঘৃণার মধ্যে অন্ধের মতো হাতড়ে ফেরে।
বলা দরকার যে এমনকি সুস্পষ্টভাবে শিক্ষাদানও এ-সমস্যা সমাধান করবে না; পিতামাতা ও শিক্ষকেরা যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শুভকামনা নিয়েও কাজ করেন, তবুও শব্দ ও ধারণার মধ্য দিয়ে যৌন অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা অসম্ভব, এটা বোঝা সম্ভব শুধু যাপন করে; যে-কোনো বিশ্লেষণেরই, তা যতোই গভীরই হোক-না-কেনো, থাকে একটা কৌতুককর দিক এবং সেটা সত্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়।
সংরাগহীন শিশুর কাছে কী করে ব্যাখ্যা করা যায় চুম্বনের বা আদরের সুখ? পারিবারিক চুম্বন দেয়া ও নেয়া হয় অনেক সময় এমনকি ওষ্ঠেই; শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির ওই সংস্পর্শের, অনেক ক্ষেত্রে, কেনো থাকে মাথা ঝিম-ধরানোর প্রভাব? এটা অন্ধের কাছে রঙের বর্ণনা দেয়ার মতো। যে-পর্যন্ত থাকে না সে-উত্তেজনা ও কামনার বোধি যা যৌনক্রিয়াকে দেয় তার অর্থ ও তার ঐক্য, সে-পর্যন্ত তার বিচিত্র উপাদানকে মনে হয় অতি জঘন্য ও পৈশাচিক। বিশেষত, ছোটো মেয়ে যখন বুঝতে পারে সে কুমারী ও রুদ্ধ, এবং তাকে একটি নারীতে পরিণত করার জন্যে দরকার পড়বে পুরুষের একটি যৌনাঙ্গের, যেটি বিদ্ধ করবে তাকে, তখন তার মনে জেগে ওঠে ঘৃণা ও ভীতির শিহরণ। যৌনাঙ্গপ্রদর্শন যেহেতু একটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত যৌনবিকৃতি, অনেক তরুণী মেয়েই দেখেছে দাঁড়ানো শিশ্ন; তা যা-ই হোক, তারা দেখেছে পুরুষ পশুর যৌনাঙ্গ, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘোড়ার যৌনাঙ্গ প্রায়ই আকর্ষণ করেছে তাদের স্থিরদৃষ্টি; এটা হতে পারে খুবই ভীতিকর। সন্তানপ্রসবের ভয়, পুরুষের যৌনাঙ্গের ভয়, বিবাহিতদের আক্রান্ত করে যে-সব সংকট, সেগুলোর ভয়, অশোভন আচরণের প্রতি ঘৃণা–এসব মিলেমিশে প্রায়ই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে ছোটো মেয়ে ঘোষণা করে : ‘আমি কখনো বিয়ে করবো না’। যন্ত্রণা, বোকামি, অশ্লীলতার বিরুদ্ধে এটাই হবে নিশ্চিত প্রতিরোধ।
তবুও রূপান্তর ঘটতে থাকে। ছোটো মেয়ে এর অর্থ বুঝতে পারে না, কিন্তু সে লক্ষ্য করে যে বিশ্বের সাথে ও তার নিজের শরীরের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে ঘটছে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন : সে সচেতন হয়েউঠছে সে-সব স্পর্শ, স্বাদ, রঙের প্রতি, যেগুলো আগে ছিলো তার প্রতি উদাসীন; অদ্ভুত সব ছবি ঝিলিক দিতে থাকে তার মনে; আয়নায় সে নিজেকে প্রায় চিনতেই পারে না; তার নিজেকে ‘অদ্ভুত’ লাগতে থাকে, সব কিছু তার ‘অদ্ভুত’ লাগে।
এ-অস্থিরতার সময়ে যা ঘটতে থাকে, তা হচ্ছে বালিকার দেহ পরিণত হতে থাকে নারীর দেহে এবং হয়ে উঠতে থাকে মাংস। লালাগ্রন্থিক ন্যূনতার বেলা ছাড়া, যেখানে বিষয়ী আবদ্ধ হয়ে থাকে বালসুলভ পর্বে, বয়ঃসন্ধির সংকট হঠাৎ এসে হাজির হয় বারো-তেরো বছর বয়সে। ছেলের থেকে মেয়ের মধ্যে এ-সংকট দেখা দেয় অনেক আগে, এবং এটা ঘটিয়ে থাকে অনেক বেশি গুরুত্বপর্ণ বদল। কিশোরী মেয়ে এর সাক্ষাৎ লাভ করে অস্বস্তির সাথে, বিরক্তির সাথে। যখন দেখা দিতে থাকে স্তন ও শরীরের লোম, তখন জন্ম নেয় এমন একটা বোধ, যা অনেক সময় দেখা দেয়। গর্বরূপে, তবে সেটা মূলত লজ্জা; হঠাৎ বালিকা হয়ে ওঠে বিনয়ী, সে উলঙ্গ হতে চায় এমনকি তার মা ও বোনদের সামনে, সে নিজেকে দেখতে থাকে মিলেমিশে যাওয়া বিস্ময় ও বিভীষিকার মধ্যে, এবং নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে সে দেখতে থাকে প্রতিটি বৃন্তের নিচে বেড়ে উঠছে এ-টানটান ও কিঞ্চিৎ বেদনাদায়ক শাঁসটি, যা এপর্যন্ত ছিলো নাভির মতোই নিরীহ। একথা অনুভব করে সে বিচলিত বোধ করে যে তার আছে একটা অরক্ষিত স্থান; এ-স্পর্শকাতর ও যন্ত্রণাপূর্ণ স্থানটি অবশ্যই পোড়ার বা দাঁতের ব্যথার তুলনায় তুচ্ছ ব্যাপার; তবে আঘাতের ফলেই হোক বা অসুখের ফলেই হোক, সব ধরনের ব্যথাই অস্বাভাবিক জিনিশ। কিছু একটা ঘটছে–যা অসুখ নয়–যার ইঙ্গিত রয়েছে অস্তিত্বের নিয়মের মধ্যেই, তবে তার প্রকৃতি অনেকটা সংগ্রামের, একটা ক্ষতের। শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মেয়েটি অবশ্যই বড়ো হয়েছে, তবে সে কখনো তার বৃদ্ধি টের পায় নি : দিনের পর দিন তার শরীর ছিলো এক বর্তমান ঘটনা, নির্দিষ্ট, সম্পূর্ণ কিন্তু এখন সে ‘বাড়ছে’। এ-শব্দটিই বিভীষিকাজাগানো; স্তনের বিকাশের মধ্যে বালিকা বোধ করে বাঁচা শব্দটির দ্ব্যর্থতা। সে সোনাও নয়হীরেও নয়, এক অদ্ভুত পদার্থ, সব সময়ই পরিবর্তনশীল, অনির্দিষ্ট, যার গভীরতলে বিশদভাবে ঘটছে অপরিচ্ছন্ন রসায়ন। সে অভ্যস্ত মাথাভরা চুলে, যা রেশমি ফেটির মতো নীরবে ঢেউ খেলে; কিন্তু তার বগলে ও মধ্যভাগে এই নতুন উদাম তাকে রূপান্তরিত করে এক ধরনের জম্ভ বা শৈবালে। তাকে আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া হোক বা না হোক, এসব বদলের মধ্যে সে অনুভব করে এক চূড়ান্ত অবস্থার পূর্ববোধ, যা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র থেকে : সে দেখতে পায় তাকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে এক জীবনচক্রে, যা প্লাবিত করছে তার ব্যক্তিগত অস্তিত্বের গতিপথকে, সে জানতে পারে ভবিষ্যতের পরনির্ভরতাকে, যা তাকে দণ্ডিত করে পুরুষের কাছে, সন্তানের কাছে, এবং মৃত্যুর কাছে। শুধু স্তন হিশেবে তার স্তন দুটিকে মনে হবে এক অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেয়া বিস্তার বলে। বাহু, পা, ত্বক, পেশি, এমনকি বর্তুল পাছা, যার ওপর সে বসে–এ-পর্যন্ত এগুলোর ছিলো সুস্পষ্ট উপযোগিতা; শুধু তার লিঙ্গটিকে, সুস্পষ্টভাবেই যেটি প্রস্রাব করার প্রত্যঙ্গ, মনে হতো কিছুটা সন্দেহজনক, তবে সেটি ছিলো গোপন ও অন্যদের কাছে অদৃশ্য। তার সুয়েটার বা ব্লাউজের নিচে থেকেও তার স্তন দুটি প্রদর্শন করে। নিজেদের, এবং যে-দেহটির সাথে ছোটো মেয়ে নিজেকে অভিন্ন বোধ করেছে, সেটিকে সে এখন বোধ করে মাংসরূপে। এটি হয়েওঠে একটি বস্তু, যা দেখতে পায় অন্যরা এবং যার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অন্যরা। ‘দু-বছর ধরে,’ এক মহিলা আমাকে বলেছেন, ‘আমার বুক লুকিয়ে রাখার জন্যে আমি ঢিলে জামা পরেছি, আমি এতো লজ্জায়ছিলাম এ নিয়ে’। এবং আরেকজন : ‘আমার আজো মনে পড়ে আমি কেমন অদ্ভুত বিভ্রান্তি বোধ করেছিলাম যখন আমার বয়সেরই এক বান্ধবী, তবে যে আমার থেকে অনেক বেশি বাড়ন্ত ছিলো, সে যখন উপুড়হয়ে একটি বল তুলছিলো আর আমি তার অন্তর্বাসের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম তার পূর্ণবিকশিত স্তন দুটি। আমার নিজের বয়সের কাছাকাছি একটি দেহ, যার আদলে গড়ে উঠবে আমার দেহটি, সেটি দেখে নিজের কথা ভেবে আমার গাল লাল হয়ে উঠেছিলো’। কিশোরী মেয়ে বোেধ করে তার শরীর যেনো তার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এটা আর ব্যক্তিতার সরাসরি প্রকাশ নয়; এটা অচেনা হয়ে ওঠে তার কাছে; এবং একই সময়ে অন্যদের কাছে সে হয়ে ওঠে একটি জিনিশ : পথে চোখে চোখে তাকে অনুসরণ করে পুরুষেরা এবং তার দেহসংস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করে। তার ইচ্ছে হয় অদৃশ্য হয়ে যেতে; মাংস হয়ে উঠতে ও তার মাংস প্রদর্শন করতে তার ভয় লাগে।
অনেক সময়, যাকে বলা যেতে পারে প্রাক-বয়ঃসন্ধিপর্ব, তার ঋতুস্রাব দেখা দেয়ার আগে, মেয়ে তার দেহ নিয়ে লজ্জা পায় না; নারী হয়ে উঠতে সে গর্ব বোধ করে এবং সন্তোষের সাথে দেখে তার স্তনের বেড়ে ওঠা, রুমাল দিয়ে সে তার ড্রেসে প্যাড লাগায় এবং বয়স্কদের সামনে এটি নিয়ে গর্ব বোধ করে; সে তখনও তার ভেতরে কী ঘটছে, তার তাৎপর্য বুঝে ওঠে না। তার প্রথম ঋতুস্রাব প্রকাশ করে এই অর্থ, এবং দেখা দেয় তার লজ্জাবোধ। তার-যদি আগে থেকেই থাকে লজ্জাবোধ, তাহলে এ-সময় থেকে তা প্রবলতর ও অতিশায়িত হতে থাকে। সব সাক্ষ্যপ্রমাণ একযোগে দেখায় যে মেয়েটিকে থেকে সতর্ক করা হয়েথাক বা না থাক, এঘটনাটি সব সময়ই তার কাছে মনে হয় অপছন্দনীয় ও অবমাননাকর। প্রায়ই মা তাকে এটা অবহিত করতে ব্যর্থ হয়; দেখা গেছে যে ঋতুস্রাবের ঘটনার থেকে সানন্দে মায়েরা তাদের মেয়েদের কাছে ব্যাখ্যা করে গর্ভধারণ, সন্তানপ্রসব, এবং এমনকি যৌনসম্পর্কের রহস্য। মনে হয় নারীদের এ-বোঝটিকে তারা নিজেরাই এমন এক বিভীষিকার সাথে ঘৃণা করে যে তাতে প্রতিফলিত হয়পুরুষদের প্রাচীন অতীন্দ্রিয় ভীতি এবং মায়েরা যা সঞ্চারিত করে যায় তাদের সন্তানদের মধ্যে। যখন মেয়ে তার কাপড়ে দেখতে পায় সন্দেহজনক দাগগুলো, সে বিশ্বাস করে সে আক্রান্ত হয়েছে উদরাময়ে, বা মারাত্মক কোনো রক্তক্ষরণে বা কোনো লজ্জাজনক রোগে। আত্মহত্যার উদ্যোগ নেয়ার ঘটনাও অজানা নয়, এবং সত্যিই কিশোরী মেয়ের পক্ষে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক, কেননা মনে হয় যেনো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তার জীবনশোণিত, হয়তো আভ্যন্তর অঙ্গে কোনো ক্ষতের ফলে। এমনকি সুবিবেচিত শিক্ষাদানের ফলে যদি তার তীব্র উদ্বেগ কেটেও যায়, তবু মেয়ে লজ্জা বোধ করে, মনে করে সে ময়লা হয়ে। গেছে; এবং সে দৌড়ে যায় স্নানঘরে, সে চেষ্টা করে তার নোংরা জামাকাপড় পরিষ্কার করতে বা লুকিয়ে ফেলতে।
ডঃ ডব্লিউ লিপমান তরুণতরুণীদের যৌনতাসম্পর্কে গবেষণা করার সময় এবিষয়ে, জোনস এ সেক্সিয়ালিতেতে, আরো বহু কিছুর সাথে সগ্রহ করেছেন নিচের মন্তব্যগুলো :
যোলো বছর বয়সে, যখন আমি প্রথমবারের মতো অসুস্থ হই, আমি খুব ভয় পাই যখন ভোরবেলা আমি এটা আবিষ্কার করি। সত্যি বলতে কী, আমি জানতাম এটা ঘটবে; তবে আমি এতো লজ্জাবোধ করি যে সারাটা সকাল বিছানায় পড়ে থাকি এবং সব প্রশ্নের উত্তরে বলতে থাকে যে আমি উঠতে পারছি না।
আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম যখন বারো বছর বয়সে প্রথম আমার ঋতুস্রাব দেখা দেয়। আমি সন্ত্রস্ত বোধ করি, এবং আমার মা যখন শুধু বলে যে এটা প্রতিমাসেই দেখা দেবে, আমি একে গণ্য করি একটা বড়ো অশ্লীলতা বলে এবং পুরুষদেরও এটা হয় না, তা মেনে নিতে অস্বীকার করি।
আমার মা আমাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে আগেই বলেছিলো, এবং আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম যখন, অসুস্থ হয়ে, আনন্দে ছুটে গিয়ে মাকে জাগিয়ে বলি : মা, আমার এটা হয়েছে। আর সে শুধু বলে : এবং এর জন্যে তুমি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে! এসত্ত্বেও এ-ঘটনাকে আমি আমার জীবনের একটি প্রকৃত বিপ্লব বলে গণ্য করেছি।
আমার মা আমাকে সতর্ক করে নি। তার বেলা এটা শুরু হয়েছিলো উনিশ বছর বয়সে, এবং তার নিচের অন্তর্বাস নোংরা করার জন্যে গালি খাওয়ার ভয়ে সে বাইরে গিয়ে একটি ক্ষেতের মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলো তার জামাকাপড়।
এ-সংকট দেখা দেয় অল্প বয়সে; বালক বয়ঃসন্ধিতে পৌছে পনেরো-ষোলোতে; বালিকা নারীতে পরিবর্তিত হয় তেরো-চোদ্দোতে। তবে তাদের বয়সের পার্থক্য থেকে তাদের অভিজ্ঞতার মৌলিক পার্থক্য জন্মে না; এটা উপস্থিত থাকে না শারীরবৃত্তিক প্রপঞ্চেও, যা বালিকার অভিজ্ঞতার ওপর প্রয়োগ করে তার মর্মঘাতী বল : বয়ঃসন্ধি দু-লিঙ্গে পরিগ্রহ করে আমূলভাবে ভিন্ন তাৎপর্য, কেননা তা উভয়ের জন্যে একই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করে না।
ছোটো মেয়েকে, এর বিপরীতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হয়ে ওঠার জন্যে বন্দী হয়ে থাকতে হয় তার ওপর তার নারীত্বের চাপিয়ে দেয় সীমার ভেতরে। বালক তার দেহে গজিয়ে ওঠা পশমে বিস্ময়ের সাথে দেখতে পায় যা ঘটতে যাচ্ছে যা ঘটবে; যে ‘নৃশংস ও নির্ধারিত নাটক’ স্থির করে বালিকার নিয়তি, তার মুখোমুখি বালিকা দাঁড়ায় ব্ৰিতভাবে। শিশ্নটি যেমন তার বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত মূল্যায়ন লাভ করে সামাজিক পরিস্থিতি থেকে, ঠিক তেমনি সামাজিক পরিস্থিতিই ঋতুস্রাবকে পরিণত করে একটি অভিশাপে। একজন প্রতীক হয়ে ওঠে পৌরুষের, আরেকজন নারীত্বের; আর নারীত্ব যেহেতু জ্ঞাপন করে বিকল্পতা ও নিকৃষ্টতা, তাই এর প্রকাশ হয়ে ওঠে লজ্জাজনক। বালিকার কাছে সব সময়ই তার জীবনকে মনে হয়েছে সে-অস্পষ্ট সারসত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, একটি সদর্থক রূপ দেয়ার জন্যে একটি শিশ্নের অভাবকে যার কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয় নি : কিন্তু সে তার দু-উরুর মাঝে দিয়ে প্রবাহিত ধারায় সচেতন হয়ে ওঠে নিজের সম্পর্কে। যদি সে ইতিমধ্যেই মেনে নিয়ে থাকে তার অবস্থাকে, তাহলে সে সানন্দে ঘটনাটিকে স্বাগত জানায়—’এখন তুমি একজন নারী’। যদি সে সব সময়ই নিজের অবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করে থাকে, তাহলে রক্তাক্ত রায় তাকে বিমূঢ় করে; প্রায়ই সে হোঁচট খায় : মাসিক অশুচিতা তার মনে জাগায় ঘৃণা ও ভয়। ‘সুতরাং এই হচ্ছে “নারী হওয়া” শব্দগুলোর অর্থ!’ নির্ধারিত যে-ভাগ্য অস্পষ্ট ও অবর্তমানভাবে এ-পর্যন্ত তার ওপর চেপে ছিলো, তা এখন গুটিসুটি মারছে তার পেটে; কোনো নিস্তার নেই; সে বোধ করে যে সে ধরা পড়ে গেছে।
এবং তার ঋতুস্রাব দেখা দেয়াই একলা বালিকার কাছে তার নারীসুলভ নিয়তি ঘোষণা করে না। তার মধ্যে দেখা দিতে থাকে আরো নানা সন্দেহজনক প্রপঞ্চ। এপর্যন্ত তার কামানুভূতি ছিলো ভগাঙ্কুরীয়। মেয়েদের মধ্যে হস্তমৈথুন ছেলেদের থেকে কম কি না তা বের করা কঠিন; বালিকা তার প্রথম দু-বছর ধরে এর চর্চা করে। থাকে, এমনকি এটা সে শুরু করে সম্ভবত তার জীবনের প্রথম মাসগুলোতেই; মনে হয়দু-বছর বয়সের দিকে সে এটা ছেড়ে দেয়, পরে আবার শুরু করার জন্যে। একটা গুপ্ত শ্লেষ্মল এলাকা ছোঁয়ার থেকে পুরুষের দেহে স্থাপিত ওই বৃন্তটির দেহসংস্থানগত অবয়ব অনেক বেশি প্ররোচিত করে ওটিকে ছোঁয়ার জন্যে; তবে হঠাৎ সংস্পর্শমেয়েটি দড়ি বা গাছ বেয়ে উঠছে, বা সাইকেল চালাচ্ছে–জামাকাপড়ের ঘষা, খেলার সময় ছোঁয়াছুঁয়ি, বা এমনকি খেলার সাথীদের, বয়স্কতর শিশুদের, বা প্রাপ্তবয়স্কদের দীক্ষাদান বালিকাকে প্রায়ই সচেতন করে তুলতে পারে সে-অনুভূতি সম্পর্কে, যা সে আবার জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে হাতের সাহায্যে।
তা যা-ই হোক, যখন পাওয়া যায় এ-সুখ, তখন তা থাকে একটি স্বাধীন অনুভূতিরূপে : সব শিশুসুলভ চিত্তবিনোদনের মতোই এর থাকে লঘু ও নিস্পাপ চরিত্র। বালিকা কখনো তার এসব গোপন উপভোগকে তার নারীসুলভ নিয়তির সাথে সম্পর্কিত করে না; ছেলেদের সাথে যদি তার যৌনসম্পর্ক ঘটে থাকে, তাহলে তা ঘটেছে মূলত ঔৎসুক্যবশত। আর সে এখন নিজেকে ধাবিত দেখে এমন এলোমেলোআবেগের মধ্যে, যার মধ্যে সে নিজেকে চিনতে পারে না। বাড়ছে কামানুভূতিপরায়ণ অঞ্চলগুলোর স্পর্শকাতরতা, এবং নারীতে এগুলো এতো অসংখ্য যে তার সম্পূর্ণ শরীরটিকেই গণ্য করা যেতে পারে কামানুভূতিপরায়ণ বলে। এ-সত্যটি তার কাছে প্রকাশ পায় পারিবারিক আদরের মধ্য দিয়ে, নিরীহ চুম্বনে, দর্জির, ডাক্তারের, বা নরসুন্দরের উদাসীন স্পর্শে, তার চুলের ওপর বা গ্রীবার পেছনে বন্ধুসুলভ হাতের ছোঁয়ায়; সে অনুভব করে, এবং অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে চায়, খেলার সম্পর্কের মধ্যে একটা গভীরতর শিহরণ, ছেলে বা মেয়েদের সাথে কুস্তি করে।
তরুণী মেয়ের উদ্বেগ প্রকাশ পায় নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্নে ও প্রেতের মতো আনাগোনা করা অলীক মূর্তিতে : যে-মুহূর্তে সে তার নিজের ভেতরে একটা ছলনাপর স্বেচ্ছাপ্রণোদনা বোধ করে, ঠিক তখনই অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিত হওয়ার ভাবনা তার। সমস্ত মনকে আবিষ্ট করে রাখে। এ-ভাবনাটি কম-বেশি নির্দিষ্ট অজস্র প্রতীকের মধ্য দিয়ে দেখা দিতে থাকে স্বপ্নে ও আচরণে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মেয়ে তার খাটের নিচে ভালোভাবে চায়, তার মনে হয় সন্দেহজনক অভিসন্ধি নিয়ে সেখানে লুকিয়ে আছে কোনো ডাকাত; তার মনে হয় বাড়িতে সে চোরের শব্দ পাচ্ছে; জানালা দিয়ে, ছোরা হাতে, তাকে ছোরা মারার জন্যে ঢুকছে আক্রমণকারী। পুরুষ তাকে কম-বেশি ভীত করে। বাবার প্রতি সে বোধ করে এক রকম বিরক্তি; তার তামাকের গন্ধ অসহ্য লাগে, তার পর স্নানাগারে যেতে তার ঘেন্না লাগে; এমনকি সে যদিও এখনো প্রীতিপূর্ণ, এ-শারীরিক অপছন্দের ভাব সে প্রায়ই বোধ করে। মনোচিকিৎসকেরা বলেন যে তাদের তরুণী রোগীরা প্রায়ই দেখে বিশেষ একটি স্বপ্ন : তারা কল্পনা করে তারা ধর্ষিত হয়েছে এক বয়স্ক মহিলার সামনে, যে কাজটিকে অনুমতি দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে তাদের কামনার কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্যে তারা প্রতীকী রীতিতে অনুমতি চাচ্ছে তাদের মায়ের কাছে।
একটা চাপ, যা তাদের ওপর অতিশয় কদর্য প্রভাব ফেলে, তা হচ্ছে কপটতা। তরুণী মেয়ে নিবেদিত ‘শুদ্ধতা’ ও ‘নিষ্পাপতা’র কাছে, আর ঠিক তখনি সে তার। নিজের ভেতরে ও চারপাশে আবিষ্কার করতে থাকে জীবন ও কামের রহস্যপূর্ণ। উত্তেজনা। মনে করা হয় সে হবে তুষারের মতো শুভ্র, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, তাকে পরানো হয় অত্যন্ত মিহি মসলিন-বস্ত্র, তার কক্ষটি মুড়ে দেয়া হয় সুরুচিসম্পন্ন রঙের কাগজে, তাকে আসতে দেখলে কথা বলা হয় নিচুস্বরে, তার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়। অশ্লীল বই। এখন, এমন কোনো ‘ভালো ছোট্ট মেয়ে’ নেই, যে সাধ মেটায় না ‘জঘন্য’ ভাবনায় ও কামনায়। সে এগুলোলুকোতে চেষ্টা করে তার অন্তরঙ্গতম বন্ধুর কাছেও, এমনকি নিজের কাছেও; সে নিয়ম মেনেই বাঁচতে ও চিন্তা করতে চায়; নিজের প্রতি তার অবিশ্বাস তাকে দেয় একটা প্রতারণাপূর্ণ, অসুখী, অসুস্থ ভাবভঙ্গি;এবং পরে এসব প্রবৃত্তির প্রতি সংকোচ কাটানোর থেকে তার জন্যে অন্য কিছুই বেশি কঠিন হয় না। এবং তার সমস্ত অবদমন সত্ত্বেও, সে বোধ করে সে বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে অকথ্য এক সীমালঙ্ঘনের ভারের নিচে। তার নারীতে রূপান্তরণ ঘটে শুধু লজ্জার মধ্যে নয়, বরং গভীর অনুশোচনার মধ্যে।
আমরা এখন পরিচিত সে-নাটকীয় সংঘাতের সাথে, যা বয়ঃসন্ধিকালে বিদীর্ণ করে কিশোরী মেয়ের মর্ম : তার নারীত্বকে মেনে না নিয়ে সে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হতে পারে না; এবং সে ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে তার লিঙ্গ তাকে দণ্ডিত করেছে একটি বিকলাঙ্গ ও নিশ্চল অস্তিত্বে, এ-সময়ে তার সামনে দেখা দেয় একটা অশুচি অসুস্থতা ও অস্পষ্ট অপরাধবোধরূপে। তার নিকৃষ্টতা প্রথমে মনে হয়েছিলো নিতান্তই একটি বঞ্চনা; কিন্তু একটা শিশ্নের অভাব এখন হয়ে উঠেছে একটা কলুষ ও সীমালঙ্ঘন। এভাবেই ক্ষতবিক্ষত, লজ্জিত, শাস্তিযোগ্য সে এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে।
“দ্বিতীয় লিঙ্গ- সিমোন দ্য বোভোয়ার” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
প্রথম খন্ডঃ তথ্য ও কিংবদন্তি
ভাগ – ১: নিয়তি
♦ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ
ভাগ – ২ : ইতিহাস
♦ পিতৃতান্ত্রিক কাল ও ধ্রুপদী মহাযুগ
♦ মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত
♦ ফরাশি বিপ্লব থেকেঃ চাকুরি ও ভোট
ভাগ – ৩ : কিংবদন্তি
দ্বিতীয় খন্ডঃ আজ নারীর জীবন
ভাগ – ৪ : গঠনের বছরগুলো
ভাগ – ৫ : পরিস্থিতি
ভাগ – ৬ : যথার্থ প্রতিপাদন
ভাগ – ৭ : মুক্তির অভিমুখে