অভিজিৎ রায় (১৯৭১-২০১৫)

অভিজিৎ রায় যুক্তিবাদী লেখক, ব্লগার এবং মুক্তমনা ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা। বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্যের সুসংবদ্ধ বিশ্লেষণের আলোয় লেখা ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’, ‘সমকামিতা:একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইগুলো তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখক হিসাবে। তার লেখা দুটি বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এবং ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ মুক্তমনা মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। সুসাহিত্যিক, অনুসন্ধিৎসু, সমাজ-সচেতন এবং সত্য সন্ধান ও প্রকাশে আপোষহীন অভিজিৎ রায়ের স্বপ্ন ছিলো বিজ্ঞান, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের আলোকে সমাজ প্রতিষ্ঠার। সেই অর্জনের পথের সমমনাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন মুক্তমনা ব্লগ যা আজও বাংলাভাষী বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও নির্ধার্মিকদের সবচেয়ে বড় অনলাইন সংগঠন।

অভিজিৎ রায়ের জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে। তখন বাবা অধ্যাপক অজয় রায় সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে তাঁর মা শেফালি রায় আশ্রয় নিয়েছেন ভারতের আসামে। স্বাধীনতার পরে বাবার কর্মসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শৈশব-কৈশোর কাটে অভিজিৎ রায়ের। তিনি যন্ত্রকৌশলে স্নাতক শিক্ষা সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমেরিকার আটলান্টা শহরে।

অনলাইনে অজস্র লেখালেখি ও প্রকাশিত দশটি বইয়ের মধ্যে দিয়ে অভিজিৎ অন্ধবিশ্বাস আঁকড়ে থাকা সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলে আঘাত করে করে অবিরাম তুলে ধরেছেন মানবতার কথা। সাহস যুগিয়েছেন বিজ্ঞান ও যুক্তি’তে আস্থা রাখতে। ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে যার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সমাজচ্যুত করে রাখা সমকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের ক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে সমকামী প্রবৃত্তি থাকা অপরাধ বা ক্ষতিকর নয়, বরং তা প্রাণীজগতের স্বাভাবিক চিত্র। এর মাত্র দুই বছর পর প্রকাশিত হয় ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (সহ-লেখক: রায়হান আবীর) বইটি যা বিজ্ঞানপ্রিয় ও মুক্তমনা মহলে ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। এই বইটিতে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে নাস্তিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সবচেয়ে যৌক্তিক ও মানবিক অবস্থানে। ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ (২০১৪) বই খানিতে তিনি ধর্মকে তুলনা করেছেন ভাইরাসের সাথে এই বলে যে, ‘ধর্ম’ ব্যপারটি মানুষকে অযৌক্তিক ঈশ্বর ও অমানবিক প্রথায় বিশ্বাস স্থাপন থেকে শুরু করে আত্মঘাতী পর্যন্ত করে তুলতে পারে।

মানব মননের ক্রমাগত উন্নতিতে বিশ্বাসী অভিজিৎ রায় উৎসাহী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, চিত্রকলায়, ও নারীর সামাজিক অবস্থান উন্নয়নের ভাবনাচিন্তায় সুসাহিত্যিক এবং মানবতাবাদী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রভাব নিয়ে লেখা ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’, অসামান্য এই বইটি প্রকাশ হয়েছিল ২০১৫ সালে। একই বছরে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা নিয়ে গণিতবিদ অধ্যাপক মীজান রহমানের সাথে লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটিও প্রকাশ পায়। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সমাজচিন্তা, ধর্ম ও আরো বহু বিষয়ে অভিজিৎ রায়’এর লেখা কৌতূহলী-অনুসন্ধিৎসু-জিজ্ঞাসু মানুষকে যোগান দিয়েছে বস্তুবাদী চিন্তার বিপুল রসদ, যা আঘাত করেছে আজকের পশ্চাৎগামী ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের সাম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ী এবং অসৎ রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের’কে।

যুক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ইসলামি জঙ্গিরা ২০১৫ সালের ২৬’শে ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে আক্রমণ করে অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদকে। বন্যা আহমেদ গুরুতর আহতাবস্থা থেকে বেঁচে উঠলেও সেই রাতেই অভিজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এমন নৃশংস পরিণতির বা সম্ভাবনার কথা অভিজিৎ জানতেন না তা নয়, তবু তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’। তাঁর সেই বিশ্বাসের অমোঘ প্রমাণ তাঁর রচনাসমূহ, যে সব আজও মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবুদ্ধির আন্দোলনে অভিজিৎ রায় আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন।

তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বইঃ

♦ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫, অঙ্কুর প্রকাশনী)

♦ মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭, অবসর প্রকাশন সংস্থা, সহলেখকঃ ফরিদ আহমেদ)

♦ স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্ৰবন্ধ সংকলন)

♦ সমকামিতাঃ বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০, শুদ্ধস্বর)

♦ অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: রায়হান আবীর) )

♦ বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)

♦ ভালবাসা কারে কয় (২০১২, শুদ্ধস্বর)

♦ শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪, শুদ্ধস্বর, সহলেখকঃ অধ্যাপক মীজান রহমান

♦ বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪, জাগৃতি প্রকাশনী

♦ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫, অবসর প্রকাশনা সংস্থা)

 

উৎসর্গ

সারা বিশ্বের অগণিত সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির মানুষদের মুক্তিসংগ্রামে যারা নির্ভয়ে আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের পুরোধা আমেরিকার গ্রিনউইচ গ্রামের স্টোনওয়াল ইন-এর সংগ্রামী মজদুরদের

এবং

বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসারে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মননের বিকাশে আত্মনিবেদিত সকল লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজকর্মীদের উদ্দেশ্যে।

 

“এখানে ছাড়তে হবে সকল অবিশ্বাস

এখানে ধ্বংস হবে সকল ভীরু হতাশ্বাস।”

দান্তের ডিভাইন কমেডিতে বর্ণিত নরকের প্রবেশদ্বারে উৎকীর্ণ পদাবলি, যা পরবর্তীকালে মনীষী কার্ল মার্কস বিজ্ঞানের প্রবেশদ্বারে খোদিত করে রাখতে চেয়েছিলেন আজীবন।

error: Content is protected !!