হাসান আজিজুল হক

দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা সব স্তরেই শিক্ষার মান নিদারুণ নেমে গেছে একথাটা এখন সবাই আপ্তবাক্যের মতো বলেন বটে, কিন্তু এই নেমে যাওয়াটা যে কোন অধঃপতনে যাওয়া তা নির্ণয় করা এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করার কোনো উদ্যম আজ কোথাও আছে বলে মনে হয় না। যেহেতু অ- তল, অর্থাৎ তল বলে কিছু নেই সেজন্য এই নেমে-যাওয়াটা কোথাও বাধা পাচ্ছে না। কৃমি-কীটে খাওয়া কবরস্থ লাশের চেহারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার । নিজের অভিজ্ঞতায় তার অকাট্য প্রমাণ পাচ্ছি। শিক্ষা বা জ্ঞান আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার কোথাও নেই । ছাত্রছাত্রী হিসেবে প্রতি বছর যাদের দেখা পাচ্ছি তারা যেন শিক্ষার্থী হিসেবে আগের বছরের তুলনায় এক সাইজ করে খাটো। অর্থাৎ অধঃপতনটা স্থির নয়, প্রগতিশীল! প্রতি বছরই ক্লাস-কক্ষে, টিউটোরিয়াল ক্লাসে, মৌখিক পরীক্ষায় এবং সর্বশেষে পরীক্ষার খাতায় ছাত্রছাত্রীরা চূড়ান্ত অধঃপতন এবং অবনমনের অমোচনীয় স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রমধর্মীদের সম্মান জানিয়ে এবং তাদের বাদ দিয়ে বলি শতকরা ৯৫% ভাগ ছাত্রছাত্রী, বই-পুস্তক, পুঁথি গ্রন্থের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। কতোই বা তাদের বয়স, তবু এই বয়সেই বই-পত্রের সঙ্গে সম্পর্ক কবেই চুকিয়ে-বুকিয়ে দিয়েছেন। ক্লাশ-কক্ষে বই তো দূরের কথা, অনেকে খাতা-কলমটিও সঙ্গে আনেন না। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, বই-পত্র তাঁরা পড়েন না, পড়ে তেমন সুবিধেও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময়ে বিদ্যার যে পুঁজিটা তাদের ছিল, সেটা বিনিয়োগ করে কোনো লাভ হয় না অর্থাৎ কোনো বই- ই আয়ত্ত তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম দিকে শুনে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল (এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি) যে তাঁরা নোট বইও পড়েন না। তাহলে? তাহলে তাঁরা কি করেন, কেমন করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হন? উত্তর খুবই সোজা। তাঁরা তাঁদের অগ্রপথিক যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা এক দুই তিন চার পাঁচ দশ বছর আগে পাস করে গেছেন, তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি— পিনআঁটা ফুলস্কেপে লেখা প্রশ্নোত্তরের নোট সংগ্রহ করেন এবং প্রতি বিষয়ের গত চূড়ান্ত পরীক্ষার দশটি প্রশ্ন সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ও তার আগের তিন চার বছরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরামর্শ করে দশ বারোটি উত্তর আয়ত্ত করে পরীক্ষায় লিখে দিয়ে আসেন। ব্যস, এইটুকুই। সকলেই জানেন আধুনিক প্রযুক্তি অত্যাশ্চর্য ফলদায়ক, সর্বকর্মসাধক। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের রেখে যাওয়া নোটের ফটোকপি তৈরি বা সংগ্রহ করে নেওয়া একশোভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষেই সম্ভব। যে প্রাক্তন ছাত্র বা ছাত্রীর নোট এইভাবে সংগৃহীত হলো, সেটি প্রমাদপূর্ণ হতে পারে, তার তথ্যগুলি ইতোমধ্যে বাতিল হয়ে যেতে পারে, জায়গায় জায়গায় কীটদষ্ট হতে পারে, মুছে যেতে পারে, ছিঁড়ে যেতে পারে, তবু কোনো কিছুরই পরোয়া না করে এঁরা এগুলিকেই শেষ অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকেন। ক্লাশে যাওয়া, শিক্ষকের কাছে যাওয়া, তাঁদের আপ্রাণ প্রয়াস আদায় করে নেওয়া কোনো কিছুতেই ছাত্রছাত্রীদের সম্ভবত কোনো প্রয়োজন নেই। কাজেই শিক্ষা কর্মকাণ্ডের কদর্যতম ফলটি পরিপক্ক হয়ে শোভা পেতে থাকে চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্রে। ছাত্র-ছাত্রীদের কাগুজে দলিলে!

তাই, যত কাম্যই হোক ‘অন্বেষণ’-এর জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে লেখা পাওয়া সুদূরপরাহত হতে থাকবেই । পরিস্থিতি আজ এমনিই দাঁড়িয়েছে । তবে এর পুরো দায়টা কি ছাত্রছাত্রীদের উপর চাপিয়ে দিয়েই নিশ্চিত হওয়া যাবে? সব দায়িত্ব যথাযথ পালিত হচ্ছে বলে আমরা শিক্ষকরা কি বিবেক ধুয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি? এমন বিষময় পরিস্থিতির গ্লানি কি আমাদের এতটুকু স্পর্শ করবে না? অবশ্য এসব প্রশ্নই শুধু আমরা তুলতে পারি, সমাধান দিতে পারি না। কারণ সমাধান কোনো এক পক্ষের কাছে নেই। আরও পক্ষ আছে ।

এখন দেখা যাচ্ছে ‘অন্বেষণ’-এর একটা সাধারণ সম্পাদকীয় লিখতে বসে আমি জটিল একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি। কাজেই আরও কিছু কথা না বললেই নয়। ছাত্রছাত্রীদের কথাই আগে বলি। চমৎকার, মনধাধানো ফল করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক উৎরে এসে উচ্চ শিক্ষায় ঢুকেই ছাত্রছাত্রীরা মর্মে মর্মে টের পায় তারা অথৈ সাগরে এসে পড়েছে, কোনোদিকেই কূলকিনারা নেই। উচ্চ শিক্ষার প্রধান একটি অবলম্বনই তাদের নেই। সেটি হল কাজ চালানোর মতো আয়ত্ত করা একটি বিদেশী ভাষা এবং আমাদের দেশের বেলায় সে ভাষা হল ইংরেজি ভাষা। কথাটা সরাসরি বলে ফেলা গেল । নানা বিতর্ক থাকলেও, বহুরকম প্রসঙ্গ এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেও এই কথাটি সবাই জানেন, মেনেও নেন। কিন্তু এই একটি বিদেশী ভাষার অবলম্বন না থাকায় ক্ষতিটা যে কতোটা অতলস্পর্শী হয়ে উঠেছে, এই অভাব যে কর্কট রোগের মতোই শিক্ষা ব্যবস্থার পুরো দেহটাকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে তা ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী কেউ-ই পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করেন বলে প্রমাণ নেই। জানি, এই মুহূর্তে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা বললে প্রায় সকলেই তীব্র প্রতিবাদ করবেন। কেউ আদর্শের কথা তুলে আমাকে দুয়ো দেবেন, বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা, আনুগত্য নেই বলে ধিক্কার জানাবেন, বাঙালি জাতির দীর্ঘ রক্তাক্ত লড়াইয়ে আমি বিশ্বস্ত নই বলে অভিযোগও করবেন। অন্যদিকে, অভিভাবকরা, বিশেষ করে খোদ ছাত্রছাত্রীরাই একরকম সুবিধাবাদের ফাঁদে পড়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। ছাত্রছাত্রীরা প্রথমেই ধরে নেবেন এইরকম বদ-উদ্যোগের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁদের পাস করা এবং ডিগ্রি পাওয়ার পক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা । কেউ-ই তলিয়ে ভাববেন না, কেউ-ই বাস্তবকে দেখবেন না । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অনেকে এর প্রতিবাদ করবেন। প্রথমত জ্ঞানচর্চার জন্য অসম্ভব কষ্টকর পরিশ্রম করা এবং উন্নতমানের মেধা নিয়োগের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে যে আরামে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা, সেটা হারানোর আশঙ্কায় এবং হয়তো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে, শস্তা বাজারি বই লিখে কিছু উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখে। আমার ধারণা যত দিন যাবে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা শিক্ষকদের মধ্যে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার দর্শনমাত্র কম্প দিয়ে জ্বর আসবে। বলতে প্রলুব্ধ হই যে আজ এদেশে বাংলা ভাষার প্রতি ঘোষিত মমতাটি একবারেই শস্তা ও মেকি। এর মধ্যে সততা যে নেই তা বোঝা যায় ছাত্রছাত্রীসহ সারাদেশে শিক্ষিত মানুষদের ব্যবহৃত বাংলাভাষার অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে। মাতৃভাষার প্রতি এরকম অসার, নিস্তেজ, নিরুৎসাহজনক, উদাসীন মনোভাব অন্য দেশে কল্পনা করাও কঠিন।

আমরা সবাই জানি পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত ও সভ্য দেশে অন্তত একটি, অবস্থাবিশেষে একাধিক, বিদেশী ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে শিখতেই হয়। কোনো শিক্ষার্থীরই এ থেকে নিষ্কৃতি নেই। ভাষাগুলি তো মানবসৃষ্ট জাগতিক ও মানসিক সৃষ্টিভাণ্ডারে ঢোকার এবং তার বিচিত্র বৈভবকে আয়ত্ত করার দরজা! ভাষার ভিতর দিয়েই সারা বিশ্বের মানুষের পরস্পর চেনা-জানা ঘটে। দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আমাদের পক্ষে ইংরেজি ভাষাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র বিদেশী ভাষা । এটা এরকম ইতিহাসই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। প্রধানত এই একটি ভাষার দরজা দিয়েই আমাদের আজ বাইরের পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে ঢুকতে হবে। কাজেই, শিক্ষার মান যে এতটা নেমে গেছে, আমার মতে, তার আশিভাগ কারণই হচ্ছে এই একটি বিদেশী ভাষা কাজ চালানোর মতো ভালোভাবে শিখতে না পারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর শিক্ষাদানের বিষয় নিয়ে ভাবলেই দেখতে পাবেন এর প্রায় নব্বই ভাগ আমাদের দেশে, দীর্ঘ দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ইংরেজি ভাষার জালে আটকে আছে। এটা কাম্য হোক আর না হোক বাস্তব এটাই। দর্শন বিভাগের কেউ যদি সত্যি সত্যি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল সম্পর্কে জানতে চায়, আধুনিক যুগের চিন্তার ইতিহাসটা আয়ত্ত করতে চায় দেকার্ত, স্পিনোজা, লিবনিৎস, লক, হিউম, বার্কলে, কান্ট, হেগেলের রচনা বা রচনার টীকাভাষ্য পড়ে, তাহলে ইংরেজি জানাটা তার জন্য বাধ্যতামূলক । ঐসব দার্শনিকের মূল রচনা পড়ার আকাঙ্ক্ষার কথা ছেড়ে দিচ্ছি। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই— সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান- সোজা কথায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যে জ্ঞানভাণ্ডারে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছে, আমাদের কপালবৈগুণ্যে তা বাঁধা পড়ে আছে ইংরেজি ভাষার কাছে । কোনো বিকল্প নেই এটা না শেখার। যাঁরা বাংলা ভাষা নিয়ে অতিচেতন, তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা : এই যে বিশাল ভাণ্ডারটির কথা বলা হলো, আমাদের নিজেদের ভাষার বাইরে যেতে না চাইলে তার কতোটা ছাত্রছাত্রীদের পাইয়ে দেওয়া যায়? পশ্চিমবঙ্গে যে অল্প কিছু কাজ হয়েছে, দেশগর্বে স্ফীত হয়ে যদি তার সাহায্য আদৌ না নিতে চাই, তাহলে বাংলাদেশের রিৎসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষ বাংলাভাষার যে ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন তা কি যথেষ্ট? তা কি মানসম্পন্ন, তা কি প্রচুর ও মৌলিক, তা কি বেনিয়াবৃত্তি থেকে মুক্ত? এইসব তিক্ত প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’। প্রয়োজনে শতকরা দশভাগও মিলবে না দেশিয় ভাষার ভাণ্ডার থেকে । এর ফল যে কি রকম ভয়াবহ তা শিক্ষকদের সকলেই চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ছাত্রছাত্রীদের রচিত উত্তরপত্র থেকেই বুঝতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় উদার, খালি হাতে বড় একটা কেউ ফিরে যায় না। আগের তুলনায় অনেক বেশি ছাত্র-ছাত্রী আজকাল কপালে জয়টীকা পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যান ।

এবার সম্পূর্ণ উল্টো একটা কথা বলব। সব উন্নত দেশই শিক্ষার প্রায় শুরু থেকে একটি বা একটির বেশি বিদেশী ভাষা শেখা আবশ্যিক করলেও শিক্ষার একেবারে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যমটা রেখে দেয় মাতৃভাষা। তার মানে যা-ই পড়ো আর যত বেশি সংখ্যক ভাষাতেই পড়ো বা শেখো, শিক্ষাদানটা সব সময়ই হবে মাতৃভাষায়। সব পরীক্ষাই দিতে হবে ওই নিজের ভাষায়। এর ব্যত্যয় চলবে না । ইউরোপ আমেরিকা ও এশিয়ার বড়ো বড়ো দেশ— প্রাক্তন রুশ প্রজাতন্ত্র, জাপান, চীন ইত্যাদি সবদেশেই এই ব্যবস্থা। মাতৃভাষায় শিক্ষা— শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । শিক্ষা শেষ করে শিক্ষার উচ্চতম পর্যায় অতিক্রম করার পরে, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার অভিপ্রায় হচ্ছে একজন ইংরেজ হবে একজন ইংরেজ, জার্মান হবে জার্মান, রুশ হবে রুশি, জাপানি হবে জাপানি। শিক্ষা শেষ করে একজন ইংরেজ জার্মান বা ফরাসি হয়ে উঠবে এটা কেউ কামনা করে না- সে শিক্ষিত ইংরেজই হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তেমনি শিক্ষা শেষে একজন বাঙালি বাঙালিই হবে, ইংরেজির ভিতর দিয়ে পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে বলে সে ইংরেজ হয়ে যাবে না। আমাদের বেলায় এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সমগ্র উপমহাদেশেরই ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিক ব্যাপার ঘটায় বাধা ছিল। এ আমাদের ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্য যে উপমহাদেশ গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ইংরেজি ভাষাই হয়ে গেল আমাদের বিধিলিপি। এই ভাষার বিষ ও অমৃত এখন আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। জার্মান, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালির উপনিবেশগুলো মূলত উপনিবেশিক শাসকদের ভাষাই নিজেদের দেশে শিক্ষার বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এশিয়া আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশকেও তাই করতে হয়েছিল। উপমহাদেশেও তাই ঘটেছে। খুব উন্নত ও যোগ্য উপমহাদেশীয় ভাষাগুলি থাকা সত্ত্বেও। বাংলার মতো এমন একটা উন্নত ভাষাকেও এই মার খেতে হল। এটা একটা কলঙ্কই বটে। এই কলঙ্ক এমনি অনপনেয় হয়েছিল যে ইংরেজ ভারত ত্যাগ করে চলে গেলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও এই ইংরেজিকে আমাদের শিক্ষার মাধ্যম করে রাখা হয়েছিল। এত গুরুত্ব তাকে শাসকরা দিয়েছিল যে দেশের মানুষ যেন মাত্র দুভাগে বিভক্ত— ইংরেজি জানা আর ইংরেজি না-জানা । ইংরেজি জানা মানেই সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা, বিত্ত সবই। আর না-জানারা প্রায় মানুষ বলেই গণ্য নয়। আমরা ইংরেজিতে পড়েছি, ইংরেজিতে পড়িয়েছি, ছাত্রছাত্রী ইংরেজিতে পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু তাতে আমাদের সম্মান বাঙালি জাতি হিসেবে বাড়েনি, সব সময়ে একটা হীনম্মন্যতা কাজ করেছে। ইংরেজি ভাষাটা ‘status symbol’ হয়ে যাওয়াতে সাধারণ মানুষের জন্য এই ভাষা না জানাটা অবমাননাই বয়ে এনেছে। ইংরেজি ভাষা হয়ে গেছে প্রভুর ভাষা। এই দিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই যথার্থ, সঙ্গত ও আত্মমর্যাদাকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে বাংলাই হবে শিক্ষার সর্বস্তরের একমাত্র বাহন। সবদিক থেকে সঙ্গত ছিল এই সিদ্ধান্ত— বাংলা ভাষার মান ও যোগ্যতার দিক থেকে, বাংলাদেশের নিজস্ব ইতিহাসের দাবির দিক থেকে, শিক্ষার ভিতরের শক্তিকে শিক্ষার্থীর ভিতরে পরিবাহিত করার দাবির দিক থেকে। আত্মমর্যাদাশীল সব উন্নত দেশ যে তাদের আপন আপন মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করেছে তা শুধুমাত্র দেশগর্ব, জাতিগর্ব বা শ্রেষ্ঠত্বের দাবির জন্যই নয়, আদতে প্রকৃত শিক্ষা সম্ভবই নয় আপন ভাষার মাধ্যম ছাড়া। খাদ্যের পুষ্টি যেমন রক্তে মেশে এক অভ্যন্তরীণ বিক্রিয়ার মতো, শিক্ষাও তেমনি ব্যক্তির নিজস্ব অর্জন হয়ে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে।

প্রশ্ন ওঠে আমরা বিপদে পড়লাম কেন? মাতৃভাষা সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে এটা যেমন স্বাভাবিক, একটি বিদেশী ভাষা, আমাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা, অবশ্য শিক্ষণীয় হবে— অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার পর থেকেই— এটাও তেমনি স্বাভাবিক । তাহলে কেন শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বিপর্যয়? উত্তর খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না ।

উন্নত দেশগুলি জানে তাদের মাতৃভাষা সব দিক থেকেই যোগ্য, শিক্ষার যে বিশাল ভাণ্ডারটি শিক্ষার্থীর জন্য অবশ্যলভ্য, তার প্রায় সবটাই তার নিজের ভাষার মধ্যে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত। তাকে শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেবার জন্য ভাষা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কারণ তা জীবন্ত, চর্চিত, সদা ও সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত। আমাদের, মুশকিল ঠিক এখানেই। বাংলা ভাষাও যোগ্য, খুবই যোগ্য। কিন্তু তা ভাষা হিসেবে- অনেকটা ফলার্জন-সাপেক্ষ সম্ভাবনা হিসেবে। সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলাভাষা নিয়ে, সর্বক্ষেত্রে তার প্রচলন-উদ্যোগ নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন যেমন তেমনি, বা তার চেয়ে বেশি ছিল গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় এর ব্যাপক চর্চা ও ব্যবহার নিয়ে। সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কোথায় সে সম্পর্কে সৎ, নির্ভীক ও সৃষ্টিশীল ভবিষ্যৎ-দৃষ্টির অভাবের ফলেই আজ পর্যন্ত তেমন সর্বব্যাপী পরিকল্পনা দেখতে পাওয়া গেল না । বাংলাভাষার যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষার মধ্যে পঞ্চম এই ভাষা, কথা বলে বিশ কোটির বেশি মানুষ। তবুও এ কথাটা সত্য যে, সমাজ যখন মৃত, ভাষাও তখন মৃত, সমাজ যখন জীবন্ত ও কর্মশীল, ভাষাও তখন জীবন্ত ও কর্মশীল। এই কথাগুলি নেহাত আপ্তবাক্য নয়। ভাষা এক অদ্ভুত সূচক, সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক। সব বিষয়ে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সাহিত্যে ভাষাই দেখিয়ে দেবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। যে সমস্ত দেশ মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিজ্ঞানে, চিকিৎসায় অন্য কোনো ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে নেবার কল্পনাও করতে পারে না, তারা নিশ্চিত থাকে যে সমগ্র পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার তাদের ভাষায় মজুত আছে এবং এই মজুত থাকার বিষয়টি প্রতি মুহূর্তে চলিষ্ণু। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে নানা কারণে তেমন ছিল না, তা জানার পরেও শুধুমাত্র সস্তা আবেগের বশীভূত হয়ে বা ফাঁকা জনপ্রিয়তার মোহে দেশের শাসকগণ এ পর্যন্ত বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করে দিয়ে নিশ্চেষ্ট থেকেছেন । দেশ স্বাধীন হবার একত্রিশ বছর পর আজ যে ভয়ানক শূন্যতার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাতে মনে না হয়ে পারে না যে, শিক্ষার প্রতি, জাতির প্রতি চরম অবহেলা দেখানো হয়েছে । প্রথম কাজটিই ছিল, যে বিশাল জ্ঞানচর্চা কাণ্ড- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু করতে হবে তার সবটা অন্য ভাষা থেকে, প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকে আমাদের ভাষায় অনুবাদের মধ্যে দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, আর সেটাকে একটা চলন্ত প্রক্রিয়ায় রূপ দেওয়া । এই কাজ করার জন্য দশ বছর, বিশ বছর মেয়াদি একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারাদেশের মেধা, অন্য কোনদিকে দৃকপাত না করে এই কাজে নিয়োজিত করা একান্ত প্রয়োজন ছিল। এ কাজের কেন্দ্র হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান; এগিয়ে আসতে পারত নানা সরকারি বেসরকারি সংস্থা, উঁচু পর্যায়ের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি। দেখা যাচ্ছে সেরকম কিছুই হয়নি। পাশাপাশি আর একটা পথ ছিল । ইংরেজি ভাষার বইগুলির মানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বাংলা ভাষাতেই মৌলিক গ্রন্থ রচনা করে উচ্চ শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা। কিছুই হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় অনুবাদ হয়েছে সামান্য । যা হয়েছে তার বেশির ভাগ অক্ষম অনুবাদ । আর মৌলিক গ্রন্থ যা রচিত হয়েছে সেদিকে চাইলে শিক্ষিত মানুষের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠবে। এসব বই নকল, অনুকৃত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চৌর্যবৃত্তি, কিংবা বিদেশী বইয়ের আদলে রচিত ও গ্রাম্য পণ্ডিতিতে পরিপূর্ণ। এসব গ্রন্থের একটা বিরাট অংশ বিদ্যাব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দ্বারা লিখিত। সম্মানিত ব্যতিক্রম ছেড়ে দিলে এসব কথা একটুকুও মিথ্যা নয়, নির্জলা সত্য। এর ফল হয়েছে মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী । ছাত্র-শিক্ষক উভয় দিক থেকেই ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাওয়াটা প্রায় আঙ্কিক নিয়মে ঘটছে। শিক্ষকরা ধীরে ধীরে ঠেকনো দিয়ে শিক্ষকতা চালানোয় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। কারণ তাঁরা জানেন তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের যত কম জানাবেন ততই ওদের মঙ্গল। বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষক নিজের জ্ঞান বুদ্ধির সঙ্গত বিকাশ ঘটিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে তার প্রতিফলন যতই আশা করবেন ততই নিরাশ হবেন, ছেলেমেয়েরা ততই পরীক্ষায় ব্যর্থ হবেন। ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ যেসব শিক্ষক পণ্ডিত এবং সৎ তাঁদের আজ চুল ছিঁড়তে দেখি, যাঁরা পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন, অনর্থক আর নিজের বিদ্যাবুদ্ধিকে নাড়াচাড়া করতে চান না তাঁরাই নিরুদ্বেগে থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন। শিক্ষার বর্তমান বিষময় চাকা এখন পুনর্বৃত্ত ঘুরে এসেছে।

error: Content is protected !!