১৯৮৫ সালের ২৫ মে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি ‘অলৌকিক’ খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত পুরো খবরটাই আপনাদের আগ্রহ মেটাবার জন্য তুলে দিচ্ছে।

পি.টি. আই-এর দেওয়া এবং আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরটার ওপর ভিত্তি করে আমি সত্যপ্রকাশকে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় চিঠি দিই ২৭.৫.১৯৮৫ তে। তাতে লিখেছিলাম – “পত্রিকায় আপনার অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা আপনার শরীরে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারেন এবং সেই তৈরির বিদ্যুৎ দিয়ে মৃদু আলো জ্বালাতেও সক্ষম। আমি একজন যুক্তিবাদী এবং আপনার অলৌকিক ক্ষমতার দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী। আশা করি আমার এই সত্যানুসন্ধানে আপনি সহযোগিতা করবেন। আপনার সুবিধামতো একটা তারিখ দিলে আমি সেই তারিখে দিল্লী গিয়ে নিরপেক্ষ স্থানে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে পারি। অনুগ্রহ করে তারিখটা এমনভাবে ফেলবেন যাতে আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি একমাসের মতো হাতে সময় পাই।

আমাদের পশ্চিমবাংলার শহর, শহরতলা ও গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন পূজো উপলক্ষে বসা মেলাতে বিদ্যুৎ-কন্যার প্রদর্শনীয় হয়। একটি মেয়ের শরীরে বাল্ব ছুঁইয়ে আলো জ্বালানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপক বেশি পয়সা রোজগারের জন্য বিদ্যুৎ-কন্যাকে অলৌকিক ক্ষমতাধারী বলে প্রচার করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই এঁরা বিজ্ঞান এবং বিদ্যুৎ-এর ধর্মকে কৌশল হিসেবে কাজে লাগিয়ে আলো জ্বালান। এই ধরনের বিদ্যুৎ তৈরিকে জাদু হিসেবে কৈশোরে দেখিয়েছি। তাই আপনাদের দাবির খবরটা পড়ে খবরের সত্যতা সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে জানতে একান্তভাবে আগ্রহী। আমার সন্দেহ হচ্ছে, আপনার গৃহীত একটা সাধারণ বৈদ্যুতিক কৌশলকে বোঝার ভুলে প্রচার মাধ্যমগুলো এইভাবে প্রচার করেছে। এই বিষয়ে প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়াকে আপনি একটি চিঠি দিয়ে ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন একটি দেশের বহু লোকের মধ্যে গড়ে ওঠা আপনার সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণার অবসান হবে।

আপনি যদি সত্যিই এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন, তবে সেইক্ষেত্রে আপনার দাবিকে আরও জোরাল করার জন্য আমাকে পরীক্ষা রতে দেওয়ার সুযোগ দিন।“

চিঠির উত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি।

পত্রিকার ‘অলৌকিক’ খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের সমিতি বহু শত অনুষ্ঠানে শরীর থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে দেখিয়েছে। নাটকীয়তা সৃষ্টি করিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ তৈরি করেছি কোনও দর্শকের শরীর থেকে। আমরাও কিন্তু বাল্ব জ্বেলে থাকি সত্যপ্রকাশের মতোই গোপন ব্যাটারি সাহায্যে।

ভূ-সমাধি

১৮৭৩ সালে ভারতের একটি চিকিৎসা-বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পত্রিকায় ডাঃ কোঠারি, ডাঃ গুপ্ত প্রমুখ তিনজন ডাক্তারের একটি চিকিৎসা বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটিতে বলা হয়, একজন যোগীকে মাটির নিচে ছোট একটি আঁধারে ৮০ দিন রেখে দেওয়া হয়েছিল। যোগী সমাধিস্থ অবস্থায় ৮০ দিন শ্বাস না নিয়েও বেঁচে ছিলেন। সমাধিস্থ যোগীর হৃৎপিণ্ড কেমন কাজ করে দেখার জন্য ডাক্তাররা যোগীর হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে E.C.G যোগাযোগ ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় দিনেই দেখা যায় E.C.G কাজ করবে না অথচ হৃৎপিণ্ড কাজ করে যাবে। চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে অতীন্দ্রিয় বলা যায় কি?

এই একই পরীক্ষাকে বিজ্ঞানগ্রাহ্য করতে হলে যোগীকে আগা-গোড়া প্রতিটি তল কাঁচের তৈরি একটি ঘরে রাখতে হবে, যেখানে সকলে প্রতি মুহূর্তে যোগীকে দেখতে পাবে। কাঁচের ঘরে একটি মাত্র ছিদ্র থাকবে, যেটা দিয়ে ঘরকে বায়ুশূন্য করা হবে। এই অবস্থায় E.C.G গ্রহণের ব্যবস্থা রাখলে যোগীর কোনও কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।

কোনও অতীন্দ্রিয় পরীক্ষা গ্রহণের সময় প্রতিযোগিকে সম্ভাব্য সমস্ত কৌশল গ্রহণের সুযোগ থেকে দূরে রাখতে হবে। যেখানে সুযোগ গ্রহণের অবকাশ রয়েছে সেখানে পরীক্ষাটিকে কখনোই যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানগ্রাহ্য বলা যাবে না।

আমার কথায় আপনারা অনেকেই আপত্তি তুলতে পারেন। জানি, আপনাদের অনেকেই বলবেন- আপনি নিজের চোখে কোনও সন্ন্যাসী বা যোগীকে মাটির নিচে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে শীর্ষাসনে থাকতে দেখেছেন। অনেক এও দেখেছেন, বড় গর্ত খুঁড়ে গর্তের ভেতর পদ্মাসনে বসে থাকেন যোগী বা সন্ন্যাসী। তারপর তার সারা শরীরটাকেই মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় তাঁরা বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেন। হ্যাঁ, আপনারা যা দেখেছেন আমিও তা দেখেছি। ঘটনাটা দেখলে যেমন যোগের অলৌকিক ফল বলে মনে হয়, বাস্তব ক্ষেত্রে কিন্তু আদৌ তা নয়। ভূ-সমাধির আগে সন্ন্যাসী বা যোগী মহারাজ তাঁর মাথাটা একটা পাতলা কাপড়ে ঢেকে নেন, যাতে চোখে মুখে বা নাকে মাটি ঢুকে না যায়। ভূ-সমাধির গর্তটা বেশ কিছুটা বড় করা হয় এবং ওপর থেকে আলগা মাটি ঢেলে শরীর বা মাথাটার ভূ-সমাধি ঘটানো হয়। আলগা মাটির ফাঁক দিয়ে অনায়াসেই বায়ু চলাচল করে এবং নাক পাতলা কাপড়ের ছাঁকনি ভেদ করে এই বায়ুর সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে যায়। দীর্ঘ অধ্যবসায় ও অনুশীলনের ফলে শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজন কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই অনুশীলনকেই সাধু-সন্ন্যাসী যোগীরা যোগের অলৌকিক শক্তি বলে প্রচার লেগে পড়েন।

কলকাতার রাজভবনের কাছে একটি যোগীকে দেখেছিলাম যে ভূ-সমাধির গর্তে বায়ু আসার জন্য একটি নলের ব্যবস্থা রেখেছিল। নলটা মাটির তলা দিয়ে গিয়েছিল দূরে বসে থাকা তারই কয়েকজন সঙ্গীর ঝোলায়। ভূ-সমাধির মাটি ভালো করে পিটিয়ে বন্ধ করা ছিল বলেই আমি বায়ু-নলের উপস্থিতি অনুমান করতে পারি। যোগীবাবার সহকারী যেখানে বসেছিল সেখানটা পরীক্ষা করতেই কৌশল বেরিয়ে পড়ে। উপস্থিত দর্শকদের প্রচন্ড গালাগাল শুনতে শুনতে দু’জনেই দ্রুত তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে যায়।

জাদু জগতের বিস্ময় জাদুকর হ্যারি হুডিনিকে (harry Houndini) একবার কফিনে পুরে ৬ ফুট মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ৬০ মিনিট পরে কফিনটি ওপরে তোলা হয় এবং দেখা যায় হুডিনি জীবিত।

বিদেশী প্রচার মাধ্যমের সামনে ভূ-সমাধি করে দেখাচ্ছেন যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য

১৯২৮ সালে এক ফরাসি সাংবাদিককে কফিনে পুরে জলের তলায় নামিয়ে দেওয়া হয়। ৮৫ মিনিট পরে কফিনটি তুলে দেখা যায় সাংবাদিকটি সম্পূর্ণ সুস্থ।

এই দুটি ক্ষেত্রেই কোনও অতীন্দ্রিয় কোনও ক্ষমতার দাবি তোলা হয়নি।

১৯৮৬-র জানুয়ারিতে এই বইটির প্রথম খন্ডের প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংস্থার উদ্যোগে হাজারের ওপর ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে ভূ-সমাধি করে দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞানকর্মীরা মাটির নিচে থেকেছে ৩ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নেহাতই খেলার মেজাজে, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দাবিকে নস্যাৎ করে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x