বন্যা আহমেদ

তোমাকে চিঠি লিখি না অনেক দিন। আজকের দিনে চিঠি না লিখলে তুমি অভিমানী হাসি হেসে বলতে, “হুঁহুঁ, তুমি কতদিন ধরে আমাকে চিঠি লেখ না সেটার হিসাব কিন্তু আছে আমার কাছে।” যে কম চিঠি লিখত সেই যেন হেরে যেত। এটা বোধ হয় তোমার করা নিয়মগুলোর একটা, তাই না? এভাবে নিষ্ঠা ভরে হাতে চিঠি লেখাটা কিভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের মধ্যে? এক বাসায় থেকেও বছরের পর বছর চিঠি লিখেছি আমরা একজন আরেক জনকে। অদ্ভুত সব নিয়ম ছিল তোমার। তোমার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর অবাক হয়ে দেখলাম ঝগড়ার পর যে প্রথম আত্ম সমর্পণ করে সেই নাকি জেতে! খুব অদ্ভুত লেগেছিল এই পুরো ধারণাটা প্রথমে শুনে। গোঁ ধরে, শক্ত হয়ে বসে থেকে জেতাটাই নাকি জেতা নয়, বরং মহত্ত্ব দেখিয়ে আগে এসে ভাব করে সেই নাকি জেতে!

সেদিন আমার-তোমার হাতে লেখা কয়েকশো চিঠি নিয়ে বসেছিলাম মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে। আমি তোমার লেখা চিঠিগুলো সযতনে তুলে রেখেছিলাম। হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে তোমার ড্রয়ারগুলো খুলে দেখলাম তার একটাতে তুমিও একইভাবে আমার চিঠিগুলো সব একসাথে করে জমিয়ে রেখেছ। আর তো কোনদিন তুমি চিঠি লিখবেনা, তাই আমার তোমার সব চিঠিগুলো মিলিয়ে দিয়েছি এক সাথে। তোমার সেই সিঙ্গাপুর থেকে পাঠানো ফেড-এক্সের বড় বড় প্যাকেটগুলোতে।

২০০৩ সালে লেখা একটা চিঠিতে দেখলাম তোমাকে এই রবীন্দ্রসংগীতটা পাঠিয়েছিলাম,

অমল ধবল পালে লেগেছে     মন্দ মধুর হাওয়া–

দেখি নাই কভু দেখি নাই     এমন তরণী বাওয়া।।

কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন–

ভেসে যেতে চায় মন,

ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া।

পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে—

মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে

ভেবে দেখলাম, সবই আসলে এখনো একইরকম আছে, শুধু গানটার সবগুলো ক্রিয়াপদ আজ অতীত কালে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমরা শেষ চিঠি আদান প্রদান করেছিলাম ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে, সেই জাপানিজ রেস্টুরেন্ট এ বসে, দেশে রওনা দেওয়ার একদিন আগে। তোমাকে সেদিন যে চিঠিটা লিখেছিলাম সেটা আবারো পড়লাম, পড়তে পড়তে মনে হলো, আচ্ছা, এটাই কেন তোমাকে লেখা শেষ চিঠি হতে হবে? তুমি না হয় আর লিখতে পারবে না, কিন্তু আমি তো পারি। উত্তর না হয় না’ই বা পেলাম, পার্থিব তিথিডোরে বাঁধা আর নাইবা থাকলাম। উত্তর’ই বা কেন পেতে হবে তোমাকে লিখতে হলে? দেখেছ, আমার কত ধৈর্য বেড়েছে, কতই না খারাপ কথা বলেছ জীবনে আমার ধৈর্যের অভাব নিয়ে!

তুমি হাসছ নিশ্চয়ই রবীন্দ্রসংগীত দেখে। রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার ভালোলাগা খারাপ লাগার সেই অস্তি-নাস্তির বিরোধটা কোনদিনও আর মিটলোনা কিন্তু। রবীন্দ্রসংগীত না থাকলে আমি এই দেড় বছরে বারবার যেন মারা যেতাম। রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার কতই না বিরোধ – তার রাজনৈতিক-দৃষ্টিভঙ্গি, শ্রেনী-দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, তার নারী-দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে; কিন্তু তার গানে এসে যেন এক অজানা ভাল লাগায় বিলীন হয়ে যাই । জানো, আমাদের সেই বাসাটার লম্বা করিডোরে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা হেঁটেছি আর গান শুনেছি। এটাই আমার থেরাপি, এটাই আমার নিজেকে একসাথে ধরে রাখার অস্ত্র যেটা কক্ষনো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। এত ডাক্তার, এত সাইকিয়াট্রিস্ট এর ভিড়ে এই গানগুলোই ছিল আমার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।

তোমার জন্মদিনটা কাছে আসতে থাকলে আমি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠতে থাকি। কী অদ্ভুত না? ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে এমনটা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেন যেন ওই দিনটাতে এরকম লাগেনি। তোমার জন্মদিনটা আমার দিকে কী যেন এক অবোধ্য অসহনীয় ভার নিয়ে ধেয়ে আসতে থাকে। তৃষাও বারবার বলছে এ দিনের কথা। জানো, ও এখনো তোমার হয়ে ওকালতি করার চেষ্টা করে। সেদিন বলছিল, ‘ড্যাড কত্ত সুখী একটা মানুষ ছিল, তুমি যদি ওকে ব্যায়াম করার জন্য এত জোরাজুরি না করতে তাহলে ওর অতটুকু দুঃখও থাকতো না।’ সেই আগের মতোই মনে হচ্ছিল কষে দুটো থাপ্পড় দেই।

এ বছর তোমার বয়স ৪৫ হতো। আমি নিশ্চিত যে স্নিগ্ধা তোমাকে আবারো আরেকবার মনে করিয়ে দিতো যে তুমি আমাদের চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোট হলেও পঁয়তাল্লিশের পরে সবাই বয়সে সমান হয়ে যায়। আর তুমি খুবই উল্লসিত হয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলতে, তোমাদের মত বয়স্ক মহিলাদের চেয়ে আমি সবসময়েই ছোট থাকবো ! বারবার কেন চমকে উঠি বলতো? দেড় বছর পার হয়ে গেল? দেড় বছর কি অনেকটা সময়? নাকি অল্প সময়? নাহ এই প্রথম ভাবিনি সময় পেরিয়ে যাওয়ার কথা। প্রায়ই ভাবি, প্রায়ই মনের ক্যালেন্ডারে বসে বসে দিন গুনি, সপ্তাহ গুনি, সেই ২৬ তারিখ থেকে শুরু করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যতবারই ভাবি ততবারই চমকে উঠি! কিন্তু কেন উঠি চমকে? সময় তো বয়ে চলারই কথা, তাই না? কিন্তু তারপরও এই নিত্য-বহমান অনিত্যের স্রোতে বারবার যেন ধাক্কা খাই। মাথা আর মনের এই যুদ্ধটার অর্থ কি আমরা কোনদিন বুঝবো? আমরা কি কোনদিন জ্ঞানের সেই মোহনায় পৌঁছব যখন এরা দুজন একই লয়ে চলবে? নাকি এরা আসলে সম লয়েই চলে, এদের আপাত-দ্বিচারিতাটার গূঢ়ার্থটা আমরা ধরতে পারি না। এত জ্ঞানবিজ্ঞানের ছড়াছড়ি চারদিকে, কিন্তু আমরা এখনো কতকিছুই জানি না, কতকিছুই বুঝি না। এটা নিয়েও আমরা কতই না আলোচনা করেছিলাম, নাকি বিতর্ক করেছিলাম, নাকি স্রেফ ঝগড়া?

কী অদ্ভুত এক আসা যাওয়ার পার্থিব গল্পে ভুলে থাকি আমরা। কত গল্প, কত ছল, কত বলা কথার মালা, কত না বলা কথার কষ্ট। কিন্তু একবার আসলে তো যেতেই হবে, গল্প একবার শুরু হলে তো সেই নটে গাছটাও মুড়োবে, তাই না? আজকাল প্রায়ই ভাবি, দুঃখ আর আনন্দ কি আসলেই দুটো বিপরীত ধারা? নাকি একই ধারার দুটো রূপ, একই স্কেলের দুই প্রান্ত। দুটি বিপরীত প্রান্ত বাঁকিয়ে গোল করে ধরলেই কি ওরা এক জায়গায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে না?

দুঃখ পেলেই কেন কষ্ট পেতে হবে? অতীতের কোন খারাপ স্মৃতি, কষ্টের স্মৃতি আমাদের ব্যথা দেয়, আবার দেখ অতীতের ভাল স্মৃতিগুলোও বেদনা দেয়। তখন আবার ভাল গল্পগুলো এখন আর নেই কেন ভেবে আমরা শোকে মুহ্যমান হই। কেন তা হবে? যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে কি তাই হবার কথা? সুখের কোন স্মৃতি ছিল এতোটা সময় ধরে, সেটা কি একধরনের আনন্দের প্রবহ হয়ে উঠতে পারে না?

মনে আছে, তোমার আমাকে সময়ের বৈজ্ঞানিক ধারণাটা বোঝানোর কথা ছিল আর আমার তোমাকে মিউটেশনের বংশগতীয় ব্যাখ্যা বোঝানোর কথা ছিল? আমি আমার কাজটা সম্পূর্ণ করেছিলাম। তুমি কিন্তু করোনি। এটা অবশ্য ঠিক, বেশ কয়েকবারই চেষ্টা করেছিলে তুমি। যতবারই মনে হয়েছে বুঝেছি ততবারই আবার পরক্ষণেই মনে হয়েছে কিসব গাঁজাখুরি কথাবার্তা। রাজর্ষির ঠিক এমনটা হয়েছিল মহাভারত নিয়ে আমাকে শেখাতে গিয়ে। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কিছু বললেই তুমি বেশ তেড়ে এসে বলতে ‘পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলো না থাকলে তোমার জীববিজ্ঞানের ‘জ’ও শুরু হতে পারতো না।’

সে যাক, সময় নিয়ে যা বলছিলাম, তুমি যে শুধু সময়ের ধারণাটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাওনি তাই’ই নয়, আমাকে এ বিষয়ে আরও বিভ্রান্ত করে দিয়ে চলে গেছ। ২৬ শে ফেব্রুয়ারির পর থেকে আরও তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু, সময় ব্যাপারটা আমার মাথায় পুরোই অবোধ্য হয়ে গেছে।

আদিতে তো সময় ছিল না, এখন কেন আছে? সময় না থাকলে কিই’বা হতো বলোতো? তাহলে কী অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত? আর সময়ের সাথে মানুষের সচেতনতার ব্যাপারটা যুক্ত করলে তো আর কথাই নেই। ধরো সময় কি সবসময়ই পরিবর্তনের সাথে যুক্ত? আমাদের সচেতন সত্তা কি শুধু বর্তমানের সাথেই সম্পর্কিত? কিন্তু বর্তমানটা তো বড্ড ক্ষণিকের। এই আছে, এই নেই। আমরা তো অতীতের কথা মনে রাখতে পারি আবার ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় দিন গুনি। তাহলে কি আমাদের সচেতন সত্তা বর্তমানের ক্ষণিকের গণ্ডি পেরিয়ে অতীত আর ভবিষ্যতেও বিস্তৃত? কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব?

দেখো আমাদের অস্তিত্বের কত কিছুই না বৈপরীত্যে ভরা! এই অন্তহীন মহাবিশ্ব আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে একেবারেই উদাসীন। কোন উদ্দেশ্য নেই, লক্ষ্য নেই, বিক্ষিপ্ততার তান্ডব সর্বত্র। কিন্তু তার মাঝেই আবার আমাদের উদ্ভব তো ঘটেছেই, আর আমরা পাগলপারা হয়ে এই উদ্দেশ্যহীনতার উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছি কতভাবে। এই দ্বৈধতা আমাদের অস্তিত্বের, আমাদের চেতনার সর্বত্র বিস্তৃত। যেমন ধরো, আমরা উদ্দেশ্যহীন এই মহাবিশ্বের জ্বলন্ত সব বিধ্বংসী অগ্নিকুন্ড দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে থেকে, নিজেদের ধূলিকণার চেয়েও তুচ্ছাতিতুচ্ছ অস্তিত্বের বাহাদুরিতে আপ্লুত হয়ে কী সুন্দর করে ভেবে নেই আমাদের সারা জীবনটা দুধেভাতে-সুখেই কাটবে। মহাবিশ্বের অনন্ত মহাপ্রলয় আমাদের গায়ে আঁচড়টাও কাটতে পারবে না। সেটা কি আর হয়? ‘সংসারের এই দোলায় সংশয়েরি ঠেলা’ তো অমোঘ নিয়মেই লাগবে। বিশ্বের নিয়মের বিপক্ষে দাঁড়ালে তো নিয়ত দুঃখ পেতেই হয় তখনি তো “বেজে উঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে উঠে বন্ধ এ ঘর”। কিন্তু তারপরেই আবার সেই আদি প্রশ্ন চলে আসে, তাহলে দুঃখ ব্যাপারটার অর্থই বা কী

মাথা আর মনের দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে আছি তো সেই ছোটবেলা থেকেই। মনে আছে তুমি বলতে এই পৃথিবীতে আমরা বড্ড মিসফিট। জানো আমি যখন বলি যে আমি এত কিছুর পরও নিজেকে এই ছন্নছাড়া পৃথিবীর অনেক মানুষের চেয়ে ভাগ্যবান মনে করি তখনো কিন্তু বুঝেই বলি। এখানেও সেই দ্বৈধতা। ওই ছোটছোট অভাগা চিবক মেয়েগুলো, আইসিসের হাতে ইয়াজিদি যৌনদাসীরা, প্যালেস্টাইনের হররোজ নিপীড়িত মানুষ আর হাজার হাজার সিরিয়ান আফগানিস্তানী সবহারা উদ্বাস্তু মানুষগুলোর চেয়ে ভাগ্যবান তো বটেই আমি। চারদিকে কতই না হানাহানি মারামারি, লোভের আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে কত দেশ কত সভ্যতা। বলতো এই ধরাকে শুচি করার সেই অগ্নিস্নান ঘটবে কবে?

অথচ এই ছোট্ট পৃথিবীটা উদ্দেশ্যহীনতার অঞ্জলি ভরে আমাদের যে উপহার দিয়েছিল তা দিয়েই কিন্তু দিব্যি ভাল থাকতে পারত আমাদের এই সাতশো কোটি সদস্য। কিন্তু তাই কি আমরা হতে দিতে পারি? পারি না। তাই জীবনানন্দকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, পৃথিবীর এই ভীষণ অসুখ তবে কীসে সারবে? সারবেনা হয়ত কখনই। কিন্তু সারানোর চেষ্টাটাও থামবে না হয়ত কোনদিন।

আমাদের সম্পর্কটা কতখানি ভাল ছিল সেটা নিয়ে কেউ বলতে আসলে কেমন যেন বিরক্ত হয়ে উঠি। দুটো মানুষের বছরের পর বছর একসাথে থাকাটাই অনেক কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। সেই দুটো মানুষ যদি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন দুটো মানুষ হয় তাহলে কাজের পরিমাণটা আরও অনেক বেড়ে যায়। আর তার উপরে আবার প্রকৃতির নিয়মে সদা নিভে আসা প্রেমের বাতিকে বারবার প্রজ্বলিত করে একসাথে থাকা তো রীতিমত একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেই দুঃসাধ্য সাধনেই ব্রতী হয়েছিলাম আমরা দুজনে। অন্যসব যুগলের মতই ঝগড়া তো আমরা কম করিনি, ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রান্তে এসে পৌঁছেছিলাম বহুবারই। আর একটু মৃদুমন্দ বাতাস লাগলেই টুপ করে পড়ে যেতে পারতাম ওপ্রান্তে।

লুকিয়ে ফারাবির মত ইতরটার সাথে বিতর্ক (আমার মতে নোংরা ক্যাচাল) করার পর কত্তগুলো দিনই না খারাপ ছিল আমাদের সম্পর্ক! এটা আর জোড়া লাগার কথাও ছিল না। চিঠিগুলো সাক্ষী হয়ে আছে সেই উত্তাল সময়টার। ওই সময়ের চিঠিগুলো পড়ে বুঝলাম দুজনার কী পরিমাণ অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আবার জোড়া লেগেছিল আমাদের সম্পর্কটা। না জোড়া লাগা বললে ভুল হবে, আবার নতুন করে শুরু করেছিলাম, নতুন করে প্রেমে পড়েছিলাম মাথা দিয়ে, মন দিয়ে, আরও কিছুদিন একসাথে থাকতে চাই আমরা দুজন এটা ভেবে। জানো স্নিগ্ধাকে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি রাতে (তুমি যেদিন দীপনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে) বলেছিলাম, ও যখন আমাকে নামিয়ে দিচ্ছিল আমাদের বাসায়, ‘ গত কতগুলো মাস আমাদের এত্ত ভাল একটা সময় যাচ্ছে যে আমার ভয় হয় এটা বেশীদিন থাকবেনা। তারপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যা ঘটলো….। কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে পারলে হয়তো ভাবতে পারতাম যে ওটা প্রিমোনিশান বা দৈব-পূর্বাভাস টাইপের কিছু একটা হয়তো।

মাঝে মাঝেই ভাবি, আমাদের দুজনার মাঝের সংযোগটা ঠিক কোথায় ছিল? নাকি তা সীমাহীন সম্ভাবনার মাঝে পরিণদ্ধ ছিল। সাধারণত সমাজে যা থাকে- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সন্তানের স্বার্থ এসব কোন কিছু দিয়েই বাধা ছিল না আমাদের সম্পর্ক। তুমি আমাকে লিখতে বলতে। এই একটা জিনিস নিয়েই জোরাজুরি করেছো তুমি, আর কিছু নিয়ে কি করেছো কখনো? মনে পড়ে না। আমি লিখি না কেন – আমার পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে, রাজনীতি এবং অর্থনীতির চিন্তাগুলো নিয়ে, আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়ে – মুক্তমনায় আরও লিখি না কেন, এ নিয়ে কতই না বলেছ, বারবার বলেছ। বিশেষ করে ব্যক্তিগত কোন বিষয় নিয়ে লেখালেখি আমি খুব অপছন্দ করি। আমার কেন যেন মনে হয়, আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ-ভালোবাসা-পাওয়ার আনন্দ-হারানোর কষ্টগুলো একান্তই আমার, এখানে আমার খুব কাছের দুই একজন ছাড়া আর কারো প্রবেশ থাকা উচিত নয়। আর তাছাড়া আমি এগুলো জানানোর প্রাসঙ্গিকতাও খুঁজে পাইনি কখনো! ফেসবুকে তোমার জন্মদিনটা দেখা যায় বলে কতই না হাসাহাসি করছিলাম, শ’য়ে শ’য়ে ‘শুভ জন্মদিন’ শুনে মনটা নারসিসিস্টিক ভালোবাসায় ভরে গেছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। মনে পরে আমার ক্যান্সারের সার্জারির সময় আমাকে নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলে সেটার জন্য কত বিপদে পড়েছিলে তুমি?

অনেকেই বলে আমাদের চিঠিগুলো প্রকাশ করা উচিত। এই কথাটা শুনলেই এক ধরণের স্বার্থপর ক্ষোভে মনটা ভরে ওঠে আমার। মনে হয়, ইশ, এগুলো এখন একান্তই আমার। আমাদের একজন কমন বন্ধু কিছুদিন আগে বেশ মজার একটা কথা বলেছে। বলেছে আমার নাকি সাহস নেই ব্যক্তিগত জিনিসগুলো সবার সাথে শেয়ার করার। এভাবে কখনোই ভেবে দেখিনি কিন্তু। আমার সাহস কম এ কথাটা শুনতে আমি একদমই অভ্যস্ত নই, তাই জোরে হেসেই উঠেছিলাম। কিন্তু সে যাই হোক, এবার ভেবেছি আমার এই জমা হয়ে থাকা কথাগুলো প্রকাশ্যেই লিখব তোমার জন্মদিনে। হয়তো তুমি খুশী হতে দেখলে, এই ভেবে। তোমার মুক্তমনাতেই না হয় লিখলাম। তোমাকে এখন সত্যিকারের চিঠি লেখার কোন দৈব-সুযোগ থাকলে দৈব-পোষ্ট বক্সে এভাবেই লিখে চিঠিটা ফেলে দিয়ে আসতাম।

তুমি সব বইতে লিখতে যে আমি তোমার সব চেয়ে বড় সমালোচক। কিন্তু জানো আমি এখন ভেবে দেখলাম তুমিও আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলে। সারকাজম, হাসিঠাট্টা, খোঁচাখুঁচি তো আমাদের সবধরনের কথাবার্তা, যোগাযোগের একটা অবশ্যম্ভাবী অংশ ছিল। তুমি আমাকে যেভাবে চিনতে, যেভাবে সমালোচনা করতে সেটা মনে হয় না আর কেউ কোনদিন করেছে। তুমি আমার চেয়েও বেশী কড়া ফেমিনিস্ট ছিলে। হাসাহাসিও তো করতাম আমরা সেটা নিয়ে অনেক। তাই কখনোই তোমার সামনে আমার শক্ত আবরণটুকু ভেদ করে অত্যন্ত গভীরের অরক্ষিত অংশগুলো উন্মোচন করতে দ্বিধা বোধ করতে হয়নি।

তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না,

আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না।।

ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,

তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।।

আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,

এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না।।

জানো, আমি তোমাকে দিনের নানা কাজে সারাদিন কখনই মিস করি না, কিন্তু হাজারো ছোট জিনিসে মনে পড়ে যায় কতকিছু। রেস্টুরেন্টে বসে পানির গ্লাসটা টেবিলে উল্টে ফেলে দিলে তোমার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, তুমি থাকলে বলতে, ‘এই যে আমাকে আর তৃষাকে সারাক্ষণ টেবিল ম্যানার নিয়ে জ্ঞান দাও, আসলে মেসটা তুমিই সবচেয়ে বেশী কর।’ সন্ধ্যাবেলাগুলো কেমন যেন দুঃসহ হয়ে ওঠে, মনে হয় আমি আর এর ভার নিতে পারছি না, দিনটা ফুরোলেই তো পারে। মনে আছে আমার এত প্ৰাইভেট থাকা, বিভিন্ন সময়ে অনমনীয় সব কর্পোরেট সিদ্ধান্ত নেওয়া এগুলো দেখে বলতে ‘বাম মতাদর্শে বিশ্বাস কর কিন্তু আসলে তুমি একটা ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক ক্যাপিটালিস্ট অ্যাসহোল। আমরা দুজনেই দুজনের সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলাম, হয়তো সেটাই আমাদের পরবর্তী স্তরে ওঠার পাথেয় হিসেবে কাজ করতো।

তোমার সাথে আমার বেশ কয়েকটা ঝগড়া বাকিই থেকে গেল। আমি কিছুতেই তোমার উপর থেকে একটা রাগ সরাতে পারছি না। তুমি কেন এত্ত অসতর্ক, এত নির্লিপ্ত ছিলে সবকিছু নিয়ে? এটা নিয়ে তোমার সাথে কতই না ঝগড়া হয়েছে। মনে আছে তোমার কিছু হলে আমার কী হবে ভাবো কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন তুমি বলেছিলে, ‘তুমি অনেক শক্ত মেয়ে, তুমি নিজেই নিজেরটা দেখতে পারো, আমারটাও পারো। এই কথাটা ভাবলেই আমার অনেক রাগ হতো, মনে হতো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বল এটা। জানো মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি প্রতিদিন মেলায় যেতে রাজি হলাম? কেন শেষদিন বাধা দিয়েও শেষ পর্যন্ত গেলাম? কিন্তু সাথেই সাথেই সেই চিন্তাগুলো থামাই। বাধা তো তোমাকে ১৩ বছরে বারবার বহুবার সবকিছুতেই দিয়েছিলাম। তুমি এবার দেশে গিয়ে যেরকম খুশী ছিলে সেটা মনে করে নিজেকে থামাই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে রিকশা করে ঘুরে ঘুরে তোমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির সেই পুরনো বাসা, পুরনো উদয়ন স্কুল, তোমাদের সেই আড্ডা মারার জায়গাগুলো দেখাতে দেখাতে তুমি যেরকমভাবে খুশী হয়ে উঠছিলে সেটার জন্য হলেও তো আমার বাধা দেওয়া ঠিক হতো না। ২৬ শে ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়ও আমরা হাত ধরে মেলা থেকে বেড়িয়ে আসার সময় ‘চলো আমরা ইলোপ করি’ বলে যেভাবে হেসেছিলে সেটার জন্য হলেও আমার তোমাকে নিষেধ করা ঠিক হতো না।

তুমি প্রায়ই হেসে বলতে ‘এত যে ঝগড়া কর, একদিন আমি না থাকলে বুঝবা। তুমি যা যা বোঝাতে চেয়েছিলে তার সবটা গত দেড় বছরে বুঝেছি কিনা জানি না তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি- তোমার অনেক দোষ-গুণই অনেক মানুষের মধ্যে আছে, অনেক কিছুই হয়তো পাওয়া যাবে অন্য মানুষের মধ্যে। কিন্তু একটা মানবিক বৈশিষ্ট্যের বড্ড আকাল পড়েছে এই পৃথিবীতে- উদারতা। আমি-তুমি খুব সচেতনভাবেই অনেক কিছুতে ভিন্ন মত পোষণ করতাম দার্শনিক, রাজনৈতিক এবং তত্ত্বগতভাবে, বিতর্ক করতাম, ঝগড়া করতাম – অনেকের চেয়ে বেশীই হয়ত করতাম। কিন্তু মানসিক উদারতার বৃহত্তর বর্ণালিতে এসে সেই ভিন্নতাগুলো কেমন করে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। খুব অবাক হয়ে দেখি, চারদিকে মানুষের মধ্যে অনেক কিছু আছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সচেতনতা, বুদ্ধি, যোগ্যতা, অযোগ্যতা – কিন্তু উদারতাটা কেমন যেন একটা দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যে পরিণত হয়েছে। তোমার ওই হাসিমাখা উদারতাটুকুই না হয় থাকা আমার একান্ত হয়ে।

তুমি ২০ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আমার হাতে তোমার নতুন বইটা, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটা দিয়ে উৎসর্গের পৃষ্ঠাটা পড়তে বলেছিলে। তোমার সেই বিশ্বাসটাই আমাকে শক্তি দিক সব ভুলে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

 

উৎসর্গ

সমন্ততঃ দুকূলপ্লাবী উত্তাল সমুদ্র, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দুঃসহ রাত্রি আর নিকষ নিঃসীম আঁধার। অবসন্ন দেহে একাকী তরী বাইতে বাইতে যখন আর ‘পারিনে যুঝিতে ’—তখন দূরে, বহুদূরে ম্লান আলোয় ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে দেখি এক দৃঢ়, তন্নিষ্ঠ, প্রত্যয়িত অবয়ব — ‘আমার হৃদয়সমুদ্রতীরে কে তুমি দাঁড়ায়ে’—জীবনসঙ্গিনীঃ

বন্যার করকমলে ।

error: Content is protected !!