যদি কোনো দিন ছন্দিত পায়ে আগন্তুকরা আসে,

তারকাখচিত তৃণের আসনে, এই বাগিচার পাশে

ফুল্ল হৃদয়ে তুমিও সেখানে চরণচিহ্ন এঁকো,

একটি শূন্য সুধার পেয়ালা নিভৃতে উপুড় করে রেখো।

-ওমর খৈয়াম, রুবাইয়াৎ

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের সূচনা থেকে সমসাময়িক কাল পর্যন্ত পরিচিত ধারাটি হলো, এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে মেধাবী ছেলেমেয়েরা নিজ দেশের ‘সর্বোচ্চ ডিগ্রি’ অর্জন করার পর ‘উচ্চতর’ শিক্ষার জন্য চলে যায় পশ্চিমে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও মধ্যযুগের প্রাক্কালে কিন্তু স্রোতটা ছিল ঠিক বিপরীত। বরং পশ্চিম থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিভাধর ছেলেদের (সেকালে মেয়েদের স্কুলে যাওয়াটাই ছিল অশ্রুতপূর্ব) স্বপ্ন ছিল প্রাচ্যের বড় বড় শিক্ষানিকেতনগুলোর কোথাও গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করা। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সে শিক্ষাগারের পীঠস্থান ছিল আরব। তখনকার দিনে উন্নততর জ্ঞানকেন্দ্র ছিল মিসর, ইরাক, সিরিয়া, ইরান এইসব মুসলিমপ্রধান দেশ।

এমনি এক উচ্চাভিলাষী শিক্ষার্থী ছিলেন লিওনার্দো ফিবোনাচি (১১৭০- ১২৫০)। ইতালির পিসা শহরে তাঁর জন্ম। ব্যবসায়ী পিতার আর্থিক সহায়তায় তিনি উত্তর আফ্রিকায় গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানে তিনি অঙ্ক শেখেন মুসলিম গণিতজ্ঞদের কাছে। কালক্রমে তিনি নিজেই একজন বিশিষ্ট গাণিতিক হয়ে ওঠেন। আফ্রিকার গণিতচর্চা শেষ করে তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। ইউরোপে তখন প্রাচ্যের গণিত, বিশেষ করে আরব-সূচিত সংখ্যা-লিখনপ্রণালি সবে পরিচিত হয়ে উঠছে। ‘শূন্য’ তখনো ঠিক তাদের সচেতন মনে ঠাঁই করে উঠতে পারেনি। গণিতের ঐতিহাসিকদের কারো কারো ধারণা, ফিবোনাচিই ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যাঁর হাতে করে আরবি গণিত এবং আরবি ‘শূন্য’ সগৌরবে পদার্পণ করে ইউরোপের মাটিতে, এবং স্থায়ীভাবে আসন করে নেয় ইউরোপের মনমানসে।

চিত্ৰঃ ফিবোনাচি

১২০২ সালে Liber Abaci (গণনাগ্রন্থ) নামক একটি পুস্তক প্রকাশ করেন ফিবোনাচি। তাতে অত্যন্ত হালকা মেজাজে একটা আপাত-তুচ্ছ সমস্যা দাঁড় করালেন তিনি। সমস্যাটি এরকম:

ধরুন এক কৃষক একজোড়া বাচ্চা খরগোশ কিনে এনেছে বাজার থেকে। ধরা যাক, খরগোশ প্রজাতির প্রজনন-প্রকৃতির ধারাটাই এরকম যে বাচ্চা অবস্থা থেকে পুরো দুমাস সময় লাগে তাদের প্রসব-যোগ্য বয়স হতে। এই দুমাস কেটে যাবার পর প্রতি মাসের প্রথম দিনটিতে তাদের একজোড়া সন্তান জন্মায়। এই সন্তান- জোড়াও দুমাস অপেক্ষা করার পর ঠিক একই নিয়মে প্রতি মাসে একজোড়া সন্তানের জন্ম দেয়। সমস্যাটি হলো এই: একটা নির্দিষ্ট-সংখ্যক মাস, ধরুন, n অতিক্রম করবার পর, n+1-তম মাসের প্রথমে তাহলে সর্বমোট কত জোড়া খরগোশের মালিক হলেন সেই কৃষক?

একটা ছেলেমানুষি মডেল, মানছি, কিন্তু এর একটা বিস্ময়কর সমাপ্তি আছে। গোনার কাজটি কিন্তু খুবই সহজ। প্রথম মাসে সংখ্যা ১। দ্বিতীয় মাসেও ১, কারণ উৎপাদন তো শুরু হয় দ্বিতীয় মাস শেষ হবার পর। তৃতীয় মাসের ১ তারিখে সংখ্যা দাঁড়ায় ২। তার পরের মাসে সন্তানেরা সাবালক হয়ে ওঠেনি বলে শুধু তাদেরই একজোড়া বাচ্চা হয়, সুতরাং মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩। তার পরের মাসে কিন্তু বাবা-মা এবং তাদের প্রথম সন্তানদ্বয়, দুয়েরই একজোড়া করে সন্তান জন্ম নেয়। তাহলে এবার সংখ্যা দাঁড়াল ৫। এভাবে হিসাব করে যে সংখ্যামালাটি অনায়াসেই উদ্ধার করে ফেলি আমরা সেটা হলোঃ

১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৫৫,….

এই ধারাবাহিক সংখ্যাগুলোর দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালে একটা সুশৃঙ্খল প্যাটার্ন ধরা দেবে যেকোনো আনাড়ি চোখেও। তৃতীয় সংখ্যা থেকে শুরু করে ডান দিকের প্রতিটি সংখ্যা তার পূর্ববর্তী সংখ্যা দুটির যোগফল। এই অবলোকনটি থেকে একটা গাণিতিক সূত্র লিখে ফেলা যায়, কী বলেন? x যদি হয় n -তম মাসের খরগোশ-জোড়ার সংখ্যা, তাহলে সেই সূত্রটি নিশ্চয়ই এরকমঃ

xn+1 = xn+xn-1

এখানে n -কে শুরু করতে হবে ১ থেকে, এবং ধরে নিতে হবে যে, x0 = 0, x1 = 0, সুতরাং x2 = 1, x3 = 2, x4 = 3, x5 = 5, ….,এই যে sequenceটি, বা অনুবর্তী রাশিমালা, এটি গণিত-জগতে বিশেষভাবে পরিচিত ফিবোনাচি সিকুয়েন্স নামে। আট শ বছর পর এখনো গণিত-বিশারদদের অনেকে এর ওপর কাজ করছেন, পেপার লিখছেন। এ এক আশ্চর্য রহস্যময় সংখ্যামালা। এত সহজ, এত সাদাসিধে, অথচ এত গভীর তার তাৎপর্য। এই তাৎপর্যের পরিসর অবিশ্বাস্য রকম বিস্তৃত। তার মাঝে একটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যাবে যদি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাই আনুবর্তিক সংখ্যাগুলোর দিকে। বাঁ থেকে ডান দিকে এগিয়ে চলুন। প্রতিটি সংখ্যাকে তার পূর্ববর্তী সংখ্যা দিয়ে ভাগ করুন। যেমন ৩/২=১.৫, ৮/৫=১.৬, ১৩/৮=১.৬২৫, ২১/১৩=১.৬১৫৩৮…, ৩৪/২১= ১.৬১৯০…। পরিচিত মনে হচ্ছে কি? এই অনুপাতটি যতই এগোবে ডান দিকে, একেবারে অন্তহীন মাত্রায়, ততই এটি একটি বিশেষ সংখ্যার নিকটে চলে যাবে। সেই সংখ্যাটি হলো পূর্ববর্ণিত ওই জাদুকরি সংখ্যাটিঃ ১.৬১৮…; পিথাগোরাসের সেই সুবর্ণ সংখ্যা যাকে ফাঁস করে দেওয়ার জন্য হতভাগ্য হিপসাসকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

আশ্চর্য, তাই না? শুধু তা-ই নয়, পণ্ডিতরা খুঁজে বের করেছেন যে অনেক প্রাণী আর উদ্ভিদের জীবনেও এই ফিবোনাচি রাশির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ যেন এক দৈব ডিজাইন। (এবিষয়ে বেশ কিছু সুপাঠ্য বই লেখা হয়েছে। কৌতূহলী পাঠক ইয়ান স্টুয়ার্টের Mathematics of Life গ্রন্থখানা পড়ে দেখতে পারেন) যারা দৈবতায় বিশ্বাস করেন না (যাঁদের মধ্যে এই বইয়ের দুই লেখকই আছে), তাঁদের কাছেও এ এক বিস্ময়কর রহস্য প্রকৃতির- যেন প্রজন্ম-বৃদ্ধির এই সহজ নিয়মটির সারল্যের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি তার নিজেরই সারল্য-প্রীতি প্রকাশ করেছে।

প্রকৃতির আইনকানুনের সঙ্গে যাঁরা মোটামুটি পরিচিত (অর্থাৎ সফল গবেষণাকর্মে লিপ্ত) তাঁরা অবশ্য অনেক আপাত-রহস্যেরই ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন, এবং অহরহ খুঁজে চলেছেন (এই অন্তহীন কৌতূহলই বিজ্ঞানীদের চালিকা শক্তির উৎস)। যেমন আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব। অভিকর্ষের ফর্মুলাটি 1/d2 র ২ হলো কেন, ৩ হলো না কেন, বা ২.১৭ বা অন্য কোনো সংখ্যা, সেটা ভাববার বিষয় বৈকি (উক্ত ফর্মুলাটিতে d হলো দুটি বস্তুর দূরত্ব, যেমন সূর্য এবং পৃথিবী।) মজার ব্যাপার যে এই একই ফর্মুলা প্রকৃতির আরো কয়েক জায়গায় কাজ করে, যেমন তাড়িতচৌম্বক ক্ষেত্রে। ফর্মুলার ২ সংখ্যাটি অন্য কোনো সংখ্যা হলে তার কী পরিণতি হতে পারত সেটা নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে- -গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সব প্রকারেরই। তাতে দেখা গেছে যে ২-এর অন্যথায় আমাদের বিশ্বপ্রকৃতির চেহারা একবারে ভিন্নরকম হতো, সম্ভবত এর স্থায়িত্ব নিয়েই নানারকম সমস্যা দেখা দিত। তার অর্থ, এই যে সহজ-সরল নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে প্রকৃতি তার একটুখানি উনিশ-বিশ হলে আমাদের অস্তিত্ব আর স্থিতি দুটিই বিপন্ন হয়ে পড়ত।

ফিবোনাচির উপরক্ত সূত্র বা সমীকরণটির সমাধান বের করা কিন্তু এমন কোনো শক্ত কাজ নয়। ধরুন সমাধানটি এরকমঃ

xn = tn , t

কোনো সংখ্যা, মূলদ-অমূলদ কিছু আসে যায় না। এই ধারণাকৃত সমাধানটি আসলেই উক্ত সমীকরণের শর্ত পালন করে কিনা তা যাচাই করতে হলে দেখতে হবে ওটাতে স্থাপন করার পর t ভিত্তিক কী সমীকরণটি বের হয়ে আসে। এটা অতি সহজেই প্রমাণ করা যায় যে সমীকরণটি হচ্ছেঃ

t2 – t – 1 = 0,

এর সমাধান কী করে বের করতে হয় সেটা তো আমাদের আগেই শেখা হয়ে গেছে আল-খোয়ারিজমি সাহেবের আবিষ্কার থেকে। এই সমাধান থেকেই চলে আসবে সেই বিপুল রহস্যে ভরা সংখ্যাটিঃ

(51/2 +1)/2=1.618….,

বিচিত্র এই বিশ্ব, তাই না?

এই অনুচ্ছেদের মূল প্রসঙ্গটি হলো ‘শূন্য’ ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর ‘অসীম’। ফিবোনাচি সূত্রে শূন্য হয়তো আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, যদিও প্রচ্ছন্নভাবে সেটা আছেও, কিন্তু অসীম তো একেবারে নাকের ডগায়। এই যে বলা হলো সংখ্যাগুলো (অর্থাৎ কৃষকের খরগোশের সংখ্যা) বেড়ে বেড়ে চলে যাচ্ছে অসীমের দিকে, সেখানেই তো ছিল গ্রিক চিন্তাবিদদের জুজুর ভয়। ফিবোনাচির রাশিতে অসীম (এবং পরোক্ষে শূন্য) দেখা দিতে পেরেছে বলেই পিথাগোরাসের সযত্নে লুক্কায়িত জুজু, সুবর্ণ অনুপাত, আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।

Liber Abaci ফিবোনাচির একমাত্র গ্রন্থ নয়। তাঁর আরেকটি গ্রন্থে ত্রিঘাতী সমীকরণ, যা কিনা ছিল ওমর খৈয়ামের প্রিয় বিষয়, তাঁর ওপর অনেক মূল্যবান গবেষণা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যেমনঃ

x3 + 2x2 + 10x = 20.

এটির কোনো মূলদ সমাধান থাকা যে সম্ভব নয়, এবং a+b 1/2 জাতীয় কোনো সংখ্যা, এধরনের আধুনিক গোছের মন্তব্যও তিনি রেখে গেছেন (উল্লেখ্য যে এখানে a এবং b উভয়কেই মূলদ সংখ্যা হতে হবে।)

 

মোনালিসার ছবিতে অঙ্ক ?

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের অন্ধকার ভালো করে কেটে ওঠেনি। উন্নততর আরব এবং ভারতবর্ষসহ দূরপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে নতুন নতুন আইডিয়ার বাতাস ভেসে এলেও প্রাচীন অ্যারিস্টটলিয়ান চিন্তাধারা তাদের বিজ্ঞান আর গণিতের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। ফিবোনাচির যুগান্তকারী আবিষ্কার আর আরব সংখ্যামালার প্রভাব তখনো প্রবেশ করেনি ইউরোপের গণমানসে, এমনকি বুদ্ধিজীবী মহলেও।

কিন্তু রক্ষণশীল সমাজের নানারকম বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সত্যিকার কোনো আকর্ষণীয় আইডিয়া যখন অঙ্কুরিত হয় কোনো দেশে তখন সেটা ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বেই কোনো-না-কোনোভাবে, চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করতে থাকবে চিন্তাশীল মানুষদের। সব বড় আইডিয়ারই ধর্ম সেটা। ‘শূন্য’ তেমনি এক বড় আইডিয়া। একে আর বেশিদিন চেপে রাখা সম্ভব হয়নি ইউরোপে। ধর্মযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসবার পর ‘শূন্যের’ আইডিয়াটি যে- সম্প্রদায়কে সবার আগে টেনে আনতে সক্ষম হয় সেটা ছিল যাঁরা ছবি আঁকতেন——–পেশাজীবী না হলেও শখের শিল্পী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন চার্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (সেকালে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলতে সাধারণত তাই বোঝাত, ল্যাটিন ভাষা-জ্ঞানসম্পন্ন পাদ্রি বা সাধু বা ভিক্ষু বা ঐ-জাতীয় কোনো উপাধিযুক্ত পুরুষ)। ফিলিপো ব্রুনেলিসি (১৩৭৭-১৪৪৬) ছিলেন তেমনি এক মননশীল ইতালিয়ান বুদ্ধিজীবী যিনি পেশাতে ছিলেন স্থপতি, নেশাতে শিল্পী, চিন্তায় গাণিতিক। এক বিরল ব্যতিক্রম সেকালের, যাঁর সঙ্গে চার্চের কোনো সরাসরি সম্পর্ক ছিল না, তবে চার্চের জন্য ছবি আঁকতেন। ১৪২৫ সালে তাঁর আঁকা ছবি, যা পরবর্তীকালে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে, সেটা এখনো ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে নামকরা চার্চের দেয়ালে সগৌরবে বোদ্ধা দর্শকদের চিত্তরঞ্জন করে চলেছে। ছবিটির বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শূন্যের বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষতার পর্দায় তুলে নিয়ে আসা। তাঁর আগে অঙ্কন-শিল্পের কোনো জীবন ছিল না- নিষ্প্রাণ সমতল ভূমিতে শবদেহের মতো ছিল তাঁদের ছবি। ব্রুনেলিসি শূন্যের সাহায্যে তাতে একটা তৃতীয় মাত্রা যোগ করে দিলেন। শিল্প জীবন্ত হয়ে উঠল। জন্ম নিল ‘পার্সপেক্টিভ’ নামক এক নতুন আইডিয়া। দ্বিমাত্রিক পটে তিনি প্রবেশ করালেন ত্রিমাত্রিক বাস্তবতাকে। শূন্য আর অসীম তাতে হাত মিলিয়ে দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দিল, মনকে তুলে নিল লোক থেকে লোকান্তরে।

চিত্রঃ ব্রুনেলিসি এবং তাঁর আঁকা ছবি

সে ছবি ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের প্রত্যুষকালের এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। ব্রুনেলিসির উত্তরসূরি ছিলেন আরেক বিশিষ্ট ইতালিয়ান, রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান কর্ণধার, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫০৯)। ভিঞ্চি ব্রুনেলিসির কাজ দ্বারা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কৈশোর আর যৌবনে। রীতিমতো একটা বই লিখে ফেলেছিলেন ‘পার্সপেক্টিভ’ বিষয়টির ওপর। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নাম শোনেনি এমন কোনো শিক্ষিত লোক পৃথিবীর কোথাও আছে কি না জানি না। জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনাতে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হলে আর কোথাও যেতে হবে না, ভিঞ্চির দুয়েকটা কাজের কথা শুনলেই যথেষ্ট। তাঁর মতো শতমুখী প্রতিভার মানুষ ইতিহাসে কখনো জন্মেছে কিনা সন্দেহ। তাঁকে বলা হয় ‘সব জিনিয়াসের সেরা জিনিয়াস’। কিংবদন্তীয় শুধু নয়, অবিশ্বাস্য, অপার্থিব, অসামান্য প্রতিভা। সাধারণ লোক তাঁর নাম শুনেছে ‘মোনালিসা’র শিল্পী হিসেবে।

চিত্রঃ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং তাঁর অনন্য শিল্পকর্ম ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান'।

কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র যে শিল্পের বাইরে কত অসংখ্য পথে বিস্তৃত ছিল—গণিত, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশল, বিমান নির্মাণ, শারীরবিজ্ঞান, বিশেষ করে মানবদেহের অভ্যন্তরীণ জগতের যাবতীয় রহস্য, যা বর্তমান যুগের মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীরা হিউম্যান অ্যানাটমি বলে জানে (সে খবর হয়তো সবার জানা নয়)। আমাদের বিশেষ অনুরোধ বাঙালি পাঠকদের কাছে তাঁরা যেন আগ্রহ করে এই লোকটার জীবনী পড়ার চেষ্টা করেন।

যা-ই হোক, আজকের প্রসঙ্গে যা বলতে চাচ্ছি তা হলো ভিঞ্চি কী ধারণা পোষণ করতেন অঙ্ক আর শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন এক জায়গায়ঃ ‘আমার কাজ যদি ভালো করে বুঝতে চায় কেউ তাহলে সে যেন অঙ্কের জ্ঞান ছাড়া বুঝতে চেষ্টা না করে’। ইউরোপের মধ্যযুগে গণিত আর অঙ্কন-শিল্প ছিল একই জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ। অনেকটা প্রাচীন গ্রিকদের মতো, যাঁরা বিশ্বাস করতেন যে গণিত আর দর্শন প্রায় সমার্থক শব্দ।

যেহেতু ব্রুনেলিসির ছবিতে শূন্যের উপস্থিতি ছিল প্রায় আক্ষরিকভাবেই, এবং সেই শূন্যই প্রকারান্তরে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল অনন্ত অসীমতার, প্রধানত সেই কারণেই, এবং আনুষঙ্গিক আরো কিছু কারণে চার্চের মন আস্তে আস্তে নরম হতে লাগল এ দু’টি অ্যারিস্টটল-বিরোধী আইডিয়ার প্রতি। ফলে চার্চ-সংশ্লিষ্ট আরো কিছু গুণীজন সাহস করে এগিয়ে এলেন তাঁদের নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে। ব্রুনেলিসির সমসাময়িক এক চার্চনেতা, কুসা শহরের জনৈক নিকোলাস, আকাশের নক্ষত্রমালার গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবার পর দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে “পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু নয়’। এবং সে মর্মে প্রকাশ্য ঘোষণাও দিয়ে ফেললেন। সেসময়কার মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী অত্যন্ত সাহসী, বৈপ্লবিক ও বিপজ্জনক ঘোষণা। কিন্তু এত বড় দুঃসাহসী ঘোষণা প্রচার হবার পরও চার্চের কোনো তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। ব্রুনেলিসির ছবি হয়তো চার্চকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল কিছুদিন। এরপর টেম্পিয়ার নামক আরেক ব্যক্তি বলে বসলেনঃ ‘ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান, যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। সুতরাং তিনি যদি চান তাহলে শূন্যতা থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন (এটিই হলো ইহুদি- খ্রিষ্টান-ইসলাম এই তিন আব্রাহামিক ধর্মের মূল বিশ্বাসের ভিত্তি), চাইলে অ্যারিস্টটলকেও ভুল প্রমাণিত করতে পারেন’। ভীষণ উদ্ধত উক্তি সন্দেহ নেই, কিছুদিন আগে বা কিছুদিন পরে হলেও অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হতো। চার্চ সেটা অগ্রাহ্য করে গেলেন। বিভোর ঘুম, নিঃসন্দেহে।

কুসার নিকোলাস কেবল ভূকেন্দ্রিক মতবাদের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি এ-ও বললেন যে, মহাবিশ্বে শুধু একটি নক্ষত্রমণ্ডল থাকবে কেন, কোটি কোটি, এমনকি অসংখ্য মণ্ডল থাকতেই বা বাধা কোথায় (পদার্থবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে আশ্চর্যরকম খাপ খেয়ে যায় এ ধারণা)। আমরা যেমন পৃথিবীতে বসে আকাশের তারাদের উজ্জ্বলতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, তেমনি অন্যান্য নক্ষত্রের অধিবাসীরাও হয়তো পৃথিবীর উজ্জ্বলতা দেখে একইভাবে মুগ্ধ হচ্ছে। তাহলে পৃথিবী কেন সবার থেকে আলাদা আসন পাবে সৃষ্টির মাঝে? পৃথিবী কেন হবে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু?

অসম্ভব বিপ্লবী কথাবার্তা। পঞ্চাশ বছর পর জন্মগ্রহণ করলে লোকটাকে নির্ঘাত শূলে চড়ানো হতো। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তার গতানুগতিক ক্ষমতার মোহাবিষ্টতায় এমনই বিভোর যে ক্ষুদ্র মানুষেরা তাদের ক্ষুদ্র চিন্তা নিয়ে কোথায় কী আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।

কুসার নিকোলাসের বলিষ্ঠ ঘোষণা বিস্মৃতির গহ্বরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই আরেক নিকোলাস উদয় হলেন ইউরোপের সদ্যজাগ্রত বিজ্ঞানজগতে – নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) নামক এক পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গাণিতিক। তখনকার ইউরোপে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় আসন ছিল পোল্যান্ডের। গণিত ও বিজ্ঞানের স্নায়ু-কেন্দ্র ছিল পোল্যান্ডের বিখ্যাত ক্র্যাকো বিশ্ববিদ্যালয়। কোপার্নিকাস তাঁর গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক যাবতীয় জ্ঞানলাভ করেন প্রধানত সেখানেই। তাঁর পাণ্ডিত্য কেবল গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানেই ছিল তা নয়, আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র—এসব বিষয়েও ছিল তাঁর বিশেষ বুৎপত্তি। তিনি কুসার নিকোলাস-প্রবর্তিত ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিলেন তাঁর নিজস্ব তত্ত্ব দ্বারা—আমাদের সৌরমণ্ডলে সূর্যই একমাত্র নক্ষত্র যা তার নিজের অবস্থানে স্থির দাঁড়িয়ে আছে, এবং পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ তার চারপাশে নিজ নিজ বৃত্তপথে প্রদক্ষিণ করছে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলার সঙ্গে। তাঁর এই দুঃসাহসী তত্ত্বটি এককথায় সম্পূর্ণ উৎখাত করে দেয় টলেমি, পিথাগোরাস আর অ্যারিস্টটলের বহুদিনের সযত্নে লালিত ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে। যে বছর তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব- সংবলিত গ্রন্থ (১৫৪৩) প্রকাশ লাভ করে ঠিক সে বছরই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ভাগ্যবান লোক। নইলে কপালে অনেক দুঃখ ছিল।

প্রায় একই সময় আরো দু-চারটে অলক্ষুনে ঘটনা ঘটে ইউরোপে যাতে রোমের ধর্মীয় সিংহাসন একটু কেঁপে উঠতে শুরু করে। প্রথম বড় ধাক্কাটা আসে তাদের নিজেদেরই এক পাদ্রির কাছ থেকে মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) নামক এক ‘কুলাঙ্গার’। জার্মানির আইলবোনে তাঁর জন্ম, ১৫০৭ সালে অগাস্টানিয়ান মনাস্টারি থেকে তাঁর সন্ন্যাসত্ব প্রাপ্তি, এবং তার বছর পাঁচেক পর উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের ফলে বাইবেল-বিষয়ক শাস্ত্রাদিতে অধ্যাপনার পদে নিযুক্তি।

চিত্রঃ নিকোলাস কোপার্নিকাস

অধ্যাপনা-জীবনের প্রথম চারবছর তাঁর কেটেছিল বহু অন্তর্দ্বন্দ্ব আর প্রশ্ন- জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে, চরম মানসিক বিবর্তন ও মৌলিক সংশয়-চিন্তায়। তাঁর মন বুঝতে চেষ্টা করে বিশ্বজগতে ঈশ্বরের যথার্থ প্রকৃতি কী, কিই বা চার্চের ভূমিকা, কেন মানুষের জীবন এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা চার্চের সীমাহীন বিধিনিষেধের বেড়াজালে, সেসব প্রশ্নও। ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা আর ক্যাথলিক চার্চের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল ক্রমেই। সাথে সাথে আরো একটি যন্ত্রণার মধ্যে আজীবন বন্দী ছিলেন তিনি—কোষ্ঠকাঠিন্য। হাসি পাবে জানি, কিন্তু সমস্যাটি এতই গুরুতর ছিল তাঁর বেলায় যে মার্টিন লুথারকে নিয়ে যত বই-পুস্তক লেখা হয়েছে এযাবৎ তার প্রায় প্রতিটিতেই এই সমস্যাটির উল্লেখ আছে। এমনও দাবি করেন কোনো কোনো লেখক যে লুথারের বড় বড় আইডিয়াগুলো শৌচাগারের নির্জনতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার সময়ই মাথায় উদয় হয়। যা-ই হোক, তিনি তাঁর সংশয়ী মনের নানা প্রশ্নকে কিছুতেই নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারেননি। ১৫১৭ সালে উইটেনবার্গের চার্চে একদিন প্রকাশ্যে রোমের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ একে একে লিপিবদ্ধ করে প্রচার করে দিলেন। অর্থাৎ চার্চের কৃষ্ণ-বেড়াল তখন থলের অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভ করে বহিরাঙ্গনে আবির্ভূত। সে ধাক্কার জের সামলাতে না সামলাতেই ইংল্যান্ডে লেগে গেল আরেক ফ্যাকড়া——বিয়েপাগলা রাজা অষ্টম হেনরি ১৫৩০ সালে পোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেই একটি আলাদা ধর্ম সৃষ্টি করে ফেললেন, এবং সে ধর্মের প্রধান নিযুক্ত করলেন নিজেকেই। এর নাম হলো চার্চ অব ইংল্যান্ড। পরপর দুটি বড় বড় ‘ধর্মবিরোধী’ ঘটনা ঘটে যাওয়াতে চার্চকে এবার নড়েচড়ে বসতে হলো। আর চুপ করে থাকা যায় না।

বলতে গেলে চার্চের শক্তহস্ত দমননীতি শুরু হয়ে গেল ১৫৪৩-এর অব্যবহিত পরই। কোপার্নিকাস মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন। বাঁচেননি বেচারা জিয়োর্দিনো ব্রুনো।

 

চার্চের রোষবহ্নি

ব্রুনো ছিলেন ডমিনিকান মতবাদী (১২১৫ সালে সেন্ট ডমিনিক প্রতিষ্ঠিত একটি ক্যাথলিক ধর্মগোষ্ঠী) ধর্মযাজক। পেশা ও বিশ্বাসে ধর্মগতপ্রাণ হলেও বুদ্ধি ও চিন্তার জগতে তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, জ্ঞানপিপাসু মানুষ, যাঁর নৈতিক আনুগত্য গির্জার প্রতি থাকলেও বৌদ্ধিক আনুগত্য ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি। ষোড়শ শতাব্দীর আশির দশকে তিনি On the Infinite Universe and Worlds নাম দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। নাম থেকেই বোঝা যায়, সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে লোকটার চিন্তাভাবনা কতখানি প্রগতিশীল ছিল, এবং কত দুঃসাহসী। একে তো তিনি বিশ্বজগৎকে infinite, অর্থাৎ সীমাহীন বলছেন, যা প্রচলিত অ্যারিস্টটলিয়ান মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তার ওপর বলছেন worlds- একটাদুটো নয়, অসংখ্য পৃথিবী। তার অর্থ আমাদের এই অতিপরিচিত বিশ্বস্ত পৃথিবীটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু তো নয়ই, আমাদেরটির মতো আরো বহু বিশ্ব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা মহাকাশব্যাপী, হয়তোবা অগণিত সংখ্যায়।

আরো একটি মারাত্মক জিনিস ছিল গ্রন্থটিতে—কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করা। এটা ছোটখাটো বেয়াদবি নয়, রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণার শামিল। ব্রুনো ভালো করেই জানতেন, ১৫৪৩-এর পর থেকে কতটা কড়াকড়ি হতে শুরু করেছেন ইঙ্কুইজিশনের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ইতালিতে, যেখানে চার্চের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। কোপার্নিকাসের মৃত্যুর পরপরই তাঁর বই বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, এবং সে বই থেকে সংগৃহীত কোনো তথ্য বা তত্ত্ব ব্যবহার করাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়। ভালো করেই জানতেন তিনি ইস্কুইজিশনের ভয়ংকর জল্লাদ-বাহিনী কতখানি তৎপর হয়ে উঠেছে তাঁর মতো “আইন ভঙ্গকারী”দের নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। কিন্তু লোকটার বুকে ছিল ভয়ানক সাহস, ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। যা তিনি সত্য বলে জানতেন, প্রাণের ভয়ে তাকে চেপে রাখার কোনো যুক্তি তিনি মানতে রাজি ছিলেন না। চার্চের তরফ থেকে এক বিচারের প্রহসনে ব্রুনোকে অগ্নিদগ্ধ করে মারার রায় দেওয়া হয়। আগুনে পোড়ানোর আগ পর্যন্ত চার্চ থেকে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল যেন তিনি কোপার্নিকাসের ভুল মতবাদ পরিত্যাগ করে বাইবেলের বিশ্বাসের সাথে সংগতিপূর্ণ ‘পৃথিবী-কেন্দ্রিক’ মতবাদকে সত্য বলে মেনে নেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতি অবিচল ব্রুনো ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরং বিচারকের দিকে তাকিয়ে নিরুত্তাপ গলায় ব্রুনো বলেছিলেন, ‘বিচারপতি, মনে হচ্ছে আমার চেয়ে আপনিই অধিকতর ভীত হয়ে এই বিচারের রায় উচ্চারণ করছেন’। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই অসমসাহসী বীর বিদ্রোহীকে সত্য ও যুক্তির সপক্ষে নিরাপস অবস্থান রাখার অপরাধে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করা হয়।

চিত্রঃ ‘বিচারপতি, মনে হচ্ছে আমার চেয়ে আপনিই অধিকতর ভীত হয়ে এই বিচারের রায় উচ্চারণ করছেন'।

‘Perhaps you, my judges, pronounce this sentence upon me with greater fear than I receive it.’ Giordano Bruno (1548 February 17 1600 )

ব্রুনোর এই ভয়াবহ পরিণতির খবর পেয়ে তৎকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি এমন ঘাবড়ে গেলেন যে কোপার্নিকাস তত্ত্বের নির্ভুলতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে সেটা প্রচার করায় বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কী মতামত সেটা কারোরই অজানা ছিল না। চার্চের রোষবহ্নি থেকে ছাড়া পাওয়া তাঁর সম্ভব হয়নি শেষ পর্যন্ত। একদিন কার্ডিনাল বেলার্মিন নিজে তাঁকে ডেকে হুঁশিয়ার করে দিলেন যাতে এসব বাজে মতামত প্রকাশ করা বন্ধ করেন। মনে মনে যা-ই ভাবুন বাইরে যেন কাকপক্ষী কেউ টের না পায় গ্যালিলিও কী ভাবছেন। তাহলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে।

চিত্রঃ গ্যালিলিও গ্যালিলি

কার্ডিনাল ম্যাটিও বার্বেলিনি ছিলেন একজন অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল পাদ্রি। এবং গ্যালিলির দারুণ ভক্ত ও ব্যক্তিগত বন্ধু। সৌভাগ্যবশত কার্ডিনাল বার্বেলিনি অষ্টম আর্বান নাম ধারণ করে পোপ হয়ে এলেন রোমে। বন্ধুর পোপ নিযুক্ত হওয়া দেখে গ্যালিলিও একটু ভরসা পেলেন বুকে হয়তো বিপদ কেটে গেল এবার। সেই ভরসাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলবেন—এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। বই প্রকাশ করতে চার্চের অনুমতি নিতে হতো। ভাবলেন, বন্ধু যেখানে সর্বেসর্বা সেখানে অনুমতি আটকাবে কে। কিন্তু দেখা গেল, চার্চের স্বার্থ যেখানে সেখানে বন্ধুত্বের খুব মূল্য নেই। অনুমতি পেলেন না। তাতে দমে গেলেন খানিক, কিন্তু একেবারে নিরুৎসাহ হলেন না। ঠিক আছে, রোমে হলো না, অন্যত্র হবে। শেষ পর্যন্ত ফ্লোরেন্সের চার্চ থেকে প্রকাশের অনুমতি পাওয়া গেল, ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। বই বেরোল দীর্ঘ শিরোনামে ‘টলেমীয় এবং কোপার্নিকান – দুটি প্রধান বিশ্বজগৎ-সম্পর্কিত কথোপকথন’। সাথে সাথে বেজে উঠল বিপদের শিঙা।

ফ্লোরেন্সের সাধারণ চার্চ তাঁকে প্রকাশের অনুমতি দিলেও ইঙ্কুইজিশনের পাদ্রিদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল তাঁর গ্রন্থটি। তাঁরা বললেন, ঠিক আছে, বই বেরিয়ে গেছে, কিছু করা যাবে না, কিন্তু খবরদার, বইটা যেন প্রচার না হয় কোনোভাবে, যেন কোনো ক্রেতার হাতে না পড়ে, কোনো বাইরের লোকের চোখ না পড়ে তাতে। ব্যাপারটা সেখানেই চুকে গেল না কিন্তু। এবার এল স্বয়ং রোমের ইস্কুইজেশন। তাঁরা সমন পাঠালেন গ্যালিলিকে চার্চের আদালতে হাজিরা দেওয়ার জন্য। ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন তিনি আসামির কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে কঠিন জেরার সম্মুখীন হলেন। চার্চের বিচারে সাব্যস্ত হলো যে তাঁর গুরুতর অপরাধের সুযোগ্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তবে সেটা মকুব করে গৃহবন্দিত্বের সাজায় নামানো যেতে পারে যদি তিনি নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন চার্চের বিচারকবৃন্দের কাছে, এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে এসব বেআইনি কথাবার্তা জীবনে আর কখনো উচ্চারণ করবেন না। প্রাণের দায়ে ঠিক তা-ই করলেন গ্যালিলিও। সেই যে বন্দী হয়ে থাকলেন ১৬৩৩ সাল থেকে, সেই বন্দিদশাতেই ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই মহাপুরুষ নয় বছর পর।

জিয়োর্দিনো ব্রুনো আর গ্যালিলিও গ্যালিলির করুণ কাহিনি সেকালের খ্রিষ্টধর্মের করুণা ও ক্ষমার আদর্শের চেয়ে বরং মধ্যযুগের পৈশাচিক রূপটাই বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছিল। দুঃখের বিষয় যে কোনো কোনো ধর্মের সেই পৈশাচিক রূপ আজকের অত্যাধুনিক যান্ত্রিক যুগেও নির্মূল হয়ে যায়নি।

সৌভাগ্যবশত যা সত্য ও শাশ্বত, যা স্বচ্ছ, সুন্দর ও পবিত্র তাকে অগ্নি, অস্ত্র আর বাহুবল, কোনোকিছু দিয়েই দমিয়ে রাখা যায় না বেশি দিন। শত আবর্জনার স্তূপ থেকেও বুনোফুল একসময় বের হয়ে আসে সূর্যের পিপাসায়। আলোর পুণ্যধারাতে অবগাহনই প্রাণের প্রকৃতি। ইঙ্কুইজিশনের শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব ইউরোপের বুদ্ধি-জগতে সাড়া সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, শতদলে প্রস্ফুটিত হয়ে নানা বর্ণে নানা পত্রপুষ্পে বিস্তৃত হতে শুরু করে।

চিত্রঃ আইজ্যাক নিউটন

মধ্যযুগের ইতালিতে ধর্মের কৃপাণ যখন বিজ্ঞান আর গণিতের মুণ্ডচ্ছেদের যজ্ঞানুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত, ইউরোপের অন্যত্র তখন রেনেসাঁর অগ্নিশিখা অনির্বাণ উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে। পোল্যান্ডের কোপার্নিকাস যে আলোর বর্তিকা নিয়ে এলেন ইউরোপে, সেই আলোর পুণ্যধারাতে সিক্ত হয়ে জার্মানির ইওহান কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) বেরিয়ে এলেন তার চেয়েও গূঢ়তর বাণী নিয়ে। কোপার্নিকাস শুধু বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে বৃত্তাকার পথে, কেপলার তাঁর দুরবিন দিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন: না, ঠিক বৃত্ত নয়, উপবৃত্ত (ellipse)। তিনি আরো বললেন যে, সূর্য থেকে পৃথিবী বা অন্য যেকোনো গ্রহ পর্যন্ত যদি একটি সরলরেখা কল্পনা করা যায় তাহলে সেই রেখাটি একই বেগে পরিক্রমণ করবে একই সমতল ক্ষেত্র। অর্থাৎ এই প্রদক্ষিণের আঞ্চলিক গতিবেগের কোনো পরিবর্তন নেই। কেপলারের তৃতীয় একটি সূত্র আছে যা বছরের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এই আঞ্চলিক গতির একটা সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। এই তিনটি সূত্রই আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায় প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে।

মজার ব্যাপার যে, সে সময় আইজ্যাক নিউটনের যুগান্তকারী অভিকর্ষ তত্ত্ব কারো জানা না থাকলেও কেপলারের তত্ত্ব থেকেই উদ্ধার করা সম্ভব যে পৃথিবী ও সূর্যের ভেতরে একটা আকর্ষণের ব্যাপার আছে এবং সেটা বিপরীত দূরত্ববর্গের সূত্র পালন করে। কিন্তু এই আকর্ষণটি যে একটি সর্বজনীন প্রাকৃতিক নিয়ম, এবং তা শুধু সৌরমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডজুড়েই তার বিস্তার, সেই বিপুল অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। এবং সেই অসামান্য দূরদর্শী পদক্ষেপটি তিনি নিয়েছিলেন কোনো দুরবিন বা অন্য কোনো যন্ত্রের সাহায্যে নয়, গণিতের সাহায্যে। এবং সে গণিত ছিল তাঁর নিজেরই উদ্ভাবিত গণিত। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী বাগানে আপেল পতনের দৃশ্য থেকেই সেই দিব্যজ্ঞান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মনে যে আপেলটি ওপরে না গিয়ে নিচে নেমেছে, তার কারণ বিশ্বপৃষ্ঠ তাকে টেনে নিয়েছে বিপরীত দূরত্ববর্গের নিয়ম অনুসারে। সব গল্প সব সময় সত্য হয় না, এ গল্পও হয়তো কেবল গল্পই। তবে এটা সত্য যে পৃথিবীর বড় বড় আবিষ্কারগুলোর বেশির ভাগেরই প্রায় একই ইতিহাস—হঠাৎ, দৈববাণীর মতো উদয় হয় সাধকের মনে হয়তো বাগানে, গোসল করতে গিয়ে, কিংবা খেলার মাঠে। এমনকি টয়লেটে বসেও মহান দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন অনেকে, যেমন মার্টিন লুথার। আইজ্যাক নিউটন এই একটি কাজ ছাড়া আর কোনো বড় কাজ যদি না-ও করতেন তাহলেও তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব ছিল তাঁর অসংখ্য যুগান্তকারী সৃষ্টির অন্যতম মাত্র। গণিত-জগতে তিনি বিশেষভাবে খ্যাত ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে, যদিও ওটা নিয়ে খানিক বিতর্ক আছে। সত্যি সত্যি নিউটন এর প্রথম আবিষ্কারক, না জার্মানির গটফ্রিড উইলেম লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬), সে নিয়ে এক বিরাট ঝগড়া ব্রিটেন আর বাদবাকি ইউরোপের মধ্যে। ব্রিটেন বলে নিউটন, ইউরোপ বলে লিবনিজ। এই বিতর্ক বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দুই দলকে বিভক্ত করে রেখেছে, যার পরিণতি ইউরোপের চাইতে ব্রিটেনের জন্যই হয়েছে বেশি ক্ষতিকর। সৌভাগ্যবশত উভয়পক্ষেরই এখন মাথা ঠান্ডা হয়েছে খানিক, ফলে দুই দেশেই গণিত-সাধনায় এসেছে নবজীবনের প্রাণোচ্ছ্বাস।

 

গ্যালিলিওর বিচার

১৬৩৩ সাল। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে – বাইবেলবিরোধী এই সত্য কথা বলার অপরাধে চার্চ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করল ‘ধর্মদ্রোহিতার’ অভিযোগে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক —পৃথিবী স্থির অনড় সৌরজগতের কেন্দ্রে’। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তা-ই করলেন। পোপ

4 পবিত্র বাইবেলে আছে,

ও ধর্মসংস্থার সম্মুখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞানসাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞানসাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিলঃ

আমি ফ্লোরেন্সবাসী স্বর্গীয় ভিন্সেঞ্জিও গ্যালিলিওর পুত্র, সত্তর বছর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলি সশরীরে বিচারার্থ আনীত হয়ে এবং অতি প্রখ্যাত ও সম্মানার্হ ধর্মযাজকদের (কার্ডিনাল) ও নিখিল খ্রিষ্টীয় সাধারণতন্ত্রে ধর্মবিরুদ্ধ আচরণজনিত অপরাধের সাধারণ বিচারপতিগণের সম্মুখে নতজানু হয়ে স্বহস্তে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শপূর্বক শপথ করছি যে, রোমের পবিত্র ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম সংস্থার দ্বারা যা কিছু শিক্ষাদান ও প্রচার করা হয়েছে ও যা কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে, আমি তা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি, এখনো করি এবং ঈশ্বরের সহায়তা পেলে ভবিষ্যতেও করব। সূর্য কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও নিশ্চল এরূপ মিথ্যা অভিমত যে কিরূপ শাস্ত্রবিরোধী সেসব বিষয় আমাকে অবহিত করা হয়েছিল; এ মিথ্যা মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে এর সমর্থন ও শিক্ষাদান থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত থাকতে আমি এই পবিত্র ধর্মসংস্থা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে একই নিন্দিত ও পরিত্যক্ত মতবাদ আলোচনা করে ও কোনো সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে সেই মতবাদের সমর্থনে জোরালো যুক্তিতর্কের অবতারণা করে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করেছি; এজন্য গভীর সন্দেহ এই যে আমি খ্রিষ্টধর্মবিরূদ্ধ মত পোষণ করে থাকি। … অতএব সংগত কারণে আমার প্রতি আরোপিত এই অতিঘোর সন্দেহ ধর্মাবতারদের ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকের মন হতে দূর করবার উদ্দেশ্যে সরল অন্তঃকরণে ও অকপট বিশ্বাসে শপথ করে বলছি যে পূর্বোক্ত ভ্রান্ত ও ধর্মবিরুদ্ধ মত আমি ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি।

‘আর জগত্ত অটল—তা বিচলিত হবে না’ (ক্রনিকলস ১৬/৩০)

‘জগত্ত সুস্থির, তা নড়াচড়া করবে না।’ (সাম ৯৩/১)

‘তিনি পৃথিবীকে অনড় ও অচল করেছেন’ (সাম ৯৬/১০)

‘তিনি পৃথিবীকে এর ভিত্তিমূলের ওপর স্থাপন করেছেন, তা কখনো বিচলিত হবে না’ (সাম ১০৪/৫) ইত্যাদি।

5 অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৬

…আমি শপথ করে বলছি যে, আমার ওপর এজাতীয় সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে,এরূপ কোনো বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আর কখনো কিছু বলব না বা লিখব না। এরূপ অবিশ্বাসীর কথা জানতে পারলে অথবা কারও ওপর ধর্মবিরুদ্ধ মতবাদ পোষণের সন্দেহ উপস্থিত হলে পবিত্র ধর্মসংস্থার নিকট অথবা যেখানে অবস্থান করব সেখানকার বিচারকের নিকট আমি তা জ্ঞাপন করব। শপথ নিয়ে আমি আরও প্রতিজ্ঞা করছি যে,এই পবিত্র ধর্মসংস্থা আমার ওপর যেসব প্রায়শ্চিত্তের নির্দেশ প্রদান করবে আমি তা হুবহু পালন করব। এসব প্রতিজ্ঞা ও শপথের যেকোনো একটি যদি ভঙ্গ করি তাহলে শপথ ভঙ্গকারীর জন্য ধর্মাধিকরণের পবিত্র অনুশাসনে এবং সাধারণ অথবা বিশেষ আইনে যেসব নির্যাতন ও শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব। অতএব, ঈশ্বর ও যেসব পবিত্র গ্রন্থ আমি স্পর্শ করে আছি, এঁরা আমার সহায় হোন। আমি ওপরে কথিত গ্যালিলিও গ্যালিলি শপথ গ্রহণ ও প্রতিজ্ঞা করলাম এবং নিজেকে উপর্যুক্তভাবে বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে প্রতিশ্রুত হলাম। এর সাক্ষ্য হিসেবে স্বহস্ত-লিখিত শপথনামা যার প্রতিটি অক্ষর এইমাত্র আপনাদের পাঠ করে শুনিয়েছি তা আপনাদের নিকট সমর্পণ করছি। (২২ জুন, ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দ, রোমের মিনার্ভা কনভেন্ট)।

শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ- জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন- ‘তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরীণ অবস্থায়। শুধু গ্যালিলিওকে অন্তরীন করে নির্যাতন তো নয়, ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারল ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরও কি সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?

কথিত আছে যে নিউটনের পর্বতপ্রমাণ কর্মকাণ্ডগণিত, পদার্থবিজ্ঞানের একাধিক শাখা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তার অধিকাংশ কাজই তিনি করেছিলেন ১৬৬৫ আর ১৬৬৭, এই দুটি বছরের মধ্যে, যখন ব্রিটেনব্যাপী এক ভয়াবহ মহামারির কারণে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দু’বছর বন্ধ থাকাকালে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিরিবিলি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স তেইশ থেকে পঁচিশ।

এই দুই বছরের ভেতর তিনি ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন, অভিকর্ষ তত্ত্ব, শক্তিশালী দুরবীন ও আলোকরশ্মিবিষয়ক আরো অনেক মৌলিক তথ্য, বলবিদ্যার মৌলিক সূত্রাবলি (বস্তুর ভর ও ত্বরণের গুণফল যে গতির চালিকা শক্তির সঙ্গে আনুপাতিকভাবে সম্পর্কিত, এ তথ্যটি তাঁর গতিতত্ত্বের তিন সূত্রের দ্বিতীয় সূত্র নামে খ্যাত), সবই সেই দুটি অবিশ্বাস্য বছরের ফসল। নিউটন সম্বন্ধে আইনস্টাইনসহ অনেক বড় বড় মনীষী এমন মন্তব্য করেছেন যে তিনি প্রকৃতির আজ্ঞাবহ ছিলেন না, বরং উল্টোটাই সত্য ছিল তাঁর বেলায়। প্রকৃতি যেন নিউটনের কাছে এসে তার সব রহস্য উজাড় করে দিয়েছিল। প্রকৃতি ছিল তাঁর পোষা জীব। এজন্যই ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি মানুষই নিউটনের অনন্যসাধারণ প্রতিভায় ছিলেন বিস্মিত, অবিশ্বাসের ঘোরে আচ্ছন্ন। নিউটন সাধারণ রক্তমাংসে গড়া মানুষ ছিলেন না।

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, নিউটনের কাজের সঙ্গে শূন্যের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে। কতটা আছে সেটা হয়তো নিউটন নিজেও অতটা বুঝতে পারেননি সে সময়, কারণ তাঁর ক্যালকুলাসের ভেতরেই যে সূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে ছিল শূন্য, সেটা পরিষ্কার হতে আরো অনেক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিজ্ঞানজগৎকে। সে প্রসঙ্গ পরে আলোচনা করব আমরা। এখানে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে সম্পর্কটি দার্শনিক না হলেও বৈজ্ঞানিক তো অবশ্যই। দুটি বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণ, সেটা কেন্দ্রিক, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় central force, সেই ‘কেন্দ্র’ শব্দটিতেই আছে ‘শূন্যে’র আভাস। কেন্দ্র একটি বিন্দু যার কোনো মাত্রা নেই, যা সাংখ্য-গাণিতিক ‘শূন্যের’ই জ্যামিতিক রূপায়ণ। সেই বিন্দু ইউক্লিডের কাজে ছিল, গ্রিসের ‘শূন্য’বিদ্বেষী পণ্ডিতদের কাজেও ছিল প্রচ্ছন্নভাবে, কিন্তু তাঁরা তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি তাঁদের দর্শনের সঙ্গে সংঘাত ঘটার কারণে। নিউটনের দর্শনে অবশ্য সমস্যাটি ছিল না। তিনি ধার্মিক ছিলেন বটে, কিন্তু শূন্য আছে কি নেই সে প্রশ্ন তাঁর বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেনি।

 

দর্শন কি অঙ্ক বোঝে?

নিউটনের জন্ম যে বছর, সে বছর ইউরোপের আরেক যুগস্রষ্টা পুরুষ, ফ্রান্সের রেনে ডেকার্ট ৪৬ বছর বয়সে পা দিলেন। তাঁর দর্শন ও গণিতের ভক্ত তখন সারা ইউরোপ জুড়ে। আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের জনক বলে ভাবা হয় তাঁকে। দর্শনের ব্যাকরণ ও রচনাপ্রণালি তাঁরই হাতে গড়া। কিন্তু তাঁর অমরত্ব যদি দর্শনশাস্ত্রে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত না-ও হয়ে থাকে, তাঁর গণিতের কাজ তাঁকে চিরঞ্জীব করে রাখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গণিতের প্রাচীন দুটি শাখা— জ্যামিতি ও বীজগণিত এ দুটিকে একসাথে যুক্ত করে একটি নতুন শাখা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এর নাম Coordinate Geometry; বাংলা অভিধান অনুযায়ী বৈশ্লেষিক জ্যামিতি। জ্যামিতির সঙ্গে মানুষের পরিচয় আদিযুগ থেকে, সেই মিশরীয় সভ্যতার সময়ই জ্যামিতির জন্ম। কিন্তু বীজগণিতের প্রথম অঙ্কুর সম্ভবত গজায় ভারতবর্ষে, তারপর তা পূর্ণতা পায় আরবের আল-খোয়ারিজমির হাতে। সেটা ঘটে মধ্যযুগের প্রাক্কালে। তখন কারো পরিষ্কার ধারণা ছিল না যে দুটি আপাত-বিচ্ছিন্ন শাখার মধ্যে কোনো সরাসরি সম্পর্ক থাকতে পারে। জ্যামিতির প্রধান বাহক হলো ছবি, রেখাচিত্র (figures), আর বীজগণিতের ভাষা হলো সংখ্যা -১,২,৩,…, a,b,c,…….ইত্যাদি। একটা ত্রিভুজের সঙ্গে এগুলোর কী সম্পর্ক থাকতে পারে? ডেকার্ট দেখিয়ে দিলেন যে গণিতের সংখ্যা দিয়েই ত্রিভুজ করা যায়, আঁকবার দরকার হয় না। দুটিকে এভাবে জোড়া লাগিয়ে নতুন একটা শাখা তৈরি করাতে মৌলিক যে জিনিসটা ব্যবহার করতে হয়েছিল তাঁকে সেটা হলো ‘শূন্য’। ধরুন একটা দ্বিমাত্রিক সমতল। সেখানে একটা বিন্দু স্থাপন করা দরকার যেখান থেকে দূরত্ব গণনা করা হবে সরাসরি ডানে, বামে বা সরাসরি ঊর্ধ্বে, নিচে, অর্থাৎ আনুভূমিক (horizontal),অথবা উল্লম্ব (vertical) রেখা। সেই বিন্দুটিকে বলা হয় মূল (origin), এবং তা প্রকাশ করা হয় এভাবে: (0,0) । ত্রিমাত্রিক ঘনক্ষেত্রে তা হবে (0,0,0)। যতই মাত্রা বাড়বে ততই বাড়বে শূন্যের সংখ্যা। এভাবে ‘শূন্য’ তাঁর নতুন গণিতে অপরিহার্যভাবেই প্রবেশাধিকার অর্জন করে নিল। উদাহরণস্বরূপ (২,৪) এমন একটি বিন্দু যার দূরত্ব মূল থেকে দুই একাঙ্ক (unit) ডান দিকে, আর চার একাঙ্ক লম্বতে, সে একাঙ্ক একেক ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে ( ইঞ্চি বা সেন্টিমিটার, মিলিমিটার ইত্যাদি)। ডেকার্টের নতুন তত্ত্ব অনুযায়ী একটা সরলরেখাকে বর্ণনা করা যায় এভাবেঃ

ax + by = c,

যেখানে a,b,c হলো তিনটি পূর্বনির্ধারিত সংখ্যা যার কোনো পরিবর্তন হয় না রেখাটির একবিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে। এগুলোকে বলা হয় প্যারামিটার, বা নির্দিষ্ট সংখ্যা। কিন্তু ও y দুটোই চলমান সংখ্যা, একেক বিন্দুতে তাদের একেক মান। এমন করে শুধু সরলরেখা কেন পুরো একটা ত্রিভুজ, একটা চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ, ইত্যাদি সব রকম জ্যামিতিক আকারকেই বীজগণিতের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, ইউক্লিডের সমস্ত উপপাদ্য, সম্পাদ্য ইত্যাদিও প্রমাণ করা সম্ভব কেবল বীজগণিতের ব্যবহার দ্বারা। ডেকার্টের এই অভিনব আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। বর্তমান যুগের সেরা গবেষকদের অন্যতম বড় আকর্ষণীয় বিষয়, Algebraic Geometry, তার পূর্বসূরি হিসেবে ডেকার্ট সাহেবকে চিহ্নিত করা হয়তো অন্যায় হবে না।

অথচ মানুষের বুদ্ধির জগৎ আর বিশ্বাসের জগতে যে কতটা সংঘাত ঘটতে পারে ডেকার্টের জীবনই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ‘শূন্য’ সংখ্যাটি এক হিসেবে তাঁর নবসৃষ্ট গণিতের মূল স্তম্ভ, কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘শূন্যের’ আইডিয়াকে পুরোপুরি গ্রহণ করাটাও ছিল তাঁর পক্ষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন গোঁড়া জেসুটপন্থী ক্যাথলিক। জেসুট স্কুল থেকেই তাঁর ছোটবেলার শিক্ষাদীক্ষা। সমগ্র ইউরোপ মহাদেশব্যাপী যখন প্রটেস্টান্ট আন্দোলনের ঝড় উঠেছে, ঠিক তখনই তিনি ঘোর ক্যাথলিক বিশ্বাসী ধার্মিক পুরুষ। তিনি ছিলেন অ্যারিস্টটলের ভক্ত, ছিলেন শূন্য-বিরোধী, ছিলেন সরলগতি-বিরোধী। অথচ তাঁর গণিতই শূন্যনির্ভর। এ এক মহা যন্ত্রণা। একদিকে তাঁর বুদ্ধির পূর্ণ সমর্থন কোপার্নিকাস তত্ত্বের প্রতি, আরেক দিকে অ্যারিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক বিশ্বকেও তিনি বর্জন করতে পারছিলেন না। বিজ্ঞান আর ধর্ম পরস্পরবিরোধী নয়, এই মতবাদ যারা আঁকড়ে থাকতে চান, তারা সম্ভবত ডেকার্টের জীবনকাহিনির সঙ্গে পরিচিত নন।

‘শূন্য’ ও তার বিপরীত ‘অসীম’কে নিয়ে ডেকার্টের নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের সমাধান তিনি নিজেই করেছিলেন। প্রাচীন দার্শনিকদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে যার অস্তিত্ব নেই তার ভেতর থেকে হঠাৎ করে কিছু বের হয়ে আসতে পারে না ( nothing can come out of nothing), যা আসলে রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেসিয়াস (৯৯-৫৫ খ্রি.পূ.) বলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই (আমাদের এ গ্রন্থের শেষের দিকে দেখব যে এ দৃষ্টিভঙ্গিটির আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানে) । এমনকি জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য বলে ভাবতেন ডেকার্ট, অর্থাৎ নতুন জ্ঞান বলতে কিছু নেই, বা নতুন চিন্তা, নতুন ধারণা। বাহ্যত নতুন মনে হলেও এসব কোনোকিছুই নতুন নয়। সেগুলো কোনো সর্বজ্ঞ সত্তার কাছ থেকে একপ্রকার সূক্ষ্ম দৈবসূত্রে প্রাপ্ত প্রতিভাস মাত্র। সেই সর্বজ্ঞানের জ্ঞানী সত্তা, সেই সর্বজ্ঞ অধীশ্বরের অস্তিত্ব যিনি ধারণ করেন তিনিই ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা। তিনি অসীম, একমাত্র অসীম। বাদবাকি সব সীমার মধ্যে আবদ্ধ—মানুষ, প্রকৃতি, বিশ্বজগৎ, জ্ঞান, সাধনা, প্রেম-ভালোবাসা। গোটা সৃষ্টি দুটি বিপরীত মেরুর মধ্যে সীমাবদ্ধ—একদিকে অসীম অর্থাৎ ভগবান। আরেক প্রান্তে শূন্য, অর্থাৎ যা অস্তিত্বহীনতার পর্যায়ে গণিতের বিমূর্ত জগতে বিরাজমান। তার অর্থ, অ্যারিস্টটল যেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন শূন্য আর অসীমকে অস্বীকার করে, ডেকার্ট সেই একই ঈশ্বরকে প্রমাণ করার প্রয়াস পেলেন দুটিকে স্বীকার করেই।

♦ ড. মিজান রহমান

♦ অভিজিৎ রায়

♦ ভূমিকা

♦ শূন্য অধ্যায়ঃ অশূন্য মতামত

♦ প্রথম অধ্যায়ঃ কিছু না

♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি

♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে

♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?

♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস

♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব

♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি

♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা

♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?

♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে

♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি

♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন

♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?

“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!