স্থানীয় রাজমিস্ত্রী আ. মজিদ মুন্সী কর্তৃক আমার লাইব্রেরীটির ভিত্তি স্থাপন করা হয় বিগত ১৯শে আষাঢ় ১৩৮৬ তারিখে। লাইব্রেরী নির্মাণের যথোপযুক্ত অর্থের সংস্থান আমার ছিল না। তাই ব্যয়হ্রাসের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব কাজেই অংশ নিতে হয়েছে আমাকে কুলি–মজুর, রাজমিস্ত্রী ও ছুতোরদের সঙ্গে। কুলিদের সাথে ইট বহন করেছি এবং মজুরদের সাথে ইট ভেঙ্গে খোয়া বানিয়েছি। উদ্দেশ্যে– এভাবে কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা কিছু অর্থ বাঁচাতে পারলে তা দ্বারা কিছু বই কেনা যাবে। আমি এসব হেয় কাজ করি বলে আমাকে অনেকে উপহাস করত। শুনে আমি তাদের জিজ্ঞেস করতাম, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন মলত্যাগ করেন তখন তার জলশৌচ করে কে? উত্তর দিত উপহাসকারীরা, রাষ্ট্রপতি নিজেই। আমি বলতাম, নিজের কাজ নিজে করেন বলে যদি জিয়াউর রহমানের বিষ্ঠা ধোয়ার ঘৃণা ও মানহানি না হয়, তাহলে আমার খোয়া ভাঙ্গায় অপমান কি? উপহাসকারীরা আমার এ প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায়নি। এভাবে আমি তাদের ঠকিয়েছি। কিন্তু কোন কোন সময় নিজেও ঠকেছি। অনভ্যাসবশত হাতুড়ীর আঘাতে বাম হাতের আঙ্গুলগুলো ছিঁড়ে–ফেটে রক্তাক্ত হতো প্রায়ই। একদা বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখটি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিলো হাতুরীর আঘাতে। সে নখটি আমার চুল, দাঁড়ি ও দাঁতের সঙ্গে কাঁচের বৈয়মে ভরে রেখে দিয়েছি আমার সমাধিগর্ভে।
লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে স্থানীয় বিত্তবানদের আমি কোন সহানুভূতি পাইনি। তবে মজুরদের সাহায্য পেয়েছি প্রচুর। তারা সকলেই লাইব্রেরীর কাজে কম মজুরী নিয়েছে, হয়তোবা কেহ মজুরী ছাড়াই কাজ করেছে। কিন্তু আমার বিত্তবান এক প্রতিবেশির কাছে বাঁশ খরিদ করতে গিয়ে তাঁর দাবীকৃত ৫০ টাকার স্থলে ৪৯ টাকা মূল্য বলায় তিনি আমাকে বাঁশ দেননি। রাজমিস্ত্রী আ. মজিদ মুন্সী ও ছুতোর মিস্ত্রী রাধাচরণের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। যেহেতু তাঁরা তাঁদের কাজের মজুরীর অর্ধেক নিয়ে আমার লাইব্রেরীর নির্মাণ কাজ সমাধা করেছেন। কাজেই এ গ্রামের মজুরদের কাছে ঋণী, হুজুরদের কাছে নয়।
কায়ক্লেশে আমার লাইব্রেরীর নির্মাণ কাজ সমাধা হয় ৩১শে ভাদ্র ১৩৮৬ তারিখে। অতঃপর ৬–৬–৮৬ তারিখে আরম্ভ করে আমার সমাধিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় ১১–৬–৮৬ তারিখে। কিন্তু পুরোপুরি নয়। সমাধির নিম্নভাগটা পাকা করতে সম্মত হলেন না রাজমিস্ত্রীরা কিছুতেই। কেননা, গ্রামের মুসল্লিরা নাকি ‘শরিয়ত–বিরোধী‘ বলে ও কাজটি করতে তাঁদের বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন। আমার রাজমিস্ত্রীর বাবা ছিলেন একজন নামকরা মুন্সী এবং তিনি নিজেও মুন্সী মানুষ। তিনি হয়তো ভাবলেন যে, চারপাশের সাথে নিম্নদিকটাও পাকা করা হলে কবরে মনকির ও নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর এভাবে ফেরেস্তাদ্বয়ের যাতায়াতের অসুবিধা ঘটালে নিশ্চয়ই তাঁর গুনাহগার হতে হবে। তাই আমার সমাধির নিম্নভাগটা সিমেন্ট করাতে মুন্সী সাহেবকে রাজী করান গেলো না। অগত্যা সে কাজটি আমার করতে হল নিজেকেই।
আমার সমাধির বিশেষ কোন বৈশিষ্ট নেই। মাত্র সমতল স্লাবের উপর আর একখানা চৌচালা স্লাব এবং তদুপরি স্লাবটি নাড়াচাড়া ও নামফলক স্থাপন করার জন্য একটি বাঁকানো রড বসানো হয়েছে – মনকির–নকির ফেরেস্তাদ্বয়ের কান্ডকারখানা দেখার ও তাঁদের কথাবার্তা শোনার জন্য। তখন আমি যেখানেই যেতাম, লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করতো ঐ কথাই। আমি তো হতবাক। কৌতূহলী জনগণকে আমি বোঝাতে পারতাম না যে, ওগুলো মিথ্যে গুজব। সে মিথ্যে গুজবের উপর ভিত্তি করে অসংখ্য লোকের সমাগম হতে লাগলো আমার সাদামাটা সমাধিটি স্বচক্ষে দেখার জন্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য-প্রমাণের বদৌলতে দর্শকদের সমাগম বর্তমানে কমেছে। তবে দূরাঞ্চলের কিছু কিছু লোক এখনো এসে থাকে আমার সমাধিটি দর্শনে।
অধ্যায়ঃ সত্যের সন্ধান
♦ দ্বিতীয় প্রস্তাবঃ ঈশ্বর বিষয়ক
♦ পঞ্চম প্রস্তাবঃ প্রকৃতি বিষয়ক
অধ্যায়ঃ অনুমান
অধ্যায়ঃ স্মরণিকা
♦ লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ
♦ লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ৭৯ সালের বৃত্তি দান
♦ মানব কল্যাণের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
♦ ১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠান
♦ পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানের ভাষণ
♦ অবহেলিত একটি প্রতিভার স্বীকৃতি বাকেরগঞ্জ জিলা পরিষদ কর্তৃক বিশেষ পুরস্কার দান
♦ বার্ষিক অধিবেশন ও ৮১ সালের বৃত্তিপ্রদান
♦ আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীর দানপত্র সংক্রান্ত দলিলসমূহের অনুলিপি
♦ কেন আমার মৃতদেহ মেডিক্যালে দান করছি
অধ্যায়ঃ আমার জীবনদর্শন
♦ জগত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা
♦ জীবন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ