হাসান আল আবদুল্লাহ

পুরুষ-শাসিত সমাজে মেয়েরা সর্বদাই উপেক্ষিত। সামাজিক কাজ কর্মে তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা পুরুষের থেকে সব ক্ষেত্রেই কম গুরুত্ব পায় । খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০ অব্দে (যাকে ক্লাসিকাল এজ বলা হয়) এথেন্সের মেয়েদের অবস্থান এবং সামাজিক সম্মানের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। তখন দাসদের থেকেও কোনো কোনো পর্যায়ে নিচু অবস্থানে ছিলেন মেয়েরা। প্রচলিত ধারণা এই ছিলো যে, নারীর জন্ম হয়েছে শিশু পালন এবং ঘরের কাজ করে সময় কাটানোর জন্যে। সামাজিক পীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি এবং জীবন বিধাতার দান ও তার দেয়া অবস্থানকে মেনে নিতে হবে, এসব কথা ভেবে মেয়েরা গৃহবধূ ও হোম-মেকার হিসেবে মুখ বুজে কাজ করে ঘরের কোণে থাকাই মেনে নিয়েছিল । তথাপি কখনো কখনো কেউ কেউ যে বিদ্রোহ করে বসেনি তা কিন্তু নয়, যেমন বিদ্রোহ করেছিলেন এ্যাসপাসিয়া ও ইউরিপেডিস লিখিত ‘এ্যান্টিগনি’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নায়িকারা। যদিও তখনকার সমাজে নারীদের অবস্থান পর্যালোচনার জন্যে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তথাপি হিরোেডাটাস ও থুসিডিডিস রচিত গ্রীসের ইতিহাস, প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য, চিত্রাঙ্কিত পাত্র, ভাস্কর্য এবং ফলকের উপর লিখিত গীতিকথা গ্রীক সমাজ ও মেয়েদের সম্পর্কে দিগন্তে সরু রেখার মতো একটি মোটামুটি ধারণা দেয় ।

আমরা জানি যে, গ্রীসের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা সোলোন একদা ‘ভালো মহিলা’ ও বেশ্যাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। ব্যাপারটি হাস্যকর হলেও তিনি একটি ভালো কাজ করেন, তা হলো নারী বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা। পণ্যের মতো নারীকে বিক্রি করা হয়েছে প্রায় পৃথিবীর সর্বত্র। শুধু গ্রীসে কেন, মিসর ও বেবিলনের সভ্যতা, ইয়োরোপ, আফ্রিকা এবং পরবর্তীতে মার্কিন দেশে দাস প্রথার কালেও যৌনাঙ্গ ব্যবহারের উৎকৃষ্ট পণ্য হিসেবে বিকিয়েছেন নারীরা ।

যুগে যুগে যুদ্ধে পরাজয়ের নিষ্ঠুরতম আঘাতটি পোহাতে হয়েছে— নারীদেরই দাসত্ব বরণ ও শরীর পুরুষের হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে। গণিমতের মাল হিসেবে যুদ্ধে ধরে আনা নারীদের মোহম্মদও হালাল করে দিয়েছেন অনুসারীদের মধ্যে। এমতাবস্থায় সোলোনের নারী বিক্রি নিষিদ্ধ করার কাজটি ছিলো যথেষ্ট মানবিক ও উদার নীতির উদাহরণ। তথাপি ‘The right of the male guardian to sell an unmarried woman who had lost her virginity’ দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেয়া হয়। যদিও সোলোন প্রতিষ্ঠিত আইন ও গণতন্ত্রের নতুন ধরন ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে যথেষ্ট সু-প্রভাব রেখেছিলো, তথাপি ‘সতীত্ব হারানো অবিবাহিত’ মেয়েদের জন্যে তার উল্লিখিত আদেশ ছিলো বর্বর। তাছাড়া তার এ আইন তখনকার নারীদের উপর পুরুষ জাতির হীন মনোভাবেরই প্রকাশ, কেননা ‘সতীত্ব হারানো’ অবিবাহিত পুরুষদের শাস্তি প্রদানের কোনো আইন ছিলো না । ফলে কেউ কেউ এ আইন মহিলা বিদ্বেষপ্রসূত আখ্যা দিয়ে নতুন সৃষ্ট গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাও পুরুষের হাতকে আরো শক্তিশালী করার নামান্তর বলে উল্লেখ করেছেন। সোলোনের গণতন্ত্রের সমালোচনা করা যদিও আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু এটাও সত্য যে নারীদের জন্যে প্রণীত এই আইন পরবর্তী কয়েক শতাব্দী বহাল থাকে এবং এখানে আলোচিত সনাতনী যুগেই এর নারী সমাজকে ন্যুব্জ করে দেয়। ‘সে সময় নারী ও দাসদের অবস্থান বস্তুত একই রকম ছিলো।’ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই যে ‘শাশ্বত এথেন্স’ নারীদের খুবই নিচু চোখে দেখত এবং কখন কখন এদের সামাজিক অধিকার দাসদের থেকেও দুঃখজনকভাবে নিম্ন পর্যায়ে ছিল। উদাহরণ, দাসরা বাজারে যাবার অর্থাৎ ঘরের বাহির হবার অনুমতি পেলেও নারীরা তা থেকে ছিল সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ঘরের কাজ, সন্তান পালন ও পুরুষের যৌন ক্ষুধা মেটানো ছিল তখনকার মেয়েদের প্রধান দায়িত্ব। তবে বিংশ শতাব্দীর কোন কোনো বুদ্ধিজীবী এথেন্সে মেয়েদেরকে দাসদের থেকে বেশি মর্যাদা দানের কথা উল্লেখ করেছেন, যা কি না অন্যরা কল্পনা প্রসূত ও অত্যন্ত স্থুল বলে তাদেরই সমালোচনা করেছেন। যেমন অধ্যাপক স্যারা বি. পামোরয়, তার ‘গডেস, হোরস, ওয়াইফস এন্ড স্লেভস’ গ্রন্থে ওইসব বুদ্ধিজীবীদের কৌশলগত প্রকৃতি নির্ণয় করে বলেন, ‘… তারা নিজস্ব সময় ও সামাজিক ধারার বলি।’

অধীনস্থ করা এবং যৌন ক্রিয়াকলাপের সুবিধার জন্যেই হয়তো পুরুষ ইচ্ছা করে নারীদের ঘরে বেধে রাখার প্রচলন করেছিলো। যদিও অনেক স্থানই ছিলো যেখানে গিয়ে পুরুষ তাদের যৌন ক্ষুধা অনায়াসে মেটাতে পারত, তথাপি স্ত্রীর স্বভাবের উপর পুরুষের ভাগ্যের স্তর নির্ধারণ করার নিয়মও ছিল। সমাজে প্রচলিত ছিল, ‘যদি তোমার স্ত্রী সত্যিই একজন ভালো নারী হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায় যে তুমি একজন প্রকৃত ভাগ্যবান, নতুবা তুমি সমস্যাশঙ্কুল।’ শুধু তাই নয়, নারীরা ঘরের বাইরে বেরুলে অন্য পুরুষের দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে এবং ফলত স্বামীকে সমস্যায় ফেলতে পারে তাই সে সময়ে সাধারণত নারীদের কোন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেয়া হত না, উপরন্তু কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিনিধি হওয়া তাদের পক্ষে তখন ছিলো অকল্পনীয়। তবে কয়েকজন ‘দেবী’ বা ‘গডেস’ যেমন সেলিনি, গেরা, এথিনা প্রমুখ মোটামুটি উচ্চাসনে অবস্থান করতেন। অন্যদিকে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশ করেন যে, শাশ্বত এথেন্সে নারীদের মাত্র দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতো : দেবী ও বেশ্যা। সাথে সাথে এটাও লক্ষ্মণীয়, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে এথেন্সে মধ্যবিত্ত সমাজ বেশ ধন সম্পদের মালিক হন। সুতরাং কেউ কেউ মনে করেন ঐ সময়টা ছিলো সমাজে মেয়েদের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রাচীন, অন্ধকার যুগের পৌরাণিক তথ্যাদিও সমাজে নারী ও পুরুষের বিপুল পার্থক্য নির্দেশ করে। বিভাজনের এই মানসিকতা এথেন্সের সাধারণ মানুষের মন থেকেও কোনভাবেই বিলুপ্ত হয়নি, বরং সময় ও সুযোগ মতো নারীদের উপরে ধর্মের ধ্বজা তুলে এসব কঠোরভাবে ব্যবহারের চেষ্টা চালানো হয়েছে। ফলত পূৰ্ণ বয়স্কা কোনো নারীর অকাল মৃত্যুতে শোক পালন ব্যতিরেকে কর্তব্য কর্মে অকৃতকার্য হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো, কারণ সন্তান উৎপাদনই যেখানে তার একমাত্র কাজ সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বীজ বপন না করে এরকম চলে যাওয়াকে সামাজিক নিষ্ঠুরতার সামিল বলে গণ্য করা হতো। এই সব অমানবিক চিন্তা চেতনার চিহ্ন পাওয়া যায় বহুবিধ চিত্রাঙ্কিত পাত্র ও প্রাচীন ফলকের উপর লিখিত গীতিকথায় ৷

আজকের দিনের মতই তখনও মেয়েদেরকে কোনো না কোনো পুরুষ অভিভাবকের অধীনে বাস করতে হতো, যদিও এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে পশ্চিমা সমাজে, পুবের মেয়েদের এখনও অভিভাবক নামক পুরুষ ব্যক্তির আদেশ মেনে নিতে হয়। অভিভাবক প্রধানত পিতা, তার অবর্তমানে বাড়ির অন্য কোনো মুরুব্বির পুরুষ চাচা, বড় ভাই…। বিবাহিতাদের জন্যে স্বামী প্রবর। স্বামীর মৃত্যুজনিত অনুপস্থিতিতে, পরিবারের অন্য কোনো উপযুক্ত পুরুষকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে হতো। আরো লক্ষ্মণীয় যে, আজ যেমন আমাদের সমাজে যৌতুকের রেওয়াজ চালু আছে, এমনটি সেই প্রাচীন সময়েও ছিল; অভিভাবক বিয়ের সময় মেয়েকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বা যৌতুক দিতেন যা দিয়ে তিনি অনায়াসে জীবন কাটাতে পারবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অর্থ সর্বদাই স্বামী প্রবরটির হাতে থাকতো। তবে আইন ছিলো, স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে যৌতুকের অর্থ ফেরত দিতে হবে। এককালীন ফেরত না দিতে পারলে প্রাপ্য অর্থের আঠারো শতাংশ সুদ দিতে হতো। কিন্তু স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দেয় সে ক্ষেত্রে ওই অর্থ স্ত্রী ফিরে পাবেন কি না এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। সম্ভবত তখনকার সমাজে, যদিও এখনও কোথাও কোথাও একই নিয়ম বহাল রয়েছে, স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার পেত না । কিন্তু বিয়ের আগে মেয়েটির সতীত্ব যাচাই করার নিয়মও প্রচলিত ছিলো ।

বিয়ের আয়োজন সাধারণত অভিভাবকই করতেন। অভিভাবকের পছন্দের পুরুষ বিয়ে করার বিকল্প ছিল না। এখানে মেয়ের মতামতের কোনো মূল্য দেয়া হতো না, বা তার কোনো মত আছে কি না সেটিও যাচাই করা দরকার বলে মনে করা হতো না । এসব ক্ষেত্রে কনে বাসর ঘরে যাবার আগে বরের সাথে সাক্ষাতের তেমন সম্ভাবনা থাকতো না। তবে কিছু কিছু বিয়ে যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইবোনদের মাঝে সংগঠিত হলে, মেয়েটি হয়ত ছেলেটিকে বিয়ের আগে পারিবারিক ‘শব যাত্রায়’ দু’একবার দেখার সুযোগ পেলেও পেতে পারতেন।

সতীত্ব রক্ষার কথা চিন্তা করে সাধারণত মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেয়ার নিয়ম চালু ছিল; অনূর্ধ্ব-১৪ বছর বয়সে একজন মেয়েকে স্বামী নামক পুরুষের হাত ধরতে হতো। এখানো আলোচিত সময়ের প্রায় এক হাজার বছর পরেও ঐতিহাসিকভাবে এ ঘটনার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব। মোহাম্মদ ৫৬ বছর বয়সে ছয় বছরের আয়েশাকে বিয়ে করেন এবং আয়েশার বয়স যখন নয় বছর তখনই স্বামীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ডাক পড়ে।

“…(H)e married the little daughter of his close friend Abu Bakr, a rich merchant of Mecca who embraced Islam in the early days of the call. The girl, named Aisha, was only six years old when the marriage contract was made. Three years later,… the little girl of nine was delivered to his harem. The apostle of Allab, in his passion to possess her, was in such a hurry that he did not even wait for nightfall; he asked the bride’s mother to send her to his bedchamber in the morning hours after the

wedding ceremony (Hekmet, 430). “

ব্যাপারটি জোরালোভাবে সমর্থন করতে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মতামত পেশ করেন, তবে মোহাম্মদের অবর্তমানে খেলাফত বা উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পাবার বিষয়টি অনেকেই সমর্থন করেন, যদিও ইসলাম প্রবর্তনের সময় বিয়ে ব্যবস্থা, এর আচার অনুষ্ঠানের ধরন, ভিন্নতর ছিল। স্বামী গৃহে স্ত্রীর প্রশ্নাতীত অবস্থানকে ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিলেও, প্রাচীন গ্রীসে বৈবাহিক সম্পর্ককে সম্পূর্ণ বলে ধরা হতো স্ত্রীর একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। ‘সন্তান জন্ম, প্রধানত একটি ছেলে সন্তান জন্ম হওয়ার মাধ্যমে একটি বিবাহ প্রক্রিয়ার সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা হতো।’ বিয়ের সময় প্রচুর বীচিযুক্ত ফল খাইয়ে মেয়ের উর্বরতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো ছুতো, তবে পুরুষ যে সর্বদা উর্বর নয় এ চিকিৎসাশাস্ত্ৰীয় জ্ঞান তাদের ছিলো না, ফলত পুরুষের উর্বরতা বাড়ানোর কোনো ফলটলও বাজারে পাওয়া যেতো না !

বিয়েতে মেয়েদের সতীত্বে উপর প্রচণ্ড জোর দেয়া হতো; অসতী হলে বিয়ের সম্ভাবনাই নাকচ হয়ে যেত, যদিও ছেলেদের যৌন ক্রিয়াকলাপের কোনো হিসেব নিকেষ বা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। পুরুষেরা যখন ঘরের বাইরে থাকতেন, যেমন যুদ্ধক্ষেত্র বা বাণিজ্যে— যৌন ক্রিয়ার জন্যে বেশ্যাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে দেখা যেত। তাছাড়া বাড়িতে থাকলেও স্ত্রী ব্যতীত তাদের যৌন সঙ্গী হতো দাসীরা, যদিও বাড়িতে স্ত্রীদের উপেক্ষা করে স্বামীরা দাসীদের ব্যবহার করতেন কি না সে ব্যাপারে সমাজ বিজ্ঞানিদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তথাপি, ‘…একজন পূর্ণবয়স্কা দাসী তার মনিবের যৌন আবেদন বা মনিব যদি তাকে সাময়িকভাবে কারো মনোরঞ্জনের জন্যে মনোনীত করতেন- তা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার তার ছিল না ৷’

এথেন্সের মতো বড় শহরে কিছু নারী বেশ্যাবৃত্তি করেই জীবন ধারন করতেন। এ পেশায় নিয়োজিতদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো : প্যারোনাইয়া– যারা শুধুই অর্থের বিনিময়ে দেহ বিক্রি করতেন, হিটাইরায়া— যারা তাদের খরিদ্দারদের শুধু দেহ দানই নয়, নাচ দেখাতেন এবং সামান্য গানও শোনাতেন, প্যাটাকাইয়া– এরা ছিলেন ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গী, নাচ গানে পারদর্শী; কখন কখন এরা উক্ত ব্যক্তির সন্ত নিও ধারন করতেন, যেমন এ্যাসপাসিয়া, তিনি প্রিকেলসের সন্তান ধারন করেছিলেন। এ ছাড়াও এথেন্সের অধিবাসীরা মূল নাগরিক ও বহিরাগত বাসিন্দা, উভয় গ্রুপই বেশ্যালয় খুলে তা দাসীদের দ্বারা পূর্ণ করার অধিকার পেতেন- এক্ষেত্রে এইসব দাসীরা জন্মগতভাবে সাধারণত বেশ্যা বা তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতেন । এবং কোনো পুরুষ একজন নারীর সাথে যখন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতেন— অধিকাংশ সময়েই ওই নারী বেশ্যাদের ভেতর থেকে আসতো কারণ সে সময়ে একজন মেয়ে যিনি বৈধ নাগরিক তার সাথে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না, যদিও বিবাহ ক্রিয়ার মাধ্যমে এটা করা যেত। ফলত কেউ কেউ মনে করেন তখনকার সমাজ ছিল পুরুষের যৌন স্বৰ্গ।

পুরুষ থেকে নারীদের দূরে রাখার প্রচেষ্টাও ‘শাশ্বত এথেন্সে’ কম ছিলো না । এ ধরনের পৃথকীকরণ শুরু হতো বাল্যকালেই। অল্প বয়সেই একটি মেয়েকে সমবয়সী ছেলেদের থেকে দূরে রাখা হতো। অর্থাৎ মেয়েটি পার্শ্ববর্তী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে তার মায়ের সাথে বসবাস করতো। ‘আমার মেয়ে কখনোই ঘরের বাইরে যায়নি’ একথা বলতে পেরে বাবারা গর্বে বুক ফোলাতেন। তখনকার একজন ‘ভাল মহিলা’ কোনো অবস্থাতেই বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি পেত না । বাড়িতে অতিথি আসলে তাদের সামনে যাওয়া এবং আপ্যায়ন করার ভার ছিল বাড়ির পুরুষ ছেলে এবং দাসদাসীদের উপর। নারীরা অতিথিদের সামনে যাওয়া থেকেও বিরত থাকতেন। এমনকি কোন সুহৃদ পুরো পরিবারকে দাওয়াত করলে স্বামী এবং ছেলে সন্তানেরা সে দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতেন, স্ত্রী ও মেয়েদের এ ধরনের সামাজিকতায় অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হতো না। শুধু তাই নয়, স্ত্রী বাড়িতেও স্বামীর সাথে বসে খাবার অনুমতি পর্যন্ত পেতেন না, স্বামীর খাওয়া শেষে দাসদাসীদের সাথেই তাকে ভক্ষণ ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হতো ।

এথেন্সে গরিব পরিবারগুলোতে অবশ্য ছেলেমেয়ে পৃথকীকরণের নিয়ম তেমন চালু ছিল না। পেটের ধান্ধায় নারী পুরুষ উভয়কেই বাড়ির বাইরে যেতে হতো। এ ধরনের অনেক পরিবারের নারীরা শাকসবজি বিক্রির জন্যে হাটে বাজারে যেতেন এবং পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভূমি কর্ষণের মতো শক্ত কাজও করতেন। তাছাড়া দরিদ্র শ্রেণী থেকেই বেশ্যাদের আগমন ঘটতো; অবশ্যই অর্থোপার্জন বা পেট বাঁচানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য ।

প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত উজ্জ্বল ও আশাপ্রদ । নাটকধর্মী ট্রাজেডিগুলোতে যেসব নারী চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে তারা শক্তিশালী মহাকবিদের সৃষ্ট নায়িকাদের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না। নারী চরিত্রগুলো শুধু পারিবারিক ক্ষেত্রেই শক্তিশালী অবদান রাখেননি, সামাজিকভাবেও যে তারা মানসম্মান এবং ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তা স্পষ্ট দেখিয়েছেন তখনকার বেশ কয়েকজন মহাকবি । হোমার ও থিসিয়াসের কবিতাগুলো এর যথেষ্ট প্রমাণ বহন করে। অন্যদিকে ইরিপিডিসের নাটক ও “থিবান এপিক সাইকেল’ দিয়েছে ইডিপাসের মতো অদ্বিতীয় অথচ বেদনাঘন কাহিনী; এন্টিগনি তার চরিত্রে যে শক্তি ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসার এবং পুরুষ শাসিত অন্ধকার সমাজকে অবাক করে দেবার মতোই বটে, তার চরিত্র কোনো অবস্থাতেই পিঞ্জরে অবাধ্য কোনো রমণীর গা-বাঁচানো ভাবলেশহীন উপস্থাপন নয় ৷

হয়তো উল্লিখিত নারী চরিত্রের সাথে ‘শাশ্বত এথেন্সে’র প্রকৃত নারী চরিত্রের কোন মিল ছিল । হয়তো অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত সেই সমাজকে ঝাকি মেরে ওঠানোর জন্যে মুক্তচিন্তার লেখকদের কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে সেইসব নারী যাদের সামাজিক মর্যাদা আছে। কেউ কেউ মনে করেন এসব চরিত্র উঠে এসেছে লেখকদের পরিচত গণ্ডির ভেতর থেকে, অর্থাৎ যেসব নারী প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে বিদ্রোহ করেছেন বা করতে চেয়েছেন তারা ওইসব লেখকদের বন্ধুস্থানীয় বা পরিচিত। ফলত ধরে নেয়া যায় যে, নির্যাতিত নারীদের পাশাপাশি একদল ছিলেন যারা প্রচলিত সমাজ ভেঙ্গে দিতে বিদ্রোহ করেছেন। এন্টিগনির উক্তি, “যখন আমি কিছুই করতে পারব না, তখনই কেবল শান্ত হব’, আমাদের এমন এক চরিত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যিনি ‘করবো নয় মরবো’ শপথে নারী মুক্তির সংগ্রাম করেন। কিন্তু একই সাথে যখন ইসমিন বলেন, ‘… আমরা মহিলা, স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের সাথে যুদ্ধ করা আমাদের সাজে না…’ আমরা এও ভাবতে ভুলে যাই না যে নারীরা দ্বিধান্বিত, সন্ত্রস্ত, দুর্বল ও সামাজিক অবস্থানের কাছে বন্দি ।

‘লাইসিসস্ট্রাটা’ নাটকে নারীরা ছিলেন শান্তির পক্ষে, তারা চাননি যে পুরুষেরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হোন। পুরুষ যখন তাদের আবেদনে সাড়া দেননি তখন স্বামীদের বিরুদ্ধে স্ত্রীরা ‘যৌন হরতাল’ ডেকে বসেন। নাটকটি যদিও হাস্যরসে সমৃদ্ধ, তথাপি যখন লাইসিস্ট্রাটা বলেন, ‘এ শহরের ভবিষ্যৎ আমাদের উপর (এরিসটোফেন, ১৮১)’, তখনই ক্লাসিকাল এথেেেন্সর নারীদের দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের বলিষ্ঠ উদাহরণ পেয়ে যাই। এই নাটকে লাইসিসস্ট্রাটা আত্মপ্রত্যয়ী, অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সফল, কিন্তু তিনি স্বীকার করেন তার সমস্ত জ্ঞানের উৎস পিতা, স্বামী ও পরিবারের অন্যান্য পুরুষেরা, যা প্রকারান্তরে প্রমাণ করে যে সে যুগে পুরুষই ছিল সকল জ্ঞানের ধারক ও বাহক। তথাপি কিছু নারী যে সম্মানিত ও শিক্ষিত ছিলেন তাও মিথ্যা নয়, যেমন এ্যাসপাসিয়া। ‘তিনি ছিলেন সক্রেটিসের বন্ধু-স্থানীয় যিনি বাগ্মিতার শিক্ষা দিতেন।’ এথেন্সের বিখ্যাত রাজনীতিক ও স্ট্রাটোপাস- নির্বাচিত সাংসদ প্রিকেলসের সাথেও এ্যাসপাসিয়ার অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিলো। প্রিকেলস ও তার স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর এ্যাসপাসিয়া হিটাইরায়া হিসেবে তার সাথে বসবাস করতেন। এ সময় তাদের একটি ছেলে সন্তানও জন্ম নেয় । প্রিকলসের মৃত্যুর পর অন্য একজন প্রিয় রাজনীতিক লিসিকেলসের সাথে তার সম্পর্ক হয়। এ সময়ে এ্যাসপাসিয়ার গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয় যখন প্লেটোর মতো দার্শনিকও তাকে নিয়ে লেখেন ।

শাশ্বত এথেন্সের নারীদের সামাজিক অবস্থান যদিও বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তথাপি হাতে গোনা দু’একজন ছাড়া সব নারীই ছিলেন অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, নিষ্পেষণের শিকার। কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে আজকের সমাজে ধর্ষণ, খুন, একাধিক বিবাহ, শারীরিক নির্যাতন অর্থের অসম বণ্টন, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি যখন প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে তখন নারীদের অবস্থা কতটুকু উন্নত? আমরা হয়তো এ নিয়ে ভাবতে পারি। ভাবা দরকার ।

error: Content is protected !!